ফুলঠাকরুণের আসল নাম ফুলেশ্বরী কি ফুলকুমারী অথবা আর
কিছু, সেকথা কেউ জানে না, সে নিয়ে মাথাও ঘামায় না।
ফুলঠাকরুণ,
যার নামে বাঘে
গোরুতে একঘাটে জল খায়। যাঁকে ঘাটে পথে আসতে দেখলে পাড়ার অতি দুর্দান্ত ছেলেরাও
একটু সরে দাঁড়ায়। চণ্ডীমণ্ডপের আড়াধারী কর্তারা নড়েচড়ে কোমরের কষি টাইট করে
পা উঠিয়ে বসেন। আর বৌ-ঝিরা রান্নাঘরে বেড়ার ফাক দিয়েও তার চেহারাটা দেখতে পেলে
অজান্তে ঘোমটাটা টেনে লম্বা করে নেয়।
এই ফুলঠাকরুণ! দশবছরে বিয়ে-এগারোয় বিধবা। তদবধি
ঠাকুমা পিসীর সঙ্গে নির্জলা একাদশী করে এসেছেন, তাদের চালেই চলে এসেছেন। এক কথায়
সেকালের একটি ডাকসাইটে শুচিবায়ুগ্রস্তা দুর্দান্ত বিধবার নিখুঁত টাইপ।
শুচিতার জন্য ফুলঠাকরুণ সাতখানা গ্রামের মধ্যে বিখ্যাত।
বাইরে তার পুকুর আলাদা,বাড়িতে
তার মহল আলাদা। ঠাকরুণের বাপ বেঁচে থাকতেই মেয়ের এই আলাদা মহলের ব্যবস্থা করে
দিয়ে গেছেন। ফুলঠাকরুণ কখনও সুতি থান পরেন না,সর্বদাই মটকা তসর কেটে। সেগুলো ফুটোফাটা
হয়ে গেলে,
রাত্রে শোবার
ব্যবহারে লাগে। ...সে সব কাপড় জীবনে সাবান মাখতে পায় না, রিঠে আর সাজিমাটিই তাদের শেষ
প্রসাধন।
একবেলা এক বার হবিষ্যান্ন, রাত্রে একটু ফল আর মধু। চিনি গুড়ের মত অশুচি জিনিস ফুলঠাকরুণের ভোগে লাগে না। অশুচি নয়তো কি? ‘সত্যিক’ জাতে পাক করে না ?
একবেলা এক বার হবিষ্যান্ন, রাত্রে একটু ফল আর মধু। চিনি গুড়ের মত অশুচি জিনিস ফুলঠাকরুণের ভোগে লাগে না। অশুচি নয়তো কি? ‘সত্যিক’ জাতে পাক করে না ?
ফুলঠাকরুণের কাছে একটি মাত্ৰ লোকের প্রশ্ৰয় আছে, সে হচ্ছে তার ছোট ভাইঝি দুগগা।
...দুর্গার বয়সের পক্ষে অবশ্য তার নামটা সেকেলে, নামকরণের সময় দুর্গার মায়ের ছিল
সকরুণ। আপত্তি। কিন্তু ফুলঠাকরুণ রায় দিয়েছিলেন ‘আমার
বাপের ভিটেয় আমার দেওয়া নামই বাহাল থাকবে। যে তাতে রাজী নয় সে মেয়ে নিয়ে
নিজের বাপের ঘরে থাকুক গে!” অগত্যা দুর্গ নামই বহাল।
দুর্গ ইদানীং বড় হয়ে তর্ক তোলে পিসীর সঙ্গে, বলে, “আচ্ছা
পিসী, ঠাকুর যে চিনির সন্দেশ খান
গুড়ের বাতাসা খান?” পিসী তাচ্ছিল্যাভরে বলেন, “খাক
গে! লুভিষ্টে দশা, যে
যা দেয় খেয়ে মরেন।”
“আর এই যে তুমি ঠাকুরের
পেসাদ খেলে না, তাতে
তোমার পাপ হল না?” “পাপ
আবার কিসের লা? চরণ-তুলসী
খাই না দুবেলা? মণ্ডা
মেঠাই দিয়ে ঠাকুরের ভোগ সাজানো তো শুধু মানুষের জিভের লালস মেটাতে! ঠাকুর কি
বলেছে-সকাল থেকে উঠে খালি আমার বাহান্ন
ভোগের যোগাড় কর?”
দুর্গাঁও ছাড়বার পাত্রী নয়, সে ফুলঠাকরুণেরই ভাইঝি। সে বলে, “পিথিবীসুন্ধু
লোক তবে করছে কেন?”
“পৃথিবীসুন্ধু লোক কি না
করছে? হাতে করে বিষ খাচ্ছে, হাতে করে আগুন খাচ্ছে। আমাকেও খেতে
হবে তাই?"
নিরক্ষর ফুলঠাকরুণ, ওঁর নামে রাখা “কোম্পানির
কাগজ"-এর সুদের টাকা মনিঅৰ্ডার
এলে টিপ-সই করে টাকা নেন, তিনি
সারা পৃথিবীর সমগ্র মানব-সমাজের বোকুবির উদাহরণ দিয়ে নস্যাৎ করে দেন তাদের। ...
মনিঅৰ্ডারের ওই টাকার ব্যাপারেও একটা মজা আছে। তিনমাস অন্তর বারোটা করে টাকা, পিয়ন রামেশ্বর জানে—যে
কোন উপায়ে ও টাকাটা তাকে কাগজের নেট থেকে রৌপ্য মুদ্রায় পরিণত করে তবে ফুলঠাকরুণের
কাছে নিয়ে যেতে হবে। কাগজের নেট ফুলঠাকরুণ কড়ে আঙুল দিয়েও ছোন না। রুপোর টাকা
দাওয়ায় ফেলিয়ে গঙ্গাজল দিয়ে তুলে নেন। ...কিন্তু সে যাক ফুলঠাকরুণের সমস্ত
আচরণের ফিরিস্তি দিতে গেলে তো অষ্টাদশ পর্বেও কুলোবে না!
তবে আন্দাজ করা যাচ্ছে-ফুলঠাকরুণ এই!
সেই ফুলঠাকরুণের বাড়িতে এক বিপত্তি। রাতে গেছে দারুণ
জলঝড়। ঘরের ছাত নেমে আসে এমন অবস্থা। কত গাছ পড়ল, কত গোরু, ছাগল মরল তার ইয়াত্তা নেই।
...ভোরের দিকে একটু ছেড়েছে। ফুলঠাকরুণ। ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কোথায় কি ক্ষতি
অপচয় হয়েছে,
তারই তদারক
করতে বাগানের দিকে যাবার দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। ফুলঠাকরুণের সারা বছরের
কাঠ ঘুটে রাখতে ছোট-মতন একটা চালা আছে,-বিশুদ্ধ ঘুটে কাঠ—সেখানে কারও হাত চলে না। তারই
কপাটের আগলটা পড়েছে ভেঙে আর সেই দোরের ভেতরে গুটি-সুটি মেরে শুয়ে আছে একটা
ছোট-লোক মাগী,কোলের
কাছে কেন্নোর মত একটা ছেলে! একেবারে ছোট্ট ছেলে। ঘর-দোর অপরিস্কার করেছে তাতে আর
সন্দেহ কি! দোরের কাছে যে জল থই থই করছে,সেটা বৃষ্টির জল না। আর কিছু তাই বা কে জানে!
রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল ফুলঠাকরুণের। এ কী স্পর্ধা!
মরতে আর জায়গা পেল না? ক্রুদ্ধস্বরে
হাঁক দিলেন,
“এই, এই
মাগী! কয়ে তুই?’
ধড়ফড় করে উঠে বসে মেয়েলোকটা। ছেড়া আঁচলের কোণটুকু
টেনে ছেলের গায়ে ঢাকা দিতে দিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়।
“হয়েছে! আর গুছিয়ে গাছিয়ে
ছেলেকে শোয়াতে হবে না, বলি
কে তুই?”
মেয়েটা কেঁদে ফেলে দেহাতী টানে যা বলে তার অর্থ-সে
নিতান্ত দুঃখিনী,তিন
কুলে কেউ নেই,
ক্ষেত-খামারে
উদ্ধৃবৃত্তি করে পেটটা চালায়! কাল দলের সঙ্গে বেরিয়েছিল, হঠাৎ ঝড় ওঠায় এলোমেলো হয়ে ছিটকে
পথ হারিয়ে ফেলেছে। বড় দুঃখিনী সে। নাম খুদুর মা। ফুলঠাকরুণ বিরক্তস্বরে বলেন,"দুঃখী, সেকথা কি আবার ঢেঁড়া পিটিয়ে
জানাবি নাকি?
চোখে দেখতে
পাচ্ছি না?
বলি তিন কুলে
কেউ নেই তো-ওই ছেলে কার লা হারামজাদি?”
খুদুর মা আবার একচোট কাঁদে,"ওই আমার খুদুর চেন্ন মা ঠাউন! এই
চৈত্তিরে জুর-বোকারে গেল খুন্দু, ছেলেটাকে
আমিই বুকে করে—”
ফুলঠাকরুণের ভুরুর কুঞ্চনটি কিঞ্চিৎ মসৃণ হয়, কিন্তু কণ্ঠস্বর মসৃণ হয় না। বিকৃত
কণ্ঠে বলেন,
“কেন ওর বাপ নেই? জামাই?"
"এই বোশেকে আবার বে করেচে। মা ঠাউন।”
'মাথা কিনেছে! বলে আপনি খেতে ভাত পায় না, শঙ্করাকে ডাকে!! ...এখানে থাকা-টাকা
চলবে না বাপু,পথ দেখ গে৷”
“এই বাদলবিষ্টিতে কোথায় যাই
মা ঠাউন? আকাশ-দ্যাবতার চ্যাহারাখানা
দেখতেছ? আজকের দিনমানটা এক ফোটা
আশ্রয় দাও।”
“দিনমানটা দেব। আর ‘আত্তির
কালটা” কোথায় যাবি রে মাগী ? তখন নড়তে চাইবি? যা যা, ওসব আদিখ্যেতা চলবে না। পাড়ায় আরও
ঢের মেলোচ্ছবাড়ি আছে,সেখানে
যা। আর ঠাই পায় নি, মরতে
এসেছে আমার বাড়ি!! আর কিনা আমারই মাথা খেতে এর ভেতরে ঢুকেছে গা! এই বর্ষায় সারা
বছরের ঘুটে কাঠ মজুত ছিল-ছিষ্টি গেল!”
খুদুর মা শঙ্কিতভাবে বলে,“আমি
তো উদিকে যাই নি মা ঠাউন। সুন্দু এই দুয়োরের খোলটুকুনের মন্দ্যি-”
“থাম থাম! ওই চৌকাঠ ডিঙোলেই
আমার সব যায়! এ কি তোদের মত ছোটলোকের ঘর? শোন,ভাল চাস তো বিদেয় হ। আর কোথাও
থাকগে যা, দুপুরে বরং এখানে এসে
দু-মুঠো ভাত গিলে যাস। গিলে আর যেতে হবে না; একখানা মাটির শানকি-ফানকিতে দেব, বাইরে কোন চুলোয় নিয়ে গিয়ে খাবি।
কোথাকার পাপ কোথায় মরতে এসেছে!’
হাঁ, এই
রকমই সভ্য মার্জিত ভাষা ফুলঠাকরুণের। আজীবন এই ভাষাতেই কথা কইতে অভ্যস্ত তিনি।
খুদুর মা আর ভরসা পায় না।
ছেলেটাকে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তবু আবার বিনীতকণ্ঠে
শেষ আবেদন জানায়-“একটা
বেলাও যদি আছ্রয় দেন! ঘরে ঢুকব নি, এই-ছ্যাঁচের কোলে পড়ে থাকব। জ্বরে কাঠ ফাটতেছে
ছোড়াটা!”
ফুলঠাকরুণ এক মুহুর্ত চুপ করে থেকে তিক্তস্বরে বলেন-“আচ্ছা ‘নেই
আঁকড়া’ মাগী তো! সক্কালবেলা কি পাপা! থাকবি
তো এই একটা বেলাই থাকবি, সন্ধ্যের
আগে বিদেয় হবি। রাতে-ফাতে থাকা চলবে না।”
“তাই তাই। কোথায় তা হলে
ছাওয়ালটাকে শোওয়া করাব, মা
ঠাউন ?”
“কোথায় আর! আমার মাথায়!
ঘরটার দফা তো খেয়েইছিস, থাক
ওখানেই থাক।”
ইত্যবসরে ছোট ভাজ উঠে এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে। এবং
ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে কাঠ হয়ে চুপ করে আছে। ফুলঠাকরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, “শুনিলি
তো ছোট বৌ?
আবদার দেখছিস? নাও,এখন ওর গুষ্টির পিণ্ডি রাঁধ। বলে-ছোঁড়াটার নাকি আবার জ্বর হয়েছে। মিছে কথা! মায়া কাড়ানোর ছল !
মরুক গে-দুধ যখন জ্বাল দিবি মাটির ভাড়ে করে এক ফোঁটা দিয়ে যাস। দুগগা দুগগা।”
এ দুগগা ভাইঝি দুগগা নয়, দেবী দুর্গা।
এক বেলা বলে তিন বেলা! বৃষ্টির বিরাম নেই। নিচু চালা,ধারটা হাত দেড়েক বাড়ানো,তবু দরজার কাছে জলের ছাট ঢোকে। নিরুপায় খুদুর মা ফুলঠাকরুণের
অসাক্ষাতে,
দুগগার কাছে
চারটি খড় চেয়ে নিয়ে নাতির বিছানার সাধ মিটিয়েছে। ঢুকেও যেতে হয়েছে একটু ভিতর
দিকে।
ঘাট থেকে স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে আসতে
ঘরের দরজায় উকি দিলেন ফুলঠাকরুণ। দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। জলে থই থই করছে দোরের
সামনেটা,একটা কাদার গর্ত সৃষ্টি
হয়েছে বললেই হয়। ডিঙোনোর চেষ্টা বৃথা। ছেলেটাকে একলা ফেলে গেছে কোথায় মাগী, ঘাটে মাঠে নিশ্চয়! কোন কালে আসবে
কে জানে! আক্কেল দেখ! আদিখ্যেতা করে বলা হচ্ছে আজ তিনদিন ছেলে জ্বরে কাঠ ফাটছে!
সত্যিই বটে...যুমোচ্ছে যেন মড়া! অথচ শোওয়ানোর কি ছিরি। ভিজে ঢোল চারটি খড়ের ওপর
একটু ময়লা কানি পেতে শুইয়েছে, গায়ের
ঢাকাও তদ্রুপ! একখানা কাঁথাও জোটে না গা! তবু এসব ঘরে মা ষষ্ঠীর দয়ার বিরাম নেই।
গলায় দড়ি। নিঃশব্দে সরে এলেন ফুলঠাকরুণ,এসে চুপি চুপি ঢুকলেন নিজের শোবার
ঘরে। ছেঁড়া-ছাঁড়া-মত কেটে কাপড় একখানা রয়েছে, র্যাপারের টুকরোও রয়েছে তোরঙ্গর
ওপর ঢাকা দেওয়া। বালিশ? বালিশ
না কচু, ভারি রাজপুত্তুর এসেছেন।
মরুক গে,এই‘পাটালী
যেন” পাতলা
বালিশটা, প্রায় ছিড়েই এসেছে-বদলাব বদলাবই করছিলেন-দিয়ে দেওয়া যাক আপদকে। জিনিস কটা তুলে নিয়ে
চুপি চুপি উঠোনে নামেন ফুলঠাকরুণ। এগিয়ে যান ঘুটের ঘরের দিকে।
ধীরে ধীরে সন্তর্পণে ছেলেটাকে তোলেন,পাছে কেঁদে উঠে পাড়া রাষ্ট্র করে!
গুছিয়ে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকান কেউ
দেখে ফেলে নি তো? নাঃ,ভগবানের দয়া!
আর একবার স্নান করতে ঘাটে যেতে হবে। দ্বিতীয়বারের
স্নানের কারণ কেউ জিজ্ঞেস করলে উত্তরটা কি দেবেন, তাই ভাজতে ভাজতে এগোতে থাকেন
ফুলঠাকরুণ।
0 মন্তব্যসমূহ