ফিরতে ফিরতে দশতা বেজে গেল। সক্কলের আগে দুটো ফোন করতে হবে। ফেরবামাত্র। একটা খোকনের বাড়িতে, ওর দাদুঠাকুমাকে জানিয়ে দিতে হবে যে খোকন আজ বাড়ি ফিরবে না। বাপি, খোকন দুজনেই হাসপাতালে রাত কাটাবে; বাচ্চুকে হসপিটালে রিমুভ করতে হয়েছে। বাচ্চুর অবস্থা ভাল নয়, লোক চিনছেনা, দারুণ রাইগর হচ্ছে। ডাক্তারবাবু বাড়িতে রাখতে ভরসা পেলেন না। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে মেজ জামাইবাবুর থ্রু দিয়ে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এলুম এইমাত্র। বাচ্চু বাপিদের সঙ্গে পড়ে, হোস্টেলে থাকে। জ্বর বাড়তে বাপি ওকে এ-বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু এখানে রাখলে চলবেনা। ডাক্তারবাবু ভয় পাচ্ছেন। জেনারেল ওয়ার্ডে রেখেও শান্তি নেই। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করানোর চেষ্টা করছেন। খোকনের দাদুকে ফোন করে দিয়েই ভক্তিব্রতঁ মেসোমশাইকে ফোন করতে হবে। অতবড় ডাক্তার মেসো নিশ্চয়ই কিছু না কিছু করতে পারবেন। হার্টের অবস্থা নাকি অস্বাভাবিক, প্রেসার অবিশ্বাস্য নিচে নেমে গেছে। বাপির বন্ধু, বয়স কত হবে আর? এই উনিশ-কুড়িই হবে। অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাবার সময় পালস ছিল না। বাচ্চুর আবার কলকাতায় কেউ নেই। লোকাল গার্জেন এক জামাইবাবু, তিনি নামেই লোকাল, থাকেন বিরাটিতে। আরে মাসের মধ্যে পাঁচ দিনই কাটান ট্যুরে। দিদিটি গিন্নিবান্নি গাঁইয়া মানুষ। খবর শুনে কেবল কেঁদেই ভাসাচ্ছেন!-জামাইবাবু এখন ট্যুরে। সবটা দায়িত্ব বন্ধুদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। তারাও তো ছেলেমানুষ। দেখি, ভক্তি মেশোকেই ধরতে হবে। রাত দশটার পরেই সেটা সুবিধে। আমিওতো খুব একটা এক্সপার্ট কেউকেটা নই, চাকুরে-মেয়ে বলে খানিকটা হালু-চালু, এই পর্যন্ত। ঠিক এই সময়টায় পাঁচদিনের জন্য দুর্গাপুর পাঠিয়েছে ওকে, -কী যে করি! খোকনের বাবা-মাও আপাতত দিল্লিতে, বাড়িতে কেবল বুড়োবুড়ি-দাদুঠাকুমা। খোকনের বাড়িতে ফোন করতে চেষ্টা শুরু করি-ওঁরা নিশ্চয়ই খুব উদ্বিগ্ন। খবরটা না দিলেই নয় যে নাতি আর রাত্রে ফিরবে না।
ডায়ালের চেষ্টা করতেই বুঝলাম লাইনে জট। তোলবামাত্রই এক ভদ্রলোক বললেন-‘ফোরয়েট সিক্সয়েট জিরো টু ত্রি?’ আমি বললুম-‘না। রং নাম্বার। ছেড়ে দিন।’ নামিয়ে রেখে আবার তুলে ডায়াল করি। আবার -‘ফোরয়েট সিক্সয়েট স্যরি, ফোরসিক্সয়েট সিক্স জিরো টু ত্রি?’
মনে অসহ্য উদ্বেগ তায় এই ইন্ডিসাইসিইভ আ্যপ্রোচ টু লাইফ অ্যাগু ফোন নাম্বার্স-ভয়ংকর রাগ হয়ে যায় আমার। বললুম-‘আগে মনস্থির করুন তো দেখি? ঠিক নম্বরটা বেছে নিন। আসলে কোনটা চান?’ বলেই খেয়াল হলো, ভদ্রলোক সাতটা ফিগার বলেছেন। ফোন নম্বরে সাতটা সংখ্যা তো হতেই পারে না। স্বগতোক্তি করে ফেলি, -সাতটা ফিগার বলছে পাগল নাকি?’ গুরুগম্ভীর আরেকটা তৃতীয় গলা এবার ফোনের মধ্যে গুমগুম করে ওঠে।–‘ছেড়ে দিন দিদিমণি, পাগল নয়, ও ম্যাড্রাসী মাতালের কাগু।’
-আজ্ঞে কী বললেন?
-বলচি-ওসব মাড্রাসী মাতাল। ওদের কিচু জ্ঞানগম্যি আচে? বিশমিনিট ধরে এই চালাচ্চে।একেকটা নম্বর। আপনি ত এইমাত্তর লাইনে এয়েচেন।
আসামের সাম্প্রতিক কীর্তিকলাপের কল্যাণে আমি এখন দারুণ সর্বভারতীয়। উদার জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ প্রানী। প্রচন্ড ভীতি জন্মেছে, বুকের মধ্যে টের পেয়েছি প্রাদেশিকতা মহাপাপ। কোমর বেঁধে লেগে পড়ি-এই মদ্রদ্বেষীকে শায়েস্তা করা দরকার।
-‘কয়েন, বাঙালী মাতালদের বুঝি জ্ঞানগম্যি থাকে? তারা মাদ্রাজী মাতালদের চেয়ে উন্নত জীব?’
-আঃ হা কী মুশকিল! সব মাতালই যাচ্ছেতাই, সব মাতালই পাবলিক নুইসেন্স। কি বাঙালী কই ম্যাড্রাসী।তবে মাদ্রাজী মাতাল আরো খারাপ। গম্ভীরভাবে উচ্চারণ করেন তিনি। আমিও খেপে যাই-
-‘কেন কেন? শুনি?’
-কেননা ইদিগে তারা মাছ মাংস খাবেনা, অথচ উদিগে মদ খাবে-ধাতে সইবে কেন? নিরিমিষ্যি সাত্ত্বিক আহারের সঙ্গে ওসব রাজকীয় পানীয় চলেনা, বুইলেন? কতায় বলে, ‘মদ্যমাংস’! মদ্য সইতে হলে মাংস চাই, প্রোটিন চাই-গায়ে বল চাই! এই রে, সাত্ত্বিক-রাজসিক কী সব লজিক্যাল ইনকনসিস্টেন্সি দেখাচ্ছে। কিন্তু মূল বিষয় যখন প্রাদেশিকতার গন্ধযুক্ত, তখন যুক্তি মানেই দুর্যুক্তি। অ্যাবসার্ড অথবা সাউন্ড-কোনওপ্রকার যুক্তিতেই প্রাদেশিকতাকে সাপোর্ট করা যায়না। অতএব ইতিহাস থেকে উদাহরণ খুঁজতে থাকি, কোথায় ভেজিটেরিয়ানরা বলশালী ছিল?-ডাইনোসর? –বৌদ্ধরাজরা?-‘হিটলার’!
-কেন মশাই, হিটলার তো নিরামিষ্যি খেত, সে কি শক্তিমান ছিল না?
-না। সে ছেলো অত্যেচারী। বলবান হওয়া আলাদা জিনিস। তাছাড়া সে ব্যাটা মদও খেত না। তাছাড়া সে ম্যাড্রাসীও ছেলোনা, ছেলো কি?
-মাদ্রাজী এত অপছন্দ কেন আপনার?
-কে বলচে? ম্যাড্রাসী ভাড়াটের মতন ভাড়াটে হয় না। বসের মতন বস হয় না। তাছাড়া ইলেকশন থেকেও তো বুইতে পাচ্চেন, ম্যাড্রাসের হাতেই ইনডিয়ার ফিউচার, ওরা সব টক দই খেয়ে মাথা ঠান্ডা মাথায় ক্লিয়ার ব্রেনে করেক্ট পলিটিক্যাল পয়েন্টগুলো দেকতে পায়। বুয়েচেন? সাধে কি আমাদের মাদ্রাসী প্রেসিডেন্ট, মাড্রাসী বিদেশমন্ত্রী, ম্যাড্রাসী অর্থমন্ত্রী?
-কিন্তু ওঁরা সবাই তো ম্যাড্রাসী নন, দুজন অন্ধের লোক। -ওই একই হলো। দ্রাবিড় কালচার। বিন্ধ্যের ওপার। ম্যাড্রাসী মানে কি ম্যাড্রাসের লোক? ম্যাড্রাসী মানে সাউথ ইনডিয়ান। ইন্ডলি-ধোসাকে কী বলবেন? ম্যাড্রাসী খাবার। সেটা কি কেবল ম্যাড্রাসেই খায়? না হােল সাউথ ইণ্ডিয়া ?
-হ্যাল্লো, সিকসয়েট ফোরয়েট-স্যারি, —ত্রিয়েট ফোরয়েট সিকস জিরো টু?--দ্বিধা-জড়িত প্রশ্ন আসে। আমনি ধমক!
-“আঃ। এগেন ডিস্টার্বিং ? পুট ডাউন রিসিভার। গো টু বেড। স্লীপ! গিভিং অল রং নাম্বার্স আনাডারস্ট্যাণ্ড ? নো সেভেন ফিগার নাম্বার ইন ক্যালকাটা। প্লিজ ডিসকানেক্ট। যত্তোসব ইয়ে-ইঃ।”
-য়োকে য়োকে, স্যারি টু ডিস্টার্ব ইউ স্যার, গুড় য়িভিনিং টুয়্যইয়ল- সবিনয়ে ফোন নামানোর শব্দ হয় - আমিও সগৌরবে ঘোষণা করি-দেখলেন কত ভদ্র ? দ্রাবিড় কালচার বাংলার চেয়ে ঢের উন্নত কালচার।
-ওই এক মিনিট। এক্ষুনি আবার তুলবে। মাতালের আবার কালচার। ছিঃ। হঠাৎ আমার খেয়াল হয় ফোনটা তো করা হচ্ছে না খোকনের দাদুকে ? একি কাণ্ড; আমিও কী মাতােল? ব্যাকুল হয়ে বলে উঠি
-আপনিও এবারে ফোনটা প্লীজ একটু নামিয়ে রাখুন, আমাকে খুব জরুরী একটা কল করতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে। -আমারও খুব জরুরী। আপনিই নাবিয়ে রাখুন। আমি লাইনে এইচি আপনার ঢের আগে। —প্লীজ ! আমি দু’মিনিটে সেরে নেব। -মেয়েছেলের ফোন দুমিনিটে সারা হবে? হাসালেন।
-এটা সেরকম ফোন নয়। একটি ছেলেকে এইমাত্ৰ হাসপাতালে ভর্তি করে এসেছি। সেই সম্পর্কে খবর দিতে হবে- সত্যিা সত্যিা ভীষণ আর্জেন্ট- বিশ্বাস করুন-আমার গলা আটকে যায়
-ঠিক আচে ঠিক আচে বুজিচি বুজিচি- খটাশ করে ফোন ছাড়ার শব্দ হয়। আঃ বেশ ভদ্রলোক তো ? এই তো ডায়ালটোন! সযত্নে খোকনদের নম্বরটি ঘোরাই। -হ্যাল্লো!
- সেই গুম গুম আওয়াজ।
-আঃ! আপনি কেননা ধরলেন ?
-ধরলুম কেন? আমার ফোন রিং করচে বলে- ।
-ওঃ-ছাডুন, ছাডুন, আপনি না ছাড়লে।
-ছাড়চি। ছাড়িচি। আমি কী ইচ্ছে করে বাগড়া দিইচি নাকি? ভালো ঝঞ্ঝাটেই পড়িচি বাপু। নিন মশাই করুন আপনার ফোন। বানাৎ করে রিসিভার নামানোর শব্দ হয়। আবার ডায়ালটোন। খোকনের নম্বর ঘোরাই। দু’বার রিং করতেই-
হ্যালো
-ফোর টু টুটি থ্রি টু?
-এখনো পাননি বুঝি?
-আঁ? আবার আপনি? ধুত্তোর ছাই
-এ লাইনদুটো জড়িয়ে গ্যাচে মনে হচ্চে
- ওটা আপনি আজ আর পাবেন না বোদায়
-পাই না-পাই আপনাকে ভাবতে হবে না! আপনি আগে নামিয়ে রাখুন তো?
-বিনাবাক্যে ওদিকে শব্দ হয়
-কটাস। ডায়ালটোন। ডায়াল করি
-হ্যাল্লো
-একটা সুদূর’শব্দ আসে এবার।
-হ্যালো,খোকনের দাদু বলছেন? দাদু নমস্কার। আমি বাপির বউদি। আমাকে চিনতে পারছেন তো?
-নমস্কার। তা আর পাচ্চিনি? খুব পাচ্চি চিনতে। রাগ করবেন না যেন বিউদিদি,আমি-ইন অ্যাডভারট্যান্টলি-আঁ? আবার আপনি?”এখনো লাইনে আছেন?
-মোটেই নেই। ফোন বেজেচে,রিসিভ করিচি। আর বলতে হবে না,ছেড়ে দিচ্চি।
-শুনুন, শুনুন, এবারে বাজিলেও রিসিভ করবেন না।
-তা কখনো হয়? আমি রিসেপশনিস্ট। ফোন-ধরা-ফোন করাই আমার কাজ।
-এই রাত সোয়া দশটার সময়ে কোন আপিসে রিসেপশনিস্ট বসে থাকে জানতে ইচ্ছে করে?
-কোনো আপিসেই নয়। আপিসগুলো বেলা পাঁচটার পরে মহাশ্মশান।
-তাহলে?
-আমি তো হোটেলে চাগরি করি। আটাশ বছর ধরে এই হোটেলে চাগরি কচ্চি। নাইট ডিউটি। মানে টেন-টু সিক্স ফুলশয্যে। অথবা কণ্টকশয্যে। যাই বলুন।
-অ! তা দয়া করে খানিকক্ষণ অন্তত ফোন ধরবেন না। আমি খবরটা দিয়ে নিই? খুব আর্জেন্ট।
-না ধরলিই বা কী? বাজচে তো এখেনে। খোকনের দাদুর বাড়িতে তো যাচেই না। বুয়েছেন? জট পাকিয়ে গাচে লাইনে। কী খবরটা কী?
-আর বলবেন না একটি ছেলেকে হাসপাতালে
-ভর্তি করে এয়েচোন। তা তো শুনলুম। কেন্সটা কী? মিনিবাস ?
-না না। ভীষণ জুর বিকার
-এনকেফালাইটিসের আশঙ্কা
-সেই খবরটা খোকনের দাদুকে দিতে হবে? যে আপনারা খোকনকে হাসপাতালে ভত্তি করে এয়েচেন ?
-না না, খোকনকে নয়। বালাই যাট। বাচ্চুকে। কিন্তু খোকন আজ রাত্তিরে ফিরবে না,ওরা সব বন্ধুরা মিলে হাসপাতালে রাত জাগবে
-সে খবরটা বুড়োবুড়ি দাদুঠাকুমারা তো উদ্বেগেই
-অ! বাচ্চু কে! কিন্তু আজগে ফোনে তো পাবেন না! বাড়িতে খবর দিয়ে আসার মতন কেউ নেই?
-কোথায় আর ? উনি দুর্গাপুরে গেছেন অফিসের কাজে,দেওর তো নিজেও হাসপাতালে রাত জাগছে। আছি কেবল ননদ আর আমি।
-আই সী। একমুহূর্ত গভীর নৈঃশব্দ্য। তারপর-
-খোকনের বাডিটা কোতায় ?
-যোধপুর পার্কে। অনেক দূর।
-আপনি ঠিকানাটা দিন দিকিনি। খবরটা যদি পৌচে দেয়া যায়, দেকি চেষ্টা করে।
-আপনি দেবেন? আপনি এখন কোথায়?
-শ্যালদায়। এ হোটেলটা শ্যালদা ইসিটশনের কাচে।
-পাগল নাকি? কোথায় শেয়ালদা কোথায় যোধপুর পার্ক! এত রাত্তিরে - --রাত বেশি হয়নি তো,স' দশটা মোটে। ট্রামবাসী চলচে। দেকি কোনো ছোড়াফোঁড়াকে পয়সা দিয়ে যদি পাঠাতে পারি - দিন ঠিকানাটা দিন
-না না ওসব পাগলামি ছাডুন। আমি বরং দেখি সামনের বাড়ি থেকে যদি ফোন করা যায়! আমাকে তো আরো গোটা দুই মেসেজ দিতে হবে কি না?
-কি ? রিলাই কত্তে পাচ্চেন না। না ?
-না না, তা কেন? আপনার কাইনড অফারের জনা অনেক ধন্যবাদ। সত্যি বলছি। দেখি, যদি- না পেরে উঠি তখন হয়তো..
সামনের বাড়ির কাকাবাবু-কাকীমা খুব ভালো লোক। প্রায় শুয়ে পড়েছিলেন,ভাগ্যিস আর দেরি করিনি। যাক একবারেই লাইন মিলে গেল। খোকনের দাদু-ঠাকুমা সত্যিই খুব ভাবনায় পড়েছিলেন। একটা ডিউটি চুকলো। নেক্সট ভক্তিব্রত মেসোমশাই।। তাকেও পাওয়া গেল এক ডাকেই। সব শুনে বললেন- ‘দাঁড়া, দেখি যদি দাশগুপ্তকে পাই, নইলে মণ্ডলকে ধরতে হবে। আমি একটু পরেই ফোন করে তোকে জানিয়ে দেব কদ্দুর কি পারা গেল।’ ফোন ছেড়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলুম। ফিরেই মনে পড়ল-ফোন করে জানিয়ে দেব’মানে ? ফোন তো নষ্ট। ফোন তো জটপাকান। শেয়ালদার সেই হোটেলের সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা। ওদিকে সামনের বাড়ির আলো নিবে গেছে।
আবার গিয়ে বুড়োমানুষদের তুলে বিরক্ত করা যায় না। কাকামা অসুস্থ মানুষ। এখন কী করি ?
এদিকে আমাদের ফোনে তো সমানেই নানাবিধ অশরীরী শব্দী- দেয়ালাকরা শিশুর আধোফোটা হাসিকান্নার মত- আধো আধো ক্রিরিরিং.রি.রি.রিং হচ্ছে তো হচ্ছেই। হঠাৎ লক্ষ্য করলুম তিনবার করে বাজছে। আশ্চর্য তো,বাজা উচিত ছ’বার করে। ছোট ননদ রিংকুটা সদ্য কলেজে ঢুকেছে,অংকের পোকা,চটপটে বুদ্ধি খেলে মাথায়, বললে- ‘ও বৌদি, নির্ঘাত সেই ভদ্রলোক ওয়ান নাইন নাইন ঘোরাচ্ছেন এবার।
-দেখই না ফোনটা তুলে।’
ফোন তুলতেই - হ্যালো, ট্রাংক বুকিং?
-আজ্ঞে না।
-তবে ? ওয়ান নাইন নাইন ?
-আজ্ঞে তাও না। আমাকে চিনলেন না? আমি সেই যে বাপির বউদি।
-ওঃ হো, আর আমি সেই শ্যালদার-
-আজ্ঞে বুঝেছি।
-আপনি কি পারলেন যোধপুর পার্কে খবরটা দিতে?
-হ্যা হ্যা, সেটা হয়ে গেছে। সামনের বাড়ি থেকে। থ্যাংকইউ।
-যাক বাঁচা গেল। এবার ছেড়ে দিন।
-আপনি এত রাত্তিরে কোথায় ট্রাংক বুকিং করছেন?
-আর বলেন কেন? হোটেলের চাগরি। বুক কচ্চি একটা ডিল্লির কল।
-ও বাবা। দিল্লি ? তাহলে আর ভদ্রতাটা রেসিপ্রোকেট করা গেল না! স্যারি।
-তার মানে?
-মানে, আপনি তো যোধপুর পার্কে গিয়ে আমার মেসেজটা দিয়ে আসতে চেয়েছিলেন? আমি কিন্তু তার রিটার্ন দিতে গিয়ে আপনার মেসেজটা দিল্লি পৌছে দিতে পারছি না! এই আর কি!
গম্ভীর গলায় সীরিয়াস উত্তর হয় - না না, তা কী করে হবে। সে তো সম্ভবই নয়। তারচে,আপনি বরঞ্চ ফোনটা ছেড়ে দিন। তাহলেই হবে। এখন রিং,শুনলেও ধরবেন না কিছুক্ষণ।
-তা কেমন করে হবে? আমি যে একটা ডাক্তারের কল এক্সপেক্ট করছি। ছটা টুংটাং বাজলেই আমি ধরব। তিনটে বাজছে শুনলে বরং আর ধরব না। আপনি চেষ্টা করুন -বলে আমি রেখে দি।
-টুং-টাং-টিং, ক্রিং-ক্রাং ক্রিং চলতেই থাকে। যেন আধোম্বুমে-আধো জাগরণে নিশি-যাপন করছে টেলিফোন। আমরাও ঘুমোতে পারি না। রিংকু আর আমি খাটে শুয়ে জেগে থাকি,ওই বকমবাজ ডিলিসিয়াস ফোনের পাশে। কী জানি,যদি ফোনটা এসে যায় ? হঠাৎ রিংকুর মস্তিষ্কে এক বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল।
-বৌদি, এক কাজ করলে হয় না? ভক্তি মেসো যতবারই ফোনের চেষ্টা করবেন,প্রত্যেকবার তো শেয়ালদার ওই ভদ্রলোককেই পাবেন? ওই নম্বরেই যাবে নিশ্চয়ই আমাদের সব ফোন। ওদের কলগুলো,ফোন এখানে বাজছে। ওকেই বল না কেন,‘রং নাম্বার’ বলে নামিয়ে না। রেখে বরং আমাদের মেসেজটা নিয়ে রাখতে?
-আইডিয়াটা মন্দ নয়। খাসা,কিন্তু একজিকিউট করবি কেমন করে? ভদল্লোককে পাব কোথায় ?
-কেন ট্রাংক বুকিং ঘোরাও। এই তো তিনটে করে রিং হচ্ছে। ঠিক কানেকশন হয়ে যাবে। গোরো বাধা আছে না ?
-ননদিনীগর্বে বুকটা ক্যাশিয়াস ক্লে-র মত চওড়া বোধ করতে থাকি। ডিরেকটারি খুলে ট্রাংক বুকিং নম্বর খুঁজে, সেইটে ঘোরাই। -হ্যালো ?
হালো-ট্রাংক বুকিং ? গভীর প্রশ্ন হয়।
-আজ্ঞে না। আমিই বলছিলুম,ঐ যে বাপির বৌদি
-বুজিচি। এখন আবার কাকে ফোন কচ্চেন?
-আপনাকেই খুজছিলুম। আর কি!
-আঃ ? রীতিমতো ভয়ের ছাপ ফোটে। গলায়।
-মানে ডাক্তারের সেই কলটা তো পাচ্ছি না, তাই ভাবছিলাম। আপনাকে একটা কথা বলে রাখি-
অ। তাই। কণ্ঠস্বরে স্পষ্টত রিলিফ-বলুক, কী বলচেন?
-আচ্ছা, থ্রি ফাইভ ফোর সিক্স জিরো থ্রিতে কোনও ফোন যদি আপনার লাইনে আসে
হ্যাঁ-হ্যাঁ এয়েছেল তো। ঐ নম্বরে এক ভদ্দশ্লোক দুতিন-
-ঐ! ঐ! ঐ হচ্ছেন ভক্তি মেসোমশাই,উনিই তো জানাবেন ছেলেটাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করা গেল কিনা! ওই ফোনের জন্যই আমরা বসে আছি।
-কিন্তু লাইন তো জড়িয়ে গ্যাচে। কল তো আপনি পাবেন না।
-সেই তো মুশকিল। তাই জন্যেই আপনাকে একটা অনুরোধ করব ভাবছি।
-বলুন। -অসামান্য ভদ্র শব্দ হয়।
-ফের যদি থ্রি-ফাইভ-ফোর সিক্স জিরো থ্রি-তে কোনও কল আসে,দয়া করে রং নম্বর বলে নামিয়ে রাখবেন না।
-কিন্তু ওটা তো আমাদের নম্বর নয়।
-জানি! জানি। কিন্তু ওইটেই তো আমাদের নম্বর। ফের যদি ফোন আসে,আপনিই দয়া করে একটু মেসেজটা নিয়ে রাখবেন? ডক্টর ভক্তিব্রত ভট্টাচার্য,ডিরেক্টর,হেলথ সার্ভিসেস ফোন করবেন।
-ওঃ হো! তাই নাকি? কি সৌভাগ্য!
-আমাদের মেসোমশাই হন ! বেশ গর্ব ফোটে গলায়।
-বা! বা! বেশ! বেশ!
-উনি যদি বুলটিকে চান,-
-আপনার নাম বুলটি?
-ঐ ডাকনাম আর কি,বুলা থেকে-
-আমার ভাইপোর নামও বুলু। বি কম পড়ছে।
-ওমা! তাই নাকি? বেশ মজা তো! বুলা,বুলু একই। তা,যা বলছিলুম,ভক্তিব্রত মেসোমশাই যদি-
-কিন্তু উনি আমাকে মেসেজটা দেবেন। কেন? আমার লোকাস স্ট্যানডাই-টা কী? হুম অ্যাম আই?
-লোকাস স্ট্যান্ডাই? সে সব থাকগে। এইভাবে তো কাজটা হতে পারে? আপনি কি ডক্টর বি. বি. ভট্টাচায্যি? ডিরেক্টর হেলথ সার্ভিসেস ? বুলটিদের লাইনটা জড়িয়ে গেছে-আমাকেই মেসেজটা নিয়ে রাখতে বলেছে। বাচ্চু কেমন আছে? ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি হলো কিনা?
-বা-চ-চু কে-ম-ন আছে। ই-ন-টেন-সিব হোলড অন প্লীজ কে-য়া-রে-
-ও কি? আপনি কী করছেন?
টেকিং ডাউন ইওর মেসেজ ম্যাডাম। হ-ল-কিনা। বাস। এটাই তো
রিসেপশনিস্টের কাজ। সারাক্ষণ তো এই কম্মোই কচ্চি। মেসেজ রাখা,আর মেসেজ দেওয়া। কল বুক করা আর কানেকশন দেওয়া। হ্যালো আর হোল্ড অন ।
-ওঃ হো স্যারি,আপনার দিল্লির বুকিংটা.
-ট্রাংক বুকিং ধরলে তো? নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্চে সব।
-তারা ধরবে কেমন করে? বাজছে তো আমাদের বাড়িতে। তারা তো জানেই না আপনি ডাকছেন।
-তাও তো বটে; ওঃ।
যাচ্ছেতাই। যাচ্ছেতাই। সব্বোধবংসী মহাকালের কুনজরে পড়িচি মশাই,দিদিমণি-সব ভেঙে পড়চে। পুরো কলকাতা শহরটা চতুর্দিক থেকে ব্রেকডাউন কচ্চে। যেমনি রাস্তাঘাটের অবস্তা তেমনি ট্রাম-বাসের অবস্তা, তেমনি তেল চিনি ক্যারাসিন তেলের অবস্তা, যেমনি আমাদের হাসপাতাল,তেমনি ইলেকট্রিক সাপ্লাই, তেমনি আমাদের জলের ব্যবস্তা, রাস্তায় তো জঞ্জালের কাঁড়ি, এমনকি, গঙ্গানদীটা পজ্জন্ত নাকি বুঁজে যাচ্ছে শুনিচি। কী সব্বোনেশে কতা! মহাপাপের ফল। বুয়েচেন? একটা জাত অনেক পাপ কল্লে তবেই তাদের অমনটা হয়। একেবারে শেষ হয়ে যাবার আগে সভ্যতার এমনি অবস্তা হয়।
কিছুক্ষণ স্বব্ধতা। তারপর বলি, তা যা বলেছেন। সত্যিই জীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠছে কলকাতাতে। উম...আচ্ছা আবার বলি, যদি থ্রি ফাইভ ফোর সিক্স জিরো থ্রিতে কেউ-
-ফোন করে, তবে মেসেজটা রেকে নেবো। থ্রি-ফাইভ-ফোর-সিক্স-জিরো-থ্রি-
আপনি নিশ্চিস্ত থাকুন...
-মেসোেমশাইয়ের নাম ভক্তিব্রত ভট্টাচায্যি, ডিরেক্টর, হেলথ সার্ভিসেস.
-ভ-ক্তি-ব্র-ত-মেসোমশাই... এই তো? ঠিক আচে । যিনি ফোন করুন, মেসেজ
নিয়ে নেব। আমি তো বসেই রইচি। কিন্তু আপনাকে খবরটা ফের দেব ক্যামন করে ?
-কেন? ওয়ান নাইন নাইন? ট্রাংক-বুকিং, ফায়ার,অ্যাম্বুলেন্স,হাওড়া স্টেশন,যা খুশি ঘোরাবেন। যাই ডায়াল করুন আমাকেই তো পাবেন।
-তা বটে। যাচ্ছেতাই। যাচ্ছেতাই। হোল সিস্টেমটা ব্রেকডাউন কচ্চে মশাই
-দিদিমণি। এখন যদি একটা কোনও এমারজেন্সি হয়-টেন পি এম টু সিকস এ এম যখন ওয়ার্কিং ডে
-সত্যিই কী কষ্ট আপনার
-সত্যি! কি কান্ড। শালাদের—স্যরি--
-যাক গে,ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই,রেখে দিচ্ছি। গুড নাইট
-গুড নাইট দিদিমণি,আমার অবিশ্যি এখন গুড নাইট নয়। গুড আফটারনুন বলতে পারেন
-কষ্ট আর কি! চাগরি। অব্যেস হয়ে গ্যাচে।
আপনি শুয়ে পড়ুন।
-কোনও খবর এলে আমি দিয়ে দেবো।
ঘণ্টাখানেক তন্দ্রা এসেছিল - আবার ফোনে তিনটি ট্রিং-রি-রিং বাজতে লাগলো। অস্ফুট ইঙ্গিতের মতো। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ড হাইজাম্প করে।
-হ্যালো!
-হ্যালো!
-ওঃ আপনি ? পেলেন দিল্লি ?
-ডিল্লি ? নাঃ চেষ্টা কচ্চি। কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলে সু। বুইলেন? কিন্তু আপনারটা এয়েছেল ।
-এসেছিল? ভক্তিব্ৰত মেসোমশাই
-আজ্ঞে হ্যা। রুগী ভালোই আচে । ইনটেনসিব কেয়ারে ভত্তি হয়ে গ্যাচে। ডাক্তার দাশগুপ্ত নিজে গে দেকে এয়েচেন এই রাত্তিরেই- তিনি বলেচেন রুগীর বয়েস কম, স্বাস্থ্য ভালো,দিব্যি ফাইট কচ্চে, ওষুদে অলরেডি রেসপন্ড করেচে-
-আপনাকে যে সত্যি,মানে কী যে বলব।--
-আগে সবটা শুনে নিন, ধানই-পানাইটা পরে হবে। ডক্টর ভটচায্যি মনে কচ্চেন সারভাইভ্যালের চান্স ভালই, তা সত্ত্বেও রুগীর আত্মীয়স্বজনদের খপর দিয়ে দেয়া উচিত- ওরা ভাবচে লক্ষণটা মেনিনজাইটিসের,-এখনো প্যাথলজিকাল টেস্টগুলো অবিশ্যি হয়নি, নেক-রিজিডিটি আছে, তাছাড়া ডিলিরিয়াসও -রুগীর বাপ-মাকে ইমিডিয়েটলি খবর দিতে বলেচেন।
-বাপ মা তো গৌহাটিতে।
-ট্রাঙ্গকল করুন। ফোন আচে?
-জানি না। কিন্তু ঠিকানা জানি।
-আর ফোন থাকলেই বা কি। এই ডিল্লির মতনই হবে। ফোনের যা অবস্তা! টেলিগ্রাম করুন।
-টেলিগ্রাম ? এত রাত্তিরে কোথায় বেরুবো? দুটো বাজে বোধহয়-কাল সকালে করতে হবে।
-সকলের চেয়ে রাতেই তাড়াতাড়ি যাবে। দেরি করবেন না। দিন দিকি ঠিকানাটা? আর মেসেজটা দিয়ে দিন। আমি পাঠিয়ে দিচ্চি টেলিগ্রাম।
-আপনিই বা এত রাত্তিরে-ডেক্সের ডিউটি ছেড়ে—
-আমি যাবো কেন? হোটেলের ছোঁড়াগুলো রয়েচে কী কত্তে? এইখেনেই ফর্ম রয়েচে-আর পাশেই টেলিগ্রাম আপিশ- হোলনাইট ওপেন। দিন,দিন ঠিকানা আর মেসেজটা-কি লিকবেন? আগে তাদের নাম ঠিকানাটা বলুন-ফর্মটা বের করি দাঁড়ান। হাঁ,রেডি। এইবার বলুন। ...কই? বলুন ?.
-বলব ?
-বলবেন না তো কি আমি হাত গুনবো? ছেলেটার বাপের নাম কি?
-সত্যেন বড়ুয়া।
-থাকে কোতায়?
-প্রফেসর্স কোয়ার্টার নম্বর ফাইভ,গৌহাটি ইউনিভারসিটি,গৌহাটি।
-বড়ুয়া? অসমীয়া? এখানে আচে যে বড়?
-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে।
-তার বেলায় বাঙ্গালী বুজি বদ নয়? হুঁ-হু। যত্তোসব পলিটিকসের বদমাইসি আসলে।
-হাঁ। সাধারণ মানুষ তো রাজনীতিকের হাতের পুতুল।
-বলুন,কী লিকবেন। এইবার? ঠিকানা লিকে নিইচি। আর্জেন্ট করবেন কিন্তু। নইলে যাবেই না। আসামে যে তাণ্ডব চলচে। আর্জেন্ট করলেও যায় কি না দেকুন। কলকাতার টেলিগ্রামতো!
হ্যা হ্যা আর্জেন্ট, নিশ্চয়ই করুন। নিশ্চয়ই। এ আর বলতে?
-ছেলেটার নাম কি?
-বাচ্চু।
-তবে লিকুন-বাচ্চু সীরিয়াসলি ইল- হসপিটালাইজড-কাম ইমিডিয়েটলি-তবে নাম কি দেবেন?
বাপি দিয়ে দিন। আমার দেওর ওদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল গৌহাটিতে।
-শুনুন,শুনে নিন ভালো করে, আবার পড়চি; আর্জেন্টি টেলিগ্রাম। সত্যেন বড়ুয়া প্রফেসর্স কোয়ার্টার নম্বর ফাইভ,গৌহাটি ইউনিভারসিটি গৌহাটি। বাচ্চু সিরিয়াসলি ইল হসপিটালাইজড কাম ইমিডিয়েটলি। বাপি। এই তো?
-বাঃ খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু টাকাটা তো দেওয়া যাবে না?
-ওটা পরে হবেখন। এটার খচ্চা বেশি নয়। কত আর,গোটা দশেকের মদ্দ্যিই হয়ে যাবে। আরও কম হবে। এখন নিচে নাম ঠিকানা দিতে হবে। কী লিখব? সেনডারস নোম অ্যাণ্ড অ্যাড্রেস !
-কিন্তু টাকাটা—
-পরে হবে। অত ভাবনার কিচু নেই। নাম ঠিকানাটা আগে দিন। টাকাটা পরে কখন ওই দেওরের হাত দে পাটিয়ে দিলিই চলবে। বলুন,কী দেবো নাম ঠিকানা? অবিশ্যি ফোন নম্বরটা দিলেও হয়! বাপি, কেয়ার অব কী লিখব?
-কেয়ার অব এন কে দত্ত, থ্রি ফাইভ ফোর সিকস জিরো থ্রি ।
-এ-ন-কে-দত্ত—থ্রি ফাইব...
এবার আপনারটা বলুন?
-বলচি, লিকে নিন। খাতা পেনসিল আচে?
-আচে
-বেশ। লিকুন-জি পি চন্দর, জ্ঞানপ্রকাশ চন্দর,থ্রি ফাইব ফোর টু এইট ওয়ান।
-হয়েছে? জি পি চন্দর, থ্রি ফাইব...হূঁ হয়েছে। এবার ঠিকানা ?
-ঠিকানা? চাগরির ঠিকানাটাই ঠিকানা। দিনের বেলায় মেস। রাত্তির বেলায় আপিস। ও আপনি অত বুজবেন না। বুজেও কাজ নেই। লিকুন,হোটেল শ্রীনিবাস
-হোটেল শ্রীনিবাসটা হচ্চে হ্যারিসন রোডের ওপরিই,প্রায় শালদার অপোজিটে।
-তিনতলা বাড়ি। সদা গোলাপী টালি লাগিয়েচে একতলার ভেতর সাইডে,বাইরের দালেও। আপনার দাওর ঠিক খুঁজে পাবে। আপনি এবার একটু শুয়ে পড়ুন দিকিনি ? এভাবে সারারাত্তির উদ্বেগের মদ্দে! আপনার টেলিগ্রাম আমি এক্ষুনি করিয়ে দিচ্চি।
-টাকাটা আমি বাপিকে দিয়ে কালই নিশ্চয়-- হাসপাতালও তো ওই কাছেই
-হবে,হবে। ছেলেটা ভগবানের দয়ায় বেঁচে উঠুক তো আগে? বিদেশ বিভূঁয়ে
-আপনাকে কী যে বলব মানে... আপনার মত মানুষ - আজকের দিনে এমন মানুষ সত্যিই...মানে
গম্ভীর গলায় মৃদু হাস্য করেন জি পি চন্দর। এই প্রথম হাসি
-এইটুকুনি তো মানুষ মানুষের জন্য করবেই।
-এটুকু করবেই মানে? কেউ করে? কেউই করে না। সবে বসে একটু জায়গা পর্যন্ত করে দেয় না কেউ অন্যের জন্যে।
দেয় দেয়। হোটেলে কাজ কত্তে কত্তে চুল পেকে গেল দিদিমণি, মানুষ কি কম দেকিচি ? মন্দও যেমন দেকিচি, ভালোও তেমনিই দেকিচি। এটুকুনি মানুষ মানুষের জন্যে করেই থাকে। আপনি কচেচন না? দাওরের বন্ধুর জন্য? এবারে ছেড়ে দিন দিকিনি। এটকু শুয়ে পড়ুন।
-ঘুম হবে কি ? হাসপাতালের খবর-টাবর আসে যদি?
-সে এলে তখন উটবেন। এলে তো আসবে এখেনে। ধরবো তো আমিই। আপনি শুয়ে পড়ুন গে।
-থ্যাংকিউ মিস্টার চন্দর... আপনাকে কী যে বলব।
-কিছুই বলতে হবে না বুলটি দিদিমণি, থ্রি ফাইভ ফোর টু এইট ওয়ানটুকু মনে রাকবেন,কোনও দরকার হলে মোটে সঙ্কোচ করবেন না। ইউ আর লাইক মাই ডটার,সুদ্ধু একটা ফোন করে দেবেন। লাইনের জটটা খুলে গেলে তো আর এরকম ডিরেকটি সার্ভিস পাবেন না।
পরদিন সকালে বাপি যখন ফিরল,অসম্ভব উত্তেজিত। মুখ্য-চোখ লাল।
-বাচ্চু কেমন আছে?
-আগের চেয়ে ভালো। প্রেশারটা স্টেবিলাইজ করে গেছে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে বৌদি। একেই বোধহয় মির্যাকল বলে,এই সকাল সাড় ছটা সাতটা নাগাদ, একজন বুড়ো মত লোক,ধুতি-শার্ট-পরা,সব চুল সাদা। এসে বাচ্চু বড়ুয়ার বন্ধুদের খোঁজ করল,-একেবারে বাপি,খোকন নাম ধরে! তারপর আমার হাতে এই স্লিপটা দিয়ে -বলতেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার বৌদি - এই স্লিপটা দিয়ে বলল
-‘বড়ুয়াকে টেলিগ্রাম করা হয়ে গেছে। এটা তার রসিদ। তোমার বৌদিদিকে দিও।'মানে আমরা তো... একেবারে স্টানড। স্পেলবাউন্ড। বিফোর উই কুড রিকভার ফ্রম দ্যাট ডেজড স্টেট, হি ডিসাঁপিয়ার্ড। হাওয়া হয়ে গেল বৌদি। জাস্ট মিলিয়ে গেল। আর,দেকতেই পেলুম না। কে লোকটা? কী করে জানল বাচ্চুর কথা? আমাদের কথা? আমাদের নাম ? তোমাদের কথা? কে? কে পাঠালো টেলিগ্রাম? রিয়ালি বৌদি,টু, থিংক অফ ইট... ও কি, তুমি হাসছ? জাস্ট লুক আট দিস চিট-আকচুয়ালি গেছে টেলিগ্রাম দেখছ তো? বাট হু ওয়াজ হি? নোবডি নোজ হিম... সত্যিই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বৌদি, এই দ্যাখো
-বাপি মুঠো করে আস্তিন-গোটান পেশি-বহুল হাতটা সামনে এগিয়ে দ্যায়। লোমগুলো খাঁড়া হয়ে উঠেছে। আমি আর হাসি না।
এমনি সময়ে খোকনের ফোন এল। তার মানে লাইনের জট খুলেছে। খোকনও অসম্ভব উত্তেজিত।
-‘শুনেছেন তো? বাপি বলেছে সব ? কী স্ট্রেনজ এক্সপিরিয়েন্স ভাবলেই গা শিরশির করে উঠছে,সত্যি বৌদি, দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ! দাদু তো শুনে বলছেন আর ভাবনা নেই, তোদের বন্ধু এ-যাত্রা বেঁচে গোল-আমি অবশ্য অতটা বলছি না,তবে ব্যাপারটা সত্যিই মিরাকুলাস। একেই বোধহয় বলে
টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি মিরাক্ল। না বৌদি? আচ্ছা,রিসীটটা আপনি হাতে নিয়ে দেখেছেন? ইটস আ রিয়্যাল রিসীট!"
ক্যান ইউ বিলিভ ইট? এমন যে হতে পারে- উত্তেজনায় খোকনের বাক্য হারিয়ে যায়।
ভাগিাস রিংকুটা মর্নিং কলেজে বেরিয়ে গেছে! ফিরলেই বারণ করে দিতে হবে। জি পি চন্দরের কথাটা ছেলেদের কাছে কোনোদিনই ভাঙা চলবে না।
ওরা বড় দরিদ্র। বিশ্বাস বস্তুটির স্বাদ ওরা মোটেই পায় না। তার সুযোগই আসে না বেচারাদের জীবনে। এটুকু পেয়েছে,আহা,জমা থাকুক। সত্যিই তো, মির্যাকুলাস ঘটনা মিস্টার জি পি চন্দর।
স্লিপটা যত্ন করে তুলে রাখি। শেয়ালদার অপোজিট,গোলাপী টালি,হোটেল শ্রীনিবাসে নিজেকেই দেখছি যেতে হবে টাকাটা ফেরত দিতে।
1 মন্তব্যসমূহ
লেখকের কৌতুক পূর্ন মুখটি চোখে ভাসছে।অসাধারণ বলার ধরণ।
উত্তরমুছুন