গৃহকত্রীর কাছে বকুনি খেয়ে বিতাড়িত মেয়েটি ভেকু ভেকু
রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। দেখতে খুবই সুন্দর। একান্তভাবেই
সরল এবং অজ্ঞ। পথঘাটও চেনে না। বয়েস বড়ো জোর চৌদ্দ কি পনেরো। শাড়ি পরে বলে বড়ো
দেখায়। পাশের ফ্ল্যাটের কাজের মেয়ে দামিনীর মা যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, “কি
রে, এ সময়ে রাস্তায় ঘুরছিস,কাজ নেই?”
মেয়েটা কেঁদে ফেলে বললো,“আমাকে
তাড়িয়ে দিয়েছে।”
‘কেন,তুই কী করেছিলি?”
“মাইনে চেয়েছিলাম।”
“মাইনে চেয়েছিস বলেই
তাড়িয়ে দিলো? সে
কী কথা?”
"চারি মাস কাজে লেগিছি একটা টাকাও দেয়নি।”
“তোর মাইনে ক’ত?”
‘জানিনা’।
‘জানিস না মানে? হাবা নাকি?
মাইনে ঠিক করে কাজে লাগিস নি?
"বলিছিল অনেক দেবে।’
‘আমনি তুই চলে এলি? এখানে তো কে আছে?”
‘কেউ না।”
‘তবে তুঁই এলি কী করে ?
‘দালা ধরি টাকা দিয়ি।’
"এখানে তোর কেউ নেই। তবে এলি কেন?”
‘ওখানে যে থাকা যায় না। ওরা
টালায়,বিয়া বসতি চায়”।
"কারা টালায়? কারা
বিয়া বসতি চায়।”
“যাদিগো দেশ। আমারে এইট্টা
কাজ দিবা দিদি?”
‘দেবো। তুই এখানে দাঁড়িয়ে
থাক। আমি দোকানে যাচ্ছি। ঘরে চিনি নেই,এখন দেরি করতে পারছি না, ফিরে আসি কাজের কথা বলবো। দুটো কাজ আছে আমার হাতে।” দামিনীর
মা দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল। মেয়েটা দাঁড়িয়ে রইলো।
অন্য ফ্ল্যাট থেকে একজন ভৃত্য বেরিয়ে এল। নাক ঝাড়ছিল চোখ
পড়ে গেল মেয়েটার দিকে। আমনি চোখমুখ চকচকে দেখালো,বিগলিত গলায় বললো, ‘আরে, তুই এখানে ? কী করছিস?” মেয়েটা
বললো, “যা
খুশি তা কুরছি তোমার কি?’
"রাগ করছিস কেন? আমি
কি তোকে কোনো খারাপ কথা বলছি ?”
“আমার খারাপ ভালোয় দরকার
নেই। তোমার কাজে তুমি যাও, আমার
দিকে চাইও না।‘
'চাইবো না? না
চেয়ে পারা যায়? তোকে
যে আমি ভালোবাসি তা কি তুই জানিস না?"
‘জানিবু না কেনো। খুব জানি।
বালো কইরাই জানি। সকলের ভালোবাসাই আমার জানা আছে।”
ভৃত্যটি এগিয়ে এসে কঁধে হাত রাখলো। মেয়েটি এক ঝটকায়
সরিয়ে দিয়ে বললো,“আমাকে ছুবে না,কেউ ছুঁলি আমার ভাল্লাগে না।”
‘কেন রে-” ভৃত্যটির মুখ তেমনি বিগলিত। সে এদিক
ওদিক তাকিয়ে ফস করে তার ব্লাউসের ভেতর হাত ঢুবিয়ে দিলো। মেয়েটা একটা কামড়
বসিয়ে দিয়ে দূরে সরে গিয়ে কাদতে লাগলো।
এই ফ্ল্যাট বাড়িতে মোট চব্বিশটা
ফ্ল্যাট। পায়রার খোপের মতো ঘরে ঘরে সব সংসার। প্রত্যেকের বাড়িতেই কাজের লোক আছে।
কোনো বাড়িতে পুরুষ,কোনো
বাড়িতে মেয়ে। তাদের নানারকম বয়েস,নানারকম চরিত্র। কেউ কেউ আজ আসে কাল যায়,আবার কেউ কেউ টিকে যায়। আবার কেউ
কেউ এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কারো সঙ্গে কারো ভাব ভালোবাসা নেই, থাকলেও মুখে মুখে। তবে ভাব
ভালোবাসার প্রশ্ন না থাকলেও এর বাড়ির লোক সে ভাঙিয়ে নিচ্ছে তার বাড়ির লোক সে
ভাঙিয়ে নিচ্ছে, এটা প্রায় নিয়ম।
নন্দিতা এ-বাড়ির তেতলার একটা
ফ্ল্যাটে থাকে। পেশা অধ্যাপনা। বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। স্বামী বছর চারেক আগে কোনো অজানা
অধরা অসুখে মারা যাবার পরেই এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হয়েছে। আগে কলকাতার বাইরে ছিল, স্বামী ছিল মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার,বদলির চাকরি,ঘুরে ঘুরেই থাকতে হয়েছে তার সঙ্গে।
তাই চাকরি করা আর পোষাতো না। মৃত্যুর পরে চেষ্টাচরিত্র করে কাজে বহাল হয়ে এখানে
এসেছে,এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে।
বিজ্ঞানের ভালো ছাত্রী,এম
এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল, পি. এইচ. ডি-ও করেছিল। গবেষণার কাজে নিয়োজিতও
করেছিল নিজেকে, বিয়েটা
হঠাৎই হয়ে গেল। কুনাল অর্থাৎ তার স্বামী তার কোনো আত্মীয় দাদার শ্যালক। সেই
দাদার বাড়িতেই আলাপ,এবং
অল্পদিনের আলাপেই পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হওয়া এবং দাদার মধ্যস্থতায় বিবাহ।
কিন্তু সুখ সইল না। কপালদোষে মারা গেল কুনাল,নন্দিতা রিক্ত হয়ে ফিরে এল কলকাতা।
কিছুদিন মা-বাবার কাছে থেকে চাকরি পাবার পরে এসেছে আলাদা বাড়িতে। সস্তানাদি হয়নি,একাই থাকে। প্রত্যেক ফ্ল্যাটের
সঙ্গেই ছোট্ট একটি ব্যালকানি আছে সামনের দিকে। আজ ছুটির দিন,কলেজ নেই,নন্দিতা সেই ছোট্ট ব্যালকনিতে
দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল এবং চেচিয়ে ভৃত্যটিকে বকে উঠল “অ্যাই’ বলে।
ভৃত্যটি দৌড়ে পালিয়ে গেল। মেয়েটিও বকা শুনে উপর দিকে তাকিয়েছিল,ইঙ্গিতে ডেকে উপরে নিয়ে এল তাকে।
আদর করে বসিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,“তোমার নাম কি?”
সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,“কমলা।”
"বাঃ, সুন্দর
নাম। কোথায় থাক ?”
“এই বাড়িরই একটা ফ্যালাটে
ছিলাম, খেদিয়ে দিয়েছে।”
‘ওমা কেন? এমন সুন্দর একটা মেয়েকে কে খেদিয়ে
দিলো। কদিন ছিলে সেখানে ?”
‘তিন-চার মাস’।’
‘তিন-চার মাস রেখে তাড়িয়ে
দিলো? কী করেছিলে ?’
“কিছু করিনি। ওনার ছেলেডা কী
ওষুধ খেয়ে নেশা করে আর সব কথাতেই মারতি উঠে। ওর মাকেও মারে। আমাকেও মারিছে।”
‘সে কী!”
‘হু, পেরাই তো মারে। দ্যাখো
না পিঠটা দ্যাখো,কেমন
বাড়ি মারিছে লাঠি দিয়ে। অন্যদিন মা ঠেকায় আজ ঠেকায়নি।'
*কেন?”
‘বলিছিলাম,এরম মারলি পরে আমি থাকবোনি,আমারে মাইনে দিয়ে দাও,আমি চলি যাই। বলতে মা-ও বললো,কুত্তার বাচ্চা,খাতি দিচ্চি,পরতি দিচ্চি আবার মাইনে! এই বলে মা
খুব জোরে চড় মারি বললো,সাগর
যে মারে খুব ভালো করে। তখন আমি বার হয়ে এলাম।”
চুপ করে থেকে নন্দিতা বললো, “এখন
তুমি কোথায় যাবে?”
‘জানিনা।‘
‘ বাড়ি কোথায়?’
‘খুইলনে।
‘এখানে কোথায় থাকো?’
‘এখানে তো ওই ফ্যালাটেই
ছিলাম।”
‘মা-বাবা কোথায় থাকেন?’
“সাহস গেরামে।”
‘তা তুমি এখানে কেন?”
“পাঠিয়ে দিলো যে দালাল
দাদার সঙ্গে।”
‘দালাল দাদা?’
‘টাকা
দিলি বাংলাদেশ থেকে যে দালাল আমাদের এখেনে নিয়ে আসে,সে আমার ডাক দাদা হয় সম্পক্কে। দু’শো
টাকা দিয়ি মা-বাবা তার সঙ্গে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। তিন মাসের খোরাক খরচও
দিয়েছে। বলেছে,কদিন
তোমার বাড়িতে রাখো,এদিকে
বন্দোবস্ত করে আমরাও পালাবো,তখন
একটা ছোট বাড়িটাড়ি দেখে দিও, আমরা থাকব।”
“না।
একমাস হতি না হতি দালাল দাদা বললো,তোকে বসিয়ে বসিয়ে ক'দিন খাওয়াবো? চল,চাকরি করবি। এই বলে এই ফ্যালাটে
দিয়ে গেল। এখানে বাসন মাজতি হয়,কাপড়
কাচতি হয়,
দাদা ওষুধ
খেয়ে বমি করলি সেইসব ধুতি হয়,আবার
ঝাড়ামোছা,
রান্না করা-"
‘সব
তুমি করতে?”
‘সব আমি করতাম।’
নন্দিতা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,’বেশ তো ছিলে বাংলাদেশে,হঠাৎ চলে এলে কেন? যদি
আসতেই হতো। তবে তো মা-বাবার সঙ্গেই আসতে পারতে।'
‘আমি বড়ো হইছি যে। বড়ো মেয়ি
যে ওখানে থাকেতি পারে না। আমার খুব কষ্ট ছিল,বাড়ি থেকে বেরুতেই পারতাম না। তাও
তো একবার হাত ধরি টানি টানি ঝোঁপির ধারে নিয়ে গিয়ে-” মুখ নিচু করল কমলা।
নন্দিতা সেই প্রসঙ্গ থামিয়ে বললো, ‘এখন তুমি কী করবে?’
‘আমি জানি না। দামিনীর মা
দিদি বলিছে দুটা কাজ আছে তার হাতে,আমাকে দিবে। রিকশাওয়ালাও বলিছে তার হাতে অনেক বড়ো কাজ আছে, সঙ্গে গেলেই দিতি পারবে। ওর সঙ্গে
যাতি আমার ভয় করে। কেবল কেমনি করি তাকায়,গায়ে ঠেস লাগায়-
‘লেখাপড়া শিখেছো ?”
‘না’।
‘কেন?’
‘দুটা দিদি ছিল,বড়ো দিদিটা দশ ক্লাশে উঠিছিল,তারপর একদিন আর ইশকুল থেকি ফিরলো
না।”
‘সে কি ?”
‘চুরি করি নিয়ি গেল।
মা-বাবা কাঁদি কঁদি মরলো, তবু
চোরেরা দিদিকে ফিরত দিলো না। ছোট দিদি সেভিনে উঠছিল, মা-বাবা বন্ধ করি দিলো পড়া। এক
বুড়ার সঙ্গে বিয়া দিয়া দিলো তাড়াতাড়ি। সিজন্য আমাকেও আর বাইরে পাঠায়ে পড়ায়
না। ঘরে কিছু কিছু পড়িছি। কুড়ির ঘরের নামতা জানি,যোগ-বিয়োগ জানি,বাল্যশিক্ষা শেষ করিছি-‘
“বাবা কী করেন। ওখানে ?”
“আমাদের কাঠের গোলা আছে।
বাড়ি অনেক বড়ো,নারকেল
গাছ আছে চব্বিশটা,সুপারি
গাছ আছে বারোটা, কিন্তু
সব ওরা পাড়ি নিয়া যায়,আমরা
কিছু পাই না। বাবা বলে এখন কাঠের গোলাটাও ছোট হতি হতি এত ছোট হয়ে যাচ্ছে সেটাও রাখা
যাবেনা।‘
‘ছোট হচ্ছে কেন? চলে না?’
‘ওরা ভাগ নেয় যে। বাবা তাই
ঠিক করিছে সব ছাড়ি চলি আসবে এখানে। বিক্রি করার চেষ্টা করিছে। কেউ নিতি চায় না, বলে ‘ছাড়িয়া যান দেখেশুনে রাখবো।‘ বাবা
বলে,’দখল তো পাবেই ছাড়ি গেলে,আর কিনবে কেন? ভালো
লোক খুঁজিছে,পালেই দিয়া দেবে।”
‘ঠিক আছে। এখন তুমি আমার
কাছেই থাকো।'
‘কী কাজ করবো?’
‘যা তোমার খুশি। একটু চা করে
দেবে। ঘরটরগুলো গুছোবে-‘
‘আর
বাসন মাজব,
কাপড় কাচবো-‘
‘না না ওসব তোমাকে করতে হবে
না। লেখাপড়া করবে। বই কিনে দেবো,খাতা
কিনে দেবো,একটু এণ্ডলে স্কুলে ভর্তি
করে দেবো।‘
‘দিবে?” বালিকার
উল্লাসে হাততালি দিয়ে বলে উঠলো,কমলা।
‘তুমি খুব ভালো। তোমাকে আমার খুব ভালো লাগিছে। কী বলে ডাকবো?’
‘সে তোমার যা খুশি। শোনো,আমার রান্না আমিই করি। একজন ঠিকে
মেয়ে এসে অন্যসব কাজ করে দিয়ে যায়, তুমিও হাতে হাতে কিছু করবে, আমাকে রান্নার সাহায্য করবে-‘
‘আর মা বলি ডাকিবো’
‘মা!’ থমকাল নন্দিতা। মা ডাকের সঙ্গে
এখনো তার পরিচয় হয়নি। নিজের ছেলেমেয়ে নেই বলেও হয়নি, এই কাঁচা চেহারায় কাজের লোকজনেরা
ডাকে না বলেও হয়নি। স্বামীর সঙ্গে থাকাকালীন সবাই বউদি বলে ডাকতো এখন দিদি ডাকে।
ঠিকের কাছের মেয়েটি দিদিমণি বলে।
অবশ্য ঠিক ঠিক সময়ে বিয়ে করলে,ঠিক ঠিক সময়ে সস্তান হলে এতবড়ো
মেয়ে থাকতে পারতো বই কি। চেহারা যতই ছিপছিপে হোক, যতই কাঁচা দেখাক, তেতাল্লিশ বছর তো পূর্ণ হলো গত
মাসে। বললো,
“সে তোমার যা খুশি ডেকো,আমি স্নান করতে যাচ্ছি, মি ততক্ষণে এই শাড়ি দু’টো ভাজ করে রাখো,কেমন?’
শনিবার নন্দিতার ছুটির দিন। মানে অফ
ডে। মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো কমলা শুধু তার শাড়ি দুটোই ভাজ
করে রাখেনি,
বিছানার
এলোমেলো বেডকভারটা সুন্দর টানটান করে দিয়েছে, ছড়ানো ড্রেসিংটেবিল্টা ফিটফাট
করেছে, এখন ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। তাকে দেখে একগাল হেসে বললো, “মা, এই ঝাড়ুটা একদম খারাপ। ফুলই নেই।
তুমি আর একটা ঝাড়ু কিনি দিও, তখন
আমি খাটের তলা টলা সব ঝাড়ি দেবো।’
নন্দিতা বললো, ‘তুমি তো খুব কাজের মেয়েও দেখছি।‘ মুক্তোর মতো দাঁতের একটি পাটি দেখিয়ে সে হাসলো, “এখন
থেকে আর তোমাকে রান্না করতিও দিবো না, আমি রাঁধবো।‘
‘বেশ তো। এখন কী খাবে বলো? সকালে কী খেয়েছো?’
‘সকালে? কিছু
তো খাইনি। সকালে তো ওরা মারিছিল, বকিছিল, চলি আলাম-‘
‘আহা,এখনো খাও নি ? চলো,খাবে চলো। কী খেতে ভালোবাসো ?’ ছোট্টো
খাবার ঘরে এসে টুকটাক টেবিল সাজিয়ে নিয়ে বসলো নন্দিতা। পাশেই ইলেকট্রিক টোস্টারে রুটি ভারতে ভরতে বললো,‘স্টোভ
জ্বালাতে পারো ?”
‘জ্বালবো?”
‘ওই দ্যাখে কেটলিতে জলভরা আছে,স্টোভ জেলে বসিয়ে দাও,জল ফুটলে ঢেলে দাও পটে। তুমি চা খাও
নিশ্চয়ই।’
কমলা লজ্জা লজ্জা হেসে বললো,‘চা আমি খুব ভালোবাসি মা।' ‘সব কথাতে অত মা মা বলছো
কেন?
‘ওই বাড়িতে আমি মাসিমা বলতাম।’
‘তবে আমাকে কেন মা মা করছো?’
‘আমার
মাকে আমি খুব ভালোবাসি। মাকে ছাড়ি আসি কত কাঁদিছি, এখন মনে হতিছে মাকে আবার পেয়ে
গেছি। মাগো তুমি আমার মা হতে চাও না?’
ঢোক গিলে হাসলো নন্দিতা’, ‘কথা শোন মেয়ের। কেন চাইবো না? মা হতে কে না চায় ?” ‘তবে? স্টোভ ধরিয়ে চায়ের জল বসালো কমলা। ফুটলে বেশ নিপুণ হাতে পটে
ঢাললো। টোস্টার থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে টোস্ট উঠতে দেখে ভুত দেখার মতো আঁতকে উঠলো।
দিন দশেক বাদে নন্দিতা যখন কলেজে। আর কমলা যখন চান করে খেতে বসবে, এই সময়ে দরজার বেল বেজে উঠল টুংটাং
করে। দৌড়ে খুলতে গিয়েছিলো,কিন্তু
খুললো না। মা বলে গেছে। 'চট
করে দরজা খুলবে না,বুঝে
শুনে খুলবে।”
এই কদিনে সে সত্যি নন্দিতার মেয়ে
হয়ে গেছে। তার জন্য কত বই এসেছে খাতা এসেছে পেনসিল এসেছে। সুন্দর সুন্দর স্কার্ট
ব্লাউসও এসেছে। নন্দিতা বলেছে,‘অতটুকু মেয়ে এখুনি শাড়ি কী? ফ্রক পরো। সালোয়ার কামিজ কিনে দেবো
পুজোর সময়।’
কমলা বলেছে, ‘ফ্রকই
তো পরতাম। মা বলিছে, আর
ফ্রক না, এখন বড়ো হয়ে গিছো, দিনরাত আঁচল দিয়ে শরীল ঢাকি রাখিবা,নইলে পাজিগুলান তো গিলি খাবে।’ হেসে অস্থির, “মা বলে আমাকে গিলি খাবে। এটা মানুষ
আর একটা মানুষকে বুঝি গিলি খাতি পারে?”
নন্দিতা থামিয়ে দিয়ে বলেছে, “আর
শোন, ওরকম অপরিস্কার হয়ে থাকবে
না, সকালে উঠে ব্রাস দিয়ে দাঁত
মেজে মুখ ধুয়ে মাথা আঁচড়ে তারপর চায়ের টেবিলে এসে বসবে বুঝেছো?’
কমলা এখন নন্দিতার পাশে বসেই খায়।
পাশের খাটে ঘুমোয়। সুন্দর চেহারা আরো সুন্দর দেখায়। নন্দিতা যদি তাকে নিজের
মেয়ে বলে পরিচয় দেয় কোথাও, অবিশ্বাস
হবে না কারো। পোশাক পরিচ্ছদও তার উপযুক্তই। আদব কায়দাও শেখায়। লোকজন এলে হেসে
বলে, ‘পুষ্যি নিয়েছি। ভালো করিনি?’ তারপর বলে, ‘একা
থাকি, মেয়েটা এসে আমাকে ভরে
দিয়েছে।’ সত্যিই ভরে দিয়েছে। কুনাল নেই,সে আছে। কী শূন্যতা। সন্তান হয়নি
বলে কোনোদিন কোন ইচ্ছে কাতর করেনি,কিন্তু কুনাল চলে যাবার পরে অনেকবার মনে হয়েছে একটা থাকলে ভালোই
হতো। সে ইচ্ছেই হয়তো ভগবান পূরণ করে দিয়েছেন মেয়েটাকে পাঠিয়ে। নৈলে সে এসেই মা
বলে ডাকতে চাইলো কেন? কেউ
তো বলে না।
অনেক ইতস্তত করে শেষপর্যন্ত কমলা
খুলেই দিলো দরজাটা। মাকে তো এই রকমই খুলতে দেখে সে। বরং সে যদি খুলতে গিয়ে কে!
কে! বলে চ্যাচায় মা রাগ করে। বলে ওরকম কে কে করো না,ওটা অভদ্রতা। দিনের বেলা ভয় কী? রাত্রিবেলা হলেই আমাকে না ডেকে
খুলবে না।
খুলেই দেখলো তার দালাল দাদা
দাঁড়িয়ে আছে। হাসিমুখে বললো, ‘তুই ও বাড়ি ছেড়ে এসেছিস? বেশ
করেছিস। ভালো খবর আছে।’ কমলা খুশি হয়ে বললে, ‘ভালো খবর? কী
খবর দালাল দাদা ?’
‘তোর মা-বাবা এসেছে।‘
‘মা-বাবা এসেছে? কোথায়? কবে?’ আনন্দে লাফিয়ে উঠলো কমলা।
‘চল, দেখবি।
নিয়ে যাই তোকে।'
‘অখন? অখন
কী করি যাবো?
এখানেও আমি
একজন মা করিছি। মা খুব ভালো। আমাকে কত ভালোবাসিছে, লিখাচ্ছে পড়াচ্ছে,এই দ্যাখো জামা কিনি দিছে,আবার বলিছে গানের ইস্কুলে ভর্তি করে
দিবো। আমি একদিন আপন মনে গান করিছিলাম,মা শুনে বললো,’তুমি এত সুন্দর গান করো,এত সুন্দর গলা, ঠিক
আছে তোমাকে আমি গানের ইস্কুলে ভর্তি করি দিবো। সেই মা কলেজে পড়াতি গেছে। বাড়ি
খালি। আমি তো অখন পারবো না। দাদার হাত জড়িয়ে ধরলো সে, “বিকালে
আসিবা? আমার মন কেমন করতেছে
মা-বাবার জন্য। এই মা কলেজ থেকে আলি আমি জিজ্ঞাসা করি রাখাবো, তুমি নিয়ে যাবা
আমাকে।‘
‘আরে বোকা, তোর মা-বাবা তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে,এখুনি চলে আসবি দেখা করে। কতক্ষণ? দুমিনিট।' ‘রাস্তায়
দাঁড়িয়ে আছে? কই? কোন রাস্তায়? চলো তাদের নিয়ে আসি গিয়ে ঘরে।‘
কমলা বেরিয়ে এলো। দরজাটা টেনে দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নামলো
দাদার সঙ্গে।
কিন্তু সিঁড়ির মুখে এসে দেখলো কেউ নেই। দাদা বললো,‘আরে,এই গলিতে নয়,বড়ো রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছে।” কমলা
চিন্তিত হয়ে বললো, ‘বড়ো রাস্তার মুখে? সেখানে যাতি আসতি তো সময় লাগবে, ঘর যে খোলা রইলো।’
‘কিছু হবে না। এইটুকু সময়ের মধ্যে কী হবে। এখুনি তো ফিরে আসবে।‘
‘না দাদা-’
‘আরে বেশ চল্ চল্ কিছু হবে না।’ প্রায়
জোর করেই দাদা তাকে গলির মুখে নিয়ে এল। ছোট্ট গলি, রাস্তার মুখে আসতে এক মিনিট লাগে
না। দেখা গেল একটি ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে,ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো তার মধ্যে, সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।
কমলা চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েছিলো,মুখে চেপে ধরে শুইয়ে দিলো সিটের
উপর। তারপর কোথায় যে তাকে নিয়ে এল কিছুই সে জানতে পারলো না। আঘোরে ঘুমিয়ে
থাকলো। যখন চোখ খুললো, নিজেকে
একটা ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে আবিষ্কার করে অবাক হয়ে গেল। এসেছিলো দুপুরবেলা, এখন প্রায় সন্ধ্যা। চারদিকে
তাকিয়ে প্রায় হাহাকার করে কেঁদে উঠে বললো,‘আমি
কোথায়?’ একজন বর্ষীয়সী মহিলা মোটা শরীরে
থপ্ থপিয়ে এগিয়ে এসে বললো,‘আ,মোলো যা, একেবারে নেকি। ভাজা মাছটি উলটে খেতে
জানে না। এই রিফিউজি মেয়েগুলোনের ঢং দেখলে মরি আর কি। কয়েকদিনের মধ্যে তো শেষে
নাগর নাগর করে হেঁদিয়ে মরবি। নে, ওঠ, মুখ হাত ধুয়ে সাজ করে নে। সুন্দর
মেয়ে,সুন্দর মেয়ে,বলে তো মিনসে এই কয় মাসে কম টাকা
নিলো না। আজ থেকেই উশুল করতে হবে।’
0 মন্তব্যসমূহ