নদী পেরিয়ে ওদের গাড়ি টিলায় চড়ল। টুয়েল্ভ ওকস নজরে আসার আগেই স্কারলেট লম্বা লম্বা গাছের মাথার ওপরে পাতার ফাঁক দিয়ে ঝাপসা ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পেল। বাতাসে ভেসে আসছে হিকোরি কাঠের আগুনে ভেড়ার মাংস আর পোর্ক ঝলসানোর সুঘ্রাণ।
বারবেকিউর চুল্লী, যেগুলো কাল থেকেই অল্প আঁচে জ্বলছে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই গনগনে লাল হয়ে উঠেছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝলসানোর সময় মাংস থেকে রস গড়িয়ে পড়ে হিস হিস শব্দ হচ্ছে আর আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। স্কারলেট জানে যে জন উইল্কসের বিশাল অট্টালিকার পেছনের ওকের বাগান থেকে বাতাস এই সুবাস নিয়ে আসছে। ওঁদের বাড়ির প্রত্যেকটা বারবেকিউই ওখানেই হয়। জায়গাটা অল্প ঢালু, গোলাপ বাগানের পাশে। খুব ছায়াছন্ন, মনোরম জায়গা। ক্যাল্ভার্টরা যেখানে বারবেকিউ করেন তার থেকে অনেক বেশি মনোরম। মিসেজ় ক্যাল্ভার্ট বারবেকিউতে তৈরি খাবার ভালবাসেন না। বলেন বারবেকিউ হয়ে যাওয়ার পর অনেকদিন পর্যন্ত সেই খাবারের গন্ধ বাড়িতে থেকে যায়। বাড়ির থেকে প্রায় সিকি মাইল দূরে অনাচ্ছাদিত সমতলভুমিতে কাঠফাটা রোদ্দুরের মধ্যে ওঁদের বারবেকিউর আয়োজন করা হয়। আতিথেয়তার জন্য এলাকায় জন উইল্কসের খুব সুনাম। বারবেকিউর আয়োজনেও তাঁর উচ্চ রুচির পরিচয় পাওয়া যেত।
উচ্চমানের লিনেনে ঢাকা পিকনিকের টেবিলগুলো গাছের ছায়ায় রাখা হত। টেবিলের দু’পাশে বেঞ্চ। হেলান দেবার ব্যবস্থা নেই। চেয়ার আর মাটিতে পেতে বসার জন্য ঘরের থেকে গদি নিয়ে এসে ইতস্তত রেখে দেওয়া হত। অনেকে বেঞ্চে বসতে চাইতেন না, তাঁদের জন্য। মাংস গ্রীল করার উনোন থাকত বেশ দূরে যাতে ধোঁয়া এসে অতিথিদের জ্বালাতন করতে না পারে। বড় বড় লোহার গামলায় বারবেকিউ স্যস আর ব্রানজ়ুইক স্ট্যু ভাসত। অন্তত এক ডজন নিগ্রো, মিস্টার উইল্কসের নির্দেশ মত, ট্রে হাতে অতিথিদের খাদ্য পরিবেশন করার জন্য ছোটাছুটি করত। গোলাবাড়ির পেছনে আরো একটা বারবেকিউর চুল্লী থাকত। বাড়ি চাকরবাকররা, সহিসরা, অতিথিদের সঙ্গে আসা পরিচারিকারা জমিয়ে বারবেকিউ করত। হো কেক, রান্না করা শুয়োরের অন্ত্র (যেটা নিগ্রোদের খুব প্রিয় আহার্য), আর মরসুমি তরমুজ খুব পরিতৃপ্তি করে খেত।
স্কারলেট প্রাণভরে তাজা পোর্ক রোস্ট হওয়ার আঘ্রাণ নিল। মনে মনে ভাবল যতক্ষণে ওগুলো তৈরি হয়ে যাবে, ততক্ষণে নিশ্চয়ই ওর খিদে পেয়ে যাবে। এখন ওর পেট একদম ভরা; আর এত টাইট করে কোমরে দড়ি বাঁধা, যে খালি ঢেকুর তুলতে ইচ্ছে করছে। তা হলেই কেলেঙ্কারি! কেবল মাত্র বয়স্ক লোক আর অতিবৃদ্ধা মহিলারা ঢেকুর তুললেই কোন রকম সমাজবিধি লঙ্ঘন হয় না।
টিলা বেয়ে ওপরে উঠে যেতেই সুন্দর সাদা বাড়িটা দেখা যেতে লাগল। লম্বা লম্বা থাম, চওড়া চওড়া বারান্দা, আর সমতল ছাদ। যেন এক লাবণ্যময়ী নারীর মত। টারার চেয়েও স্কারলেট টুয়েল্ভ ওকসকে বেশি ভালবাসত। টুয়েল্ভ ওকসের সৌষ্ঠব কিংবা আভিজাত্য কোনটাই জেরাল্ডের বড়িতে ছিল না।
লম্বা বাঁকানো ড্রাইভওয়েতে বেশ কিছু জিন লাগানো ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়িও এসেছে। অতিথিরা নামতে নামতে একে অন্যকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। পার্টিতে আসতে পেরে উদ্দীপ্ত নিগ্রোরা হাসিমুখে জানোয়ারগুলোকে শস্যাগারের কাছে নিয়ে গিয়ে জিন খুলে দিচ্ছে সারাদিনের জন্য। এক দঙ্গল সাদা আর কালো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা চারদিকে ছোটাছুটি করে খেলছে আর কে কতটা খেতে পারবে তাই নিয়ে উত্তেজিত হয়ে কল কল করছে। বাড়ির সামনে থেকে পেছন অবধি লম্বা হলে পুরুষ এবং মহিলারা গিজ গিজ করছে। ও’হারাদের গাড়ি যখন বাড়ির সামনে এসে থামল, স্কারলেট দেখল মেয়েরা সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরে, এক হাতে একে অন্যের কোমর বেষ্টন করে প্রজাপতির মত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ঊঠছে আর নামছে। মাঝে মাঝে থাম ধরে হাতলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে হেসে হেসে ছেলেদের ডাকাডাকি করছে।
ফরাসী জানালার ফাঁক দিয়ে স্কারলেট দেখল সিল্কের পোশাক পরিহিত বয়স্ক মহিলারা ড্রয়িংরুমে গোল হয়ে বসে বাচ্চা, অসুখবিসুখ, কার সাথে কার বিয়ে হল, কার হল না, এই সব নানা বিষয়ে আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত। টম, উইল্কসদের পরিচারক, একটা রুপোর ট্রে নিয়ে, হল থেকে হাসিমুখে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এসে, সুবেশ যুবকদের শরবত পরিবেশন করছে।
রোদ ঝলমলে সামনের বারান্দায়ও অনেক অতিথি সমাগম হয়েছে। স্কারলেটের মনে হল কাউন্টির সমস্ত মানুষ এখানে চলে এসেছে। টার্লটনের চার ভাই আর তাদের বাবা লম্বা লম্বা থামের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রেন্ট আর স্টুয়ার্ট যথারীতি একসঙ্গে। বয়েড আর টম তাদের বাবা জেমস টার্লটনের পাশে। মিস্টার ক্যালভার্ট তাঁর ইয়াঙ্কি স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে। পনের বছর জর্জিয়াতে কাটিয়েও ভদ্রমহিলা এখনও এখানকার পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন নি। সকলেই ওঁর সাথে ভদ্র এবং সহৃদয় ব্যবহার করেন এবং নিজেকে এই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পারার জন্য সহানুভূতিশীল। তবে এঁরা একথা একদমই ভুলতে পারেন না যে ইনি একসময় মিস্টার ক্যাল্ভার্টের সন্তানদের গৃহশিক্ষিকা ছিলেন। রেফোর্ড আর কেড, ক্যাল্ভার্টের দুই ছেলে, আর তাদের লাস্যময়ী, ব্লন্ড বোন ক্যাথলীন, গোমড়ামুখো জো ফোনটেন আর ওর হবুবউ মিষ্টি চেহারার স্যালি মুনরোর পেছনে লাগছে। অ্যালেক্স আর টোনি ফোনটেন ডিমিটি মুনরোর কানে কানে কিছু বলছে আর মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। প্রায় দশ মাইল দূর লাভজয় থেকেও কোন কোন পরিবার এসেছেন। ফ্যেয়াটভিল, জোন্সবোরো, এমনকি আটলান্টা আর ম্যাকন থেকেও কেউ কেউ এসেছেন। জনারণ্য; তুমুল কোলাহল; হাসিঠাট্টার পরিবেশ।
দেউড়ির সিঁড়ির কাছে জন উইল্কস দাঁড়িয়ে। রুপোলী চুল, সৌম্য চেহারা। উষ্ণ আতিথেয়তার প্রতিমূর্তি, ঠিক যেন জর্জিয়ার গ্রীষ্মকালের সূর্যের মত অমলিন। হানি উইল্কস তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে। ওকে সকলে হানি বলে ডাকে কারণ ও ছোট বড় সবাইকেই এমনকি খেতমজুরদেরও এটা বলেই ডাকে। আগত অতিথিদের অভিবাদন করতে গিয়ে ও ছটফট করছিল আর হেসে গড়িয়ে পড়ছিল।
বাবার সংযত আচরণের পাশে হানির পুরুষদের নজর কাড়বার এই উচ্ছল প্রয়াস দেখে স্কারলেটের মনে হল, মিসেজ় টার্লটনের কথাটা হয়ত ভুল নয়। উইল্কসদের পুরুষদের চেহারায় একটা পারিবারিক বৈশিষ্ট আছে। ঘন সোনালি ভুরু আর ধূসর চোখ। অথচ হানি আর ওর বোন ইন্ডিয়ার ভুরু অত ঘন নয় আর চোখও কেমন যেন ফ্যাকাসে। হানিকে ভুরুহীন খরগোশের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আর ইন্ডিয়ার চেহারা তো বৈশিষ্টহীন।
ইন্ডিয়াকে কোথাও দেখতে পেল না। স্কারলেট জানে ও নিশ্চয়ই রান্নাঘরে চাকরদের তদারকি করছে। বেচারা ইন্ডিয়া, ভাবল স্কারলেট, মা মারা যাবার পর থেকে ঘরদোর সামলাতে গিয়ে আর বর পাকড়াও করার সময়ই পায় না। এক স্টুয়ার্ট টার্লটন ছাড়া। আর ও যে হানির থেকে বেশি সুন্দরী তাতে স্কারলেটের দোষ কোথায়!
স্কারলেটদের দেখতে পেয়েই জন উইল্কস নেমে এলেন ওকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করার জন্য। নামতে নামতে স্যুয়েলেনকে বোকার মত হাসতে দেখে বুঝল ভীড়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি রয়েছেন।
গাড়ি থেকে হেসে জন উইল্কসকে ধন্যবাদ দিতে দিতে স্কারলেট খানিক শ্লেষের সঙ্গে ভাবল আমি অন্তত ওরকম বুড়োহাবড়া প্রেমিক পছন্দ করতাম না!
স্যুয়েলেনকে সাহায্য করবার জন্য ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন। স্যুয়েলেনের হাব ভাব দেখে স্কারলেটের ইচ্ছে হল ওকে কষে একটা চড় মারে। হতে পারে ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি এই কাউন্টির অন্যদের থেকে অনেক বেশি জমির মালিক আর সহৃদয় মানুষ। কিন্তু তাঁর বয়স চল্লিশ হয়ে গেছে। মুখে পাতলা তামাটে দাড়ি আর কেমন যেন ব্যস্তবাগীশ আইবুড়ো হাব ভাব। যাই হোক, নিজের পরিকল্পনার কথা মনে রেখে, স্কারলেট চড় মারার ইচ্ছেটা পরিহার করল। তারপর মিষ্টি হেসে ওঁর দিকে তাকাল। অভিভূত হয়ে মিস্টার কেনেডি স্যুয়েলেনের দিকে হাত বাড়িয়েও স্কারলেটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
স্কারলেট জন উইল্কসের সঙ্গে মৃদু বাক্যালাপ করতে করতেই চারদিকে চকিত দৃষ্টি ফেলে অ্যাশলেকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু ও দেউড়ির আশে পাশে কোথাও ছিল না। অনেকেই ওকে অভিবাদন জানাল। স্টুয়ার্ট আর ব্রেন্ট টার্লটন ওঁর দিকে এগিয়ে এল। মুনরোর মেয়েরা এগিয়ে এসে ওর ড্রেসের প্রশংসা করতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই ওকে ঘিরে ধরল। ওর শ্রুতিগোচর হওয়ার জন্য সকলেই খুব হল্লা করতে শুরু করল। সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু অ্যাশলে কোথায়? মেলানী আর চার্লস? কাউকে বুঝতে না দিয়ে ও চারদিকে দেখতে লাগল। হলের ভেতর কলরবমুখর মানুষজনের মধ্যেও খোঁজার চেষ্টা করল।
হাসি ইয়ার্কির ফাঁকে ফাঁকে চার দিকে চোখ চালাতে চালাতে ওর নজর হঠাৎ একজন অচেনা আগন্তুকের দিকে পড়ল। হলের মাঝখানে একলা দাঁড়িয়ে বেহায়ার মত ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরুষমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারার নারীসুলভ তৃপ্তি আর বুককাটা ড্রেস পরে থাকার জন্য বিব্রত বোধ করা, এই দু’ধরনের একটা মিশ্র অনুভুতির স্রোত ওর মধ্যে বয়ে গেল। বয়স বেশির দিকেই, অন্তত পঁয়ত্রিশ। বেশ লম্বা এবং শক্তিশালী। ওর দেখা যে কোন ভদ্রলোকের তুলনায় অনেক বেশি চওড়া কাঁধ আর পেশীবহুল চেহারা। চোখে চোখ পড়তেই উনি হাসলেন। যত্নকরে ছাঁটা কুচকুচে কালো গোঁপের নীচে ঠোঁট দুটো ফাঁক করে ধবধবে সাদা দাঁতের সারি বের করে। তামাটে চেহারা, অনেকটা জলদস্যুদের মত। সপ্রতিভ কালো চোখ। জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া অথবা কুমারী নারীর ইজ্জত হরণ করা জলদস্যুদের যেমন হয়। হাসির মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব আর তরল পরিহাসের অভিব্যক্তি। স্কারলেটের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। ওর মনে হল এরকম দৃষ্টিতে ওর অপমানিত বোধ করা উচিত। কিন্তু কি লজ্জা, ওর তো অপমান বোধ হচ্ছেই না! ভদ্রলোক কে সেটা স্কারলেটের জানা নেই, কিন্তু তামাটে মুখটা দেখে মনে হয় কুলীন বংশেরই কেউ হবেন। পুরু লাল ঠোঁটের ওপর ঈগলের মত নাক, চওড়া কপাল আর দীর্ঘায়ত চোখ।
একটুও না হেসে ও চোখ সরিয়ে নিল। কেউ একজন ডাকল, “রেট! রেট বাটলার! এদিকে আসুন! জর্জিয়ার সবথেকে কঠিন হৃদয় মহিলার সাথে আপনার আলাপ করিয়ে দিই।” শুনতে পেয়ে উনিও সেদিকে চলে গেলেন।
রেট বাটলার? নামটা খুব চেনা চেনা। যেন কোন একটা রগরগে কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে আছে নামটা! যাকগে, এখন অ্যাশলেকে ছাড়া অন্য কারুর ব্যাপারে ভাবার সময়ই নেই।
“ওপরে গিয়ে চুলটাকে একটু ঠিক করে আসি,” ও ব্রেন্ট আর স্টুয়ার্টকে বলল। ওরা অনেকক্ষণ থেকেই ওকে পাকড়াও করার তালে ছিল। “আমার জন্য একটু অপেক্ষা কর। এরমধ্যে অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে যদি কেটে পড় তাহলে কিন্তু খুব রেগে যাব।”
অন্য কারও সাথে ফ্লার্ট করলে আজ স্টুয়ার্টকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল। সকাল থেকেই অবিরাম পান করে চলেছে। দু’চোখে ‘এসো এক হাত হয়ে যাক’ ধরনের দাম্ভিক দৃষ্টি। এর থেকে সমস্যা তৈরি হতে পারে সেকথা ভাল করেই জানা আছে স্কারলেটের। যাবার সময় হলে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু দাঁড়াল। দেখতে পেল ইন্ডিয়া বাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে এল। আলুথালু চুল, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওকে হেসে অভিবাদন জানাল। বেচারি ইন্ডিয়া! বিবর্ণ চুল আর চোখের পালক আর লম্বাটে থুতনির জন্য এমনিতেই ওর বয়স কুড়ি বছর বেশি লাগে। স্কারলেটের খুব জানতে ইচ্ছে করে স্টুয়ার্টকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে আনার জন্য ইন্ডিয়া কি ওকে ওকে মনে মনে ঘৃণা করে! অনেকেই বলে থাকে ইন্ডিয়া এখনও স্টুয়ার্টকেই ভালবাসে। তবে উইল্কসদের সম্পর্কে জোর দিয়ে কেউই কিছু বলতে পারে না। যদি স্কারলেটকে পছন্দ নাও করে, হাবে ভাবে সেটা কখনো বুঝতেই দেয় নি। আগের মতই নির্লিপ্ত সৌজন্য দেখিয়েই ও স্কারলেটকে অভ্যর্থনা করে।
ওর সঙ্গে হেসে একটু কথা বলেই স্কারলেট সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। পাশ থেকে কেউ একজন খুব লাজুক গলায় ওর নাম ধরে ডাকল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল চার্লস হ্যামিলটন। সুন্দর চেহারা, শুভ্র কপালের ওপর একরাশ নরম বাদামি চুল এসে পড়েছে, গাঢ় বাদামি রঙের চোখে স্বচ্ছ, কোমল দৃষ্টি। সর্ষে রঙের ট্রাউজ়ার, কালো কোট, প্লীট দেওয়া শার্ট আর কেতাদুরস্ত টাইয়ে খুব সুন্দর লাগছিল ছেলেটাকে। স্কারলেট ঘুরে তাকানোয় গালদুটো অল্প লাল হয়ে উঠল। মেয়েদের ব্যাপারে চার্লস যথেষ্ট লাজুক। আর লাজুক হবার কারণে, ও দূর থেকেই সুন্দরী, লাস্যময়ী, সহজলভ্য মেয়েদের দেখে মোহিত হয়। এর আগে স্কারলেট ওকে সাধারণ সৌজন্য দেখানো ছাড়া বিশেষ পাত্তা দেয়নি। আজ যখন দু’হাত বাড়িয়ে একগাল হেসে ওকে অভিবাদন জানাল, তখন ও আনন্দে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল।
“কি ব্যাপার চার্লস হ্যামিলটন! কি দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে! নিশ্চয়ই আমার মন চুরি করতে অ্যাটলান্টা থেকে এতদূর এসেছ!”
অপ্রত্যাশিত আনন্দে বিহ্বল হয়ে চার্লস স্কারলেটের নরম উষ্ণ হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে, মুগ্ধদৃষ্টিতে ওর চঞ্চল সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েরা অন্য ছেলেদের সাথে এভাবেই কথা বলে? ওর সাথে তো কেউ বলে না! ওর থেকে অনেক কম সুপুরুষ ছেলেরা, যাদের থেকে ও অনেক ব্যাপারেই শ্রেষ্ঠ – তাদের সাথেও মেয়েরা কত রকম ফষ্টিনষ্টি করে। কবে থেকেই তো চেয়েছে মেয়েরা ওর সাথেও ওরকম করুক! অবশ্য কখনও যে হয় নি তেমন নয়। কিন্তু তখন এমন জড়তা এসে যায় যে ও কথা খুঁজে পায় না! তারপর রাত্রে বিছানায় শুয়ে একরাশ ভাল ভাল কথা মনে পড়ে যায় আর ভাবে এর পরে ঠিক বলতে পারবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে মেয়েরা একবার হতাশ হয়েছে তারা ওকে আর দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না!
এমন কি হানি – যার সঙ্গে ওর বছরখানেক বাদে বিয়ে হবে বলে ধরেই নেওয়া হয়েছে – ওর সঙ্গেও কথা বলতে গেলেও জড়তা এসে যায়। মাঝে মাঝে এমনও মনে হয় ইন্ডিয়া যে ওর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে সেটা চার্লসের প্রেমিকসুলভ আচরণের জন্য নয়। ইন্ডিয়ার ছেলেঘেঁসা স্বভাবের জন্য। যে কোন ছেলের সাথেই ও এটা করবে। ওকে বিয়ে করার ব্যাপারেও চার্লস মন থেকে তেমন সাড়া পায় না। বইতে প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে যে রসসিক্ত আবেগের কথা লেখা থাকে, তেমন কোন আবেগই ইন্ডিয়ার ব্যাপারে ওর আসে না। সুন্দরী, সাহসী, দুরন্ত প্রেমিকাই মনে মনে ওর পছন্দ।
আর স্কারলেট মন চুরি করবার কথা বলে ওর পেছনে লাগছে!
যথাযথ প্রত্যুত্তর দেবার ইচ্ছে হল, কিন্তু সে আবার সব গুলিয়ে গেল। তবু ভাগ্য ভাল বলতে হবে, স্কারলেট উত্তরের প্রত্যাশা না করেই অনবরত কথাবার্তা চালিয়ে গেল। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। এটা কি স্বপ্ন না সত্যি! বিশ্বাসই হয় না!
“এইখানে চুপটি করে দাঁড়াও, যতক্ষণ না ফিরে আসি। বারবেকিউ আমি তোমার সঙ্গেই খেতে চাই। অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে যেও না যেন। আমি কিন্তু ভীষণ হিংসুটে, বলে দিচ্ছি,” লাল ঠোঁট নেড়ে বলে গেল। গালের দু’পাশে টোল পড়িয়ে। সবুজ চোখের ওপর কালো পালকগুলো বার বার ওঠানামা করতে লাগল।
“না, যাব না,” কোনক্রমে ও বলে ফেলল। স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে স্কারলেট মনে মনে ওকে কসাইয়ের সামনে বাছুরের সঙ্গে তুলনা করছে!
ভাঁজ করা হাতপাখা দিয়ে চার্লসের বাহুতে মৃদু টোকা দিয়ে ঘুরে যখন ওপরে উঠতে গেল, দেখতে পেল রেট বাটলার নামের সেই লোকটা একা একা চার্লসের থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার মানে চার্লসের সাথে ওর কথাবার্তা সবই উনি শুনেছেন। উনি যখন স্কারলেটকে দেখে হুলোবেড়ালের মত হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে অল্প হাসলেন, তখন ও একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেল। মনে হল অত্যন্ত দৃষ্টিকটূ ভাবে উনি ওর আপাদমস্তক লেহন করে নিলেন। এরকম নির্লজ্জ দৃষ্টিতে ও একদমই অভ্যস্ত নয়।
“অসভ্য, জানোয়ার কোথাকার!” স্কারলেট মনে মনে ফুঁসল। “এমনভাবে তাকাল যেন আমি অন্তর্বাসটুকুও পরে নেই!” তারপর গটগট করে ওপরে উঠে গেল, কোনদিকে না তাকিয়ে।
শোবার ঘরে, যেখানে উপহার সামগ্রী রাখা হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে দেখল ক্যাথলীন ক্যাল্ভার্ট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের ওপর দাঁত দিয়ে চাপ দিয়ে সেগুলোকে আরো লাল করবার চেষ্টা করছে। ওড়নার লাল গোলাপগুলো ওর গালের রঙের সাথে মিলে গেছে। নীল চোখদুটো উত্তেজনায় চকচক করছে।
“ক্যাথলীন,” নিজের বুকের দিকের কাপড়টা একটু ওপরে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করল, “নীচের তলায় বাটলার নামের ওই অসভ্য লোকটা কে রে?”
“হায় কপাল, তুই জানিস না!” ক্যাথলীন ফিসফিস করে উত্তেজিতভাবে বলল। তারপর আড়চোখে যেদিকে ডিলসি আর উইল্কস মেয়েদের ম্যামি গল্প করছিল, সেদিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, “জানি না মিস্টার উইল্কস কি ভাবছেন ..... । জোন্সবোরোতে উনি মিস্টার কেনেডির ওখানে গিয়েছিলেন – তুলো কেনা কিংবা ওইরকম কোন ব্যাপারে – মিস্টার কেনেডিকে ওঁকে সাথে করে নিয়ে আসতে হয়েছে। একা তো আর রেখে আসতে পারেন না।”
“ওঁর ব্যাপারটা কি?”
“কি বলব, উনি কোথাও আমন্ত্রিত হন না!”
“সত্যি!”
“হ্যাঁ।”
স্কারলেট মনে মনে খবরটাকে হজম করার চেষ্টা করল। কোথাও আমন্ত্রিত হন না এমন লোকের সাথে এক ছাতের তলায় হওয়ার সুযোগ এর আগে কখনও আসে নি। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর।
“কি করেছেন এমন?”
“কি বলব, স্কারলেট! ভদ্রলোকের প্রচণ্ড বদনাম। ওঁর নাম রেট বাটলার। চার্লসটনে থাকেন। ওঁর আত্মীয়-স্বজনরা যথেষ্ট ভদ্রলোক। ওঁরা এই ভদ্রলোকের সাথে সম্পর্কই রাখেন না। গত বছর গরমের সময় ক্যারো রেট বলেছিল ওঁর সম্বন্ধে। ওঁদের কোন আত্মীয় নয় যদিও, তবু সবই জানে ওঁর সম্বন্ধে। ওঁকে ওয়েস্ট পয়েন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল! ভাব একবার! ঘটনাটা এতই কদর্য ছিল যে ক্যারোও জানতে পারে নি! তারপর আরো আছে – যে মেয়েটাকে উনি বিয়ে করলেন না।”
“বল্, বল্।”
“তুই কি কিছুই শুনিস নি সোনা? সেবার ক্যারো সবই বলেছিল। ও যে এগুলো সব জানে, ওর মা জানতে পারলে লজ্জায় মরে যাবেন। সে যাই হোক। একবার মিস্টার বাটলার চার্লসটনেরই এক মেয়েকে ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরতে নিয়ে গেছিলেন। সে কে ছিল সেটা জানতে পারি নি, তবে কোন একজনকে আমার সন্দেহ হয়। মেয়েটা মোটেই ভাল নয় – নইলে পড়ন্ত বিকেলবেলা একা একা কেউ একজন পুরুষমানুষের সাথে বেরিয়ে যায়? কি বলব তোকে, রাত প্রায় কাবার করে দুজনে ফিরে এল! কি না ঘোড়াটা নাকি পালিয়ে গেছিল – আর ওঁদের গাড়িটা একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেছিল – ওঁরা নাকি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ভাব একবার ____”
“ভাবতে পারছি না রে। তুই বল,” স্কারলেট দুরন্ত কৌতুহলে জানতে চাইল। মনে মনে, সব থেকে খারাপ ব্যাপারটাই হয়েছ্ এই আশা নিয়ে।
“পরের দিন, উনি ওকে বিয়ে করতে রাজী হলেন না।”
“ওহ,” স্কারলেটকে নিরাশ লাগল।
“উনি বললেন – মানে – উনি এমন কিছুই করেন নি যাতে ওকে বিয়ে করতে হবে। মেয়েটার ভাই ওঁকে বেরিয়ে আসতে বলল। উনি বললেন ওই বুদ্ধু মেয়েটাকে বিয়ে করার চেয়ে বরং গুলি খেয়ে মরে যাওয়া ভাল। শেষমেশ উনি মেয়েটার ভাইয়ের সঙ্গে ডুয়েল লড়লেন। ভাইটা ওঁর গুলি খেয়ে মারা গেল। ওনাকেও চার্লসটন ছেড়ে চলে যেতে হল। এখন তাই কেউ ওঁকে আমন্ত্রণ জানায় না,” ক্যাথলীনের বলাও শেষ হল আর ডিলসি ফিরে এল স্কারলেটের প্রসাধনের তদারকি করতে।
“কোন বাচ্চা হয়েছিল?” ক্যাথলীনের কানে কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল স্কারলেট।
ক্যাথলীন জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। “তবে মেয়েটার একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেল,” স্কারলেটের কানে কানে ফিসফিস করে বলল।
আমার আর অ্যাশলের মধ্যে এরকম কিছু একটা হলে খুব ভাল হত। ও যেরকম ভদ্রলোক, আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হত। তবু ওই বোকা মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজী না হওয়ার জন্য রেট বাটলারকে মনে মনে তারিফ না করে থাকতে পারল না।
***
বাড়ির পেছন দিকে একটা বিশাল ওক গাছের ছায়ায় রোজ়উডের একটা নীচু আসনে স্কারলেট বসল। মৃদু বাতাসে ওর পোশাক একটু এলোমেলো। পায়ের সবুজ মরক্কো চপ্পল অল্প উঁকি দিচ্ছে। যেটুকু প্রদর্শণ করলেও লেডি থাকা যায়, ঠিক সেটুকু। হাতে ধরা প্লেটের খাবার স্পর্শ করে নি। সাতজন প্রণয়প্রার্থী ওকে ঘিরে রেখেছে। বারবেকিউ জমে উঠেছে। হাসি হুল্লোড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। রোস্টেড মাংস আর গ্রেভির সুগন্ধে বাতাস ভরপুর। মৃদুমন্দ বাতাসে চুল্লির ধোঁয়া মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। তখন মহিলারা মৃদু প্রতিবাদ করার ভান করছেন আর ঘন ঘন তালপাখা নাড়িয়ে ধোঁয়া তাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
অল্পবয়সী মেয়েরা বেশিরভাগই টেবিলের দুদিকে রাখা বেঞ্চগুলোতে যার যার সঙ্গীকে নিয়ে বসেছিল। কিন্তু স্কারলেট ভেবে দেখল বেঞ্চে ওর দুই দিকে মাত্র দুজন ছেলেই বসতে পারবে, তার বেশি নয়। তাই ও সবার থেকে আলাদা হয়ে বসেছে, যাতে ওর আশে পাশে একসঙ্গে অনেক ছেলেই জুটতে পারে।
বিবাহিত মহিলারা দলবেঁধে বাগানে বসেছেন। তাঁদের পরনে গাঢ় রঙের পোশাক। এইসব বিবাহিত মহিলারা, বয়স যাই হোক না কেন, অবিবাহিত মেয়েদের থেকে আলাদা হয়ে দল বেঁধে বসতেন। বয়সের সুযোগ নিয়ে ঠাকুমা ফোনটেন ক্রমাগত সশব্দে ঢেকুর তুলে চলেছিলেন। আর ওদিকে বেচারা সতেরো বছরের অ্যালিস মুনরো প্রথম গর্ভাবস্থাজনিত গা গুলোনোর অস্বস্তিকে প্রাণপনে দমিয়ে রেখেছে। এঁরা সবাই মিলে বংশবৃত্তান্ত আর স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত আলোচনায় মগ্ন। অল্পবয়সীদের কাছে এইসব আলোচনা যেমন কৌতুহলব্যঞ্জক তেমনই জ্ঞানগর্ভ।
স্কারলেট খানিক অনুকম্পা নিয়ে এঁদের দিকে তাকাল। ঠিক যেন কয়েকজন হৃষ্টপুষ্ট মুর্গি বসে আছেন। এঁদের জীবনে ফুর্তি করবার কোন জায়গা নেই। ওর মাথায় অবশ্য এটা এল না যে অ্যাশলেকে বিয়ে করার পরে ওকেও এই আসরেই যোগ দিতে হবে। ওকেও এই ধরনের অনুজ্জ্বল পোশাক পরতে হবে, আর ফুর্তি করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। আসলে, সব অবিবাহিত মেয়ের মতই ওর কল্পনাও বিয়ের বেদী অবধিই পৌঁছায়। তাঁর বেশি নয়। তবে এই মুহুর্তে অস্থির মনটাকে কোনভাবেই অন্য দিকে লাগাতে চাইছে না।
খুব মার্জিতভাবে ও প্লেটে রাখা একটা বিস্কিটে ছোট্ট একটা কামড় লাগাল, ঠিক একজন লেডির মত। ম্যামি নিশ্চয়ই খুশি হত। অবশ্য খিদেও নেই একেবারে। অসংখ্য পাণিপ্রার্থীরা ওকে ঘিরে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে এরকম নিঃস্ব এর আগে কখনওই মনে হয় নি। কি এক অজ্ঞাত কারণে অ্যাশলের ব্যাপারে কাল রাতের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। অ্যাশলেকে বাদ দিয়ে অন্য প্রণয়প্রার্থীকে টেনে আনতে ওর কোন অসুবিধেই হয় নি। কাল বিকেলের আশঙ্কা আজ সত্যে পরিণত হতে চলেছে। ওর হৃদয়স্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। গালের রঙ ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
অ্যাশলে ওর প্রণয়প্রার্থীদের দলে ভেড়বার কোন চেষ্টাই করে নি। এমন কি আসার পর থেকে অ্যাশলের সঙ্গে একলা কথা বলার কোন সুযোগও পায় নি। হ্যা, বাড়ি পেছনের বাগানে দেখা হওয়ার পর অ্যাশলে এগিয়ে এসে হেসে ওকে অভ্যর্থনা করেছে। মেলানির বাহু ওর হাতে ধরা ছিল। মেলানী ওর কাঁধ অবধিও লম্বা নয়।
ছোটোখাটো, রুগ্ন চেহারা। মনে হচ্ছিল যেন মায়ের বিশাল লম্বা স্কার্ট পরে পুঁচকে একটা মেয়ে। ওর বাদামী চোখের লজ্জাজড়ানো ভীরু দৃষ্টির জন্য আরো বেশি করে মনে হচ্ছিল। ওর ঘন লম্বা কোঁকড়া চুল নেট দিয়ে মাথার ওপর এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যে ওর পানপাতার মত মুখের গঠন আরও স্পষ্ট লাগছিল। চোয়ালের কাছটা চওড়া আর থুতনির কাছটা ছুঁচলো। ভীতু কিন্তু মুখটা মিষ্টি। তবে বড্ড সাধারণ। আর ওর এমন কোন নারীসুলভ আকর্ষণ নেই যে এই সাধারণ ভাবটা আড়াল হয়ে যাবে। সরল, সাদাসিধে আর স্বচ্ছ্ব। তবু ওর চলাফেরার মধ্যে একটা চাপা আভিজাত্য আছে যেটা মন ছুঁয়ে যায়, কিন্তু ওর বয়স মনে হয় যেন সতের বছরের অনেক বেশি।
স্কারলেটকে দেখে মিষ্টি হেসে ওর সবুজ ড্রেসটার প্রশংসা করল। স্কারলেট তখন অ্যাশলের সাথে আলাদা করে কিভাবে কথা বলা যায় সেটা ভাবতে ব্যস্ত। তাই প্রত্যুত্তরে ওর জবাবটা তত শিষ্ট হয় নি। ভীড় থেকে দূরে, মেলানির পায়ের কাছে একটা টুলে বসে অ্যাশলে ওর সাথে হেসে, গল্প করে একটানা সঙ্গ দিয়ে গেছে। সেই স্বপ্নময় হাসি যেটা দেখতে স্কারলেট ভালবাসে। অ্যাশলের কোন কথায় মেলানি হেসে উঠল। ওর চোখে একটা ঝিলিক মেরে গেল। আড়াল থেকে স্কারলেট দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে মেলানিকে খুবই সুন্দর লাগছে। অ্যাশলের চোখে চোখ রাখল মেলানি। ওর সাদামাটা মুখে একটা হালকা আভা। প্রেমপূর্ণ হৃদয়ের ভাষা যদি কখনও মুখে ফুটে ওঠে, তাহলে এই মুহুর্তে সেটা মেলানি হ্যামিলটনের মুখে ফুটে উঠেছে।
ধূসর রঙের অরগ্যান্ডির পোশাক, সাথে চেরি রঙের ঝালর দেওয়া বক্ষাবরক ওড়না ওর অপরিপুষ্ট শরীরটা আড়াল করে রেখেছে। মাথায় হলুদ রঙের হ্যাট, চেরি রঙের লম্বা ঝালর দেওয়া, মাখনের মত নরম ত্বককে উজ্জ্বল করে তুলেছিল। মাথার দু’পাশ থেকে সোনার লম্বা ঝোলা দুল, শান্ত চোখের পাশে দুলছিল। শীতকালের নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণির মধ্যে ঝরে পড়া পাতার মত বাদামি সেই চোখ।
ওদের দিক থেকে নজর সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও পেরে উঠল না। আর যতবার দেখছে তত ও ফুর্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওকে ঘিরে থাকা ছেলেদের সাথে নাচ, গান, হাসি ঠাট্টা চালিয়ে যেতে লাগল। ওদের প্রশংসাসূচক কথা নানারকম মুখভঙ্গী করে উড়িয়ে দিতে লাগল। বলল এগুলো কোনটাই কেউ মন থেকে বলছে না, তাই ও কারও কথাই বিশ্বাস করছে না। দুঃখের বিষয়, অ্যাশলে ওর এইসব কথাবার্তায় কোন মনযোগই দিল না, আর আপন মনে মেলানির সঙ্গে গল্প করায় ব্যস্ত রইল। মেলানির দৃষ্টি থেকে পরিষ্কার যে অ্যাশলে ওরই, আর কারও নয়।
এজন্যই স্কারলেট নিঃস্ব বোধ করছিল।
ওপর ওপর কেউই স্কারলেটকে দুঃখী বলে ধরতে পারবে না। আজকের বারবেকিউতে সেই হল সবার নয়নের মনি, আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যে উন্মাদনা আজ পুরুষকুলে ও সৃষ্টি করতে পেরেছে আর তাঁরই ফলশ্রুতি হিসেবে নারীকুলের ঈর্ষা উৎপাদন করতে পেরেছে, তাতে অন্যদিন হলে ওর পরিতৃপ্তির সীমা থাকত না।
চার্লস হ্যামিলটন, স্কারলেটের নজরে পড়ার সুবাদে, সাহসী হয়ে ওর ডানদিক দখল করে বসে আছে। টার্লটন ভাইদের প্রভূত চেষ্টা সত্ত্বেও ওকে নড়ানো যায় নি। এক হাতে স্কারলেটের তালপাতার পাখা আর অন্য হাতে বারবেকিউর প্লেট। হানির চোখে চোখ না পড়ার সযত্ন প্রয়াস। এদিকে হানির প্রায় কেঁদে ফেলবার জোগাড়। কেড বসেছে স্কারলেটের ডান পাশে। স্কার্টে টান দিয়ে স্কারলে্টের মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে আর চোখ পাকিয়ে স্টুয়ার্টের দিকে তাকাচ্ছে। ওর সঙ্গে যমজ ভাইদের প্রায় হাতাহাতি হবার জোগাড়। দু’চারটে গালি দু’পক্ষ থেকেই বেরিয়ে গেছে। ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি ওক গাছের ছায়া আর টেবিলের মধ্যে চক্কর কাটছেন। খাবারদাবার নিয়ে আসছেন স্কারলেটকে প্রলুব্ধ করার জন্য। যেন এই কাজটা করার জন্য কোন চাকর ওখানে নেই! ফলে স্যুয়েলেনের বিরক্তি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, মাঝে মাঝেই সেটা ভদ্রতার মুখোস খুলে বেরিয়ে পড়ছে। ক্যারীনেরও কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সকালে স্কারলেটের আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও, ব্রেন্ট শুধু একবার ওর মাথার রিবন নাড়িয়ে দিয়ে, “কি খবর বোন” বলে সম্পূর্ণভাবে স্কারলেটের দিকে মনযোগ দিয়ে বসে আছে। ব্রেন্ট তো ওর সঙ্গে কি মিষ্টি ব্যবহার করে, সব সময় কত গুরুত্ব দিয়ে ওর কথা শোনে, আর তাই জন্যেই না বড় হবার পর ওকেই বর হিসেবে কল্পনা করে রেখেছে! এখন মনে হচ্ছে স্কারলেটই ওকে দখল করে নিয়েছে! মুনরোর মেয়েরা অবশ্য ওদের বিরক্তি গোপন করেই রেখেছে। ফোনটেনদের ছেলেরাও স্কারলেটের শিবিরে যোগ দিয়েছে। কিন্তু যে ভাবে স্কারলেটের কাছাকাছি যাবার জন্য কসরত করে চলেছে সেটা কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি!
স্কারলেটের আপত্তিকর ব্যবহার দুই বোন চোখের ইশারায় হেটি টার্লটনকে জানাল। ‘চরিত্রহীন’, স্কারলেটের জন্য এটাই উপযুক্ত বিশেষণ। নিজের নিজের ছাতা তুলে নিয়ে তিন কন্যা একসাথে ঘোষণা করল যে খাওয়াদাওয়া অনেকে হয়ে গেছে, তারপর কাছে দাঁড়ানো ছেলেদের কাঁধে হাত রেখে বায়না করল গোলাপের বাগান, ঝর্ণা, গ্রীষ্মাবাস এসব দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের সুকৌশলী পশ্চাদপসরণ অন্তত একজন মহিলা আর একজন পুরুষের নজর এড়িয়ে গেল না।
তিনজন প্রণয়প্রার্থীকে টেনে নিয়ে যাওয়া দেখে স্কারলেট মুখ টিপে হাসল। কি দেখতে যাচ্ছে? না জন্ম থেকে যেগুলো বার বার দেখেছে সেগুলোই! আড়চোখে অ্যাশলেকে দেখল। নাঃ ও মেলানির দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিছুই লক্ষ্য করে নি। স্কারলেটের বুকটা মুচড়ে উঠল। ইচ্ছে করল মেলানির শুভ্র ত্বক খামচে রক্ত বের করে দিতে। খুব তৃপ্তি হয় তাহলে!
মেলানির ওপর থেকে চোখ ঘোরাতেই ও রেট বাটলারকে দেখতে পেল। ভীড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে জন উইল্কসের সঙ্গে কথা বলছেন। উনি ওর ওপর নজর রাখছিলেন আর চোখে চোখ পড়তেই কথা নেই বার্তা নেই হেসে উঠলেন। স্কারলেট এটা ভেবে অস্বচ্ছন্দ বোধ করতে লাগল যে উনি হলেন এখানে উপস্থিত একমাত্র ব্যক্তি (যাঁকে কেউ আমন্ত্রণ জানায় না) যিনি স্কারলেটের উদ্দাম আচরণের আসল রহস্যটা টের পেয়ে গেছেন। আর সেটা বুঝতে পেরে একটা অবজ্ঞামিশ্রিত আনন্দ লাভ করছেন। ওঁকে আঁচড়ে দিতে পারলেও ওর মনে শান্তি হবে।
“যদি বিকেল পর্যন্ত এই বারবেকিউতে টিঁকে থাকতে পারি,” মনে মনে ভাবল স্কারলেট, “মেয়েরা যখন বিশ্রাম নেবার জন্য ওপরে চলে যাবে, আমি নীচে থেকে যাব অ্যাশলের সাথে কথা বলার জন্য। আমার জনপ্রিয়তা ও নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবে।” তারপর আর একটা কথা ভেবে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। “মেলানির দিকে নজর না দিয়ে ওর কোন উপায়ও তো ছিল না। ওর পিসতুতো বোন বলে কথা! আর আমার মত জনপ্রিয়তাও তো বেচারার নেই। অ্যাশলে নজর না দিলে বেচারা একেবারে একা হয়ে যেত।”
ভাবনাটা ওর মনে বেশ সাহস সঞ্চার করল। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবার চার্লসের প্রতি মনোনিবেশ করল। চার্লসের বাদামি চোখ আশায় জ্বলজ্বল করে উঠল। দিনটা ওর কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। স্কারলেটের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। হানি ওর স্মৃতি থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। হানি যেন কর্কশকন্ঠী চড়াই পাখি। আর স্কারলেট সুরেলা খঞ্জনা পাখি। স্কারলেট ওর সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করতে লাগল। হাজারটা প্রশ্ন করে চলল। তারপর আবার নিজেই জবাব দিয়ে দিল। অন্যদের মাঝে ওকে চটপটে প্রমাণ করার জন্য। স্কারলেটের এই পক্ষপাত লক্ষ্য করে অন্য ছেলেরা খানিক হতবুদ্ধি আর খানিক বিরক্ত হল। চার্লস! যে কিনা পরপর দুটো কথা গুছিয়ে বলতে পারে না! ভদ্রতা দিয়ে রাগ ঢাকা দেওয়া ওদের পক্ষে বেশ শক্ত হয়ে পড়ল। অ্যাশলে ছাড়া সবাই রাগে ফুঁসছে। তবুও জয়ের আনন্দটা মাটি হয়ে গেল।
খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরে স্কারলেট আশা করছিল যে ইন্ডিয়া আসর গুটিয়ে মহিলাদের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলবে। প্রায় দুটো বাজে। মাথার ওপরে সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে। কিন্তু তিন দিনের ধকলে ক্লান্ত ইন্ডিয়ার গাছের ছায়ায় বসে থাকতে ভালই লাগছিল। ফ্যেয়াটভিল থেকে আসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছিল। উনি কানে একটু কম শোনেন।
চারপাশে একটা অলস আচ্ছন্ন পরিবেশ। নীগ্রো দাসদাসীরা টেবিল পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। হাসিঠাট্টা, কথাবার্তা ঝিমিয়ে এসেছে। অনেকেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। সকলেই হোস্টেসের সকালের আসরের সমাপ্তির প্রতীক্ষা করছেন। তালপাতার পাখাও অনেক মন্থর গতিতে চলছে। অনেক ভদ্রলোকই ভরপেট ভোজনের পর গরমে ক্লান্তি প্রকাশ করছেন। বারবেকিউ শেষ হল। সূর্য মধ্যগগনে থাকা পর্যন্ত সবাই একটু বিশ্রাম নিতে চাইছিল।
সকালের সরগরম পার্টির পর, সন্ধ্যাবেলা বলডান্স শুরু হবার মাঝে এই মধাহ্ন বিরতির সময়ে সকলেই মোটামুটি শান্ত। শুধু তরুণের দল এখনও তাদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা বজায় রেখেছে। বিভিন্ন দলে গিয়ে গিয়ে মৃদুস্বরে কথাবার্তা চালিয়ে নিজেদের চাঙ্গা রাখছে। এরা চঞ্চল ঘোড়ার মতই সুন্দর আর বিপজ্জনক। উত্তেজনার কারণ ঘটলে এরা মুহুর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।
আরো খানিকটা সময় কেটে গেল। সূর্যের তাপ আরো বেড়েছে। স্কারলেট এবং অন্যরা ইন্ডিয়ার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। প্রায় নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ সকলে খানিক দূর থেকে জেরাল্ডের বাজখাঁই গলা শুনতে পেল। জন উইল্কসের সঙ্গে কোন ব্যাপারে জোর তর্ক চলছে।
“গুলি মারুন আপনার সন্ধিচুক্তিকে! ওই ইয়াঙ্কি বদমাশদের সাথে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা! যাদের আমরা ফোর্ট সামটারে গুঁড়িয়ে দিয়েছি? শান্তিপূর্ণ, ফুঃ! আমরা দক্ষিণের লোকরা যুদ্ধ করে বুঝিয়ে দেব যে আমরা অপমান সহ্য করব না! আমরা ওদের দয়ায় ইউনিয়ন ছাড়ছি না। নিজেদের জোরে ছাড়ছি।”
“হে ভগবান!” স্কারলেট ভাবল। “আবার শুরু করেছেন! হয়ে গেল, এখন মাঝরাত অব্দি বসে থাকতে হবে!”
মুহুর্তের মধ্যে ঝিমিয়ে পড়া পরিবেশ আবার সরগরম হয়ে উঠল। বেঞ্চ আর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে, হাত নেড়ে, হই হট্টগোল করতে করতে সকলেই নিজের নিজের দৃষ্টিভঙ্গী অন্যদের শোনানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এতক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতি, আসন্ন যুদ্ধ, এসব ব্যাপারে কোন কথাই বলা হয় নি। জন উইল্কস অনুরোধ করেছিলেন যে মহিলারা যাতে বিরক্তবোধ করেন এমন কোন বিষয় নিয়ে যেন আলোচনা না করা হয়। কিন্তু জেরাল্ড “ফোর্ট সামটার” বলে চেঁচিয়ে উঠতেই সকলেই হোস্টের নিষেধাজ্ঞা বেমালুম ভুলে গেল।
“যুদ্ধ তো নিশ্চয়ই করব __” “ইয়াঙ্কি চোর সব ___” “এক মাস লাগবে ওদের __” “আরে ওদের কুড়িজনের মোকাবেলায় আমাদের একজনই যথেষ্ট __” “এমন শিক্ষা দেব যে সহজে ভুলবে না ___” “শান্তিপূর্ণভাবে? ওরা শান্তিতে থাকতে দেবে না কি?” “ আমাদের কমিশনারদের মিস্টার লিঙ্কন কি ভাবে অপমান করেছিলেন!” “তাই তো দিনের পর দিন ফেলে রেখেছিলেন – সামটার নাকি খালি করিয়েই ছাড়বেন!” “ওরা যুদ্ধ চায়; এমন শিক্ষা দেব যে যুদ্ধের নাম শুনলেই পালাবে!” আর সবার গলা ছাপিয়ে গিয়ে জেরাল্ডের গলা শোনা গেল “রাষ্ট্রের অধিকার, ভগবানের দোহাই!” বার বার বলছিলেন। জেরাল্ড উপভোগ করছিলেন পরিস্থিতিটা; কিন্তু তাঁর মেয়ে নয়।
“বিচ্ছিন্নতা”, “যুদ্ধ” কথাগুলো শুনতে শুনতে স্কারলেট বিরক্ত হয়ে গেছিল। কিন্তু এখন শুনে ওর ঘেন্না হতে লাগল। এর মানে পুরুষরা এখন ঘন্টার পর ঘন্টা এটা নিয়ে হ্যাজাবে, আর ওর অ্যাশলের সঙ্গে একলা কথা বলার সুযোগ আসবে না। এরা ভাল করেই জানে এই যুদ্ধটুদ্ধ কিছুই হবে না শুধু এঁদের এই নিয়ে চেঁচামেচি করতে ভাল লাগে!
অন্যদের সাথে চার্লস হ্যামিল্টন কিন্তু চলে যায় নি। তুলনামুলকভাবে স্কারলেটকে একা পাওয়া গেছে। আরো একটু ঘনিয়ে বসে, নবলব্ধ সাহসে ভর করে একটা স্বীকারোক্তি করে ফেলল।
“মিস ও’হারা – আমি – আমি ঠিক করেছি – যদি যুদ্ধ হয় তাহলে সাউথ ক্যারোলাইনার ট্রুপে যোগ দেব। শুনেছি মিস্টার ওয়েড হ্যাম্পটন ওখানে একটা অশ্বারোহী বাহিনী তৈরি করছেন। আমি ওঁর সাথেই যেতে চাই। খুব ভাল মানুষ। আমার বাবার সবথেকে প্রিয় বন্ধু।
চার্লসের ভাব দেখে স্কারলেট বুঝল যে ওর মনের গোপনতম কথাটা ওকে বলে ফেলেছে। ভাবল, “শুনে আমি করব? হাততালি দেব?” কিন্তু বলার কিছু পেল না, তাই ওর দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকল। ছেলেরা কেন যে বোকার মত ভাবে এসব ব্যাপার জানার জন্য মেয়েদের খুব আগ্রহ! চার্লস ওর এই চুপ করে থাকাটাকে ধরে নিল যে খবরটা শুনে স্কারলেট হতচকিত হয়ে পড়েছে, তাই সাহস পেয়ে বলে চলল –
“যদি যাই – তোমার – তোমার মন খারাপ হবে মিস ও’হারা?”
“প্রত্যেকদিন তোমার জন্য বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদব,” একটু ফাজলামির সুরে বলল স্কারলেট। কিন্তু চার্লস কথাটাকে সত্যি ভেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। খুব সাবধানে স্কারলেটের একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে আস্তে করে চাপ দিল। নিজের সাহসে আর স্কারলেটের আপত্তি না করায় একেবারে বিহ্বল হয়ে গেল।
“রোজ আমার জন্য প্রার্থনা করবে?”
“কি বুদ্ধু রে বাবা!” ভাবল স্কারলেট। তারপর আড়চোখে ইতিউতি চাইল নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় খোঁজার জন্য।
“করবে?”
“ও – হ্যা নিশ্চয়ই। কম করে তিনবার করে জপ করব – প্রত্যেক রাতে!”
চার্লস চকিতে একবার চারদিক দেখে নিল। একবার জোরে নিঃশ্বাস নিল। পেটের কাছের পেশিগুলো টান টান করে নিল। আশেপাশে কেউই নেই। এরকম সুযোগ সুচরাচর পাওয়া যায় না। যদি পাওয়াও যায়, হয়ত সাহসে কুলোবে না।
“মিস ও’হারা – তোমাকে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে – আমি – আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
“উঁ? স্কারলেট অন্যমনষ্ক ভাবে বলল। তর্কাতর্কিতে ব্যস্ত মানুষদের মধ্যে ও অ্যাশলেকে খুঁজছিল। এখনও মেলানির পায়ের কাছে বসে গল্প করছে।
“হ্যা!” নিবিড় উত্তেজনায় চার্লস ফিসফিস করে বলল। এই রকম পরিস্থিতিতে মেয়েরা যেটা করে থাকে – হাসা, চেঁচিয়ে ওঠা, কিংবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলা – স্কারলেট সেরকম কিছুই করল না। “আমি তোমাকে ভালোবাসি! তুমি – তুমি হলে খুব ____” এই প্রথম জড়তা ওকে গ্রাস করল না। “আমার দেখা সব থেকে সুন্দরী মেয়ে। তোমার কত মিষ্টি ব্যবহার! তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। আমি ভাবতেই পারি না তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসবে! মিস ও’হারা, তোমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি! আমি ____”
চার্লস থেমে গেল। ভালবাসার গভীরতা বোঝাবার জন্য কোন কঠিন কাজের কথা বলা যেতে পারে সেটা ওর মাথায় এল না। তারপর সোজাসুজি বলল, “আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।”
“বিয়ে” কথাটা শুনে স্কারলেট ধাক্কা খেয়ে বাস্তবে ফিরে এল। এতক্ষণ মনে মনে “বিয়ে”র কথাই ভাবছিল। অ্যাশলের সাথে ওর। চোখেমুখে বেশ বিরক্তি নিয়েই চার্লসের দিকে তাকাল। কেন এই বোকা হাবাটা ওর ভাবনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে? আজকের এই বিশেষ দিনটাতে? যখন ওর মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়! ওর নরম বাদামি চোখের দিকে তাকিয়ে একবারও ওর প্রথম প্রেমের সলজ্জ অনুভুতিটা দেখতে পেল না। দেখতে পেল না ওর মধ্যে এক অনির্বচনীয় আনন্দের প্রকাশ। ভালবাসার যে প্রদীপ ওর মধ্যে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে সেটা খেয়াল করল না। অনেক ছেলেই ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে থাকে। এটা ওর কাছে নতুন নয়। চার্লস হ্যামিলটনের থেকে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক পুরুষেরা। যারা অনেক বেশি বাকপটু। কত জরুরি ব্যাপার এখন ওকে মাথায় রাখতে হচ্ছে, আর তখনই কিনা ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে! ওকে দেখে স্কারলেটের মনে হল যেন কুড়ি বছরের লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া একটা মূর্খ! এই কথাগুলো সোজাসুজি বলে ফেলতে গিয়েও এলেনের শিক্ষা মনে পড়ে গেল। তাই ওর মুখ থেকে এরকম পরিস্থিতিতে যেটা বলা উচিত সেটাই বেরোল। আস্তে আস্তে বলল, “মিস্টার হ্যামিলটন, তুমি আমার পাণিগ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়ে আমাকে যে সম্মান দিয়েছ তাতে আমি খুবই অভিভূত। কিন্তু ব্যাপারটা এতই আকস্মিক যে আমার কি বলা উচিত তা বুঝতে পারছি না।”
মর্যাদায় আঘাত করাও হল না আবার ব্যাপারটাকে আপাতত মুলতুবী করে রাখাও গেল। এ ধরনের টোপ চার্লসের কাছে নতুন, তাই কথাটা হজম করে নিল।
“আমি সারাজীবন তোমার অপেক্ষা করব। তুমি মন থেকে চাইলেই আমি তোমাকে বিয়ে করব। মিস ও’হারা , একবার শুধু বলে দাও যে আশা করব কি না?”
“উঁ,” বলল স্কারলেট। দেখল অ্যাশলে এখনও মেলানির দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। এই বোকাটা হাত ধরে আছে থাকুক, কিন্তু যদি একটু চুপ করে থাকে তাহলে ওদের কথাবার্তাটা শুনতে পারে! কি বলাবলি করছে ওরা জানাটা খুব দরকার। কি এমন বলছে মেয়েটা যে অ্যাশলে এত আগ্রহ নিয়ে শুনছে?
চার্লস আবার কথা বলে উঠতেই আর কিছু শুনতে পেল না।
“একটু চুপ কর না!” ওর হাতে একটু চাপ দিয়ে স্কারলেট হিসহিসিয়ে উঠল। ওর মুখের দিকেও তাকাল না।
চার্লস প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল। তারপর দেখল স্কারলেট গভীর দৃষ্টিতে ওর বোনকে দেখছে। বুঝতে পারল, পাছে ওর বোন ওদের কথাবার্তা শুনে ফেলে তাই স্কারলেটের ভয়। ও হেসে ফেলল। ভয় কিংবা লজ্জা পাওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। জীবনে এই প্রথম ও কোন মেয়ের লজ্জা পাওয়ার কারণ হল। চিন্তাটা ওর মধ্যে একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করল। ও স্কারলেটের হাতে চাপ দিয়ে নীরবে বোঝাল ও কিছু মনে করে নি।
স্কারলেট খেয়ালও করল না। ও তখন স্পষ্ট মেলানির সুরেলা কন্ঠ – যেটাই ওর একমাত্র গুণ – শুনতে পাচ্ছে, “আমি কিন্তু মিস্টার থ্যাকারের কাজের ব্যাপারে তোমার সাথে একমত হতে পারলাম না। উনি খুব ছিদ্রান্বেষী। আর মিস্টার ডিকেন্সের মত ভদ্রলোক নন মোটেই।”
একজন পুরুষমানুষের সঙ্গে কি বোকা বোকা কথা! স্বস্তি পেয়ে স্কারলেট মুখ টিপে হাসল। আসলে ওর মধ্যে খুব লেখাপড়া জানার অহঙ্কার। মেয়েদের লেখাপড়া জানার অহঙ্কারকে ছেলেরা কেমন ভাবে নেয়, সেটা স্কারলেটের ভালই জানা আছে। আরে পুরুষমানুষ কি নিজেকে ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কথা শুনতে ভালবাসে নাকি? যদি মেলানিকে বলতে শুনত, “তোমাকে কি দারুণ লাগছে!” বা “তুমি কেমন করে এত সব জান?” কিংবা “এসব আমার ছোট মাথায় ঢুকবে না।” তাহলে অবশ্যই চিন্তার কারণ ছিল। আর ও কি না ওর পায়ের কাছে বসে থাকা ছেলেটার সঙ্গে এমন গম্ভীরভাবে কথা বলছে যেন ও গির্জায় রয়েছে! মনে মনে নিজের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা ভেবে খুশিয়াল হয়ে উঠল। এত খুশি হল যে চার্লসের দিকে ফিরে হাসল। আনন্দের হাসি। খুশির আতিশয্যে ওর পাখাটা নিয়ে এত জোরে বাতাস করতে শুরু করল যে স্কারলেটের চুল এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল।
“অ্যাশলে, তোমার মতটা জানতে পারলাম না,” উত্তেজিত মানুষদের দিক থেকে ঘুরে, জিম টার্লটন বললেন। মাপ চেয়ে অ্যাশলে উঠে দাঁড়াল। এই ভিড়ের মধ্যে ওর মত সুপুরুষ আর কাউকেই মনে হল না স্কারলেটের। মাথার সোনালি চুলে আর গোঁপে সূর্যের আলো পড়ে ঠিকরে পড়ছে। অনেক বয়ষ্ক মানুষও ওর কথা শুনতে এগিয়ে এলেন।
“দেখুন, জর্জিয়া যদি যুদ্ধে যোগদান করে, তবে আমি নিশ্চয়ই যুদ্ধে যাব। এইজন্যই তো আমি ট্রুপে নাম লিখিয়েছি, তাই না?” ও বলল। ওর ধূসর চোখ থেকে স্বপ্নালুভাব উধাও। এরকমটা স্কারলেট আগে কখনও দেখে নি। “কিন্তু বাবার মত আমারও মনে হয়, ইয়াঙ্কিরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে। মনে হয় শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হবে না __” ফোনটেন আর টার্লটন ছেলেদের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করে একটু হেসে হাতটা ওপরে তুলল। “ঠিক ঠিক, জানি ইয়াঙ্কিরা আমাদের অপমান করেছে। মিথ্যে বলেছে। তাও ধরা যাক, আমরা ওদের জায়গায় হতাম – আমরা কি চাইতাম – যদি ওরা ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইত? ঠিক তাই! আমাদের ভাল লাগত না।”
“আর পারি না!” স্কারলেট ভাবল। “সব সময় অন্যের দৃষ্টিভঙ্গী বোঝার চেষ্টা।” স্কারলেটের কাছে যে কোনো বিতর্কে একটাই মাত্র সঠিক দিক। মাঝে মাঝে অ্যাশলেকে ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।
“বেশি মাথা গরম করারও দরকার নেই আর যুদ্ধ যুদ্ধ করে বেশি লাফালাফি করারও দরকার নেই। পৃথিবীর বেশির ভাগ দূর্দশার মূলেই এই যুদ্ধ। যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় তখন কেউ বুঝতেই পারে না লড়াইটা কেন হচ্ছিল!”
স্কারলেট নাক কুঁচকালো। ভাগ্যে অ্যাশলের অসমসাহসিকতার জন্য সুনাম আছে। নইলে আজ সমস্যা হত। ভাবতে না ভাবতেই, অ্যাশলের কথার সূত্র ধরে চারদিক থেকে জোর গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। অনেকেরই চোখে মুখে চাপা রাগ। গলার স্বরে অসন্তোষ।
গাছের ছায়ায় চেয়ারে বসে থাকা সেই কানে কম শোনা ফ্যেয়াটভিলের ভদ্রলোক ইন্ডিয়াকে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, “কি নিয়ে এই ঝগড়া? কি বলছে ওরা?”
ইন্ডিয়া ওঁর কানের কাছে হাত জড়ো করে চেঁচিয়ে জবাব দিল, “যুদ্ধ! ওরা ইয়াঙ্কিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়।”
“যুদ্ধের কথা বলছে? তাই নাকি?” উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে পড়ে লাঠিতে ভর করে দাঁড়ালেন। “আমি ওদের যুদ্ধের কথা বলব। আমি যুদ্ধে গিয়েছি!” মহিলারা সব সময় দমিয়ে রাখে বলে মিস্টার ম্যাকরে বিশেষ কথা বলার সুযোগ পান না।
কোনমতে লাঠিতে ভর দিয়ে উনি ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। যেহেতু উনি আর কারও কথাই শুনতে পাচ্ছিলেন না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, উনিই মাঠ দখল করে ফেলেছেন।
“তোমাদের বয়সও কম, মাথাও গরম। শোন আমি কি বলছি। তোমরা লড়াই করতে চাও না। আমি লড়াই করেছি। সেমিনোলের যুদ্ধে। ১ আমি এত বোকা ছিলাম যে মেক্সিকান যুদ্ধেও ২ গেছিলাম। যুদ্ধ কি জিনিস, তোমরা জানোই না! তোমরা মনে কর যুদ্ধ মানে হল, ভাল ভাল ঘোড়ায় চড়া আর মেয়েরা তোমাদের ফুল ছুঁড়ে বিদায় জানাবে। তারপর যখন ফিরে আসবে তখন বীরের সম্মান দিয়ে অভ্যর্থনা করবে! না তা নয়! যুদ্ধ মানে খিদের জ্বালা; হাম কিংবা নিউমোনিয়ায় ভোগা। ভিজে মাটিতে শোয়ার জন্য! আর ধর হাম কিংবা নিউমোনিয়ায় তুমি কাবু হলে না। তোমার পেট! তোমরা জানোই না যুদ্ধে আমাদের পেটের অবস্থা কি হয়! আমাশা, পেট খারাপ, আর _____” [১ সেমিনোলের যুদ্ধ – ফ্লোরিডার যুদ্ধ - সেমিনোল আর আমেরিকার সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াই। ১৮১৬ তে শুরু হয়। শেষ হয় ১৮৫৮ তে। মাঝে মাঝে বিরতি ছিল।] [২ মেক্সিকান যুদ্ধ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টেক্সাস দখল করার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত চলা মেক্সিকোর সঙ্গে যুদ্ধ]
মেয়েরা লজ্জায় বেজায় লাল হয়ে গেল। আসলে মিস্টার ম্যাকরে আর ঠাকুমা ফোনটেন যে যুগের মানুষ তখনকার মানসিকতা ছিল অনেক বেশি স্থূল; ঠাকুমা ফোনটেনরা সশব্দে ঢেকুর তুললেও কিছু বলার ছিল না, কিংবা মিস্টার ম্যাকরেও এমন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন যেটা আজকের প্রজন্ম ভাবতেই পারে না।
“তাড়াতাড়ি যাও, দাদুকে নিয়ে এস!” ওঁর মেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক অল্পবয়সী মেয়েকে বললেন। “কি বলব, দিনে দিনে ওঁর মুখের ভাষা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!” আশেপাধের মহিলাদের উদ্দেশ্য বললেন। “বিশ্বাস করতে পারবে না আজ সকালে মে্রীকে কি বলছিলেন! আর মেরী মাত্র ষোল!” তারপর ফিসফিস করে কি বললেন সেটা আর অন্য কেউ শুনতে পেলেন না। নাতনী দাদুকে ফিরিয়ে আনতে চলে গেল।
গাছের ছায়াতে বসে মেয়েদের দল কারণে অকারণে হাসছে; ছেলেরা একটু আধটু কথাবার্তা বলছে। শুধু একজন ব্যাক্তি কোন কথাবার্তা না বলে শান্ত ছিলেন। স্কারলেটের চোখ রেট বাটলারের ওপর পড়ল। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। একাই ছিলেন, কারণ মিস্টার উইল্কস অন্য কোথাও গেছেন। যখন বাদানুবাদ চলছিল, তিনি একটি কথাও বলেন নি। সযত্নে ছাঁটা কালো গোঁপের নীচে দৃঢ়বদ্ধ লাল অধরোষ্ঠ । কালো চোখে শ্লেষের হাসি। যেন কিছু অর্বাচীন বালকের ফাঁকা আস্ফালন শুনতে হচ্ছিল। স্কারলেটের মনে হল হাসিটা কেমন যেন বেতালা। চুপচাপ শুনছিলেন; এমন সময় স্টুয়ার্ট টার্লটন বলে উঠল “আমরা ওদের একমাসেই উচিত শিক্ষা দিতে পারি! ভদ্রলোকেরা ছোটলোকদের থেকে অনেক ভাল করে যুদ্ধ করতে জানে। এক মাস – একটা লড়াই শুধু ____”
“ভদ্রমহোদয়গণ,” রেট বাটলার, চার্লসটনের ধীর বাচনভঙ্গীতে বলতে শুরু করলেন। অবস্থান পরিবর্তন করলেন না, কিন্তু পকেট থেকে হাত বের করে নিলেন। “আমি কি একটা দুটো কথা বলতে পারি?”
তাঁর চোখের ভাষায় আর আচরণে একটা অবজ্ঞা ফুটে বেরোচ্ছে, কিন্তু কন্ঠস্বরে সৌজন্য।
সবাই ওঁর দিকে ফিরে তাকিয়ে একজন বহিরাগতর যে সম্মান পাওয়া উচিত সেটা জানাল।
“আপনারা কি কখনও ভেবে দেখেছেন ম্যাসন-ডিক্সন লাইনের দক্ষিণে একটাও কামান বানাবার কারখানা নেই? অথবা আমাদের এদিকে লোহা ঢালাইয়ের কারখানার সংখ্যা কত কম? কিংবা পশমের কারখানা, কটন মিল বা ট্যানারি? এটা কি ভেবেছেন আমাদের একটাও যুদ্ধ জাহাজ নেই? ইয়াঙ্কিরা এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের বন্দরগুলো কব্জা করে নিতে পারে, যাতে আমরা বিদেশে তুলো রপ্তানি করতে না পারি? এসব নিয়ে আপনারা নিশ্চয়ই ভেবেছেন।”
“উনি কি আমাদের ছেলেদের আহম্মক মনে করেন?” স্কারলেট উষ্মার সঙ্গে ভাবল। রাগে গালদুটো লাল হয়ে গেল।
ভাবনাটা শুধু স্কারলেটের মনেই এসেছে, তা নয়। ছেলেদের মধ্যেই অনেকেই রোঁয়া ফুলিয়ে যোগ্য প্রতিবাদ করবার জন্য তৈরি হল। মিস্টার উইল্কস তাড়াতাড়ি এসে বক্তার পাশে দাঁড়ালেন। সবাইকে বোঝাতে চাইলেন যে ইনি তাঁর অতিথি। আর সবথেকে বড় কথা ওখানে মহিলারাও রয়েছেন সেটা ভুললে চলবে না।
“আমাদের দক্ষিণের মানুষদের মুশকিল হল,” রেট বাটলার বলে চললেন, “– হয় আমরা বেশি ভ্রমণ করি না, আর নয়ত ভ্রমণ করলেও তার থেকে কোন শিক্ষাগ্রহন করি না। জানি আপনারা সকলেই দেশে বিদেশে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু কি দেখেছেন? ইউরোপ, নিউ ইয়র্ক আর ফিলাডেলফিয়া, আর হ্যা মহিলারা সারাটোগা গেছেন” (এই বলে তিনি গাছের ছায়ায় বসে থাকা মহিলাদের উদ্দেশ্যে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালেন)। “আপনারা হোটেলে থেকেছেন, জাদুঘরে গেছেন, বলডান্স দেখেছেন আর জুয়ার আড্ডায় গেছেন। তারপর এরকম একটা ধারণা নিয়ে ফিরেছেন, যে আপনাদের দক্ষিণের থেকে ভাল কোন জায়গাই হয় না। আমাকে দেখুন। আমার জন্ম চার্লসটনে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর হল আমি উত্তরে কাটিয়েছি।” উনি সাদা দাঁত বের করে মৃদু হাসলেন। যেন ওঁর চার্লস্টনে না থাকার কারণটা সবারই জানা। “আমি এমন অনেক কিছুই দেখেছি যেটা আপনারা দেখেন নি। হাজার হাজার অভিবাসী আছে যারা সমান্য কিছু খাবার আর টাকার বিনিময়ে ইয়াঙ্কিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত। ওদের মত কল কারখানা, ঢালাইয়ের কারখানা, জাহাজ তৈরির কারখানা, কয়লার খনি – এসব আমাদের নেই। আমাদের রয়েছে ক্রীতদাস, তূলো আর একরাশ দম্ভ। আর একমাসের মধ্যে সেটাও থাকবে না!”
চারদিকে একটা চুড়ান্ত অস্বস্তিকর নীরবতা। রেট বাটলার পকেট থেকে একটা দামী রুমাল বের করে কোটের হাতার ধুলো ঝাড়তে লাগলেন। জনতার মধ্যে থেকে অসন্তোষের গুঞ্জন উঠল। মৌচাকে ঢিল পড়লে যেরকম আওয়াজ হয়, গাছের ছায়ায় বসা মহিলাদের মধ্যেও সেরকম গুনগুন শুরু হয়ে গেল। উত্তেজনা স্কারলেটকেও প্রভাবিত করল। তবু ওর কেমন যেন মনে হল ভদ্রলোক যেটা বলছেন সেটা হয়ত মিছে নয়; বরং যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য। সত্যিই তো ও কখনও কারখানা দেখে নি, আর দেখেছে বলে কাউকে বলতেও শোনেনি। যাই হোক ওনাকে কোনমতেই ভদ্রলোক বলা চলে না। আর এখানে সবাই ফুর্তি করতে এসেছে। তাই এই কথাগুলো ওনার বলা উচিত হয় নি।
ভুরু কোঁচ করে স্টুয়ার্ট এগিয়ে গেল, পেছনে ব্রেন্ট। বারবেকিউতে আপত্তিকর কোন দৃশ্যের অবতারণা না করার মত শিক্ষা ওদের আছে। বিরক্তির যথেষ্ট কারণ থাকলেও। তবুও উপস্থিত মহিলারা মনে মনে কিছুটা হর্ষ অনুভব করলেন। সরাসরি এই ধরনের বিবাদ দেখার সুযোগ সাধারণত হয় না। তৃতীয়পক্ষের মুখ থেকে যেটুকু জানা যায়।
“স্যর,” স্টুয়ার্ট খুব গম্ভীরভাবে বলল, “আপনি কি বলতে চান?”
“বলতে চাই সেটাই,” উনি বললেন, “যেটা নেপোলিয়ন বলে গেছেন – আপনি নিশ্চয়ই তাঁর নাম শুনে থাকবেন – একবার বলেছিলেন “যে পক্ষে শক্তিশালী যোদ্ধারা আছে, ভগবান সব সময় সে পক্ষে থাকেন!” তারপর জন উইল্কসের দিকে ঘুরে, অকৃত্রিম সৌজন্যের সঙ্গে বললেন, “আমাকে আপনার লাইব্রেরি দেখাবেন বলেছিলেন, স্যর। যদি এখন সেটা দেখতে চাই, তাহলে আপনার কি খুব অসুবিধে হবে? বিকেলে আমাকে জোন্সবোরোতে ফিরে যেতেই হবে। একটা জরুরি ব্যবসার কাজে।”
সবার দিকে ঘুরে খুব মার্জিত কিন্তু প্রগলভ ভঙ্গীতে মাথা হেলিয়ে বিদায় নিলেন। তারপর জন উইল্কসের সাথে লন পেরিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন। ওঁর হাসি সকলের মধ্যে একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে গেল।
অল্প কিছুক্ষণের নীরবতা, তারপর আবার মৃদু গুঞ্জন শুরু হল। ক্লান্ত ইন্ডিয়া ক্রুদ্ধ স্টুয়ার্ট টার্লটনের দিকে এগিয়ে গেল। স্কারলেট ওর কথা শুনতে পেল না। কিন্তু স্টুয়ার্টের দিকে ওর তাকানোটা দেখতে পেল। স্কারলেটের মধ্যে একটু বিবেকের দংশন হল। ঠিক মেলানি যে ভাবে অ্যাশলের দিকে তাকিয়েছিল, সেই রকম একাত্ম দৃষ্টি! যদিও স্টুয়ার্টের সেটা দেখবার চোখ নেই। তার মানে ইন্ডিয়া এখনও স্টুয়ার্টকে ভালোবাসে। এক মুহুর্তের জন্য স্কারলেটের মনে হল জোন্সবোরোতে সেদিন যদি ওভাবে স্টুয়ার্টের সাথে ওরকম খোলাখুলি ফ্লার্ট না করত, তাহলে হয়ত এতদিনে ওদের দুজনের বিয়ে হয়ে যেত। তা ওর কি দোষ? কেউ যদি নিজের প্রেমিককে আগলে না রাখতে পারে সেটা তো তারই অক্ষমতা!
স্টুয়ার্ট হাসল, শেষপর্যন্ত; অনিচ্ছার হাসি। মাথা নাড়ল। হয়ত ইন্ডিয়া ওকে মিস্টার বাটলারের পেছন পেছন গিয়ে ঝগড়া না করতে বলছে। অবশেষে যে যার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পোশাকে লেগে থাকা খাবারে টুকরো গুলো ঝেড়ে ফেলল। বিবাহিত মহিলারা তাঁদের ছেলেমেয়ে আর নার্সদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন। অল্পবয়সী মেয়েরা হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে বাড়ির দিকে এগোল কেচ্ছা আদানপ্রদান করবার জন্য আর ওপরতলায় বেডরুমে অল্প ঘুমিয়ে নেবার জন্য।
মিসেজ় টার্লটন ছাড়া অন্যান্য মহিলারা পেছন উঠোনের গাছের ছায়া ছেলেদের জন্য ছেড়ে গেলেন। মিসেজ় টার্লটনকে জেরাল্ড, মিস্টার ক্যালভার্ট এবং আরো কয়েকজন ট্রুপে ওঁর ঘোড়া দেবার ব্যাপারে ফয়সলা করার জন্য থাকতে অনুরোধ করলেন।
স্কারলেট আর চার্লস যেখানে বসেছিল, অ্যাশলে সেদিকে এগিয়ে গেল। কিছু একটা ভাবছে, কিন্তু মুখে একটা হাসি লেগে রয়েছে।
“দাম্ভিক, শয়তান, তাই না?” বাটলারে চলে যাওয়ার দিকে দেখতে দেখতে মন্তব্য করল। “মনে হয় উনি বোর্জিয়াদের৩ কেউ হবেন।” [৩ বোর্জিয়া (১৪৭৬-১৫০৭) – ইতালির একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং জেনারাল। কার্ডিনাল রোডরিগো বোর্জিয়ার – পরে যিনি পোপ অ্যালেক্সান্ডার ৪ হয়েছিলেন – অবৈধ সন্তান।]
স্কারলেট চট করে মনে করবার চেষ্টা করতে চেষ্টা করল। কিন্তু এই কাউন্টি কিংবা আটলান্টা অথবা স্যাভান্নাতে কোন বোর্জিয়া পরিবারের কথা মনে করতে পারল না।
“আমি ওঁদের চিনি না। উনি কি ওঁদের কোন আত্মীয়? ওঁরা কারা?”
অবিশ্বাস, লজ্জা আর ভালবাসা মেশানো অদ্ভুত দৃষ্টিতে অ্যাশলে ওঁর দিকে তাকাল। শেষপর্যন্ত ভালবাসারই জয় হল। মেয়েদের সুন্দরী আর শান্ত হওয়াটাই বেশি দরকারি। লেখাপড়া বেশি জানলে মেয়েদের মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়। ভাবল ও। তারপর হেসে বলল, “বোর্জিয়ারা ইতালির লোক ছিলেন।”
“ওহ,” স্কারলেটের আর আগ্রহ নেই। “বিদেশী।”
স্কারলেট মধুর ভাবে হাসল, কিন্তু দেখল অ্যাশলের নজর ওর দিক থেকে ঘুরে গেছে। ও চার্লসের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে একটু উপলব্ধির চিহ্ন, সঙ্গে সহানুভূতির ছোঁয়া।
**
সিড়ির ল্যান্ডিংএ দাঁড়িয়ে থামের ওপর দিয়ে সন্তর্পনে উঁকি মেরে স্কারলেট দেখল যে নীচের হলঘরটা ফাঁকা রয়েছে। ওপরে বেডরুম থেকে কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। কখনও জোরে, কখনও আস্তে; মাঝে মাঝে খিল খিল করে হাসির শব্দ; “সত্যি, বললি!”, “তারপর কি হল!” এ ধরনের দু’চারটে কথা। বড় বড় ছ’টা শোবার ঘরে, মেয়েরা বিশ্রাম করছে। ঢিলে পোশাক পরে, চুল খুলে। দুপুরে অল্প ঘুমোনোর অভ্যেস এই কাউন্টিতে বরাবর আছে, বিশেষ করে এই রকম পার্টির দিনে সকাল থেকে হই হুল্লোড় করে সন্ধ্যাবেলা বল ডান্সের আগে প্রয়োজনও হয়। প্রথম আধঘন্টা হাসি ঠাট্টা চলবে; তারপর দাসীরা দরজা ভেজিয়ে দেবে তখন আধো অন্ধকারে খানিকক্ষণ ফিসফাস চলবে; তারপর ঘুমিয়ে পড়বে।
স্কারলেট প্রথমে নিশ্চিত হল যে মেলানি হানি আর হেট টার্লটনের সঙ্গে শুয়ে পড়েছে। তারপর হলঘর দিয়ে নীচে নামতে লাগল। ল্যান্ডিংএর জানালা থকে দেখল ছেলেরা গাছের ছায়ায় লম্বা ,লম্বা গ্লাসে পানীয় নিয়ে গল্পগুজব করছে। ওরা বিকেলের শেষ অবধি ওখানেই থাকবে। অ্যাশলেকে ওঁদের মধ্যে দেখতে পেল না। তারপর একটু কান পাততেই ওর গলা শুনতে পেল। যেমন ভেবেছিল, ও ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে প্রস্থানরত বিবাহিতা মহিলা আর তাঁদের ছেলে মেয়েদের বিদায় জানাচ্ছে।
দুরুদুরু বুকে ও তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এল। যদি মিস্টার উইল্কসের মুখোমুখি পড়ে যায়, কি লজ্জার ব্যাপার হবে! সব মেয়েরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছে, তখন ওর ঘোরাঘুরির জন্য কি অজুহাত দেবে? কিন্তু এই ঝুকিটা ওকে নিতেই হবে।
সিঁড়ির নীচের ধাপে পৌঁছাতেই ডাইনিং রুমে চাকরবাকরদের চলাফেরার শব্দ পেল। খানসামার নির্দেশে চেয়ার টেবিল সরাচ্ছে, রাত্রে বলডান্সের অনুষ্ঠানের জন্য। হলঘরের উল্টোদিকে লাইব্রেরির দরজাটা খোলা। পা টিপে টিপে ওখানে ঢুকে পড়ল। যতক্ষণ না অ্যাশলের বিদায়পর্ব শেষ না হয়, ওখানেই অপেক্ষা করবে।
পর্দা টানা থাকায়, লাইব্রেরিটা প্রায় অন্ধকার। অল্প আলোতে, চারদিকে বড় বড় দেওয়াল জুড়ে বই দেখে স্কারলেট বিষণ্ণতাবোধ করল। দেখা হওয়ার জন্য এরকম একটা জায়গা ওর কল্পনায়ই ছিল না। বই দেখলেই ও বিষন্ন বোধ করে; যারা সারাক্ষণ বই মুখে নিয়ে বসে থাকে তাদের দেখলেও। মানে – একমাত্র অ্যাশলেকে ছাড়া! আলো আঁধারিতে ভারি ভারি আসবাবপত্রগুলো যেন ওকে গিলে খেতে লাগল। বড় বড় লম্বা পিঠওয়ালা সোফা – লম্বা গড়নের উইল্কস পুরুষদের জন্য। উইল্কস মহিলাদের জন্য মাটির ওপরে বসবার গদী। ঘরের অন্যদিকে, যেখানে শীতকালে আগুন জ্বালানো হয় সেখানে অ্যাশলের প্রিয় সাত ফুট লম্বা সোফা। একটা ঘুমন্ত পশুর মত শুয়ে আছে।
অল্প একটু ফাঁক রেখে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। হৃৎস্পন্দন সংযত করার চেষ্টা করল। তারপর কাল রাত্রে অ্যাশলেকে কি কি বলবে বলে ভেবে রেখেছিল সেগুলো মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই মনে পড়ল না। ও কি অ্যাশলেকে কিছু বলবে বলে ভেবেছিল? না কি অ্যাশলেই ওকে কিছু বলবে বলে আশা করেছিল? নাহ মনে পড়ছে না। হঠাৎ একটা শীতল ভয়ের স্রোত ওকে গ্রাস করে নিতে চাইল। ওহ, যদি মনটাকে একটুও শান্ত করতে পারত, তাহলে ঠিকমত ভাবতে পারত! যখন ও বুঝতে পারল অ্যাশলের বিদায়দানপর্ব শেষ হয়ে গেল, তখন ওর হৃৎস্পন্দন আরো বেড়ে গেল।
একটা কথাই খালি ওর মনে ঘুরে ফিরে আসতে লাগল যে ও অ্যাশলেকে ভালবাসে – ওর সব কিছুকে। ওর সোনালি চুলওয়ালা মাথার উদ্ধত ভঙ্গী, ওর হাসি –যদিও কখনো কখনো সেটা খুব রহস্যময় লাগে – তবুও। ওর নীরবতাকেও ও ভালবাসে। শুধু যদি ও নিজে থেকে ভেতরে এসে ওকে নিজের বাহুতে টেনে নেয়! তাহলে নিজে থেকে কিছু বলার হাত থেকে ও অব্যহতি পায়! “যদি আমি প্রার্থনা করি ___”, স্কারলেট চোখবন্ধ করল, তারপর অস্ফুটে বলতে শুরু করল, “হে মেরী, দয়াময়ী ___”
“ব্যাপার কি, স্কারলেট!”, অ্যাশলের গলার স্বর শুনতে পেল, আর একেবারে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। হলে দাঁড়িয়ে অ্যাশলে দরজার ফাঁকে দিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে।
“কার ভয়ে লুকিয়ে আছ? চার্লস – না – টার্লটন?”
ও ঢোঁক গিলল। তাহলে ও দেখেছে, ছেলেরা কিভাবে ওকে ঘিরে রেখেছিল! কি ভাল লাগছে ওকে! চোখদুটো ঝিকমিক করছে! ওর মধ্যের উত্তেজনার আঁচ পায় নি। বাক্যস্ফূর্তি হল না। কিন্তু হাত বাড়িয়ে ওকে ভেতরে টেনে নিয়ে এল।
ও একটু আশ্চর্য হয়েই ভেতরে এল, কিন্তু কৌতুহলও হল। স্কারলেটের মধ্যে কেমন যেন আড়ষ্ট ভাব। চোখদুটো এমন ভাবে জ্বলতে আগে কখনও দেখেনি। এত অল্প আলোতেও দেখল ওর গালদুটোয় একটা লালচে আভা। যন্ত্রচালিতের মত ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে স্কারলেটের হাত ধরল।
“কি হয়েছে,” প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
হাতের ছোঁয়া পেয়ে স্কারলেট কাঁপতে শুরু করল। বহু প্রতীক্ষিত সময় এসেছে! মাথার মধ্যে হাজার হাজার অসংলগ্ন ভাবনা এসে জড়ো হল। কিন্তু কি বলবে সেটা গুছিয়ে নিতে পারল না। শুধু একটু কেঁপে উঠে ওর মুখের দিকে তাকাল। ও কেন কিছু বলছে না?
“বল কি হয়েছে,” অ্যাশলে আবার বলল। “গোপনীয় কিছু – আমাকে বলতে চাও?”
হঠাৎ ও কথা খুঁজে পেল। এলেনের এত বছরের সহবত শিক্ষা বিফল হয়ে গেল। বরং জেরাল্ডের আইরিশ রক্তের প্রভাব ওঁর মেয়ের কথায় ফুটে উঠল।
“হ্যা – খুব গোপন কথা। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
হঠাৎ চারপাশ এত নিস্তব্ধ হয়ে গেল যেন দুজনের কেউই নিঃশ্বাসটাও নিতে ভুলে গেছে! আস্তে আস্তে ওর কাঁপুনি কমে এল। একটা ভালোলাগার অনুভুতিতে মন ভরে উঠল। কেন এই কাজটা আগেই করেনি? লেডি সাজবার মিথ্যে বিড়ম্বনার থেকে এটা কত সহজ! তারপর ও অ্যাশলের চোখের দিকে তাকাল।
ওর চোখে একটা বিহ্বলতা, একটা অবিশ্বাস এবং আরো যেন কত কি – সেটা কি? এরকম দৃষ্টি একবার জেরাল্ডের চোখে দেখেছিল। ওঁর শিকারি কুকুরে পা ভেঙে যাওয়ার পর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য ওকে গুলি করে মারতে হয়েছিল, তখন। কিন্তু এই কথা এখন মনে হল কেন? কি হাস্যকর চিন্তা! কিন্তু অ্যাশলে কিছু না বলে এরকম অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে কেন? তারপর ওর মুখে সহবতের মুখোশ নেমে এল। সৌজন্যের হাসি দেখা গেল মুখে।
“আজকে তুমি মোটামুটি সব ছেলেকেই ঘায়েল করে ফেলেছ! এটাই যথেষ্ট নয় কি?” চিরাচরিত পেছনে লাগার সুরে বলল। “না কাউকেই বাদ দিতে চাও না? সে যাই হোক, তোমাকে যে আমার ভাল লাগে সেটা কখনও লুকিয়ে রাখিনি। তুমি কি সেই ভাল লাগাটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে চাইছ?”
নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়ে গেছে – সাংঘাতিক ভুল! এটা তো ঠিক ও যেরকম ভেবেছিল সেরকম হচ্ছে না। মনের মধ্যে যে হাজার হাজার ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে, তার মধ্যে একটা ভাবনা যেন দানা বাঁধতে চাইছে। অ্যাশলে হয়ত ভাবছে যে ও ফ্লার্ট করছে। কিন্তু ও আসল কথাটা জানে। হ্যা নিশ্চয়ই জানে।
“অ্যাশলে – ওহ অ্যাশলে – আমাকে বল – না তোমাকে বলতেই হবে – আমাকে জ্বালাতন কোরো না! তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? আমি তোমাকে কত ভালো ___”
অ্যাশলে তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিয়ে ওকে থামাল। পরিহাসের মুখোশ সরিয়ে ফেলল।
“এসব কথা তোমার বলা উচিত নয়, স্কারলেট! এরকম তুমি বলতে পারো না। তুমি মন থেকে একথা বলনি। একথা বলার জন্য তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। আর শোনার জন্য, আমাকেও ঘৃণা করবে।”
ঝাঁকুনি দিয়ে মাথাটা সরিয়ে নিল। ওর সারা শরীরে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে চলেছে।
“না আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারব না – কক্ষনো পারব না। সত্যি বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি জানি তুমি আমার কথা ভাব কারণ ____” ও থেমে গেল। কাউকে এত ক্লিষ্ট হতে এর আগে কখনও দেখেনি। “অ্যাশলে, তুমি আমার কথা ভাব – তাই না?”
“হ্যা,” ম্রিয়মাণ স্বরে অ্যাশলে বলল। “ভাবি।”
অ্যাশল যদি বলত ওকে ঘৃণা করে তাহলেও বোধ হয় স্কারলেট এতটা ভয় পেত না। বাকরুদ্ধ হয়ে ও অ্যাশলের শার্টের হাতাটা চেপে ধরল।
“স্কারলেট,” ও বলল, “চল না আমরা এখন যা ঘটল সেটা ভুলে যাই। যেন আমরা এরকম কিছুই বলিনি?”
“না,” স্কারলেট হিসসিয়ে বলল। “আমি পারব না। কি বলতে চাইছ? তুমি কি – আমাকে বিয়ে করবে?”
অ্যাশলে বলল, “আমি মেলানিকে বিয়ে করতে চলেছি।”
স্কারলেট খেয়াল করল যে ও একটা নীচু ভেলভেটের চেয়ারে বসে আছে। অ্যাশলে ওর পায়ের কাছে একটা গদীতে বসে শক্ত করে ওর দুহাত নিজের হাতে ধরে রেখেছে। ও অনেক কিছু বলে যাচ্ছে – এমন কিছু যার অর্থ ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ওর মাথাটা একেবারে শূন্য লাগছিল, কোন চিন্তা ভাবনা – যেগুলো এতক্ষণ ওর মাথায় ভীড় করে আসছিল – কিছুই আর আসছে না। কাঁচের ওপর বৃষ্টির জল যেমন কোন চিহ্ন রেখে যায় না, ওর কথাগুলোও মনে সেরকম কোন দাগ কাটতে পারছে না। কথাগুলোর মধ্যে স্নেহের আর্দ্র স্বর, সমবেদনায় ভরপুর। যেন বাবা তাঁর অবোধ শিশুকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
একবার মেলানির নামটা শুনতে পেয়ে ওর উজ্জ্বল ধূসর চোখের দিকে তাকাল। সেই অজ্ঞেয় আত্মনিমগ্ন চাহনি, যা স্কারলেটকে চিরদিনই হতবুদ্ধি করেছে।
“আজ সন্ধ্যেবেলা বাবা আমাদের বাগদানের কথা ঘোষণা করবেন। আমাদের বিয়েরও বেশি দেরি নেই। তোমাকে আমার বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তুমি জান। ভেবেছিলাম সবাই জানে – বহুদিন থেকেই জানে। আমি তোমাকে বিয়ে করবার কথা স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। তোমার এত পাণিপ্রার্থী। ভেবেছিলাম তুমি স্টুয়ার্টকে ____”
আবার অনুভুতি আর বোধশক্তি স্কারলেটের মধ্যে ফিরে আসতে লাগল।
“কিন্তু এই যে তুমি বললে, তুমি আমার কথা ভাব।”
“হায় স্কারলেট, যে কথা শুনলে তুমি আঘাত পাবে, আমাকে সে কথা বলতে বাধ্য করবে?”
স্কারলেট কিছু বলল না। অ্যাশলে বলে চলল।
“কি করে বোঝাই তোমাকে! তোমার বয়স অল্প; একটু হঠকারী। তাই বিয়ে কি জিনিস তুমি বুঝতে চাইছ না।”
“আমি শুধু জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
“সফল বিবাহের জন্য ভালবাসাই সব কিছু নয়। তোমার আর আমার মধ্যে ভাবনা চিন্তার কত তফাৎ! একজন পুরুষমানুষের সবটুকু তুমি দাবী করে বসবে – তার শরীর, তার হৃদয়, তার ব্যক্তিত্ব, তার মন। সবটুকু না পেলে তুমি সন্তুষ্ট হবে না। কিন্তু আমি তো তোমাকে আমার সব দিয়ে দিতে পারব না। কাউকেই পারব না। আমিও তোমার মন, তোমার ব্যক্তিত্বকে পুরোপুরি চাইব না। তুমি সেটা সহ্য করতে পারবে না – আর তখন তুমি আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। যে বই আমি পড়ি সেগুলোকে তুমি ঘৃণা করবে, ঘৃণা করবে যে সব সঙ্গীত আমি শুনতে ভালবাসি। কারণ খানিকটা হলেও তারা তোমার আমার মধ্যে দেওয়াল তুলে দেবে। হয়ত আমি __”
“তুমি কি মেলানিকে ভালোবাস?”
“ও ঠিক আমারই মত। আমার সঙ্গে ওর রক্তের সম্পর্ক। আমরা দুজন দুজনকে বুঝতে পারি। স্কারলেট! স্কারলেট! তুমি কি বুঝতে পারছ না বিয়ে করে সুখী হতে গেলে দুজনের মানসিকতা একই সুরে বাঁধা থাকা খুব দরকার?”
কেউ যেন বলেছিল, “বিয়ে করবার জন্য মনের মিল থাকা খুব জরুরি। না হলে বিয়ে সুখের হয় না।” কে বলেছিল? যেন কত লক্ষ বছর আগে কথাটা শুনেছিল। কিন্তু আজও এ কথার মানে ও বুঝে উঠতে পারেনি।
“কিন্তু তুমি বলেছিলে তুমি আমার কথা ভাব।”
“কথাটা আমার বলা উচিত হয়নি।”
মাথার মধ্যে একটা নিষ্ফল ক্রোধের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলতে শুরু করল।
“ইতরের মত কথাটা বলে এখন ___”
অ্যাশলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।
“আমি সত্যিই ইতর! মেলানিকে বিয়ে করতে চলেছি। তোমার প্রতি আমি অন্যায় করেছি! মেলানির প্রতি আরও বেশি! তোমাকে আমার বলা উচিত হয়নি কথাটা। কারণ জানতাম তুমি বুঝবে না। কি করে আমি তোমার কথা ভাবতে পার বল? তুমি এত প্রাণচঞ্চল? আর আমি একদমই নই! যেরকম প্রবল ভাবে তুমি ভালবাসতে আর ঘৃণা করতে পার, আমি কোথায় পারি? তুমি আগুন, বাতাস আর অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির মত চিরন্তন আর আমি __”
সহসা মেলানি স্কারলেটের ভাবনায় এসে পড়ল – ওর বাদামী চোখের শান্ত চাহনি, স্থৈর্য, সমাহিত নীরবতা। এক অপ্রতিরোধ্য ক্রোধের বন্যায় ও সম্পূর্ণ ভেসে গেল। যে ক্রোধের প্ররোচণায় জেরাল্ড একদিন মানুষ খুন করে ফেলেছিলেন। সেই ক্রোধ, যার জন্য ওর অনেক আইরিশ পূর্বপুরুষকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়েছিল। মার্জিত রোবিল্যার পরিবারের প্রশান্ত নীরবতা দিয়ে যে কোন বিপর্যয়কে অবজ্ঞা করার ক্ষমতার প্রকাশ ওর এই মুহুর্তের আচরণে প্রকাশ পেল না।
“আগে বলনি কেন, তুমি আমাকে বিয়ে করতে ভয় পাও? কাপুরুষ কোথাকার! তুমি সারা জীবন ওই বোকা মেয়েটার সাথে কাটাতে চাও, যে শুধু “হ্যা” আর “না” ছাড়া কিছুই বলতে পারে না! আর ওর মত মেনিমুখো বাচ্চার জন্ম দেবে! কেন ___”
“মেলানি সম্বন্ধে এরকম কোন কথা বোলো না!”
“আমি তোমার ধার ধার না! আমি কি বলব আর বলব না – সেটা তুমি বলার কে? কাপুরুষ, ইতর – তুমি – তুমি আমাকে বিশ্বাস করিয়েছিলে যে তুমি আমাকে বিয়ে করবে __”
“অন্যায় কথা বোলো না,” অ্যাশলের গলায় মিনতি। “ আমি কি কখনও ---“
কিন্তু ন্যায়পরায়ণ হবার ইচ্ছে ওর মোটেই নেই। ও জানে অ্যাশলে সত্যি কথাই বলছে। ও কখনো বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করে নি। এই কথা মনে হতেই ও আবার নতুন করে রেগে উঠল। অহঙ্কার মাটিতে মিশে যাবার জন্য রাগ, নারীসুলভ আত্মাভিমান। ওর পেছনে দৌড়ে বেড়িয়েছে, অথচ ও সেটাকে গুরুত্বই দিতে চায় না! ওই ফ্যাকাসে মেলানিকে ওর বেশি পছন্দ ওর থেকে! ভাগ্যে ও এলেন আর ম্যামির শেখানো মত কখনও অ্যাশলেকে বুঝতে দেয়নি যে ও ওকে ভালোবাসে। কি লজ্জার ব্যাপার হত তাহলে!
ও লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। হাত মূঠো করে। অ্যাশলেও উঠে দাঁড়াল। চোখে মুখে বিষণ্ণতা। যেন একটা বেদনাময় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
“সারা জীবন আমি তোমাকে ঘৃণা করব – যতদিন আমি বেঁচে থাকব! ইতর – অভদ্র __” কি কথাটা বলতে চায়? আর কোনো খারাপ কথা মনে এল না যেটা বললে শান্তি পাওয়া যায়।
“স্কারলেট – দয়া করে ___”
ও স্কারলেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। গায়ে যত জোর ছিল, স্কারলেট ওর গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিল। চাবুকের আওয়াজের মত ঘরের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল। পরমুহুর্তেই ওর রাগ কমে গেল। শুধু বুকের মধ্যে একটা হতাশা।
অ্যাশলের গালের ওপর ওর চড়ের দাগটা লাল হয়ে দেখা যাচ্ছিল। ও কিছু বলল না। শুধু স্কারলেটের অবশ হাতটা তুলে নিয়ে একবার চুম্বন করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। ওকে অন্য কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।
স্কারলেট ধপ করে বসে পড়ল। হাঁটু দুটো অবশ হয়ে গেছে। অ্যাশলে চলে গেছে। কিন্তু ওর বেদনার্ত মুখ ওকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়াবে।
লম্বা হলঘর দিয়ে ওর চলে যাবার মৃদু পদশব্দ ভেসে এল। এতক্ষণে ওর কৃতকর্মের গুরুত্ব ও বুঝতে পারল। অ্যাশলে চিরদিনের মত ওর কাছে হারিয়ে গেল। যখনই দেখা হবে ওর মনে পড়ে যাবে স্কারলেট কি কি বলেছিল। ও স্কারলেটকে সারা জীবন ঘৃণা করবে। স্কারলেটের ভালবাসায় ও তো সাড়া দেয় নি।
“আমি হানি উইল্কসের মতই বোকা,” সহসা ওর মনে হল। হানির গায়ে পড়া নিয়ে সবাই কত হেসেছিল – এমন কি নিজেও – সেটা মনে পড়ল। হানির ছেলেদের দেখে গলে যাওয়া, আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চাওয়া, হাসা এ সব মনে পড়তেই আবার রাগ চড়তে লাগল। নিজের ওপর, অ্যাশলের ওপর, গোটা দুনিয়ার ওপর। নিজেকে ঘৃণা করে তাই সবাইকে ঘৃণা করে। ওর ষোল বছর বয়সের অভিমান। নিজের আকর্ষণ করবার ক্ষমতার ওপর এতটাই বিশ্বাস ছিল যে ভালবাসার মধ্যে যে একটা কমনীয়তার ব্যাপার আছে সেটাই কখনও বুঝতে পারে নি। একটা কিছু হারানোর ভয়, তার থেকেও বড় কথা নিজেকে হাস্যাস্পদ করে ফেলার বোকামি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। সবাই কি ওকে হানির মতই পরিহাসের চোখে দেখবে?
পাশের টেবিলের ওপর ছোট মত চীনেমাটির পাত্রের ওপর হাত লেগে অন্য একটা চীনেমাটির পরীর গায়ে ধাক্কা খেয়ে খট করে আওয়াজ হল। নিস্তব্ধতার মধ্যে আওয়াজটা এত আকস্মিক যে ও চেঁচিয়ে উঠল। কিছু একটা ওকে করতেই হবে, নাহলে ও পাগল হয়ে যাবে! পাত্রটা তুলে নিয়ে জোরে সেটা ঘরের অন্য প্রান্তে ছুঁড়ে মারল। লম্বা সোফাটা কোনমতে এড়িয়ে গিয়ে একটা শ্বেতপাথরের তাকে লেগে মেঝেতে পড়ে সেটা চুরমার হয়ে গেল।
সোফার ভেতর থেকে একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেল। “এটা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি!”
এর আগে ও কখনো এতটা চমকে যায় নি বা ভয় পায় নি। মুখ শুকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। চেয়ারের পেছনটা ধরে নিজেকে সামলাল। হাঁটুতে জোর নেই। দেখল, সোফার পেছন থেকে রেট বাটলার উঠে অতিরিক্ত ভদ্রতা দেখিয়ে ওকে বাও করলেন।
“একে তো যে সব কথাবার্তা এতক্ষণ শুনতে বাধ্য হলাম, তাতেই আমার দুপুরের ঘুমটা ভেঙ্গে গেছিল। তার ওপর আবার প্রাণের ওপর হামলা!”
নাহ, ভুত নয়, উনিই সশরীরে! হে ভগবান! উনি তার মানে সবই শুনেছেন! সমস্ত শক্তি একত্রিত করে একটা আত্মমর্যাদার আবরণ তৈরি করল।
“স্যর, আপনি যে এই ঘরে আছেন, সেটা জানান দেওয়া উচিত ছিল।”
“সত্যি বলছ?” ওঁর সাদা দাতের সারি ঝিলিক মারল। ওঁর সপ্রতিভ চোখদুটো হাসছে। “অনধিকার প্রবেশ তো তুমি করলে। আমাকে মিস্টার কেনেডির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। কেন জানি মনে হল, পেছনের উঠোনে আমি অবাঞ্ছিত। তাই বিবেচনা বোধ থেকে নিজেকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এখানে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম এখানে আমাকে কেউ বিরক্ত করবে না। কিন্তু কি আর বলব!” অসহায় ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে মৃদু হাসলেন।
আবার স্কারলেটের মেজাজ চড়তে থাকল। এই দুর্বিনীত, অসভ্য লোকটা সবটাই শুনেছে! যে কথাগুলো বলে ফেলে ওর একেবারে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে!
“আপনি আড়ি পেতে শুনছিলেন __”, খুব তেজের সঙ্গে বলতে শুরু করল।
“আড়ি পাতলে অনেক রসাল আর জ্ঞানগর্ভ কথা শোনা যায়,” উনি মুচকি হেসে বললেন। আড়ি পাতার অনেক পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ____”
“স্যর,” স্কারলেট বলে ফেলল, “আপনি ঠিক ভদ্রলোক নন!”
“একদম ঠিক ধরেছ,” খুব রসিয়ে বললেন। “কিন্তু মিস, তুমিও কিন্তু ঠিক লেডি নও।” হয়ত ওকে দেখে ওঁর কৌতুকপ্রদ মনে হচ্ছিল। তাই আবার মৃদু হাসলেন। “তোমাকে যা যা বলতে শুনলাম আর করতে দেখলাম, তারপর কোন মেয়ে লেডি থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। অবশ্য আমার লেডিদের প্রতি তেমন কোন আকর্ষণ নেই। ওঁদের মনের ইচ্ছে কি সেটা বোঝা শক্ত নয়। কিন্তু ওঁরা মুখে কিছুতেই স্বীকার করবেন না। সাহস কিংবা শিক্ষার অভাব – যে ভাবে দেখবে! তাই ওঁদের সঙ্গে আমি ক্লান্ত বোধ করি। তবে, প্রিয় মিস ও’হারা, তুমি অত্যন্ত প্রশংসনীয় বিরল সাহসের অধিকারী। আমি তোমার সাহসের সম্মান করি। আমি বুঝতে পারি না তোমার মত দূর্জয় স্বভাবের মেয়ে মার্জিত রুচির মিস্টার উইল্কসের মধ্যে কি এমন পেল! ওর তো হাঁটু গেঁড়ে বসে ভগবানে কাছে ধন্যবাদ জানান উচিত যে তোমার মত – কি যেন কথাটা বলেছিল? – ‘প্রাণচঞ্চল’ - কিন্তু বেচারার মধ্যে সাহসের এতই অভাব ___”
“আপনি ওর পায়ের নখের যোগ্যও নন,” স্কারলেট রেগে বলল।
“আর তুমি না কি ওকে সারা জীবন ঘৃণা করবে!” এই বলে সোফাতে তলিয়ে গেলেন। স্কারলেট ওঁর হাসি শুনতে পেল।
যদি সম্ভব হত, স্কারলেট ওঁকে খুন করে ফেলত। তার বদলে যতটা সম্ভব ঔদ্ধত্য দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে দমাস করে দরজাটা বন্ধ করল।
**
সিঁড়ি বেয়ে দ্রুতপায়ে ওপরে উঠে এসেই মনে হল অজ্ঞান হয়ে যাবে। একটা থাম ধরে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে হাতুড়ির আঘাত পড়ছে। অপমান, ক্লান্তি, অবসাদ, সব মিলিয়ে মনে হল বুকটা ফেটে বেরিয়ে আসবে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু ম্যামি এত টাইট করে লেস বেঁধে দিয়েছে যে অসুবিধে হচ্ছে! অজ্ঞান হয়ে গেলে সবাই ওকে এই ল্যান্ডিংএ দেখতে পাবে। কি ভাববে সবাই? সব কিছুই ভাবতে পারে! অ্যাশলে, ওই নচ্ছার বাটলার লোকটা, আর হিংসুটে মেয়েরা! জীবনে প্রথমবার মনে হল সঙ্গে স্মেলিং সল্টের শিশি থাকলে ভাল হত। যেমন অন্য মেয়েদের থাকে। কখনওই মাথা ঘোরায় না বলে ওর একটা গর্ব ছিল! নাহ, কিছুতেই অজ্ঞান হওয়া চলবে না!
অস্বস্তির ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগল। মিনিটখানেকের মধ্যে আর একটু সুস্থবোধ করলে ইন্ডিয়ার ঘরের লাগোয়া ড্রেসিংরুমে গিয়ে লেসটা ঢিলে করতে হবে। তারপর ঘুমন্ত মেয়েদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে। চোখ, মুখ, শ্বাসপ্রশ্বাস সব শান্ত করতে চেষ্টা করল। কেউ যেন ওকে দেখে কোন সন্দেহ না করতে পারে। কোনো মেয়ে জেগে থাকলেই ধরে ফেলবে! কেউ – কেউ যেন এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও না জানতে পারে।
ল্যান্ডিংএর চওড়া জানালা দিয়ে দেখল গাছের ছায়ায় চেয়ারে বসে ছেলেরা এখনও গুলতানি করছে। ছেলে হওয়া কত ভাগ্যের! ওরা মন খুলে ফুর্তি করতে পারে আর ওর মত এরকম কোন দুঃখও পেতে হয় না! হঠাৎ ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পেল। খুব জোরে ছুটে আসছে। পথের নুড়িপাথরগুলো এদিক ওদিক ছিটকে পড়ছে। কেউ উত্তেজিত গলায় একজন নীগ্রোকে কিছু জিজ্ঞেস করল। আবার ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। তারপর নুড়িপাথরের পথ ছেড়ে সবুজ লন পেরিয়ে গাছের তলায় বসা লোকদের দিকে চলে গেল।
দেরি করে আসা কোন অতিথি নিশ্চয়ই। কিন্তু ইন্ডিয়ার প্রিয় লন মাড়িয়ে গেল কেন? ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে নেমে জন উইল্কসের বাহুতে হাত রাখল লোকটা। কিন্তু স্কারলেট লোকটাকে চিনতে পারল না। দেখল ওকে দেখে সবার মধ্যেই একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। গ্লাস আর তালপাআর পাখা নামিয়ে রেখে সকলে ওকে ঘিরে দাঁড়াল। একটু দূরে হলেও, স্কারলেট ওদের কথাবার্তার অস্পষ্ট আওয়াজ পাচ্ছিল। প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্ন, ডাকাডাকির শব্দ। পরিবেশ একটু থমথমে। এর মধ্যে স্টুয়ার্ট টার্লটনের গলা উঠল। উল্লসিত “ইয়ে – য়ে”, ঠিক শিকারে গেলে লোকে যেমন আওয়াজ করে। নিজের অজান্তেই ওর কানে ভেসে এল প্রতিবাদের কন্ঠস্বর।
টার্লটন ভাইরা দল ছেড়ে বেরিয়ে আস্তাবলের দিকে চলল। “জীমস – এই জীমস ঘোড়ায় লাগাম পরা” বলতে। ফোনটেন ভাইরাও ওদের পেছন পেছন এগিয়ে গেল।
“কারো বাড়িতে আগুন লেগেছে মনে হয়,” স্কারলেট ভাবল। কিন্তু আগুন লেগে থাকুক বা না লেগে থাকুক, ওর কাজ হল কেউ দেখে ফেলবার আগেই শোবার ঘরে ঢুকে যেতে হবে।
মনটা এখন অনেক শান্ত হয়েছে। পা টিপে টিপে ওপরে উঠে নিঃশব্দ হলে চলে এল। সারা বাড়ি যেন মেয়েদেরই মত তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। আবার সন্ধ্যেবেলা লাবণ্য, মোমবাতির আলো আর মধুর সঙ্গীতের ধ্বনীতে জেগে উঠবে। ড্রেসিংরুমের দরজা সাবধানে খুলে ঢুকে পড়ল। হাত দিয়ে পেছনে এখনও দরজার হাতল ধরে রেখেছে। হানি উইল্কস কিছু বলছে। খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে। বেডরুমের দরজার ফাঁক থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে।
“যাই বলিস, আজ স্কারলেট যা করেছে, সেটা এক কথায় ছেনালি।”
আবার স্কারলেটের বুকে হাতুড়ি পেটা দ্রুতগতি হয়ে গেল। অবচেতনভাবে ও বুকটা খামচে ধরল। যেন জোর করে ওটার গতি রোধ করবে। “আড়ি পাতলে অনেক রসাল আর জ্ঞানগর্ভ কথা শোনা যায়,” একটা স্মৃতি বিদ্রুপের মত ফিরে এল! বেরিয়ে যাবে নাকি? না কি হানিকে লজ্জা দেবার জন্য ওর উপস্থিতি জানান দেবে? সেটা ওর উপযুক্ত শাস্তি হবে! কিন্তু পরের গলার স্বরে সে থেমে গেল। মেলানির গলা শোনার পর ওর পালিয়ে যাবার ইচ্ছেটা চাপা পড়ে গেল।
“হানি, ছিঃ এমন নিষ্ঠুরভাবে বোলো না। ওকে কত প্রাণোচ্ছল আর ফুর্তিবাজ লাগছিল! আমার তো ওকে সবথেকে সুন্দর লাগছিল!”
“ওহ,” রাগে নখ দিয়ে ড্রেসটাকে খামচে ধরে স্কারলেট ভাবল, “শেষমেশ ওই মেনিমুখোটা আমার হয়ে কথা বলছে!”
হানির কুচুটেপনা থেকেও এটা সহ্য করে আরও কঠিন। সারা জীবনে একমাত্র নিজের মা ছাড়া আর কোন মেয়েকে ও বিশ্বাসও করেনি আর নিঃস্বার্থপরও ভাবেনি। জানে ও অ্যাশলেকে ভাল মতই হাতের মূঠোয় করে ফেলেছে, তাই উদার হতে কোন বাধাই নেই! স্কারলেটের মনে হল নিজের জয়কে প্রতিষ্ঠিত করা আর একই সঙ্গে ভাল সাজার এটাই মেলানির কৌশল। স্কারলেট নিজেও তো প্রায়ই একই কৌশলেই ছেলেদের বশ করে আর দেখায় যে ও কত ভাল আর নিঃস্বার্থপর!
“তাহলে মানতেই হবে যে তুই অন্ধ!” হানি তীক্ষ্ণস্বরে বলল।
“আস্তে হানি,” স্যালি মুনরো হিসহিসিয়ে বলল। “সারা বাড়ি তোর কথা শুনতে পেয়ে যাবে!”
হানি গলা নামিয়ে বলে চলল।
“দেখলি না, আজ ও প্রতিটা ছেলের সাথে ছেনালি করে গেল – এমন কি মিস্টার কেনেডির সাথেও – যিনি ওরই বোনের প্রেমিক! আমি বাবা এরকম কখন দেখিনি! আর চার্লসের পেছনেও পড়েছে!” হানি সচেতন ভাবে মুখ চেপে হাসল। “আর জানিসই তো চার্লস আর আমার __”
“কথাটা তাহলে সত্যি!”, কেউ একজন কৌতুহলের সঙ্গে জানতে চাইল।
“তবে, শোন, কাউকে বলিস না – এখুনি!”
সবাই আরো কিছুক্ষণ মুখ চেপে হাসাহাসি করল। হানির পেছনেও লাগল, হুল্লোড়ের চোটে বিছানায় মচ মচ শব্দ হতে লাগল। মেলানি অস্ফুটে যেন বলল হানি ওর বোন হতে চলেছে, তাই ও খুব খুশি।
“আমি বাবা ওই স্কারলেটকে আমার বোন হিসেবে পেতে চাই না – ওই দুশ্চরিত্র মেয়েটা!” হেটি টার্লটনের ক্ষুব্ধ গলা পাওয়া গেল। “আমার তো মনে হয় ওর স্টুয়ার্টের সঙ্গে কিছু একটা ব্যাপার চলছে। অবশ্য ব্রেন্ট কথাটা পাত্তাই দেয় না। আর কি বলব, ব্রেন্টও তো ওই মেয়েটাকে নিয়েই পাগল!”
“যদি আমার কাছে জানতে চাও,” হানি বেশ গম্ভীর গলায় বলল, “স্কারলেটের যদি কোন ছেলের দিকে নজর থাকে, তাহলে সে হল – অ্যাশলে!”
এই কথায় মেয়েদের মধ্যে তুমুল গুজগুজ ফুসফুস শুরু হয়ে গেল। স্কারলেটের শরীরে একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত বয়ে গেল। ভয়ে আর লজ্জায়। হানি বুদ্ধু হতে পারে, কিন্তু ওর সহজাত মেয়েলি প্রবৃত্তিকে স্কারলেট কখনই বিশেষ পাত্তা দেয় নি। অ্যাশলের প্রত্যাখ্যান আর রেট বাটলারের শ্লেষের পর কথাগুলো ওর মধ্যে হুল ফোঁটাতে লাগল। ছেলেদের তবু বিশ্বাস করা যায় – এমনকি ওই মিস্টার বাটলারের মত মানুষকেও – ওঁরা কাউকে সেধে কিছু বলতে যাবেন না। কিন্তু হানির উইল্কসের জিভের দৌলতে কাল সকাল ছ’টার মধ্যে সারা কাউন্টিতে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে যাবে! কালই না জেরাল্ড বলছিলেন যে উনি চান না কাউন্টিতে কেউ ওঁর মেয়েকে নিয়ে হাসুক। আর এখন সবাই এ নিয়ে কত হাসি ঠাট্টা করবে! আপাদমস্তক, স্কারলেটের, ঘামে ভিজে গেল।
খুব সংযত আর শান্ত স্বরে মেলানি বলল, “হানি তুমি জান যে কথাটা সত্যি নয়। আর কত নিষ্ঠুরভাবে বললে তুনি!”
“নিষ্ঠুর, কিন্তু সত্যি মেলি! তুই যদি সবার মধ্যে কেবল ভালটাই না দেখতিস, তাহলে তুইও বুঝতে পারতিস। আর এটা সত্যি বলে আমি খব খুশি! ওর সঠিক শাস্তি পাওয়া দরকার! স্কারলেট ও’হারা সবসময়ে ঝামেলা পাকিয়েছে, আর অন্য মেয়েদের প্রেমিকদের নিয়ে ফস্টিনস্টি করেছে! তুই তো ভাল করেই জানিস, ও স্টুয়ার্টকে ইন্ডিয়ার কাছ থেকে কিরকম দূরে সরিয়ে দিয়েছে! কিন্তু ও ওকে বিয়ে করবে না। আর আজ – মিস্টার কেনেডি – অ্যাশলে – চার্লস ___”
“নাহ, আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে!” স্কারলেট ভাবল, “বাড়িই যেতে হবে!”
যদি চোখের পলকে টারার নিরাপদ আশ্রয়ে উড়ে চলে যেতে পারত! যদি ও এলেনের কাছে থাকতে পারত! শুধু ওঁকে দেখতে পেত, একবার ওঁর স্কার্ট ধরে কোলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে পারত! সব কথা যদি খুলে বলতে পারত! হানির আর একটা কথা শুনতে পেলেই ও গিয়ে মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে টান মারত। মেলানি হ্যামিলটনের মুখে থুতু ছিটিয়ে বুঝিয়ে দিত ওঁর উদারতা নিয়ে ও কি ভাবে! কিন্তু আজ এমনিতেই ও অনেক লজ্জাজনক কাজ করে ফেলেছে – ছোটলোকের মত – ওখানেই যত সমস্যা!
আতে কোন খস খস আওয়াজ না হয়, তাই ড্রেসটাকে দুহাতে চেপে ধরে চুপিসাড়ে বেরিয়ে গেল। হল থেকে তাড়াতাড়ি নামতে নামতে মনে মনে বলল ‘বাড়ি’ নিস্তব্ধ ঘরগুলো আর বন্ধ দরজা পেরিয়ে যেতে যেতে ভাবল, ‘আমাকে বাড়ি যেতে হবে’।
সামনের বারান্দার কাছে পৌঁছেই একটা নতুন কথা ওর মাথায় উঁকি দিল। না, ও বাড়ি যেতে পারবে না! ও পালিয়ে যেতে পারবে না! মেয়েগুলোর দ্বেষ সহ্য করেও ওকে এর শেষ দেখে যেতে হবে। কষ্ট আর অপমান হলেও! পালিয়ে যাওয়া মানে ওদের হাতে আরও অস্ত্র তুলে দেওয়া।
সাদা থামের ওপর হাত মুঠো করে একটা ঘুসি মারল। যদি ও স্যামসন হত! টুয়েল্ভ ওকসের সব কিছু টেনে নামিয়ে গুঁড়িয়ে দিত! এখানকার প্রত্যেকটা লোককে ধ্বংস করে দিত। সবাইকে অনুশোচনা বোধ করতে বাধ্য করত। ওদের দেখিয়ে দিত ওর চিন্তা ভাবনা ওদের থেকে কত আলাদা! বোঝাতে ওকে হবেই, আজ না হয় কাল! ওদের কাছ থেকে যে আঘাত ও পেয়েছে, তার শতগুণ আঘাত ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
এই মুহুর্তে অ্যাশলেকে ওদের থেকে আলাদা করে ভাবতে পারছে না। এখন ও সেই লম্বা স্বপ্নিল চোখের ছেলে নয় যাকে ও ভালবাসে; ও উইল্কসদেরই একজন! টুয়েল্ভ ওকস, এই কাউন্টির একজন। ও এইসব কিছুকে ঘৃণা করে। ষোল বছর বয়সে প্রেমের থেকে অহঙ্কার অনেক বেশি শক্তিশালী। এখন ওঁর মনে ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছুরই স্থান নেই!
“আমি বাড়ি যাচ্ছি না,” ও ভাবল। “এখানেই থাকব আর ওদের দেখে নেব! আর মাকেও কিছু বলব না। কাউকেই বলব না।” আবার ফেরবার জন্য ঘুরে সিঁড়ি চড়তে গেল।
দেখল লম্বা হলের অন্য দিক থেকে চার্লসও বাড়িতে ঢুকছে। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, উত্তেজনায় গাল জিরেনিয়াম ফুলের মত গোলাপি। স্কারলেটকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল।
“জানো, কি হয়েছে?” কাছে আসার আগেই চেঁচিয়ে বলল। “শুনেছ? জোন্সবোরো থেকে এইমাত্র পল উইলসন ঘোড়ায় চেপে খবরটা নিয়ে এসেছে!”
ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে একটু দম নিল। স্কারলেট কিছু বলল না। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
“মিস্টার লিঙ্কন স্বেচ্ছাসেবিদের সৈন্যদলে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন – পচাত্তর হাজার জনকে!”
আবার মিস্টার লিঙ্কন! ছেলেদের কাছে কি এছাড়া আর কোন ব্যাপারেরই কোন গুরুত্ব নেই? আর এই বুদ্ধুটা ভাবছে মিস্টার লিঙ্কনের কথা শুনে আমি একেবারে আনন্দে নাচতে থাকব! যখন আমার মন এত খারাপ!
চার্লস স্কারলেটের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখ কাগজের মত সাদা আর চোখদুটো পান্নার মত জ্বল জ্বল করছে। আর কোন মেয়ের মধ্যে এরকম আগুন দেখেনি।
“সত্যি আমি কি বেয়াক্কেলে!” ও বলল। “খবরটা তোমাকে আরো একটু রইয়ে সইয়ে দেওয়া উচিত ছিল আমার। মেয়েরা এত নরম মনের হয়! তোমাকে দুঃখ দেবার জন্য খারাপ লাগছে। শরীর ঠিক লাগছে তো? তোমার জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে আসি?”
“না,” স্কারলেট কোনক্রমে একটু হেসে বলল।
“আমরা কি কিছুক্ষণ বেঞ্চে গিয়ে বসতে পারি?” ওর হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করল।
স্কারলেটের সম্মতি পেতেই ও খুব সাবধানে ওকে নিয়ে সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সব থেকে বড় ওকগাছটার তলার বেঞ্চের দিকে এগোল। কত দূর্বল হয় মেয়েরা, ও ভাবল, সামান্য যুদ্ধের কথা শুনেই প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল! কথাটা ভেবে ওর মধ্যে পুরুষসুলভ সৌজন্যবোধ জেগে উঠল। অতিরিক্ত সাবধানে ওকে বেঞ্চে বসিয়ে অর পাশে বসল। ওকে কি সুন্দর লাগছে। ওর সাদা মুখের মধ্যে একটা বন্য সৌন্দর্য আছে। আমি যুদ্ধে চলে যেতে পারি বলে ও কি খুব কষ্ট পাচ্ছে? এটা মনে করা আবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! কিন্তু ওর দিকে অমন অদ্ভুত করে তাকাল কেন? লেসের রুমালটা ধরার সময় ওর হাতই বা কাঁপছিল কেন? আর ও চোখের কালো পালকগুলো? মেয়েরা ভয় পেলে আর প্রেমে পড়লেই তো ওরকম চোখ পিটপিট করে!
তিনবার গলা খাঁকারি দিয়ে গলা সাফ করেও কিছু বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিল, কারণ স্কারলেটের সবুজ চোখ এমন ভাবে ওকে বিদ্ধ করছিল যেন ওকে দেখতেই পাচ্ছে না।
“ওর অনেক টাকা আছে,” স্কারলেট চট করে ভেব নিল। মাথায় একটা মতলব এসেছে। “ওর মা বাবাও নেই যাঁরা আমাকে বিরক্ত করতে পারেন। এছাড়া ও থাকে অ্যাটলান্টায়। যদি ওকে বিয়ে করে নিই, তাহলে অ্যাশলেকে বোঝানো যাবে আমি ওকে পাত্তাই দিইনি। আমি ওর সঙ্গে শুধু ফ্লার্ট করছিলাম। আর হানি উচিত শিক্ষা পাবে! জীবনে আর কোন প্রেমিক যোগাড় করতে পারবে না। মেলানিও কষ্ট পাবে, তার কারণ চার্লসকে মেলানি খুবই ভালবাসে। স্টু আর ব্রেন্টও আঘাত পাবে – অবশ্য স্কারলেট জানেনা কেন ওদের দুজনকে আঘাত দিতে চায় – এক হতে পারে ওদের হিংসুটে বোনগুলোর জন্য। আর যখন আমি সুন্দর জুড়িগাড়িতে চেপে এখানে আসব, আমার অনেক সুন্দর সুন্দর ড্রেস থাকবে, নিজের বাড়ি থাকবে – ওরা হিংসেয় জ্বলবে – তখন আর কেউ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে সাহস পাবে না!”
“লড়াই যে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই,” অনেকবার চেষ্টা করার পর চার্লস ভাষা খুঁজে পেল। “তবে তুমি চিন্তা কোরো না মিস স্কারলেট, এক মাসের মধ্যেই ওরা কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। ঠিকই বলেছি, কান্নাকাটি শুরু করবে! এই সুযোগ তো আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না। আজ তেমন ভাবে বলডান্সের আসর জমবে বলে মনে হয় না। ট্রুপকে জোন্সবোরোতে চলে গিয়ে আলোচনা করতে হবে। টার্লটন ভাইরা খবরটা সবাইকে দেবার জন্য বেরিয়ে পড়েছে জানি, লেডিদের খারাপ লাগবে।”
বলার মত কিছু না পেয়ে স্কারলেট শুধু বলল, “ওহ।”
মাথাটা অনেকটা ঠাণ্ডা হয়েছে। আবার ঠিকমত ভাবনা চিন্তা করতে পারছে। মনের মধ্যে যেন বরফ জমে গেছে। মনে হচ্ছে উষ্ণতা ওর কাছ থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। এই সুন্দর দেখতে, লাজুক ছেলেটাকে বিয়ে করলে কি হয়? অন্যদের থেকে ওর কোন তফাৎ কোথায়? ভারী বয়ে গেল। যদি নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হয়, তবুও ওর আর কোন কিছুতেই এসে যাবে না।
“এখনও ঠিক করতে পারি নি মিস্টার ওয়েড হ্যাম্পটনের সাউথ ক্যারোলাইনা লেজিয়নে যাব না অ্যাটলান্টা গেট সিটি গার্ড-এ যাব।”
ও আবার বলল “ওহ” তারপর ওর চোখে চোখ রেখে তাকাল। চোখের পালকের ওঠা নামা, চার্লসকে একেবারে বিগলিত করে দিল।
“তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে, মিস স্কারলেট? তুমি – মানে ওদের পিটিয়ে ফিরে আসা অব্দি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে জানলে – আমি হাতে স্বর্গ পাব! রুদ্ধশ্বাসে ওর জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। স্কারলেটের ঠোঁট কুঞ্চিত হল। মনে হল ওই ঠোটদুটোতে চুমু খেলে কত ভাল লাগবে। স্কারলেটের ঘামে ভেজা হাত ওর হাতের মধ্যে চলে এল।
“আমি অপেক্ষা করতে চাই না,” ওর চোখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে স্কারলেট বলল।
চার্লস অবাক হয়ে মুখ হাঁ করে খুলে ওর হাতদুটো হাতে নিয়ে বসে রইল। আড়চোখে স্কারলেট ওকে দেখল। ঠিক একটা ব্যাঙের মত দেখাচ্ছে। চার্লস তোতলামি করে কিছু বলবার চেষ্টা করতে অনেকবার মুখ খুলল আর বন্ধ করল। আবার গালটা জিরেনিয়াম ফুলের মত গোলাপি হয়ে উঠল।
“তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে পারবে?”
স্কারলেট কোন কথা বলল না। শুধু দৃষ্টি নত করল। চার্লস অসম্ভব উচ্ছ্বসিত হল কিন্তু কিছুটা লজ্জাও পেল। হয়ত এরকম প্রশ্ন কোন মেয়েকে করা ঠিক নয়। কিংবা কোন কুমারী মেয়েই এই প্রশ্নের জবাব দিতে লজ্জা পাবে। আগে কখনও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় নি বলে চার্লস একটু ধাঁধায় পড়ে গেল কি করা উচিত ভেবে। ওর চেঁচাতে ইচ্ছে করছিল, গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছিল; ইচ্ছে করছিল লনের সবুজ ঘাসের ওপর ছুটে যেতে। কালো সাদা সবাইকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছিল যে স্কারলেট ওকে ভালোবাসে। ওকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সেসব কিছু না করে স্কারলেটের হাতটা চেপে ধরল। এত জোরে যে আংটিগুলো আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে গিয়ে স্কারলেটের ব্যথা লাগছিল।
“তুমি চাও যে আমাদের বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক, মিস স্কারলেট?”
“উম,” নিজের ড্রেসে আঙ্গুল চালাতে চালাতে স্কারলেট বলল।
“তাহলে দুটো বিয়ে একই সঙ্গে হয়ে যাক। মেল ____”
“না,” স্কারলেট তাড়াতাড়ি বলে উঠল। চার্লসের দিকে আশঙ্কাজনকভাবে তাকাল। চার্লস বুঝল আবার ভুল কথা বলে ফেলেছে। কোন মেয়েই নিজের বিবাহ অনুষ্ঠানের গরিমা অন্য কারও সাথে ভাগাভাগি করতে ভালবাসে না। এমন অবিবেচকের মত কথা বলার পরও ও আমাকে ভুল বোঝেনি! একটু সন্ধ্যে হয়ে এলে অন্ধকারে ওর হাতে একবার চুম্বন করে যে কথাগুলো বলতে চেয়েছে সেগুলো বলতে পারত।
“তোমার বাবার সঙ্গে কবে কথা বলতে পারি?”
“যত তাড়াতাড়ি পারো,” মনে মনে প্রার্থনা করল আংটির ওপর থেকে চাপটা সরিয়ে নিক। নাহল বাধ্য হয়ে নিজেকেই বলতে হবে।
চার্লস উঠে দাঁড়াল। এক মুহুর্তের জন্য স্কারলেটের মনে হল ও উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবে। কিন্তু না, শেষমেশ ওর আত্মমর্যাদাবোধ জেগে উঠল। হাসিমুখে স্কারলেটকে দেখল। চোখের ভাষায় ওর সরল হৃদয়ের প্রতিফলন। আর কেউ স্কারলেটের দিকে এমন ভাবে তাকায় নি, আর তাকালেও ও তাকে পাত্তাই দিত না। অনাসক্তভাবে ওর মনে হল যেন একটা বাছুর তাকিয়ে আছে।
“আমি এখনই যাচ্ছি তোমার বাবাকে খুঁজতে,” সারা মুখ হাসিতে ভরিয়ে বলল। “আমার তর সইছে না। আমি কি যেতে পারি ডারলিং?” এই ভালবাসার সম্বোধন নিজের কানে শুনতে এত ভাল লাগল, যে কথাটা আবার বলল। বলাটাকে খুব উপভোগ করল।
“হ্যা যাও,” স্কারলেট বলল। “তোমার জন্য এখানেই অপেক্ষা করব। জায়গাটা খুব ঠাণ্ডা আর ভাল।”
লন পেরিয়ে চার্লস বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ও একা রইল। ওক গাছের তলায়। হাওয়ায় গাছের পাতার মৃদু শিরশিরানি ভেসে আসছে। আস্তাবল থেকে ঘোড়ায় চড়ে দলবেঁধে লোকেরা বেরোচ্ছে। নিগ্রো চাকরেরা মনিবদের পেছনে পেছনে চলছে। মুনরো ভাইয়েরা হাতে করে টুপি নাড়তে নাড়তে আগে এগিয়ে গেল। ফোনটেন আর ক্যাল্ভার্টরা হট্টগোল করতে করতে গেল। টার্লটনদের চার ভাই লনের পাশ দিয়ে ওর সামনে দিয়ে গেল। যাবার সময় ব্রেন্ট বলে গেল, “মা আমাদের ঘোড়া দিতে রাজী হয়েছেন! ইয়ে – য়ে – য়ে! সবাই বেরিয়ে যাবার পর ও আবার একা বসে রইল।
সাদা বাড়িরটার লম্বা লম্বা থামগুলোর দিকে তাকাল উদাসীন চোখে। এটা আর কোনদিনই ওর বাড়ি হবে না। এই বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে অ্যাশলে ওকে স্ত্রী হিসেবে বাহুতে করে নিয়ে যাবে না। ওহ অ্যাশলে – অ্যাশলে! এ আমি কি করলাম? অন্তরের অন্তস্থলে – ওর আহত অহঙ্কার আর প্রখর বাস্তবতার পরত ভেদ করে – কি যেন একটা ব্যথা ছেয়ে আছে। একটা পূর্ণবিকশিত অনুভুতি আস্তে আস্তে ওর মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। ওর অহঙ্কার আর ওর সচেতন স্বার্থপর প্রকৃতির থেকে যেটা অনেক বেশি শক্তিশালী। অ্যাশলেকে ও ভালবাসে। এই মুহুর্তে – যখন চার্লস নুড়িপাথরের রাস্তা ধরে দূরে মিলিয়ে গেল – তখন আরও ভাল করে বুঝতে পারল যে ও অ্যাশলেকে খুবই ভালবাসে।
0 মন্তব্যসমূহ