অদিতার আঁধার : পর্ব নয়

দীপেন ভট্টাচার্য

দুহাজার বছর পরে পৃথিবীতে আলাদা কোনো দেশ নেই। মানুষের মৃত্যু হলে তার কপি-করা মস্তিষ্ক পুনরায় দেহে বসানো হয়। কিন্তু লোহিতক সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে এই পদ্ধতি প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে। লোহিতক গোষ্ঠীর নেতা অশিরের নির্দেশে দুই আততায়ী - মিরা ও সিলোন - হত্যা করে ডকটর বিনতাকে। তারপর তারা বেতার তরঙ্গ দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দেয় অদিতার প্রতিস্থাপিত মস্তিষ্ক। এই পর্বে বিনতার কপি-করা মস্তিষ্কের স্বপ্ন ও পৃথিবী পরিচালনা কমিটির দুই গোয়েন্দার সঙ্গে অধ্যাপক বিষাণের কথোপকথন।
আগের পর্বগুলো পড়ার লিংক
-----------------------------------------------------------------------------------------

অদিতার আঁধার : পর্ব নয় 

দুবছর আগে বিনতা এসেছিল ‘নিলয়ে’ তার মস্তিষ্ক কপি করাতে। সেই কপি-করা মস্তিষ্ক দুবছর ধরে স্বপ্ন দেখেছে সূর্যাস্তের যে সূর্যাস্তের কোনো শেষ নেই। এক প্রশান্ত সাগরপাড়ে দিগন্তের মেঘের পেছনে সূর্য অস্ত যায়, বিনতা বালির ওপর বসে থাকে। তার পেছনে খাড়াই পাহাড় নেমে এসেছে, রচনা করেছে একটা বালিয়াড়ির তিনদিকে অর্ধবৃত্ত, অর্ধবৃত্তের অন্যদিকে একটা সরলরেখা ধরে ভেঙে পড়ে সমুদ্রের ঢেউ। পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যে এই উন্মুক্ত ছোট কুলুঙ্গীতে বসে বিনতার মনে পড়ে না সূর্যাস্ত ছাড়া অন্য কোনো সময়ে সে সূর্যকে দেখেছে কিনা, অথচ মনে হয় তার মনের গভীর কোনে এক কুয়াশা-ঢাকা স্মৃতি রয়ে গেছে - সে দেখেছিল তার দুপাশে ছোট ছোট মসৃণ ভেজা কালো পাথর চকচক করছে দুপুরের উষ্ণ সূর্যের আলোয়। কোনো এক অতীতে সূর্য মাথার ওপরে ছিল। 

এছাড়াও তার স্বপ্নে থাকত আর একটি মানুষের অধরা উপস্থিতি। তার কাছেই কোথাও আছে এক যুবতী, বিনতার মনে হয় তাকে সে চেনে - স্বপ্নে যেমন হয় - একটা আবছায়া বোধগম্যতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে পরিচয়। মাঝে মাঝে দূর থেকে নিজেকে দেখে বিনতা - পেছনে চুল ছড়িয়ে সমতল উজ্জ্বল বালির ওপর বসা সে নিজে, তার অল্প পেছনে বসা আর একটি তরুণী। কিন্তু সে যখন মুখ ফিরিয়ে তরুণীকে দেখতে চেয়েছে সেখানে সে কাউকে দেখে নি। কোনো কোনো সময় বিনতা তার ছোট বালিয়াড়ির বাইরে যেতে চেয়েছে, কিন্তু চারপাশের পাহাড় তাকে বের হতে দেয় নি। সে চেষ্টা করেছিলে পাহাড়ের পাথরে পা রেখে ওপরে উঠবার, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে, পা পিছলে পড়েছে বহু নীচে। কিন্তু সেই পড়ায় তার হাড় ভাঙে নি, চামড়া ছড়ে রক্ত বের হয় নি। এখানে সকাল নেই, দুপুর নেই, এমনকি অন্ধকারও নেই, অথচ তার মনে হয় পৃথিবীতে সূর্যোদয় ছিল, দুপুর ছিল, আর পৃথিবীটা পাহাড় দিয়ে আটকানো সমুদ্রের ধারে এই ছোট বালির জগতের চাইতে বড় ছিল। বিরামহীন সূর্যাস্ত আর পাহাড়ের দেয়াল তাকে আটকে রেখেছিল সময় ও স্থানে। 

বিনতার স্বপ্ন বুদবুদের মত ভেসে উঠছিল একটা রাসায়নিক-ইলেকট্রনিক পাত্রে যত্ন করে রাখা মস্তিষ্কে। সেই মস্তিষ্ক বাইরের জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন ছিল না, কিন্তু ধীরে ধীরে বিনতা বুঝেছে তার অবরুদ্ধতা, বুঝেছে এই স্বপ্নের বাইরে সে যেতে পারবে না। সে সমুদ্রে সাঁতাড় কাটতে চেয়েছে, কিন্তু হাঁটুজল থেকে সে বারে বারে হাঙরের ভয়ে ফিরে এসেছে, স্বপ্ন তাকে সাঁতার কাটতে দেয় নি। এক সূর্যাস্ত থেকে আর এক সূর্যাস্ত, তারপরে এর এক সূর্যাস্ত - অসীম সংখ্যক সূর্যাস্ত তাকে বিদ্ধস্ত করে দিয়েছিল। এক অসহায় ক্ষোভে সে পাহাড়ের পাথরে মাথা কুটেছে, কিন্তু তাতে মাথা ভাঙে নি, রক্ত ঝরে নি। সে চিৎকার করত, “আমাকে মুক্তি দাও, পাহাড় ভেঙে আমাকে নিয়ে যাও।” কিন্তু তার আর্তনাদ স্বপ্ন-জগতের নিউরনদের বাইরে যেতে পারত না। 

অবশেষে একদিন সে স্বপ্ন থেকে বের হয়ে আসে। পৃথিবীতে চলমান ডকটর বিনতা খুন হয়েছে লোহিতক আততায়ীদের হাতে। মৃত বিনতার মাথায় স্থাপন করা হল রাসায়নিক-ইলেকট্রনিক পাত্রে সুরক্ষিত বিনতার কপি-করা মস্তিষ্ক যে মস্তিষ্ক অন্তবিহীন সূর্যাস্তের স্বপ্ন দেখেছে গত তিন বছর। এই বিনতা আসলে পুরনো বিনতা, অপারেশনের পরে তার জ্ঞান ফিরে এলে প্রথমেই সে দেখে ডকটর তারকারের চোখ, তাতে উদ্বেগ। প্রথমে বিনতা ভাবে তার সূর্যাস্তের জীবনের সাথে যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রার, বিনতা বলে, “পারছি না, আর পারছি না, আমাকে মুক্তি দাও।” ডকটর তারকার বুঝতে পারেন বিনতার আকুতি, গভীর সমবেদনায় হাত রাখেন বিনতার কপালে, বলেন, “আপনার মুক্তি হয়েছে, ডকটর বিনতা।” তারকারের অগোছালো সোনালী চুলের নিচে উজ্জ্বল সহৃদয় নীল চোখে বিনতা সান্ত্বনা পায়। তারকারকে চিনতে পারে বিনতা, এই তো সেই বিশেষজ্ঞ যার সঙ্গে তার সবে পরিচয় হয়েছে, যে কিনা তার মস্তিষ্ককে কপি করার জন্য তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। বিরাট কাচের জানলার বাইরে বিশালগড়ে তখন মধ্যরাত, গতকাল এরকম সময়েই আর এক বিনতাকে শহরের রাস্তায় ছোরা দিয়ে কারা যেন হত্যা করেছিল। সেকথা এই নতুন বিনতা এখনো জানে না, কিন্তু সে জানে সে যখন পাহাড়-ঘেরা সমুদ্রতীরে আটকে ছিল, তার প্রতিলিপি - আর এক বিনতা - পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেরিয়েছে। আজকের বিনতা এও বোঝে ঐ বিনতার মৃত্যু হয়েছে। 

*****************************

ডকটর তারকার যখন বিনতার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করছিলেন তখন ‘নিলয়ের’ আর একটি ঘরে বিষাণ কথা বলছিল কেন্দ্র থেকে পাঠানো দুজন রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে। এদেরকে হয়তো গোয়েন্দা বলাই সঙ্গত। এদের একজন পৃথিবী পরিচালনার নীতিসংক্রান্ত বিধিগুলো দেখে, তার নাম আলহেনা, অপরজন হল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, তার নাম নাকোটা। নাকোটা উড়ে এসেছে সুদূর গ্রীনল্যান্ড আর আলহেনা আরব অন্তরীপ থেকে, দুজনেই তরুণী, তাদের বয়স এক শর নিচে। বিশালগড়ের আর্দ্রতার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না। এখন নিলয়ের আবহাওয়া-নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে দুজনেরই স্বস্তি পাবার কথা, কিন্তু স্বস্তি তারা পাচ্ছে না। গত কয়েক শ বছর ধরে পৃথিবীতে যে সাম্যাবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তার মধ্যে কোথায় যেন চিড় ধরেছে। সেই ফাটলের শুরু কোথায় সেটাই ধরতে চাইছে এই দুজন। 

পৃথিবী পরিচালনা কমিটির সঙ্গে একসময়ে বিষাণের খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, কারণ মস্তিষ্ক কপি করার বিজ্ঞানে বিষাণের কাজ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্ক নিয়ে অধ্যাপক বিষাণের গবেষণার কথা এই দুই গোয়েন্দা খুব ভাল করেই জানে। তারা বিষাণের সঙ্গে কথা বলার জন্য খুবই উৎসুক ছিল, বিষাণ তাদের কাছে এক কিংবদন্তীর নায়ক। তবু এই আলাপে পেশাদারীত্ব বজায় রাখতে আলহেনা ও নাকোটা তাদের উচ্ছ্বাস সংবরণ করে। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে আলহেনা বলে, “প্রফেসর বিষাণ, আমাদের বেশ কিছু প্রশ্ন আছে, এটা একটা বিরাট ধাঁধা, এই ধাঁধার সমাধানে আপনার একটা বড় ভূমিকা আছে।” কেন্দ্র থেকে আসা এই দুই নারীকে একটা বাড়তি আপদ ভাবছিল বিষাণ, অদিতা ও বিনতাকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে, এখন এদের সঙ্গে কথা বলে সে সময় নষ্ট করতে চায় না। গত দুদিনের নিদ্রাহীন ক্লান্তি তাকে গ্রাস করে, কিন্তু আলহেনার কথায় সহানুভূতির ছোঁয়া পায় সে, তার অসন্তোষ কিছুটা কমে। তাছাড়া পরিচালনা কমিটির সঙ্গে সংযুক্ত সবাই খুবই যোগ্য মানুষ, তারাও সময়ের অপব্যবহার করে না। 

“আপনাকে আমরা বেশ কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব, আপনি এতে আমাদের ওপর বিরক্ত হবেন না,” আলহেনা কপালের ওপর সোনালী চুল হাত দিয়ে পাশে সরিয়ে বলে, “আপনার সঙ্গে আমাদের কথাগুলো ভিডিও করা হবে, আশা করি তাতে আপনার সম্মতি আছে?” আলহেনার হাল্কা কালো চোখের দিকে তাকিয়ে বিষাণ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। 

“আপনার সঙ্গে অদিতা সানের কতদিন হল ছাড়াছাড়ি হয়েছে?” নাকোটা জিজ্ঞেস করে। এই প্রশ্নটা বিষাণ আশা করছিল না। কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় সে উত্তর দিতে, “আশি বছর হবে প্রায়।” 

“আর চাঁদে আপনার ছেলে সেনভা কবে হারিয়েছে?” নাকোটার কালো লম্বা চুলের একপাট সামনে রাখা। সেনভার কথাটা কেন নাকোটা জিজ্ঞেস করছে সেটা বিষাণ বুঝতে পারে না। 

“একশো বছর হল অন্ততঃ।” একটু ভেবে উত্তর দেয় বিষাণ। 

“হমমম…,” মাথা দোলায় নাকোটা। চুলের পাটের মধ্যে দিয়ে তার জামার ওপর পরিচালনা কমিটির ব্যাজ চোখে পড়ে। বিষাণ জানে এসব কথা আর ছবি রেকর্ড হচ্ছে নাকোটার বাদামী চোখের মণির পেছনের রেটিনায়। 

এবার আলহেনা প্রশ্ন করে, “ডকটর বিনতাকে আপনি কবে থেকে চেনেন?” 

“ওনার সঙ্গে মাত্র গতকাল পরিচয় হল।” 

“উনি কি আপনাকে কোনো অদ্ভূত আঁধারের কথা বলেছেন?” আলহেনা জিজ্ঞেস করে। 

চমকে ওঠে বিষাণ। আঁধার? এরা আঁধারের কথা কী করে জানল? কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে বিষাণ, ঘরের একদিকে বড় কাচের জানালা দিয়ে বিশালগড়ের আলো দেখা যায়। বিষাণ মনে করতে চায় বিনতার সঙ্গে তার কথোপকথন। তারপর আস্তে বলে, “ডকটর বিনতা আমাকে এক আকারহীন অন্ধকার মেঘের কথা বলেছিলেন যা কিনা সমস্ত আলো শুষে নেয়। অদিতা তাঁকে সেই মেঘের কথা বলেছিল।” 

“হ্যাঁ, আমাদের ফাইলে অদিতা সানের সঙ্গে ডকটর বিনতার কথোপকথনটা আছে। আপনার এটা দেখা দরকার,” নাকোটা একটা ছোট বাক্স টেবিলের ওপর রেখে হাত দিয়ে একটা ইঙ্গিত করে, বাক্স থেকে একটা ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণ বের হয়, তাতে অদিতাকে কথা বলতে দেখা যায়। এই ভিডিওটি বিনতার চোখ রেকর্ড করেছিল। 

অদিতা বলছে, “"হ্যাঁ, অন্ধকার, অদ্ভূত আঁধার বলতে পারেন। এক ধরনের শূন্যতা। সেটা স্বপ্ন কি বাস্তব আমি বুঝতে পারি না। ঘরটা যদি আলো-আঁধারি হয় শুধু তখনই সেটা আসে, একটা কালো বেলুন ফুলে ফেঁপে ওঠে ঘরের মধ্যে। হয়তো জানালা দিয়ে আসে, কিন্তু জানালা বন্ধ থাকলেও আসে। পুরো ঘরটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যায়। মনে হয় কালো কালো আঙ্গুল সেই অন্ধকার গঠ্ন থেকে বের হয়ে আমার মুখের দিকে আসছে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। তারপর আর কিছু মনে থাকে না। এমন যেন আমার মৃত্যু হয়েছে।" 

শিউরে ওঠে বিষাণ। একটা ঠাণ্ডা বাতাস যেন বয়ে যায় ঘরে, হিম হয়ে যায় শরীর। মনে হয় ঘরটা অন্ধকার হয়ে আসে, বিশালগড়ের রাত ঘরের উজ্জ্বল বাতিগুলোকে ম্রিয়মান করে দেয়। 

অদিতার প্রক্ষেপণ বলতে থাকে, "যে রাতে আমার ঘুম আসে না সে রাতে আমি দোতলার বারান্দায় যেয়ে নদীর ওধারে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকি। জোনাকীরা ঝলমল করে, নদীর এপাড়ে যখন তারা নেভে ওপাড়ে তখন তারা জ্বলে ওঠে, আবার ওপাড়ে নিভলে এপাড়ে জ্বলে। ঝিঁঝিঁর ডাকও যেন তার সাথে ওঠানামা করে। মাঝে মধ্যে মেছো পেঁচা ডেকে ওঠে কোথায় হুহহুহু-হু, রাতের অন্ধকারেও মেঘহও মাছরাঙারা জলে ঝাঁপ দেয়। অনেক সময় নেকড়ের ডাক শুনি, উউউউউউ, রহস্যময় সেই ডাক। গায়ে কাঁটা দেওয়া তাদের কোরাস কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ে পুরোনো বনস্পতির ওপর দিয়ে, নিশীথ রাতের চাঁদের নীরবতার নিচে সেই ডাক ভেসে আসে নদীর এধারে আমাদের বাড়িতে। এসব কিছুই আমার চেনা, আমিই এখন রাতের অরণ্য। বনের শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ আমার মজ্জাগত। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যেই অন্য একটা কিছু জিনিস সৃষ্টি হতে থাকে। আমি যেন দেখতে পাই নদীর ঐ পাড়ে একটা অন্ধকার দলা পাকিয়ে উঠছে, ফুলে ফেঁপে উঠছে বর্ষার কালো মেঘের মতন। ফুঁসে উঠছে সেই অন্ধকার। আর তখনই বনের সব আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। নেকড়ে, পেঁচা, ঝিঁঝিঁ সব। জোনাকীরাও যেন কোথায় চলে যায়। 

"নদী পার হয়ে সেই কালো অন্ধকার আমার দিকে তার শীর্ণ হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেই আঁধারের মধ্যেই, সেই ফুলে ওঠা অন্ধকারের মধ্যেই কি যেন নেকড়ের চোখের মত জ্বলজ্বল করে, আমাকে যেন লক্ষ করে। এরকম মিনিটখানেক থাকে, তারপর সেই অন্ধকার, জ্বলজ্বলে চোখ মুছে যায়। আমি ঘরে ফিরে আসি। ঐসব রাতে সেই আঁধার আর আমার ঘরে আসে না। এমন যেন একবার ভয় দেখিয়েছে, আর দেখানোর দরকার নেই।" 

অদিতার বর্ণনা নাকোটা আর আলহেনার মধ্যেও এক ধরণের ভয় সঞ্চারিত করে। নাকোটা অদিতার এই কথাগুলি বারদুয়েক শুনেছে, যতবার শুনছে ততবার সে এক অন্ধকার মেঘ কল্পনা করছে, ততবাত শিহরিত হয়েছে। সে বিষাণকে প্রশ্ন করে, “প্রফেসর, ডকটর বিনতা কি নিজে সেই আঁধার অনুভব করেছেন?” 

“হ্যাঁ, উনিও নাকি এই আঁধার দেখেছিলেন। যেদিন অদিতা তাঁকে সেই অন্ধকার মেঘের কথা বর্ণনা করেছিল সেদিন রাতেই ডকটর বিনতা তাঁর ঘরে ঐ কালো মেঘ দেখেন। ওঃ, আর একটা কথা অদিতা বিনতাকে বলেছিল একবার এই অন্ধকার মেঘ কেটে গিয়েছিল বাঁশীর শব্দে।” 

“বাঁশীর শব্দে!?” নাকোটা আর আলহেনা দুজনেই আশ্চর্য হয়ে বলে ওঠে। বিষাণ তাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়, এই দুজন এমন কী জানে যা তার অজ্ঞাত। কিন্তু তারা কিছু বলে না। বেশ কিছু সময় তিনজনই মৌন থাকে, তারা যেন সেই ঘরে অন্ধকার মেঘ জমার অপেক্ষা করছিল, তারা যেন সেই বাঁশীর শব্দ শুনতে চাইছিল। 

আলহেনা নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে, “অদিতা সান তাঁকে মৃত অবস্থা থেকে যাতে আর ফিরিয়ে না আনা হয় সেটার চেষ্টা করছিলেন। উনি এখন কোমায় আছেন, আপনি ভাল জানবেন উনি এই কোমা থেকে ফিরতে পারবেন কিনা। যদি না ফেরেন তবে আর মাত্র একটি মস্তিষ্ক আছে ওনার, সেটি নিষ্ক্রিয় হলে ওনার অভিলাষ পূর্ণ হবে। আপনার কি মনে হয় ওনার সঙ্গে লোহিতক গোষ্ঠীর কোনো যোগাযোগ হয়েছিল?” 

ব্যাপারটা এভাবে বিষাণ আগে যে ভাবে নি তা নয়, লোহিতক যদি সব সংরক্ষিত মস্তিষ্ক ধ্বংস করে দেয় তবে অদিতার মুক্তি হবে। কিন্তু লোহিতকের সঙ্গে অদিতার সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকবে সেটা বিষাণ ভাবতে পারে না 

“আপনার কম্পুটার সিমুলেশন কি লোহিতকের নেতা সম্পর্কে কোনো তথ্য দিয়েছে?” আলহেনা প্রশ্ন করে। 

“না, শুধু বলেছে বিনতার হত্যাকাণ্ডে লোহিতকের দায়িত্বের সম্ভাবনা শতকরা ৮২ ভাগ। সেখানে কোনো নেতার উল্লেখ করা হয় নি।” 

নাকোটা বিষাণকে প্রশ্ন করে, “আপনি কম্পুটারে সিমুলেশন করেছেন, বলছেন ডকটর বিনতাকে হত্যা করতে পারে লোহিতক সন্ত্রাসী সংগঠন। আপনার সিমুলেশন বলছে অদিতা সানকে বেতার তরঙ্গের সাহায্যে কোমায় নিয়ে গেছে লোহিতকরাই। আপনি কি নিজেকে এই সিমুলেশনে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন?” 

নাকোটার প্রশ্নটা বুঝতে অসুবিধে হয় বিষাণের। “আমাকে? না, আমাকে সিমুলেশনে রাখি নি।”

“আপনি বলছেন নিজেকে সিমুলেশনে রাখার কথাটা আপনার মনে হয় নি?” এবার প্রশ্ন করে আলহেনা। তার আর নাকোটার চোখে-মুখে বিস্ময়, বিষানের মত বুদ্ধিমান মানুষ নিজের চরিত্রকে বাদ দিয়ে অদিতা ও বিনতার মৃত্যুকে সিমুলেশন করেছে সেটা তাদের বিশ্বাস হয় না। 

তরুণী দুজনের বিস্ময় দেখে বিষাণের বোধোদয় হয়, সত্যি কেন সে নিজেকে বাদ দিয়েছে এই গণনা থেকে! সে ভাবে কেমন করে প্রোগ্রামে নিজের তথ্য দিতে সে ভুলে গেল! 

“আপনি সেনভাকে শেষ কবে দেখেছেন?” আলহেনার প্রশ্ন। আবার সেনভা, ভাবে বিষাণ, সেনভার সঙ্গে এইসব ঘটনার কী সম্পর্ক? 

“প্রায় ষাট-সত্তর বছর হবে। আমি আর দিতা কেম্যান দ্বীপে গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করতে।”

“শেষ কবে তার সঙ্গে কথা হয়েছে?” 

“পরশু দিন, আমি ওকে ফোন করেছিলাম অদিতার খবরটা জানাতে।” 

“কোথায় ছিল সেনভা যখন আপনি ফোন করেছিলেন?” 

“উত্তরের আর্কটিক মহাসমুদ্রে, এক জাহাজে।” 

আবার দৃষ্টি বিনিময় করে আলহেনা ও নাকোটা। বিষাণ সেই দৃষ্টির অর্থ ধরতে পারে না, সেনভাকে এর মধ্যে কেন টেনে আনা? যা মনে হয় এরা সেনভা সম্বন্ধে মোটামুটি সব কিছুই জানে। বেশ অনেক বছর আগে বৃহস্পতির উপ্রগ্রহ ইউরোপা অভিযানে সমুদ্রবিজ্ঞানী হিসেবে সে যোগ দিয়েছিল, এ কথা অনেকেরই জানা। এসব ভেবে আরো শ্রান্ত হয়ে পড়ে বিষাণ। তার ক্লান্তি চোখে পড়ে আগন্তুকদের। 

নাকোটা বলে ওঠে, “আপনি এখন বিশ্রাম নিন, প্রফেসর। তবে একটু সুস্থির হয়ে সিমুলেশনটা আর একবার চালাবেন - এবার আপনাকে অন্তর্ভূক্ত করে। সেটার কী ফলাফল হয় দেখতে আমরা খুবই আগ্রহী।” 

“কেন? আপনারা কী কিছু জানেন, আপনাদের সিমুলেশন কি নতুন কোনো তথ্য দিয়েছে? দয়া করে আমার কাছ থেকে আড়াল করবেন না,” বলে বিষাণ। 

নাকোটা আলহেনার দিকে তাকায়। আলহেনার কালো ভুরু অল্প ওপরে ওঠে, যেন সম্মতি দেয়। নাকোটা বলে, “লোহিতকগোষ্ঠী একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, মানব জীবনের মূল্য তাদের কাছে খুবই কম, তারা মানুষের দীর্ঘ জীবন চায় না। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা তারা এই উদ্দেশ্যের জন্য মানুষ হত্যা করতে পিছ-পা হয় না। এই সন্ত্রাসের শিক্ষা প্রতিটি লোহিতকের সদস্য পায় তাদের এক নেতা থেকে। সে আমাদের সমস্ত ধরণের তথ্য সংগ্রহ-উপায়ের বাইরে থাকে। মাত্র গতকাল তার একটা ছবি আমরা জোগাড় করতে পেরেছি। আপনাকে দেখাচ্ছি।” 

টেবিলের ওপর যে ছোট বাক্সটা বিনতার সঙ্গে অদিতার কথোপকথন দেখাচ্ছিল সেটাতে একটা মুখ ভেসে ওঠে। সেটা দেখে বিষাণের মুখ থেকে একটা অস্ফূট গোঙানি বের হয়। তারপর দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে সে, বলে, “এটা সম্ভব নয়, এটা সম্ভব নয়।” আলহেনা ও নাকোটা বিষাণের বেদনায় বিচলিত হয়, উতলা হয়, কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের করার কিছু থাকে না। বিষাণের কথা প্রায় শোনা যায় না, ভাঙা গলায় সে বলে, “আপনারা ভুল ছবি দেখাচ্ছেন।” 

(চলবে)


লেখক পরিচিতি
দীপেন ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯। আদি নিবাস এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল।
বিজ্ঞানী। গল্পকার।

মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইন্সটিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিয়ার) গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রকাশিত বই : দিতার ঘড়ি, নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো, নক্ষত্রের ঝড়, বার্ট কোমেনের ডান হাত ও অন্যান্য কল্পকাহিনী। এছাড়া: বঙ্গীয় বদ্বীপের অতীত ও ভবিষ্যৎ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ