২০১৭ যুব সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন গল্পকার শমীক ঘোষ, এলভিস ও অমলাসুন্দরী গল্পসঙ্কলনের জন্য। শমীক নিজে তাঁর গল্প বিষয়ে বলে থাকেন, “বাস্তবকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে, দেখা আর না-দেখার শুঁড়িপথ ধরে অন্য কোন বাস্তবের নির্মাণ।”
শমীকের গল্পসঙ্কলন ‘এলভিস ও অমলাসুন্দরী’ এবং তাঁর লেখা ও লেখায় উঠে আসা সমাজের অন্ত্যজ হেরে যাওয়া মানুষদের কথা- ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে গল্পকারের আড্ডায় রিমি মুৎসুদ্দি।
----------------------------------------------------------------+
কিন্তু প্রলেতারিয়েত একবার লুম্পেন হলে তার ফেরার পথ থাকে সেটাও বুঝি।
থাকে না। হাফ টাইম আসলে তো লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের গল্প নয়। হাফ টাইম আসলে ক্লাস কনশাসনেসের গল্প।
আমি বলেছি হেরে যাওয়া মানুষেরা কি এরপরও আপনার লেখায় জায়গা পাবেন? এই হারের জন্য রাষ্ট্রের দায় কি অস্বীকার করা যায়?
শমীকের গল্পসঙ্কলন ‘এলভিস ও অমলাসুন্দরী’ এবং তাঁর লেখা ও লেখায় উঠে আসা সমাজের অন্ত্যজ হেরে যাওয়া মানুষদের কথা- ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে গল্পকারের আড্ডায় রিমি মুৎসুদ্দি।
----------------------------------------------------------------+
রিমিঃ
এলভিস ও অমলাসুন্দরী গল্পসঙ্কলনের ‘ঘোলা’ গল্পটা আপনার প্রথম লেখা। গল্পটায় নেহেরুয়ান অর্থনীতির এক ভয়াবহ রূপ দেখিয়েছেন । আপনি কি মেধাপাটেকর, অরুন্ধুতি রাও-এর নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে উৎসাহী হয়ে লিখেছিলেন?
শমীকঃ
ঘোলা লিখেছিলাম ছোট বয়সে। খুব দুর্বল গল্প। আবার ওটাই আমার প্রথম লেখা গল্প। প্রথম ছাপা হওয়া গল্প। আমার তখন ১৯-২০ বছর বয়স হবে। তাঁর কিছু আগে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন হয়েছে। আমরা সেই সময় বেড়াতে গিয়েছিলাম মাইথনে। অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি। অসাধারণ সুন্দর। কিন্তু আমার তখন বারংবার মনে হচ্ছিল যে নর্মদার বাঁধটাও হলে হয়ত এইরকমই নৈস্বর্গের শোভা থাকবে।
এত সুন্দরই হবে জায়গাটা। অথচ প্রতিট বাঁধই আসলে মানুষের ডিসপ্লেসমেন্টের গল্প। মানুষের বহু বছরের আবাসভূমিকে উন্নয়ন নামক মুলো ঝুলিয়ে একদিনে কেড়ে নেওয়ার গল্প। এই থেকেই লিখেছিলাম। সেই বয়সে নেহেরুর অর্থনীতি বুঝতাম না। এইটুকু জানতাম যে বড় বাঁধ আসলে প্রকৃতির পক্ষে ক্ষতিকর। কনস্ট্রাকশান কম্পানি আর নেতা মন্ত্রী ছাড়া কারো লাভ হয় না। বা হলেও যাঁদের উচ্ছেদ করে হল, যাঁদের ক্ষতি করে হল, তাঁদের কোনো লাভ হয় না।
এত সুন্দরই হবে জায়গাটা। অথচ প্রতিট বাঁধই আসলে মানুষের ডিসপ্লেসমেন্টের গল্প। মানুষের বহু বছরের আবাসভূমিকে উন্নয়ন নামক মুলো ঝুলিয়ে একদিনে কেড়ে নেওয়ার গল্প। এই থেকেই লিখেছিলাম। সেই বয়সে নেহেরুর অর্থনীতি বুঝতাম না। এইটুকু জানতাম যে বড় বাঁধ আসলে প্রকৃতির পক্ষে ক্ষতিকর। কনস্ট্রাকশান কম্পানি আর নেতা মন্ত্রী ছাড়া কারো লাভ হয় না। বা হলেও যাঁদের উচ্ছেদ করে হল, যাঁদের ক্ষতি করে হল, তাঁদের কোনো লাভ হয় না।
রিমিঃ
এলভিস ও অমলাসুন্দরী গল্পটার প্লট কিভাবে পেলেন? বাস্তবে কি কোন অমলাসুন্দরীর দেখা পেয়েছিলেন?
শমীকঃ
এলভিস ও অমলাসুন্দরী। দশ বছর পর আমি যখন আবার লিখব ঠিক করলাম, তখন ফেসবুকে আমার বন্ধু দোলনচাঁপা এই গানটা শেয়ার করেছিল। সে এলভিসের ভক্ত। আমি ততটা নই। অথচ গানটা শুনতে শুনতে আমার একটা দৃশ্য মাথায় আসছিল। একটা সিড়ি দিয়ে উঠে একটা ঘর, সেই ঘরে গাউন পরা এক মহিলা আর স্যুট পরা একজন পুরুষ নাচছেন। বল ড্যান্স।
ওই ভাবনাটা নিয়ে খেলতে খেলতেই গল্পটা। অমলাসুন্দরী চরিত্রে আমার এক দিদার আদল ছিল। চেহারায়। হাবে ভাবে। কথার ভঙ্গিমায়। ওইরকম অভিজাত। আবার ওইরকম ডাঁটিয়াল। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ তাঁর জীবনের সঙ্গে মেলে না। আসলে গল্পে তো আমরা ব্যক্তিজীবন থেকেই উপাদান নিই। সেইগুলোকেই সাজাই নিজেদের মতো করে।
ওই ভাবনাটা নিয়ে খেলতে খেলতেই গল্পটা। অমলাসুন্দরী চরিত্রে আমার এক দিদার আদল ছিল। চেহারায়। হাবে ভাবে। কথার ভঙ্গিমায়। ওইরকম অভিজাত। আবার ওইরকম ডাঁটিয়াল। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ তাঁর জীবনের সঙ্গে মেলে না। আসলে গল্পে তো আমরা ব্যক্তিজীবন থেকেই উপাদান নিই। সেইগুলোকেই সাজাই নিজেদের মতো করে।
রিমিঃ
একটি অতিআলৌকিক কথন অথবা নিছক কইমাছ- গল্পটা অসম্ভব ডার্ক একটা পোর্টেট বলা যেতে পারে। এই ধরণের লেখার জন্য কি আলাদা কোন পরিকল্পনা থাকে?
শমীকঃ
না, ওটা মুম্বাইতে বসে লেখা।
রিমিঃ
বলিউডের কল্যাণে মুম্বাইয়ের অন্ধকার জগত সম্পর্কে কম বেশি ধারণা সকলেরই আছে। মুম্বাইয়ের অন্ধকার জগত কি প্রভাব ফেলেছিল গল্পটা লিখতে?
শমীকঃ
আমার ছোটবেলাটা এমন এক জায়গায় কেটেছে যেখানে আশেপাশে বস্তি ছিল এবং খুব সাধারণ বস্তি নয়। বেশ অপরাধপ্রবণ অঞ্চল। আমার এক ছেলেবেলার ক্রিকেট খেলার সঙ্গী, পরে ক্রিমিনাল হয়। আমার থেকে কয়েক বছরের বড় ছিল সে। আমি যখন ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ি তখন সে খুন হয়ে যায়। ঐ ঘটনাটাকে নিয়েই লিখতে চেয়েছিলাম। মানে ঠিক ঐ ঘটানাটা নয়। খানিকটা অন্যরকম। ওই গল্পটায় আমি কিছুটা হরর অফ দ্য কমেডি ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। মানে কমেডি ততক্ষণই কমেডি যতক্ষণ আপনি তাঁর বাইরে। এই গল্পে আমার আরো একটা কথা ছিল। লুম্পেন প্রলেতারিয়েত কে নিয়ে আসলে একধরণের রোম্যান্টিসিজম আছে অনেকের। আমি লুম্পেন প্রলেতারিয়েত কে দেখেছি। লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের আলটিমেট ডেস্টিনি কী সেটা জানি। সেটাও বলতে চেয়েছিলাম।
রিমিঃ
কখনও কি কোন কমেডির ভিতরে ঢুকে কোন চরিত্র হয়েছিলেন?
মানে বলতে চাইছি ঈশ্বরের কান্না গল্পের কোন ঈশ্বরকে কি কাছ থেকে দেখেছেন?
শমীকঃ
আপনি যেই কমেডির ভিতরে, আপনি নিজেই যখন তাঁর মূল চরিত্র তখন সেটা কিন্তু আপনার কাছে হরর। অর্থাৎ আপনার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে তখন সেটা হরর। এটা কিছুটা কাফকান। আসলে হঠাৎ ঈশ্বর বা ঈশ্বরের মতো কেউ একজন খুনেকে খুন করতে বারণ করবে কেন? মানে খেয়ে বসে কাজ নেই নাকি? আর যদি বা করেন তখন সেই খুনেই বা সেটা শুনবে কেন? কিন্তু ধরা যাক সে শুনল। হঠাৎ একদিনে তাঁর খুন করার জন্য অনুশোচনা হল। সে খুন করতে রাজি হল না। তখন কী হবে?
রিমিঃ
নীল পিঁপড়ে, ভিউফাইণ্ডার, টিউলিপ গল্পগুলো মেইনস্ট্রীম ছোঁয়া। আবার দুরবীন, তুলসীতলা, ক্যানভাস এমনকি লোকটা গল্পটাও ননলিনিয়ার। এই যে ছক ভাঙা লেখা, মেইনস্ট্রীমের বাইরে থাকার চেষ্টা- এতে ঝুঁকি মনে হয় না?
শমীকঃ
আমি মেনস্ট্রিম শব্দটার আমি মানে বুঝিনা। আমি নানা রকম লেখবার চেষ্টা করি। বিভিন্ন ভাবে। বিষয় অনুযায়ী আবার কখনও ফর্মগত দিক দিয়েও। ফর্ম আর বিষয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। মানে কোন গল্পটা কোন ফর্মে বলব।
রিমিঃ
মেইনস্ট্রিম শব্দটার সাথে বাণিজ্যিক শব্দটাও যুক্ত
শমীকঃ
যে গল্পটা বলতে চাইছি সেটাকে সেইভাবে বলার চেষ্ট করি। দেখুন আমার বইতে স্পষ্ট লেখা আছে। যে আমি বানিজ্যিক কাগজেও লিখি আবার লিটল ম্যাগাজিনেও লিখি। লিটল ম্যাগাজিনে পরীক্ষা নিরিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি। তাঁরা সেইরকম লেখাই চান। মূলত তাঁর একটা কারণ হল লিটল ম্যাগাজিনের পাঠক অন্যরকম। আবার বানিজ্যিক পত্রিকার পাঠক অল ইনক্লিউসিভ। ফলে লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের অনেক ধরণের গল্পকে জায়গায় দেওয়ার সুযোগ থাকে। বানিজ্যিক কাগজের সম্পাদকের কম থাকে। তবে দূরবিন বা লোকটা দেশ পত্রিকায় ছাপা গল্প। দুটো গল্পেই কিছু অন্যরকম ব্যাপার ছিল। দূরবিনে টাইম স্পেস নিয়ে খেলা ছিল। প্রতীকের ব্যবহার বেশী ছিল। আবার লোকটা একটা প্রবল অ্যাবসার্ড গল্প। দুটো ক্ষেত্রেই দেশের সম্পাদকমন্ডলি একজন অচেনা লেখককে এই ধরণের লেখা লিখতে সুযোগ দিয়েছেন। সেই জন্য আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি মনে করি, একজন ভালো লেখক নিজেকে বারংবার পরীক্ষা করবেন, যাচাই করবেন, বাজিয়ে দেখবেন। এটা পারি কিনা, ওটা পারি কিনা।
আমি সেটার চেষ্টা করি। কখনও তাই আমার প্রেমের গল্প লিখতে ইচ্ছা করে, কখনও আবার খুব অন্যরকম অ্যাবসার্ডিটি নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে।
আমি সেইটুকুই চেষ্টা করি। হয় কিনা সেই বিচার পাঠকের। সম্পাদকের।
আমি সেটার চেষ্টা করি। কখনও তাই আমার প্রেমের গল্প লিখতে ইচ্ছা করে, কখনও আবার খুব অন্যরকম অ্যাবসার্ডিটি নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে।
আমি সেইটুকুই চেষ্টা করি। হয় কিনা সেই বিচার পাঠকের। সম্পাদকের।
রিমিঃ
টিউলিপ গল্পটা একটা প্রেমের গল্প। আপনার অন্য গল্পগুলোর থেকে স্বতন্ত্র। এটা কি মেইনস্ট্রীমকে ছোঁয়ার প্রয়াস? নিজের লেখাকে কোন বিশেষ ছাঁচে না ফেলে মেইনস্ট্রীম আর মেইনস্ট্রীমের বাইরে এই দুইয়ের মধ্যবর্তী একটা জায়গায় এনে ফেলা?
শমীকঃ
টিউলিপ লেখাটা চেয়েছিলেন আমার অগ্রজ লেখক জয়ন্ত দে। বর্তমানের পুজোর ক্রোড়পত্রের জন্য। উনি বলেছিলেন প্রেমের গল্প লিখতে। আমার যাঁরা গুরু লেখক, যাঁদের কাছ থেকে লেখার ক্রাফট শিখেছি। বহু সময় আটকে গেলে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁদের একজন উনি।
আমি লিখেছিলাম। আমার মতো করে প্রেমটাকে ডিল করেছিলাম
আমার মনে হয়েছিল প্রেম নিয়ে লিখব। বাল্যপ্রেম নিয়ে। প্রেমের ব্রীড়া নিয়ে। এইটুকুই।
আমি লিখেছিলাম। আমার মতো করে প্রেমটাকে ডিল করেছিলাম
আমার মনে হয়েছিল প্রেম নিয়ে লিখব। বাল্যপ্রেম নিয়ে। প্রেমের ব্রীড়া নিয়ে। এইটুকুই।
রিমিঃ
ঈশ্বরের কান্না গল্পের ঈশ্বরকে আপনি নায়ক হিসাবে দেখিয়েছেন। একটা নেগেটিভ চরিত্রের মধ্যে সফট রোমান্টিসিজম বা বিবেকবোধ জাগিয়ে তোলা- এই ফর্মের বিষয়ে কিছু বলুন
আপনি কি কোনদিন ঈশ্বরের মত চরিত্রের মুখোমুখি হয়েছেন? কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা?
আপনি কি কোনদিন ঈশ্বরের মত চরিত্রের মুখোমুখি হয়েছেন? কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা?
শমীকঃ
ঈশ্বর নেগেটিভ কোথায়? ঈশ্বর তো ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষ। হ্যাঁ এই গল্পের প্রথম দিকে ঈশ্বর লুম্পেন প্রলেতারিয়েত। এইখানে আমি অতিলৌকিক কথনের থেকে আলাদা স্ট্যান্ড নিয়েছি। এইখানে ঈশ্বরের প্রতি সংবেদনশীল।
ঈশ্বর হল ভারতবর্ষের প্রকৃত হেরে যাওয়া মানুষ। যাঁদের কথা আমরা ভারতবর্ষের, শাইনিং ইন্ডিয়ার মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছি।
ঈশ্বরকে বার বার ফিরিয়ে আনার মধ্যে আমি লেখক হিসাবে আমার স্ট্যান্ড পরিস্কার করে দেখিয়েছি।
সেই জন্যই চরিত্রটার নাম ঈশ্বর। একদম সেই কারণেই।
আপনি জিজ্ঞাসা করছিলেন আমি ঈশ্বরদের দেখেছি কিনা। উত্তর হবে হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু এর বেশী কিছু বলা লেখকের উচিৎ হবে না।
ঈশ্বর হল ভারতবর্ষের প্রকৃত হেরে যাওয়া মানুষ। যাঁদের কথা আমরা ভারতবর্ষের, শাইনিং ইন্ডিয়ার মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছি।
ঈশ্বরকে বার বার ফিরিয়ে আনার মধ্যে আমি লেখক হিসাবে আমার স্ট্যান্ড পরিস্কার করে দেখিয়েছি।
সেই জন্যই চরিত্রটার নাম ঈশ্বর। একদম সেই কারণেই।
আপনি জিজ্ঞাসা করছিলেন আমি ঈশ্বরদের দেখেছি কিনা। উত্তর হবে হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু এর বেশী কিছু বলা লেখকের উচিৎ হবে না।
রিমিঃ
হ্যাঁ, কখনও আপনি সংবেদনশীল হচ্ছেন লুম্পেন প্রোলেতারিয়েত, নিপীড়িত ভারতবর্ষ বলে একটা সফট কর্ণার তৈরি করছেন আবার অতি আলৌকিক কথন বা হাফ টাইমের পর গল্পে এর বিপরীত অবস্থান
শমীকঃ
লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের লুম্পেন হওয়ার কারণটা বুঝি।
কিন্তু প্রলেতারিয়েত একবার লুম্পেন হলে তার ফেরার পথ থাকে সেটাও বুঝি।
থাকে না। হাফ টাইম আসলে তো লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের গল্প নয়। হাফ টাইম আসলে ক্লাস কনশাসনেসের গল্প।
রিমিঃ
হ্যাঁ, এখানেও আপনি মধ্যবিত্ত ক্লাসের ডার্কনেসটাই তুলে ধরেছেন
শমীকঃ
বন্ধুত্বেও একটা বয়সের পর ক্লাস থাকে। দেখুন আগেও বলেছি যে আমার বাল্যকালের ক্রিকেট খেলার সঙ্গীরা অনেকেই বস্তিতে থাকত। বহু বছর পর তাঁদের একজনকে আমি দেখি গড়িয়াহাটের ফুটপাথে হকার হিসাবে।
রিমিঃ
আপনার গল্পের লেবু চরিত্র?
শমীকঃ
আমি তাকে দেখে থমকাই। সেও আমাকে চিনতে পারে। কিন্তু ওইটুকুই কয়েক মুহূর্ত পর চোখ সরিয়ে নিয়ে সে আবার খদ্দেরদের ডাকতে থাকে।
আমিও বুঝে যাই আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্বের মধ্যে ক্লাস কনশাসনেস এসে গিয়েছে। আমরা কেউই সমাজের সেই ব্যারিকেডটা ভাঙতে পারব না। আপনি ভাবতে পারেন যে হাফটাইমের পর আসলে আমার সেই অপরাধবোধ থেকেই লেখা। বন্ধুকে অপমান করা থেকে লেখা।
আমিও বুঝে যাই আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্বের মধ্যে ক্লাস কনশাসনেস এসে গিয়েছে। আমরা কেউই সমাজের সেই ব্যারিকেডটা ভাঙতে পারব না। আপনি ভাবতে পারেন যে হাফটাইমের পর আসলে আমার সেই অপরাধবোধ থেকেই লেখা। বন্ধুকে অপমান করা থেকে লেখা।
রিমিঃ
বাকীটা আপনার কল্পনা?
তবে সাউথপয়েন্টের ছেলে ফুটপাথে হকার এটা ভাবতে একটু অবাক লাগছে।
শমীকঃ
আমি আমার ব্যক্তিজীবন নিয়ে একটাও গল্প লিখিনি। সব কটাই কল্পনা। কিন্তু হ্যাঁ আমার দেখা জীবন সেইখানে ঢুকে পড়েছে। আমি তাদের গায়ে মাংস লাগিয়েছি, রঙ বদলে দিয়েছি। কাহিনী বদলেছি।
না আমি সাউথপয়েন্টে পড়তাম। সে পড়ত না। সে তো আমার পাড়ার ক্রিকেট খেলার সঙ্গী। আমার পাড়ায় বস্তি ছিল বললাম তো। এবং আমার সমবয়স্ক একজনই ছিল তথাকথিত ভদ্রলোক। দেখুন আমার ছোটবেলাটা অদ্ভুত। ক্লাস সিক্স অবধি। আমি পড়ি কলকাতার বিত্তশালী, উচ্চমধ্যবিত্তদের সঙ্গে। আর আমার পাড়ার ক্রিকেট খেলার সঙ্গীরা সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর। ফলে আমি হয়ত এই দুটো শ্রেণীকেই দেখেছি।বুঝতে শিখেছি। অত ছোটবেলায় তো ক্লাস কনশাসনেস থাকে না পুরোপুরি। সামান্য থাকে। কিন্তু খেলার সময় থাকে না। শর্ট রান নেওয়ার ডাকের সময় থাকে না। ক্যাচ নেওয়ার সময় থাকে না।
না আমি সাউথপয়েন্টে পড়তাম। সে পড়ত না। সে তো আমার পাড়ার ক্রিকেট খেলার সঙ্গী। আমার পাড়ায় বস্তি ছিল বললাম তো। এবং আমার সমবয়স্ক একজনই ছিল তথাকথিত ভদ্রলোক। দেখুন আমার ছোটবেলাটা অদ্ভুত। ক্লাস সিক্স অবধি। আমি পড়ি কলকাতার বিত্তশালী, উচ্চমধ্যবিত্তদের সঙ্গে। আর আমার পাড়ার ক্রিকেট খেলার সঙ্গীরা সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর। ফলে আমি হয়ত এই দুটো শ্রেণীকেই দেখেছি।বুঝতে শিখেছি। অত ছোটবেলায় তো ক্লাস কনশাসনেস থাকে না পুরোপুরি। সামান্য থাকে। কিন্তু খেলার সময় থাকে না। শর্ট রান নেওয়ার ডাকের সময় থাকে না। ক্যাচ নেওয়ার সময় থাকে না।
রিমিঃ
তুলসীতলায় ছেচল্লিশের দাঙ্গা আছে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে কিছুটা ঢুকে পড়েছে, আবার অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙা পরবর্তী কলকাতাও রয়েছে। এটা কি এই সময়ের হিন্দু-মুসলিম চাপানোতর নিয়ে সচেতন লেখা। সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া?
শমীকঃ
অনেকেই আমাকে বলেছেন যে তুলসীতলা তে দুটো আলাদা ঘটনাকে আনা হল কেন? এবং বাবরী মসজিদ ও তো অনেক আগের ঘটনা। আমি এত পরে অন্য কিছু আনলাম না কেন। আমার মনে হয় বাবরী মসজিদ হল গোটা উপমহাদেশের একটা খুব জরুরি অধ্যায়। একটা কালমিনেশান পয়েন্ট। ৯০ এর দশকে ভারতবর্ষের অর্থনীতি বিশ্বের কাছে খুলে যাচ্ছে। ৯০ এর দশকেই আবার বাবরী মসজিদ ভাঙা হচ্ছে। এটা ভারতীয় সমাজের একটা ট্র্যাঞ্জিশানকে সিগনিফাই করে বলে আমার ধারণা। এবং ৪৬ এর সময় পাকিস্তান নামক একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র এবং ভারতবর্ষ নামক একটা সেকুলার ধারণার জন্ম হয়। সেইটাই সংঘাত ছিল। হিন্দু ও মুসলমানের।
এর প্রায় সাড়ে চার দশক পরে ভারতবর্ষের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার সেই দিকে ফিরে গেল। সেটা ভালো না খারাপ সেই কথাটা আমার লেখায় আছে। সেটা নিয়ে বলব না। বাট আই ফিল বাবরি মসজিদ ইজ দ্য আনফিনিশড বিজনেস অফ পার্টিশান।
সেই জন্যই তুলসীতলা লেখা।
ওর মে বি বাবরী মসজিদ ইজ ব্রিংগিং ব্যাক দ্য আদার কনসেপ্ট অফ হোয়াট ইন্ডিয়া ক্যুড হ্যাভ বিন।
সেটা করার কিছু কারণ আছে। সেই কথাগুলো বলা রাজনীতি হবে। লেখকের সেই কথাটুকু তাঁর লেখায় ঈঙ্গিতের মধ্যে দেবেন। সেইটাই অভিপ্রেত।
এর প্রায় সাড়ে চার দশক পরে ভারতবর্ষের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার সেই দিকে ফিরে গেল। সেটা ভালো না খারাপ সেই কথাটা আমার লেখায় আছে। সেটা নিয়ে বলব না। বাট আই ফিল বাবরি মসজিদ ইজ দ্য আনফিনিশড বিজনেস অফ পার্টিশান।
সেই জন্যই তুলসীতলা লেখা।
ওর মে বি বাবরী মসজিদ ইজ ব্রিংগিং ব্যাক দ্য আদার কনসেপ্ট অফ হোয়াট ইন্ডিয়া ক্যুড হ্যাভ বিন।
সেটা করার কিছু কারণ আছে। সেই কথাগুলো বলা রাজনীতি হবে। লেখকের সেই কথাটুকু তাঁর লেখায় ঈঙ্গিতের মধ্যে দেবেন। সেইটাই অভিপ্রেত।
রিমিঃ
দুরবীন গল্পে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলোকাস্ট আর বাংলার দুর্ভিক্ষ কিভাবে তিনটে মেলালেন। মানে আপনার ভাবনায়?
শমীকঃ
দূরবিন গল্পটা নিয়ে আমি খুব খেটেছিলাম। আমি কোনোদিনও পোল্যান্ড যাইনি। আমি কোনোদিনও ইয়োরোপে যাইনি। আমি কোনোদিন বরফ পড়া দেখিনি। আমি পোলিশ জানি না। জার্মানও জানি না। কিন্তু দূরবিন গল্পটা মাথায় আসার পর আমি একমাস শুধু রিসার্চ করেছিলাম। আসলে দূরবিন কি যা দূরকে কাছে আনে, কাছের জিনিসকে দূরে নিয়ে যায়। আসলে দূরবিন আমার সময়ের কথাই। অন্যভাবে বলা। ঈঙ্গিতে বলা। গোটা পৃথিবীর রাজনীতি যে দিকে যাচ্ছে তাঁর দিকেই ঈঙ্গিত করা। সেইখানে দূরটা সেকেন্ড ওয়ার্লড ওয়ার। হলোকাস্ট।
কিন্তু হলোকাস্ট টা একমাত্র ইতিহাস নয়, বাংলার মন্বন্তর এবং চার্চিলের বাংলাকে না খাইয়ে মারার অপচেষ্টাও কারণ। যুদ্ধ-হানাহানি ক্রমাগত তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াই আবার বুঝে না বুঝে সেইটার পার্ট হয়ে যাওয়াটাও কারণ। এইগুলো নিয়েই দূরবিন। তবে কী দূরবিন নিয়ে অনেকে খুব উচ্ছ্বসিত। তাঁরা মনে করেন খুব ভালো। অনেকে বলেন খুব খারাপ, আমি কত জানি সেটা জাহির করেছি। এবং দূরবিন জানুশ কোরচাক এবং রবীন্দ্রনাথের গল্পও।
কিন্তু হলোকাস্ট টা একমাত্র ইতিহাস নয়, বাংলার মন্বন্তর এবং চার্চিলের বাংলাকে না খাইয়ে মারার অপচেষ্টাও কারণ। যুদ্ধ-হানাহানি ক্রমাগত তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াই আবার বুঝে না বুঝে সেইটার পার্ট হয়ে যাওয়াটাও কারণ। এইগুলো নিয়েই দূরবিন। তবে কী দূরবিন নিয়ে অনেকে খুব উচ্ছ্বসিত। তাঁরা মনে করেন খুব ভালো। অনেকে বলেন খুব খারাপ, আমি কত জানি সেটা জাহির করেছি। এবং দূরবিন জানুশ কোরচাক এবং রবীন্দ্রনাথের গল্পও।
রিমিঃ
এই দুটো আলাদা সময়কে মেলানো বাংলা সাহিত্যে বিশেষত ছোটগল্পে বিশেষ দেখা যায় নি। সত্যজিৎ রায়ের নীল উপাখ্যান এর উদাহরণ হতে পারে।
শমীকঃ
জানুশ কোরচাক এবং রবীন্দ্রনাথ যা বোঝান, তাঁদের যা দর্শন ছিল সেটার গল্পও।
রিমিঃ
আপনার কি মনে হয় ভারতবর্ষে লেখালেখির জগতে সাম্প্রদায়িকতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে? বাংলাদেশের একজন লেখক যতটা না সংখ্যালঘু সমস্যা নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য হবেন আমাদের এদেশে কিন্তু সংখ্যালঘু লেখক তাঁর সমস্যা ফুটিয়ে তুলতে পারবেন?
শমীকঃ
ভারতবর্ষ একটা বিরাট দেশ। ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অনেক ভালো গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে।
কিন্তু আমার নাম পদবী সংখ্যালঘুদের মতো নয়। ফলে আমার জানা নেই যে একজন লেখক কী সমস্যায় পড়তে পারেন।
কিন্তু আমার নাম পদবী সংখ্যালঘুদের মতো নয়। ফলে আমার জানা নেই যে একজন লেখক কী সমস্যায় পড়তে পারেন।
রিমিঃ
সংখ্যালঘু সমস্যা নিয়ে লিখতে গিয়ে বা লিখবেন ভেবেও কি কখনও পিছিয়ে এসেছেন?
শমীকঃ
আমার লেখায় সংখ্যালঘুর সমস্যা বার বার এসেছে। ঘুরে ফিরে। যেমন এনকাউন্টার। আসলে আপনি যদি দূরবিন প্রসঙ্গে বা তুলসীতলা নিয়ে আমার উত্তরগুলো দেখেন তাহলে দেখবেন যে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দিয়েছি।
রিমিঃ
আপনার প্রথম গল্পেই রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। প্রথম গল্পেই এই সাহস কি একটু ঝুঁকি মনে হয়েছিল?
শমীকঃ
প্রথম গল্প লেখার সময় এত ম্যাচুওর্ড ছিলাম না যে ঝুঁকি মনে হবে। যা বলতে চাইছিলাম সেটাই গল্প করার চেষ্টা করেছি।
রিমিঃ
এখন কি সেই ঝুঁকি আবার নিতে পারবেন? না রাষ্ট্র কর্তৃক পুরস্কৃত হয়ে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হবেন?
শমীকঃ
দেখুন একজন লেখকের একটা রাজনৈতিক দর্শন থাকবে। যেমন একজন সচেতন মানুষের থাকা উচিত। সচেতন মানুষরাই তো সাধারণত লিখতে আসেন। কিন্তু একজন লেখক আর রাজনৈতিক নেতার তফাৎ আছে। একজন লেখকের বারংবার মনে হতে পারে যে তিনি রাজনীতি করতেই পারবেন। কিন্তু একজন লেখক আসলে এটাও জানেন যে শেষ অবধি সব রাজনীতিই আসলে ক্ষমতায় থাকার লড়াই। সব রাজনৈতিক চেতনাই আসলে তাই শেষ পর্যন্ত ফিউটাইল।
পরের প্রশ্ন - ঝুঁকি। আমি লিখতে এসেছি। আমার কথা বলতে এসেছি। কাউকে খুশি করতে আসিনি। রাষ্ট্র যদি আমাকে একটা পুরস্কার দিয়ে থাকে তাহলে সেটা তাকে প্রতিস্পর্ধী হয়ে প্রশ্ন করার জন্যই হয়ত দিয়েছে। তাহলে কী আমি রাষ্ট্রের লিবারাল স্পেসের একজন ক্রিড়ানক মাত্র? রাষ্ট্রের হাতের পুতুল? এই প্রশ্নটা যদি নিজেকে করি তাহলে বলব উত্তর জানি না। একজন লেখকের উচিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবস্থান করা। আমার লেখায় সেটা বোধহয় আছে।
পরের প্রশ্ন - ঝুঁকি। আমি লিখতে এসেছি। আমার কথা বলতে এসেছি। কাউকে খুশি করতে আসিনি। রাষ্ট্র যদি আমাকে একটা পুরস্কার দিয়ে থাকে তাহলে সেটা তাকে প্রতিস্পর্ধী হয়ে প্রশ্ন করার জন্যই হয়ত দিয়েছে। তাহলে কী আমি রাষ্ট্রের লিবারাল স্পেসের একজন ক্রিড়ানক মাত্র? রাষ্ট্রের হাতের পুতুল? এই প্রশ্নটা যদি নিজেকে করি তাহলে বলব উত্তর জানি না। একজন লেখকের উচিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবস্থান করা। আমার লেখায় সেটা বোধহয় আছে।
রিমিঃ
পুরস্কার পাওয়ার পর কি সেই বিরোধী অবস্থান রাখতে কোথাও একটু কুন্ঠা হবে? না কি প্রতিস্পর্ধী হওয়ার স্পর্দ্ধা আপনার লেখক সত্তায় প্রভাব ফেলবে?
শমীকঃ
আমার বইয়ের ভূমিকায় আমি খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি লেখক হিসাবে আমার অবস্থান। আমি নিজে একজন হেরো মানুষ। তাই আমি আমার মতোই হেরে যাওয়া একা মানুষদের কথাই আমি বলতে চাই। এটাই আমার অবস্থান।
রিমিঃ
কিন্তু এখন তো আপনি সফল। তাহলে হেরো মানুষেরা কি আশা করতে পারেন তাদের আশ্রয় হবে আপনার লেখা?
শমীকঃ
পুরস্কার সাফল্যের মানদন্ড নাকি? আমি যখন দ্বিতীয়বার লেখা শুরু করি তখন আমি একটা বড় নামী ব্র্যান্ডের কর্পোরেট স্ট্র্যাটেজি বিভাগে চাকরি করছি। তা তখন কী অসফল ছিলাম?
রিমিঃ
পুরস্কার সাফল্যের মানদণ্ড- কিছুটা তো বটেই, যেহেতু স্বীকৃতি বা রাষ্ট্রকর্তৃক মান্যতা। লেখক হিসাবে সাফল্য।
শমীকঃ
একজন পুরস্কৃত মানুষও প্রেমিক হিসেবে অসফল হতে পারেন। একজন তথাকথিত সফল মানুষও তাঁর অতীতের কাছে ক্ষুদ্র ভঙ্গুর হতে পারেন। এইগুলো তো আমার লেখাতেই আছে। তাহলে এই প্রশ্নগুলোর মানে কী?
রাষ্ট্র আমাকে চাকরিও দিয়েছিল। রাষ্ট্র আমার পড়ার খরচে ভর্তুকিও দিয়েছিল। রাষ্ট্র আমাকে প্যানকার্ড পাসপোর্ট আধার কার্ড দিয়ছে। আমি রাষ্ট্রকে তখন কোথায় অস্বীকার করছি?
রাষ্ট্র আমাকে চাকরিও দিয়েছিল। রাষ্ট্র আমার পড়ার খরচে ভর্তুকিও দিয়েছিল। রাষ্ট্র আমাকে প্যানকার্ড পাসপোর্ট আধার কার্ড দিয়ছে। আমি রাষ্ট্রকে তখন কোথায় অস্বীকার করছি?
রিমিঃ
অস্বীকার করার কথা তো জিজ্ঞাসা করি নি। তবে অন্ত্যজ মানুষের যন্ত্রণার জন্য রাষ্ট্রের দায় অস্বীকার করা যায় কি?
শমীকঃ
দেখুন সলঝেনিৎসিন বা বুলগাকভ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই লিখেছেন। আবার ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন এমন লেখকদেরও আমরা চিনি। দেবেশ রায় তিস্তাপারের বৃত্তান্তর জন্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত রাষ্ট্রের অপদার্থতার কথাই বলে। অমর মিত্র অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর লেখাতেই রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা আছে। সব থেকে বেশী আছে মহাশ্বেতা দেবীর লেখায়। তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
অনিতা অগ্নিহোত্রি রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তাঁর লেখাতেও রাষ্ট্রীয় পলিসির বিরুদ্ধে কথা আছে। এখন আপনি কি এদেরও দ্বিচারীতা আছে বলতে চাইছেন?
অনিতা অগ্নিহোত্রি রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তাঁর লেখাতেও রাষ্ট্রীয় পলিসির বিরুদ্ধে কথা আছে। এখন আপনি কি এদেরও দ্বিচারীতা আছে বলতে চাইছেন?
রিমিঃ
কি মুশকিল! না আমি তো আপনাকে কোথাও দ্বিচারিতার কথা বলি নি?
আমি বলেছি হেরে যাওয়া মানুষেরা কি এরপরও আপনার লেখায় জায়গা পাবেন? এই হারের জন্য রাষ্ট্রের দায় কি অস্বীকার করা যায়?
শমীকঃ
আপনি সোজাসুজি বলেননি। সেইভাবে প্রশ্ন সাজিয়েছেন। আমার লেখার টেক্সখুলে দেখান যে আমি কোথায় সমঝোতা করেছি। আপনি যে প্রশ্নটা করলেন সেই প্রশ্নটার উত্তর আমার ঈশ্বরের কান্নায় আছে। আমার যা বলার আমি আমার লেখায় বলে দিয়েছি। আমার স্ট্যান্ডও বলে দিয়েছি।
রিমিঃ
আপনার প্রশ্ন বুঝতে ভুল হচ্ছে। এই তর্কের শেষ হবে না বোধহয়। প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছি। নতুন যারা লিখছেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন
শমীকঃ
নতুন লেখক? আমিও নতুন লেখক। অন্যদের কী বলব? আগের প্রশ্নটার উত্তর - এমনকি আমার এনকাউন্টার গল্পেও আছে, ইয়ে দাগ দাগ উজালাতেও আছে, হাফ টাইমের পরে তেও আছে। অতিলৌকিক কথন অথবা নিছক কইমাছেও আছে। আমার কথা তো আমার লেখাতেই বলা আছে।
রিমিঃ
বেশ আমি কনক্লিউড করছি, আপনার লেখাই আপনার বক্তব্য। আগামী দিনেও তাই হবে আশা করি।
শমীকঃ
রাষ্ট্রের ধারণার জন্য আছে। কিন্তু এর বাইরেও প্রান্তিকতা আছে। একজন এফিম্যানিয়াক মানুষ কি প্রান্তিক নন? একজন সিজোফ্রেনিক? একজন খুব সফল ব্যবসাদার যাঁকে তাঁর স্ত্রী ভালোবাসেন না? কিংবা এমন একজন যিনি লেখক হতে চান, খাটেন কিন্তু লেখা ছাপা হয় না কোথাও তিনি কি প্রান্তিক নন? আমার কাজ প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে। রাষ্ট্রের কারণে প্রান্তিকতাও যেমন আমার লেখার বিষয় তেমন আরো নানা কারণে প্রান্তিক মানুষও আমার লেখার বিষয়। মানুষ আমার সাধনগুরু। মানুষই আমার সিদ্ধাই। মানুষের কথা বলাই আমার কাজ।
রিমিঃ
হ্যাঁ, সহমত আপনার সঙ্গে।
শমীকঃ
আর আমি রাষ্ট্রের বিরোধীতার থেকে বেশী যেটার বিরোধীতা করি সেটা হল ক্ষমতার। ক্ষমতা একটা ভীষণ কঠিন ধারণা। লিটিল ম্যাগের সম্পাদকও ক্ষমতা, রাষ্ট্রও ক্ষমতা, কর্পোরেটও ক্ষমতা, এমনি বাধ্যতামূলক বৈধ বিয়েও একটি ক্ষমতা। আমি ক্ষমতার বিরুদ্ধে।
রিমি মুৎসিদ্দি
গল্পকার। প্রবন্ধকার। অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক।
দিল্লীতে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ