অমর মিত্রের গল্প : মানুষটি স্বপ্ন দেখেছিল

এক বন্ধু ফোন করেছিল আর এক বন্ধু সুবীরকে। সুবীর এখন গৃহবন্দী প্রায়। গা ভর্তি এলারজি। ঘা হয়ে গিয়ে তা এখন শুকোচ্ছে। বেরতে পারছে না। সুস্থ হতে আরো দিন কুড়ি লাগবে। শিশু অবস্থায় কারবলিক অ্যাসিড মুখে দিয়েছিল।
তা অনেক বছর অন্তর অন্তর গায়ে ফুটে বের হয়। এক কবিরাজ ওকে দ্যাখেন। সুবীর আমাকে ফোন করে বলল, রঞ্জন ফোন করেছিল, বলল, খুব অভিমান নিয়ে চলে যাচ্ছে। সে আর বাঁচবে না। এক-দু মাস বড় জোর। কর্কট রোগের ঘা ছড়িয়ে পড়েছে ভিতরে। এখন আর কেমো থেরাপি বা অন্য কোনো প্রতিষেধক কাজ করবে না। যন্ত্রণা মুক্তির ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে।

সজল শুনতে শুনতে বলল, যাব, আসলে অনেক দূর তো, যাব যাব করে যাওয়া হয়নি। 

সুবীর বলল, রঞ্জনের বউ-এর সঙ্গে কথা হয়েছে ওর। ঊর্মি বলল, কথাটা সত্যি। রঞ্জন প্রবল ব্যথায় কাতর হয়ে পড়লে বড় হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। হসপিটালে দুদিন রাখার পর বলেছে এই কথা। কর্কট চাপা পড়ে ছিল বছর তিন। আবার জেগে উঠেছে প্রবল প্রতাপে। সজল তুমি যদি পার একবার যেও, বাড়িতেই আছে। 

সুবীর খুব ভালো মানুষ। অ্যালারজিতে জর্জরিত হয়ে আছে। না হলে যেতই। সুবীরই সকলের খোঁজ রাখে। খোঁজ নেয়। থাকে বারুইপুর থেকে কটি স্টেশন পেরিয়ে ধবধবি নামের এক গঞ্জে। ওখানে সে চাকরি করতে গিয়েছিল অনেক দিন আগে। ভাল লেগে যায়। বাড়িও করেছে সেখানে। বাগান, ক্ষেত-খামার নিয়ে তার দিন কাটছে। কতবার সুবীর ডেকেছে, সজল যেতে পারেনি। তার সময়ই হয় না। সে নামী অধ্যাপক। দেশ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিয়ে বেড়ায়। আর টেলিভিশনে নানা বিষয়ে বলতে আমন্ত্রিত হয়। সজল দেশের নানা সংকটে নিজের মতামত দেয়। সুবীর যতবার ডেকেছে ধবধবিতে, সে ব্যস্ততার কারণে যেতে পারেনি। 

তারা সকলেই বাল্যকালের সাথী। ষাট-বাষট্টি বছর আগে তারা জন্মেছিল নিশ্চিন্তপুর নামের এক গ্রামে। সেই গ্রামের অদূরে হুগলী নদী। গঙ্গা। গঙ্গার ওপারে হাওড়া জেলার ফুলেশ্বর কিংবা উলুবেড়িয়া। হায়ার সেকেন্ডারির পর সকলেই গ্রামের বাইরে চলে গেছে। কেউ বড় সরকারি চাকুরে, কেউ অতি সাধারণ যেমন সুবীর, কেউ নামী অধ্যাপক। গ্রাম থেকে আসেনি শুধু রঞ্জন। রঞ্জন সেই নিশ্চিন্তপুর গ্রামে নির্মাণ করেছিল এক শিল্পকলার আশ্রম। সে ছবি আঁকত ভাল। কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছিল। তাদের কিছু জমি-জমা ছিল। আম বাগান ছিল। রঞ্জন সেই সব আর তার আশ্রম নিয়ে ছিল নিশ্চিন্তপুরে। রঞ্জনের বাবা ছিলেন ইংলিশের টিচার। রঞ্জনের দাদা অঞ্জন কৃষ্ণনগরে থাকেন। ভূগোলের টিচার। শোনা যায় সেই আশ্রমটি রঞ্জন গড়েছিল শান্তি নিকেতনের আদলে। ক্রমশ বড় হচ্ছিল তার আশ্রম। বাইরে থেকেও অনেকে এসেছেন রঞ্জনের আশ্রম দেখতে। কিন্তু সজল যাবে যাবে করে যেতে পারেনি। সুবীর দু’বার গিয়েছিল, ফিরে এসে সজলকে বলেছিল, দেখে আসতে। রঞ্জন কতজনকে হাতের কাজ শেখায়। ছবি আঁকার পাঠ দেয়। রঞ্জন নিজেও ভাল পেইন্টিং করে। রঞ্জনের আশ্রমে গেলে মন ভালো হয়ে যায়। সজল, বসন্ত, সুমিত্র কেউ যায়নি। সজল বরং সুবীরকে বলেছিল, ব্যর্থ চেষ্টা করছে রঞ্জন। শান্তি নিকেতন যাব, নিশ্চিন্তপুর যাব কেন? সুবীরের ভালো লাগেনি সজলের কথা। রবীন্দ্রনাথেই কি শেষ? ছোট ছোট এমনি শিল্পকলা কেন্দ্র, আশ্রম থাকলে তো স্থানীয় মানুষের ভিতর শিল্পে আগ্রহ তৈরি হয়। হাতের কাজ শেখায় রঞ্জন। কুটুম কাটাম কী তা কি জানে সাধারণ মানুষ ? বেতের কাজ, বাঁশের কাজ, দারু শিল্প করছে কতজন। নিশ্চিন্তপুরে রঞ্জন একটা বদল এনেছে। 

হ্যাঁ বদল হয়ে গেছে। এখন এল,পি,জি, ফিলিং প্ল্যান্টের জন্য অধিগৃহীত হয়ে সেই গ্রামের চিহ্নই নেই। রঞ্জন তার আশ্রম বাঁচাতে পারেনি। প্ল্যান্টের বাইরে আশ্রম গড়ে দেবে বলেছিল কোম্পানি। কিন্তু তা কি হয়? তিলতিল করে গড়া সেই আশ্রম কি পাকা ইস্কুলবাড়ি গড়ে দিলে হয়ে যায়? কী সুন্দর ছিল সেই সাজানো বাগান। আশ্রম। রঞ্জনের সমস্ত জীবনের স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেছে। রঞ্জন নিশ্চিন্তপুর বাঁচাও কমিটি গড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল। পারেনি। রঞ্জন তখন চেষ্টা করেছিল বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার আন্দোলনে সহমর্মিতা আদায়ে। তারা কেউ সাড়া দেয়নি। দেবে কী করে। সুবীর বলেছিল, ফিলিং প্ল্যান্ট তো চাই, না হলে কয়লার উনুন জ্বালাতে হবে। 

কিন্তু একটা সবুজ গ্রাম এল,পি,জি প্ল্যান্টের প্রাচীরের আড়ালে চলে যাবে? একটা গ্রাম তো নয়, সাতটা গ্রাম প্ল্যান্টে চলে যাবে। কত মানুষ উচ্ছেদ হবে। তিন ফসলী জমির চাষ-বাস বন্ধ হয়ে যাবে। রঞ্জন ঘুরেছিল বন্ধুদের কাছে। বসন্ত বড় সরকারি চাকরি করে। ক্ষমতাবান। বসন্ত কি পারবে না নিশ্চিন্তপুর বাঁচাতে? সজল টেলিভিশনে গিয়ে বলুক তার শিল্পকলা আশ্রমের কথা। রঞ্জনের পাশে তারা কেউ দাঁড়ায়নি। রঞ্জন বিক্ষোভ সংগঠিত করেছিল। সমর্থন তার বন্ধুরা করেনি। সুবীর গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। সুবীর সজলকে ফোন করে বলেছিল, একজনের সমস্ত জীবনের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আমরা তার পাশে দাঁড়াতে পারলাম না। সজল বিরক্ত হয়েছিল। বলেছিল, সামান্য ছবি আঁকিয়ে, তার জন্য এল,পি,জি, প্ল্যান্ট বন্ধ করে দিতে হবে ? 

বসন্ত বলেছিল, সরকার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে, বাড়িয়ে দিতে পারি আশ্রমের সম্পদ বেশি দেখিয়ে। 

সুবীর বলেছিল, আশ্রমে যা ছিল তার দাম হয় না বসন্ত।

বসন্ত বলেছিল, রঞ্জনের কথা মতো সে তদন্ত করিয়েছিল, কাঠকুটো আর রংচঙে হলেই কি অনেক দাম হয়, আর্ট করে সমাজের কোন উপকার হয়? 

সজল বলেছিল, সবাই যদি রামকিঙ্কর কি নন্দলাল বসু হতে চায়, তাহলে তো বিপদ, নিজের সীমানা বোঝা উচিত, আমি যদি রঞ্জনের আশ্রম বাঁচাতে তার হয়ে কথা বলি টেলিভিশনে, লোকে হাসবে। 

সুবীর কিন্তু বেশ কয়েকবার গিয়েছিল প্রতিরোধ আন্দোলনের সময়। রঞ্জনকে প্রস্তাব দিয়েছিল, ধবধবিতে জমি কিনে আবার আরম্ভ করতে। তখন পঞ্চাশ পার। তখন কি আর আরম্ভ করা যায়? হতাশ এবং পরাজিত রঞ্জন বজবজের দিকে চলে গিয়েছিল। ক্ষতিপূরণের টাকায় একটা পুরোন বাড়ি কিনেছিল। তার একটা ঘরে খুলেছিল চিত্রকর নামে একটি আঁকার ইস্কুল। তার পুত্র তাকে ত্যাগ করে বাঙ্গালুরু চলে গেছে, আর আসে না। কন্যাটির বিবাহ হয়েছে কাছেই, সে বাবা মাকে দ্যাখে। নিশ্চিন্তপুরে এল,পি,জি প্ল্যান্ট চালু হয়ে গেছে। তিরিশ বছর আগে কাটা চাষের ক্যানেল আর কোনো কাজেই লাগছে না। সুবীরের খবর এইসব। সুবীরই বলল, রঞ্জন চলে যাচ্ছে।

সজল তখন বসন্তকে ফোন করল। বসন্ত অবসর নিয়েছে। অবসরের পর তার সমস্ত ক্ষমতা চলে গেছে। যখন ক্ষমতায় ছিল,বহুজন তার পাশে ঘুরঘুর করত অনুগ্রহের আশায়। এখন তারা কেউ আসে না। তাই সে একটু নিঃসঙ্গ বোধ করে। ফেসবুক শিখেছে। সেখানে নানা উপদেশ দেয় সরকারকে। সমাজকে। নিজে যখন ক্ষমতায় ছিল কী কী প্রশাসনিক কাজ করত জনসাধারণের ক্লেশ লাঘব করতে তা লেখে। সে খুব ভালো পেনশন পায়। বছরে কয়েকবার ভ্রমণে যায়। কিন্তু কত ঘুরবে? সবই তো তার ঘোরা। তার পুত্র থাকে বিদেশে। কন্যা নেই। বসন্ত ইতোমধ্যে আমেরিকা ঘুরে এসেছে। আবার যাবে। ছমাসের বেশি তো থাকা যায় না, তাই একটু মরমে মরে থাকে। এমনিতে তার করার কিছু নেই। বসন্ত বলল, আচ্ছা সজল, রঞ্জন কেমন শিল্পী?

সজল বলল, সে জানে না। কিন্তু কেউ কেউ তার কথা বলে। কেন বলে তাও সে বোঝে না। 

বসন্ত বলল, কেউ এই ভাবে জীবন নষ্ট করে, ও একটা ভাল চাকরি করতে পারত।

হ্যাঁ, স্কুল টিচার হতে পারত, টিচারদের এখন ভাল মাইনে, তার উপর টিউশনি তো থাকতই।

বসন্ত বলল, অধ্যাপকদের স্যালারি তো আরো ভাল, গ্রেড-ওয়ান অফিসারদের মতোই।

সজল খুব খুশি হয় না এই কথায়, বলল, পি,এইচ,ডি, থাকলে লিফট হয়, প্রিন্সিপাল কিংবা যদি ভি সি হতে পারে কেউ, প্রিনসিপাল সেক্রেটারির সমান স্যালারি হয়।

বসন্ত বলল, ও অধ্যাপক হতে পারত কিন্তু।

উঁহু, অতটা এলেম ছিল না, আমি তো শেষ দেড় বছর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলাম।

দুজনে আলাপ করতে করতে এই সিদ্ধান্তে আসে যে রঞ্জন ভুল করেছে। জীবনটা নিয়ে ছেলেখেলা করেছে। এইটা না করতেই পারত। এখন বুঝতে পারছে ভুল। তাই আক্ষেপ করছে। একজন অসফল মানুষের এমন হয়। কথাটা সুবীরকে বলল সজল। সুবীর তার বাড়ি এসেছিল সজলের ডাকে। তার এলারজি শুকিয়েছে। সেই ছেলেবেলার ভুল যে সারাজীবন ধরে ভোগাতে পারে তা সে টের পাচ্ছে খুব ভালো করে। সজলের কথা শুনে সুবীর বলল, ওইভাবে বলা যায় না সজল, জীবনানন্দ দাশের জীবন তো জান, উনি কি ব্যক্তি জীবনে সফল ছিলেন?

সজল হাসে, আরে কার সঙ্গে কার তুলনা করছ, হি ওয়াজ আ জিনিয়াস, ওঁকে নিয়ে কত গবেষণা হচ্ছে, সেখানে রঞ্জন কে, অপটু এক শিল্পী।

সুবীর বলে, ভ্যান গগ, তুলুজ লোত্রেক, পল গঁগা, কত শিল্পীর কথা পড়েছি, তাঁরা কত কষ্ট করেছেন, লাস্ট ফর লাইফ পড়েছি তো আমি।

হা হা করে হাসে সজল, বলে, তুমি কি তাদের মাপের শিল্পী ভাবছ রঞ্জনকে?

সুবীর বলে, আমি কিছুই ভাবছি না সজল, কিন্তু সবাই যে ভ্যান গগ হবে তা তো নয়, অমন হবে না বলে ছবি আঁকবে না কেউ, তাই কী হয় ?

সজল বলল, কী করতে বলো আমাদের, হেল্প করব ?

সুবীর বলল, কর্কটের চিকিৎসায় জমানো টাকার বেশিরভাগ গেছে, কিন্তু এখন কোনো চিকিৎসা খরচ নেই ওর, হেল্প চাই না, ও কারো সাহায্য নেয়নি। 

তুমি ওর ব্যাঙ্ক ডিটেইল দিলে আমি কিছু ট্রান্সফার করে দিতাম, বসন্তও তাই বলেছে।

সুবীর বলল, ও আমাকে বলেছে অভিমান নিয়ে চলে যাচ্ছে।

কিসের অভিমান, কার উপর অভিমান ?

সুবীর বলল, আমি জানি না সজল। 

সজল চুপ করে বসে থাকে। সুবীরও। সুবীরকে ঠিক বোঝা যায় না। সুবীর সামান্য চাকরি করত। ক্লার্ক ছিল। প্রমোশন পেয়ে একটু উপরে উঠেছিল হয় তো। কতই বা পেনশন পায়। সুবীর সেই অজ এক গাঁয়ে বাড়ি করেছে। চাষবাস করে। আর রঞ্জনের কাছে যায়। ক্যাশ টাকা কি সুবীরের হাতে দেওয়া যায়? সুবীর কেন রঞ্জনের কথা নিয়ে ঘুরছে, ফোন করছে? সুবীরের কি স্বার্থ? অভাব কি সুবীরের ? সুবীর তুমি তো নিশ্চিন্তপুর অধিগ্রহণের ক্ষতিপুরণ পেয়েছ ? 

সুবীর বলল, আমি নিইনি, আমার অন্য চার ভাই ভাগ করে নিয়েছে, আর ক্ষতিপুরণ বেশি হয়ও নি। 

সজল বলল, তুমি তো বসন্তকে বলতে পারতে, ও পরামর্শ দিত, গভমেন্টের বিরুদ্ধে একটা কেস ফাইল করে দিলেই কোর্টের রায়ে অন্তত দশগুন পেয়ে যেতে, বাইশ হাজার প্রতি কাঠা দিয়েছিল সরকার, আমি কোর্টে গিয়ে দু লক্ষ দশ হাজার পেয়েছি কাঠা প্রতি।

সুবীর অবাক হয়ে সজলের কথা শুনল। তারপর বলল, আমাকে তো বলেনি বসন্ত, তবে কোর্ট কাছারি করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। 

তোমাকে কিছুই করতে হতো না, এর জন্য উকিল আছে, তারাই এসব করিয়ে দেয়, শুধু কতগুলো সিগনেচার করতে হতো। বলে হাসল সজল। বসন্তও তাই পেয়েছে। তখন রঞ্জন তার আশ্রম নিয়ে ছোটাছুটি না করে এই সব করলে, অনেক লাখ টাকা নিয়ে বেরোতে পারত। 

সুবীর বলল, ও তো আশ্রমটা রক্ষা করতে চেয়েছিল, সমস্ত জীবনের স্বপ্ন ছিল ওইটা, সেই জন্য কেউ ওর পাশে দাঁড়ায়নি।

সজল বলল, অনর্থক হতো, কে চেনে ওকে, একটা পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করে দেবে ওই জন্য! 

সুবীর কিছু বলল না। দুজনের ভিতরে নীরবতা বয়ে যেতে থাকে। সুবীর একটু পরে উঠল। সজল চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে বছর পাঁচ। নানা বয়সের নারীর সঙ্গে তার নানা রকম সম্পর্ক আছে। নামী অধ্যাপক। অনেক ছাত্রী এসেছে, চলে গেছে। একজন ফোন করল একটু পরে। চন্দ্রাবলী। মফস্বল শহরের মেয়ে। তাঁর কাছে পি,এইচ,ডি, করেছিল। একটি কলেজে পড়ায়, বলল, স্যার কি ব্যস্ত, কথা বলতে পারি ?

কেন বলো দেখি। জিজ্ঞেস করলেন সজল। 

স্যার আপনাকে একজন আর্টিস্টের কথা বলব? সুরেলা গলায় চন্দ্রাবলী বলল। 

বুঝতে পারছি না। সজল ভিতরে ভিতরে একটু উদ্বিগ্ন হলেন। কার কথা বলবে, কেনই বা বলবে? রঞ্জনের কথা। লোক শিল্প গবেষণা আর বই লেখার জন্য ভালো, কিন্তু লোক শিল্পী তাঁর পছন্দের কেউ নয়। চন্দ্রাবলী বলল, স্যার আপনাকে একটু বাঁকুড়া যেতে হবে, আপনি কি যেতে পারবেন, আমরা নিয়ে যাব, সব ব্যবস্থা থাকবে, আপনি শুধু এক শিল্পীকে সংবর্ধিত করবেন। 

তিনি কে ? সজল জিজ্ঞেস করলেন।

চন্দ্রকান্ত মাহাতো। বলল চন্দ্রাবলী, আপনি হয়তো তাঁর নাম শোনেননি, লোক শিল্পী। 

না, শুনিনি তো। সজলের কথায় ঈষৎ তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। 

চন্দ্রাবলী বলল, আমার বাড়ি বাঁকুড়া স্যার, বাঁকুড়া তো শিল্পীর দেশ স্যার।

হুঁ, কিন্তু এঁর নাম তো শুনিনি আমি। সজল বললেন। 

ইনি একজন পেইন্টার, তা বাদে মূর্তি গড়েনও, ভাস্কর্য, আমি আপনাকে আগে বলেছি স্যার, আপনি ভুলে গেছেন।

সজল বললেন, মনে নেই চন্দ্রাবলী, তুমি কেমন আছ বলো।

চন্দ্রাবলী বলল, ভাল আছি স্যার, আপনার হাত দিয়ে ওঁকে সম্মানিত করতে পারলে উনিও একটু গুরুত্ব পাবেন, বয়স হয়েছে পঁচাত্তরের উপর, জীবনে কিছুই পাননি। 

সজল চুপ করে থাকে। এই তো গত মাসে তাকে যেতে হয়েছিল মেদিনীপুর শহরে। এক কবির জন্মদিনে তাঁকে সংবর্ধিত করতে। তার জন্য সজল একটা ভালো টাকা সাম্মানিক নিয়েছেন। কেন নেবেন না? ওই কবি বড় কনট্রাক্টর। খরচ সব তিনিই করেছেন। তাঁর বই উদ্বোধন এবং জন্মদিন পালন সজল বসুর হাতেই হলো। চন্দ্রাবলীকে তিনি বললেন, তুমি বলছ, যেতে হবে, কিন্তু একটা প্রোজেক্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে আছি, দেখি সময় করতে পারি কি না ।

চন্দ্রাবলী বলল, ইনি খুব দরিদ্র শিল্পী, আমরা নিজেরা টাকা সংগ্রহ করে এই ব্যবস্থা করছি, স্যার, আপনার হাতে সমস্তটা হলে খুব ভালো হতো। 

সজল বললেন, আমি আমার ডেটগুলো দেখি ডায়েরিতে, তুমি কোন তারিখের কথা বলছ ? 

তারিখ জেনে নিয়ে সজল বললেন, তিনি ওই দিনে আর এক লোক শিল্পী রঞ্জন পালিতের কাছে যাবেন, তিনি মৃত্যু শয্যায়। এই কথাই আচমকা মুখে চলে এল। না হলে বিনা পারিশ্রমিকে তাঁকে বাঁকুড়া গিয়ে কাজটা করে দিয়ে আসতে হতো। চন্দ্রাবলী তাঁর খুব পছন্দের অধ্যাপক। নারী। সুন্দরী। তার কাছে সাম্মানিক দাবী করা যায় না। 

চন্দ্রাবলী কিন্তু চেনে রঞ্জনকে, বলল, তাঁর কাছে যাবেন, হি ইজ আলসো আ ডিপ্রাইভড আর্টিস্ট, তাঁর আশ্রমটাকে ভেঙে দিয়ে শেষ করে দিয়েছে কত দুষ্প্রাপ্য কাজ, আচ্ছা স্যার, দেখি আমরা তারিখ বদলাতে পারি কি না, রঞ্জন পালিতের কাছে যাবেন স্যার, খুব ভালো হবে, আমি ওঁর কাজ দেখেছি, শুনেছি উনি খুবই অসুস্থ, আমিও একদিন যাব। 

চন্দ্রাবলীর ফোন রেখে দিয়ে সজলের মনে হলো ওই তারিখে তাঁকে রঞ্জনের কাছে যেতেই হবে। কেন না পরদিনই চন্দ্রাবলী ফোন করে জানতে চাইবে কেমন আছে রঞ্জন পালিত। রঞ্জনকে ও চিনত। তার কাজ দেখেছে। আশ্রমেও নাকি গিয়েছে একবার। তাঁকে বলেছিল কি? না বলেনি মনে হয়। না কি বলেছিল, তিনি শুনতে পাননি। শুনতে পেয়েও ভুলে গেছেন। যে কথা শুনতে ভাল লাগে না, মাথা থেকে দ্রুত উড়ে যায়। ইস্কুলের অতি মাঝারি মাপের ছাত্র রঞ্জন পালিত লোক শিল্পী, এ কী করে মানবেন তিনি ? 

রঞ্জনের কাছে তাঁকে যেতেই হলো। বসন্ত আসেনি। বাঙ্গালুরু গেছে ছেলের শ্বশুর মশায়ের ডাকে। ওঁদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে। তারাতলায় দাঁড়িয়েছিল সুবীর। কুন্ঠিত গলায় বলল, রঞ্জনের কাছে সে দিন পনের যেতে পারেনি। ফোন করে বলে দিয়েছে ঊর্মিকে। সে খুব খুশি। রঞ্জন চলে যাচ্ছে, ওর অভিমান কেটে যাক সজল, পৃথিবীতে মানুষ তো একবারই আসে সজল। 

সজল কোনো কথা বললেন না। তাঁর ওই ছাত্রী চন্দ্রাবলীর জন্যই আসা। চন্দ্রাবলীকে তিনি পছন্দ করেন। হোয়াট’স অ্যাপে প্রতিদিনই গুড মর্নিং জানান গোলাপগুচ্ছ পাঠিয়ে। চন্দ্রাবলীর রূপ আছে, গুণও। কলকাতায় এলে তাঁর কাছে আসবেই। চন্দ্রাবলীকে রিফিউজ না করলেই হতো। 

তারাতলা-বজবজের রাস্তায় কন্সট্রাকশন চলছেই। পথের অনেকটাই ভাঙাচোরা। বাতাসে ধূলিকণা। এদিকে অনেক কল-কারখানা ছিল, উঠে গেছে। সেই জমিতে স্বর্গোদ্যান নামের হাই-ফাই সিটি। সজল এদিকে আসেনি বহুদিন। সব কিছুই অচেনা লাগছে। নিশ্চিন্তপুর এই রাস্তার প্রায় শেষ প্রান্তে। এই পথেই তিনি শেষবারের মতো নিশ্চিন্তপুর এসেছিলেন। সারাটা পথ কথা বিশেষ হলো না সুবীর আর সজলে। সজল এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে তো ?

কেন ? সুবীর জিজ্ঞেস করল। 

কিছু টাকা ফেলব আমি, বসন্তও। 

আমি তো বলেইছি, টাকা চায় না রঞ্জন। সুবীর বলল।

সজল চুপ করে থাকলেন। তাহলে কী করতে যাচ্ছেন? অসফল ব্যক্তির ভিতরে থাকে শুধু ঈর্ষা। তিনি কি সেই ঈর্ষার সমুখে গিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারবেন? কেন পৌঁছলেন এই পুরোন, প্রায় ধ্বংসের মুখে চলে যাওয়া বাড়িতে? দালান বাড়ি, দেওয়ালের প্লাস্টার খসা। সামনে ভাঙাচোরা পথ। শীত চলে গেছে, গাছের পাতা ধুলিমলিন। রাস্তায় দম ফুরোন টিউব-বাতির আলোয় অন্ধকার কাটে না। এমন ঝাঁ চকচকে গাড়ি এই গলিতে ঢোকে কালেভদ্রে। গাড়ি রাখলে রিকশা আটকে যাবে, তাই তাদের নামিয়ে দিয়ে বড় রাস্তায় অপেক্ষা করতে থাকে ড্রাইভার তার বাহন নিয়ে। সুবীরের পিছু পিছু একটা গুমো গন্ধ ভেদ করে যে ঘরে ঢুকলেন সজল, সেই ঘরে অতি উজ্জ্বল আলো। দেওয়াল জুড়ে মস্ত ক্যানভাস। দেওয়ালই যেন ক্যানভাস। একটা কিছু আঁকার চেষ্টা হয়ে যাচ্ছে। আঁকা বাঁকা রেখা, হলদে, সবুজ, লাল, কালো রঙের প্রলেপ। খাটে শুয়ে আছে সে। রঞ্জন। ফতুয়া আর লুঙ্গি পরিহিত শীর্ণকায় কঙ্কাল এক। চামড়া কুঁচকে কুঁচকে গেছে। শুকনো বাঁশের মতো পা দুখানি, কঞ্চির মতো হাত যেন মানুষের ছায়া, মানুষ নয়। কপালে চন্দন লেপা। খাটের শিয়রে এক ভাঙাচোরা মহিলা। রঞ্জনের স্ত্রী। তিনি বললেন, বসুন দাদা, আপনাদের শুধু ডাকে। 

চোখদুটি শুধু জ্বলজ্বল করছে। সুবীর ডাকে, সজল এসেছে রঞ্জন।

চোখ বন্ধ করল রঞ্জন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসল স্ত্রীর সাহায্যে। দেওয়ালে বালিশ, বালিশে পিঠ। অবাক হয়ে রঙের পোঁচ মারা দেওয়ালে তাকিয়ে থাকল। সজল তার দৃষ্টি অনুসরণ করেন। দেওয়ালে কী এঁকেছে রঞ্জন। একেবারে শিশুর হাতে রঙ তুলি দিলে যেমন হয়, তেমনি। ঊর্মি বললেন, আরম্ভ করেছিল, এখন আর পারে না, হাত থেকে খসে যায় তুলি, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। 

সুবীর বলল, বলেছিল, এঁকে রেখে যাবে বলেছিল আমায়।

কী ? সজল অনুচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

সেই আশ্রমটা, আশ্রম ছিল ওর স্বপ্ন, স্বপ্নটা এঁকে রেখে যাবে বলছিল, আরম্ভ করেছে তাহলে?

ঊর্মির চোখ ছলছল করছিল, বললেন,আর হবে না।

সজল দেখলেন রঙ। সজল চোখ মেললেন, দেখতে পেলেন রঙের ভিতর থেকে ফুটে বের হচ্ছে গাছ-পালা, আলো বাতাস, মেঘ ও রৌদ্র, নদীর চ্ছলচ্ছল…...নিশিন্তপুর। তার ভিতরে স্বপ্ন। তিনি মাথা নামালেন, বিড়বিড় করে বললেন, হয়েছে রঞ্জন, হয়েছে, হয়েছে বন্ধু।

সজল ভেঙে পড়ছিলেন। তাঁকে গুড়িয়ে দিয়েছে এই এলোমেলো তুলির টান। স্বপ্ন এমনিই হয়। এমনি। তিনি ফিরতে ফিরতে বুঝে নিতে চাইছিলেন স্বপ্নটা কেমন। কী ভাবে তা স্বপ্নের ভিতরে আসে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সুন্দর গল্প। পড়তে পড়তে ছান্দারের কথা মনে হচ্ছিল। উৎপল চক্রবর্তী নেই, কেমন আছে ছান্দার?

    উত্তরমুছুন
  2. নিজের ব্যথা ভুলে থাকার জন্য গল্পপাঠ খুললাম। প্রিয় একজন কথাশিল্পীর গল্পটি পড়া শুরু করেও পড়লাম না।পড়তে পারলাম না। এখানেও সেই কর্কট রোগের ব্যথার কথা। সার্থক কথাশিল্পী। আমি আপনার বর্ণনা নিতে পারিনি বলে গল্পটি পড়া শেষ করিনি।

    উত্তরমুছুন