মোহছেনা ঝর্ণা
"মরা তেলাপোকার গায়ে অসংখ্য পিঁপড়ের মতো অসংখ্য নৌকা নদীর তীরে আঁকড়ে পড়ে আছে। তাদেরই মধ্য থেকে একটা নৌকা তীর হতে খসে পড়ে। দিগন্তের ওপার থেকে পয়গম্বরের এবং মানুষের খোদা যদি সেসময় উঁকি মেরে দেখতেন তখন তাঁরও মনে হত তেলাপোকার মৃতদেহ ছেড়ে একটি পিঁপড়েই বুঝি খসে পড়েছে।" উপমা, শব্দ চয়ন আর বাক্যের গভীরতা কি অদ্ভুত ভাবে নাড়া দিয়ে যায়। বলছিলাম অসামান্য শিল্পী সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর গল্প "কেরায়া"র কথা। কয়েকটা বাক্যে জীবনের গূঢ় রহস্য কী চমৎকার করে উন্মোচন করে দিলেন পাঠকের সামনে। ওয়ালী উল্লাহর গল্পের এক দুর্বার আকর্ষণ আছে। একই গল্প বারবার পাঠ করা যায়। প্রতিপাঠেই নতুন করে মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকি। যে গল্প জীবনের কথা বলে সে গল্পের প্রতি মোহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
ওয়ালী উল্লাহর প্রায় গল্পেই উঠে এসেছে নদীর কথা। মাটির কথা, মাটির মানুষের কথা। কেরায়া গল্পেও আছে নদীর কথা। নদীর পারে নৌকা নিয়ে বসে থাকে দু'জন মাঝি। ফুটফরমাশ খাটার জন্য মাঝিদের সাথে নৌকায় একটি এতিম ছেলেও আছে। মহাজনের গুড়ের কেরায়া নিবে বলে তিন দিন ধরে তারা নদীর কিনারে অপেক্ষা করে আছে তো আছে। কিন্তু মহাজন তার গুড় নিয়ে আসেনি। নদীতে অন্য কেরায়া নৌকা এসেছে, আবার কেরায়া নিয়ে চলেও গেছে, কিন্তু তারা বসে আছে মহাজনের জন্য।
লেখকের বর্ণনায় উঠে আসে, "তাদের দু-ধারে অন্য কেরায় নৌকা এসেছে, নোঙর ফেলেছে, আবার চলে গেছে। তীরে হাট বসেছে, ক্রেতা- বিক্রেতার ভিড় হয়েছে, কেনা চলেছে, তারপর একসময় সে হাটও ভেঙেছে। তারপর নিত্যকার মতো শূণ্য ভাঙা - হাটে নেড়ি কুত্তাগুলি ঘেউ ঘেউ করে লড়াই করেছে, ঘাসশূন্য মাঠে দমকা বাতাসে ধূলোর ঘূর্ণি উঠেছে, বৃহৎ গাছটি থেকে মরা পাতা ঝরেছে নিঃশব্দে। মহাজন ফিরে আসে নাই, তাদের যাওয়াও হয় নাই।"
এদিকে নৌকায় হঠাৎ করে কোথ থেকে এক মুমূর্ষু বুড়োমানুষ এসে নৌকার ছইয়ের নিচে ঢুকে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। বুড়োটি মাঝিদের পরিচিত নয়। তবু সে মাঝিদের কাছে তার জীবনের শেষ বাসনার কথা বলে। সে নিজের গ্রামে, নিজের মানুষদের সান্নিধ্যে থাকতে চায়
। মাঝিরা বুড়োর কথায় সম্মতি কিংবা বিরক্তি কিছুই প্রকাশ করে না। তারা তখনো মহাজনের গুড়ের কেরায়া নেয়ার আশার পথ চেয়ে থাকে।
বুড়োটার মূমূর্ষ অবস্থা দেখে মাঝিরা খুব একটা ভাবিত হয় না।বরং কেরায়া না পাওয়ার কারণে কাল তাদের শূণ্য হাতে বাড়ি ফিরতে হবে, বাড়িতে তাদের জন্য এক বুক আশা নিয়ে বউ,বাচ্চাসহ পরিবার পরিজনেরা অপেক্ষা করে আছে। তারা খাবার নিয়ে ফিরবে এই বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে। লেখক তাদের অপেক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, "পাখির ছানার মতো নীড়ের নিরাপত্তায় গভীর বিশ্বাসে তারা অপেক্ষা করে"। কিন্তু প্রতিবার তারা খাবার, পয়সা-কড়ি কিংবা একটু আধটু উপহার নিয়ে ফিরতে পারে না।তখন তাদের মনের অবস্থা লেখকের ভাষাতেই উঠে আসে স্পষ্ট, "তখন তাদের ভেতর থাকে শুষ্ক -ভীতি, কেমন একটা কম্পমান, বুক জুড়ে নিঃসহায় ভাব। হয়তো ভেতরে - বাইরে তখন কিছুই থাকে না। নিঃসীম আকাশের মতো তখন সবই ফাঁকা, শূন্য মনে হয়।এ সময় তারাও হয়তো পাখি- ছানার মতো ছোটই হয়ে পড়ে।" লাইনক'টা কেমন মর্মস্পর্শী বেদনার অনুভব ছড়িয়ে দিয়ে গেল।
মহাজনের অপেক্ষায় তারা আরেকটি রাত পার করে। নিঃশব্দ কালো স্রোতের মতো নিঃসীম রাত। গভীর রাতে নদীর তীরে হঠাৎ শব্দ হলে তাদের মনে আবার আশার সঞ্চার হয়, মহাজন আসল কি! কিন্তু, না, মহাজন আসেনি, কেউ আসে নি। বরং রাতের অন্ধকার ভেদ করে একটা প্যাঁচা বেরিয়ে আসে। প্যাঁচার আওয়াজে মাঝি দুজনের মনে হঠাৎ করে আখেরাতের ভয় জেগে ওঠে।
রাতের তৃতীয় প্রহরে মুমূর্ষ লোকটির হঠাৎ ঘুম ভাঙে। তার পাশে শুয়ে থাকা এতিম ছেলেটিকে দেখে তার নিজের মৃত ছেলের কথা মনে পড়ে। যে ছেলেকে সাপে কেটেছিল। যে ছেলের জন্য শীতে বুড়ো একটা লাল ডোরা কাটা জামা কেনার কথা চিন্তা করেছিল। কিন্তু শীতের আগেই ছেলেটি মারা গেল। বুড়োর মনে কি খেয়াল চাপে, সে ঘুমন্ত ছেলেটির অনাবৃত বুকে আলতো করে খোঁচা দেয়। যেন ছেলেটির ঘুম ভাংগে। কিন্তু ছেলেটির ঘুম ভাঙে না। কয়েকবার খোঁচানোর পর হঠাৎ বুড়োর মনে হয়, সবই যেন মৃত্যুঃ রাতটি, নিচে কাঠের পাতাটন, তারপর ছেলেটি। সব মরে ভূত হয়ে আছে।
এরমাঝেই জীবন- মৃত্যুর এক অপূর্ব দর্শন নিয়ে হাজির হন লেখক, "মৃত্যু জীবনের মতো নয়। তার না আছে জীবনের অনুভূতি না রসবোধ।"
একসময় বুড়োটি সজোরে এতিম ছেলেটির বুকে লাথি মারে। এবার ছেলেটি জেগে ওঠে। বুড়োটির মনে নিজের ছেলের জন্য হাহাকার জেগে ওঠে তা বোঝা যায়, বুড়োটি এতিম ছেলেটিকে গভীর মমতা নিয়ে বাপজান বলে ডাকে। ঘুমন্ত ছেলেটি সে ডাকে সাড়া না দিলে বুড়োর আবার বিভ্রম হয়।বুড়োর মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নের কখনো শেষ নাই, স্বপ্ন কারো পিছু ছাড়ে না।
রাতের কোন প্রহরে বুড়োটি মারা যায় তা জানা যায় না। কারণ যখন ভোরের রক্তিম সূর্য উঠে আরেকটি নতুন দিনের সূচনা হয়, সেই নতুন দিনের আলোয় মাঝি দুইজন নৌকার ছইয়ের ভেতর বুড়োটির মৃত দেহ দেখতে পায়। তবে রাতের তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত বুড়োটি বেঁচে ছিল। মৃত দেহ দেখে মাঝিদের যে খুব বেশি ভাবান্তর হয় না তা বোঝা যায় "তারা হাই তোলে" ছোট্ট বাক্যটি দিয়ে। তারা নোঙর তুলে যাত্রা শুরু করে। যাত্রা পথে একজন মাঝি মৃতদেহটির গা ঘেঁষে ঘুমায়। অন্য মাঝি হাল টানে। একটা সময় হাল টানা মাঝি গিয়ে মৃতের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে। অন্য মাঝি দাঁড় বায়। জীবিত এবং মৃত দেহ দুটিকে পাশাপাশি দেখে মনে হয় দু'জনই ঘুমাচ্ছে। কিংবা দুটি মৃত দেহ পড়ে আছে। কেমন কঠিন এক নির্মমতার স্থিরচিত্রের মতো দৃশ্যপটটি চোখে ভেসে ওঠে!
তবে এই মাঝিদের মনে যে তবু কিছু মায়া, দয়া, মানবতা আছে তা বোঝা যায় কারণ তারা বুড়োর মৃতদেহটি তার গ্রামে নিয়ে আসে। আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায় এবং তাদের মনে হয় যদি তারা মহাজনের কেরায়ার জন্য অপেক্ষা না করত হয়তো তারা মুমূর্ষু বুড়োটিকে জীবিত অবস্থায়ই তার স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারত।
বুড়োর লাশ কাঁধে নিয়ে তার স্বজনরা ধীর গতিতে গ্রামের দিকে রওনা হয়। বউঝিদের কান্না, বিলাপ শোকের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে অনেকটা সময় পর্যন্ত।
কেরায়া না পাওয়া নৌকার মাঝিরা পুনরায় অনিশ্চিত গন্তব্যকে সংগী করে যাত্রা শুরু করে। সংগে থাকে এতিম ছেলেটি। তাদের সেই অনিশ্চিত গন্তব্যে আমরা পাঠকরাও মুমূর্ষু বুড়োর মতো হঠাৎ তাদের নৌকার ছইয়ের ভেতর উঠে পড়ি। ছলাৎছলাৎ শব্দে নৌকা দুলে ওঠে। আমরাও দুলতে দুলতে কেরায়া নৌকার মাঝিদের সাথে চলতে থাকি দূর অজানায়। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জীবন বোধও দৃষ্টি এড়ায়নি লেখকের। মানস চোখ দিয়ে শুধু দেখেনই নি, অনুভবও করেছেন বঞ্চিত মানুষদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মানবতা, যা দারিদ্র্যের কবলে নিষ্পেশিত হয়ে ঠিক ভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারে না, তবে অন্যকে বঞ্চিত করার কৌশলও জানে না।
0 মন্তব্যসমূহ