অন্যধারার ঔপন্যাসিক : শাহযাদ ফিরদাউস

অদ্রিশ বিশ্বাস

বাংলা ভাষার এমন একজন লেখক যিনি শুধুমাত্র উপন্যাসই লিখেছেন, তার বাইরে একটাও গল্প কবিতা প্রবন্ধ লেখেননি। এই দৃষ্টান্ত আর নেই। বলেন, বড় ক্যানভাস ছাড়া কাজ করতে পারেন না, তাই সব উপন্যাস। এবং এটা সংখ্যায় অনেক। কোনো রিপিটেশন নেই। প্রত্যেকটার কাহিনি আলাদা।

তবে দর্শন ছাড়া ফিরদাউস লিখতে পারেন না। তাঁর কাহিনিতে অন্তর্গত স্রোতের মত মানব সভ্যতার এক ভয়াবহ নমুনা যা মানুষেরই তৈরি করা, হত্যা গণহত্যা নিধন ত্রাস তাঁর অবলোকনের দর্শন হয়। এদেশেই বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়। আর সম্পূর্ণ ভাবে একজন ভারতীয় লেখক হয়ে যান সংখ্যালঘু । শাহযাদ ফিরদাউস তখন ভয়ে বাড়ি বন্দী। যদিও তাঁর অধিকাংশ বন্ধুরা হিন্দু ও বিখ্যাত মানুষ। যেমন, চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষ, যাঁকে তিনি " মনের মানুষ " সিনেমায় কাহিনি ও গান রচনা করে সাহায্য করেছেন। লালনের গুরুর কোনো গান সংরক্ষণ হয়নি, "জলের ওপর পানি, না পানির ওপর জল / বল তোরা বল " এটা শাহযাদ ফিরদাউসের লেখা এবং জনপ্রিয় হয়। 

এমন সব বন্ধুরা ওঁকে ভালবাসেন আর ওঁর মতো একজন দুর্দান্ত লেখককে আমি আমার কালে পড়েছি, দেখেছি ও সংকলন বের করেছি বলে গর্ব হয়। কারণ, ভবিষ্যতে তিনি হবেন অপরিহার্য একজন সামাজিক দলিল ও দর্শনের লেখক। যদিও তাঁর কথা খুব বেশি লোক জানেন না, তাই এই পরিচয় রচনা। 

আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদে। নিজের পৈতৃক অংশ বেঁচে দিয়ে যে টাকা পেলেন তাই নিয়ে চলে গেলেন লন্ডন। উদ্দেশ্য দেশ দেখা আর সিনেমা বানানো। লন্ডনে বসে স্বপ্নের সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করলেন। বিষয় মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেবের জীবন। ব্যাসকে নিয়ে এর আগে কেউ কাজ করেননি। সিনেমাটা হবে হিন্দিতে, বিশাল স্প্যান, বড় বাজেট। 

ব্যাসের চিত্রনাট্য শেষ করলেন লন্ডনেই। ব্যাস হবেন দিলীপকুমার, যাঁর সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হবে এটা।তাই প্লেন ধরে ফিরে এলেন। কলকাতা নয় মুম্বাইতে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিলীপকুমারের বাড়িতে গিয়ে প্ল্যান বলা হল সাংঘাতিক উত্তেজিত দিলীপকুমার এক কথায় রাজি। সঙ্গে বললেন, তিনিই প্রযোজনা করবেন ব্যাস। এখন কাজ চিত্রনাট্য শোনা। ফিরদাউসকে বললেন, আমার বাড়িতেই থেকে যান, আমার গাড়ি ব্যবহার করুন আর রোজ সকালে উঠে একটু একটু করে চিত্রনাট্য শোনান আমাকে। ফিরদাউস সেটাই শুরু করলেন। 

রোজ চিত্রনাট্য শোনেন দিলীপকুমার আর চিত্রনাট্যের গুণ গায়। ব্যাস তাঁর স্বপ্নের চরিত্র হয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন দিলীপকুমার, যাঁর আসল নাম ইউসুফ খান, তাঁর বিবি সায়রাবানু বলে ওঠেন, আচ্ছা, এমন একটা হিন্দু মহাকাব্যের হিন্দু রচয়িতা ব্যাসদেবের চরিত্র করবেন মুসলমান অভিনেতা, পরিচালক তার মুসলমান, প্রযোজক মুসলমান, দাঙ্গা হবে না তো! ইউসুফ খানের উজ্জ্বল মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে যায়। তিনি ফিরদাউসকে বলেন, তিনি প্রজেক্টায় থাকতে পারবেন না। তারপর পাংশুবর্ণ হয়ে যায় ফিরদাউসের মুখ। স্বপ্নের সিনেমা খতম। 

তখন সেটাই ফিরদাউস জীবনে যেটা হবেন কখনোই ভাবেননি, ঔপন্যাসিক বা লেখক, সেই পথ বেছে নেন। "ব্যাস " হয়ে ওঠে প্রথম উপন্যাস ( ১৯৯৫ )।এটা পড়ে আমি চমকে যাই। আলাপ করতে খুঁজি এবং পেয়েও যাই। ফিরদাউসদা পূর্ণ সময়ের লেখক, তাই একটা টানাটানির সংসার। কিন্তু লেখাতে কোনো ভেজাল নেই, সব অসামান্য লেখা। যেমন, " শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার ", এখানে শেক্সপিয়ারের নাটকের সব ভিলেনরা অতীত কিনে নেয় মানুষের। মানুষ হয়ে যায় অতীতহীন। এভাবেই অতীতহীন মানুষরা বিপন্নতার মধ্যে দাঁড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বকেই কিনে নেয় প্রথম বিশ্ব। এই ধরনের চমকপ্রদ সব কাহানি কিন্তু গড়ে তোলেন সহজ পদ্ধতিতে নয়, বেশ জটিলভাবে। ফলে শাহযাদ ফিরদাউস পড়া কঠিন । তৈরি পাঠক ছাড়া অনেক সময় তার উপন্যাসের জট ছাড়ানো কঠিন। 

আলতামাস, প্লেগ, মহাভার, পালট মুদ্রা এইসব তাঁর উপন্যাসের নাম। জীবনে একবারই আনন্দবাজার হাউসের পুজো সংখ্যায় উপন্যাস লিখতে সুযোগ পায়। লেখেন। বই করেন আনন্দ পাবলিশার্স। কিন্তু তাঁর পাঠক এত ছোট যে সেটাতে জনপ্রিয় হন না ফিরদাউস। তবে একটা কথা, যিনি ওঁর লেখা একবার ভালবেসে ফেলবেন তাঁর অবস্থা আমার মত, পড়তেই হবে শাহযাদ ফিরদাউসকে। যেমন, রাধার ছিল কৃষ্ণের বাঁশি। সেই টান অপ্রতিরোধ্য। 

তিনি একটা বিষ্ময় আমার কাছে। কারণ, একটা হতে পারে, দুটোৈ হতে পারে, এমন অসংখ্য উপন্যাস তিনি লিখেছেন যার মান বাংলাভাষী হিসাবে আপনার মাথা উঁচু করে দেবে। যিনি শাহযাদ ফিরদাউস পড়েননি তিনি মিস করেছেন। ফিরদাউসের ভক্তের তালিকা ঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য, শামসুর রহমান, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, গৌতম ঘোষ ইত্যাদি অসংখ্য। এঁরা অনেকেই বহুবার চেষ্টা করেছেন ওঁর উপন্যাসকে সিনেমা কিংবা নাটক বানাবার। ছোটরা পেরেছে, বড়রা পারেনি। ওঁর একটা উপন্যাসের নাম " সময়সীমা দশ সেকেন্ড " মানুষের স্বপ্ন দেখার সময়সীমা মাত্র দশ সেকেন্ড। এই উপন্যাসটা এত জটিল যে আমি এর রহস্য উদ্ধারে ওঁর কাছেই যাই। তিনি বলেন, সেখানটায় তুমি আটকেছো, সেখানটা লিখতে গিয়ে আমি নিজেও আটকেছি। এক বন্ধুর বাড়িতে সাতদিন তাদের ছাদে পায়চারি করে গেছি। তারপর সূত্র মিলেছে। 

বন্ধুর বাড়ির ছাদ কেন? কারণ, শাহযাদ ফিরদাউসের কোনো নিজের ছাদ নেই। একটা ছোট্ট এক কামরার ভাড়া বাড়িতে কোনোক্রমে তাঁর দিন কাটে। অথচ ভবিষ্যতে তিনি আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন আলবেয়ার কামু আর আলেকজান্ডার সলজেনেৎসিনের সমতুল্য রচনা, যাঁকে অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. শাহযাদ আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক তো বটেই, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠদ্দের অন্যতম। শাহযাদ যদি শুধু ব্যস লিখেই থেমে যেতেন তাতেও এই কথাটি অন্যরকম হতো না।

    উত্তরমুছুন