দীপেন ভট্টাচার্য'র ধারাবাহিক উপন্যাস : অদিতার আঁধার শেষ পর্ব

সব কটা পর্ব একসাথে পড়ার লিঙ্ক: 

[লোহিতক গোষ্ঠীর হাতে নিলয় নামের পৃথিবীর সব মস্তিষ্ক সংরক্ষণাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিল অশির ও বিষাণের শিক্ষক রাস্কো। রাস্কো বিষাণ ও অদিতার সন্তান সেনভাকে চাঁদে অপহরণ করে সন্ত্রাসী নেতা অশির হিসাবে গড়ে তোলে, পরে ডামুরির বনে তীর ছুঁড়ে অদিতাকে হত্যা করে। বিশালগড়ের নিলয় ধ্বংস হবার শেষ মুহূর্তে অশির ও পুনরুজ্জীবিত অদিতা মুখোমুখি হয়। অদিতার আঁধারের শেষ এই পর্বে।]

পর্ব ১৩:

অদিতা চোখ খোলে। তাঁর সামনে, বিছানার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে চারটি মানুষ, দুটি নারী, দুটি পুরুষ। এদের কাউকে সে চেনে না। গতকাল, নাকি বহুদিন আগে, দুজন চিকিৎসক তার পাশে ছিল - ডকটর তারকার আর ডকটর স-কুরা। তারা বলেছিল ঘুম ভাঙলে তাদেরই সে দেখবে? কিন্তু এরা কারা, ভাবে অদিতা, এদের পোশাক কেমন জানি ভিন্ন। তাকে অচেতন করে দেবার আগে ডকটর তারকার বলেছিলেন, ‘আপনি এখন প্রায় বারো ঘন্টা ঘুমাবেন। সকালে যখন উঠবেন সামনের দেয়ালে দিন-তারিখ ফুটে উঠবে। আপনি দেখবেন সন ৪৩৫৩, নভেম্বর ১১, শুক্রবার। তবে ভবিষ্যতে আপনার যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে ঐ সনটা ৪৩৫৩ হবে না সেটা বুঝতেই পারছেন। আপনার কপি-করা মস্তিষ্কই জেগে উঠবে ভবিষ্যতের ঐ তারিখে। সাধারণতঃ এই বারো ঘন্টার ঘুমে সবাই স্বপ্ন দেখে, আপনিও বোধহয় দেখবেন।” 

একটা স্বপ্ন তাড়া করে ফিরেছে অদিতাকে, কিন্তু সেই স্বপ্ন বারো ঘন্টার নয়, অনন্তকালের। এক পুরোনো পাথরের উপাসনালয়ে হারিয়ে গিয়েছিল সে। পাহাড়ের পাথর কেটে তৈরি হয়েছিল সেই প্রাচীন মন্দির। কিন্তু সেখানে কোনো দেব দেবীর মূর্তি ছিল না, ছিল না কোনো চিত্র, কোনো লেখা, অন্ধকারে ভেসে থাকা অলিন্দের পর অলিন্দের গোলকধাঁধায় ভরা সেই স্থান থেকে বের হতে চাইছিল সে, কিন্তু পারছিল না। সেই স্বপ্নের মধ্যে ডকটর তারকারের গলা ভেসে উঠেছিল - “বারো ঘন্টা পরে আপনি জেগে উঠবেন।” কিন্তু অদিতা বুঝেছিল বারো ঘন্টা বহু আগেই পার হয়ে গেছে। গোলকধাঁধায় ঘুরে ঘুরে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। 

অবশেষে সে জেগে উঠেছে। কিন্তু সেখানে তারকার নেই, স-কুরা নেই। ছাদের দিকে তাকায় অদিতা, এটা নিলয় নয়, দেয়ালে দিন-তারিখের সন্ধান পায় না অদিতা। একপাশে একটা স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের ওপাশে সমুদ্র দেখে সে। নিলয়ের পাশে সমুদ্র ছিল না। এখন কি সকাল? নীলাভ সমুদ্রের কোনদিকে সূর্য বুঝতে পারে না অদিতা। তাঁর বাঁ-পাশে যে নারীটি দাঁড়িয়ে ছিল সে বলে, “অদিতা সান, আপনি কেমন বোধ করছেন?” নারীটি যেভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করল তাতে প্রাচীন আভিজাত্যের টান আছে, যে পোশাকটি পড়ে ছিল তার মধ্যেও পুরোনো ভাব আছে। অদিতা অস্ফূট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আমি কোথায়? আপনারা কে?” সম্মিলিত চারজন একে অপরের দিকে তাকায়। সেই নারী আবার বলে, “আপনি আমাদের চিনবেন না, অদিতা সান। আপনি এখন একটা নতুন সময়ে, আপনার জন্য এটা হয়তো আকস্মিক হবে, তবে আপনার সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জানি তাতে বলতে পারি আপনি হয়তো এই নতুন পরিস্থিতিকে সামলাতে পারবেন?” 

সামলানোর ব্যাপারটা বুঝতে পারে না অদিতা। সে কি নতুন পরিস্থিতিকে সামাল দেব, নাকি নতুন পরিস্থিতি মেনে নেবে? সেই নারী হাসে, এক ধরণের হাসি যাতে নির্ভর করা চলে, বলে, “দুটোই”। অদিতা আশ্চর্য হয়, তারপর সামলে নেয়, মনের কথা বুঝে নেবার অনেক উপায় আছে। আবার হাসে সেই নারী, যেন এই সামলে নেয়াটাও সে বুঝতে পেরেছে। অদিতা সেই হাসিতে আশ্বস্ত হয়। সেই নারী বলে, “আজকের তারিখ হল ৫০৬৩, জানুয়ারি ২৫। আপনি নিলয়ে আপনার মস্তিষ্ক কপি করতে আসার পর প্রায় ৭১০ বছর পার হয়েছে।” 

অদিতার বিহ্বল দৃষ্টি চারজনের মুখের ওপর ঘুরে বেড়ায়। অনেক ধরণের পরিস্থিতি সে সামলাতে পারে, কিন্তু এই সংবাদ সামলানো সহজ নয়। নারী বলে, “আমার নাম অন্তরা। আমি আন্টারিসে জন্মগ্রহণ করেছিলাম বলে আমার বাবা মা আমাকে অন্তরা নাম দিয়েছিলেন।” 

আন্টারিস? সে তো কিংবদন্তীর জাহাজ। নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে তার যাত্রা। পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ সেই কবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসেছে সেই আন্টারিস আবার পৃথিবীতে? দু হাজার বছর পরে? কিন্তু সে নিজে কে? অদিতা তার দুটি হাতের দিকে তাকায়, অচেনা দুটি হাত, তার হাত নয়। ডান করতল দেখে অদিতা, অচেনা সব রেখা, বাঁ করতলেও তাই। হাতের ওপর নীল শিরা তার নয়। এই মসৃণ পেলব ত্বক তার নয়। দুই করতল দিয়ে মুখ ঢাকে অদিতা - তার চোখ, নাক, ভুরু কপাল এগুলোর কোনোটাই তার নয়। ৭০০ বছর পরে তার দেহ থাকার কথা নয় কোথাও। চিৎকার করে উঠতে চায় অদিতা, কিন্তু আবার সামলে নেয়। অন্তরা এবার হাসে না। বলে, “এই দেহ আপনারই, আপনার তরুণ বয়সের, আপনার ডিএনএ থেকেই করা। আপনি সবই জানবেন, কিন্তু এখন আপনার বিশ্রামের দরকার। আপনি এখন ঘুমোন, কাল আবার আমাদের কথা হবে।” অন্তরা উপস্থিত একজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়, সে অদিতার চোখের সামনে একটা ছোট রঙীন স্ক্রিন ধরে, তাতে কিছু রঙের আঁকিবুঁকি ফুটে ওঠে, অদিতার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। 

পরদিন অদিতা ঘুম ভাঙলে দেখে ঘরে কেউ নেই। উঠে দাঁড়ায়, অপরিচিত দেহ এখন আর অজানা মনে হয় না, বহু বছর আগে এই দেহ সে বিসর্জন দিয়ে এসেছিল। দূরে কোনখান থেকে বেহালার শব্দ ভেসে আসে। পুরোনো পরিচিত সুর, হাজার বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে নতুন দেহে স্বচ্ছন্দে হাঁটে অদিতা, অপরিচিত পা নিশ্চিত পদক্ষেপ ফেলে। ঘরের পাশে বারান্দা, শ্লথ গতিতে সেদিকে এগোয় অদিতা, বারান্দায় ঢোকার কাচের দরজাটা নিজ থেকে খুলে যায়, বাইরে দিগন্তব্যাপী জল। ঠাণ্ডা হাওয়া গালে লাগে, বহু বিস্মৃত ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। সেনভা, বিষাণ, মা, আরো কত বন্ধু, প্রিয়জন। সময়ের স্রোতে তারা হারিয়ে গেছে বহুদিন হবে। কোথায় সে, কোন সমুদ্র এটা? পেছন থেকে তার গায়ে কেউ একটা শাল জড়িয়ে দেয়। বহু দূরে দিগন্তে জাহাজের সারি, জল ঘেঁষে উড়ে যায় ফ্লেমিঙ্গোর ঝাঁক। অদিতা ঘুরে দেখে অন্তরা। 

“পৃথিবীর মানুষেরা সৌভাগ্যবান যে তাদের গ্রহে এরকম সমুদ্র আছে।” অন্তরা এমনভাবে কথাটা বলে যেন সে পৃথিবীর কেউ নয়। “পৃথিবীটা আপনি যেমন দেখেছিলেন সেরকম আর নেই, অদিতা সান। আমরা সবাই যেমন বদলেছি পৃথিবীও সেইভাবেই বদলেছে। পঞ্চাশ বছর আগে আমরা পৃথিবীতে ফিরে আসি, আমাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করছিল না। যুদ্ধ করে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর কক্ষপথে আমরা যখন প্রবেশ করলাম তখন পৃথিবীর কেউ সেটা লক্ষ করে নি।” 

“কেউ লক্ষ করে নি? হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ, পৃথিবীর বুকে বড় বড় দূরবীন, কেউ আপনাদের দেখতে পায় নি?” 

মাথা নাড়ায় অন্তরা। “আপনাদের পৃথিবী অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে অদিতা-সান। আমাদের পূর্বপুরুষেরা মহাকাশে পৃথিবীর মত আর একটা গ্রহ আর খুঁজে পায় নি, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমাদেরকে তাঁরা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আমরা ভেবেছিলাম পৃথিবী এর মধ্যে তার সব সমস্যার সমাধান করেছে, পৃথিবী আমাদেরকে ফিরে পেয়ে খুশী হবে। কিন্তূ আমাদের জন্য পৃথিবীতে কোনো অভ্যর্থনা কমিটি অপেক্ষা করছিল না। তারা আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে পুরোই অজ্ঞ ছিল। শুধুমাত্র যখন আমরা পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করলাম শুধুমাত্র তখনই আমরা বুঝলাম পৃথিবীর কি দুর্গতি।” 

যে পৃথিবীকে অদিতা তার গতকাল পর্যন্ত জানত সেখানে বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষকে অমর করতে চেয়েছিল। 

“হয়তো এরকমই হবার কথা,” বলে অন্তরা। “উত্থান, তারপর পতন, তারপর আবার উত্থান ।” 

“কিন্তু কীভাবে, কীভাবে পতন হল পৃথিবীর?” অদিতা নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, “আর আমিই বা কেন এত বছর পরে বেঁচে আছি? আর আমার সময়কার মানুষেরা? তারা কি এখন জীবিত আছে?” 

“না, তারা কেউ জীবিত নেই, অদিতা সান, আর মস্তিষ্ক কপি-করার পদ্ধতিও এই পৃথিবীতে হারিয়ে গেছে। আপনার মস্তিষ্কই হল শেষ মস্তিষ্ক যা কিনা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।” 

অদিতা চুপ করে থাকে, সে বোঝে যা হয়েছে সেটা বুঝতে সময় লাগবে, কিন্তু সেই বোঝাটাকে সহ্য করার মত ক্ষমতা তার কি হবে। দূরে সমুদ্র যেখানে আকাশের সঙ্গে মিশেছে সেখানে একটা মেঘ একাকি ভেসে থাকে। 

“এটা কোন সমুদ্র?” জিজ্ঞেস করে অদিতা। “এটা উত্তর সাগর, আগে যাকে আর্কটিক নামে চিনত সবাই।” এই সাগরে সেনভা কাজ করত। বুক ভারি হয়ে আসে অদিতার। সেনভা তাকে সারা জীবন ভুল বুঝেছে। এই পৃথিবীতে কি তার বংশধর আছে? না, সেটা সে জানতে চায় না। তার পৃথিবী অদৃশ্য হয়েছে বহুদিন। এ আর এক স্বপ্নের জগৎ। এই পৃথিবী থেকে সে বিদায় নিতে চেয়েছিল, কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, সেই পৃথিবী তাকে বারে বারে ফিরিয়ে আনছে, এমনকি তার সমস্ত পরিচিত মানুষ, ভালবাসার মানুষ, আপন জনেরা চলে যাবার পরেও। 

“আর বিশালগড়?” প্রশ্ন করে অদিতা। 

“বিশালগড় বলে সেরকম কিছু নেই এখন। পাঁচশ বছর আগে পৃথিবীব্যাপী যে ভয়ানক তোলপাড় হয়ে সেই সময় যুদ্ধের তাণ্ডবে বিশালগড় ধ্বংস হয়ে যায়। শুধুমাত্র আপনার মস্তিষ্কটা মাটির অনেক নিচে একটা গোপন স্থানে ছিল বলে সেটা পাওয়া গেছে।” 

“নিলয়ের কথা বলছেন?” জিজ্ঞেস করে অদিতা। “না, নিলয় নয়,” উত্তর দেয় অন্তরা, “নিলয়ে তার অনেক আগেই ধবংস হয়ে যায়।”

“কি বলছেন? তাহলে আমার মস্তিষ্ক তার সাথে ধ্বংস হল না কেন?” 

“খুব ভাল প্রশ্ন? আমাদের কাছেও এটা একটা ধাঁধা ছিল। সেই ধাঁধা উদ্ধার করতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয় ইতিহাসের এই হারিয়ে যাওয়া অংশটাকে উদ্ধার করতে পেরেছি।” 

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অন্তরা। সাতশ বছর পার হয়ে গেছে। অথচ তার মনে শুধুমাত্র গতকালের কথাই মনে আছে। নিলয়ে এসেছিল সে মস্তিষ্ক কপি করাতে। বিষাণও জানতো না যে সে আসবে। 

“আমি যতটুকু বুঝেছি,” বলে অন্তরা, “আপনার মস্তিষ্ক এর পরেও আর একবার কপি করা হয়েছিল। ৪৩৫৬ সনে। নিলয়ে আপনার দুটি মস্তিষ্ক সংরক্ষিত ছিল। ৪৩৫৬ সনের মস্তিষ্কটিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল, কারণ ৪৩৫৮ সনে আপনি নিহত হন ডামুরির বনে।” 

নিহত হয়েছে আর এক অদিতা, এই মস্তিষ্ক কপি করার পরও যে পাঁচ বছর পৃথিবীর বুকে ঘুরেছে। 

“আপনার দশ বছরের ছেলে সেনভা চাঁদে হারিয়ে গিয়েছিল।” সেনভার ইতিহাস এরা জানে, আশ্চর্য হয় অদিতা। অন্তরা যেন অদিতার মনের কথা ধরতে পারে, “আসলে ঘটনাটা আরো জটিল। শুধুমাত্র এখনই, আমাদের পৃথিবীতে ফিরে আসার পঞ্চাশ বছর পরে আমরা সব তথ্যগুলোকে মিলাতে পেরেছি। সাতশো বছর আগের ঘটনাকে ঠিকভাবে পুনর্নিমাণ করা কঠিন কাজ, বিশেষত যখন মানুষের কারিগরি অগ্রগতির অনেকাংশই পরবর্তী মাৎসান্যায়ে ধ্বংস হয়ে যায়। 

“আপনার ছেলে সেনভা চাঁদে হারিয়ে যায় নি, অদিতা সান, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। আর যে তাকে অপহরণ করেছিল তাকে আপনি চেনেন। প্রফেসর রাস্কো।” 

“প্রফেসর রাস্কো!?” রাস্কো যেন দূর জগতের কোনো অপসৃয়মাণ বস্তু। রাস্কোকে সে চিনত, সে রাস্কোর প্রণয়ী ছিল, রাস্কো তাকে ভালবাসত, কিন্তু তাদের গবেষণাগারে বিষাণের আবির্ভাব সব সমীকরণ পাল্টে দেয়। রাস্কো তাকে এজন্য ক্ষমা করে নি। তবে সেজন্য সেনভাকে এরকম নির্দয়ভাবে তার কাছে থেকে নিয়ে যাবে সেটা ভাবতে পারে না অদিতা। 

এবার সামলাতে পারে না নিজেকে অদিতা। সে মেঝেতে পড়ে যাবার আগেই অন্তরা তাকে ধরে ফেলে। ভেতরে নিয়ে এসে অদিতাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। 

অন্তরা বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে। বলে, “প্রফেসর রাস্কো মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে অধ্যাপক বিষাণ পরিচালনা কমিটির প্রস্তাব মেনে নেন। রাস্কো বিষাণের এই সিদ্ধান্তকে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করেন। মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনাকে চিরতরে বন্ধ করার জন্য তিনি একশ বছরের পরিকল্পনা করেন। সেনভাকে শুধু যে অপহরণ করেন তা নয়, সেনভার নতুন নাম দেন অশির, অশিরকে এক সন্ত্রাসী সংগঠন লোহিতকের নেতা হিসেবে গড়ে তোলেন।” 

এও কি সম্ভব? ভাবে অদিতা। সেনভা হারিয়ে যায় নি, বেঁচে ছিল। 

“আপনি কি অশির সম্পর্কে কিছু জানতেন?” না, মাথা নাড়ায় অদিতা। 

“তারপর রাস্কো আপনাকে একদিন ডামুরির বনে তীর ছুঁড়ে হত্যা করে। ডকটর বিনতা আপনার দেহ নিলয়ে নিয়ে আসে।” 

আমি তাহলে মারা গিয়েছিলাম, ভাবে অদিতা। দেখেছিল কি সেই অদিতা রাস্কোকে? অথবা অশিরকে? আর কি প্রতিহিংসার বশে রাস্কো তাকে খুন করেছিল? 

“রাস্কো চেয়েছিল আপনার দেহকে যেন নিলয়ে নিয়ে আসা হয়। তারা আপনার মস্তিষ্কের নিরাময় কম্পাঙ্ক জানতে পেরেছিল, সেটা দিয়ে আপনাকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। কয়েকদিন পরে তারা বিশালগড়ের নিলয় আক্রমণ করে আর আপনাকে দিয়ে নিলয়ের সংরক্ষিত সব মস্তিষ্ক ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়।” 

ভাবতে পারে না অদিতা, তারই হাত দিয়ে নিলয়ের মস্তিষ্ক ধ্বংস হয়েছে। না, তার হাত দিয়ে নয়, আর এক অদিতার হাত দিয়ে। “বিশালগড়ের নিলয় আক্রমণ কোনো একক ঘটনা ছিল না। রাস্কো পৃথিবীব্যাপী এটা করতে পেরেছিল, এইভাবে একদিনে সব সংরক্ষিত মস্তিষ্ক ধ্বংস হয়ে যায়।”

“আর সেই অদিতা? আর তার ছেলে অশির?” অদিতা নিজেকে মনে করে পৃথিবী থেকে বিযুক্ত একটি মানুষ। আসল অদিতা তো সেই কবে মরে গেছে। 

“বিশালগড়ের নিলয়কে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয় হয়, সেই বিস্ফোরণ থেকে অশির বা অদিতা নিজেদের বাঁচাতে পারে নি।” 

এই সংবাদটুকুও অদিতাকে যেন বিচলিত করে না. সে প্রশ্ন করে, “কিন্তু বিশালগড়ের নিলয় যদি ধ্বংসই হয়ে থাকে তবে আমার মস্তিষ্ক কীভাবে সেই বিস্ফোরণ এড়াল।” 

“আপনার মস্তিষ্ক আমরা নিলয়ে পাই নি। পেয়েছিলাম প্রফেসর বিষাণের গবেষণাগারে। এই খবরটা বিষাণ সংকেত আকারে লিখে গিয়েছিলেন, সেই সংকেতের অর্থ উদ্ধার করার ক্ষমতা পরবর্তী প্রজন্মদের ছিল না, শুধুমাত্র আন্টারিসের লোকেরাই সেটা করতে সক্ষম হয়। বিশালগড়ে আপনাকে হত্যার পরে রাস্কোর লোকেরা আপনার প্রতিস্থাপিত মস্তিষ্ককে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এটা বুঝতে পেরে প্রফেসর বিষাণ আপনার দ্বিতীয় কপি-করা মস্তিষ্কটা নিলয় থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। সেটা উনি যদি না করতেন তবে আজ আপনাকে আমরা পেতাম না।” 

অদিতাকে অন্তরার কোনো কথাই সান্ত্বনা দেয় না। এই নতুন পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার কথা নয়। 

অন্তরা বলে, “নিলয় ধ্বংস হবার পরে লোহিতক গোষ্ঠী খুব সহজেই ক্ষমতা দখল করল। পুরোনো সভ্যতা এরকম বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। রাস্কোর দর্শন অনুযায়ী দেশ ও আচার ফিরে এল, মানুষ আবার তাদের স্থানীয় জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হল, ধর্মীয় উন্মাদনাও তার সাথে যুক্ত হল। বিজ্ঞানকে মনে করা হল মানুষের শত্রু, নতুন গবেষণার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল হল। গত সাতশ বছরে অন্তত দশটা বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে।” 

অদিতা অন্তরার দিকে চায়, নির্বোধ দৃষ্টি। অন্তরা বলতে থাকে, "একজন মানুষ যখন মনে করে তার হাতে পৃথিবী  উদ্ধারের চাবিকাঠি তা শেষপর্যন্ত কাজে দেয় না, মানুষকে অনেক কষ্টে ফেলে এরকম অনেক উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আছে রাস্কোর বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায় তারই পুনরাবৃত্তি মাত্র।” 

“কিন্তু সব নিশ্চয় ধ্বংস হয় নি। আপনারা আমাকে পুনর্জীবিত করেছেন। সেই প্রকৌশল এখনো আছে।” 

“না,” বলে অন্তরা, “এই প্রকৌশল পৃথিবীর নয়। আন্টারিসে আমরা চমৎকার শিক্ষা পেয়েছিলাম আমাদের গুরুজনদের কাছ থেকে। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা দু হাজার বছর আগের পৃথিবীর জ্ঞান নিয়ে যাত্রা করেছিলেন মহাকাশে। এই গ্যালাক্সিতে নতুন পৃথিবী আমরা খুঁজে পাই নি, কিন্তু আমাদের নিরন্তর গবেষণা শুধু মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনই নয়, বহু মস্তিষ্কের সংযোজনে সম্মিলিত চেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে আমরা খুবই প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীণ হই, পৃথিবীর মানুষ বিজ্ঞান চায় না, মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানতে চায় না।” 

“কিন্তু আপনারা তো এখানে গবেষণাগার, হাসপাতাল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আমার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করেছেন। ” 

“আমরা গ্রীনল্যান্ডের এক বিচ্ছিন্ন নির্জন কোনায় আশ্রয় নিয়েছি। এখানে আমরা কী করি সেটা বাদবাকি পৃথিবী জানে না। শুধুমাত্র আপনার মস্তিষ্ক উদ্ধার করতে বিশালগড়ে গোপনে একটি দল পাঠানো হয়। বিশালগড়ের কেউ জানত না আপনার মস্তিষ্কের কথা। আমাদের প্রকৌশল বাদবাকি পৃথিবীর তুলনায় খুবই উন্নত, বিশালগড় টেরই পাই নি যে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম।” 

“তাহলে..এখন আপনাদের কী পরিকল্পনা?” অদিতা প্রশ্ন করে। 

“কী পরিকল্পনা?” অনেকক্ষণ পরে হাসে অন্তরা। কী পরিকল্পনা সেটা দেখতে হলে আপনাকে আমার সাথে আসতে হবে। আপনি কি হাঁটতে পারবেন?” 

ততক্ষণে অনেকটা সুস্থ বোধ করে অদিতা। অন্তরা তাকে নিয়ে যায় নিচের তলায়। যেতে যেতে দেয়ালে লাগানো বাধানো ছবিগুলো দেখে, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি, কয়েকটি ছবি ছিল অদিতার চেনা। একটা চালকবিহীন গোলাকার গাড়ি অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। সেই গাড়ি করে দুজন একটা কয়েক কিলোমিটার লম্বা সুরঙ্গ পার হয়। গাড়িটার দরজা খুললে অদিতা আশ্চর্য হয়ে যায়। সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা বিশাল ঘরের মধ্যে যার অপর দিকের দেয়াল মনে হয় দিগন্তে মিশেছে, যার ছাদ মনে হয় একটি পনেরো তলা বাড়ির সমান উঁচু। সেখানে তৈরি হচ্ছিল এক বিরাট মহাকাশযান। 

সেদিকে এগোতে এগোতে অন্তরা বলে, “আন্টারিসের প্রকৌশল অনেক পুরোনো, অদিতা-সান। আমরা এখন নতুন প্রজন্মের মহাকাশযান তৈরি করছি যা কিনা শুধু আলোর এক তৃতীয়াংশ গতিতেই ভ্রমণ করবে না, সেটা এক ধরণের বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হবে। আমরা আবার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি, অদিতা-সান।” 

পুরো সাদা পোশাক পরা লোকেরা ব্যস্ততার সাথে পাশ দিয়ে চলে যায়। অদিতা তাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি বলছেন, অন্তরা? তাহলে আপনারা পৃথিবীতে ফিরলেন কেন?” 

“পৃথিবীর মত আর একটি গ্রহ এই গ্যালাক্সিতে নেই, অদিতা-সান। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ বোধহয় পৃথিবীর যোগ্য নয়। আসলে এই কথাটা বলার অধিকার আমার নেই, বিচার করার আমি কে বলুন? আমরা ফিরে এসেছিলাম এই ভেবে যে পৃথিবী তার হারানো ছেলেমেয়েদের উদার হাতে বুকে টেনে নেবে। তা হল না। আমরা কাউকে বিরক্ত করতে চাই না, কারুর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। কিন্তু আমরা পৃথিবীতে থাকলে সেটা আমাদের করতেই হবে, আমাদের মনোজগতের উন্নতি পরোক্ষভাবে সেটা করবেই।” 

“সেটা খারাপ কেন? আপনাদের দিয়ে পৃথিবীর উন্নতি হবে।” অদিতা বলে। 

“না, হবে না। বরং আরো রক্তক্ষয় হবে।” 

“কিন্তু আপনার যদি পৃথিবী ছেড়ে চলেই যাবেন, তাহলে আমাকে আবার ফিরিয়ে আনলেন কেন?” 

“অদিতা-সান, আমরা অন্টারিসের মানুষেরা হলাম নক্ষত্রের সন্তান, মহাকাশের কালোতে আমাদের জন্ম। পৃথিবীর নীল আমাদের এখনো স্পর্শ করে নি। এই নীল গ্রহে এখন আপনিই একমাত্র সচেতন অস্তিত্ব যা কিনা পৃথিবীর যেটুকু ভাল ছিল তাই বহন করছে। আপনাকে আমাদের বড় দরকার অদিতা-সান। আপনি আমাদের শিক্ষক হবেন।” 

“না, তা হয় না। আমি আপনাদের কী শিক্ষা দেব? আপনারা আমাদের সময় থেকে কত এগিয়ে গেছেন। আর আমাকে পুনর্জীবিত করাটা হয়ত আপনাদের উচিত হয় নি। আমি তো মরতেই চেয়েছিলাম।” 

“মরতেই চেয়েছিলাম” কথাটা রুঢ় শোনায় অদিতার নিজের কানেই। 

অন্তরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সেই বিশাল ঘরে যন্ত্রের মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়, বেশ কয়েকজন কর্মীকে কাজে ব্যস্ত দেখা যায়। 

অন্তরা বলে, “অদিতা-সান, এই মহাবিশ্বকে ক্ষণিকের জন্য দেখার ও বোঝার সৌভাগ্য আমাদের মত সচেতন অস্তিত্বের হয়েছে। মহাবিশ্বের কোটি কোটি বছরের অস্তিত্বে আমাদের জীবন চোখের পলক মাত্র। এখান থেকে চলে গেলে সেই অনুভূতির শেষ হবে, কিন্তু যতদিন আমরা আছি ততদিন এই বাস্তবতাকে অনুভব করার জন্য, বোঝার জন্য, আমাদের অস্তিত্বর সঙ্গে মহাবিশ্বের যোগাযোগ বোঝার জন্য আমি বেঁচে আছি। অদিতা-সান, আমাদের আশা আপনি আপনার জ্ঞান ও বিচক্ষণতা দিয়ে আমাদের এই বেঁচে থাকাকে আরো সমৃদ্ধ করবেন।” 

“কিন্তু আপনারা প্রায় দু হাজার বছর পৃথিবীর মত আর একটা গ্রহের সন্ধান করেছেন, পান নি। আবার এই অতল আঁধারে কেন যাত্রা করছেন?” 

“আমাদের গ্যালাক্সি খুব বড় অদিতা-সান। আমরা তার শতকরা ১ ভাগও দেখে উঠতে পারে নি। এবার আমরা যাব সম্পূর্ণ অন্য একটা দিকে। এই খোঁজার মধ্যেই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য।” 

অদিতা তার সামনে নতুন মহাকাশযান সৃষ্টির কর্মযজ্ঞ দেখে। গতকাল তার আর একটা জীবন ছিল, কিন্তু তা ছিল সাতশ বছর আগে, এই নতুন পৃথিবীতে সেই সাতশ বছর আগের সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে। এবার হয়তো তার পৃথিবীকে ছেড়ে যাবার পালা। 

“আর মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন? আপনারা কী সেই প্রতিস্থাপন শুরু করেছেন?” 

“আমরা প্রতিস্থাপন প্রকৌশল উন্নত করেছি,” বলে অন্তরা, “কিন্তু প্রতিস্থাপন করব কিনা তা নিয়ে এখন আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। আমার মনে হয় এটা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। আপনি চাইলে মস্তিষ্ক কপি করবেন, না চাইলে না।” 

অদিতা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। হাজার ক্ষোভের মধ্যেও আশার আলো আছে। তার সামনে নক্ষত্রের জাহাজ ধীরে ধীরে প্রাণ পায়। পৃথিবীতে তার জীবনকে সে প্রলম্বিত করতে চায় নি, পরিচালনা কমিটির কাছে সে দরখাস্ত করেছিল তাকে যেন পুনরুজ্জীবিত না করা হয়। পৃথিবীতে সে থাকতে চায় নি, তাই হয়তো এবার পৃথিবী ছাড়ার পালা। তার মস্তিষ্ক আর কপি করা হবে না, এবার তার মৃত্যু হবে নক্ষত্রদের মাঝে।

অদিতা অন্তরার দিকে তাকায়। অন্তরা এই প্রথম দেখে অদিতার মুখে স্মিত হাসি। বিরাট ঘরটার এক কোনায় গর্জে ওঠে মহাকাশযানের একটা ইঞ্জিন। নতুন প্রকৌশলের অনুশীলন হচ্ছে।

- সমাপ্ত -

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ



  1. অসাধারণ সমাপ্তি ! আমি কেঁদেই ফেল্লাম .....।
    ২৭ বছর আগে, হুমায়ুন আহমেদের "তোমাদের জন্য ভালবাসা" পড়ে কেঁদেছিলাম - এমনই।
    ____________________________________________________________
    তবে হুমায়ুন আহমেদের চাইতে দীপেন দা'র গল্প বলার ঢঙ ও ভাষা অনেক ভিন্ন, আধুনিক আর সাবলীল মনে হয়েছে আমার কাছে। বাংলা নাম ও শব্দচয়ন আর আদ্যোপান্ত বাংলায় বলে যাওয় - অনোন্যসাধারণ।
    এই পৃথিবী ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত ও তার সমীকরণটি এক কথায় চমৎকার!
    এরকম বরাত আবার কবে হবে, কে জানে।

    ~ রবিউল ইসলাম সবুজ।

    উত্তরমুছুন