ইমতিয়ার শামীম'এর গল্প : শীতের দূরত্বে শ্রাবণরাজা

সার্কাসের দল চলে গেলে সে বাড়ি ফেরার জন্য মুখ ঘোরাল। দেখল তখনও অল্প অল্প ধূলি উড়ছে স্কুলের মাঠে। বাঁশের খুঁটিগুলো কেমিকেলহীন নেংটা দেখাচ্ছে। টিনের বেড়া, চটের কাপড় আর ছাউনি দেয়ার সামিয়ানা এতদিন আড়াল করে রেখেছিল সেগুলোকে। কিন্তু সকালেই সবকুছু খুলে ফেকা হয়েছে। খানিক বাদে বাঁশগুলো তুলে ফেকবে পাড়ার ছেলেপেলেরা। কথা ছিল সামনের হাটে সেগুলো বেচা হবে। কিন্তু টেংরাহাটের মোজাম খুব সেয়ানা। বাজারে যাওয়ার পথে একবার চেয়ে দেখেই দরদাম শুরু করেছে ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর মতো। এ তো আর পুরনো বাঁশ নয়। মাসদেড়েক আগে কাটা হয়েছে স্কুলের পাশের বাঁশবাগান থেকে। আইন অনুযায়ী তাই বাঁশের মালিক স্কুল কমিটি। কিন্তু সামান্য বাঁশ নিয়ে হেডমাস্টার টানাহেঁচড়া করতে আসেনি।

এমনিতেই এই চওটে খুব বদনাম হল তার। লোকজন বলাবলি করছে খন্দকারের কাছ থেকে টাকা খেয়ে সে স্কুলের মাঠে যাত্রা করতে দিয়েছে বছর শেষের পরীক্ষার মধ্যে। কথা ছিল যাত্রার দল আসবে সার্কাস পার্টি চলে যাওয়ার পর। কিন্তু ওসব কানকথার চোটে যাত্রার আর আসা হল না। পাড়ার ছেলেপেলেরা সার্কাস পার্টির লোকজনের সঙ্গে মিলে স্টেজ খোলা শুরু করলে হেডমাস্টার খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। তারপর সেই যে স্কুলের পাশে তার বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢুকেছে আর বেরোয়নি। সবকিছুই ফলো করেছে রূপম। সার্কাসের সেই মেয়েটিকে রাতের চেয়ে আরও অনেক ভালো দেখাচ্ছিল তখন। কেমন পলকা শরীর, যেন বরফভাঙা স্তব্ধ হাড় ফুটে উঠবে ত্বক ফুঁড়ে সামান্য ঝাঁকুনি দিলে। আর মুখে জমা হয়েছে রাজ্যের ঘুম। তবু আত্রাংক, বোঝা, গাড়িপাতিলের শিকে এসব তুলছে একে-একে। গোছাচ্ছে এটাসেটা। অথচ নিজের পোটলাটা ঠিকই সামলে রেখেছে নিজের কাছে। ছাড়বে না কিছুতেই। একটা সবুজ আর অবশিষ্ট নেই মানুষের পায়ে পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া ঘাসের গায়ে আর মাটির মাথায়। কিন্তু বরফভাঙা স্তব্ধ হাড়-ত্বকের নিচে লুকিয়ে রাখা ঘুমকুমারী সেই শূন্য মাঠের ওপর দিয়ে হেটে গেলে সবকিছু সবুজ হয়ে ওঠে তার সামনে। অবারিত সবুজের মধ্য দিয়ে ঘুমকুমারী ধীরে ধীরে মিলাতে থাকে দূরের পথে। তখন ট্যাংরাহাটার মোজাম দামাদামি শুরু করেছে। পাড়ার ছেলেরা অলস ভঙ্গিতে কথা বলছে তার সঙ্গে। দাম একটু কম পেলেও নগদ দিলে বাঁশগুলোর ওপর থেকে মালিকানা তুলে নিতে আপত্তি নেই তাদের। বরং ভালোই হয়, হাটে নিয়ে বাঁশ বেচার দায় থেকে রেহাই পেতে পারে তারা। তা ছাড়া পিকনিকটাও সেরে ফেলা যাবে আজকে রাতেই। সে প্রচণ্ড শূন্যতা নিয়ে মুখ ফেরায়। ঘুমকুমারীকে যদি দেখা যায়!

তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়।

ঘুমভাঙা তার চোখের সামনে মোস্তফা মিটমিটিয়ে হাসে, তোর ওই রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো খারাপ না রে। বিশেষ করে ওইটা--

বোধহয় মনে নেই তার। তাই চিন্তা করে নেয়। তারপর আগের কথার জের টেনে বেশ আস্থার দঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে সার্টিফিকেট দিতে থাকে, ওই যে ওইটা-- ফুলের বনে যার কাছে যাই তারেই লাগে ভালো। মাইরি বলছি ভাই, এক্কেরে পিওর কথা কইছে লোকটা, ফুলের বনে যার কাছে যাই তারেই লাগে ভালো!

সে বারকয়েক গানের কলিটা আপনমনেই বলে। বলে আর মাথা ঝুঁকিয়ে হাসে। হাসে আর বলে, এই কথাটা আমি তোদের এতদিনেও বোঝাতে পারলাম না। অথচ গুরু ঠিকই বুঝেছে। গুরু! গুরু! নমস্তে গুরু! এতিদিন তোমাকে কেন যে শুনিনি আমি! এখন বুঝতে পারছি কেন পাঞ্জাবিপরা বুড়োভামগুলো তোমাকে গুরু গুরু বলে পূজা করে। আর ভুল হবে না গুরু, এখন থেকে কেবল তোমার গানই শুনব আমি। বলতে বলতে মোস্তফা তার করজোড় করা হাত কপাল বরাবর তুলে সেই যে চোখ বোজে, সহজে আর সেই চোখ খোলে না, হাত নামে না। রূপম হাসতে হাসতে সিগারেটের খোঁজে শিথানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। গানটা যে মোস্তফার ভালো লেগেছে তার কোনও সন্দেহ নেই। মেয়েটলানি ছেলে বলে খ্যাতি আছে ওর। মোস্তফার মতো ছেলেদের পৃথিবীর সব মেয়েকেই ভালো লাগে। এরকম ছেলে যদি না থাকত তাহলে পৃথিবীর অনেক মেয়ের কাছেই বেঁচে থাকাটা ক্লান্তিকর হয়ে উঠত। মোস্তফা তাকে আরও কিছু ভাবার সুযোগ দেয় না, আবারও বলে ওঠে, ওই গানটাও ভালো,-- আমার পানে দেখল কী বা চেয়ে, আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে... দেখ না বাঁ, কী শয়তান গুরু! কেবল ও জানে আর জানে সেই মেয়ে।

মোস্তফা সেই মেয়েটির একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, এমন ভঙ্গিতে ইতিউতি করে। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে মোস্তফার এসব আদিখ্যেতা নিয়ে গবেষণা করতে কোনও ইচ্ছে জাগে না তার। যা ইচ্ছে শুনুক, যা ইচ্ছে ভাবুক। কিছুই আসে যায় না। সে বরং ঘুমের মধ্যে হারিয়ে ফেলা স্বপ্নকে ফের চিন্তা করতে থাকে। আজকাল সে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে। বাস্তবতা আর বিভ্রম এক হয়ে যায় স্বপ্নের মধ্যে। সার্কাসের দল তো সত্যিই এসেছিল তাদের বালকবেলায়। এতদিন এই স্মৃতি কোথায় ছিল? কিংবা কয়েকদিন আগে স্বপ্ন দেখেছে, তাদের বাড়ির রান্নাঘরের পাশে বড় কাঁঠালগাছে ঝোলানো একটি দোলনার পাশে সে আর তার মা দাঁড়িয়ে আছে, তার যখন জন্ম হয় মায়ের বয়স তখন মাত্র উনিশ। মা তার সেই বয়স নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে দোলনায় শোয়ানো বাচ্চাটাকে দোল দিচ্ছে। দোল দিতে দিতে বলছে, দেখ, ছোটবেলায় তুই কেমন ছিলি। বলে মা সারা চোখেমুখে ঝাঁকঝাঁক লজ্জা নিয়ে মুখ নামিয়ে হাসছে নিস্তব্ধে। আর তার মনে হচ্ছে, মা নয়, নম্রতার কথা। এরও আগে সে স্বপ্ন দেখেছিল কাঁচা সড়ক দিয়ে এক বৃষ্টির দিনে বাবার কবর দেখতে বেরিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। নামছে অন্ধকার। বোধহয় কৃষ্ণপক্ষ পুরো হতে চলেছে। তাই গাঢ় অন্ধকার বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে মিলেমিশে চারপাশ আরও অন্ধকার করে ফেলেছে। বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও সে টাল সামলে এগিয়ে যাচ্ছে কাদার মধ্যে শক্ত করে পা ফেলে ফেলে। কিন্তু কবরখানার একটু আগেই বাঁশবাগানের মধ্যে গেলে এত বেশি অন্ধকার সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে ফেলল যে আর কিছুতেই এগুতে পারছিল না সে। বার বার চোখে, মুখে, হাতের ডানায়, পিঠের ওপর, উরু ঘেঁষে বাঁশের কঞ্চির খোঁচা লাগছিল। তখনই হঠাৎ দেখা গেল, বাবা একটা মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে আসছে। কিন্তু বাবাকে সে চিনতে পারেনি। বাবার মুখে তখন একটুও দাড়ি ছিল না। মাথার বাবরিচুলের পুরোটাই ভেজা ভেজা, উল্টোদিকে টেনে সিঁথি করা। তা ছাড়া তার নিজেকে মনে হচ্ছিল বাবার একেবারে সমবয়সী, যেন দু’জনে মিলে এখনই বের হবে গ্রীষ্মের শুকনো হাওরের মধ্যে নাচানাচি করতে থাকা যুদ্ধরত ষাঁড়দের দেখতে। সমবয়সী মনে হচ্ছিল, যে জন্যে নিজেকে চেনার অন্য কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না রূপম। টের পাচ্ছিল রূপম, অনেকটা সেই পুরনো দিনের মুক্তি সিনেমার নায়ক প্রথমেশ বড়ুয়ার মতো করে নিজেকে সাজানোর চেষ্টা করেছে বাবা। কাপড়-চোপড় সেই ত্রিশের দশকের মানুষজনের, পাঞ্জাবি পরে কাঁধে একটা চাদর ভাঁজ করে রেখেছে। এগিয়ে এসে বাবা তার হাতে ধরা মোমবাতিটা তুলে দিলে রূপমের মনে পড়ল, এ তো বাবা। এই ছবি সে কতবার কতদিন দেখেছে তাদের পারিবারিক অ্যালবামটায়! তখনই বাবা বলে উঠল, মোমবাতিটা নিয়ে যা, নইলে তো তোর বাবার কবর এই অন্ধকারে খুঁজে পাবি না!

আবার আরেক দিন দেখল, একটা সাঁকোর মাথায় সে আর নম্রতা দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে তাকাতেই মনে পড়ল, ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার পথে এরকম একটা খাল পড়ত। শীতের পরে খালটা একেবারে শুকিয়ে যেত। সড়কের ঢালু বেয়ে নামতে নামতে তখন আর তাদের মনে হত না এটা আসলে একটা খাল। বর্ষা এলে থই থই করবে সড়কের দুই পাশ আর এই শুকনো খালটাই তাদের মধ্যে জলের সেতু গড়ে তুলবে তখন। তখন এখানে বাঁশ দিয়ে সাঁকো বানানো হত। বর্ষার পানি বাড়তে বাড়তে একসময় সড়কও ডুবে যেত। তখন সাঁকোটাও তলিয়ে যেত পানির ভেতর। নৌকাগুলো অনায়াসে চলে যেত সাঁকোর ওপর দিয়ে, একটু বুঝতে পারত না সেটার অস্তিত্ব। পানির তোড় কম থাকলে সাঁকো জেগে থাকত। নৌকা চালাতে চালাতে নৌকার মাঝি আর যাত্রীরা মাথাটা সামান্য নিচু করত। নৌকা অনায়াসে চলে যেত সাঁকোর নিচের ফাঁকা জায়গা দিয়ে। কিন্তু পরেরদিনই হয়তো দেখা যেত পানি এত বেশি বেড়ে গেছে যে, নৌকা সাঁকোর পাদানীর ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে লগির ঠেলা খেয়ে। তবে তখনও মাথা নিচু করতে হত সাঁকোর ওপরদিকে হাত দিয়ে ধরার জন্যে বাঁধা বাঁশ থেকে মাথা বাঁচাতে। পানি কমতে শুরু করলে সড়কের মাটি জাগত, দেখা যেত পানির ভেতর থেকে থেকে ঘাসগুলো ভয়ানক ফরসা আর তেলতেলে হয়েছে। হাতের আঙুল পিছলে যেতে চায়। সাঁকোর হাড়মজ্জা দেখা যেত তারপর।

স্বপ্নে সে দেখল, ওইরকম এক বর্ষা যাই-যাই সময়ে সে আর নম্রতা দাঁড়িয়ে আছে সাঁকোর মুখে। সড়ক থেকে সাঁকোয় ওঠার পথে অনেক কচুরিপানা আটকে গেছে, কচুরির বালাগুলো ধীরে ধীরে রস শুষতে মাটির মধ্যে শুঁড় দাবাচ্ছে। সে সেই কচুরিপানার মধ্যে থেকে একটা বিরাট কচুরিফুল তুলে নম্রতার হাতে দিতে গেলে সেটা নিতে নিতে দু’জনেই দেখল, সাঁকোর ওইপার থেকে আরেকটা নম্রতা হেঁটে আসছে। ঠিক একই চেহারা, একটুও আলাদা করা যায় না তার পাশে থাকা নম্রতার চেহারা থেকে। ওরা কি যমজ, নাকি নম্রতাই ওপারে গিয়ে আবার ফিরে তাকায়? তখন তার পাশে দাঁড়ানো নম্রতা হাসতে হাসতে ফুলটা নিয়ে খোঁপায় গুঁজতে গুঁজতে বলল, ওকে পানির ভেতর ফেলে দেই, না কি বলো? বলে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে শাড়ির কুঁচি সামলে জোরে জোরে সাঁকোটায় নাড়া দিতে শুরু করল। আর সাঁকোর ওপর দাঁড়ানো নম্রতার মুখটা ভয়ে কেমন শুকিয়ে উঠতে শুরু করল। টাল সামলাতে না পেরে সে টলতে টলতে পানির মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়বে-পড়বে সময়ে রূপমের ঘুম ভেঙে গেল।

এমন সব ওলটপালট অদ্ভুত অথচ সুন্দর স্বপ্নগুলো নিয়ে সে একদম মাথা ঘামাতে পারছে না মোস্তফা বাসায় থাকায়। হয়তো মাথার মধ্যে স্বপ্নগুলো কেবল খেলা করতে শুরু করেছে, সে প্রস্তুতি নিচ্ছে নম্রতার সঙ্গে আরেক নম্রতাকে খুঁটিয়ে দেখার, স্বপ্নের নম্রতার পাশে যাবতীয় স্বপ্নহীনতা রেখে বাস্তবের নম্রতাকে খুঁজে বের করার, ঠিক তখনই হয়তো মোস্তফা ঘরে ঢুকে বলে উঠল, সামনের বাসায় চারতলায় থাকা ওই মেয়েটা কী করে জানিস নাকি?

তারপর রূপম হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারেনি ভেবে সূত্র ধরিয়ে দিতে সামান্য থেমে আগের কথার রেশ টেনে নিজেই ফের বলতে থাকে, ওই যে কালো রঙের ফুটিফুটি কামিজ পরে, ওই মেয়েটা--। আরে, কাল ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে মোমবাতি ধরিয়ে একটা মেয়ে বারান্দায় টবে পানি দিল না? ওই মেয়েটা—

সারাদিন মোস্তফা বাসায় থাকে। জানালার গ্রিল গলিয়ে চোখ মেলে এসব দেখে। অনেক দূরের কোন ছাদ, বারান্দা কিংবা ঘরের মধ্যে থেকে বোঝা যায় না সেই চোখ উদাসীন নাকি শিকারী। অথচ মোস্তফা নির্বিবাদে টবের পাশে পানির পাইপ হাতে দাঁড়ানো মেয়ের আদল দেখেই অনায়াসে বলে দেয়, মেয়েটি বাসার বুয়া নাকি স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া, বেড়াতে এসেছে না কি বিয়ে হয়ে গেছে। আশেপাশের সব বাসার মেয়েদের এইসব আইডেনটিটি আর ক্লাসিফিকেশন শেষে সে এখন ব্যস্ত তাদের পরিচিতি সন্ধানপর্ব নিয়ে। এ বাসায় তিন বছর থেকে যা তার জানা হল না মোস্তফা তা জেনে নিয়েছে তিনদিনের ভেতর। খুব বিরক্ত লাগে তার মোস্তফার এই কৌতূহলে। এমনিতেই ব্যাচেলরদের বাড়িওয়ালারা বাসা ভাড়া দিতে চায় না, মোস্তফার এইসব অনুসন্ধানের কথা জানলে তাদের মাথাও আরও বিগড়ে যাবে। মোস্তফা অবশ্য এসবের পরোয়া করে না, এ ধরনের কোনও প্রসঙ্গ উঠলেই সে বলে, অ-অ, তাড়ায়ে দেয়া এত সহজ। কেন, মাসে মাসে তুই ভাড়া দিস না কড়কড়াইনা সাত হাজার নোট? ঘরসংসার নাই, কেউ বিরক্ত করে না পানি নিয়া। ইলেকট্রিসির ডিস্টার্ব হয়, নিজেই মেকানিক ডাইকা আনিস, ট্যাপ নষ্ট, নিজেই কিইনা আনিস। রাউক ফ্যামিলি। জান বারায়ে যাবি ঘরনীমায়্যার বকবকানিতে। তুমি না বোঝ, বাড়িওয়ালা ঠিকই বোঝে তুমি রওনের উপকারিতা। সাত হাজার টেয়া? হুঁ হুঁ--, ফ্যামিলির কাছ থনে এর ভাড়া পাঁচ হাজারও না পাইত। তুমি যদি বাসায় সপ্তাহে দু’একদিন মেয়ে নি আও, টেইর পায়েও বাড়িওয়ালা কিছু না কয়।

কথার তোড়ে লুকিয়ে থাকা ইঙ্গিতে মোস্তফা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তিনদিন হয়ে গেছে, নারী চাহিদা দেখা দিয়েছে তার।

সে এসব ভাবে আর সিগারেট টানতে থাকে অফিস করার ধকল পুষিয়ে নিতে। এতক্ষণ রাগ হয়নি, এখন এই অবসরে মনে হয় সারা গা ঘিন ঘিন করছে। স্লেভারি, ঠিকই বলে মোস্তফা। প্রথম দিন কথাটা ধরতে পারেনি। দাঁত দিয়ে লুঙ্গির ধার আটকে প্যান্ট খুলতে খুলতে অফিসফেরতা তার চোখেমুখে অবসন্নতার পরত ছিঁড়ে একটু একটু উৎসাহ ঝিলিক দিয়েছিল,-- কী বলে মোস্তফা?! কেননা তখনও মোস্তফা বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি। সেদিনই সে কেবল ঢাকা এসে পৌঁছেছে বাড়ি থেকে। তখন ভোরও হয়নি। বাস এসে থামে রাত চারটার দিকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে বেবি নিয়ে চলে এসেছে, যদিও ভয় ছিল ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। মফস্বল শহরে বসে তারা তো খবরই পড়ে সারাদিন। বাসায় এসেই এমন জোরে কড়া নাড়তে শুরু করেছে সে, তার ঘুম ভাঙার আগেই দোতলা, তিনতলা আর চারতলার মানুষজনের ঘুম ভেঙেছে। ঘুমজড়ানো চোখে দরজা খুলে দিতে মোস্তফা সোজা ভেতরে ঢুকে ‘মাইরি যা ঘুম পেয়েছে’ বলে তার বিছানায় শুয়ে পড়েছে। রূপম যখন অফিসে যায় তখনও মোস্তফা গভীর ঘুমে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখে একটা স্যান্ডোগেঞ্জি আর ঢিলেঢালা ট্রাউজার পরে সে রূপমের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে। তাকে দেখে অল্প হেসে বলেছিল, কী রে, স্লেভারি শেষ হয়েছে?

স্লেভারি মানে এই চাকরি করা,-- সেটা বুঝা গেল আরও খানিক বাদে। রাত উজানে গেলে। তখন ম্যাডোনার লিঙ্গেরি দুলছে, কিন্তু তাদের কারও ধৈর্য নেই তাকিয়ে দেখার। তা ছাড়া সেই স্কুলের রাস্তাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নম্রতার মা ছিল গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। হাতে একটা শঙ্খ আর কপালে বড় একটা টিপ ছাড়া আর কিছু কোনদিন চোখে পড়েনি তাদের। অনেক রক্তজবা গাছ ছিল বাড়ির সামনের বাগান জুড়ে। আবার কোনওটা সাদা, কোনওটা হয়তো লাল, কোনওটা অন্যরকম। চোখ লাল হয়ে ওঠে মোস্তফার অল্প টানেই। রূপম উস্কানি দেয়, ক্যা-বা চোউখ তো তুমার নম্রতার বাগানের জবা-জবা লাগে!

টকটকে রক্তজবার মতো মতো দুলতে দুলতে মোস্তফা তখন তাকে আবারও হুঁশিয়ারি করে দেয়, মাতো কেনে? এ-এ—করো তো স্লেভারি। সকাল আটটায় শুরু অয়, সন্ধ্যা রাইত কুনু ঠিক নাই। আবার মাতে?!

মোস্তফা এভাবেই কথা বলে। সে তাই কিছু মনে করে না। রুমের সামনে ছড়িয়ে থাকা ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। ব্যাচেলর মানুষদের বাসা এরকমই হয়। বাসাই তো পাওয়া যায় না, ভাগ্য ভালো থাকলে ঠাঁই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিচতলা না হয় একেবারে ওপরের চিলেকোঠায়। কোন ব্যকরণবিদ আবার কাব্যি করে বলে গেছে চন্দ্রশালা। পানশালায় পান করা হয়, পাঠশালায় পাঠ দেয়ানেয়া হয়, বন্দিশালায় রাখা হয় বন্দি করে আর চন্দ্রশালায় বসে বসে পান করা যায় চাঁদের সুধা। এরকম চন্দ্রশালায় বসে থাকতে থাকতে ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ শুনে মোস্তফার মধ্যে গুটিশুটি মারা এই উপলব্ধি অন্য কোনও সময় হলে সে হয়তো উপভোগ করত। কিন্তু অফিসের কথা মনে হওয়ায় নিজেকেই গুটিয়ে নেয় সে নিজের ভেতর।

অফিস আর এই স্বপ্নের বিভ্রম নিয়ে রূপম এবার উঠে বসে। মোস্তফা কেন এসেছে শুনতে হবে। এইভাবে দিনের পর দিন ও তার বাসায় পড়ে থাকবে তা তো হয় না। বাসায় দু’চারজন মানুষ মাঝে মাঝে তার ভালোই লাগে। কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমশই নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে। তার নিঃসঙ্গতাকে সে উপভোগ করতে চায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তাড়িয়ে তাড়িয়ে। কোন কোন দিন হয়তো তার ঘুম ভেঙে যায় খুব সকালে। চোখ মেলে দেখে সাদা দেয়াল। আর বাথরুমের দরজার সামনে একটা তুলতে-না-পারা স্টিকার: তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আগে বেহেশতে যাবে, কে পরে যাবে, আদৌ কেউ যাবে কিনা, বেহেশতই আছে কিনা এসব নিয়ে তার কোনও কৌতুহলও নেই। এই স্টিকার তা হলে নিশ্চয়ই আগের কোনও ভাড়াটিয়ার লাগানো। তার কি মেয়ে ছিল? না কেবলই ছেলে আর ছেলে? না কি এটা তার স্ত্রীর কাণ্ড? পুত্রসন্তান প্রত্যাশী স্বামীর ক্ষুব্ধ মনকে বশে আনতে এই বাণী সে লাগিয়েছিল দরজার ওপরে? সেই দম্পতির নিশ্চয়ই কেবল একটা বাচ্চা ছিল। কেননা এ বাসা ঠিক দু’সন্তান নিয়ে থাকার মতো নয়। এক সন্তান হলেই এ বাসায় সমস্যা হওয়ার কথা। ছাদ কিংবা ছাদের মতো বারান্দা পেরিয়ে একটি দরজা দিয়ে ঢুকলে মাত্র দু’টো রুম, আর সেসব রুমে ঢোকার মুখে সামান্য জায়গা। সেখানে সোফাসেট বসালে সামনে টি-টেবিল বসানো সম্ভব নয়। বসালে চলাফেরার রাস্তাই বন্ধ হয়ে যাবে। তার অবশ্য সোফাসেটের দরকার নেই। বাসায় ওঠার পর সে চেষ্টা করেছিল স্টিকারটা তুলে ফেলবে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। খুবই গাঢ় হয়ে সেঁটে আছে দরজার বার্নিশমারা কাঠের গায়ে। নম্রতা কি জানে এ বাণী? ঘন বৃষ্টির ছাঁটে ফরসা হয়ে যাওয়া মাঠের ওপর খড় দিয়ে বানানো বল তাদের পায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে, সেই বল সামলাতে সামলাতে আবার খেয়াল রাখতে হচ্ছে শ্রাবণরাজা গাছটা থেকে কোন আম মাটিতে পড়ল কিনা। কিন্তু সেই জানালা আর চোখে পড়ে না, বৃষ্টির ছাঁট সবকিছু ঝাপসা করে ফেলে, মনে আর হয় না নম্রতা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই না-খেলার, এই না-কুড়ানোর হীনম্মন্যতা ঢাকতে, জানা থাকলে ও কি সান্ত্বনা পেতে পেত স্টিকারের ওই বাণী মনে করে? নাকি মনটা আরও কুঁকড়ে যেত ঘরের ঠাকুরের দিকে চোখ পড়ায়?

তুমি তো আর শাওনরাজার আম খাইতে গ্যালা না বা! ও আর আম দেয় না। আমকাঠ দিয়া চকি বানাইমু।

বানাগা।-- সে বিরক্তি চাপার চেষ্টা করে না।– ঢাকা শওরে আমের অভাব পইড়ছেনি।

আরে বা শাওনরাজা, তুমি খ্যাপো কেনে? খেপলে কিন্তু চকিও বানামু না। ব্রিকফিল্ডের খড়ি বানামু। এইডা তোমার কিশোর কুমারের কৃষ্ণচূড়া না যে দাড়ি রাইখা অনেক পরত যাইয়া গান গাইবা, এই সেই কৃষ্ণচূড়া যার তলে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ বুকে বুক...

নিজের রসিকতায় মোস্তফা নিজেই হাসে হো হো করে। সে যখন ভাবছে বোশেখ-জৈষ্ঠ নয়, আষাঢ় মাসও নয়, অদ্ভুত আমগাছটায় আম পাকে শ্রাবণ মাসে গিয়ে, মোস্তফার নানী তাই নাম দিয়েছে শ্রাবণরাজা, মোস্তফা তখন একটা বার্মিজ চুরুট বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, দেখছেন ক্লিনটনের সেই সিগার নি এডা?

বলে আচমকা টিভি চালায়। আগে থেকেই সেখানে বিবিসি ছিল। আফগানিস্তানের পাথুরে ভূমিতে তাই বোমা পড়তে থাকে, আকাশমুখো ধোঁয়াবালি উগড়ে ওঠে। রিফিউজি ক্যাম্পের একটা বাচ্চা মেয়ে স্প্লিন্টার লাগা মুখ নিয়ে করুণ চোখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ভেতর ভেতর থরথরিয়ে কাঁপে, বিয়ে করলে তারও অমন মেয়ে হতো বোধহয়। মোস্তফা এবার গাঁজা বানানোর প্রস্তুতি নেয়, কমদামী সিগারেটের মশলা ফেলে গাঁজা ভরতে ভরতে বলে, আমাগরে সাংবাদিকগুলা ভুয়া নি রে? হিন্দুগুলাক মাইরা সাফা কইরা দিল। দু’এক রিল তুইলা দেখাইবার নি পারে না?

এবার সে গাঁজায় দম দিতে থাকে। দম দিতে দিতে বলে আপনমনে, আগেভাগে ভারত চইলা গিয়ে ভালোই কইরছে নম্রতারা।

শুনে সে ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে। মোস্তফা তার দিকে স্টিকটা এগিয়ে দেয়, কাইল হোসেনের বাসায় যামু।

কিয়ে? কী’র লাইগ্যা?

না বা,-- তোমার একলা থাকাই ভালা। তুমি নম্রতা নিয়া থাকো। আমার চোখ লেফটরাইট করে। হোসেনের বাসাই ভালো।

তার খারাপই লাগে। তা কী এইজন্যই সে নিজে থেকে বলার আগেই মোস্তফা তাকে নাকচ করে হোসেনের বাসায় চলে যাচ্ছে? না নম্রতাকে নিয়ে ভাবতেও অরুচি এখন এই চারপাশের চাপে? অরুচি অথবা ভয়?! তার হাতে কি অস্ত্র আছে? ধানের শিষ? দাঁড়িপাল্লা? অথবা নৌকা? কাস্তেহাতুড়ি? কোন অস্ত্রে ভয় কাটে চোখের মণি থেকে ঠিক পায় না। রাতের অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে হাতের কাঁকনভাঙা মেয়েরা গোঙাতে থাকে, অনেক অনেক নাকফুল ভেসে যায় শ্রাবণ শেষে জল নিম্নমুখী হয়ে গড়িয়ে যেতে শুরু করলে।

রিমোট কন্ট্রোলটা বোধহয় মোস্তফা হাতে নিয়েই উঠে গেছে। পর্দার আফগানিস্তান আর মার্কিন সৈন্য থেকে, স্বপ্ন ও বাস্তবের নম্রতা থেকে চোখ সরানোর জন্যে রূপম মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে আবার। এখনও শীত নামেনি মহানগরে, তবু চাদর মুড়ি দেয়। কানটা ঢেকে নিতে নিতে মোস্তফা গুনগুন করছে হোসেনের বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে, ফুলের বনে যার কাছে যাই তারেই লাগে ভালো...।●
























লেখক পরিচিতি





ইমতিয়ার শামীম : ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার রামগাতি গ্রামে জন্ম। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিকতা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৪। উপন্যাস--ডানাকাটা হিমের ভেতর (১৯৯৬), আমরা হেঁটেছি যারা, অন্ধ মেয়েটি জ্যোৎস্না দেখার পর, চরসংবেগ, মৃত্যুগন্ধী বিকেলে সুশীল সংগীতানুষ্ঠান। গল্পের বই-- শীতঘুমে একজীবন (১৯৯৬), গ্রামায়নের ইতিকথা, মাৎস্যন্যায়ের বাকপ্রতিমা, কয়েকটি মৃত মুনিয়া, আত্মহত্যার সপক্ষে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ