সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী - সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের আলাপ


শাহনাজ মুন্নী এ সময়ের বাংলাদেশের অত্যন্ত শক্তিশালী গল্পকার, কবি ও সাংবাদিক। তাঁর গল্প সকলের চেয়ে আলাদা। ছোট ছোট যাদুকরী আখ্যান, গুটি কয়েক চরিত্র, সুষমামণ্ডিত ভাষা,  আর চমক যে কোন গল্পকেই পাঠককে আক্রান্ত করে। পাঠককে নতুন কোনো ভাবনায় ফেলে দেয়।
তাঁর বেশ কয়েকটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। জ্বিনের কান্না, তার প্রথম ছোটগল্পের বই যেটি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পগাথা, পানসুন্দরী, আমি আর আমিন যখন আজিমপুরে থাকতাম--আরো কয়েকটি গল্পের বই। গল্পকার, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম সম্প্রতি ঢাকার দীপনপুরে শাহনাজ মুন্নীর সঙ্গে তাঁর লেখালেখি, লেখালেখির ভাবনা, নারীবাদ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। সেটা নিচে পত্রস্থ হলো। 

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
আলাপ বিষয়টা মোটেও প্রথাগত হওয়া উচিৎ না।
শাহনাজ মুন্নী : 
প্রথাগত হলে ওটা সাক্ষাৎকার। আড্ডাই আনন্দের তবে আমাদের গল্প এক বসায় শেষ নাও হতে পারে। এমনিতেই রাত হয়ে গিয়েছে যথেষ্ট।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। পুরুষ হলে নিশ্চয়ই এটাকে এখন রাত বলতাম না।
শাহনাজ মুন্নী : 
এমন করে বললে পুরুষকে কিন্তু প্রতিপক্ষ মনে হয়। প্রতিপক্ষ না সমকক্ষ ভাবি। আর এটাও মানি, নারীবাদি না হলে মানবাতাবাদী হওয়া যায় না। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি ঠিক উচ্চকিত নারীবাদের প্রচারে অভ্যস্থ নই। 
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
 আমিও না। এমনকি নারীবাদি লেখক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে বলেও মনে করি না। তবে আপনার মনে হয় না নারীবাদ সাহিত্যে একটা স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে আগাচ্ছে? 
শাহনাজ মুন্নী : 
পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে গেলে প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে তবে মৌলিক সাহিত্যকর্মে কিন্তু তা অন্তরায় হবেই। মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানো, নারীবাদি লেখক বলে আলাদা একটা তকমা লাগিয়ে কোন নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বন্দী করে ফেলা হলো কি-না ? আমরা তো অবারিত আকাশ চাই, মুক্ত বাতাসে উড়তে চাই। 
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
ইসমত চুঘতাইয়ের মতো সাহসী লেখককে যদি নারী লেখক হিসেবে উপস্থাপন করা হয় কেমন লাগবে? মাঝেমাঝে সেটা হয় বলেই প্রসঙ্গটা তুললাম। 
শাহনাজ মুন্নী : 
ইসমত চুঘতাই বেঁচে থাকলে বেশিকথা না বলে নিশ্চয়ই লিহাফের মতো আরেকটা গল্প লিখেই প্রতিবাদ জানাতেন তাতে। আমার কাছেও মনে হয় লেখকের জন্য লেখাই তাঁর প্রতিবাদ। 
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
কিন্তু লিহাফ গল্পে বেগমজান চরিত্রের প্রতি লেখক সুবিচার করেননি মনে হয় কখনো। আপনারও একটা চরিত্রের কথা মনে এলো, ২২ আঙ্গুলের জীবন গল্পে ‘সোহাগী’। 
শাহনাজ মুন্নী :  
অবদমিত আকাঙ্খা নিয়ে বেগম জানের চরিত্রটা আসলে একটা যাত্রা বলা যায়। উত্তম পুরুষে লেখক নিজেকে একরকম ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন বলেই হয়ত তাকে এভাবেই আনতে হয়েছে। ইসমত কিন্তু সরাসরি কোন অভিযোগও করেননি এটা বুঝতে হবে তোমাকে। আমার মনে হয়, তিনি সমাজের দৃষ্টিকোন থেকে বেগমজানকে রূপ দিতে চেয়েছেন। রব্বু যেখানে বেগমজানের মন বাসনা এবার পূর্ণ নাও হতে পারে ইঙ্গিত দিয়েছিল সেখানে দ্যাখো, কেমন তছনছ করে ফেলছেন মহিলা। ফিট হয়ে যাচ্ছেন, সোনার হার ছিড়ে ফেলছেন, কাপড় টুকরো টুকরো করছেন। কী অসহায় অবস্থা। তখন কিন্তু পাঠকের মায়াও হয় বেগমজানের জন্য। 
২২ আঙ্গুলের জীবনে ‘সোহাগী’ একটা ছোট্ট চরিত্র। খুব হাশিখুশী আমুদে মানুষ, সব সময় রসিকতা করছে সেও ভেতরে ভেতরে কতখানি অতৃপ্তি বহন করলে আত্মহননের পথে যায় সে রকম একটা বিষয় আছে। আমাদের অধিকাংশ মানুষই তো নিজেকে আড়াল করে চলে অনেক সময়, আর আমরা খণ্ডিত অংশেরই ব্যাখ্যা করি। 
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
মান্টোর সন্তান গল্পের জুবেদাকে বরং বেশি নারীবাদি মনে হয়।
শাহনাজ মুন্নী : 
সেখানে নারীকে মাতৃত্বের আকাঙ্খায় আটকে ফেলার বিষয়টা দেখছ না? মান্টো কিন্তু নারীর দৃঢ়তার কথা বলেননি। বরং মাতৃত্বের কারণে নারী তাঁর নিজের কল্পনার ভেতর নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে। তুমি বরং ‘ঠান্ডা গোশত’ গল্পের উদাহরণ আনতে পারো। সেখানে ঈশ্বর সিংয়ের স্ত্রী কুলবন্ত কাওর কেমন জাদরেল নারী! সে স্বামী ঘরে ঢুকতেই খুটিয়ে খুটিয়ে তাকে পরখ করে। এক পর্যায় ঈশ্বর সিংকে ধমকে উঠে সঠিক জবাব না পেয়ে। আবার সে নেহাল সিংয়ের মেয়ে বলে শপথ করছে, মিথ্যে বললে স্বামীকে কেটে টুকরো টুকরো করবে। এই তেজ কিন্তু বেশ সবল নারী চরিত্র দেখিয়েছেন মান্টো। 
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
মুক্তিযুদ্ধ বা ভাষা আন্দোলনে নারীদের অগ্রণী ভূমিকাকে কিন্তু বেশ গর্বের সাথেই আমরা স্বীকার করি, গ্রহণ করি।
শাহনাজ মুন্নী : 
একবাক্যে অতো সহজে বলা যাবে না। এখনও বীরাঙ্গনারা তাদের এই পরিচয় প্রকাশে কুণ্ঠিত। কেন? সমাজের কারণে। বীরঙ্গনা মানেই যার নারী অঙ্গ অন্য পুরুষ প্রত্যক্ষ করেছে। অথচ এর পেছনে কত গভীর কান্না আছে তা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সামাজিক ট্যাবুর কাছে। 

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
আমরা দেশকে মা হিসেবে দেখি, পয়মন্ত লক্ষ্মী সংসারের সমৃদ্ধি আনছে, দশভূজা দুর্গা বা বিদ্যার দেবী সরস্বতী এসব বিশ্বাস নারীবাদকে সমর্থন করে না?
শাহনাজ মুন্নী : 
সুভাষণের রাজনীতি এটা। এসব বলে নারীর ওপর দায়ভার চাপিয়ে দেয়ার একটা কৌশল। এখন ফেবসবুকে দ্যাখো না একজন নারীকে সবকিছু কেমন করে সামলাতে হয় সেটা বোঝাতে দুর্গার ছবিটা ব্যবহার করে? মেয়েদের বিশেষ সময়টাতে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করা নিষেধ। সন্তান প্রসবের সময় ব্যবহার করা লেপ তোষক আগে ফেলে দেয়া হত। ভুলে যেও না ওয়াটার বা ফায়ার ছবি ব্যান্ড হয়। পুরাণের কথা যদি তুলি তাহলে দ্যাখো সীতার অগ্নি পরীক্ষা, দৌপদীর বস্ত্র হরণ, পঞ্চ পান্ডবের এক নারীকে বিয়ে এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। আবার পুরুষের চার স্ত্রী থাকা জায়েজ, ধর্ম মুতা বিয়েকে সমর্থন করে রেখেছে। নারীর জন্য এখানে কোন ছাড় দেয়া আছে? এরকম আরও বহু বিষয় আছে আমাদের সংস্কার, চর্চা আর ধর্মে যা নারীকে খর্ব করার পথই। 

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
পশ্চিমা পৌরাণিকের দিকে তাকালেও আমরা তাই দেখি। প্যান্ডোরার সিন্দুক বা বাইবেলে মানুষের পতনের কাহিনী উপাখ্যানগুলো পুরো নারী বিদ্বেষী মনে হয় না?
শাহনাজ মুন্নী :  
প্যান্ডোরায় নারীকে দণ্ডিত করা হয়েছে যৌনতার দায়ে। ইভ-এর আপেল খাওয়ার ফলে যত অনাসৃষ্টি। এসব রচনা পিতৃতন্ত্রের বলেই তাদের ইচ্ছে মতো কল্পনা হয়েছে। পিতৃতন্ত্র সব সময়ই কামের সব দোষ নারীর উপর চাপিয়ে দেয়। গর্বটা পুরুষের। হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইতে এ নিয়ে আলোচনা আছে। নারীর লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে বলতে যেয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে গ্রীকরা কেমন করে উর্বরতার উৎস হিসেবে পুরুষাঙ্গের পুজো করছে আবার কামকে নিন্দা করতে তখন দোষারোপ করছে প্যান্ডোরাকে।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
সেদিনও একটা নিউজে পড়ছিলাম। ইউরোপে উইচ বলে দুই নারীকে মেরে ফেলা হয়েছে। সভ্যতার এই জায়গায় এসে এখনো এসব ঘটে!
শাহনাজ মুন্নী : 
ঘটবেই। আমাদের এখানেও ষাট-সত্তুরের দশকের প্রচুর বাংলা গল্পে তুমি এরকম পাবে। ডাকিনী- যোগিনী আখ্যা দেয়া হতো। এক ঘরে করা হতো বা চুল কালি মেখে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হতো। পক্স বা কলেরা হলে নাকি মানুষ ওলা দেবি, শীতলা দেবিকে দেখত। 
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
এ পর্ব হয়ত আমরা কিছুটা অতিক্রম করে এসেছি তবে ট্যাবু বিশেষ ভাঙ্গেনি। গ্রামে এখনও সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে বাক্যের পুণরাবৃত্তি হয়। আপনার কেমন লাগে নারী লেখিকা হিসেবে পরিচিত হতে?
শাহনাজ মুন্নী : 
কখনোই নারী লেখক হিসেবে পরিচিত হতে চাইনা। লেখকের আবার নারী-পুরুষ কী! আমি তো নারীই। এটা নিয়ে আমার গর্ব আছে। তবে সত্যি যা তাই আবার বিশেষ করে উল্লেখ করলে একটা ‘কিন্তু’ তৈরি হয়। 

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
তাহলে এই যে নারী পাতা, নারী লেখকদের নিয়ে বিশেষ আয়োজন এটা আসলে সত্যি লেখকের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে নাকি কোঠা ভিত্তিক করে অবস্থানটা আরও দূর্বল করে তোলে?
শাহনাজ মুন্নী : 
নির্ভর করে কোন পরিস্থিতিতে কেমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এর ওপর। আমার মনে হয় না লেখক কখনো নারী লেখক হওয়ার জন্য লিখবেন। যারা নারীত্বের সুবিধা ভোগ করে লেখক হতে চান তাকে ঠিক লেখক বলা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। তিনি হয়ত শুধু নিজের অবস্থানের একটা পরিবর্তন আনতে লেখাটা টুলস হিসেবে ব্যবহার করছেন। আসল সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ কতটা, এটা নিশ্চিত নই।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
 রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন তাদেরকে কিন্তু নারী লেখক হিসেবেই প্রথমে লড়াই করতে হয়েছে। এরপর তারা দেখিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা শুধুই লেখক। এবং বাংলাদেশের লেখকদেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন এখন সেটা লেখার জোরেই। কী বলবেন?
শাহনাজ মুন্নী : 
রিজিয়া আপা বা সেলিনা আপাদের লেখা যখন প্রথম প্রকাশিত হয় সে সময় আর এ সময়ের মধ্যে অনেকটা ব্যবধান। তাদের সময় বেগম পত্রিকায় নারী পাতা ছাড়া অন্য সম্পাদকরা অতো সাহস দেখাতেন না তাদের লেখা প্রকাশের। আর এখন দ্যাখো। ঈদ সংখ্যা বা বিশেষ ক্রোড়পত্র সবকিছুতে সম্পাদকরা জেন্ডার ব্যালেন্স হচ্ছে কিনা সেটাও কিন্তু বিবেচনায় রাখেন। তবে এই সংগ্রামটা নব্বইয়ের দশকেও ছিল। আমাদেরও প্রথম প্রথম লেখা দিলে জানতে চাইত, নারী পাতায় ছেপে দেই? কেউ কম্প্রোমাইজ করেছে, কেউ করেনি। যারা করেনি তারা লেখক হয়নি তা কিন্তু না বরং সে সময়ে নারী পাতায় স্থান পাওয়া অনেক লেখকই এখন আর লেখেন না। আমাদের আগে নাসরীন জাহানদেরও এই পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কিন্তু নাসরীন আপা একেবারে প্রথম থেকেই প্রমাণ করেছেন তিনি শুধু লেখকই হতে এসেছেন। 
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
 যদি নারী পাতায় আপনার ওপর বিশেষ প্রতিবেদন করে নিষেধ করবেন? আমিও তো নারী সংখ্যার জন্যই এ আলাপ শুরু করলাম।
শাহনাজ মুন্নী : 
লেখককে নিয়ে প্রতিবেদন আর নারী লেখক হিসেবেই লেখা প্রকাশ দুটো এক না। ওটা প্রচারণা। পত্রিকা যদি প্রচারণা করতে চায় লেখক হিসেবে তা কেন না করবো? কিন্তু আমাকে কোনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটা জরুরি। 

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
আপনার ‘মেয়ে মানুষের গোশত’ গল্পটাকে আমার নারী বান্ধব গল্প মনে হয়। 
শাহনাজ মুন্নী : 
ওটা আসলে শুধু একটা গল্পই। নারী বান্ধব বা নারী কেন্দ্রিক বললে বলতে পারো, আপত্তি করব না। হয়তো তোমার বিবেচনায়, এই গল্পে, পুরুষের বিরুদ্ধে পুরুষ দাঁড়িয়েছে। একদল পুরুষ নারীর মাংস খেতে উৎসব করছে। আর সেটাই নানা কৌশলে প্রতিহত করতে চাইছে যে সেও আরেক পুরুষ। এটি একটি লোকগল্প। আমি এই গল্পটাকে আধূনিক সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে মিলাতে চেয়েছি। এই গল্পে দুটো তিনটে গল্প পাশাপাশি চলেছে। একটা গল্প আরেকটাকে রিলেট করেছে। তারপর এটা ব্লেন্ডিং হয়েছে। সুতরাং তুমি এর আঙ্গিক নিয়ে কথা বলতে পারো। এর বিষয় বস্তু নিয়ে কথা বলতে পারো। তবে কোন বিশেষ তকমা না দেয়াই ভাল। 
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
ফেয়ার অ্যান্ড ফাইন লুক গল্পটা প্রচণ্ড নারীবাদী। এটা অস্বীকার করতে পারবেন না।
শাহনাজ মুন্নী : 
 অস্বীকার করব কেন? নারী লেখক হতে চাই না মানে আমি নারীবাদি গল্প লিখতে পারব না? একজন পুরুষেরও নারীবাদি গল্প লেখার স্বাধীনতা আছে। অনেক বিখ্যাত নারী চরিত্র পুরুষের হাতেই সৃষ্টি। একজন আন্না কারেনিনা বা বিনোদিনী চরিত্র অথবা ধরো পাভেলের মা এসবত তলস্তয়,রবীন্দ্রনাথ বা গোর্কিরই সৃষ্টি। ফেয়ার অ্যান্ড ফাইন লুক গল্পটা মেটাফোরিক্যালি নারীবাদ। শেষ পর্যন্ত পুরুষরা সম্পূর্ণ কোন নারীকে পেল না। ‘শুধু নারীদের জন্য’ লেখা সাইন বোর্ডের ফেয়ার অ্যান্ড ফাইন লুক নামক সৌন্দর্য কেন্দ্রের মেঝেতে পেলো নারীদের রঙহীন চোখের জল, দীর্ঘ চুল, ফ্যাকাশে মাংস, স্থবির পা আর কালশিটে পড়া ত্বক। 
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
এই গল্পে পতিতার বক্তব্য আরেকটা দিক তৈরি করেছে। একজন পতিতা সে পুরুষদের সৌন্দর্যকেন্দ্রে প্রবেশ করছে কিন্তু ফেয়ার অ্যান্ড ফাইন লুকে তার প্রবেশের অবকাশ নেই। এই যে নারী হয়েও আবার তার অধিকার নেই সেখানে।
শাহনাজ মুন্নী : 
এটাও সমাজ ব্যবস্থা। একটা সমাজে অনেক স্তরের নারী থাকে। তাদের অধিকারও শ্রেণী ভেদে পালটে যায়। গল্পের শেষ বাক্যটা মনে আছে? আহা, এইসব অঙ্গকে আবার তাদের মানে নারী কর্মচারীদের সুচারু পরিচর্যা করে চাররঙা সংসারে পাঁচ রকমের কাজের মধ্যে ফিরিয়ে দিতে হবে।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম :  
আপনার ‘নানার কাহিনী’ গল্পে হাওরের নামহীন ওই নারীকেও বেশ অন্যরকম চরিত্র মনে হয়। উদ্ধারকর্তা, আশ্রয়দাতা আবার আকাঙ্খিত হয়েও কেমন নিজেকে দৃঢ় রাখলো সে। আপনি এই গল্পে আঞ্চলিক ডায়লেক্ট ব্যবহার করেছেন দারুণ।
শাহনাজ মুন্নী : 
ইন্টারেস্টিং চরিত্র না? ভয় পেতে পারত, সাথে না আনতে পারত আবার ভোর রাতে ওরকম অন্ধকার থাকতেই টেনে তুলে নাও বলতে পারত ‘অহন যাইনগা, পচ্চিমমুহী গেলে গঞ্জ পাইবাইন, হেইনো নাও-ও পাইবাইন, আইন্ধার থাকতে থাকতে রওনা দেইন’। এটা কিন্তু কিশোরগঞ্জের হাওর অ লের ভাষা। 

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
এর যে কোন একটা না ঘটলেই গল্প হয়ত আরেক রকম হয়ে যেত। আপনি এই তিনটি অঙ্ক ঠিক করে গল্পটার কাঠামো বানিয়েছেন। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম দেখতে পাওয়া এবং ভোর রাত। এ দুটো পরিস্থিতি তৈরি করতেই হাওরে অমন নৌকা উল্টে গেল, ভাটির দেশের পুরুষদের বছরের একটা সময় উজানে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।
শাহনাজ মুন্নী : 
এটা নিয়ে আমি বলবনা। পাঠক বলবে। 
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
আদি ঢাকার মিথ পড়ছিলেন বলেছিলেন। বইটা পাইনি খুঁজে। কেমন মিথ ? 
শাহনাজ মুন্নী : 
খুব সরু মাত্র কয়েক পাতার বই। কারা যে প্রকাশ করেছে মনে আসছে না। তবে গল্পগুলো তোমার পছন্দ হবে। এখানে একটা গল্প আছে।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
বলুন--
শাহনাজ মুন্নী : 
পুরান ঢাকায় এক বুড়ি দাই ছিল, ধাত্রী আরকি। একদিন রাতে বেশ মন টন খারাপ করে শুয়ে আছে ঝুপড়ির ভেতর। সারাদিন কোন কাজ পায়নি। খাবারও জোটেনি। মাঝরাতে তাঁর দরজায় টোকা পড়লো। সে দরজা খুলে দ্যাখে ইয়া বিশাল এক লম্বা চওড়া সুপুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। বললো তাঁর সাথে এখুনি যেতে হবে একটা সন্তান প্রসব করাতে। অনেক রাত তারওপর এরকম দেখতে একজন মানুষ একা একা এসেছে। দাই একটু ভাবলেও দায়িত্ব, তারওপর সারাদিন কাজ পায়নি বলে সংশয় নিয়েও রওনা হলো ওই লোকের সাথে। লোকটা লালবাগের কেল্লার ভেতর ঢুকল। সেই ধাত্রীকে একটা ঘরের সামনে নিয়ে বললো, এই ঘরে আছে। সেও ঘরে প্রবেশ করলো। 

চাদরের নিচে এক নারীকে ঢেকে রাখা। আশপাশ দিয়ে খুব সুন্দরী মেয়েরা, ঝলমলে পোশাক পরা সবাই চলাফেরা করছে। কেউ কাপড় আনছে, কেউ গরম পানি আনতে ছুটছে। ধাত্রী চাদরের নিচে হাত দিয়ে প্রসূতির হাত বের করলো। থমকে গেল। মানুষের গায়ের রঙ এত সুন্দর হয়। যেন জ্যোতি বের হচ্ছে তাঁর গা থেকে আর সে আলোতে পুরো ঘরও মনে হচ্ছে আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। যা হোক ধাত্রী বুড়ি হতচকিত অবস্থায় সেই নারীর সন্তান প্রসব করালো। বাচ্চাটাকে হাতে নিতেই সে উড়ে যেয়ে ঘরের সিলিংয়ের কাছে একটা স্থানে বসে রইলো। এ অবস্থা দেখে তো বুড়ির অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপায়। সেই বাচ্চা আবার ওখানে বসেই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাকিয়ে আবার হাসছে। 

তাঁর মনে হলো সে আসলে অন্য কোন কল্প লোকের ভেতর প্রবেশ করে ফেলেছে। এরা ঠিক মানুষ না। এমন সময় ওই ঘরের দরজায় আবার খটখট শব্দ। দরজা খুলে বাইরে আসতেই বুড়ি দেখলো সেই লোকটা যে তাকে সাথে এনেছিল। জানতে চাইছে কাজ শেষ হয়েছে কিনা। বুড়ি হ্যাঁ বলতেই লোকটা বললো, আপনি অনেক উপকার করলেন। এই নিন আপনার পারিশ্রমিক। বলেই বুড়ির হাতে একটা ছোট্ট কাপড়ের দলা তুলে দিল। বুড়ির মনটা খারাপ হয়ে গেল। সারাদিন না খাওয়া। কোথায় টাকা পাবে তা না দিয়েছে একটা কাপড়ের পুটলি। তবুও তাঁর মনে হলো, এখান থেকে এখন যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যাওয়া দরকার। সে আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। 

পথে আসতে আসতে খুব কৌতুহল নিয়ে সেই কাপড়ের পুটলিটা খুললো। খুলে মনটাই দমে গেল বুড়ির। কাপড়ের মধ্যে কতগুলো কয়লার টুকরো। রাগে কষ্টে বুড়ি সেই টুকরোগুলো পথে একটা একটা করে ছুড়ে ফেলতে ফেলতে ঘরে ফিরল। একটু থিতু হয়ে সবঠিকঠাক করে কাপড়টা ধরে টান দিয়ে ফেলে দিতেই দ্যাখে ওর ভেতর থেকে আলো বের হচ্ছে। বুড়ির চোখ ছানাবড়া। সে ভালো করে তাকিয়ে, আলোর সামনে ধরে ঘুরিয়ে নেড়ে দেখে বুঝলো ওটা একটা হীরার খন্ড। একটা টুকরো যেটা সে ফেলে দেয়নি। বুড়ি সেই ভোর ভোর আলোয় দৌড়ে আবার পথে নামলো। যে পথ দিয়ে কয়লা ফেলতে ফেলতে এসেছিল সেখানে আবার তন্ন তন্ন করে খুঁজল। সবগুলো টুকরো পেলো কিন্তু যেগুলো ফেলে দিয়েছে সেগুলো কয়লা হয়েই আছে। অনুতাপ করতে করতে ফিরে এলো নিজের ঝুপড়ি ঘরে। 

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
 নিশ্বাস আটকে শুনছিলাম গল্পটা। গল্প লেখার পাশাপাশি কথকের ট্রেন্ডটাও চালু হওয়া উচিত। সেই আগে যেমন পুঁথি পড়া হতো । ভাবলাম আপনার সাথে বসে আরণ্যপর্ব, বর্বরতাপর্বের নারীদের জীবনের সাথে সভ্যতার নারীদের পরিবর্তন নিয়ে আলাপ করবো। তবে মনে হলো এই ভালো হয়েছে। 
শাহনাজ মুন্নী : 
ওসব না হয় বড় লেখকরা, তাত্ত্বিকদের জন্য থাক। আমরা যে আড্ডা দিলাম সেই বেশ উপভোগ্য হয়েছে আমার কাছে।
  
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম : 
আমারও তাই মনে হয়। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব, লৈঙ্গিক রাজনীতি বা বিবর্তিত প্রথা এসকল গুরু গম্ভীর বিষয় আমাদের না। আমার আনন্দ হলো এই প্রাণ খোলা গল্পেই।



লেখক পরিচিতি
সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম
গল্পকার। প্রবন্ধকার। সাংবাদিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ