ধারাবাহিক উপন্যাস : যেদিন ভেসে গেছে--সপ্তম পর্ব

মূল উপন্যাস : মার্গারেট মিচেল
অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত

এই ঘটনার দু’সপ্তাহের মধ্যে স্কারলেটের বিয়ে হয়ে গেল, আর দু’মাসের মধ্যে বিধবাও হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে আর বিশেষ চিন্তা ভাবনা না করে যে বাঁধনে স্কারলেট নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছিল, তার থেকে খুব অল্প সময়েই সে মুক্তও হয়ে গেল, যদিও কুমারী জীবনের উদ্বেগহীন স্বাধীনতা আর ফিরে পেল না। বিয়ের প্রায় সাথে সাথেই বিধবা হয়ে গেলেও, মাতৃত্বের নতুন বন্ধনে জড়িয়ে পড়ল।

জীবনের পরবর্তি বছরগুলোতে, ১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসের শেষদিকের সেই ঘটনা পরম্পরা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সে মনে করতেই পারেনা। সময় আর ঘটনা পরম্পরা একসাথে মিলে একটা অপস্রিয়মাণ দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়েছে, যেন এক যুক্তিহীন পরাবাস্তব। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই ঘটনাগুলো ওর স্মৃতিতে খানিকটা শূন্যস্থান হিসেবে থেকে যাবে। যে স্মৃতিটা ওর কাছে সবচেয়ে বেশি অস্পষ্ট হয়ে যাবে সেটা হল চার্লসের বিবাহ প্রস্তাবে রাজী হওয়া থেকে শুরু করে ওর সাথে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত। মাত্র দু’সপ্তাহ! দেশে শান্তির আবহে বাগদানের পর এত অল্প সময়ের মধ্যে বিবাহ, কল্পনাতীত। স্বাভাবিক পরিস্থিতে একবছর কিংবা অন্তত ছ’মাসের একটা শোভন বিরতি রাখা হয়। কিন্তু দক্ষিণে তখন যুদ্ধের উন্মাদনা। ঘটনার স্রোত ঝড়ের গতিতে বয়ে চলেছে। আগেকার নিস্তরঙ্গ জীবন আর নেই। এলেন ইতস্তত করেছিলেন। স্কারলেটকে একটু সময় নিয়ে ভাল করে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলেন। কিন্তু স্কারলেট অনড়। কোন কথাই কানে নিল না। বিয়ে ওকে করতেই হবে! আর দু’সপ্তাহের মধ্যেই! 

যখন জানতে পারল যে অ্যাশলের বিয়ে হেমন্তের সময় থেকে এগিয়ে এনে পয়লা মে করা হয়েছে – কারণ যে কোন দিন ওকে ট্রুপে যোগ দিতে হতে পারে – স্কারলেট নিজের বিয়ের দিন তার আগেই ফেলল। এলেন বাধা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চার্লস ওর সদ্য অর্জিত বাকপটুতা দিয়ে বিয়েটা পিছিয়ে না দেবার জন্য মিনতি করল। দক্ষিণ ক্যারোলাইনাতে গিয়ে ওয়েড হ্যাম্পটনের লেজিয়নে যোগ দেবার জন্য ও মনে মনে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল। জেরাল্ডও ওদের পক্ষ নিলেন। উনি নিজেই যুদ্ধের উন্মাদনায় মেতে ছিলেন। স্কারলেটের পছন্দও তাঁকে আহ্লাদিত করেছিল। আর এই যুদ্ধের বাজারে, দু’জন তরুন-তরুনীর প্রেমের পথে তিনি কেন বাধা হতে যাবেন? দক্ষিণের অন্য মাইয়েদের মতও অবশেষে বিভ্রান্ত হয়ে মত দিলেন। তাঁদের সুপরিচিত স্বস্তির দুনিয়া কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে। ঘটনার দূর্বার স্রোতে, তাঁদের সব রকম মিনতি, প্রার্থনা আর উপদেশ ভেসে গেল। 

সমগ্র দক্ষিণে, উদ্দীপনা আর উত্তেজনা একটা নেশার মত সবাইকে আঁকড়ে ধরেছিল। সবাই ধরে নিয়েছিল একটা লড়াইয়েই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। তাই যুবসম্প্রদায় যুদ্ধ থেমে যাবার আগেই যাতে সেনাদলে নাম লিখিয়ে ফেলতে পারে তার জন্য সচেষ্ট হয়ে পড়ল। আর ইয়াঙ্কিদের গুঁড়িয়ে দেবার জন্য ভার্জিনিয়াতে অগ্রসর হবার আগেই নিজের নিজের প্রেমাষ্পদার পাণিগ্রহণ করে নিতে চাইল। কাউন্টিতে প্রায় ডজন খানেক প্রাক-যুদ্ধ বিবাহ অনুষ্ঠিত হল। বিদায়ের লগ্নে চোখের জল ফেলবার সময় কমই থাকল। কারণ সকলেই চোখের জল ফেলা কিংবা বিষন্ন অন্তরে বিদায় জ্ঞাপনের থেকেঅ আসন্ন লড়াইয়ের কথা ভেবেই উত্তেজিত আর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ইউনিফর্ম সেলাই করা, মোজা বোনা আর ব্যান্ডেজ গোটান নিয়ে মহিলারা ব্যস্ত। পুরুষেরা ব্যস্ত বন্দুক চালানো আর লড়াইয়ের অনুশীলনে। ট্রেন ভর্তি করে ট্রুপের সৈন্যরা উত্তরে অ্যাটলান্টা কিংবা ভার্জিনিয়া যাবার পথে জোন্সবোরোর ওপর দিয়ে যেত। বাছাই করা কিছু সেনাবাহিনীর পোশাকের আদলে, সৈন্যরা, লাল, হালকা নীল অথবা সবুজ পোশাক পরিধান করত। কেউ কেউ আবার ঘরে বোনা চামড়ার টুপি পরে যেত। বাকিরা ইউনিফর্মের বদলে বনাত কিংবা উঁচুমানের সুতির পোশাক পরে যেত। অনেকেরই যথেষ্ট অনুশীলন করার অভিজ্ঞতা ছিল না। অনেকের কাছে যথেষ্ট অস্ত্রও ছিল না। কিন্তু ওদের উত্তেজনা আর হল্লা দেখে মনে হত ওঁরা যেন লড়াই করতে নয় বরং পিকিনিক করতে যাচ্ছে। ওঁদের উদ্দীপনা দেখে কাউন্টির ছেলেদের মধ্যে আতঙ্ক হয়ে গেছিল যে যুদ্ধ খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে আর স্থানীয় ছেলেরা ভার্জিনিয়াতে যুদ্ধে যাবার সুযোগই পাবে না। সেই আশঙ্কাতেই ওরা যুদ্ধের প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করবার জন্য এত অধৈর্য হয়ে পড়েছিল।

এই ডামাডোলের মধ্যেই স্কারলেটের বিয়ের তোড়জোড় চলতে থাকল আর স্কারলেট ভাল করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, এলেনের বিয়ের পোশাক আর মুখাবরণে সজ্জিত হয়ে, বাপীর হাত ধরে টারার সিঁড়ি বেয়ে নেমে সমাগত অতিথিদের সন্নিকটে এসে দাঁড়াল। দেওয়ালে শত শত মোমবাতি জ্বলছে, মায়ের স্নেহময় কিন্তু ঈষৎ হতভম্ব চাউনি, মেয়ের সুখের জন্য নীরব ওষ্ঠকম্পন, সবই এখন আবছা ভাবে স্কারলেটের মনে পড়ে। জেরলাডের গর্বিত চেহারা – ব্র্যান্ডির প্রভাবে সামান্য লাল। তাঁর মেয়ে শুধু বড়লোকের ঘরণী হচ্ছে তাই নয়, পুরনো আর সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হচ্ছে। মেলানিকে বাহুতে নিয়ে অ্যাশলে সিঁড়ির তলায় দাঁড়িয়ে আছে। 

অ্যাশলের মুখের ভাব দেখে মনে মনে ভাবল, “এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না! হতেই পারে না! এটা নিশ্চয়ই একটা দুঃস্বপ্ন! নাহ, এখন এ নিয়ে ভাবলে চলবে না। তাহলে লোকজনের সামনে আমি মেজাজ ঠিক রাখতে পারব না। এখন ভাবতেও পারছি না। পরে ভাবা যাবে – যখন আমি এটা সহ্য করতে পারব – যখন ওর চোখ আমি দেখতে পাব না।”

সমস্ত ব্যাপারটাই স্বপ্নের মত। দু’পাশে স্মিতমুখ মানুষজনের সারি। চার্লসের লজ্জারুণ মুখ আর কথা বলতে গিয়ে তোতলামি, আর ওর কাঠ কাঠ শীতল জবাব। চুম্বন, অভিনন্দনজ্ঞাপন, স্বাস্থ্যপান, নাচ – সবকিছুই একটা স্বপ্নের মত। এমনকি গালে অ্যাশলের মৃদু চুম্বনের অনুভুতি, মেলানির মৃদুস্বরে বলা, “আজ থেকে আমরা সত্যিকারের বোন হলাম,” – সবই যেন কল্পনা। চার্লসের গোলগাল, স্নায়ুপ্রবণ পিসী মিস পিটিপ্যাট হ্যামিলটনের জ্ঞান হারানোর ফলে চাঞ্চল্য – সবই যেন দুঃস্বপ্নের মত।

তারপর একসময় নাচ এবং স্বাস্থ্যপান শেষ হয়ে গেল। ভোর হবার আর দেরি নেই। অ্যাটলান্টার অতিথিরা টারায়, ওভারসীয়ারের বাসস্থানে, সোফায়, মেঝেয় গদী পেতে, যে যেখানে জায়গা করতে পারল, ঘুমিয়ে পড়ল। প্রতিবেশিরা যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়ে পরের দিন টুয়েল্ভ ওকসের বিবাহের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। তখন স্বপ্নের ঘোর চুরমার হয়ে গিয়ে স্কারলেট কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হল। দেখল চার্লস লাজুক চোখে ওর ড্রেসিং রুম থেকে রাতের পোশাক পরে বেরিয়ে এল। গলা পর্যন্ত টেনে দেওয়া চাদরের ওপর থেকে স্কারলেটের সচকিত দৃষ্টি দেখে চোখ সরিয়ে নিল। 

স্কারলেট জানে যে বিবাহিত নারী-পুরুষ একই শয্যায় শয়ন করে, কিন্তু এটা নিয়ে কখনও বিশেষ করে ভাবেনি। নিজের মা-বাবার সম্বন্ধে ব্যাপারটা ওর কাছে কখনওই অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কিন্তু নিজের ব্যাপারে কখনওই ভেবে দেখেনি। বারবেকিউএর পর আজ প্রথম উপলব্ধি করল তাড়াহুড়ো করে ও এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ওকে এমন একজনের সাথে শয্যা ভাগাভাগি করতে হবে যাকে সে কনোদিনই বিয়ে করতে চায়নি। এমন একটা দিনে যখন অ্যাশলেকে চিরতরে হারানোর বেদনায় ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। একেবারে অসহ্য! চার্লস দ্বিধাগ্রস্ত পদক্ষেপে বিছানার দিকে এগিয়ে আসতেই ও হিসহিসিয়ে বলল,

“খবর্দার, তুমি যদি আমার কাছাকাছি আস, তাহলে আমি কিন্তু খুব জোরে চেঁচাব! সত্যি বলছি কিন্তু – একেবারে তারস্বরে চেঁচাব! তুমি চলে যাও! আমাকে ছোঁবার চেষ্টা একদম করবে না বলছি!”

আর তাই চার্লসকে সারা রাত ঘরের কোনে রাখা একটা আরামকেদারায় বসে কাটাতে হল। অবশ্য এই ঘটনায় ও খুব একটা নিরাশ হয়নি। ও বুঝেছিল – অন্তত ওর মনে হয়েছিল যে ও বুঝতে পেরেছে – এটা হল ওর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর স্বাভাবিক লজ্জা আর নারীসুলভ কমনীয়তারই অভিব্যাক্তি। আরামকেদারায় একটা সুখকর অবস্থিতির অন্বেষণ করতে করতে ভাবছিল যে যতক্ষণ স্কারলেটের জড়তা না ভাঙ্গে, ওকে সময় দেওয়া উচিত – কেবল –কেবল – ওকে তো খুব শিগগিরই যুদ্ধে চলে যেতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর।

পরের দিন, অ্যাশলের বিয়ের দুঃস্বপ্ন নিজের বিয়ের থেকেও স্কারলেটকে বেশি করে বিদ্ধ করল। আপেলরঙের সবুজ ড্রেসে, টুয়েল্ভ ওকসের বৈঠকখানায়, শত শত মোমবাতির আলোয়, একই অতিথির ভীড়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখল অতি সাধারণ দেখতে মেলানি হ্যামিল্টনকে মেলানি উইল্কস হওয়ার সময় কি উজ্জ্বল আর সুন্দর দেখাচ্ছে। অ্যাশলে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল। ওর অ্যাশলে! নাহ, আর ওর অ্যাশলে নয়! সত্যিই কি ও কখন ওর ছিল? সব কিছুই কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে, আর ভেবে ভেবে ওর হৃদয় খুব ক্লান্ত! বলেছিল যে ওকে ভালবাসে, কিন্তু তাহলে দুজনকে আলাদা হতে হল কেন? নাহ কিছুই মনে করতে পারছে না। এটা ঠিক যে চার্লসকে বিয়ে করে ও কাউন্টির লোকদের রসাল গালগল্প করবার সু্যোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়! একটা সময় ছিল, যখন এটা সম্পর্কে ওর ভয় ছিল; এখন আর এর কোন গুরুত্বই নেই। যেটা জরুরি ভাবনা সেটা অ্যাশলেকে নিয়ে! কিন্তু সে তো এখন পর হয়ে গেছে। আর ও যাকে বিয়ে করেছে, তাকে ভাল তো বাসেই না, বরং রীতিমত অবজ্ঞা করে।

ওফ! কি অনুতাপই না হচ্ছে! কথায় বলে ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা’। কিন্তু সেটা তো একটা কথার কথা! কিন্তু আজ ও কথাটার সঠিক মানেটা বুঝতে পারছে। কি ইচ্ছেই না হচ্ছে, চার্লসের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে, আবার আগের মত টারায় ফিরে যেতে! কিন্তু কাকে দোষ দেবে? সবই তো ওর নিজের কৃতকর্মের ফল! এলেন কতবার ভাল করে ভেবে দেখতে বলেছিলেন। কিন্তু সে কথা তো ও কানেই তোলেনি! 

তাই সারারাত একটা ঘোরের মধ্যে থেকে ও নেচেছে, জোর করে হেসেছে আর সবাই ভেবেছে ও কত সুখী! কি বোকা সবাই! ওঁরা বুঝতেও পারছে না যে ব্যথায় ওর বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভাগ্যে বুঝতে পারছে না! 

সেই রাত্রে ওকে রাতের পোশাক পরিয়ে দেবার পর ম্যামি যখন চলে গেল, চার্লস লাজুক পদক্ষেপে, দুরু দুরু বুকে – হয়ত আজও আরামকেদারায় রাত কাটাতে হতে পারে – ওর কাছে এল, তখন ও হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। চার্লস বিছানায় এসে বসে ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। নিঃশ্বব্দে কাঁদতে কাঁদতে একসময় চোখের জল শুকিয়ে গেল। তখন চার্লসের কাঁধে মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগল। 

যুদ্ধের দামামা না বেজে থাকলে, নতুন দম্পতির সম্মানার্থে সপ্তাহখানেক ধরে কাউন্টির প্রত্যেকের বাড়িতে বারবেকিউ আর নাচের আসরে আমন্ত্রণ আসত। তারপর সারাটোগা কিংবা হোয়াইট সালফারে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য যেতে পারত। যুদ্ধ শিয়রে বসে নিঃশ্বাস না ফেললে, স্কারলেটের তৃতীয়দিন, চতুর্থদিন, কিংবা পঞ্চমদিন নতুন নতুন ড্রেস পরবার সু্যোগ হত ওর সম্মানে ফোনটেনদের, কিংবা ক্যাল্ভার্টদের, কিংবা টার্লটনদের বাড়ির পার্টিতে। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে কোন পার্টিও হল না। মধুচন্দ্রিমার কথাও দূরে সরিয়ে রাখা হল। বিয়ের সাতদিনের মাথায় চার্লস কর্নেল ওয়েড হ্যাম্পটনের ট্রুপে যোগ দিতে চলে গেল। তার দু’সপ্তাহ পরে অ্যাশলেদের ট্রুপও বিদায় নিল। পুরো কাউন্টি জনশূন্য হয়ে গেল!

এই দুসপ্তাহে, অ্যাশলেকে স্কারলেট কখনও একলা দেখেনি, আলাদা করে কথা বলার সুযোগও পায়নি। ট্রেনে ওঠার আগে একমুহুর্তের জন্য টারায় থেমেছিল – বিদায়ের সেই ভয়ঙ্কর মুহুর্তেও ওর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে পারেনি। মাথা বনেটে ঢাকা, গায়ে শাল – নবলব্ধ গৃহিনীসুলভ সম্ভ্রম নিয়ে মেলানি অ্যাশলের সাথে সাথে ঘুরেছে। কাউন্টির সাদা কালো নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ ভেঙ্গে পড়েছিল অ্যাশলেকে যুদ্ধে যাবার আগে বিদায় জানাতে। 

মেলানি বলেছে, “স্কারলেটকে একটা চুমু খাও অ্যাশলে। ও এখন আমার বোন।” অ্যাশলের নির্লিপ্ত মুখ নীচু হয়ে স্কারলেটের গালে শীতল ঠোঁট স্পর্শ করেছিল। মেলির নির্দেশিত এই চুম্বনে স্কারলেট কোন আনন্দ অনুভব করেনি। ফিরে যাবার আগে, মেলানি স্কারলেটকে বুকে টেনে নিয়েছিল।

“তুমি অ্যাটলান্টায় এসে আমার আর পিটিপ্যাট পিসির সঙ্গে থেকো। আসবে না অ্যাটলান্টা? আমরা তোমার সঙ্গে একসাথে থাকতে চাই। আমরা চার্লির বউকে আরো ভালভাবে জানতে চাই।”

পাঁচ সপ্তাহ কেটে গেল। সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে চার্লস স্কারলেটকে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছে। লজ্জা জড়ানো, উচ্ছ্বাসপূর্ণ, প্রেমময়। স্কারলেটের প্রতি ওর অনুরক্তি, যুদ্ধ শেষ হলে স্কারলেটকে নিয়ে ওর পরিকল্পনা, স্কারলেটের জন্য নিজেকে বীর হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা, ওর সেনাপতি ওয়েড হ্যাম্পটনের প্রশস্তি – এই সব কথায় চিঠি ভরা থাকত। সপ্তম সপ্তাহে, কর্নেল হ্যাম্পটনের কাছ থেকে প্রথমে একটা টেলিগ্রাম এল। তারপর একটা চিঠি – অত্যন্ত সম্ভ্রমপূর্ণ ভাষায় শোক আর সমবেদনা জ্ঞাপন। চার্লসের মৃত্যুর খবর। কর্নেল আরো আগেই টেলেগ্রাম করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চার্লস নিজের ‘সামান্য’ অসুখের খবর জানিয়ে কাউকে চিন্তায় ফেলতে চায় নি। অভাগা ছেলেটা কেবল প্রেমের ব্যাপারেই প্রতারিত হয়নি, যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের সম্মান নিয়ে মৃত্যুও ওর ভাগ্যে জুটল না। প্রথমে নিউমোনিয়া, আর তারপরে হামে ভুগে, যুদ্ধক্ষেত্রে ঈয়ঙ্কিদের সামনাসামনি পৌঁছানোর আগেই, অকিঞ্চিৎকর মৃত্যু বরণ করল।

যথাসময়ে চার্লসের ছেলের জন্ম হল। সেই সময় পুত্রদের, তাদের বাবা যে সেনাপতির অধীনে যুদ্ধ করেছেন তাঁর নামে নাম দেওয়ার একটা রীতি প্রচলিত হয়ে গেছিল। তাই ওর ছেলের নাম রাখা হল ওয়েড হ্যাম্পটন হ্যামিলটন। যখন স্কারলেট বুঝতে পেরেছিল যে সে মা হতে চলেছে তখন দুঃখে কেঁদে ফেলেছিল। এর থেকে ওর মরে যাওয়াই বেশি ভাল ছিল! যাই হোক, বড় কোন সমস্যা ছাড়াই, সন্তানধারনের নির্দিষ্ট সময় পার করে, বিশেষ কোন কষ্ট ছাড়াই সন্তানের জন্ম দিল, আর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সুস্থ হয়ে উঠল। ম্যামি ওকে আড়ালে বলতে বাধ্য হয়েছিল ব্যাপারটা ঠিক লেডিদের মত হল না, কারণ লেডিদের সন্তানের জন্ম দিতে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। সেই শিশুর প্রতি ও খুব একটা মমতা বোধ করতে পারল না। অবশ্য মনের সে ভাব সে মনেই রাখল। এক তো এই সন্তান তাঁর অনাকাঙ্খিত; সন্তানধারন করবার ইচ্ছে ওর ছিল না। কিন্তু শিশুটি যে তারই একটা অংশ এই কথাটা মেনে নিতে ওর বাধছিল। 

ওয়েডের জন্মের পর যদিও ও দৃষ্টিকটু ভাবে শারীরিক দিক থেকে সুস্থ হয়ে উঠল, কিন্তু মানসিক দিক থেকে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। প্ল্যান্টেশনের প্রত্যেকে ওকে মানসিক অবসাদ থেকে বের করে আনবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকল। কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে এলেন ঘোরাফেরা করেন। জেরাল্ডের গালি দেবার প্রবণতা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেল। মাঝেমাঝেই তিনি জোন্সবোরো থেকে অপ্রয়োজনীয় সব উপহার এনে দিতে লাগলেন। এমন কি বৃদ্ধ ডাক্তার ফোনটেনও স্বীকার করলেন যে সালফার, গুড় আর ভেষজ দিয়ে তৈরি করা টনিকেও স্কারলেটকে চাঙ্গা করতে না পারায় তিনি খুবই বিভ্রান্ত। এলেনকে আড়ালে বললেন স্কারলেটের পর্যায়ক্রমে বিরক্তি আর উদাসীনতার কারণ ওর মানসিক আঘাত। অবশ্য স্কারলেটের বলবার ইচ্ছে থাকলে বলতে পারত যে ওর সমস্যা একেবারেই আলাদা আর বেশ জটিল। মা হবার একঘেয়েমি আর বিহ্বলতা এবং অ্যাশলের অনুপস্থিতিই হল ওর অবসাদের সঠিক কারণ।

একঘেয়েমিটা প্রবল, আর কখনওই পিছু ছাড়তে চাইছে না। মনোরঞ্জনের কথা কাউন্টিতে আজকাল কেউ চিন্তাই করতে পারে না। সামাজিক জীবনও একেবারে স্তব্ধ। কারণ ট্রুপের সাথে আমোদপ্রিয় ছেলের দল যুদ্ধে চলে গেছে। টার্লটনদের চার ভাই, ক্যাল্ভার্টরা দু’ভাই, ফোনটেনরা, মুনরোরা, জোন্সবোরো, ফেয়াটভিল, লাভজয়ের সব আকর্ষক তরুনেরা। কেবলমাত্র, যাঁরা বয়ষ্ক কিংবা প্রতিবন্ধী আর মহিলারা থেকে গেছেন। এঁদের সময় কাটে সেলাইফোড়াই নিয়ে, কিংবা আরো বেশি তুলো চাষ করে, আরো বেশি করে শুয়োর, ভেড়া আর গরু প্রতিপালন করে, যাতে সেগুলো সেনাবাহিনীর কাজে লাগতে পারে। শক্ত সবল পুরুষ মানুষ কাউন্টিতে আর দেখতেই পাওয়া যায় না। একমাত্র স্যুয়েলেনের মাঝবয়সী প্রেমিক ফ্র্যাআঙ্ক কেনেডি আর তাঁর প্রতিনিধি দলকে, খাবার এবং অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করার জন্য প্রতিমাসে একবার ঘোড়ায় চড়ে আসতে হত। প্রতিনিধি দলের লোকেরা ছিল একেবারেই নীরস; আর ফ্র্যাঙ্ক কেনেডির সাহসহীন প্রণয় নিবেদন দেখলে স্কারলেট বিরক্তই হত, আর পরের দিকে সেই বিরক্তি চেপে রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। কবে যে ওঁর আর স্যুয়েলেনের মধ্যের ব্যাপারটার ফয়সলা হবে কে জানে! 

প্রতিনিধি দলের লোকেরা যদি মজাদার হত তাহলেও স্কারলেট ফুর্তি করতে পারত না। ও তো বিধবা, তাই ওর হৃদয়ও তো এখন সমাধিস্ত। অন্তত সকলে তাই মনে করে আর চায় যে ওর আচরণও যে সেরকমই হয়। এটাই তাঁর কাছে আরো বিরক্তির কারণ ছিল, কারণ চার্লসের ব্যাপারে কিছুই মনে করতে পারত না, কেবল ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেবার সময় ওর সেই বাছুরের মত চাউনিটা ছাড়া। সেই ছবিটাও দিনে দিনে আবছা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাহলেও ও এখন বিধবা, তাই বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে। কুমারী মেয়েদের মত আমো আহ্লাদ ওর করা উচিত নয়। সব সময় বিষন্ন আর নির্লিপ্ত থাকতে হবে। এলেন পইপই করে সাবধান করে দিয়েছেন। একদিন ফ্র্যাঙ্কের একজন সহকারী স্কারলেটকে দোলনায় বসিয়ে দুলিয়ে দিচ্ছিল আর স্কারলেট হেসে লুটিয়ে পড়ছিল। এলেন সেটা দেখে ফেলেছিলেন। গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে স্কারলেটকে বুঝিয়েছিলেন যে কত সহজেই লোকেরা বিধবা মহিলাদের নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলতে শুরু করে দেয়। বিধবাদের বিবাহিত মহিলাদের চেয়ে দ্বিগুণ সতর্ক থাকতে হয়।

“আর একমাত্র ভগবানই জানেন,” মায়ের স্নিগ্ধ উপদেশ বাধ্য মেয়ের মত শুনতে শুনতে স্কারলেট ভাবছিল, “বিবাহিত মহিলাদের আমোদ আহ্লাদ করবার সুযোগ নেই বললেই চলে! এর থেকে বিধবাদের মরে যাওয়াই ভাল!” 

বিধবাদের কালো রঙের বিচ্ছিরি পোশাক পরতে হবে, তাতে ফুল, পাতার নক্সা থাকতে পারবে না। লেস কিংবা এমব্রয়ডারির কাজ থাকা চলবে না। গয়না পরা যাবে না। কেবল শোকসূচক অনিক্স পাথর লাগানো ব্রোচ বা মৃত ব্যক্তির চুল থেকে তৈরি নেকলেস পরা যাবে। আর বনেটের ওপর থেকে হাঁটু পর্যন্ত কালো আচ্ছাদনে ঢেকে রাখতে হবে। বিধবা হবার অন্তত তিন বছর পরে সেটার ঝুল কাঁধ পর্যন্ত ছোট করা যাবে। বিধবারা মজা করে আড্ডা দিতে পারবে না। জোরে হাসতেও পারবে না। হাসলেও তার মধ্যে বিষন্নতা মেশানো থাকতে হবে। দুঃখের হাসি। সবথেকে বিপদের ব্যাপার হল তুমি কখনও পুরুষসান্নিধ্যে তোমার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারবে না। কোন ভদ্রলোক যদি সুরুচির তোয়াক্কা না করে তোমার প্রতি আগ্রহ দেখায়, তাহলে তাঁকে তোমার মৃত স্বামীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নিরস্ত করতে হবে। হ্যা কখনো কখনো বিধবাদের পুনর্বিবাহ করতে স্কারলেট যে দেখেনি এমন নয়, তবে তখন তারা বুড়িয়ে একদম ঝুনো হয়ে গেছে। পড়শিদের চোখের সামনে ওরা এরকম গর্হিত কাজ কেমন করে করে, সেটা স্কারলেটের মাথাতে আসতে চায় না। আর সেটাও কোন বিপত্নিক পুরুষের সঙ্গে, যার হয়ত বিরাট প্ল্যান্টেশন আছে আর এক ডজন কাচ্চাবাচ্চা আছে।

বিয়ে ব্যাপারটাই খারাপ – আর তারপরে বিধবা হওয়া – সে তো মরে যাওয়ার শামিল! কি বোকার মত সবাই বলে থাকে যে চার্লসের অবর্তমানে, ওয়েড হ্যাম্পটনই হল স্কারলেটের একমাত্র অবলম্বন! ওর বেঁচে থাকার প্রেরণা! ও নাকি চার্লসের ভালবাসার মরণোত্তর নিদর্শন। স্কারলেট অবশ্য ওদের বিশ্বাসে আঘাত দেয় না। ও অবশ্য এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। মাঝে মাঝে তো ভুলেই যায় যে ওয়েড ওর সন্তান। 

প্রতিদিন সকালে একটা খুশি খুশি মন নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে আর হাই তুলতে তুলতে নিজেকে সেই পুরনো স্কারলেট ও’হারাই মনে হয়। ম্যাগনোলিয়া ঝোপের ভেতর দিয়ে সূর্যে আলোকে আগের মতই উজ্জ্বল লাগে। মকিং বার্ডের গান শুনতে শুনতে বেকন ভাজার সুগন্ধ পায়। নিজেকে আগের মতই নিশ্চিন্ত আর কিশোরী মনে হয়। আর তারপরই একটা খিটখিটে ক্ষুধার্ত কান্নার আওয়াজে চমকে ঊঠে ভাবে, “মনে হচ্ছে বাড়িতে কোথাও একটা বাচ্চা কাঁদছে!” তারপর মনে পড়ে, আরে এ তো ওরই বাচ্চা! কি বিভ্রান্তিকর ব্যাপার!

আর অ্যাশলে! অ্যাশলেই তো মন জুড়ে আছে! জীবনে এই প্রথম টারাকে ওর অসহ্য লাগছে। অসহ্য লাগছে এই লম্বা লাল রাস্তাটাকে যেটা পাহাড়ের গা ঘেঁসে নদীর কাছে চলে গেছে। লাল রঙের খেত আর সেই খেতে সবুজ তুলোর ফলন অসহ্য লাগছে। প্রতিটা জায়গা, প্রতিটা গাছ, নয়ানজুলি, রাস্তাঘাট, অলিগলি, সব কিছুই ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখন ও অন্য মেয়ের হয়ে গিয়েছে, যুদ্ধে চলে গিয়েছে, কিন্তু ওর স্মৃতি স্কারলেটকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, যখন গোধুলির ম্লান আলো রাস্তার ওপর পড়ে। মনে হয় উঠোনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, ধূসর চোখে অ্যাশলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। এমন কোনদিন হয়নি, টুয়েল্ভ ওকসের দিক থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ নদীর ধার দিয়ে আসার শব্দ শুনে এক মুহুর্তের জন্যেও অ্যাশলে আসছে ভেবে খুশিয়াল হয়ে ওঠেনি। 

এক সময় টুয়েল্ভ ওকসকে ভালবাসলেও আজকাল অসহ্য লাগে। তবুও ওখানে যেতে মন চায়। জন উইল্কস আর মেয়েরা অ্যাশলেকে নিয়ে আলোচনা করেন – ভার্জিনিয়া থেকে লেখা ওর চিঠি পড়েন। কষ্ট হলেও ওগুলো শুনতে ইচ্ছে করে। একগুঁয়ে ইন্ডিয়া আর হ্যালবেলে হানিকে ও অপছন্দ করে আর এটাও জানে যে ওরা ওকে ঠিক ততখানিই অপছন্দ করে। কিন্তু ওদের থেকে সরেও ও থাকতে পারেনা। যতবারই টুয়েল্ভ ওকস থেকে ঘুরে এসেছে, ওর এত মন খারাপ হয়েছে যে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছে আর সাপার খাবার ইচ্ছেই হয়নি।

ওর এই না খেতে চাওয়াটাই এলেন আর ম্যামির সব থেকে বেশি চিন্তার কারণ হয়েছে। ম্যামি লোভনীয় খাবার নিয়ে আসে আর বলে এখন বিধবা হয়ে যাওয়ায় যত খুশি খাওয়ার কোন বাধা নেই। কিন্তু স্কারলেটের খিদেই পায় না।

তারপর যখন ডাক্তার ফোনটেন খুব গম্ভীরভাবে বললেন যে এরকম অবস্থায়, মনের দুঃখে মেয়েরা অসুস্থ হয়ে মৃত্যু ডেকে আনে, তখন এলেন খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন, কারণ তাঁর মনেও একই ভয় ঘোরাফেরা করছিল। 

“কিছু কি করা যায় না ডাক্তারবাবু?”

“বায়ু পরিবর্তনই এখন ওর পক্ষে সব থেকে ভাল,” ডাক্তার ফোনটেন বললেন। মনে মনে এরকম অসন্তোষজনক রুগীকে ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলতে চাইলেন। 

অতএব নিতান্ত অনিচ্ছাভরে, সপুত্র স্কারলেট প্রথমে স্যাভান্নায় ও’হারা আর রোবিল্যা্র আত্মীয়দের কাছে আর পরে চার্লসটনে এলেনের বোন পলাইন আর ইউল্যালিদের কাছে বেড়াতে গেল। কিন্তু এলেনের প্রত্যাশামত যতদিন থাকার কথা, তার একমাস আগেই আবার টারায় ফিরে এল, কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই। স্যাভান্নায় সকলে ওর সাথে সহৃদয় ব্যবহারই করেছিলেন। কিন্ত্য জেমস আর অ্যান্ড্রুর স্ত্রীরা ঘরের এককোনে বসে বসে যে সব পুরোনো কাসুন্দি ঘাটতে ভালবাসতেন সেগুলো স্কারলেটের শোনার ইচ্ছেই হত না। রোবিল্যারদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। আর চার্লস্টনে তো অসহ্য লাগল স্কারলেটের। 

পলাইন মাসী আর তাঁর প্রৌঢ় স্বামী টারার থেকেও নির্জন, নদীর ধারে এক প্ল্যান্টেশনে নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করেন। তাঁদের নিকটতম প্রতিবেশী অন্তত কুড়ি মাইল দূরে থাকতেন। সাইপ্রেসের জলাভুমি আর ওক গাছের সারির নির্জন আর অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। শ্যাওলায় আচ্ছাদিত ওক গাছের সারি দেখে মনে হত যেন জেরাল্ডের গল্পের আইরিশ ভুতেরা ধূসর কুয়াশার মত চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারাদিন উল বোনা ছাড়া করার আর কিছু থাকত না। রাতের বেলায় ক্যারী মেসো জোরে জোরে মিস্টার বুল্যার লিটনের১ রচনা পড়ে শোনাতেন। [১ বুল্যার লিটন – এডোয়ার্ড জর্জ আর্ল লিটন বুল্যার – বৃটিশ ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার – লাস্ট ডেজ় অফ পম্পেই তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস]

চার্লসটনের ব্যাটারি এলাকায় বিশাল বাড়ির পাঁচিলতোলা বাগানে ইউল্যালী মাসীর সঙ্গেও সময় কাটানোটাও মোটেই আনন্দজনক ছিলনা। পাহাড়ে ঘেরা বৃক্ষশোভিত খোলামেলা জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত স্কারলেটের মনে হত যে জেলখানায় বন্দী। অবশ্য এখানে পলাইন মাসীর জায়গা থেকে সমাজ জীবনের আস্বাদ অনেক বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু যাঁরা আসা যাওয়া করতেন, তাঁদের স্কারলেটের মনে ধরত না। এঁরা পরম্পরা আর পারিবারিক স্বাতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। স্কারলেট ভাল করেই জানত যে এঁরা মনে করেন স্কারলেট হল অসম বিবাহের সন্তান। এঁরা ভেবেই পেতেন না একজন রোবিল্যার কি করে একজন নবাগত আইরিশকে বিয়ে করতে পারে! স্কারলেটের কেমন যেন মনে হত মাসী ওর আড়ালে এই নিয়ে ওঁদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এসব ভেবে ওর মাথা গরম হয়ে যেত, কারণ জেরাল্ডের মত সেও পরিবার নিয়ে কখন মাথা ঘামায় নি। জেরাল্ডের জন্য ওর খুব গর্ব। শুধু আইরিশ মাথার জোরে আজ এত কিছু করে দেখাতে পেরেছেন।

আর চার্লস্টনবাসীরা ফোর্ট সামটারের ঘটনার জন্য নিজেদের দায়ী করতে ভালবাসেন। এই বোকাগুলো বুঝতেই পারেনা ওরা গুলিটা চালিয়ে যুদ্ধ শুরু হতে না দিলে, অন্য যে কেউ সেটা করত। এঁদের আস্তে আস্তে কথা বলার ধরন পার্বত্য জর্জিয়ার দ্রুত লয়ের বাচনভঙ্গী থেকে একদম আলাদা। ওর মনে হয় এই ধরনের কথা শুনতে শুনতে ও এক সময় চিৎকার করে উঠবে। একবার তো একটা অনুষ্ঠানে স্কারলেট জেরাল্ডের কথা বলার ধরন নকল করে সবাইকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। তারপরই ও টারায় ফিরে গেল। চার্লস্টনের বাচনভঙ্গী কানে যাওয়ার থেকে অ্যাশলের স্মৃতিতে কষ্ট পাওয়া ভাল। 

টারার আয় বাড়ানোর জন্য এলেন যখন উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছিলেন – যাতে কনফেডারেটদের সাহায্য করা যায় – সেই সময় একদিন চার্লস্টন থেকে টারায় ফিরে এল; রুগ্ন, ফ্যাকাসে আর খিটখিটে। তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। মর্মপীড়া কি জিনিষ, নিজের জীবনে তিনি উপলব্ধি করেছেন। তাই রাতের পর রাত, জেরাল্ডের পাশে শুয়ে, তাঁর নাসিকা গর্জন শুনতে শুনতে, মনে মনে তোলপাড় করে একটা উপায় খুঁজতে লাগলেন। চার্লসের পিসী, মিস পিটিপ্যাট হ্যামিল্টন, স্কারলেটকে অ্যাটলান্টায় পাঠানোর আর অনেকদিন থাকতে দেবার অনুরোধ করে চিঠির পর চিঠি লিখে চলেছিলেন। এই প্রথম এলেন কথাটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখলেন।

মিস পিটিপ্যাট লিখেছিলেন যে তিনি আর মেলানি একটা বিশাল বাড়িতে একলা থাকেন “কোনরকম পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই। আমাদের প্রিয় চার্লি আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেল। আমার ভাই হেনরি অবশ্যই আছে। কিন্তু সে আমাদের সাথে থাকে না। হয়ত স্কারলেট হেনরির ব্যাপারে আপনাদের সবকিছু জানিয়ে থাকবে। কিন্তু ভদ্রতাবশতঃ চিঠিতে আর সেই ব্যাপারে কিছু লিখতে দ্বিধাবোধ করছি। স্কারলেট এখানে এসে থাকলে মেলি আর আমি খুওবি নিরাপদ বোধ করব। তিনজন নিঃসঙ্গ মহিলা দু’জনের থেকে ভাল। আর স্কারলেট হয়ত ওর দুঃখ কিছুটা ভুলতে পারবে, এখানকার হাসপাতালে বীর সন্তানদের সেবা করে, যেমন মেলি করে থাকে। এছাড়া মেলি আর আমি ওকে দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি ___”

তাই আবার শোকের পোশাকে ট্রাঙ্ক গুছিয়ে নিয়ে, ওয়েড হ্যাম্পটন আর ওর আয়া প্রিসিকে নিয়ে অ্যাটলান্টার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। এলেন আর ম্যামি ওকে আচার আচরণ সম্বন্ধে সতর্ক করলেন, আর জেরাল্ড কনফেডারেট সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য একশ ডলার পাঠালেন। অ্যাটলান্টায় খুব একটা যাবার ইচ্ছে স্কারলেটের ছিল না। এক তো পিটিপ্যাট পিসীকে ওর বোকার হদ্দ বলে মনে হয়। তার ওপর অ্যাশলের বউয়ের সঙ্গে একই ছাদের তলায় থাকার ব্যাপারটাও ওর কাছে অসহ্য মনে হল। কিন্তু স্মৃতির ভারে কাউন্টিতে থাকাও ওর কাছে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। একটা পরিবর্তন সে মনে প্রাণে চাইছিল।

(চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ