মুঠিবদ্ধ আঁখের পাতা-মৌসুমী কাদেরের হেমব্রমের উত্তরায়ণ পড়ে- দীপেন ভট্টাচার্য

লেখক কেন লেখেন সেটা যেমন একটা রহস্য, তাঁর বিষয়বস্তু নির্বাচন ততোধিক একটা রহস্য। হয়তো লেখক নিজেই জানেন না তাঁর লেখার তাগিদের উৎস। তাঁর মনে একটা স্ফূলিঙ্গ দানা বাঁধে, অঙ্গারকণা - আগুণ থেকে উৎসারিত, সেই কণায় জারিত হয় একটা বোধ। কিন্তু সেই বোধকে লেখক নিজেই বুঝতে পারেন না, তাঁর মনে সেটা একটা কুয়াশাচ্ছন্ন গঠনহীন আকার। সেই আকারকে সাকার করতে চান লেখক, এখানে তিনি এক শিল্পী - আর্টিস্ট, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে মূর্ত করতে চান ঘটনার অবয়ব। কিন্তু অবচেতন সচেতন যাই হোক না কেন প্রতিটি সৃষ্টিই শিল্পীর অভিজ্ঞতা ও মানসিক গঠনের ওপর নির্মিত। হেমব্রমের উত্তরায়ণের নির্মাণ ঐ দুটি গুণনীয়কের গভীরতাই নির্দেশ করে।

বাংলাদেশে সরকারি তত্ত্বাবধানে সাঁওতালদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা এই দেশের আদি বাসিন্দা, তারা নিগ্রহিত হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা। চিনির কলের জন্য আঁখ লাগবে বলে সাঁওতাল জমি নিয়ে নিয়েছিল সরকার, বলেছিল কল না হলে জমি ফেরৎ দেবে। কল হয় নি, সাঁওতালরা ফিরে এসেছিল পূর্বপুরুষের জমিতে। তাদেরকে স্থানীয় বাঙালী নেতারা আশ্বাস দিলেও পরে পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আগুন দিল সাঁওতাল ছাউনিতে, গুলি চালাল নিরাপরাধ আদিবাসীদের ওপর। দ্বিজেন হেমব্রম এক সাঁওতালী প্রতিরোধী পুরুষ। তার কাছে আধুনিক মারণাস্ত্র নেই, তার পেছনে সামাজিক কোনো শক্তি নেই, তার হাতে তীর-ধনুক যা কিনা আধুনিক অস্ত্রর কাছে অক্ষম, কিন্তু ন্যায় ও সাহসের প্রতীক হিসেবে ভাস্বর। সুদূর কানাডার তুষার নির্ঝরণের মাঝে লেখক মৌসুমী কাদের তাড়িত হয়েছেন সেই অত্যাচারে। এই তাড়না সবার থাকে না। লেখক তাড়িত হন। সংবেদী মন উদ্বেলিত হয়। তিনি শব্দ দিয়ে ভাষা গড়েন, সেই ভাষা আমাদের বলে:

“সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর গেউস আলীর বাড়ির কাছে যে কাচারীঘর তার পাশেই গামছাটা পেতে শুয়ে পড়েছিল ক্লান্ত দ্বিজেন। দুপুর তখন বিকেল হবার জন্য টলছে। ছায়াগুলো নুয়ে পড়েছে। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল সে কি করে এ লড়াইয়ে জেতা যায়।” 

সামান্য চিনিকলের জমিতে তাদের অধিকার বজায় রাখতে এই লড়াই। এই সময়ই আঁখ ক্ষেতে দ্বিজেন আবিষ্কার করে গোপাল নামে আদিবাসী এক ছেলের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহকে, তার হাতের মুঠিতে ছিল আঁখের পাতা - একতার প্রতীক। এরপরে গল্পে হেমব্রম মিলিয়ে যায়, আবির্ভাব হয় কনস্টাবল করিম মুন্সীর। তার চরিত্র হেমব্রমের প্রতিপক্ষ অথচ সমান্তরাল। অসহায় সাঁওতালদের ওপর সে গুলি চালাতে, তাদের ঘরে আগুন দিতে সে অস্বীকার করে। এর পরিণামে এক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা তাকে লাঠির বাড়ি মেরে কান ফাটিয়ে দেয়। হাসপাতালে যেয়ে করিম মুন্সী ডাক্তারকে আর তার সহকর্মী শফিককে ইতিহাসের কথা বলে - আড়াইশ বছর আগে ঝাড়খণ্ডে তিলকা মাঝির বিদ্রোহের কথা। এই বলার মধ্যে সে হয়তো আবিষ্কার করে তার নিজের উৎস - সে সাঁওতাল সিধু মাঝির ছেলে। পুনঃপ্রাণ পায় পুলিশের কনস্টাবল করিম মুন্সী - ফিরে যায় তার শেকড়ে। কাহিনীর শেষে আমরা দেখতে পাই করিম মুন্সী বগুড়া-রংপুর রোড ধরে হাঁটছে, তার গায়ে পুলিশের নীল পোষাক নেই। লেখক আরো বলছেন শফিক ঘুষ খেয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, আমাদের ধরে নিতে হবে শফিক কর্তৃপক্ষকে করিম মুন্সীর আদি পরিচয় বলেছে, এর ফলে করিম চাকরি হারিয়েছে। তবে এখানে পাঠকের স্বাধীনতা আছে তার নিজস্ব উপসংহার সৃষ্টি করার। 

লেখক পাঁচটি অধ্যায়ে পরিণত কথার বাঁধুনীতে ক্রমশ করিম মুন্সীর উত্তোরণকে প্রকাশ করেছেন। যে দ্বিজেন হেমব্রমকে দিয়ে গল্পটা শুরু করেছিলেন সেই দ্বিজেন গল্পের বাকি অংশে আর ফিরে আসে নি। দ্বিজেনকে তিনি ব্যবহার করেছেন এই কাহিনীর প্রেক্ষাপটকে উন্মোচন করার জন্য। এক্জন ডাক্তার - যে কিনা আহত করিম মুন্সীকে সেবা করছিল - তাকে ব্যবহার করেছেন পট-উন্মোচনের হাতিয়ার হিসেবে, কারণ ডাক্তারের কাছে তিলকা মাঝির বিদ্রোহের কথা বলার মধ্য দিয়েই করিম যেন তার আত্মপরিচয় খুঁজে পায়। 

আফ্রিকা থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে বেরিয়ে পড়েছিল আমাদের যাযাবর পিতামহেরা, তারা এই বাংলা পার হয়ে পৌঁছে গিয়েছিল অস্ট্রালিয়া পর্যন্ত। তাদের কেউ রয়ে গিয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। এরপর থেকে বহিরাগতদের আগমনে তাদের দক্ষিণায়ন শুরু। দক্ষিণায়ণ থেকে উত্তরায়ণ। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তর দক্ষিণবিন্দু থেকে উত্তরমুখী যাত্রা হল উত্তরায়ণ। আঁধার থেকে আলোতে। খগোলে অংশুমানের যেমন হয় পুনর্জন্ম, হেমব্রমেরা তেমন প্রাণ পায় মুন্সীদের মাঝে। ভাল লেখা আমাদের ভাবায়, তাই লেখা শেষে এই উত্তোরণে পাঠকও নিজের অজান্তেই পরিবর্তিত হন। তাঁরও উত্তরায়ণ হয়, তিনিও বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সাঁওতাল প্রান্তিক গোষ্ঠীর অসহায় মিথষ্ক্রিয়ায় নিমজ্জিত হন। হয়তো সেই বিক্রিয়ায় খুঁজতে চান আত্মপরিচয় যেমন করে করিম মুন্সী বলে উঠেছিল “আমি কে?” তার মনে পড়ে সে সাঁওতাল সিধু মাঝির ছেলে। পুলিশের নীল উর্দি ত্যাগ করে মুন্সী আঁখের শেকড় ধরে ফিরে গিয়েছিল হাজার হাজার বছর আগের তার মূলে। শুধু ঝাড়খণ্ড থেকে রংপুর নয়, সারা পৃথিবীতে তার বিচরণ ক্ষেত্রে। এই অর্থে কাহিনীটি শুধুমাত্র রংপুরে আদিবাসী অধিকারের সংগ্রাম নয়, বরং এর উত্তোরণ হয়েছে মহাকালের আঙিনায়। বগুড়া-রংপুর রোড ধরে হাঁটে করিম মুন্সী।

“সীমাহীন নীল আকাশ দূরে খয়েরী মাটিতে মিলে গেছে। ঝাপটা বাতাস শরীর থেকে যেন একেকটি আক্রোশ খসে ফেলছে। সেই কবে হেমব্রম রুখা টাঁড় জমিতে আখ পুঁতেছিল, আজ তার বিস্তার ঘটেছে এমন যে কেউ চাইলেই শেকড় উপড়ে ফেলতে পারবেনা।” 

পাঠক কি তাঁর নিজের শেকড় খুঁজে পেয়েছেন? “আমি কে” এই আকুতি কি পাঠকের মর্মে ধ্বনিত হয় নি? সমস্ত ধরণের শ্রেণীবিভাজনের উর্ধে, শাসক-শোষিত নানান অর্থনৈতিক টানা-পোড়েনের সম্পর্কের বাইরে আমরা কি এই পরিচিতি খুঁজতে চাই না। সেই সন্ধানপর্ব আমাকে বিচলিত করে, নিজের সঠিক পরিচয় কে জানে? 

মহাশ্বেতা দেবীর বীরসা মুণ্ডা অরণ্যের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, অরণ্য ছিল মুণ্ডাদের মা। অরণ্যের গাছের আছে দৃঢ় শেকড় আর আঁখের রয়েছে ঋজু গঠন। সেই দৃঢ়তা আর ঋজুত্বর সন্ধানে ভারতীয় উপমহাদেশের সাঁওতাল ও মুণ্ডা, কোল আর ওঁড়াও, ভীল ও হাজংদের হাজার হাজার বছর ধরে বহিরাগতদের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই তারা হেরেছে, হারতে হারতে বিশাল দেশের মধ্যেও কোনঠাসা হয়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। তাই লেখক যখন বলেন ‘’কেউ চাইলেই শেকড় উপড়ে ফেলতে পারবে না” তাতে আমরা আশাবাদী হই, কারণ আমাদের সবার উৎস - মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব - এই আদিবাসীদের কয়েক হাজার বছরের জীবনের অভিজ্ঞতার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিজেন হেমব্রম আর করিম মুন্সী দুজনেই আজ নতুন বীরসা। কিন্তু বাংলাভাষী মানুষ সেই উৎস সম্পর্কে অজ্ঞান, তাদের মানসে এই প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম জনগোষ্ঠীর কোনো অনুরণন নেই, তিলকা মাঝি বা বীরসা মুণ্ডার স্মৃতি নেই। এই গল্পটি বাংলাদেশের সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায় এই গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, তাদের বঞ্চনা ও সংগ্রামকে যেমনভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরে তেমনইভাবে আমাদের আত্মপরিচয় খুঁজতে প্রেরণা দেয়। তাই শেষে বলব মৌসুমী কাদেরের লেখাটি শুধুমাত্র সামাজিক দায়বদ্ধতার অঙ্গারকণা নয়, আমাদের একক ব্যক্তিমানসের পরিচয় উদ্ধারের এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টাও। গল্পটির পরম সার্থকতা এর মধ্যেই। 



--------------------------------------------
মৌসুমী কাদের'এর মূল গল্পটি পড়ুন -
হেমব্রমের উত্তরায়ণ


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ