সাদিয়া সুলতানা'র গল্প : যে জীবন তার না



১.

এবার নাসরিনের একটু লজ্জাই লাগে। মেয়েটা বোতলের মুখ চাটতে চাটতে খুনখুন করে কাঁদছে। এক ফোঁটা জুস ঠোঁটে লাগতেই চকাস চকাস আওয়াজে বারবার জিহ্বা চোষে রিনা। মেয়ের কথা ভুলে গিয়ে এক ঢোকে জুসটুকু খানিক আগে গলায় ঢেলেছে নাসরিন।

বালিরঙা নিথর আকাশের মাঝে কোনো মেঘ নেই। রোদের উত্তাপও নেই। কিন্তু আকাশজোড়া থমকে থাকা আলোর ঝলক চোখে লেগে চোখ ক্ষয়ে আসে। সাথে কেমন একটা গুমোট ভ্যাপসা গরম। এই ভ্যাপসা ভাদুরে গরমে অস্থির হয়ে জুসটা একাই খেয়ে নিয়েছিল নাসরিন। সকাল থেকে দু’টাকা এক টাকা পেতে পেতে যখন মনটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল হঠাৎ এক লোক বিশ টাকার কচকচে নতুন একটা নোট দিতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে জুসটা কিনেছিল নাসরিন। ভিক্ষে করতে করতে গরমে গলা শুকিয়ে এসেছিল। কোলে থাকা রিনার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে এক ঢোকে গিলে খেয়েছে সবটা। কী বেহায়া মা সে! আরেকটা কিনবে নাকি? ওড়নার শেষপ্রান্তে গিঁট মেরে কয়েকটা নোট এখনো রাখা কিন্তু টাকা কয়টা শেষ হলে তো মহা সর্বনাশ। বরং চাম্পাকে পেতে হলে আরো শ'দুয়েক লাগবে। 

তোফায়েল শয়তানটা আজকাল মহাখচ্চর হয়েছে। টাকা ছাড়া মাল হাত দিয়ে গলে না হারামীটার। আগে তবু নাসরিনের শরীরের জন্য ছোঁকছোঁক করে বিশ-ত্রিশ টাকা কম নিতো। আজকাল নাসরিন শরীর পেতে দিলেও হারামীটা চোখ তুলে তাকায় না। তাকাবে কী! নাসরিনের কী আর সেই শরীর আছে! 

হঠাৎ ওর নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করে। আকাশের মতো ধূসর আর পান্ডুর মুখটা আয়নায় দেখে চমকে ওঠে নাসরিন। মার্কেটের পার্কিংপ্লেসে দাঁড়ানো বিশালাকার একটা গাড়ির গ্লাসে হাত রেখে নিজের গালে হাত বুলায়, আহারে রঙটা পুড়ে গেছে! মলিন স্বাস্থ্য, চোখের কোণে ময়লা, ঠোঁটের দুই কোণে ঘা। রুক্ষ চুলের রাশি আর অমসৃণ ত্বকে আয়নার উপর দিয়ে হাত বুলালে মসৃণই লাগে। তবু নিজের শ্রীহীন মুখখানা দেখে নাসরিন বড়ো বেদনার্ত হয়ে যায়।

-সর মাতারি! গ্লাস ময়লা করস ক্যা! 

নাসরিনের ইচ্ছে করে ড্রাইভারের মুখে থুতু মারে। কিন্তু শুষ্ক জিবে থুতু নেই দেখে সে মুখ চালায়, 

-ওরে আমার রসের নাগররে, ময়লা খাতি মন চায়রে! 

নাসরিনের ঠোঁটের ভঙ্গির অশ্লীলতায় বিব্রত ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি নিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে। নাসরিন হাসে। মায়ের হাসির শব্দে কোলে থাকা দেড় বছর বয়সী রিনাও হাসে সশব্দে। মায়ের আমোদ যেনো পুরোটাই ধরে ফেলেছে সে। জুসের ভাগ না পেয়ে মায়ের উপর ঘনিয়ে আসা অভিমানটুকু উড়ে যায় এক নিমিষে। নাসরিন মেয়ের গালে চুমু খায়, হাসেরে আমার মাটা। পরির লাহান হাসে।

প্রশ্রয় পেয়ে মায়ের বুকে মুখ ঘষে রিনা। যদিও সে জানে অমৃতরস পাবে না। তবু নিজের শুষ্ক, অস্থির ঠোঁট মায়ের অনুচ্চ বুকে রাখে। কাপড়ের উপর দিয়েই নিজের দাবী জানাতে খানিকটা কাপড় মুখে পুরে নিয়ে চুষতে থাকে। মেয়ের আদরে দিশেহারা নাসরিনের চোখ ভরে পানি আসে। আজব দুনিয়া! বিস্মিত নাসরিন চোখ মোছে। এই জিবের পানি শুকায় কিন্তু চোখের পানি শুকায় না।

ভাদ্রের আকাশ বৈচিত্র্যহীন আকাশকে বিশ্বাস নেই, মানুষের মনের মতো রঙ পাল্টায়। বেলা ঘুরতে না ঘুরতে আকাশের ভাঁজে ভাঁজে মেঘের বুনন দেখা যায়। বিদ্যুৎ চমকায় যেন মেঘ বাজে মুহুর্মুহু। যেন আকাশের কোটরে বন্দি ঝড় ডানা ঝাপটায়। মেঘের বাতাস শরীরে লাগতেই অপ্রস্তুত লোকজন পায়ের গতিপথ পাল্টায়। নাসরিন মেয়েকে নিয়ে লোকজনের পিছু পিছু তাদের গতিতে ছোটে, যদি কিছু পায়। 



২.

লোকজনের হাতে টাকা অনেক কিন্তু খরচের রাস্তাও অনেক। ফকিরশ্রেণির পিছনে নিয়মিত খরচ করে কিছু মানুষ। দুনিয়াদারীর হিসেবনিকেশের ভয় ছাড়াও পাপমোচনের নানা কায়দা-কানুন ভালোই জানে এসব মানুষ। নাসরিনেরও ম্যালা পাপ, একটাই সুবিধে পাপমোচনের কোনো গ্লানি তার ভেতরে কাজ করে না। বরং জাতে ওঠা মানুষজনের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে নাসরিনেরও জাতে উঠতে ইচ্ছে করে। খরচের রাস্তাগুলোতে অঢেল খরচ করতে ইচ্ছা করে। যে জীবন তার নয় সে জীবনের বাসিন্দা হবার স্বপ্ন দেখার সুখ অদ্ভুতভাবে নাসরিনকে আকৃষ্ট করে। নেশা করে স্বপ্নবিভোর ঘুমে এতই মশগুল থাকে যে, রাতে রিনা যখন মাকে খামচে ধরে কাঁদে, গোঙায় তখন সে কিছুই টের পায় না। মায়ের মনোযোগ না পেয়ে বেশিরভাগ দিনই রিনা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়, কখনো কখনো নাসরিনের মাতৃত্বকে অভিশাপ দিতে দিতে পাশের ঝুপড়ির রতনের মা এসে এক বাটি ভাত ডালের সাথে চটকে রিনাকে খাইয়ে যায় নইলে কবে রিনার অইটুকুন শরীর ফুরিয়ে যেত। 

নাসরিন মেয়েকে কোলে করে একটা করলা গাড়ির ঝকঝকে গ্লাসে হাত রেখে অনেকক্ষণ ধরে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। জ্যামে আটকা গাড়িটির পিছনের সিটে বসে এক সুন্দরী মেয়ে নিবিষ্ট মনে মোবাইল দেখছে কিন্তু কিছুতেই নাসরিন মেয়েটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। গাড়ির ড্রাইভার এক-দুইবার মাছির তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে নাসরিনকে তাড়ানোর চেষ্টা করে তবু নাসরিন সরে না। উল্টো গাড়ির গায়ে ও হেলান দিয়ে থাকে। কখনো কখনো বড়লোকদের সুখে বাগড়া বাঁধিয়ে নাসরিনের খুব নির্মল আনন্দ লাগে। যতক্ষণ মেয়েটা ওর দিকে না তাকায় ততক্ষণ ও এক পাও সরবে না ভেবে নাসরিন নিয়ত করে রেখেছে। হঠাৎ মেয়েটা ওর দিকে তাকায়। নাসরিন কাতর চোখে হাত বাড়ায় কিন্তু মেয়েটি কীসব বিড়বিড় করে নাসরিনের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকায়। জ্যাম ছুটতে শুরু করে গাড়িটি খানিকটা এগোতেই বিদ্যুতের চমকের মতো নাসরিন হাতের মুঠোতে লুকানো লোহার সরু পাতটা দিয়ে গাড়ির জানালার গ্লাসে হাঁচকা টান মেরে উধাও হয়ে যায়। পিছনে শুধু হৈহৈ শোনা যায়। নিরাপদ দূরত্বে চলে এসে নাসরিন রিনাকে চুমু খেতে খেতে হাসে, বড়লোকের ছেড়ির দেমাগ কত! দাগের ঠ্যালা বোঝ।

কারো দাগহীন জীবনে দাগ ফেলতে পেরে নাসরিনের আজ সুখের যেন সীমা নেই। সুখে সুখে গানের কলি আওড়াতে আওড়াতে রাস্তার পাশের সস্তার হোটেলে ঢুকে ভাত-ডালের অর্ডার করে। মায়ের সাথে ভাত খাবার আনন্দে মিশু সারল্যে রিনা হাসে, এঁটো মুখে মায়ের গাল চাটে। অনেকদিন পর ভরপেট খেয়ে রিনা মায়ের বুকে ঘুমিয়ে যায়। 

নাসরিন ভাবে আজ একটু স্থির হবে। নিজের তো আর কোনো জাত নেই। তবু দিন শেষে ঘরে ফিরে সাবান ঘষে গোসল করবে। চুলে শ্যাম্পু করে সাফ করবে। আহা, এই শরীরের জন্য কতো পুরুষ যে পাগল ছিল! হালকা বাদামি গায়ের রঙের মুখশ্রীর সাথে মসৃণ, নিখুঁত ভাঁজের শরীর ছিল নাসরিনের। নাসরিনের শরীরের বাঁকে বাঁকে পুরুষের দৃষ্টি আটকে থাকতো। ও হাসলেই রক্তিমাভা ছড়িয়ে ওর যেতো কোমল গালে। নাসরিনও যেনো প্রতিদিন সচেতনভাবে নিজের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলতো। পার্লারে গিয়ে চুলের কাট বদলাতো দুমাস পর পর। দৈহিক সৌন্দর্যে সাথে সাথে আপাতসুখ চর্চাকে উপভোগ করতে করতে নাসরিনের জীবন একসময় বর্ণিল হয়ে উঠেছিল। 

দিনকে দিন নিজেকে রাজরাণী মনে হতো ওর। আশেপাশের প্রেমিকদলের নতজানু চেহারার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল নেশাগ্রস্থ বন্ধুর ভিড়। নাসরিনের উজ্জ্বল দুচোখ কবে যে রঙিন স্বপ্ন গ্রাস করে নিলো নাসরিন টের পায়নি। শুধু আবছা আবছা মনে আছে একদিন বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। বাড়িতে নাকি নোংরা আবর্জনার স্থান থাকতে নেই। এমনিতেই অভাবের সংসারে থাকার কোনো ইচ্ছে ছিল না ওর। কিন্তু দারিদ্র্যের প্রতি আকর্ষণহীনতা যখন ওকে আরো দরিদ্র করে তুললো তখন নাসরিন অন্য মানুষ হয়ে উঠেছিলো। সে নিজেও জানে না কবে সে মানুষের কাছে শরীরের সাথে সাথে হাত পেতেছে। 

মানুষের জন্মের অর্থ কি বোঝে না নাসরিন। সবই যদি ওই উপরে বসে থাকা কারো অলঙ্ঘনীয় ইশারাতেই হয় তবে কেন মানুষ নিজের কপাল পাল্টানোর জন্য অত চেষ্টা-তদবীর করে! কপাল ঘষে কপাল আলো করে লাভ নেই বলে নাসরিন আর সেপথে হাঁটে না। 

ফুটপাতে, রেল-স্টেশনে, ওভারব্রিজের উপরে কাটানো ভাসমান মানুষের সাথে চলতে চলতে একদিন মা হয়ে যাওয়ায় ওর জীবনে কোনো আনন্দযোগ না হলেও তবু রিনার উপস্থিতি ওকে নতুন করে শক্তি যোগায়। মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুরলে আয়-রোজগার মন্দ হয় না। আবার মাঝেমাঝে রিনার হাসি বুকের মধ্যে কী এক আবেগ উথলে দিয়ে ওকে মা করে তোলে।

-কী রে মাইয়ার বাপ কী করে রে?

-যা মলে তা করে, তর কী?

-হুনি না!

-তর বাপ কী করে আমি জিগাইছি?

-অই আমার বাপ তুলে কথা কছ মাগী। কোলেরটার লাহানতো নিজের বাপের ঠিক নাই।

-বাপের ঠিক নাই তাতে তর কী? তর বাপরে হাঙ্গা করছি আমি! হারামি!

রিকশাওয়ালা রিকশা টান মেরে চলে গেলেও রিনাকে বুকে চেপে নাসরিন বাতাসের সাথে ঝগড়া করে। নিজের একগুঁয়েমির জোর গলায় মানুষের হৃদয়হীনতা ঢেকে দেয়। 

কোর্ট কোর্ট ডাক তুলে একটা অটো পাশে দাঁড়ায়। নাসরিন উঠে পড়ে। হরগ্রাম বাজারে যাবে। কিছু কেনা-কাটা করবে। নিজের শরীরটাকে হুট করে ওর ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। রিনা ঘুমিয়ে পড়েছে। নাসরিনের পাশে একটা উঠতি বয়সের ছেলে ওর কাছ থেকে বেশ শরীর বাঁচিয়ে বসেছে। দেখে নাসরিনের হাসিই লাগে। নাসরিন অস্পৃশ্য! অথচ সে জানে তার নারী শরীরের কদর এখনো কমেনি। এখনো সন্ধ্যের পরে চাম্পাকে গিলে যখন ঝিম মেরে পড়ে থাকে টের পায় আলগোছে কোনো শক্ত হাত ওর বুক, নিতম্ব হাতিয়ে যায়। কোনো কোনো গাঢ় অন্ধকারের রাতে শরীরের গোপন সুড়ঙ্গ খুঁড়তে অচেনা পুরুষ ইশারায় ডাকে। কিন্তু রাস্তাঘাটের খদ্দেরের অবস্থা ওর পকেটের মতোই সঙ্গীন। আজকাল শরীরে পোষায় না বলে রিনা কোলে আসার পর থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতেই ও থিতু হয়েছে। নাসরিনের পরিচিত দু’একজনের সাথে দেখা হলে তারা আজকাল ওকে চেনে না। না চেনারই কথা। যারা চেনে, তারা ওকে তাদের জীবনে নেয় না। নাসরিন নিজেও জানে, এ জীবন ওর না। 


৩.

আত্মবিস্মৃত নাসরিন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় তোফায়েলের দিকে এগোতে থাকে। নাসরিনের অবস্থা দেখে মেঝেতে আধশোয়া তোফায়েল লুটোপুটি খেতে খেতে হাসে।

-তোরে চিপলে তো এক ফোঁটা রসও বাইরাইবো না নাসু! চাম্পাতো ছিবড়া কইরা কবেই ছাইড়া দিছে তোরে। আমাগো লেইগা তো একটুসও রাহে নাই।

মুখ দিয়ে চুক চুক করে আওয়াজ করে তোফায়েল। যেন পোষা কুকুরকে সান্ত¦না দিচ্ছে। তোফায়েলের হলদে দাঁতগুলো বাইরে বেরিয়ে এসেছে। 

-তোরে দলাই-মালাইয়ে আর সুখ নাইরে নাসু। তয় তোরে আইজ ফ্রিতে চাম্পা দিমু। বহুত সুখ পাইছিরে। আহারে! মজাই মজা! সুখই সুখ!

যেন নাসরিনের শরীর ভোগের চেয়ে নাসরিনের নির্লজ্জ নিবেদন বেশি শরীরী সুখ দিচ্ছে তোফায়েলকে। নাসরিনও হাসে। সেই হাসি কান্নার চেয়েও করুণ দেখায়। কেমন প্রাণহীন, নিদ্রাচ্ছন্ন কাতর মুখ নাসরিনের। তড়িঘড়িতে কামিজটা গায়ে জড়াতে যেয়ে গলায় আটকে যায়। আধা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকা একটা বোতাম খুলে মেঝেতে পড়ে যায়। গলার কাছে ঝুলে থাকা কামিজে ওর শীর্ণ স্তনজোড়া বেকায়দাভাবে দৃশ্যমান হয়ে কী যেন মিনতি করে। তা দেখে তোফায়েলের হাসি আরো বেড়ে যায়। রিনা গভীর সমবেদনা নিয়ে মায়ের কাছে এগিয়ে আসে। মায়ের মূল্যহীন বুকে মুখ রাখে কোনো মূল্যবান রত্নের প্রত্যাশায়। মিনিটখানেক চেষ্টা করে এক ফোঁটা দুধও না পেয়ে রিনার মমতা বদলে যায় চরম আক্রোশে। মায়ের ডান স্তনে কামড় দিয়ে মাংস ছিঁড়ে ফেলতে চায়। 

মেয়ের অযাচিত আক্রমণে কী এক অন্তর্গত বেদনায় নাসরিনের বুক চিরে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে, আহ!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ