সা-রে-গা
বইদ্যার হাট যখন তার ছোট্ট শরীরে ভাণ্ডারীকে বেমালুম এঁটে নিলো, তখন না ভাণ্ডারী নিজে, না বইদ্যার হাটের গোটা পনের পান-বিড়ি-দর্জি-কেরোসিন-পেঁয়াজুর দোকান টের পেলো কিচ্ছু।
চিরকালের মতোই দোকানগুলো দাঁড়িয়ে ছিলো ¯স্নানের তৃষ্ণা নিয়ে। শরীরে তাদের কত কত বছরের ধূলো, স্যাঁতা পড়া দাগ, ভাঙা পড়ো-পড়ো অবয়বে ল্যাপ্টে আছে জলস্মৃতি। তবু হাটের পাশে দাঁড়ানো আকাশের সমান উঁচু প্রতাপ ডাক্তারের সমাধি-মুকুটের চূড়ায় যদি কোন রকমে উঠে পড়া যায়, উঠে চোখ রাখা যায় বইদ্যার হাটের দিকে, মনে হবে - দু সারি দোকান যেন ময়লা দাঁত, হাটের সরু পথটিকে মাঝখানে রেখে হা হা করে হাসছে। হয়তো এমন দৃশ্যই দেখে হাটের উপর দিয়ে উড়ে চলা কাক, শ্যামা, ময়না, চড়ুইগুলো। আর এই হাঁ করা মুখের দাঁত কেলানো হাসি তাদের বুকে কি কাঁপন তোলে কে জানে - ওরা পড়িমড়ি করে উড়ে যায় আশেপাশের মাঠ, গাছপালা-ঝোপজঙ্গলের দিকে।
মনে করার চেষ্টা করলে এ হাটে ভাণ্ডারীর অভিষেকের একটা ধোঁয়াটে স্মৃতি হয়তো দোকানিদের মনে পড়বে। হাটের দোকানগুলোতে যে ক’জন রাত্রিতে ঘুমায়, তারা হয়তো মনে করিয়ে দিবে: খুব পেশাব পাইছিল। ঘুম থেকে না উঠলে বিছানা নষ্ট করার দশা। তাই উঠলাম। দোকানের ঝাঁপ ঠেলি উত্তর কোণার পেশাবখানার দিকে হাঁটা ধরলাম। দেখি কি, জহিরের ডিসপেনসারি ঘেঁষি যে খালি জায়গাটা, তার একটুখানি জায়গা চট দিয়া ঘেরা। তার মধ্যে একটা বোঁচকার মতো গোলগাল মানুষ বসি ঢুলে আর কি বিড়বিড় করে। ঘটনা কি ভাবতে ছিলাম। কিন্তুক একদিকে পেশাবের বেগ, আরেকদিকে ঘুম। ধুত্তুরি বলি কোনরকমে পেশাব সারি আবার দোকানে ঢুকি দিলাম ঘুম।
ব্যস। মোটামুটি এ গল্পই কয়েকজনের কাছে শোনা হয়ে যাবে। এবং এর পরদিন সকালে এ রাতারাতি গজিয়ে ওঠা চটে ঘেরা জায়গায় ঢুলতে থাকা মানুষটা বইদ্যার হাটে কোন বিশেষ আলোড়ন যে তোলে না, তার কারণ কি এই যে, যে কোন প্রয়োজনে তারা লোকটিকে বিকট কন্ঠে ডাকতে পারে: “ভাণ্ডারী, এক বালতি পানি নিয়া আয় কল তলা থেকি”। কিংবা, “এই পান গুলা ধুইয়া দে রে, ভাণ্ডারী”। কিংবা, “দোকানটায় একটু ঝাড়– দিয়া যা।” কিংবা, “হুজুরের দোকান থেইক্যা এক দৌড়ে পঞ্চাশ টাকার ভাংতি নিয়া আয় রে ব্যাটা।” এবং এই ফাইফরমাশের বদলা কখনো একটা একটা পেঁয়াজু কি গুলগুলা কি আধেকটা পান কিংবা আধ খাওয়া চা দিলেই ভাণ্ডারী ভীষণ আহ্লাদিত হয়ে পড়ে। আহ্লাদিত হলে তার জিভে একটা টাক্ টুক্ শব্দ উঠে। তা দেখে দোকানীরা হাসে আর বলাবলি করে, পাগলার জিব্বার খাই মিটে না। হা হা হা। ওরে বাপ রে বাপ, সারাদিন তো দেখি খাওনের উপরেই আছে।
তারপর এ দোকান ও দোকান হতে দোকানীরা স্ব স্ব উদারতা প্রদর্শনের জন্য সারাদিন ভাণ্ডারীকে কী কী খাইয়েছে, তার একটা ফিরিস্তি দেয়। এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবে, সে ফিরিস্তিতে আধা পরোটা পুরো পরোটা হয়ে যায়, আধা কাপ রঙ চা ভরা কাপ দুধ চা হয়ে ওঠে এবং তার বাবদে ভাণ্ডারী কি কাজটি করে দিয়েছিলো - তা বেমালুম বাদ পড়ে যায়।
তখন হয়তো সে দোকানে বসে ছিলেন মুন্সী বাড়ির বুড়ো বেপারী সাব। কিছুদিন আগে তার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, মরণের ভয়ে খুব হিসেব করে খেতে হচ্ছে। তিনি দোকানটির মাছি ওড়া সিঙাড়া, বুট আর পেঁয়াজুর গামলার দিকে চেয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস চেপে ব্যাজার মুখ করে বলেন, ইনসানের খাওয়া খাদ্য হিসাব করি খাওন দরকার। বুঝলি ভাণ্ডারী, কেয়ামতের দিন দানায় দানায় হিসাব হইবো। দানায় দানায়।
উত্তরে ভাণ্ডারী ঘোঁত ঘোঁত করে হাসে। বেপারী সাব হুঁশশ্ করে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটি ছাড়েন। দেখেন, বাজারের নেড়ি কুত্তাটার লেজ নড়ছে দ্বিগুণ বেগে। মুখে ভাণ্ডারীর ছুঁড়ে দেয়া পরোটার অর্ধেকটা। তা দেখে, ডায়াবেটিস জিনিসটা কি শুধু ইনসানেরই হয় - এ প্রশ্নটা তার মনে ঘুরঘুর করতে থাকে।
এতদ আলোচনা এ সারকথাটি বলার উদ্দেশ্যে যে, বইদ্যার হাটে ভাণ্ডারীর যে অধিষ্ঠান, তাতে এ ছোট্ট হাটে কোন আলোড়নই উঠে না। কোন এক রাতে জহির ডাক্তারের ডিসপ্যানসারীর পাশের খালি জায়গাটার হাত চারেক জায়গা চট দিয়ে ঘিরে বোঁচকার মতো গোলগাল একটা মানুষ থাকতে শুরু করে, এবং দিব্যি এ হাটের শরীরে নিপুন এঁটে যায় কেউ কিছু টের পাবার আগেই।
রে-গা-মা
মানুষ হলে তার নাড়ী থাকে। এও এক ভীষণ ঝক্কির। কেননা, নাড়ীটি কোথাও পোঁতা থাকে। সুতরাং, এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের দেখা হলে সুলুক-সন্ধান জরুরী হয়ে পড়ে। না হলে, সেই কোন গুহায় থাকতো আদম, হাওয়াই বা পড়ে থাকতো কোন গুহায়!
সুতরাং, বইদ্যার হাটে আসা মানুষরা মাঝে মাঝে ভাণ্ডারীকে জিজ্ঞেস করে, কোন গেরামে বাড়ি রে তোর?
গ্রামের হিসাব নেয়া হলে হয়তো তার পর কোন বাড়ি, কোন ঘর, কার পুত, কার নাতির প্রশ্নগুলো ক্রম অনুযায়ী নড়ে-চড়ে উঠতো। কিন্তু প্রথম প্রশ্নটিই পার হয়ে ওঠা হয় না। প্রশ্ন হতেই ভাণ্ডারী অম্লান মুখে বিড় বিড় করে উত্তর দেয়, ইয়াদ নাই।
গ্রামের নাম ইয়াদে না থাকার মত অভাবনীয় ঘটনা তো এ অঞ্চলে রোজ রোজ ঘটে না, তাই তারা ‘বলদ্যা’ পাওয়ার আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে। দুই তিনজন এক সাথে বলে উঠে: ওরে শোন, শোন, বলদ্যায় কয় কী! হা হা হা, কয় কি বলদ্যায়!
কিন্তু স্বস্তি হয় না। কোন গ্রামে এ মানুষটার নাড়ী পোঁতা - জানা না থাকলে নিয়মিত অস্বস্তি লেগে থাকার সম্ভাবনার যন্ত্রণায় না গিয়ে কেউ একজন সিদ্ধান্ত টানে: ‘বোধ হয় নদী ভাঙা কোন গেরামের’। ধারণাটি জনপ্রিয় হয় দ্রুত। এবং তার পেছন পেছন দ্বিতীয় সিদ্ধান্তও আসে: ভাইরে, মানুষটার দোষ দিয়া লাভ নাই। নদী ভাঙি বেবাক যখন তলাই যায়, মাথার ঠিক থাকে নি? আহারে বেচারা!
তা বৈদ্যার হাটের মানুষের মনে দয়া-মায়া আছে। ‘আহারে বেচারা’ শব্দের দ্যোতনা উপস্থিত প্রায় সবাইকেই ছুঁয়ে যায়। এ উপলক্ষ্যে তাদের এলাকা যে কখনো নদী ভাঙার কবলে পড়েনি - এ জন্য তারা মনে মনে নিজ পছন্দমত খোদা কিংবা ভগবানকে ধন্যবাদ দেয়। ইত্যবসরে সম্মিলিত জনতা নদী-ভাঙা জনপদের যে সব গল্প জানে, কিছুক্ষণের জন্য ভাণ্ডারীকে ভুলে গিয়ে সেসব কথা চালাচালি করতে শুরু করে। তা যখন তারা করে, সে ফাঁকে ভাণ্ডারীর দিকে চেয়ে দেখি:
ভাণ্ডারীর দিকে তাকালে তার ঘাড় হীন মাথাটিকে প্রথমে চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে তার গায়ে চড়ে থাকা গাদা খানেক কাপড়-চোপড়, তাদের তালি-তাপ্পা মারা নানান ঝুল আর অদ্ভুত সব রঙের সমাহারকে। কি শীত, কি গ্রীষ্ম, গোটা পাঁচেক জামা, দুটো গেঞ্জি তার গায়ে ঝোলে। পরনেও দু’তিনটা লুঙি। এই বিপুল কাপড়ের বহর পরনের পেছনে তার যুক্তিটি খুব সরল: আমার দুয়ারে কড়া নাই গো, ঘরে রাখলে কে না কে নিয়া ভাগি যাইব। সুতরাং, তার কঙ্কালসার দেহটা বোঝা যায় না। কাপড়ের এই সমাহার পেরিয়ে চোখ যখন তার মুখে ওঠে, দেখা যায় চোখ আর নাক আর মুখের অবস্থান যেনো ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে। কোথায় বা এর হনু, কোথায় বা গালের মাংস! মুখের হা’টি যথাস্থানে রেখে বাকি আর সমস্তটা কেমন জড়িয়ে-মড়িয়ে পিকাসোর ছবি হয়ে থাকে। তাই হয়তো কাপড়ের এ বিপুল ভা-ার পেরিয়ে তার চেহারার দেখার প্রবৃত্তি হয় না জনগণের। তার চেয়ে রিকশার পিছনে তাকিয়ে থাকলেই ভালো। রাধা-কৃষ্ণ-মায়ের দোয়া-বালক জিলানীর লালটুস চেহারার মজুত থাকতে কে আর ঝুঁকি নেয় হনুভাঙা গালে নজর হানার!
বানভাসী জনপদের কথা ফুরিয়ে গেলে আড্ডার কেউ একজন আবার প্রশ্ন তোলে: তোর নাম কি রে বলদ্যা?
বলদ্যা একথাটির উত্তর দেয় না। কেবল কোমল স্বরে ‘ঘোঁত’ করে ওঠে। পাশে বসা অন্য কেউ উত্তর দেয়, মনে হয় নামও ইয়াদ নাই। ঐ কি রে, নাম ইয়াদ নাই?
ব্লাউজের কারিগর মন্তু খানিকটা নরম দিলের। লোকজন ফাজলামো করে বলে, বেডি মানুষের বুকের মাপ নিতে নিতে ওর ভাব-চক্করও বেডি মানুষগো মতো। সে কোমল গলায় পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করে, এই বাজারে না থাইক্যা আমিন বাজার যা গিয়া। মাইজ ভাণ্ডারীর দরগা আছে। দরগায় পইড়া থাকলেও খাইয়া বাঁচতে পারবি।
এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে মুদি দোকানদার বাসু মিয়া। বাজারে এমন উটকো একটা মানুষের উপযোগীতা হয়তো সবার চেয়ে তার চোখেই বেশি করে ধরা পড়েছিল। সে হাত উল্টে বলে, আরে না। এই খানেই থাক।
তারপর বাকি সবার দিকে চোখ টিপে বলে, আরে, এইগুলান হইলো বাজারের শোভা। না থাকলে কেমন উদলা উদলা লাগে।
বাজারে ভাণ্ডারীর স্থায়ী অধিষ্ঠান মূলতঃ সেদিন থেকেই। বাজারের শোভাও বাড়ে হয়তো কিছুটা। কিন্তু নামটা? বলদ্যা তো আর কারো নাম হয় না। নিছক বিশেষণ পদই তো সেটা। বোবা নয় মানুষটা, বুদ্ধি-শুদ্ধি যে একেবারেই নেই, তাও বলা যায় না। নিজের কাপড়-চোপড় রক্ষার জন্য যে টনটনে যুক্তি, তাতে খানিকটা অবাকই হতে হয়। শুধু নাম-ধাম-সাকিন মনে নেই - এ আবার কেমন ধারার মানুষ? বৈদ্যার হাটের লোকজন বেশ ঝক্কির মধ্যেই পড়ে। নামহীন কোন মানুষের অস্তিত্ব মানেই নিদারুণ অস্বস্তি, এ কথা সকলেই বোঝে। না হলে, কোন কালরাতে আজরাইল বা যম এসে কাকে ডাকতে বসে কাকে নিয়ে চলে যায় - তার কোন ঠিক আছে? তাই নাম লাগে। উপরোক্ত খুচরা আলাপের মাঝে কোন কথা থেকে কোন কথায় যে কেউ একজন তাকে ভাণ্ডারী বলে ডেকে ওঠে, কেনই বা, তার হদিশ আর পাওয়া যায় না। কিন্তু নামটা সবার কানে লেগে যায়। কে জানে, মন্তুর ‘মাইজ ভাণ্ডারে যাবার’ পরামর্শের বাক্য হতেই শব্দটা কারো বাক্যে জড়িয়ে-মড়িয়ে উঠেছিল কি -না। তবে মোদ্দা কথা, এই বলদ্যা মানুষটার নাম হয়ে যায় ভাণ্ডারী, একই দিন থেকেই।
মা-পা-ধা
দিনের পায়ে যে তেল মাখা বল-বিয়ারিং আছে, তা খেয়াল করার মানুষ ছিল না বাজারে। যেহেতু পেট এবং লুঙির তলায় জ্যান্তব সুড়সুড়ির বিহিত করতে করতে চন্দ্র-সূর্য উদয় হয়, অস্ত যায়, শীত-গ্রীষ্ম গত হয় এবং কুদরতের এই সব শান বোঝার কোন উৎসাহ কারো মধ্যে কোনদিন দেখা যায় না। বল-বিয়ারিংটাতে মাঝে মাঝে তেল কমে এলে দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। তখন কারো কারো চুল-দাড়ি পাকায় নজর পড়ে, তৈল চিক্কন চামড়ায় মাছের মতো আঁশ গজাতে দেখা যায়। কিন্তু ঐ যে কুদরতের শানে বিপুল বিশ্বাস! তাই খোকন নাপিতের নতুন পারা লাগানো আয়না হতে সহজেই তারা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রাত্যহিকের হাউ-কাউতে। এমনকি মফিজ ম-লের চালের আড়তে এক ব্যাণ্ডের রেডিওতে গ্যাড় গ্যাড় করে যখন দূর-কোন-দেশের টুপি-টিকির ঠোকাঠুকির সংবাদ পাওয়া যায়, তখনও কী গজব ঘনিয়ে আসছে এদিকে, সে বিষয়ে তাদের সম্বিত ফিরে না। সাহাতে-চৌধুরিতে মিলে হালখাতার মিষ্টি খেতে খেতে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। আর বলে, মরলে বুঝন যাইবো কার হাতে মরছো: আজরাইল না যম। এখন নিজা বুঝ, তরমুজ।
কিন্তু খোঁড়ালেও দিন আগায়, মরচে পড়া চাকায়ও রাত ‘ঘটর ঘটর’ করে চলে। থামার নিয়মই নেই যে। তবে একদিন থমকায়। সময়টি এক কোজাগরী পূর্ণিমার রাত।
ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছিল ডি ডাং ডি ডাং ছন্দে। স্বর্গের পারিজাত ছেড়ে পেঁচক বাহিনী মর্ত্যে নেমে এসেছে। সন্ধ্যা নামতেই তাই বাতাসে ফিসফাস:
তুমি মাগো লক্ষী দেবী, কমল বরণী
কমল লতিকা কৃপা কর নারায়ণী
সাজায়ে রেখেছি মাগো ধান্য-গুয়া-পান
আসিয়া কর মাগো ঘটেতে অধিষ্ঠান।
ধূপ-ধুনো-ঘৃতবাতির ঘ্রাণে চারপাশ ম ম করছিল। কিন্তু এমন সুঘ্রাণও কারো কারো নাকে বিষবৎ হয়ে ঢোকে। মগরিবের সালাম ফিরিয়েই ফোঁস করে ওঠেন বড় মসজিদের ইমাম সাহেব: কলিজায় হাত দিছে, খবর রাখেন? কাফিরগো পাড়া পড়ছে দিয়ারা শরীফে। কত্তবড় সাহস! একজনও কালাপাহাড় কি জিন্দা নাই?
সারি সারি অবোধ মুসুল্লীদের মাঝে পাকানো চোখে তিনি কালাপাহাড় খুঁজতে শুরু করেন।
তার চোখের আগুনে জমায়েতের শরীরের নানাজায়গার লোম খাড়া হতে থাকে। নামাজ অন্তে মুরুব্বীরা প্রতাপ সিংহ ডাক্তারের বার বাড়িতে পাঁচালি শুনতে, এবং ইসা-মুসা-হারুনরা কাঁচা সন্দেশ খেতে যাবে বলে ঠিক করেছিল - সকলে থতমত খেয়ে যায়।
ধা-নি-সা
মাঝরাতের একটু আগে, একদল মানুষ ত্রস্ত পায়ে ঢুকে পড়ে বৈদ্যার বাজারে। মানুষগুলোর হাতে রাম দা, চাঁদের আলোয় চিক্ চিক্ করে উঠছে তার শান দেওয়া ধার। মাথায় নানান কিসিমের টুপি। জোছনার সারি সারি আলোয় তাদের চেহারায় নূরের জেল্লা চকমক করে উঠে। নিজের তালি দেয়া চটের ফাঁক দিয়ে এই মানুষগুলোকে দেখে ভাণ্ডারীর মনে হচ্ছিল সারি সারি নয়াদুলা নেমে আসছে দুলদুল চড়ে। একটা বিয়ের শিল্লুক মনে পড়ে যায় তার। সে গুনগুন করে নিজেকে নিজে শিল্লুক ধরে:
প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম, এ্যান
দুলা আইছে বিয়া করতে, আপনেরা আইছেন ক্যান?
এই প্রশ্নের উত্তর আওড়াতে গিয়ে থমকে যায় সে। বাহিরে গুম গুম আওয়াজ হচ্ছে। তার সাথে কলিজা ওল্টানো শোরগোল। ফলে শিল্লুকের উত্তরটা মনের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ে কোন দিকে - ঠাহর হয় না তার। পরের বাক্যগুলো কিছুতেই আর মনে পড়ে না।
ফলে সে ওঠে। চটের ফাঁক দিয়ে দেখে, নয়াদুলার জমায়েত দ্রুত পায়ে কয়েকটা নির্দিষ্ট দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আচমকা হাতের লাঠি আর রামদায়ের কোপ পড়তে শুরু করে টিনের ঝাঁপগুলোর উপর। এসব ইতিহাস র্যাকেশ ব্যাটবল লিখবেন এক কালে। আগুন জ্বলবে, কিংবা মাটিতে ছিটকে পড়বে মুণ্ডু - সেসবও। যে গল্পটি তিনি লিখেননি, তার দিকে বরং চোখ দেই এইবেলা।
শোরগোল শুনে ভাণ্ডারী তার চট ঘেরা ঘরটি হতে বেরিয়ে আসে। শঙ্খ আর ঢোলের শব্দ থেমে, শুরু হয়েছে আগুন আর রক্তের রোশনাই। বেরুতেই দেখে বৈদ্যার সাহার গদিতে আগুন লেগে পুড়ে যাচ্ছে ধান। সেদিকে দৌড় দেয় সে। মানুষগুলো কা-জ্ঞান নাই নাকি, ধান পোড়ায় কেন?
কিন্তু কার যেনো বাড়িয়ে দেয়া পায়ে বেঁধে যায় ভাণ্ডারী। কাপড়ের কুণ্ডুলিশুদ্ধ হুড়মুড় করে পড়ে যায় এবড়োথেবড়ো মাটিতে।
: ওই, তুই কেডা। কেডারে এইটা?
: ভাণ্ডারী। এইটা তো ভাণ্ডারী। পাগলা।
: আরে অংচংবংয়ের লোক নি, সেটা বল।
: জানি না তো। ঐ ভাণ্ডারী, তুই হিন্দু, না মুসলমান?
মুখে পট্টি বাঁধা মানুষগুলোকে চিনতে পারে না ভাণ্ডারী। প্রশ্নটাকেও না। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এখন আর এদেরকে নয়াদুলার মতো লাগে না তার কাছে।
: কথা কস না কেন? পূজা দিছিলি? আজ রাইতে পূজা দিছিলি?
ভাণ্ডারী মাথা দোলায়। পূজা যে দেয়নি - কথাটা মনে আছে তার।
: তাইলে নামাজ পড়ছিলি সন্ধ্যায়? তোরে তো কোনদিন মসজিদে দেখলাম না। পড়ছিলি নামায।
ভাণ্ডারী আবারো মাথা দোলায়। সন্ধ্যার নামাযও যে পড়েনি - তাও মনে আছে তার।
: এই হারামজাদার পূজাও নাই, নামাযও নাই। ওই, তুই মালাউন, না মুসলমান - কথার জবাব দে। নইলে -
লোকটা তার হাতের রাম দা উঁচিয়ে তাকে ভয় দেখায়। ভাণ্ডারীর ভয় লাগে না। সে উবু হয়ে বসে থেকে থেকে প্রশ্নটার জবাব ভাবার চেষ্টা করে। কিছু মনে পড়ে না। সে মিনমিন স্বরে বলে -
: ইয়াদ নাই গো। কিচ্ছু ইয়াদ নাই।
এইবারে তারা থমকায়। হিন্দু না মুসলমান - এ কথাও আবার কারো ইয়াদ থাকে না! হারামজাদাটা যে বিরাট চালবাজ, হয়তো কারো গুপ্তচর হয়েই ঢুকেছে বাজারে - এ কথাটা একজনের মনে হয়। সে তড়াক করে বলে ওঠে: ওরে, কাটা না আকাটা দেখলেই তো হয়।
আরেকজন হৈ হৈ করে ওঠে: ঠিক কথা। ঐ হারামজাদা, কাপড় খোল।
ভাণ্ডারী কথাটা বুঝতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে, কাপড় খোলবো কেন?
: তোর নিশানা দেখবো। খোল কইলাম।
বলতে বলতে সে হাতের হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভাণ্ডারীকে দাঁড় করায়। মুখে শব্দ ওঠে: খিক্ খিক্ খিক।
কিন্তু তবু ভাণ্ডারী ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কাপড়ে হাত যায় না তার। একজন ধমকে ওঠে -
: ওই, পাগল লইয়া তামাশার সময় নাই। টান দিয়া খোলতো ওর কাপড়টা।
কাপড়ের নিচে কাপড়, তারপরে আরেক পরত কাপড়, তারো পরে আরেক পরত। কাপড় খুলতে থাকা হাতটা দিশেহারা বোধ করে।
: এই কুত্তাটা লালমোহনের পুরা বস্ত্রবিতান পিন্দা রাখছে।
: তাইলে এত খোলাখুলির কাম নাই। বস্ত্রবিতানে আগুন দিয়া দে।
লোকটার হাতে মশাল। শিখাটা চিড়বিড় করে উঠছে থেকে থেকে। কিন্তু এক সময় কাপড় শেষ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া অজ¯্র অপার কাপড়ের উপর ন্যাংটা দাঁড়িয়ে থাকে ভাণ্ডারী। একজন মশাল এগিয়ে ধরে তার শরীরের নিচের অংশের দিকে। তারপরেই আঁতকে ওঠে,
: ও মজু, জিনিসতো নাই।
: আরে কাটা না আকাটা - সেইটা দেখ না।
: আরে যন্ত্রইতো নাই রে - তার আবার কাটা আকাটা!
: কি কস। নাই? দেখি দেখি -
তারা তখন ভাণ্ডারীর দুই পায়ের চিপায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মশালের ধিকি ধিকি আলোয় কয়েকজোড়া চোখ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে, ওখানে কিচ্ছু নেই। একেবারে ফাঁকা। নাড়াশুদ্ধ তুলে নেয়া ফসলের মাঠের চেয়েও, শুণ্য। এ দৃশ্য তাদেরকে বিস্মিত করে, উত্তেজিত করে, মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। একজন খেঁকিয়ে ওঠে-
: ঐ হারামজাদা তোর যন্ত্র কই?
এরা যে ঠিক কি খুঁজছে, তা ভাণ্ডারীর মাথায় আসে না। সে অনুত্তেজিত স্বরে বলে -
: যন্ত্র দিয়া কি করবেন?
: কুত্তার বাচ্চা কয় কি! লিঙ্গ কই তোর? হিন্দু না মুসলিম- বুঝবো কেমনে?
ভাণ্ডারী তবু বুঝতে পারে না। সে সরল প্রশ্ন করে -
: লিঙ্গ দিয়া ধর্মের বিচার?
দলটা থমকে যায়। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কিন্তু মুখের বিস্ময় যায় না। তারা আবারো ভাল করে চেয়ে দেখে ওদিক। খালি জায়গাটা কি চাঁদতারা না ত্রিশূল আকৃতির - না বুঝতে পেরে দিশাহারা লাগে তাদের। একজন ফাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে শুধু, কই হারাইল রে জিনিসটা?
আগুনের আঁচে সাহা আড়তের ধান তুষ হয়ে ছিটকে যাচ্ছে মহাশূণ্যের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে ভাণ্ডারী বিড়বিড় করে বলে, ইয়াদ নাই গো। কই যে হারাইলাম! টিকটিকির লেজের মতো জিনিস, খইস্যা পড়ছে। গেছে, ভালই হইছে। লিঙ্গও গেছে, ধর্মও গেছে।
এমন সময়ই হঠাৎ শিল্লুকের উত্তরটি মনে পড়ে তার। সে হাসতে হাসতে গায়:
উত্তর: ওয়ালাইকুম আসসালাম ওবা
দুলা আইছে বিয়া করতে, আমরা আইছি শোভা।
বাজারের নানান কোণা হতে স্রষ্টার গুণকীর্তন করে ধ্বনি উঠছে থেকে থেকে। অনেকগুলো দোকানে আগুন জ্বলছে। মাটির পুতলাগুলোকে মাটিতে আছড়ে ফেলে হো হো ধ্বনি উঠছে জ্যান্তব গলায়। আকাশ কালো করে ওঠা ধোঁয়ায় ভুবন ভাঙা জোছনা ম্লান হয়ে যেতে লাগলো ক্রমশঃ।
চাঁদটা যেনো পরওয়ারদিগারের চোখ। ব্যথিত, না উল্লাসিত - ধোঁয়ার আস্তরন ভেদ করে বুঝবে, কার সাধ্যি!
-০-
১৮ জুলাই, ২০১৭
লেখক: সাগর রহমান
কবি, গদ্যকার
নোয়াখালিতে জন্ম।
প্রকাশিত গ্রন্থ:খড়িমাটির দাগ (গল্পগ্রন্থ)
0 মন্তব্যসমূহ