
ইংরেজিতে যাকে বলে সেন (sane) বাংলায় তাকেই তো আমরা বলতে পারি সৎ। এই সৎ শব্দটির পেছনে সদসতের কোনো নিরিখ নেই, আছে সামাজিক জীবন-যাপনের কতকগুলি সভি রীতির চর্চার প্রতি সমর্থন। কোন সৎ সমাজের সম্ভাবনা ও সঙ্কট নিয়ে একজন ঔপন্যাসিকের কী বলার থাকতে পারে? চ্যাপলিনের 'দি কিড' ছবিটিতে বাচ্চা জ্যাকি কুগান ঢিল মেরে-মেরে জানলার কাচ ভাঙছে, যাতে চ্যাপলিন সেগুলো সারাতে পারে। জানলার সার্সি সারানোর পেশায় সাফল্যের ওটা ছিল চ্যাপলিনি কৌশল। একটি সম্পূর্ণ সৎ সমাজে একজন ঔপন্যাসিক তো লিখতে চান তখন, যখন শুধু জানলার সার্সি নয়, গোটা-গোটা বাড়ি, বহুতল বাড়িও ঝুরঝুর ভেঙে পড়ে। যে দুঃসময়ে সময়ের গ্রন্থি ভেঙে যায়, তখনই ঔপন্যাসিকের উপন্যাস লেখার সুসময়।
কিন্তু কেন? ঔপন্যাসিকরা কি ঘোলাজলে মাছ শিকার করতে ভালবাসেন? অথবা কাসান্দ্রার মত চেতাবনী দিতে? কাসান্দ্রা যে-কোনো উপন্যাসের পক্ষেই একটু বেশি বানানো চরিত্র, তার জন্যে মঞ্চ দরকার, মহাযুদ্ধের পট দরকার, রাজপ্রাসাদের অলিন্দ, সোপান, অন্ধকার আর মুক্ত বাতায়ন। উপন্যাসে এত কিছু সাজিয়ে তোলা চলে না। যদি কোনো কাসান্দ্রাকে উপন্যাসে নেহাৎ লাগেই, তাহলে ঔপন্যাসিক আর-একটু নমনীয় কাসান্দ্রা চাইবেন।
অথচ প্রশ্নটা তো প্রশ্নই থেকে গেল—একটা দুঃসময়কেই কেন ঔপন্যাসিক বেছে নেন, বা বেছে নিতে চান? বা সময়টাকে উল্টে দিতেই তিনি চান কেন? সময়কে গোলমেলে করে না দিলে তাঁর চরিত্র আর ঘটনাকেন্দ্র বিকেন্দ্রিত হতে পারে না? একজন কোনো মানুষের অকারণ বাসনা ঔপন্যাসিককে টানে, সমুদ্যত সর্বনাশ ঔপন্যাসিককে টানে। তার মানে কখনোই এই নয় যে ঔপন্যাসিকরা সর্বনাশের পরিস্থিতিই পছন্দ করেন। বরং উল্টো-ঐ সর্বনাশে আর বাসনায় তিনি এমন এক মানবসত্যের দেখা পান, যুক্তির দিক থেকে যে সত্য, সত্য হয়ে ওঠার কথা ছিল না। কিন্তু সত্যি তো ভালমন্দ-নির্ভর নয়। কোথাও যুক্তির বিপর্যয় ঘটে গেছে। কোথাও সম্ভাব্য সত্য ধ্বস্ত হয়েছে আর তার জায়গায় নতুন এক সত্য জেগে উঠেছে যা ভয়ঙ্কর হলেও সত্য, অনভিপ্রেত হলেও সত্য, অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য। ঔপন্যাসিক সত্যের সেই বামমুখ দেখে ফেলেছেন।
কিন্তু যা সম্ভাবনা ছিল, আকাঙ্ক্ষা ছিল, অভিপ্রেত ছিল, যুক্তিযুক্ত ছিল-- তার কথা মনে না রাখলে সর্বনাশ ও সময়নাশের কাহিনীও মানবসত্য হয়ে ওঠে না। সেই আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনা, অভিপ্রেত ও আর সঙ্গত-- উপন্যাসে সব সময়ই মনে পড়ে, উপন্যাস সব সময়ই পড়িয়ে দেয়। তা যদি মনে না পড়ায় তাহলে উপন্যাসের কাহিনী হয়ে দাঁড়ায় আলগা গল্প। ঔপন্যাসিক মানুষের এই দুই সত্যের সংযোগস্থলের চড়াই ভাঙেন—যুক্তির সত্য আর সর্বনাশের সত্য। সেই কারণেই একজন ঔপন্যাসিক উপন্যাস-রচনাকর্মী হিশেবেই সব সময় তাঁদেরই সহযাত্রী, যাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে মানবসংসারে মুক্তি আর কাণ্ডজ্ঞানের খোঁজে ফেরেন। কাণ্ডজ্ঞানই সবচেয়ে দুর্লভ--চরম সংকটে সে-কথাই বারবার জানতে হয়।
কিন্তু একজন বাংলা ঔপন্যাসিক হিশেবেকোন শিল্পের আমি চর্চা করি, কী আমার আত্মপরিচয়? খুব আলগাভাবে আমি বলতে পারি--আমি গল্প উপন্যাস লিখি বা আমি একজন ঔপন্যাসিক। আমার পেশার বা ব্রতের এই বিবরণে কি আমার আত্মপরিচয় সম্পর্কে আমি নির্দ্ধিধ ? “গল্প-উপন্যাস লিখি” বা “আমি একজন ঔপন্যাসিক" একথা তো বলি এই কারণে যে এই কথাগুলোতেই আমার কাজটা সবচেয়ে সহজে বোঝানো যায়। বলি, কারণ এ-রকমই বলা হয়ে থাকে। এ-রকম বললেই সহজে বোঝানো যায়। এ-রকম বললেই কাজ চলে যায়। এই শব্দগুলির বা বাক্যগুলির সহজবোধ্যতা বা কার্যকারিতা তিনশ বছরের পুরনো। এমনকী, আরো একশ বছরও পেছিয়ে যাওয়া যায়। নিজের পরিচয় দেওয়ার ব্যাপারে এত পুরনো কতকগুলি শব্দে নিরাপদ বোধ করা যায়।
ইয়োরোপ থেকে যাঁরা উপনিবেশ তৈরি করতে এসেছিলেন, তাদের কাছে আমরা এই শব্দগুলি শিখেছি। তারা এদেশে এসেছিলেন, আরো নানা দেশে গিয়েছিলেন--আফ্রিকায়, এশিয়ায়। এইসব দেশেই তাদের কাছ থেকে আমরা শিখেছি এইরকম ভাষায় নিজের কাজের পরিচয় দিতে-- আমি গল্প-উপন্যাস লিখি’, ‘আমি একজন ঔপন্যাসিক’। তার আগে তো জানতাম না উপন্যাস কাকে বলে, লিরিক কাকে বলে, ট্রাজেডি-কমেডি কাকে বলে। ইয়োরোপের এই উপনিবেশ নির্মাতারা আমাদের শেখালেন--দেশের অর্থনীতি বলতে বোঝায় শিল্প, দেশের শাসন বলতে বোঝায় গণতন্ত্র, দেশের শিল্প-সাহিত্য বলতে বোঝায় এ-রকম সব ভাগ-উপভাগ-লিরিক, ট্রাজেডি-কমেডি, নভেল। এখন গত তিন-চারশ বছরে এগুলো সাধারণ সত্য হয়ে গেছে। ইয়োরোপীয় আলোকপর্বের এনলাইটমেন্টের ‘আবিষ্কৃত’ এইসব সাধারণ সত্য—বিজ্ঞানের যুগ, যুক্তির যুগ--সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। ধারণা ও জ্ঞানের সেই বিস্তারে শিল্পায়ন, প্রশাসন, শিল্পসংজ্ঞাই যেন প্রধান বাক্য আর ঔপনিবেশিকতা যেন উপবাক্য। কার্তেসীয় যুক্তিবিজ্ঞানের এমনই কৌতুক যে কোন বাহনের মাধ্যমে এই ধারণাগুলি এমন সর্বজনীনতা পেল সে প্রশ্ন যেন অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক, অবৈজ্ঞানিক। এখন, যদি কোনো ভারতবাসী প্রশ্ন তোলেন যে শাহেবরা আমাদের ভাষাগুলিকে তাদের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে বা আমাদের সাহিত্যগুলিকে তাদের তুলনামূলক সাহিত্যতত্ত্বে বা আমাদের ধর্মগুলিকে তাদের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে যে-ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেই ব্যাখ্যাই কেন একমাত্র ব্যাখ্যা বলে মানব, তখন তাকে বোঝানো হবে যে ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম এই সব তো সনাতন বিষয় ; শাহেব এলেও যা, শাহেব না এলেও তা ; কলোনিয়ালিজম বা উপনিবেশবাদ দিয়ে এই সর্বজনীন সিদ্ধাস্তকে খাটো করে বুঝো না। অর্থাৎ উপনিবেশের সুবাদে শাহেবরা যা শিখিয়েছিলেন, সেগুলোই এখন উপনিবেশ-নিরপেক্ষ সাধারণ সত্য হয়ে গেছে। আমাদের এখন বোঝানো হবে যে পরিণতিটাই মুখ্য, পদ্ধতিটা নয়। আমাদের বোঝানো হবে, সভ্যতার বিস্তারে দুই সভ্যতার বিনিময় সব সময়ই উপকারী। আমরাও এগুলো মেনে নিতে পারি। যদি আমরা ‘সভ্যতা’ ও ‘প্রগতি’ ও এ-সব শব্দের অর্থ নিয়ে কান একটু বন্ধ রাখি, বা ‘সভ্যতা প্রগতি" এ-রকম শব্দ ব্যবহারে কলম একটু খোলা রাখি। কিন্তু সবসময় তো সবাই এতটা সুবিধেজনক পদ্ধতিতে কান বা কলম খোলা বা বন্ধ রাখতে পারেন না। তাই এমন কথাও আজকাল উঠছে যে শাহেবরা যে-অঙ্ক আমাদের শিখিয়েছেন তাও সাম্রাজ্যবাদী অঙ্ক”। ১৯৯০-এর ৩২ (২) সংখ্যার ‘রেস এ্যান্ড ক্লাস’ সাময়িকপত্রে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিভাগের অধ্যাপক অ্যালান জে বিশপ তাঁর পশ্চিমি ‘গণিতবিদ্যা : সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের গোপন অস্ত্ৰ’ রচনাটিতে স্পষ্টই বলেছেন, ‘পশ্চিমি গণিতবিদ্যার পরিচয় আবিষ্কার প্রয়োজন, কারণ এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিই, বিশেষত পশ্চিম ইয়োরোপীয় সংস্কৃতিই সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যসাধনে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।’
উপন্যাস কাকে বলে এটাও আমাদের শিখিয়েছেন ইয়োরোপীয়রাই, তাদের অ্যাংলো-স্যাকসন চেহারায়, যদিও ইয়োরোপ মহাদেশে অ্যাংলো-স্যাকসন উপন্যাসের ঐতিহ্য তেমন উঁচু মাপের নয়, কিন্তু আমরা স্কটের কাছ থেকেই যখন উপন্যাস শিখছি, তখন আমাদের হাইল্যান্ড ও ব্যারন না থাকলেও, উপন্যাসে হাইল্যান্ড ও ব্যারন আমাদের তৈরি করে নিতে হল। ১৮৬৫-তে আমরা উপন্যাস লিখতে ও পড়তে শিখি। কলোনির ‘শিক্ষিত প্রজা’র এই শিক্ষার ভিতর কী নির্মম কৌতুক নিহিত ছিল। মাত্র তার বছর তিরিশ আগে সমগ্র বাঙালি ভারতীয় সমাজ অসম দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল-বিধবাদের স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা চালু থাকবে কীনা, এরকম একটি প্রশ্নে। কোম্পানির সরকার যে সতীদাহ নিষিদ্ধ করে একটা আইন বানাতে পেরেছিলেন সে তো মাত্র সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুর সমর্থনের জোরে। ১৮৬৫-র মাত্র বছর দশেক আগে কোম্পানির সরকার বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সমর্থনে বিধবাদের পূনর্বিবাহ আইন সঙ্গত ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। আর ১৯৬৫-তে প্রথম বাংলা উপন্যাসের নায়িকা বিশ্বের কাছে ঘোষণা দিল, ‘ এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর’। এ ঘোষণা মিথ্যা ঘোষণা--যেমন এমন এমনই মিথ্যা ছিল পৃথিবীর অন্যান্য উপনিবেশে ও মহাদেশে। কিন্তু ঘোষণার বিশয়টা যত মিথ্যেই হোক, ঘোষণার ভাষা তো সত্য। যে-ভাষায় এই মিথ্যেঘোষ্ণাকেও তো সত্যের মতই শোনাত। বাক্ আর অর্থের মধ্যে এক ঔপনিবেশিক শক্তি ঢুকে পড়ে তাদের বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে দিয়েছে। আমরা তখন থেকেই আমাদের নিজেদের কাহিনীকার হওয়ার পরিচয় হারাতে শুরু করি। আমরা ধরে নিল্ম--ঐ ভাষা আর ঐ ঘোষণার নামই উপন্যাস। ঐ ভাষা আর ঐ ঘোষণার মাঝখানের ফাঁক দিয়ে ‘অর্থ’ গলে। ইংরেজরা আমাদের এই উপন্যাস শিখিয়েছে। আমরা আমাদের নিজেদের কাহিনী হারিয়ে ফেলেছি।
ব্রতকথা, পাঁচালি, কথকতা, কীর্তনে আমাদের একটা কাহিনীর ধরণ তো ছিল। এগুলোর ছক ছিল বাঁধাছক কিন্তু প্রত্যেকবার প্রত্যেক ব্রতকথা বা পাঁচালিকার বা কথকঠাকুর বা কীর্তিনিয়ায় বলার সঙ্গে সঙ্গে এই কাহিনীগুলি অদ্ভুতভাবে বদলে যেত। এই কাহিনী ভিন্ন কথকের গলায়-ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী হয়ে যেত। একই বাঁধা ছকের কাহিনী এমনই অব্যর্থতায় কাহিনীকারের ব্যক্তিত্বের ছাঁচে আরো একবার ঢালাই হয়ে যেত। যেন ছৌ নাচের মুখোশের অপরিবর্তনীয়তা আর এক নিয়ত পরিবর্তমান ছাঁচের আকার পেত। গল্পগুলো এত চেনা, এত জানা, এত শোনা। কিন্তু সেই গল্প আরো একবার না বললে ব্ৰতপালন সম্পূর্ণ হবে না, ব্ৰত ভাঙা যাবে না। পাঁচালি, কথকতা, কীর্তন সম্পূর্ণ হবে না। এরই ভিতর, সেই অপরিবর্তনীয় ছাঁচের ভিতর কথক তার নিজের প্রায় কেচ্ছা শোনানোর ভঙ্গিতে শিব বা কৃষ্ণের নানা কাহিনী শোনাতে থাকেন, আর সেই প্রক্রিয়াতে ঐ কাহিনীর অপরিবর্তনীয় ছাঁচের ভিতর সমকালীনতা সঞ্চারিত হয়ে যায়। ঐ একই অপরিবর্তনীয় কাহিনীর অর্থের একটা স্তর তৈরি হয়। এই মৌখিক কাহিনীর ধারা ইংরেজ আক্রমণের প্রভাব এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। এড়িয়ে থাকতে পূরেছিল। কলকাতার মত নতুন শহরে আখড়াই, কবি, খেমটা, খেউর-এর মত কীর্তনের নানা ধরন তৈরি হয়েছিল। সঙ্গে বিভিন্ন কাহিনীর দৃশ্য-শ্রাব্য চেহারা ভরে দেওয়া হত। সমকালীনের এ-ছিল কাহিনীগত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ইংরেজরা এইসব কাহিনীর আঙ্গিকের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। আমরাও তাই আমাদের পরিচয় ভুলে যেতে শুরু করলাম। গত শতকের মাঝামাঝি যখন ডিরোজিয়ানরা বাঙালি-ভারতীয় সংস্কৃতির দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন, তখনই এই সমস্ত দেশী আঙ্গিক অব্যবহারে নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে ।
লাতিন আমেরিকায়, আফ্রিকায়, একই ঘটনা ঘটেছে। উপনিবেশ বিস্তারের নানা বৈচিত্রা সত্ত্বেও মনের উপনিবেশ প্রায় সর্বত্রই সমান। ভারতীয় উপনিবেশ, উপনিবেশ সত্ত্বেও ভারতই ছিল। কিন্তু হাজার হাজার বছরের সেই ভাষা-সাহিত্য, দর্শনশাস্ত্র, তত্ত্ববিদ্যা ইত্যাদির ওপর পাশ্চাত্যবিদ্যার আক্রমণ ঘটেছিল এমন সৰ্ব্বাত্মক যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভিতযুদ্ধ নড়ে গিয়েছিল। কবিরাজ আর তার বিধান দেওয়ার জন্য আয়ুর্বেদের প্রাচনীগ্রন্থের চর্চা করতে পারতেন না। স্মার্ত আর তাঁর বিধান দিতে ন্যায়ের প্রাচীনশাস্ত্ৰ ঘাঁটতে পারতেন না। স্মার্ত পণ্ডিতের কথা না হয় থাক। কারণ তিনি যে-সমাজকে বিধান দেবেন সেই সমাজটাই অত্যন্ত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। কিন্তু আয়ুর্বেদ? তার সঙ্গে তো আমাদের বাঁচামরার সম্পর্ক। দর্শনশাস্ত্র, সৌন্দর্যতত্ত্ব বা অন্যান্য তত্ত্বচিন্তা-- সেগুলোর ইতিহাস তো হাজার-হাজার বছর ধরে ছড়ানো। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের প্রতাপ এমনই সর্বব্যাপক যে ঐ হাজার-হাজার বছর মাত্র গুটিকয়েক বছরের হিন্দুস্কুলি-বিদ্যার কাছে অবান্তর হয়ে যেতে পারে।
তবু ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের মতই প্রকাণ্ড বলে আর চীন, চীনের মত দুষ্প্রবেশ্য বলে--প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাম্রাজ্যের লক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ও আমাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের ভিতর সাম্রাজ্যবাদের কার্যকারণ ঢুকে যাওয়া সত্ত্বেও আমাদের ভাষাগুলি আমাদের ভাষাই থাকতে পেরেছে ও সেই ভাষায় যে-সাহিত্য লেখা হয়েছে, তা আমাদেরই ভাষায় সাহিত্য হয়েছে। সেখান থেকে এক নতুন আরম্ভ আমরা চিনে নিতে পারি।
আফ্রিকাতে হয়তো সবটা এ-রকম হয়নি। সেখানে ইয়োরোপীয়রা আফ্রিকার মানুষদের নিজস্ব উপজাতিত্ব আর ভাষা নিয়ে বনেজঙ্গলে থাকতে দিয়েছে, যখন দরকার তাদের শহরে এনে খাটিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাহাজবন্দী করে নিয়ে গেছে শুধু শ্রমিক হিশেবে। ইয়োরোপীয়রা আফ্রিকানদের ভিতর থেকেই একটা 'এলিট' শ্রেণী তৈরি করে নিয়েছে। এই এলিটরা ইয়োরোপীয় ভাষা শিখেছে, সামাজিকতা আয়ত্ত করেছে, শিক্ষা পেয়েছে। বাকি আফ্রিকানদের কাছে এই এলিট আফ্রিকানই হয়ে গেছে লক্ষ, তাদের জীবনযাত্রাই হয়ে উঠেছে দেশের জীবনযাত্রা।
ফলে, স্বাধীন আফ্রিকার দেশগুলিতে এই বিরোধটাই ক্ৰমে প্রবল হয়ে উঠছে--আফ্রিকার ভাষা কি তবে ইয়োরোপীয় ভাষাই? তার প্রধান লেখকরা আচেবে, সোয়ইঙ্কা, অলুকো, ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, লেগুমা--কি ইংরেজি ভাষাতেই লিখে যাবেন, যেমন লিখছেন। নাকি আফ্রিকান উপজাতীয় নিজস্ব ভাষা একটা সর্বজনীন রূপ পাবে—এখন না হলেও, কোনোকালে?
একটা প্রতীকী ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৭০-এর মার্চে জেমস ন্গুগি নাইরোবিতে পূর্ব আফ্রিকার প্রেবাইটেরিয়ান চার্চের পঞ্চম সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, ‘ আমি গির্জার লোক নই। আমি এমনকি খ্রিস্টানও নই।’ তাঁর প্রায় নাস্তিক বক্তৃতা শেষে এক বুড়ো হলের পেছন থেকে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে আসেন। তিনি চিৎকার করে বলেন, “নিজের নামটা তো দিব্যি খৃস্টান রেখেছ, অথচ বক্তৃতা দিচ্ছ ধর্মের বিরুদ্ধে। ‘’ এর আগে কখনও ন্গুগি এই আত্মবৈপরীত্যের কথা ভাবেননি। ন্গুগি তাঁর প্রথম নাম ‘জেমস’ ছেড়ে দিলেন। নিজের নামটাকে আফ্রিকান করে নিলেন-- ‘ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গে’। নামটা বদলালেন ন্গুগি, কিন্তু লিখতে তো হচ্ছে তাঁকে এখনও সেই ইংরেজিতেই, আর, ইংরেজিতে লিখেই তো তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে হচ্ছে আফ্রিকার সত্য--'দি রিভার বিটউইন’, ‘উইপ নট চাইল্ড’, ‘এ গ্রেইন অফ হুইট’।
ক্যারিবিয়ান বা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ বিস্তার কোনও স্থানীয় আভাস বা ভাষাকেই আত্মরক্ষার সুযোগ করতে দেয়নি। সমস্ত দ্বীপপুঞ্জের আদি সমাজ আদি ভাষা কোথায় লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন ইংরেজিই তাদের মাতৃভাষা ও পিতৃভাষা। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তো তারা ইংরেজিভাষী ইয়ােরোপীয় বা আমেরিকার প্রধান ভূখণ্ডের অধিবাসী নয়। অন্যদিকে তারা বংশপরম্পরায় তাদের ঔপনিবেশিক প্রভুদের কাছ থেকে শিখেছে--আফ্রিকার সঙ্গে তাদের সম্পর্কটাই কলঙ্কের। স্বাধীনতার পর তাদের ঘৃণা আর সংলগ্নতার দ্বন্দ্বে নিজ বাসভূমে এক পরবাসীর জীবন কাটাতে হয়। অন্তত তাদের উপন্যাসে সেই পরবাসের কথাই তো বারবার ঘুরেফিরে আসে। নাইপল, ল্যাসিং, উইনটার, প্যাটারসন--এই সব লেখকই এই আফ্রিকান এশিয়ান অতীতের সন্ধানে যান, ইহুদি পুরাণের সঙ্গে তাদের উপন্যাসের গল্পের এত মিল।
আজও ব্রাজিল, সুরিনাম ও ফ্রেঞ্চ গিনিতে পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ ও স্পেনিশ বলা হয়, লেখা হয়। দেশের পর দেশে, মহাদেশের পর মহাদেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে মাতৃভাষা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সন্দেহ হয় যে, সে-মাতৃভাষার সাহিত্যিক পুনরুদ্ধার আর কখনোই সম্ভব নয়।
কিন্তু এই সব দেশেই, আমাদের দেশেও আমাদের ভাষায় ও ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষায় জাতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহিত্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিয়েছে। সাহিত্য, স্থানীয় ইতিহাস, ভূগোল ও জনজীবন কল্পনা করতে ও তাকে আকার দিতে সাহায্য করেছে। বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রেরণা সাহিত্য তো দিয়েইছে, তা ছাড়া, উপনিবেশের প্রজার ভিতরে চিন্তার আলো জ্বলিয়ে তুলতে, তাকে আকার দিতে, সে-আগুনের উৎস হিশেবে সাহিত্য পরাক্রান্ত কাজ করেছে (এডোয়ার্ড ডাবলু সয়ীদ-এর প্রবন্ধ রেস এ্যান্ড ব্লকাস’ কাগজের ৩২(১), ১৯৯০ সংখ্যায়)।
কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা বড় জটিল। কার্পেন্তিয়ার, আস্তুরিয়াস, হুয়ান রুলফো, মার্কোয়েজ, কোর্তাজার, ফুয়েন্তেস ও লাতিন আমেরিকার আরো অনেক লেখক, ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, ইমোস তুতুওলা, আচেবে, সোয়াইঙ্কা ও আফ্রিকার আরো অনেক লেখক তাদের নিজের দেশের ও ভাষার প্রাক্-কলোনি কাহিনীর ফর্ম আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন, যাচ্ছেন। তারা নিগ্রো, ইন্ডিয়ান, মেসতিসো ঐতিহ্যের কাছে গেছেন। লাতিন আমেরিকার কলোনি-উত্তর পর্বের প্রধানতম সাহিত্যিক-পুরুষ কার্পেন্তিয়ার-এর একটি উপন্যাস আছে 'হারানো পথরেখা' নামে। যেমন এক সময় টমাস মানের টোনিও ক্রুগার ইয়োরোপীয় শিল্পের আত্মিক সংকটের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তেমনি কার্পেন্তিয়ারের ‘হারানো পাথরেখা’ লাতিন আমেরিকার লেখকদের আত্মদ্বন্দ্বের এক প্রতীকী কাহিনী হয়ে উঠেছে। কার্পেন্তিয়ার তাঁদের নিজেদের বিষয় সন্ধানকেই তাঁর উপন্যাসের বিষয় করেছিলেন।
চলচ্চিত্রের এক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক তাঁর পেশাগত কারণে অথচ সাঙ্গীতিক এক টানে গিয়ে পৌঁছুলেন ওরিনোকে অরণ্যের গভীরে। সেখানে তখনও এক উপজাতি আছে যারা প্রাক্-কলম্বাস পর্বের গান ও বাদ্য গায় ও বাজায়। এই লুপ্ত পথরেখা খুঁজে বের করা হল। কিন্তু আধুনিক শিল্পী হিশেবে তো তাঁকে ফিরে আসতে হল শহরে যেখানে তিনি সেই সঙ্গীতের সমঝদার শ্রোতা পাবেন। পথরেখা আবার হারিয়ে গেল। সঙ্গীত-পরিচালক আর ওরিনোকোতে ফিরে যেতে পারলেন না--বন্যা আর ধ্বসে ওরিনোকে আবার সঙ্গীত-পরিচালকের কাছে লুপ্ত হয়ে গেল। (কার্পেন্তিয়ার একটা কথা বলতে চেয়েছিলেন--যদি কোনো ঔপন্যাসিক কোনো কথা কখনোই বলতে চান— প্রাক্কলোনি অতীতের সঙ্গে সংযোগ পুনরাবিষ্কার করতে হবে, এবং আবার হারাতে হবে। এই পুনরাবিষ্কারে কোনো মোহ বা অতীত মায়া নেই, এই পুনর্বিরহে কোনো নতুন বেদনা বা বিধুরতা নেই। আমাদের পক্ষে, এই দুটােই সমান সত্য--এই পুনরাবিষ্কার আর এই পুনর্বিরহ। পুনরাবিষ্কার ছাড়া আমরা আমাদের অস্তিত্বের শিকড় খুঁজে পাব না, চিরকাল মেট্টোপলিটান সংস্কৃতির পরগাছা হয়ে থাকব। পুনর্বিরহ ছাড়া আমরা আমাদের অস্তিত্বের আধুনিক সঙ্গতি পাব না, চিরকাল আমাদের অতীতবিলাসী হয়ে থাকতে হবে।
আরব জগতে “কলোনির মানুষের ভিতর থেকে ছড়িয়ে পড়া আলো” যে-সাহিত্য, তার গতি নানা আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে। সেখানে নেগুইব মহাফৌজ, মোহাম্মদ দরবেশ ও আরো কয়েকজন লেখক তাদের নিজেদের দেশেই নিষিদ্ধ। মেহফৌজকে যখন নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো ইজিপ্টের সরকার তখন বেশ অপ্রস্তুত হয়েছিলেন, কারণ ইজিপ্টে মেহফৌজ নিষিদ্ধ। প্যালেস্তাইন যুদ্ধের কর্তৃপক্ষের অন্যতম মোহাম্মদ দরবেশ এতদিনে নিশ্চয়ই বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু এই লেখকরাই ইসলামবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নতুন আরবসত্য আবিষ্কার করছেন। আর সলমান রাশদির মত অনারব লেখক, প্রাক্কলোনি আরব ভাঙিয়ে খাচ্ছেন। এ-কথা মনে রাখা দরকার যে রাশদি ইংরেজিতেই লেখেন ও ইংরেজি-জানা-দুনিয়া ইসলামবিরোধিতা থেকেই তাকে সমর্থন করেছে।
যাঁরা রাশদির সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁরা কেউ কোনোদিন সেই সব আরব লেখকদের সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি যাঁদের আমেরিকার অনুগত ইজরায়েলে বা আমেরিকার বিরোধী লিবিয়া-ইরান-সিরিয়ায় খুন করা হয়েছে। আটকে রাখা হয়েছে, আক্রমণ করা হয়েছে। মেহফৌজ ও দরবেশ আরব বাস্তবতার ভূমিতে দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে রাশদিকে সমর্থন ও করেছেন ও রাশদিকে বিরোধিতা করেছেন। সেখানেই মেহফৌজ ও দরবেশের স্বদেশিক ভিত্তির মহত্ত্ব।
অন্যান্য প্রাক্তন বা আধা-উপনিবেশের সাহিত্যে, বিশেষ করে উপন্যাসে, যে-ধরণের চিন্তাভাবনা কাজ করছে তার এই বর্ণনাতে আমরা নিজেকে কোথায় দাঁড় করাব, আমরা যারা ভারতবর্ষের একটি প্রাদেশিক ভাষায় গল্প-উপন্যাস লিখি কিন্তু সেই ভাষাভাষীর সংখ্যা সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে ষষ্ঠ।
আরব লেখকদের মতই আমাদের স্বদেশ ও সমাজকে আমাদের মত করেই বুঝে নিতে হবে--আমাদের স্বদেশের অখণ্ডতা ও সমাজের বহু বৈচিত্র্যকে। আর এই বুঝে নেওয়ার কাজটিই আমাদের এক অনুত্তরণীয় দ্বন্দ্বের মধ্যে ঠেলে দেয়। ইয়ােরোপীয় উপন্যাসের মডেল আমাদের স্বদেশিক অখণ্ডতাকে একটা ছাঁচে ফেললেও, সেই অখণ্ডতা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। আর আমাদের সামাজিক বহুবৈচিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণাও ধ্বংস করে। ইয়োরোপীয় সেই মডেল আমাদের স্মাজের মানুষ ও সেই মানুষের জীবন বুঝে নেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যখন আমাদের আদিবাসী জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখি তখন সেও হয়ে দাঁড়ায় ইয়ােরোপীয় মডেলের নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস, সেও শাহেবরা যে রকম শিখিয়েছিল। ভারতের প্রধান মানবধারার অন্তর্গত হয়ে সেই আদিবাসী আসে না।
উপন্যাসের ফর্ম বা মডেল বলব কাকে? ঔপন্যাসিকের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে যা উপন্যাসে পরিণত করে সেটাই তো ফর্ম। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে গল্প-উপন্যাস লেখার নানা চেষ্টায় বারবার হয়তো এখানেই ঠেকে গেছি। ঠেকে যে গেছি তাও সব সময় বুঝিনি, বুঝি না। এখন যখন নিজের অতীতটাকে একসঙ্গে দেখার মত চড়াইয়ের দিকে চলছি আর সেই চড়াই থেকে যতই চোখের সামনে বাংলা উপন্যাসের সমতল বিস্তৃততর হচ্ছে, ততই অসহায় ও ক্ষমতাহীন ক্ষোভে বুঝতে পারছি--ইয়োরোপীয় মডেলে আমাদের পরিত্রাণ নেই। আমি আগেও বলেছি, কাহিনী বলার একটা নিজস্ব ধরণ আমাদের ছিল পাঁচালি, কথকতা, কীর্তন আর কবিগান। এই সব ধরন কী ছিল তা আন্দাজ করাও আজ কঠিন--অপরুচির উদাহরণ হিশেবে এই সব প্রকরণকে এমনই অবশেষহীন লোপাট করে দিয়েছে ইঙ্গনেসান্সের আত্মগৌরব-পুষ্ট হিন্দু ও ব্রাহ্মণরা। রাজধানীর নেপথ্যে জনরুচি ক্লিন্ন আত্মরতির কামনায় এই ফর্মগুলিকে আবিষ্কার করেছিল--এই শিক্ষা এতদিন আমাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন একবার উল্টো দিক থেকে ভাবা দরকার। নব্য রাজধানী কলকাতার দেশি নেপথ্যে এগুলো ছিল জনপ্রতিবাদেরই এক-একটি ধরন, প্রতিরোধহীন জনপ্রতিবাদের এক-একটি ধর্ন। এমনকী যাকে বলে সমাজের এলিট, তাদেরই আঙিনায়, ঠাকুরদালানে এসব বলা হত, গাওয়া হত। তাঁরাই টাকা-পয়সা দিয়ে এই সব গানের দলকে বঁচিয়ে রাখতেন। তাদের বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত এই সব কাহিনী শুনত। তারপর, সেই সম্ভোগের শেষে তারা এই ফর্মগুলিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিলেন। ততদিনে ইংরেজ আমাদের ছাপাখানা দিয়েছে, বাংলা হরফে বাংলা গল্প আমরা পড়তে শিখেছি।
কিন্তু আমার তাত্তিক জ্ঞান এই পর্যন্তই। অথবা ইতিহাসের কিছু তথ্যকে একটু উল্টোপাল্টা করে নিয়ে আমি যদি কোনাে তত্ত্ব বানিয়ে তোলার চেষ্টা করি, তাও এইখানেই শেষ। এর বেশি আমি কিছু জানি না। জানার উপায় নেই। আমি চাইলেও তো এখন আর মঙ্গলকাব্য লিখতে পারব না, কথকতা লিখতে পারব না। মঙ্গলকাব্য আর কথকতার সঙ্গে আধুনিকতার সব সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। কার্পেন্তিয়ারের উপন্যাসের আদিবাসীরা জীবনের সঙ্গে আর তাদের বাসভূমির সঙ্গে যে-সংরাগে বাঁধা ছিল, শেষ-আঠারো শতকে বা আদি উনিশ শতকের কলোনির শহর কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি সে-সংরাগে তার বাসভূমির সঙ্গে বাঁধা ছিল না। প্রথম থেকেই তো সে নিজ বাসভূমে পরবাসী, প্রথম থেকেই তার ঘর হইতে আঙিনা বিদেশ। সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়ে সেই পরাশ্রয়ী অস্তিত্বের লোভ এত প্রবল আর ক্ষমতা এত কম যে লোকশিল্পকেও সেই শহুরে জীবন গ্রাস করে নিয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের মত দেশে লোকজীবনও এত বিচিত্র, জটিল ও বিস্তৃত যে সাম্রাজ্যবাদের আশ্রিত মধ্যবিত্তও তা শেষ করে দিতে পারেনি। এই সেদিনও তো মীরা মুখোপাধ্যায় মধ্যপ্রদেশের বস্তার হুমকির শিল্পকে উদ্ধার করে আনলেন এক নতুন ভাস্কর্যের প্রথম ভিত হিশেবে।
আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আমি শুধু একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পসংকটের কথা ভাবছি—এমন কোনো ঔপন্যাসিক যে আজ বা আগামীকাল উপন্যাসের এমন এক ভাষার অধিকার চাইতে পারে যে-ভাষায় তার কথা সত্য মনে হবে, বানানো মনে হবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পসংকটের কথা ভাবছি যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে সে যে-বাক্যটি রচনা করবে। আর সেই বাক্যের ভিতরে যে-অর্থটি ভরে দিতে চাইবে তার মাঝখানে একমাত্র সংযোজক হিশেবে সেই থাকবে লেখক হিসেবে, কথক হিশেবে; সে কখনো কলোনির প্রজা হিশেবে কলোনির কোনো শিক্ষা তার বাক্যের ভিতরে ভরে দেবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের কথা ভাবছি যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে--সে স্বাধীন, তার লেখা স্বাধীন, ও সেই লেখায় নিহিত অর্থও স্বাধীন।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পপাঠে এই ধরণের লেখা আরো প্রকাশিত হোক।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লেগেছে।নতুন করে ভাবছি এই লেখাটি পড়ার পর থেকে।