আন্তারেস পর্ব ১-এর লিঙ্ক
আমি খেতে আরম্ভ করি। এক ধরণের মাংসের চপ, সবুজ শবজি, রাইদানার পাঁউরুটি। সাথে কমলার রস। এই মহাকাশযানে মাংস তৈরি হয় রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় - যন্ত্রে। আর শবজি ও শস্য তৈরির জন্য বড় একটি ঘর আছে, সেখানে অতিবেগুনী আলো জ্বলে, পৃথিবীর মাটিতে গাছ বেঁচে থাকে, তাতে কমলা ফলে।
খিদে পেয়েছিল, পাঁচ মিনিটে খাওয়া শেষ করে বেল্ট বেঁধে তৈরি। কিন্তু দেখলাম নিয়ন্ত্রণকক্ষের লোকেরা তখনো ছোটাছুটি করছে। এর মধ্যেই মা’র ফোন এল। ফোনে মা’র মুখ ভেসে উঠল যদিও তাকে আমি টেলিভিশন স্ক্রিনে নিয়ন্ত্রণকক্ষের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম।
মা জিজ্ঞেস করল আমার খাওয়া হয়েছে কিনা, সিটবেল্ট বেঁধে বসেছি কিনা। মহাকাশযান জুড়ে সাইরেনের শব্দ শোনা গেল, এর সাথে একটা ঘোষণা, নেনার গলা চিনতে পারলাম। “সবাই প্রস্তুত হও, আন্তারেস আর দু’মিনিটের মধ্যে কক্ষপথ ত্যাগ করার প্রক্রিয়া শুরু করবে।” এই ঘোষণার সাথে সাথেই আন্তারেসের বিশাল ইঞ্জিন গর্জে উঠ্ল এমন যেন এক দানব জেগে উঠেছে। আমি জানি কার হাতের স্পর্শে সেই বিশাল দানব গজরাচ্ছে, আমার বাবার আঙুলের স্পর্শে, বাবা হল এই মহাকাশযানের প্রধান প্রকৌশলী।
মা’র ফোনের মধ্যেই বাবা ফোন করল। বাবা আন্তারেসের যে জায়গায় কাজ করে সেটা বেশ কঠিন জায়গা। মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় অক্ষের কাছে যেখানে কোনো ধরনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। কারণ সেই জায়গাটা ঘোরে না। মা’র প্রশ্নগুলোই বাবা করল, খেয়েছি কিনা, সিটবেল্ট বেঁধেছি কিনা। এইসব জিজ্ঞেস করতে করতেই দেখলাম বাবা বিশাল ইঞ্জিনঘরের ত্বরণ-চেয়ারে বসে বেল্ট বাঁধছেন। মা দেখলাম একটু উদ্বেগের সঙ্গে বাবার সিটবেল্ট বাঁধাটা দেখছেন। বাবা মাকে বলল, “চিন্তা কর না, ইঞ্জিন খুব ভাল কাজ করছে।”
ড্রেগলস এই মহাকাশযানের অধিনায়ক হতে পারে, কিন্তু আমার বাবাকে ছাড়া আন্তারেস এক চুলও নড়তে পারবে না। আন্তারেসের হৃদযন্ত্রকে চালু রাখাই ছিল তার প্রধান কাজ, আমার বন্ধুরা তাই বাবাকে ভাবত এক যাদুকর যে যাদুকর তার অসীম জ্ঞানে মহাকাশযানের গভীর গহ্বরের বিশাল ইঞ্জিনের প্রাণ সঞ্চার করে। পৃথিবী থেকে দশ আলোকবর্ষ দূরে, কোটি কোটি কিলোমিটার পার হয়েও সেই ইঞ্জিন গজড়ে চলেছে। কিন্তু সেই ইঞ্জিন থেকে যে তেজষ্ক্রিয় কণা ও রশ্মি বের হয় তার জন্য মা সবসময় বাবার জন্য চিন্তা করত। বাবা মা’কে সান্ত্বনা দিত, বলত, ‘আমি যে পোষাক পড়ে কাজ করি তাতে শতকরা ৯৮ ভাগ তেজষ্ক্রিয়তা আটকে দেয়া যায়।’
মা বলত, ‘আর বাকি দু ভাগ?’
‘আর বাকি দুভাগ ওষুধের ওপর। আমি তো রোজই ওষুধ খাচ্ছি যাতে শরীর থেকে নষ্ট কোষগুলো সরিয়ে দেয়া যায়।’
মা এতে ভরসা পেত না। তেজষ্ক্রিয়তা শরীরের কোষের ক্ষতি করতে পারে, নির্দিষ্ট ওষুধ সেগুলোকে চিহ্নিত করে মেরে ফেলতে পারে। আমি জানতাম মৃত কোষ শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়, কিন্তু নষ্ট কোষ যত যন্ত্রণার মূল। একটি নষ্ট কোষ থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি - এরকমভাবে অসংখ্য নষ্ট কোষের জন্ম হতে পারে, আর একেই নাকি বলে ক্যান্সার। মা বলতেন পৃথিবীতে নাকি ক্যান্সার যাতে না হয় সেজন্য অনেক বংশগতিবিদ্যার চর্চা হয়। ‘বংশগতিচর্চা’ মানে জেনেটিক্স, শরীরের কোষের ভেতর জিনকে নাকি নানাভাবে বদলানো যায়, সেসব করে ক্যানসারকে নাকি বিদায় করা হয়েছে। কিন্তু এই মহাকাশযান প্রতিনিয়তই মহাকাশ থেকে ছুটে আসা শক্তিশালী কণিকার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেই কণিকারা মানুষের শরীরের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এর জন্য আন্তারেস যানের চারদিকে সবসময় একটা প্রবল চুম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। সেই চুম্বকক্ষেত্র তড়িৎ-আধানযুক্ত কণিকাদের মহাকাশযান থেকে দূরে পাঠিয়ে দেয়। কোথা থেকে আসে সেই দ্রুত কণিকারা, আমি ভাবি।
এর মধ্যেই নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে শোরগোল শোনা গেল। বাবা মা দুজনেই ফোন ছেড়ে দিল। সামনের স্ক্রিনে দেখলাম নেনা, ড্রেগলস আর বাকিরা দাঁড়িয়ে কক্ষের বড় স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনটায় জেমলা গ্রহের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। বহু দূরে দিগন্ত, সেই দিগন্তের বায়ুমণ্ডল লাল, আমাদের পেছনে মিহির তারা অস্ত যাচ্ছে। কিন্তু এছাড়াও দিগন্তের ধারে একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু সেটা যে তারা নয় সেটা নিয়ন্ত্রণকক্ষের সবার ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ড্রেগলসের গলা শোনা গেল, সে চিৎকার করছে, তমাল, ওদের এখানে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে?” তমাল এক জাহাজের সুরক্ষার ব্যাপারটা দেখে। সে একাধারে বিজ্ঞানী আর সেনা-অফিসার। তমাল পনেরো সেকেন্ড সময় নিল, কম্পুটার ঘেঁটে উত্তর দেয়, “ওরা যদি এই গতি বজায় রাখে তাহলে কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট।”
ওরা কারা? ভয়ে সিঁটিয়ে যাই আমি চেয়ারের সাথে? আউরেউরগথ? ঐ উজ্জ্বল আলোটা কি আউরেউরগথদের মহাকাশযান? কুড়ি মিনিটের মধ্যে নিশ্চয় আমরা কক্ষপথ ত্যাগ করতে পারব, কিন্তু তার আগে যদি ওরা আমাদের দিকে লেজার, মিজাইল বা রকেট-জাতীয় কিছু নিক্ষেপ করে? সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার তো কোনোই ব্যবস্থা নেই আমাদের যানে। নাকি আছে? ছোটদের তো অনেক কথাই বড়রা বলে না।
মিহির গ্রহের দিগন্তের তারাটা উজ্জ্বল থেক উজ্জ্বলতর হতে থাকে। আর একটি মহাকাশযান? আমার এই বারো বছরের জীবনের অন্য কোনো যান আমদের পথে পড়ে নি, এই অনন্ত মহাকাশে আমরা একাই চলেছিলাম। নিশ্চয় এটা একটা মহাকাশযান, কিন্তু সেটা যে আউরেউরগথদেরই হবে সেটা সম্বন্ধে ড্রেগলস এত নিশ্চিত হল কেমন করে?
দেখলাম ড্রেগলস বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। ইঞ্জিন তৈরি। এরপর নেনা ড্রেগলসকে কি যেন বলল। তারপরই নেনার কথা আমার ঘরের লুকানো স্পিকারে ধ্বনিত হল, “আন্তারেসের অভিযাত্রীরা, প্রস্তুত হও। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা কক্ষপথ ত্যাগ করব।”
এর পরে কী হবে আমি জানতাম। আমরা যেখানে থাকি, সেই ঘুরন্ত অংশ ধীরে ধীরে তার ঘোরা বন্ধ করে দেবে, উচ্চ ত্বরণের সময় কোনো কিছুর ঘোরা চলবে না। নেনা বলতে থাকে, “কক্ষপথ ত্যাগ করার আগে আমরা মহাকাশযানের মূল চক্রের ঘূর্ণন বন্ধ করে দেব, এর ফলে যাত্রীরা ভারহীন হয়ে যাবে। আশা করি তোমরা সবাই সিটবেল্ট বেঁধেছে। এরপরে সিট স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমাদের জাহাজ যেদিকে ছুটবে সেদিকে ঘুরে যাবে। শুরুতে মহাকাশযানের ত্বরণ হবে প্রতি বর্গ সেকেন্ডে দশ মিটার যা কিনা পৃথিবীর বুকে মহাকর্ষজ ত্বরণের সমান। এর ফলে যাত্রীরা আবার তাদের ওজন ফিরে পাবে। এরপরে আমাদের ত্বরণ প্রতি বর্গ সেকেন্ডে কুড়ি মিটার হবে, তখন আমাদের ওজন দ্বিগুণ হবে।”
স্ক্রিনে দেখতে পেলাম ড্রেগলস, নেনা আর আরো অনেকে চেয়ারে বসে তাদের স্বয়ংক্রিয় সিটবেল্টটা চালু করছে। একটা যান্ত্রিক ভোঁতা শব্দ বাইরে থেকে ভেসে এল, আমাদের বাসস্থান চক্রটা তার ঘূর্ণন থামাচ্ছে। আমি জানি এই থামানোর কাজটা সহজ নয়, এত বিশাল একটা স্থাপনার গতিজাড্য অনেক, তাকে থামাতে হলে - মহাশূন্যে তার ঘূর্ণন বন্ধ করতে হলে - কেন্দ্রীয় অক্ষের সাথে যুক্ত আর একটি চক্রকে উল্টো দিকে ঘোরাতে হবে। আমাদের বাসস্থানের চক্রাকার গতি যত কমে এল, আমার ওজন তত কমা শুরু হল। চার মিনিট মত সময় লাগল চক্রটার থামতে। তত্ক্ষণে আমি নিজের ভারহীন অবস্থাটা ভালই টের পাচ্ছিলাম। সিটবেল্ট না বাঁধা থাকলে তো ঘরের মধ্যে ভেসে ভেসেই বেড়াতে পারতাম।
নেনার গলা ভেসে আসে, “রওনা হতে এক মিনিট।”
ইঞ্জিনের গর্জন আরো প্রকটিত হয়। থর থর করে কাঁপে মহাকাশযানের বিশাল দেহ। এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের আগে অনেকবার হয়েছে, কিন্তু এই প্রথমবারের মত আমরা ছোটরা একা একা নিজেদের ঘরে বসে এই ত্বরণের মধ্যে দিয়ে যাব। অন্য সময় আমার সবাই নিয়ন্ত্রণকক্ষের পাশেই একটা বড় ঘরে একসাথে বসি ত্বরণের সময়। কিন্তু আজ সময় ছিল না সেই কক্ষে যাবার। অন্যসময় আমি এতে ভয় পাই না। কিন্তু আজ আন্তারেসকে ধরতে আউরেউরগথদের একটা যান জেমলার অন্যদিক থেকে বের হয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। আমি সেটাকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মা নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে নিশ্চয় ওদের দেখতে পাচ্ছে, না হলে এত তাড়াহুড়ো করে আমরা কেন জেমলা ছেড়ে যাব, বিশেষতঃ যখন জেমলা অনেকটা পৃথিবীর মতই দেখতে ছিল। আমরা তো এখানে থাকতেই পারতাম।
আমি জানতাম জেমলা তার সূর্য মিহিরের চারদিকে সেকেন্ডে ৪০ কিলোমিটার বেগে চলছে। আন্তারেস যেহেতু জেমলার কক্ষপথে সেজন্য আন্তারেসের গতি ইতিমধ্যে সেকেন্ডে ৪০ কিলোমিটার আছে, কিন্তু মিহিরের মাধ্যাকর্ষণ থেকে বের হবার জন্য আন্তারেসের সেকেন্ডে ১০০ কিলোমিটার গতি পেতে হবে। সেটা এই মহাকাশযানের জন্য এমন কিছু নয়, কারণ প্রয়োজনে আন্তারেস আলোর গতির এক দশমাংশ, অর্থাৎ সেকেন্ডে ৩০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি সঞ্চার করতে পারে, তবে সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য।
আবার নেনার কন্ঠ, “প্রস্তুত! দশ সেকেন্ড কাউন্ট-ডাউন। দশ, নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন , দুই, এক, শূন্য - শুরু।”
থরথর করে কাঁপে মহাকাশযান। আমার ভয় করে, এই প্রথমবার মা বা বাবা কেউ সাথে নেই। আমি দু হাত দিয়ে চেয়ারের নিচটা চেপে ধরি। ধীরে ধীরে আমার শরীর চেয়ারের পেছনের দিকে চেপে বসে। সামনের স্ক্রিনে জেমলা গ্রহ ভেসে ওঠে - নীল, সবুজ আর কমলা রঙের সমন্বয়। প্রথমে মনে হল গ্রহটি যেন আমাদের পিছু নিয়েছে, তার আয়তন কমছে না। তারপর খুব ধীরে সেটি ছোট হতে থাকল। মা’র মুখ ভেসে উঠল স্ক্রিনের এক কোনায় - “ভাল আছিস তো, শোগি মা?” আমি বললাম, “আছি, তুমি কখন ঘরে আসতে পারবে?’ মা বলল, “আরো পাঁচ-ছ ঘন্টা লাগবে। তুই এর মধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠিস না। দেখ কোনো ছবি-টবি পাস কিনা এর মধ্যে দেখার মত।”
আউরেরগথরা পিছু নিয়েছে, এর মধ্যে কি আর ছবি দেখার অবস্থা আছে! তবু স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলাম, “মিরা, ভাল একটা ছবি দেখাও তো যেটা আমি এখনো দেখি নি।” স্ক্রিনে একটি বেশ বয়স্কা মানুষের মুখ ভেসে উঠল। ওঁর নাম হল মিরা। মিরা বলল, “তোমাকে কতবার করে বলেছি আমাকে আপনি করে সম্বোধন করবে।” বললাম, “ভুল হয়ে গেছে, আপনাকে তো সবসময় দেখতে পাই নি।” মিরা হাসল, তারপর বলল, “আমি ঠাট্টা করছিলাম, আসলে আমাকে তুমি করেই বল। তোমাকে মনে হয় আমার নাতনী।”
কেমন করে একটা ইলেকট্রনিক মস্তিষ্ক আমাকে নাতনী ভাবতে পারে সেটা নিয়ে আমি কোনোদিন মাথা ঘামাই নি। কিন্তু স্ক্রিনে মিরার মুখটায় এমন একটা সহৃদয়তা আছে সেটা সবাইকে কাছে টানবে। তার গালে ও কপালে পোড়া চামড়া কুঁচকেছে, কপালের ওপরে সাদা চুল। সে বলে, “মা বুঝি ব্যস্ত? আমাদের মহাকাশযান জেমলা গ্রহ ছেড়ে চলে যাচ্ছে?” আমি বললাম, “সবে ছাড়ছে, আউরেউরগথরা আমাদের পিছু নিয়েছে।”
আউরেউরগথ নামটা শুনে মিরার মুখটা কেমন জানি অন্ধকার হয়ে গেল। “আউরেউরগথ?” সে যেন স্বগোতিক্ত করল। তারপর বলল, “আউরেউরগথরা এখানে কেমন করে এল?” মিরার থমথমে মুখ দেখে আমি খুব ভয় পেলাম, কিন্তু আমার ভয়ার্ত মুখ দেখেই মিরা তাড়াতাড়ি বলল, “ওঃ, কোনো চিন্তা কর না, আন্তারেস খুব শক্তিশালী মহাকাশযান, ওরা আমাদের কিছু করতে পারবে না।” এট্কু বলে মিরা কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়, আমি জানি ঐটুকু সময়ের মধ্যে ও আন্তারেসের সমস্ত কথাবার্তা, বিভিন্ন স্ক্রিনের ভিডিও সব দেখে নিল মহাকাশযানের ইলেকট্রনিক তথ্যলাইনে, ব্যাপারটাও বুঝে নিল। হয়তো মা কী করছে এখন সেটাও দেখল, তারপর আমাকে বলল, “ঠিক আছে, আমরা একটা সিনেমা দেখি?” আমি বললাম, ‘আমাকে পৃথিবীর কোনো পুরোনো কাহিনী দেখাও।’ মিরা বলল, ‘তুমি কি আশ্চর্যদেশে অ্যালিস ছবিটা দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘বোধহয় দেখেছি, কিন্তু আমি ওরকম রূপকথা জাতীয় কিছু দেখতে চাই না। আমাকে বরং কোনো অ্যাডভেঞ্চারের ছবি দেখাও। মিরা হেসে বলে, “অ্যালিসের কাহিনী ঠিক রূপকথা নয়, তবে ঠিক আছে, তোমাকে দেখাই নেপচুনের অভিযান। আগে দেখেছ কখনো?”
না, ‘নেপচুনে অভিযান’ আমি আগে দেখি নি। জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কত পুরনো বল তো? তুমি তো আবার সেই সেকেলে সব ছবি পছন্দ কর।” মিরা হাসে, বলে, “তা শ পাঁচেক বছর তো হবেই। দেখ, ভাল লাগবে।”
নেপচুনের অভিযান শুরু হল, কেমন করে একদল মহাকাশযাত্রীরা নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটনের পাশ দিয়ে গিয়েছিল, তারপর তাদের একজনের মাথা খারাপ হল, তাতে কি সব বিপর্যয় হল, ইত্যাদি। আধঘন্টা দেখে মিরাকে বললাম, “এসব আমার একেবারেই পছন্দ নয়।” এই বলতে না বলতেই মহাকাশযান ভীষণ ঝাঁকুনি খেল, স্ক্রিনে মা’র মুখ ভেসে উঠল, উদ্বিগ্ন। “শোগি মা, ঠিক আছিস তো?” আমি বললাম, “কি হচ্ছে মা?” মা বলল, “আউরেউরগথরা আমাদের পেছন ছাড়ে নি। তারা লেজার দিয়ে আমাদের ইঞ্জিন বিকল করে দেবার চেষ্টা করছে।” মা’র কথা শেষ হতে না হতেই আমি বুঝলাম আন্তারেস তার গতিপথ বদলাচ্ছে, আমার চেয়ার আমাকেসহ ঘুরে গেল, আমার পিঠ সেঁটে গেল চেয়ারের সাথে, আমরা খুব জোরে ত্বরাণ্বিত হচ্ছি। বুঝলাম এই ত্বরণটা অধিনায়ক ড্রেগলসের পরিকল্পনায় ছিল না। বাবার জন্য খুব চিন্তা হল, বাবা তো ইঞ্জিনের ওখানেই বসে আছেন। মা’কে জিজ্ঞেস করলাম বাবার কথা। মা বলল, ‘চিন্তা করিস না, শোগি। বাবা যে ঘরে আছে সেটা খুব মজবুত জায়গা, লেজার কিছু করতে পারবে না।’
“আউরেউরগথদের মহাকাশযানটা কি স্ক্রিনে দেখান যাবে?” প্রশ্ন করি মা’কে। “না’রে, এখন এসব দেখিয়ে তোদেরকে আরো ভয় পাইয়ে দিতে চাই না। চিন্তা করিস না, আমাদের ইঞ্জিন খুব মজবুত, ওদের লেজার কিছু করতে পারবে না।” এদিকে মহাকাশযানের ত্বরণ আমাকে আর কথা বলতে দিচ্ছিল না, মা’র মুখটাও দেখলাম কেমন চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। মা ফোন রেখে দিল।
আমার স্ক্রিনে মহাকাশের কালো ভেসে উঠল, আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিকের চিত্র। নিকষ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে কিছু তারা, আমি জানি আমরা যাচ্ছি কালপুরুষের নক্ষত্রমণ্ডলীর বাহুর দিকে। আবারো একটা বড় ঝাঁকুনি, আউরেরগথরা নিশ্চয় ইঞ্জিনে আঘাত করছে। মিরাকে ডাকলাম, তার মুখ স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই জিজ্ঞেস করলাম, “আমার বাবা ঠিক আছেন তো?” মিরা তার দু-চোখ মুহূর্তমাত্র বুঁজল, তারপর চোখ খুলে বলল, “ইঞ্জিনের অংশ খুব সুরক্ষিত, কোনো ক্ষতি হয় নি, তোমার বাবাও ভাল আছেন।”
“কিন্তু ওরা শুধু ইঞ্জিনকে বিকল করে দিতে চাইছে কেন?” প্রশ্ন করি।
মিরার চোখে একটা ত্রাসের চিহ্ন সেকেন্ডখানেক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। সে বলল, “শোগি, আউরেরগথরা গ্যালাক্সিজুড়ে ঘোরে অন্য সভ্যতার মহাকাশযান দখল করার জন্য যাতে তারা সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। আর সেই যানের মানুষদের বা অন্য গ্রহান্তরীদের আটক করে দাস বানায়। সেজন্য তারা আন্তারেসের ইঞ্জিন নষ্ট করে দিতে চাইছে যাতে এই মহাকাশযানটি মানুষসহ তারা পেতে পারে।”
মিরার কথাটা শেষ হতে না হতেই আমার শরীর প্রচণ্ডভাবে সিটের সঙ্গে সেঁটে গেল, বুঝলাম আন্তারেস ত্বরাণ্বিত হচ্ছে, গতিবেগ বাড়ছে খুব দ্রুত। মনে হল প্রতি সেকেন্ডে অন্তত সেকেন্ডে ৩০ মিটার করে গতিবেগ বাড়ছে, অর্থাৎ পৃথিবীবুকের ত্বরণের তিনগুণ, তার মানে আমার ওজনও বেড়েছে তিনগুণ। আউরেরগথরাও কি এই ত্বরণের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে? আর আমরাও কি এই তিনগুণ ওজন বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারব?
মিরা বলল, “আউরেরগথ মহাকাশযান পিছিয়ে পড়ছে।”
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
আন্তারেস সে যাত্রায় আউরেউরগথদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল, কিন্তু জেমলার মতন অমন সুন্দর একটা গ্রহ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। মিহির তারার সৌরজগৎ ছেড়ে আসার পরে আমরা বহুদিন অন্ধকারে চললাম। নেনা আমাদের জানাল যে আমাদের সামনে আর একটি ছোট লাল বামন তারা পাওয়া গেছে, তার চারিদিকে একটি সৌরমণ্ডলীও আছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে আরো একটা বছর লাগবে। সেই একটা বছরে আমি অনেক কিছু শিখলাম। মা’র কাছ থেকে পিয়ানো আর পদার্থবিদ্যা, বাবার কাছ থেকে গিটার আর প্রকৌশলবিদ্যা, বেলকের কাছ থেকে অঙ্ক আর ইতিহাস। এসবের ওপর আবার পরীক্ষা দিতে হত স্কুলে। সিয়ানা নিত আমাদের পরীক্ষা। এতদিন পরে মনে হয় ঐ একটা বছর আমার ছোটবেলার সবচেয়ে সুন্দর সময়। বাইরে অনন্ত অন্ধকার থাকলেও, ঐ মহাকাশযানের ভেতর আমরা যে পৃথিবী গড়ে তুলেছিলাম তা হয়তো আসল পৃথিবীতে বেড়ে ওঠার স্বাদটা দিত। আমরা খেলা করতাম একটা ছোট হ্রদের পাশে বালুকাবেলায়। সেই হ্রদে ছোট ঢেউ সৃষ্টি করা হত। অনেক সময় বৃষ্টি পড়ত সেখানে, বাজ পড়ার শব্দ হত। একটা ছোট স্রোতস্বিনী এসে পড়ত সেই হ্রদে, তাতে পাথর ছিল। সেই স্রোতের উৎস ছিল আর একটি বড় ঘর যেখানে ছিল একটা ছোট বন। আমরা সেখানে লুকোচুরি খেলতাম। মহাকাশে নিরাপত্তায় আমরা মাঝে মাঝে ভাবতাম পৃথিবীর কথা, সেই পৃথিবী তখন আউরেরগথদের হামলায় বিপর্যস্ত।
(চলবে)
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ