লেখার শৈলী বিষয়ক সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : এমদাদ রহমান
রুমা মোদক। গল্পকার। নাট্যকার। শিক্ষক। মঞ্চাভিনেত্রী। দুটি গল্প সংগ্রহ বই হয়েছে। তৃতীয় গল্প সংগ্রহ ‘গোল’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের ৩টি নাটক’ নামে দুটি বই প্রকাশের পথে।
শেষ বইটির নাম প্রসঙ্গটি বিব্রতকর, তার আগের বইটির নাম ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক ভিন্ন স্বর তিনি। তার সঙ্গে কথা হয় অনলাইনে। দেশ-বিদেশের দূরত্ব ঘুচে যায়, কথা বলেন তিনি আন্তরিক ভঙ্গিতে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
সাক্ষাতকারী :
রুমা'দি, অন্ধকার আপনার ভাল লাগে?
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, নিজেকে যাচাই করে দেখেছি, ঝলমলে আলোর চেয়ে রহস্যময় অন্ধকারই আমার বেশি ভাল লাগে। অনেক সম্ভাবনা অন্ধকারের। সব দেখা হয়ে গেল, জানা হয়ে গেলোর হতাশাহীন, অনেক কিছু আরো দেখতে পারি, জানতে পারির অপার সম্ভাবনার অপেক্ষা, আনন্দ অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। ছেলেবেলায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে কুপি জ্বালানো রহস্যময় আঁধার, ঝিঁঝিঁর ডাক, দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের আর্তনাদ এই ঝলমলে স্যাটেলাইট চ্যানেলের হৈচৈ এ আমি খুব মিস করি। জানি সময়ের চাকা পিছনে ঘুরে না।
সাক্ষাতকারী :
একেবারে শুরুতেই অন্ধকারের কথা কেন জিজ্ঞেস করলাম জানি না।
রুমা মোদক :
কেন বলো তো...
সাক্ষাতকারী
লেখকদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করে।
রুমা মোদক :
তাই!
সাক্ষাতকারী
আপনি কখন লেখেন? আপনার লেখার রুটিন সম্পর্কে বলেন।
রুমা মোদক :
এটা খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন। কিন্তু আমার উত্তরটা বড় বিব্রতকর আমার জন্য...
সাক্ষাতকারী
তবু বলেন। শুনি। বিব্রতকর হলেও।
রুমা মোদক :
আমার লেখার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, মাথায় চাপলে মধ্য দুপুরেও বসি। ছেলে গণিত বুঝতে আসে, মেয়ে জামা খুঁজে পাচ্ছে না অভিযোগ নিয়ে আসে, ঘরের সহকারি কি মাছ ফ্রিজ থেকে খুলবে জানতে আসে। ছেলেমেয়ের বাপ বলে- ওর হাতে বানানো চা একদম খেতে পারি না। তুমি বানিয়ে দাও। আমি চা বানিয়ে, তরকারি চুলায় চাপিয়ে আবার লিখতে বসি। এই সাংসারিক চাপে,জবের চাপে কতোদিন এমন হয়,ভাবনার তাড়া রাতে ঘুমাতে দেয় না, কিন্তু সকালে কলেজ যেতে হয়, লেখা নিয়ে বসা হয় না, প্লট মাথায় নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যায়। এই অসহায় যাপন খুব কষ্টকর আমার কাছে।
সাক্ষাতকারী :
গল্পের প্লট কীভাবে পান?
রুমা মোদক :
আমার একটা নিজস্ব ওয়ে আছে। জীবন তো আর স্বাধীন নয়, যেখানে যার কাছে যখন ইচ্ছে যেতে পারি না।অপরিহার্য সাংসারিক সামাজিক নানারকম শৃং্খল, সীমাবদ্ধতা। আবার অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে লেখার সাহসও করি না। কিন্তু যখন যেখানে যে কারণেই যাওয়া হয়,যে অবস্থাতেই থাকি আমি মানুষের কাছে যাই, তাদের গল্প শুনি, জীবনের অভিজ্ঞতা, সংগ্রামের গল্প শুনি। এই ধরো রিক্সাওয়ালা কিংবা আমার ঘরে কাজ করতে আসা মহিলাটি, প্রতিদিন কলেজ যাবার পথে ইজিবাইকে সহযাত্রী সবার কাছে জীবন শুনি। সেই জীবন থেকে গল্পের উপাত্ত খুঁজে পাই। এবং জানো যা পাই তা হলো জীবন ফিকশনের চেয়ে অনেক রূঢ় আর অবিশ্বাস্য। আসলে ষোল কোটি মানুষের দেশে ষোল কোটি জীবন। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের অগণিত অসংখ্য মুহূর্ত একেকটি প্লট। আমার মতো লেখকের তা প্রকাশের সামর্থ্য সীমিত। অনেক বলে ফেললাম তোমার এক কথার উত্তরে!
সাক্ষাতকারী
আর কি কোন সোর্স আছে? সমসাময়িক ঘটনাবলী, খবরের কাগজ, রাজনীতি...এসব থেকেও কি...
রুমা মোদক :
অবশ্যই,এই দৈনিক পাঠতো নাগরিক জীবনের অভ্যাস হয়ে আছে ছেলেবেলা থেকেই। অস্থির সময়, অস্থিতিশীল বৈশ্বিক বর্তমান, পাল্টে যাওয়া মেরুকরণ, স্বদেশে জীবনবোধের ক্রম নিম্নমুখীতা, মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, ফুলেফেঁপে উঠা উন্নয়ন সব কিছুই তো গভীর থেকে চেতনায় অভিঘাত করে।
সাক্ষাতকারী
আর...
রুমা মোদক :
এই যে ক্রমাগত ধর্ষণ, হত্যা, জঙ্গি, রোহিংগা শরনার্থী, চিন ভারত আমেরিকা, রাশিয়ার ভূমিকা... আইসিস, বোকোহারেম, হরকাতুল জিহাদ, গণজাগরণ মঞ্চ,হেফাজত, সিরিয়া সব-ই তো আলোড়িত করে।
সাক্ষাতকারী :
এই সেদিন, ছুটি ছিল, আমি হিথ্র পার হয়ে, হেইজ এন্ড হারলিংটন স্টেশনে ট্রেন থেকে নামছি, প্ল্যাটফর্মে পা দেব, হঠাৎ আপনার একটি গল্পের কথা মনে পড়ল। গল্পটির নাম প্রসঙ্গটি বিব্রতকর। এই গল্পটির ভাবনা কীভাবে এল?
রুমা মোদক :
সাম্প্রদায়িক হানাহানি, একজন লেখক উদাসীন থাকতে পারেন না। ও এটা নিয়ে কিন্তু বিস্তারিত বলেছি ওপর এক সাক্ষাৎকারে। গল্পপাঠে।
সাক্ষাতকারী :
হ্যাঁ।
রুমা মোদক :
গল্পের কলকব্জা
সাক্ষাতকারী
হ্যাঁ। গল্পের কলকব্জা। ধরুন, গল্পের ভাবনা মাথায় এল, তারপর? পুরো গল্পটি কি মাথায় তৈরি হয়ে যায়? একেবারে কোথায় শেষ হবে, তাও?
রুমা মোদক :
না না।
সাক্ষাতকারী
তাহলে? আপনি বলুন। ডিটেইলে।
রুমা মোদক :
সামান্য একটা প্লট ধরো উপলব্ধিতে অভিঘাত করলো, তারপর শুরু হয় ভাবনা। কী বলতে চাই,কীভাবে বলতে চাই, কোন আংগিকে কি ভাবে প্রকাশ করবো ইত্যাদি। একসময় হয়তো সিদ্ধান্তে পৌছাই, আমি কি বলতে চাই । কিন্তু কিভাবে বলবো তা নিয়ে অনেক অনেকদিন ভাবতে হয়। তখন অন্য অনেক লেখা পড়ি। গল্প পড়ি। কোন গল্পের পুণ-পাঠ ও করি। ভাবনার খোরাক পাই। হয়তো শুরু করি, সন্তুষ্ট হই না। রেখে দেই। আবার লিখি। আবার লিখি ।
এই যেমন এখন আলবেয়ার ক্যামুর আউটসাইডার পড়ছি আবার। একটা গল্পের প্লট মাথায় এসেছে বলে। প্লটটাও এই শহরে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা থেকে পাওয়া।ক্রমাগত ধর্ষনের ক্ষরণে রাষ্ট্রের উন্নাসিকতায় আন্তন চেখভ এর আমলার মৃত্যুর কয়েকটি অনুবাদ পড়ছি, এর অনুপ্রেরণায় একটা গল্প লিখবো বলে।আর মাহবুবুল হক পড়ছি,কালো বরফ, জীবন আমার বোন। নিঃসংগতার একশ বছর পড়বো আবার ভাবছি।
সাক্ষাতকারী
তার মানে ভাল লেখা পড়ার ভিতর থাকতে থাকতেই লেখার প্লট পাওয়া যায়? একটি লেখা আরো অনেক লেখার জন্ম দেয়?
রুমা মোদক :
নিশ্চই দেয়। ডাইমেনশান পাওয়া যায়। বীজ পাওয়া যায়, কিন্তু নিজের লেখাটা মৌলিক হয়ে উঠতে হয়।
সাক্ষাতকারী
লেখায় কাটাকুটি করেন?
রুমা মোদক :
অসংখ্য বার।
সাক্ষাতকারী :
আপনি কাগজেই লেখেন নাকি কম্পিউটারে?
রুমা মোদক :
আমিতো এনালগ মানুষ। কাগজে কলমে লিখি। কতোবার যে রিরাইট করি। সবচেয়ে কম করেছি তিনবার।
সাক্ষাতকারী :
লেখার নির্দিষ্ট কোন জায়গা আছে আপনার?
রুমা মোদক :
হাহাহা, এও এক মজার প্রশ্ন...
সাক্ষাতকারী :
বলেন...
রুমা মোদক :
দাঁড়াও আমার লেখার টেবিলের ছবি দিয়ে তারপর বলি... আমি ডাইনিং টেবিলে বসে লিখি। কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে...লিখার অভ্যাস।
সাক্ষাতকারী :
(টেবিলের ছবি দেখে) আপনার বেশির ভাগ লেখাই এই টেবিলে বসে লেখা?
রুমা মোদক :
না। ডাইনিং টেবিলে। এখানে সব কিনে আনা বই স্তুপিকৃত থাকে।
সাক্ষাতকারী :
তার মানে হচ্ছে রান্না করতে করতে কিংবা চা বানাতে বানাতে লেখালেখি করেন?
রুমা মোদক :
পরে যখন কোন বই খুঁজে পাইনা তখন টেবিলটা গুছাই, গত শুক্রবার গুছালাম, হ্যাঁ, সেইতো বললাম আগে, এখানেই আমার লেখালেখি।
সাক্ষাতকারী :
যখন বাইরে যান সাথে কি নোটবুক নিয়ে যান?
রুমা মোদক :
না, নোটবুক রাখি না। কোথাও একটু টুকে রেখে দেই। তবে যখন ভাবনাটা নিয়ে একটা লাইনও লিখি নিজেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করতে চাই এই সংসারের প্রয়োজন থেকে। ঐ বাক্যটিতেই বাস করি, পরের বাক্যে ফিরে আসতে না পারলে রেখে দেই। কারণ সাংসারিক বিঘ্নগুলো আগেই বলেছি।তবে কয়েকবার রাফ করি তো, ফ্রেশ করার সময় ঘরে আল্টিমেটাম দেই এখন আমাকে কেউ ডিস্টার্ব দেবে না। সেক্ষেত্রে রাতটাকেই বেছে নিই, আর পরদিন ছুটি।
সাক্ষাতকারী :
তার মানে লেখার জন্য সময় নির্দিষ্ট করা নেই!
রুমা মোদক :
না, কোন নির্দিষ্ট সময় নেই।
সাক্ষাতকারী :
কখন পড়েন?
রুমা মোদক :
নিয়ম করে প্রতিদিন ঘণ্টাখানিক পড়ি, ঘুমাবার আগে। এটা গত ৩৫ বছরের অভ্যাস। বিয়ে বাচ্চার আগে বলতে গেলে খাওয়া,ঘুম, কলেজ ছাড়া সারাদিন পড়তাম অনেকদিন তা পারি না। ইদানিং বাচ্চারা বড় হয়ে যাওয়ার কারণে সময় বের করে একটু পড়তে পারি। অনেক বিকেল থিয়েটারকে দিতে হয়। রিহার্সেল থাকে। পড়ার অনেকটা সময় নিয়ে নেয় রিহার্সেল।
সাক্ষাতকারী :
পত্রিকা তো পড়েন?
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, পত্রিকা পড়ি। এটাতো দীর্ঘদিনের অভ্যাস। না পড়লে মনে হয় কী যেন বাকি থেকে গেলো!
সাক্ষাতকারী :
আচ্ছা এটা কি কখনো মনে হয়- মানুষ আমার লেখা কেন পড়বে?
রুমা মোদক :
এটা আমি খুব মাথায় রাখি! পাঠক কেন পড়বে। একটা আবিষ্কারের আনন্দ পাঠককে দিতে চাই। দীপেন ভট্টাচার্যও এটা বলেছেন, আমার দ্বিতীয় বইয়ের ফ্ল্যাপে কথাগুলি আছে। এই আবিষ্কারে পাঠক বিস্মিত হয়। এই চেষ্টা কিন্তু সচেতনভাবেই করি। সব গল্পেই এটা সম্ভব হয়ে উঠে না। লেখক হিসাবে আমার সীমাবদ্ধতা আমি উপলব্ধি করি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, আমার গল্প সবার জন্য নয়। অর্থাৎ সিরিয়াস পাঠকের জন্য। এটা আমি তিরস্কার নয়। পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করেছি। কারণ আমি পাঠকপ্রিয়তা চাই না। পাঠকের মনোযোগ চাই।
সাক্ষাতকারী :
একটা গল্প লিখতে কয়দিন সময় নেন?
রুমা মোদক :
এটা কিছু নির্দিষ্ট নেই, দুইতিনদিনেও হয়, দুইতিন মাসও লাগে।
সাক্ষাতকারী :
সাহিত্য থেকে পাঠক হিসেবে আমরা আসলে কী পেতে চাই?
রুমা মোদক :
পাঠক হিসাবে কী পেতে চাই তা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা অসম্ভব। পাঠের আনন্দের উর্দ্ধেও কিছু একটা একটা প্রত্যাশা থাকে বৈকি। সব পড়ে তো সমান তৃপ্ত হই না।এর মানে একটা প্রত্যাশা তো আছেই। এটাকে আসলে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। দায়বদ্ধতা, সমাজ এবং কাল সচেতনতা, সাহিত্যমান। শুধু দায়বদ্ধতা, সমাজ সচেতনতা ইত্যাদি তো শ্লোগান হয়ে উঠে। আসলে কি যে চাই- নিজেকে আবার প্রশ্ন করি। উত্তর পাবো নিশ্চই।
সাক্ষাতকারী :
কিভাবে আপনি একজন লেখক হয়ে উঠলেন?
রুমা মোদক :
লেখক হয়ে উঠতে পেরেছি কি আদৌ? প্রাণপণ চেষ্টা করছি বলতে পারো। কৈশোরে ঘরে বিশাল সমৃদ্ধ একটা বইয়ের ভাণ্ডার পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এড়িয়েও টিকে ছিলো। বিচিত্রা, উদয়ন সাময়িকী থেকে শুরু করে ঠাকুরমার ঝুলি,পথের পাঁচালী, ইস্পাত, মা কী না পেয়েছি হাতের কাছে। এসব পড়াই লেখক হবার বাসনা জন্ম দিয়েছে। সবাই যখন এইম ইন লাইফ লিখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। আমার খুব ইচ্ছে হতো লিখি লেখক হবো। হাহা, পারি নি অবশ্য ছকের বাইরে গিয়ে লিখতে।
লেখক কতোটা হতে পেরেছি আমি সন্দিহান। তবে কিছু অর্জন আমাকে তৃপ্ত করে। আজ ভোরে ঘুম থেকে জেগে দেখি এক নারী ম্যাসেজ দিয়েছেন - ঈদসংখ্যায় লেখা পড়ে আপনাকে খুঁজে বের করেছি শুধু এটুকু বলবো বলে, আপনি কলম থামাবেন না। আমার প্রাপ্তি এই যে পাঠক লেখা পড়ে আমায় খুঁজে। আরেকদিন আরেকজন ইনবক্সে লিখলেন, ভালো একটা লেখা পড়লে, ইচ্ছে করে লেখকের পায়ে ধরে সালাম করি। আমি একদিন আপনার পায়ে ধরে সালাম করতে চাই। উনি কলেজের বাংলার অধ্যাপক।এখন আমার মনে হয় এর চেয়ে বেশি আমার আসলে কিচ্ছু প্রত্যাশা নেই। নির্বাচিত গল্পপাঠ এ আমার নাম টা আলাদা করে উল্লেখ করলে। এওতো বিশাল অর্জন।
তবে যা-ই বলো, কেউ লেখক বললে ধন্য হয়ে যাই। লেখক হতে চাই, এই লক্ষ্য থেকে যেনো সরে না যাই।
কেন লেখক হতে ইচ্ছে করলো এটা নির্দিষ্ট করে কিছু হয়তো বলা যাবে না। তবে লেখকই যে হতে চাই এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা ছিল না। এখন মাঝে মাঝে নিজে কিন্তু নিজের মুখোমুখি হই, কেন লেখক হতে চাইলাম? এখন আবিষ্কার করি, যে না লিখতে পারলে না পড়তে পারলে নিজের ভেতর একটা অস্থিরতা তৈরি হয়। না লিখে পারি না। আর একসময় পাঠের মুগ্ধতাই বোধহয় লেখক হবার বাসনা জন্ম দিয়ছে। অপু- দুর্গার শৈশব পড়ে, 'রাউণ্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজে'র রোমাঞ্চকর অভিযান পড়ে, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এর 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' পড়ে তখন মনে হতো আমিও একদিন এরকম লিখবো। লেখক হবো।
কিভাবে লেখক হলাম কিংবা আদৌ হতে পেরেছি কিনা এ নিয়ে আগে কিছুটা বলেছি। সবটুকুই সময়ের এবং পাঠকের বিবেচ্য। এখন এই বর্তমানে যখন পাঠক আমায় চিনছে, পড়ছে দেশে কিংবা দেশের বাইরে, প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ ইনবক্সে লেখার নীচে নানাভাবে কমেন্ট করছে। পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ আমি দারুনভাবে ইন্সপায়ার্ড হচ্ছি। এই যে প্রতিদিন দু-চারজন অচেনা পাঠক নক করছেন এটা কি আমার মতো লেখক হতে চাওয়া মানুষের জন্য কম পুরস্কার?
আমার এই গল্পকার হিসাবে কমবেশি পরিচয়টা কিন্তু মাত্র কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠেছে। যখন আমার লেখাগুলো গত তিন চার বছর ধরে নিয়মিত ছাপা কিংবা প্রকাশের মুখ দেখছে আমি খুব আনন্দ বোধ করছি এজন্য যে খুব অল্প সময়েই আগ্রহী পাঠক আমাকে খুঁজে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে। দু-একজন এমনও বলেছেন আপনি এতো লিখেন! আমি মনে মনে হাসি। হাসির কারণটা তোমাকে বলি। গত তিন/ চার বছর ধরে প্রকাশিত গল্পগুলো কিন্তু গত প্রায় ১৫/১৮ বছর ধরে লেখা। সিরাজুল ইসলাম স্যারের নতুন দিগন্তে ২০০২, জাতীয় দৈনিকে আজকের কাগজের সুবর্ণরেখায় , খুব সম্ভব ২০০৪ সালে আমার লেখা গল্প প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে আমার প্রিম্যাচিউর যমজ সন্তানের জন্ম। তখন প্রকাশের এক দীর্ঘ বিরতি। কিন্তু লেখা অব্যাহত ছিলো। প্রায় সাত বছর আমার লেখা কিন্তু থেমে ছিলো না। বেশ কয়েকটা গল্প আমি লিখেছি। কিন্তু কোথাও প্রকাশিত হয় নি।যেগুলো এখন হচ্ছে। নতুনও লিখছি।
বর্তমানে আমাকে ভীষণ ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে গল্পপাঠ। প্রথম গল্পটা যখন গল্পপাঠ প্রকাশ করে,কথাসাহিত্যিক কুলদা রায়ের গৃহীত সাক্ষাৎকার গল্পের কলকব্জাসহ বেশ উল্লেখযোগ্য ট্রিটমেন্ট দিয়ে, দেশের বাইরে বাংলা ভাষাভাষী পাঠক কিন্তু এর মাধ্যমেই আমাকে চিনে নিয়েছে।
স্বপ্ন ছিলো লেখক হবো। জীবনের শুরুটা সেই লক্ষ্যেই করা। ঢাকার একটা জাতীয় দৈনিকে চাকরি নেয়া। আসলে কি বলতো তখন একটা অপরিণত ধারণা ছিলো লেখক হতে হলে ঢাকায় থাকতে হবে। কিন্তু থাকতে পারলাম না। ধরো খুব নিজের মনে করা মানুষ, যার সবচেয়ে বেশি সাহায্য করার কথা,তারই তীব্র অসহযোগিতায় এমন হোঁচট খেলাম, ভেবেছিলাম আর বোধহয় উঠে দাঁড়াতে পারবো না জীবনে। এটা হলো আত্মবিশ্বাস ভেংগে যাওয়ার হতাশা,প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা, নিজেকে করুণা করার সময়। সব ছেড়ে দিয়েছিলাম, লেখা, পড়া। সে সময় কাটিয়ে আবার আমি লিখছি। লিখতে পেরেছি।আমি পেরেছি এটাই আমার তৃপ্তি। এখন এইসময়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, সময়, পরিস্থিতি বারবার আমাকে পিছু টেনে ধরেছে। কিন্তু আমি থেমে যাইনি। যদি জানতে চাও, খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন লেখালেখিতে কার উৎসাহে? উত্তরে বলি, না কারো উৎসাহ পাইনি। কারো নয়।নিজের ইচ্ছাতেই কেবল পথ চলেছি। এখন নিজেকে মূল্যায়ন করি, লেখকই হতে চেয়েছি। কেবলই লেখক।
সাক্ষাতকারী :
লেখালেখির সবচেয়ে কষ্টের দিক কোনটি?
রুমা মোদক :
ফুলটাইম লেখক এবং পাঠক হতে পারছি না এটা প্রধানতম কষ্ট। আর একটা কষ্ট নয়, বলা যায়, কৌতূহলজাত বেদনা আছে বলা যায় । কেন যেন মনে হয়, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অঙ্গন আমাকে উপেক্ষা করে যায়... নিজেকে সন্দেহ হয়, উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্ট হয়নি বোধহয়।
সাক্ষাতকারী :
আর সব চেয়ে আনন্দের দিক কোনটি?
রুমা মোদক :
এই যে কিছু পাঠক পড়ছেন। আর কিছু হলেও তো লিখতে পারছি, যদি একেবারেই না পারতাম? এটাই সবচেয়ে আনন্দের দিক।
সাক্ষাতকারী :
এই যে আপনার লেখক হতে ইচ্ছে করল, এই যে আত্মপ্রকাশ সেটা কেন? কী বলবেন?
রুমা মোদক :
কেন! কি জানি!! এই প্রশ্নের উত্তর টাতো জানিনা। পাঠক পড়বে ভেবে তো আসলে লিখি না। লেখায় একটা নিমগ্নতার আনন্দ আছে। সেই আনন্দে লিখি। লেখার পর মনে হয় প্রকাশ হলে তো ভালোই হয়। অস্বীকার করি না পাঠকের প্রতিক্রিয়া উৎসাহিত করে, অনেক মতামত সংশোধনেও উৎসাহিত করে। ইদানিং কিন্তু প্রকাশের তাড়ায়ও লেখা হয়। বিভিন্ন জায়গায় লেখা চায়, মাথায় ঘুরতে থাকা প্লটগুলো লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। তবে ইদানিং ভাবছি প্রকাশের তাড়ায় আর একদম লিখবো না।
সাক্ষাতকারী :
ছাতিম ফুলের গন্ধ কেমন হয়?
রুমা মোদক :
শুনেছি গন্ধটা।
সাক্ষাতকারী :
গন্ধ কেউ শুনে নাকি?
রুমা মোদক :
গন্ধ তো পেতে হয়। পাওয়া যায় গাছের কাছাকাছি গেলে।
সাক্ষাতকারী :
আমাদের পাশের গ্রামে ছিল। ঈদগাহর কাছে। ছাতিমের গন্ধ বহু দূর থেকে পাওয়া যায়।
রুমা মোদক :
আমিতো আসলে শহরে বড় হয়েছি, মফস্বল শহরে। বন্ধ ঘরে।গ্রামের সাথে ধরো আমার চার বা ততোধিক পুর্বপুরুষের কোন সম্পর্ক নেই। ফলে জগত চিনেছি পাঠ্যবই এর বাইরে আউটবই পড়ে। আর হ্যা আমার একটা মামারবাড়ি ছিলো। শহরের মাঝখানে একটুকরো গ্রাম। বিশাল বাড়ি, একপাশে পুকুর, দুর্গামণ্ডপ। অন্যপাশে একটা পতিত মাঠ। ঝোপঝাড় গাছপালায় অন্ধকার। ওখানে একটা ছাতিম ফুলের গাছ ছিলো। কিশোরীবেলায় এক দুপুরে সংগীসাথীদের নিয়ে ওখানে চড়ুইভাতি খেলতে গেছি। আঞ্চলিক ভাষায় বলতাম "টুপা ভাত"। সেদিন গন্ধটা আবিষ্কার করেছিলাম। আর বিস্ময়ে ভেবেছিলাম, এই গন্ধটা এতোদিন পাই নি কেনো? আজ কী কাছে এলাম বলেই পেলাম? আমার কাছে খুব মধুর কিন্তু মাতাল মনে হয় না।পরেরবার গভীরভাবে গন্ধটা নেব, দেখবো সত্যি মাতাল করে কিনা...
সাক্ষাতকারী :
আজ খুব ছাতিমগাছের কথা খুব মনে পড়ছে। আজকাল আমরা অনেক কিছুই দিতে পারি কিন্তু গন্ধ দিতে পারি না। গন্ধের অনুভব না থাকলে কিছুই বোঝা যায় না।
রুমা মোদক :
এ ব্যাপারে আমার একটা ফিলিং আছে। ইদানীং একটা সিনেমা দেখে জনসন বেবি পাউডারের গন্ধ পেলাম।
সাক্ষাতকারী :
সে তো আপনার অভিজ্ঞতায় ছিল বলে। অভিজ্ঞতার বাইরের গন্ধ, ঘ্রাণ... লন্ডনের ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যায় না, গভীর করে না নিলে। সেদিন একটা গোলাপ ছিঁড়ে এত নাক ডুবিয়ে গন্ধ নিলাম... এখন সব কিছুতেই খালি স্মৃতি যেন... হ্যাঁ, ছবিটা সময় পেলেই দেখব। এখন বলুন- থিয়েটারে আগ্রহ জন্মাল কবে থেকে? পারিবারিকভাবে?
রুমা মোদক :
থিয়েটার এ আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে। তখন বেইলি রোড কেন্দ্রিক থিয়েটার চর্চা। আমরা হলে সূর্যাস্ত আইনে বন্দী। মাঝে মাঝে কাছের বন্ধুর সাথে হল কতৃপক্ষের পারমিশান নিয়ে থিয়েটার দেখতে যেতাম। প্রথম দিকে টিভি স্টারদের সামনা সামনি দেখার উদ্দেশ্যে আগ্রহটা তৈরি হলেও পরে নেশায় পড়ে যাই। প্রায়ই কাছের বন্ধুদের নিয়ে সুযোগ করে থিয়েটার দেখতে চলে যেতাম। কিন্তু তখনো স্বপ্নেও ভাবি নি নিজে করবো কিংবা করতে পারবো।এটা সম্ভব হয়েছে আমার জীবনসংগী শান্তনুর কারণে। ও ৩০ বছর ধরে থিয়েটার কর্মী। ও আমাকে থিয়েটারে নিয়ে এসেছে। প্রথমে নাটক লেখা ১৯৯৯ সালে। পরে অভিনয়। যেহেতু সে নিজেই থিয়েটারকর্মী সেহেতু আমার তো কোন বাধা নেই।
সাক্ষাতকারী :
সমাজে লেখকের অবস্থান কোথায়? তার লড়াইটা কার সাথে? কেন সে লেখে? আপনি কেন লেখেন?
রুমা মোদক :
এটা বেশ ভালো বলেছ- সমাজে লেখকের অবস্থান কোথায়। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে কবির কোন স্থান ছিলো না। কবি বলতে লেখকই বুঝিয়েছিলেন। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের কথা যদি ধরি এখানে সামাজিক অবস্থান তৈরি হয় অর্থনৈতিক অবস্থা দিয়ে। এবং এই অর্থের উৎস প্রশ্নাতীত। এই আধা সামন্ত আধা পুঁজির সমাজে লেখকের অবস্থান যে ঠিক কোথায়!
লেখকের লড়াইটা এই এস্টাব্লিশমেন্টের সাথে। যে-সমাজ মানবিক নয় তার সাথে, সর্বোপরি নিজের সাথে, মেনে না নেয়ার মতো অনেক কিছুই মেনে নিতে হচ্ছে। এই অবদমনটাই বোধহয় লেখক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অন্তত আমাদের মতো অসম ব্যবস্থার সমাজে।
আমি কেন লিখি, আসলে না লিখে পারি না। এই যে একটা অনিবার্য লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করি, ভিতরে একটা তাড়া অনুভব করি।
সাক্ষারকারী :
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে কিছু সমস্যা থাকে, সরকার যাকে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যেমন ইলেকশনে কারচুপি। সরকার ইলেকশনের ফলাফল তার পক্ষে গেলে বলে যে কারচুপি হয়নি, অনিয়ম হয়নি, কিন্তু আপনার গল্পে পাওয়া গেল যে নির্বাচনে ভোট চুরি, ভোটকেন্দ্র দখল ইত্যাদি হয়েছে।
একদিকে সরকার বলছে কিছুই ঘটেনি অন্যদিকে সাহিত্য বলছে- না, ঘটেছে!
রুমা মোদক :
তৃতীয় বিশ্ব বলতে কী এখন আর আদৌ আছে কিছু। সোভিয়েতের পতনের পর আদর করে এর নাম দেয়া হয়েছে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। হাহা।
হ্যাঁ, এখানেই বোধ করি একজন লেখকের প্রয়োজন। সময়টাকে সাহিত্যে ধরে রাখা, তার যাবতীয় অসংগতি কে সাহিত্যে ধরে রাখা। সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিবাদটুকু জারি রাখা। এখানে লেখকের কোন আপোস নেই। আমি বলবো এই অনাচার মানতে না পারাটাই লেখকের স্বভাব। যা তার প্রতিভা কিংবা লিখতে পারার ক্ষমতাকে প্রতিবাদে প্ররোচিত করে। একসময় রাজারা সভাকবি পালতেন। তারা রাজাদের গুণকীর্তন করে কাব্য করতেন। লেখকদের প্রতিভা কিনে নিত রাজারা। আর এখন কনসেপ্টটাই বদলে গেছে। লেখকরাই হয়ে উঠছেন সমাজের, সময়ের প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি। একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলে লেখকের প্রয়োজন বা অবস্থান। আজ থেকে ৫০ বছর পর যদি কেউ আমার 'গোল' কিংবা 'প্রসংগটি বিব্রতকর' কিংবা সে সন্ধ্যায় দ্রৌপদী এসেছিলো গল্পগুলো দৈবক্রমে পড়ে তবে কিন্তু সময়ের একটা ছবি সে পাবে। যা কখনোই শাসক কিংবা এস্টাব্লিশমেণ্ট ইতিহাস হিসাবে লিপিবদ্ধ করবে না।
সাক্ষাতকারী :
আপনার 'গোল' গল্পটিতে দেখা যায় জাহিদ রাজনৈতিক নেতার কাছে চাকরির জন্য তার বোনকে নিয়ে যাচ্ছে। বোনকে বাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে সে বাইরের কক্ষে অপেক্ষা করছে। আমরা ভাবছি তথাকথিত কিছু কথা যেমন নারী দেহ, শরীরের কারবার, লাম্পট্য, লোলুপতা... গল্প যেন আচমকা নতুন কোন মোড় নিচ্ছে না। পাঠক চমকে উঠছে না। যেন পাঠকও ধরে নিয়েছে জাহিদের বৌ বের হবে না। যেন নেতার বাড়িতে এমন কিছুই ঘটবে, এমন ঘটবার কথা। সেই বলটিও তাকে নিয়ে পরিহাস করেছে- এবারও হল না...
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, এখানে হয়তো পরিণতিটা খানিকটা প্রেডেক্টিবল। অনেকে আবার বলেছে শেষ টা এমন হবে ভাবে নি। দুরকম প্রতিক্রিয়াই পেয়েছি। এই অভিজ্ঞতা আমার নিজের পরিবেশ থেকে অর্জন করা। আমি জোর করে নতুন কোন মোড় দিতে পারি নি। মনে হয়েছে আরোপিত হবে হয়তো। লেখক হিসাবে এটা আমার সীমাবদ্ধতা বলতে পারো। হয়তো কোন মহৎ লেখক নতুন কোন মোড় আনলেও আনতে পারতেন।কেননা লেখকই তো বাস্তবের সম্ভবের গণ্ডি ভেংগে অসম্ভব ঘটাতে পারেন।
সাক্ষাতকারী :
এই গল্পটি লেখার পেছনের ভাবনাটি বলুন।
রুমা মোদক :
এতো আমাদের সমকালীন রাজনীতির নিত্য দেখা বাস্তবতা। কাগজে কলমে ধরে রাখা শুধু।
সাক্ষাতকারী :
সমাজে লেখকের দরকার হয় কেন?
রুমা মোদক :
কঠিন প্রশ্ন। সমাজের লেখক দরকার নাকি লেখকের সমাজ দরকার? সমাজ জানে না কী প্রয়োজন লেখকের, লেখক সম্ভবত নিজের মেধা কিংবা সৃজনশীলতার দায়বোধ থেকে সমাজে নিজেকে অনিবার্য করে তোলেন।
সাক্ষাতকারী :
আপনি নাটক লেখেন, অভিনয় করেন - এই যে কাজ, এর পেছনে কোন জীবনদর্শন কাজ করে? কত দিন ধরে মঞ্চে কাজ করছেন? আপনার অনুভূতি টা কেমন? থিয়েটার কে কী মনে হয়?
রুমা মোদক :
ভালোবাসা ভালোলাগা থেকে করি। তবে এখানে এখনো স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতাটা পাই। আর মঞ্চের একটা নেশা আছে, প্রায় ২০ বছর হতে চললো
সাক্ষাতকারী :
থিয়েটারের দর্শক তো সেই একটি বিশেষ শ্রেণি যারা নাটক দেখে, সিনেমায় যায় আবার এরাই সাহিত্যের পাঠক। ঘুরে ফিরে একটা বৃত্তের মাঝে সব আটকে থাকছে না? আবার সেন্সরশিপ-এর ব্যাপারও তো আছেই। মানে শিল্পির স্বাধীনতা...
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, একটা বিশেষ শ্রেণি। আমার কাছে একই মনে হয় সাহিত্যের পাঠক, মঞ্চের দর্শক। তবে মঞ্চের দর্শক নানা কারণে সাহিত্যের পাঠকের চেয়েও কম। সেন্সরশিপ কিছু তো আছেই, তবে অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে কম।
সাক্ষাতকারী :
সাহিত্যের পাঠক কি দিনে দিনে কমছে?
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, কমছে।
সাক্ষাতকারী :
প্রযুক্তির কারণে?
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, প্রযুক্তির একটা অন্যতম কারণ। সামাজিক অস্থিরতাও একটা বড় কারণ।
সাক্ষাতকারী :
আগামি দিনে সাহিত্যের পাঠক কি অনেক কমে যাবে? বই কিন্তু আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি বের হচ্ছে।
রুমা মোদক :
আমার ব্যক্তিগত মতামত প্রিন্টিং মিডিয়ার আবেদন কোনকালেই কমবে না, বই হচ্ছে বেশি, পাঠকও বাড়ছে। তবে রেসিও বাড়ছে না। তবে একটা কথা কী, বই প্রচুর প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু সাহিত্যমান আদৌ কয়টা বইএর আছে তা বিবেচনার কোন মাপকাঠি নেই। টাকা থাকলেই বই করা যাচ্ছে। প্রকাশনার কোন নীতি নেই, প্রকাশকদের এডিটিং বোর্ড নেই। ফলে বেশি বই প্রকাশ বিষয় টাকে আমি খুব ইতিবাচক ভাবে দেখতে পারছি না।
সাক্ষাতকারী :
যখন একটি গল্প লিখতে থাকেন মানে লেখাটা চলছে তখন কি স্বপ্নে দেখেন গল্পটিকে?
রুমা মোদক :
খালি স্বপ্ন! আমি ডুবে থাকি গল্পে, গল্পের চরিত্রে খেতে ঘুমাতে কাজ করতে করতে মগ্ন হয়ে থাকি। এ মগ্নতায় সৃষ্টির আনন্দ আছে। পরিণতিতে যেতে না পারার যন্ত্রণা আছে। অনেক সময় এমন হয় পরিণতি অসহনীয় তাড়া দিতে থাকে,কিন্তু সাংসারিক পেশাগত তাড়ায় টেবিলে বসতে পারছি না। এ সময়টুকু পার করা খুব যন্ত্রণার। তখন মনে হয় সাহিত্যের সাধনা করতে হলে সংসার করা উচিত নয়। হাহাহা।
সাক্ষাতকারী :
এমন কখনো হয়েছে, গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে লিখতে বসে গেছেন অসমাপ্ত গল্পটিকে?
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, অনেকদিন। এটা আগে বেশি হতো মানে বাচ্চাদের জন্মের আগে। এখন গল্পের তাড়ায় ঘুম ভেঙে গেলেও উঠে আর লিখতে বসি না। পরদিন নিজের চাকরি, বাচ্চাদের স্কুল, সংসার সব সামলানো শরীর এলাউ করে না। নিজের সৃষ্ট চরিত্ররা ক্ষমা করে এই অপারগতা, সংসার কিন্তু ছাড় দেয় না।
সাক্ষাতকারী :
নিজেকে কি খুব একা লাগে?
রুমা মোদক :
কখনো নয়, সবসময়। সংসার থেকে সমাজ। পরিবার থেকে পেশা। সর্বত্র।
সাক্ষাতকারী :
এই যে একাকীত্বের বোধ, সেটা কি আপনি লেখক বলেই?
রুমা মোদক :
একাকীত্বের বোধটা ঠিক লেখক হিসাবে নয় বোধকরি। ব্যক্তিমানুষ হিসাবেই আমি এই দ্রুত নিজেকে পাল্টে ফেলা, মুখোশ পরা মানুষদের সাথে তাল মেলাতে পারি না।প্রতিমূহুর্তে একা হয়ে যাই। সত্যি কথা যারা এভাবে গিরগিটির মতো নিজেকে দ্রুত পাল্টে ফেলতে পারে তারাই আমাদের সমাজে সো-কল্ড সাকসেসফুল মানুষ।
সাক্ষাতকারী :
আপনি কি একটি ভাবনা থেকে গল্প লিখতে শুরু করেন? যাকে মূল ভাবনা বলা হয়? লেখাটি এগিয়ে যেতে যেতে কি মাঝে মাঝে মূল ভাবনা থেকে দূরে সরে যায়?
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, গল্পের মূল ভাবনাটা আগে থেকেই থাকে। তবে ধরো, এমন তো মাথায় থাকে না, যেমন ছোটগল্প সম্পর্কে এডগার এলেন পো বলেন, আধঘণ্টার মধ্যে পড়ে শেষ করতে হবে কিংবা এইচ জি ওয়েলস বলেন ১০-৫০ মিনিট সময়সীমা ইত্যাদি। ভাবনাটাকে প্রকাশের তাড়াটাই থাকে কেবল। ভাষার ব্যতিক্রমে, আংগিক এর বব্যতিক্রম এ। নিজস্ব কিছু বলার চেষ্টাটাই থাকে প্রধান।তবে লিখতে বসে অন্য অনেক গল্প মূল ভাবনা বিচ্যুত হয়ে নতুন ডাইমেনশান এ চলে আসে। যা বলতে চেয়েছিলাম,যেভাবে বলতে চেয়েছিলাম তা না বলে অন্য কিছু বলা হয়ে যায়। এরকম হয়েছে দু একবার।
সাক্ষাতকারী
আপনি কার জন্য লেখেন? আপনার পাঠক কারা?
রুমা মোদক :
না, সত্যি জানি না আমি কার জন্য লিখি। মানুষ কেন পড়ে তা ভেবেও বিস্মিত হই। না লিখে পারি না, তাই লিখি। পাঠক পাঠ করেন আমি ধন্য বোধ করি। কারণ যে কোন লেখার পাঠকই তো আরাধ্য। লেখার সময় কিন্তু এটা মাথায় থাকে না।
আমার পাঠক কারা আমি তাও ঠিক জানি না। চেনাজানা বন্ধুমহল, আমার মঞ্চ সহযোদ্ধারা, কিছু আগ্রহী পাঠক এবং লেখক যারা সমকালীন লেখকদের পড়তে চান তারা। তবে আমার পরিবারের কেউ আমার লেখা পড়েন না।
সাক্ষাতকারী :
কখনো কি কোন অচেনা পাঠকের সাথে কথা হয়েছে? অচেনা পাঠকের চিঠি, ফোনকল পেয়েছেন?
রুমা মোদক :
একবার নয় অনেকবার। অচেনা পাঠক নক করেছেন। এখন তো চিঠি লিখে না কেউ, ফেসবুকের রিকোয়েস্ট বক্সে পাঠকদের বার্তা পাই। প্রায়ই পাই।তবে এখনো পর্যন্ত কোন ফোনকল পাই নি কোন পাঠকের।
সাক্ষাতকারী :
আপনার কি কোন কল্পিত পাঠক আছে? কোন কল্পিত সমালোচক?
রুমা মোদক :
আমার কল্পনায় নেই। থাকলে বেশ হতো। তবে আমার ২য় গল্পগ্রন্থের প্রকাশক অনুপ্রাণন থেকে কুহক ভাই বলছিলেন, কেউ একজন আমার ১০ কপি বই কিনে নিয়ে গেছেন। আমি আজো ভেবে পাচ্ছি না কে সে? কে হতে পারে!
সাক্ষাতকারী :
গল্পকার রুমা মোদককে কীভাবে সমালোচনা করেন?
রুমা মোদক :
অসহায় গল্পলেখক। অনেক কিছু বলতে চাই। পারিনা। গল্পে যা বলেছি, কিছুদিন পরে পড়লে মনে হয়, দূর কিছুই হয় নি। একটা ভালো গল্প পড়লে নিজের সব সৃষ্টি অর্থহীন মনে হয়। কুলদা রায় এর ' মার্কেজের পুতুল' পড়ে সম্প্রতি তাই মনে হলো।
সাক্ষাতকারী :
আপনার বই প্রকাশের কোনও অভিজ্ঞতা...
রুমা মোদক :
প্রথম গল্পগ্রন্থ টি নিয়ে প্রথম যে প্রকাশকের সাথে আলাপ করলাম, তিনি খুব উচ্চকিত স্বরে বলেন, তরুণ দের বই করেন, নতুনদের বই করেন। তাঁর প্রকাশিত বই পুরস্কৃত হয় প্রতিবছর। তো আমাকে তিনি বললেন, পাণ্ডুলিপি পাঠান। আমাদের নিজস্ব এডিটোরিয়াল বোর্ড আছে। মনোনীত হলে জানাবো। পাঠালাম।সপ্তাহ দুয়েক পর তিনি ফোন দিলেন। এডিটোরিয়াল বোর্ড এপ্রুভ করেছে। বাহ। আমি তো আনন্দিত। একথা ওকথার ফাঁকে তিনি বললেন ৫০,০০০ টাকা দিতে হবে। বইটি পরে প্রকাশ করে ঐতিহ্য। তারাও ১০০ কপি নিজে নেবো এই শর্তে প্রকাশ করে। কথাগুলো আগেও বলেছি, এখানে লেখকদের ইগো ঠিক রাখা মুশকিল।প্রকাশক কোনোদিন খুঁজে বের করবে না।
সাক্ষাতকারী :
আপনি গল্প লিখতে গিয়ে কি কোন সত্যকে অনুসন্ধান করেন? পাঠক আপনার লেখায় কি খুজে পায় বলে আপনার ধারণা?
রুমা মোদক :
একটা নতুন আবিষ্কার পাঠকের হোক এটা প্রত্যাশা থাকে। চেষ্টাও থাকে।এটা কোন " "সত্য" কিনা জানি না। তবে খুব সামান্য সংখ্যক পাঠক হলেও বলেন,তারা সেটি পান। মানে নতুন একটি আবিষ্কার পান। আসলে আমি খুব আত্মবিশ্বাসীও নই কিংবা উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখকও নই। একজন পাঠক যদি আমার অন্তর্গত চেষ্টাটি ধরতে পারেন তাতেই ধন্য হই।
সাক্ষাতকারী :
সেই আবিষ্কারটা কী? নতুন আবিষ্কার বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন।
রুমা মোদক :
ধরো পাঠক গল্পটি পড়তে পড়তে একটা পরিণতি আন্দাজ করেন, কিন্তু শেষ টায় গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য এক আবিষ্কারে বিস্মিত হন, যার জন্য তার পাঠকমন প্রস্তুতই ছিলো না অনেকে বলেন তখন গল্পটি তিনি পুণরায় পাঠ করেন।সব গল্পেই প্রচেষ্টা সার্থক হয়, দাবি করি না। পারিও না।
সাক্ষাতকারী
লেখার নাম কি আগেই ভেবে নিয়ে লিখতে শুরু করেন? প্রশংটি বিব্রতকর গল্পটির নাম কি লিখতে শুরু করার আগেই ভেবেছিলেন?
রুমা মোদক :
গল্পের নামের ক্ষেত্রে সবসময় একরকম ভাবে কাজ করি না। কখনো আগে থেকেই প্লটের সাথে নামটা ভাবনায় চলে আসে।কখনো বা পরেই নামটা দেই।তবে তুমি যে গল্পটির নাম উল্লেখ কিরলে তাঁর নামটি গল্পটি লেখার আগেই অর্থাৎ প্লটটি ভাবার সাথেই মাথায় চলে এসেছে। আমার গল্পের নাম নিয়ে অনেকেই কমপ্লেন করেন। নামগুলো যুৎসই হয় না।
সাক্ষাতকারী
লেখাটি সম্পূর্ণ শেষ হবার পর আবার কি পড়ে দেখেন?
রুমা মোদক :
লেখাটি সম্পূর্ণ করার পর আমি খুব মনোযোগ দিয়ে কলম নিয়ে বসে গল্পটি পড়ি। বলা যায় আমিই আমার গল্পের প্রথম মনোযোগী পাঠক। এটার ব্যত্যয় আজ পর্যন্ত কোন লেখাতেই হয়নি। সত্যিকার অর্থে তখনই গল্পটির শব্দচয়নে, বাক্যগঠনে দুর্বলতা সবলতা আমি নির্মোহ ভাবে উপলব্ধি করি। লেখার সময় যা পারি না।এবং সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এডিট টি তখনই হয়। সন্তুষ্ট হই বা না হই, আমার গল্পের প্রথম সিরিয়াস পাঠক কিন্তু আমি।
সাক্ষাতকারী
লেখা শেষ হওয়া মাত্রই পড়েন নাকি কিছুদিন পর গল্পটির ঘোর থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ গল্পটি পড়েন?
রুমা মোদক :
না, লেখা শেষ হওয়া মাত্রই পড়ি। এটা নাকি এলিস মুনরো করতেন, লিখে লেখাটির কাছ থেকে কয়েকসপ্তাহ নিজেকে দুরে রাখতেন।দীর্ঘসময় পরে গল্পটির সাথে একটা নির্মোহ সম্পর্ক তৈরি হয়। পাঠক হিসাবে তখন যদি লেখাটি তাঁর নিজের কাছে পাস মার্ক পায়, তবেই তিনি তা পাঠকের পাঠের উপযোগী ভাবতেন।আমার তা হয়না। তবে বেশ কিছুদিন প্রায় প্রতিটি গল্প মনে হয় সংগে থাকে,প্রকাশ হওয়ার পরও। মনে হয়- এই জায়গাটা, ঠিক এই ঐ জায়গাটা...
সাক্ষাতকারী
তখন কী করেন?
রুমা মোদক :
প্রকাশিত না হলে ঠিক করি। সম্পাদকগণ আমার এই বিরক্ত করার সাথে পরিচিত।
সাক্ষাতকারী
আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে এই ব্যাপারটাই সাহিত্য পাঠের আনন্দ?
রুমা মোদক :
হ্যাঁ, অবশ্যই ওটাই আমার লক্ষ্য থাকে, পাঠককে আমার মতো করে একটা আনন্দ দেয়ার।
সাক্ষাতকারী
আপনার কি কোন প্রিয় লেখক আছেন যাকে আপনি লেখালেখির শিক্ষক মনে করেন?
রুমা মোদক :
প্রিয় লেখক অনেকেই। তবে সে অর্থে শিক্ষক তেমন কাউকে মনে করি না।
সাক্ষাতকারী
কোন লেখকের লেখা বার বার পড়তে ইচ্ছা করে?
রুমা মোদক
হ্যাঁ, সব লেখকের সব লেখা নয়। অনেকের অনেক লেখা। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্র, শহীদুল জহিরের কাঁটা, মোঁপাসার নেকলেস, শমীক ঘোষের দূরবীন, হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবী গাছ, চেখভের কেরানির মৃত্যু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র একটি তুলসীগাছের আত্মকাহিনী, আরো অনেক আছে এরকম, এই সময়ে দীপেন ভট্টাচার্যের নিস্তারমোল্লার মহাভারত, কুলদা রায়ের সুবলসখার বিবাহ বৃত্তান্ত, ইদানিং যোগ হলো 'মার্কেজের পুতুল' ইত্যাদি বারবার পড়তে নয় কেবল, মনে হয় এমন একটা গল্প যদি আমি লিখতে পারতাম...
এমদাদ রহমান
গল্পকার, অনুবাদক।
............................................................
5 মন্তব্যসমূহ
উত্তরমুছুনশুরুটায় বেশ চমকে গেলাম। অন্ধকার ভালো লাগে প্রশ্নে। লেখকের এলোমেলো পড়ার টেবিলটা দেখতে পেলাম। নোটবুক নয়, কাগজে টুকে রাখার ধরণটাই ভালো, থাকে। ভালো লাগলো। সত্যি ওরকম একেবারে সরাসরি টাকা চেয়ে বসেছিল? কী দুর্ভাগ্য আমাদের! তবে একটা কথা, যাপনের ধরণটা হয়ত একটু ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু সব লেখককেই ওই সে জীবনটার, যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রবাহিত করে নিয়েই লিখতে হয়। বিশেষত আমাদের দেশের নারী লেখকদের। জীবন থেকে নিরবচ্ছিন্ন হলে লেখা হয়না। এটা খুব গর্বেরও নিশ্চয়ই।অভিনন্দন।
ভালোবাসা
উত্তরমুছুনআঁধার যাপনের লেখক অসহায় বোধ করবেন কেন!
উত্তরমুছুন"তিনি তো দুহাতে ওড়াবেন সোনালী মেঘ কিংবা কিছুই না"।
আপনারজনের কথোপকথনে আমার পাঠ্যাপনও কম কিসে। আরো লিখুন। ভালো থাকুন।
পাঠ্যাপনও নয়, ওটা পাঠযাপন হবে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুন