পরদিন কাজে ইস্তফা দিলাম, আমার উপরওয়ালা কিছু কানাঘুষা শুনে থাকবে, সেও ধরে নিল আপাতত একটা লম্বা ছুটিতে যাওয়াই আমার জন্য মঙ্গল। আমি চলে যাচ্ছি শুনে সহকর্মীদের অনেকেই ভীষণ অবাক হলো কিন্তু কেউই আমার সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য তেমন চাপ দিল না।
দেখলাম, চাকরি ছাড়া খুব কঠিন কিছু নয়। একবার কিছু ছাড়ার সংকল্প করলে ছাড়া যায় না এমন খুব কমই জিনিস আছে। একবার হাঁটকানো শুরু করলে হেন বস্তু নেই, যা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। যেন বাজিতে হেরে প্রায় সর্বস্ব হারানোর পরে ভাবছি টাকাকড়ি আর যা কিছু বাকি আছে তাও হারি, চুলোয় যাক কৌপিনখানাও। শেষটুকু আঁকড়ে রাখা কঠিন।
দেখলাম, চাকরি ছাড়া খুব কঠিন কিছু নয়। একবার কিছু ছাড়ার সংকল্প করলে ছাড়া যায় না এমন খুব কমই জিনিস আছে। একবার হাঁটকানো শুরু করলে হেন বস্তু নেই, যা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। যেন বাজিতে হেরে প্রায় সর্বস্ব হারানোর পরে ভাবছি টাকাকড়ি আর যা কিছু বাকি আছে তাও হারি, চুলোয় যাক কৌপিনখানাও। শেষটুকু আঁকড়ে রাখা কঠিন।
একটা মাঝারি গোছের নীল স্যামসোনাইট স্যুটকেসে আমার যা কিছু লাগতে পারে, তার সব গুছিয়ে তুললাম। ইজুমিও সমান মাপেরই লাগেজ নিল।
মিসরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এক রকম প্রচণ্ড ভয় আর আশঙ্কা আমায় গ্রাস করল যে অন্য কেউ আমার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যাবে। এ রকম কত হাজার হাজার নীল স্যামসোনাইট স্যুটকেস আছে দুনিয়ায়। হয়তো গ্রিসে গিয়ে স্যুটকেস খুলে দেখব সেটা অন্য কারো জিনিসপত্রে ঠাসা। রীতিমতো প্যানিক অ্যাটাক হতে লাগল আমার। স্যুটকেসটা হারালে এক ইজুমি ছাড়া বিগত জীবনের সঙ্গে আমার সব সূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে। হঠাৎ কেমন মনে হতে লাগল, দুনিয়ার সামনে থেকে যেন হাওয়া হয়ে গেছি আমি, একেবারে অদৃশ্য। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। যেন এই যে প্লেনে বসে আছি, এটা আর আমি নই। যেন ভুলক্রমে আমার মস্তিষ্ক হুবহু আমার মতন দেখতে আরেকটা প্যাকেজে সুবিধে মতন ঢুকে গেছে। মাথার ভেতরটা চরম বিশৃঙ্খল। যেন আমার এখনই জাপানে ফিরে যাওয়া চাই, তবেই আমার নিজের শরীরের ভেতর আবার ঢুকে যেতে পারব। কিন্তু এই তো আমি জেট প্লেনে সওয়ার হয়ে মিসরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি, এ তো পাল্টানো যাবে না। যেন একটা নতুন শরীরের প্লাস্টারকাস্টে সাময়িকভাবে ঢুকে গেছি, চুলকোলে প্লাস্টারের খড়ি উড়বে। প্রচণ্ড কাঁপুনি হতে লাগল আমার। মনে হতে লাগল, এভাবে যদি আরো কিছুক্ষণ কাঁপতে থাকি তবে এ শরীর নামক আধারখানা ভেঙে খান খান হয়ে ধুলোয় মিশে যাবে। প্লেনের বাতানুকূল আবহাওয়ার ভেতরই আমি কুলকুল করে ঘামছি। আমার শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে আমার গায়ে, বিচ্ছিরি গন্ধ উঠছে আমার গা থেকে। পুরো সময়টা ধরে অবশ্য ইজুমি আমার হাত শক্ত করে ধরে ছিল, মাঝে মাঝে জড়িয়েও ধরছিল একটাও কথা না বলে, সে জানত আমার কেমন লাগছিল। এ কাঁপুনিগুলো আসছে আর প্রায় আধঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে, মনে হচ্ছে মরে যাই, কানে রিভলভারের নল সেঁধিয়ে দিয়ে ট্রিগার চেপে দিই যেন আমার দেহ আর মন একসঙ্গে ধুলোয় মিশে যায়।
কাঁপুনিগুলো থামার পরে অবশ্য আমার হালকা লাগতে লাগল হঠাৎ করেই, উদ্গ্র্রীব হয়ে থাকা কাঁধগুলো একটু ভারমুক্ত হয়ে উঠল, স্রোতের সঙ্গে ভাসিয়ে দিলাম নিজেকে। কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। যখন চোখ খুললাম, নিচে তাকিয়ে দেখি ইজিয়ান সাগরের ফিরোজা জলবিথার ছড়িয়ে আছে।
***
দ্বীপটায় আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় যে সমস্যা অপেক্ষা করে ছিল, তা হচ্ছে কোনো কিছুই করার নেই এখানে। আমাদের কোনো চাকরি নেই, বন্ধুও নেই এখানে। দ্বীপটায় কোনো সিনেমা হল নেই, টেনিস কোর্ট নেই, কোনো বই পড়ার নেই। এত তাড়াহুড়ো করে আমরা জাপান ছেড়েছি যে সঙ্গে করে বই আনার কথা মনেও ছিল না। এয়ারপোর্ট থেকে দু’খানা উপন্যাস কিনেছিলাম, সেগুলো আর ইজুমির কাছে ছিল এক কপি ইসকাইলাসের ট্র্যাজেডি। এর সব কয়টা আমার দুবার করে পড়া শেষ। সৈকতের ম্যাগাজিনের দোকানে কয়েকটা ইংরেজি পেপারব্যাক আছে কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। পড়াটা আমার নেশার মতো ছিল, সবসময় ভাবতাম কখনো খুব খানিকটা ফুরসত পেলে আচ্ছামতো বইয়ে ডুব দেব, আর নিয়তির খেল এমনই, এখন সারা দুনিয়ার সবটুকু সময় আমার হাতে অথচ পড়ার কিছু নেই।
ইজুমি গ্রিক শিখতে শুরু করেছিল, জাপান থেকে সঙ্গে করে একটা গ্রিক ভাষা শিক্ষার বই এনেছিল সে, ক্রিয়াপদগুলোর একটা চার্ট সঙ্গে করে নিয়ে ঘুরত আর সেগুলো সে বানান করার মতো চেঁচিয়ে পড়ত। এক পর্যায়ে দেখা গেল, সে দোকানিদের সঙ্গে আর ক্যাফের ওয়েটারদের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা গ্রিক ভাষায় কাজ চালিয়ে নিতে পারছে। এভাবে সামান্য কিছু লোকের সঙ্গে আমাদের খানিকটা পরিচয় হলো। আমিও দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড় ফ্রেঞ্চটা আবার সড়গড় করে নিলাম, বলা যায় না কাজেও তো আসতে পারে কিন্তু এই মরার দ্বীপে আমার একটা আদমের সঙ্গে দেখা হলো না যে ফ্রেঞ্চ বলে। টাউনে অবশ্য আমরা ইংরেজিতেই চালিয়ে নিতে পারতাম। কোনো কোনো বয়স্ক লোক ইতালিয়ান বা জার্মান বলতে পারত। তবে ফ্রেঞ্চ সেখানেও অচল।
তেমন কিছু করার ছিল না বলে সর্বত্রই আমরা হেঁটে বেড়াতাম। সৈকতের দিকটায় কয়েক দিন মাছ ধরার চেষ্টা করে একেবারে বিফল হলাম। মাছের অভাব ছিল না সেখানে, তবে জল অতিরিক্ত স্বচ্ছ বলে মাছগুলো বড়শির ডগা থেকে শুরু করে কে বড়শি ফেলে ধরার চেষ্টা করছে তাদের চেহারা অব্দি দেখে ফেলত। একেবারে মহামূর্খ মাছ না হলে এভাবে কেউ ধরা পড়ে না। স্থানীয় দোকানগুলোর একটা থেকে একখানা স্কেচবুক আর কিছু জলরঙ কিনলাম একদিন। তারপর দ্বীপের নানান জায়গার দৃশ্য আর মানুষের মুখ স্কেচ করে বেড়ালাম। ইজুমি আমার পাশেই বসে বসে দেখত আর নিজের গ্রিক মুখস্থ করত। স্থানীয়রাও আমার আঁকা দেখতে ভিড় জমাত, সময়ক্ষেপণের আশায় এদের কারো কারো পোর্ট্রেটও আমি করতে শুরু করলাম, এরা তাতে ভারি আমোদ পেল। কাউকে তার ছবি এঁকে দিলে সে হয়তো আমাদের বিয়ার কিনে দিত। একবার এক জেলে তার পোর্ট্রেট পেয়ে আমাদের আস্ত একটা অক্টোপাস উপহার দিয়েছিল।
ইজুমি একদিন বলল, ‘পোর্ট্রেট এঁকেই রোজগার করতে পারতে কিন্তু! বেশ ভালো আঁকো তুমি, ভালোই ব্যবসা করে ফেলতে। এই ধরো ভেক ধরলে যে তুমি একজন জাপানি শিল্পী। এখানে তেমন কাউকে তো এরা দ্যাখেনি। ভালোই হতো!’
আমি হেসে ফেললাম, যদিও ইজুমির মুখ বলছে ও পরিহাসচ্ছলে বলেনি। মনে মনে দেখলাম গ্রিক এক দ্বীপের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে পোর্ট্রেট করছি আর মাঝে মধ্যে বিয়ার উপহার পাচ্ছি। খারাপ না!
-‘আর আমি ধরো জাপানি ট্যুরিস্টদের ট্র্যুর কনডাক্টর হয়ে গেলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে জাপানি ট্যুরিস্ট বাড়বে নিশ্চয়ই, আর আমাদেরও অর্থ সাশ্রয় হবে। অবশ্য এর মানে হচ্ছে, আমায় আরো অনেক ভালো করে গ্রিক শিখতে হবে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ইজুমি, তুমি কি সত্যি মনে করো, আমরা এ দ্বীপে এভাবে কিছুই না করে আড়াই বছর কাটিয়ে দিতে পারব?’
ইজুমি বলল, ‘যতক্ষণ না আমাদের টাকা কেউ ডাকাতি করে নিয়ে যাচ্ছে বা শক্ত কোনো অসুখবিসুখ করছে, ভবিষ্যতে কখন কী হয় তা তো বলা যায় না... ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে পারব তো। তার পরেও আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, ওই যে কখন কী হয়!’
তখন পর্যন্ত আমি কখনো ডাক্তারের কাছে যাইনি, সে কথা আমি ইজুমিকে মনে করিয়ে দিলাম। মুখ একদিকে বাঁকিয়ে আর ঠোঁট চেপে ধরে ইজুমি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইল, বলল, ‘এই ধরো আমার পেটে বাচ্চা এল, তখন কী করবে? আমি জানি তুমি সবসময় যথেষ্ট প্রটেকশন নাও, তার পরেও তো ভুলচুক হতেই পারে। আর যদি সেটা হয় তাহলে আমাদের পয়সাকড়ি কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে আসবে।’
-‘তাই যদি হয়, আমরা তখনই জাপান ফিরে যাব বলেই আমার ধারণা’ বললাম আমি।
ইজুমি মৃদু গলায় বলল, ‘তুমি আসলে বুঝতে পারছ না, তাই না? জাপানে আমরা আর কখনই ফিরে যাচ্ছি না?’
***
ইজুমি তার গ্রিক ভাষাশিক্ষা চালিয়ে গেল। আমি আমার আঁকাআঁকি। আমার সারা জীবনের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ সময় সেটা। আমরা সাধারণ খাওয়াদাওয়াই করতাম, ওয়াইনও খেতাম রয়েসয়ে এবং সবচেয়ে সস্তাটা। প্রতিদিন কাছের একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠতাম গিয়ে। সেখানে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল, সেখান থেকে দূরের দ্বীপপুঞ্জগুলো দেখা যেত। তাজা বাতাসে আর এমন কায়িক শ্রমে স্বাস্থ্য খুব ভালো হয়েছিল আমার। সূর্যাস্তের পর সারা দ্বীপে কোনো শব্দ পাওয়া যেত না। সেই নৈঃশব্দ্যে আমি আর ইজুমি শরীর মেলাতাম আর কত রকম কথাই যে বলতাম। আর আমাদের শেষ ট্রেন ধরার তাড়া ছিল না, ছিল না নিজ নিজ জীবনসঙ্গীকে মিথ্যে বলার দায়। অবিশ্বাস্য রকমের আনন্দদায়ক একটা সময়। বাইরে শরত্কালের রঙ পর্দা চড়াচ্ছিল ধীরে ধীরে, নতুন শীত পড়ে গেছে। বাতাসে শীতের ছোঁয়া লাগছিল। সমুদ্রের ঢেউয়ে জমছিল সাদা ফেনা।
এ রকম একটা সময়ে আসলে আমরা সমুদ্রের ধারে বসে সেই মানুষখেকো বেড়ালদের গল্পটা কাগজে পড়লাম। সেই একই খবরের কাগজে জাপানের সম্রাটের শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হওয়ার খবরও ছিল। তবে কাগজটা আমরা কিনেছিলাম এক্সচেঞ্জ রেট দেখার জন্য। ইয়েন ড্রাকমার বিপরীতে কতটা বাড়ছিল, আমাদের জন্য সেটা গুরুত্বপূর্ণ, ইয়েন শক্ত হওয়ার মানে আমাদের জমানো অর্থের অংকটা বেশি। বেড়ালগুলোর খবর পড়ার পরের একদিন আমি ইজুমিকে বললাম, ‘বেড়ালের কথায় মনে পড়ে গেল, আমার ছোট্টবেলায় একটা বেড়াল ছিল, বেড়ালটা ভীষণ অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেছিল।’
ইজুমি তার ক্রিয়াপদের চার্ট থেকে উত্সুক মুখ তুলে তাকাল, ‘কীভাবে হারাল?’
-‘আমার বয়স তখন সাত বা বড়জোর আট। আমরা কোম্পানির দেয়া একটা বাড়িতে থাকতাম, বাড়িটার লাগোয়া একটা বিরাট বাগান ছিল, বাগানে একটা বহু পুরনো পাইন গাছ। গাছটা এত উঁচু যে তুমি তার চূড়া দেখতে পাবে না। একদিন পেছনের পর্চে বসে আমি বই পড়ছি, আমাদের টরটয়েজ শেল বেড়ালটা বাগানে খেলছে। বেড়ালটা আপনা থেকেই লাফ দিয়ে দিয়ে উঠছিল, সব বেড়ালই যেমন করে মাঝে মাঝে। কী কারণে যেন সে খুব বিপর্যস্ত, টেরই পায়নি যে আমি তাকে দেখছি। যত দেখছিলাম তত ভয় পাচ্ছিলাম আমি, বেড়ালটাকে মনে হচ্ছিল যেন ভূতে ধরেছে, লাফিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে, লোমগুলো খাড়া, যেন সে এমন কিছু দেখতে পাচ্ছে, যেটা আমি পাচ্ছি না। শেষে সে পাইন গাছটার গুঁড়িটার চারদিকে প্রচণ্ডবেগে দৌড়াতে শুরু করল, ওই ‘লিটল ব্ল্যাক সাম্বো’-তে বাঘটা যেমন করে দৌড়াচ্ছিল। তারপর আচমকা সে থেমে গিয়ে গাছটা বেয়ে তরতর করে উঠে গেল একেবারে মগডাল অব্দি। আমি কেবল সবচেয়ে উঁচু ডালগুলোর ফাঁকে তার ছোট্ট মুখটা দেখতে পেলাম, তখনো সেই মুখ উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত। ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে একদৃষ্টে একদিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি তার নাম ধরে কত ডাকলাম। মনে হলো, সে কিছু শুনতেই পেল না।’
-‘বেড়ালটার নাম কী ছিল?’ ইজুমি জিজ্ঞেস করল।
-‘ভুলে গেছি। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হলো, অন্ধকার হয়ে এল। আমি দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি কখন সে গাছ থেকে নামবে। একসময় সব ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। বেড়ালটাকে আমি আর দেখিনি এরপর।’
-‘খুব অস্বাভাবিক নয়। বেড়ালরা অনেক সময় এভাবে উধাও হয়ে যায়, বিশেষ করে যে ঋতুতে তাদের শরীর গরম হয় তখন তারা খুব উত্তেজিত থাকে, বেরিয়ে পড়ে আর তারপর বাড়ির রাস্তা ভুলে যায়। রাতের বেলা তুমি যখন দেখছিলে না, তখন তোমার বেড়াল নির্ঘাত পাইন গাছটা থেকে নেমে এসেছিল আর তেমনি করে বেরিয়ে পড়েছিল।’
-‘হয়তো তা-ই হবে। আমি তো তখন ছোট, ভেবেছিলাম বেড়ালটা হয়তো গাছেই বাসা করে ফেলল এখন থেকে। হয়তো এমন কোনো কারণ আছে যেজন্য সে নামতে পারছে না। প্রতিদিন আমি পর্চে বসে অপেক্ষা করতাম, পাইন গাছের মগডালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ডালগুলোর আড়াল থেকে বেড়ালটার মুখ উঁকি দিচ্ছে কিনা দেখতাম।’
ইজুমিকে দেখে মনে হলো, ওর ঔত্সুক্যটুকু আর অবশিষ্ট নেই। সে তার দিনের দ্বিতীয় সালেম ধরাল, তারপর মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল।
-‘তুমি কি তোমার সন্তানের কথা ভাবো প্রায়ই?” সে জিজ্ঞেস করল।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কীভাবে এর উত্তর দেয়া সম্ভব, সত্যিটাই বললাম, ‘মাঝে মাঝে মনে করি। সবসময় না। প্রায়ই কিছু না কিছু আমাকে ওর কথা মনে করিয়ে দেয়।’
-‘তুমি ওকে দেখতে চাও না?’
-‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে।’ মিথ্যে বললাম এবার, যেমন করে আমার বোধ করা উচিত সেভাবেই যেন হয় উত্তরটা।
যখন ছেলেটার সঙ্গে একসঙ্গে ছিলাম তখন ভাবতাম জগতে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর বস্তু হচ্ছে আমার এ ছেলেটা। বাড়িতে দেরিতে ফিরলেও প্রথম আমি ওর ঘরে ঢুকতাম, ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখতাম। প্রায়ই একেবারে হাড় গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো করে ওকে আমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হতো। আমার এখনকার জীবনে ওর মুখ, ওর গলার আওয়াজ, ওর কাজকর্ম সবই অনেক দূরের কোনো দেশের বিষয় বলে মনে হয়। সবচেয়ে স্পষ্ট করে আমার মনে আছে ওর সাবানের গন্ধ। আমি ওর সঙ্গে গোসল করতে ভালোবাসতাম, খুব ঘষেমেজে ওকে গোসল করিয়ে দিতাম আমি। ওর চামড়া একটু স্পর্শকাতর ছিল, ওর জন্য আমার স্ত্রী আলাদা সাবান রাখত। নিজের ছেলেটার আর সব স্মৃতি ছাপিয়ে আমার সবচেয়ে তীব্রভাবে মনে আছে সেই সাবানের গন্ধটা।
-‘তুমি যদি জাপান ফিরে যেতে চাও, আমার জন্য যেন আটকে থেকো না। আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি ম্যানেজ করে নেব কোনোভাবে।’
মাথা নেড়ে সায় দিলাম, তবে মনে মনে জানতাম তেমনটা কখনই হবে না।
-‘আচ্ছা তোমার কি মনে হয়, তোমার ছেলে বড় হলে তোমাকে নিয়ে তার স্মৃতি হবে সেই বেড়ালটার মতো? যেন তুমি সেই বেড়ালটা, যেটা একদিন ভূতগ্রস্তের মতো পাইন গাছের মগডালে গিয়ে উবে গেল।’
হেসে ফেললাম আমি, বললাম, ‘হয়তো তা-ই।’
ইজুমি ছাইদানিতে সিগারেটটা চেপে নেভাল আর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, ‘চলো বাড়ি ফিরে যাই, আর তারপর খুব সেক্স করি?’
-‘এখন? এখনো তো সকাল।’
-‘কেন তাতে কী হয়েছে?’
-‘নাহ, কিছু হয়নি।’ বললাম আমি।
***
মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, ইজুমি নেই। বিছানার পাশের ঘড়িটায় সময় দেখলাম। সাড়ে ১২টা। বাতিটা জ্বালানোর জন্য হাতড়ালাম, জ্বালালাম, ঘরের চারদিকে খুঁজলাম। চারদিক এত নিঃসাড় যেন কেউ এসে নৈঃশব্দ্যের ভস্ম ছিটিয়ে দিয়ে গেছে। ছাইদানিতে দুখানা সালেম নেভানো। পাশে সালেমের শূন্য প্যাকেট মোচড়ানো। বিছানা থেকে নেমে বসার ঘরে গেলাম। ইজুমি সেখানে নেই। দরজা খুলে উঠানে এলাম, এক জোড়া ভিনাইল লাউঞ্জ চেয়ার জোছনায় চকচক করছে। ইজুমির নাম ধরে খাটো গলায় ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। আবার ডাকলাম। এবার আমার বুক ধকধক করছে, এটা কি আমার নিজের গলা? কেমন ভারী আর অস্বাভাবিক শোনাল না? কোনো সাড়া নেই এবারো। সমুদ্রের দিক থেকে আসা মিহি বাতাসে কাশ গাছগুলোর ডগা দুলছে। আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে রান্নাঘরে এলাম, স্নায়বিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য আধগ্লাস ওয়াইন ঢাললাম।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাঁধভাঙা জোছনা এসে পড়েছে, বিচিত্র সব ছায়াসম্পাত করেছে দেয়ালে আর মেঝেয়। যেন কোনো এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের জন্য সাংকেতিক মঞ্চসজ্জা করেছে কেউ। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, যে রাতে আমার বেড়ালটা পাইন গাছে উঠে গেছিল, সেই রাতটা ছিল অবিকল এমনি, নির্মেঘ আকাশে পূর্ণ চাঁদ... রাতের খাবারের পরে আমি বেড়াল খুঁজতে আবার পর্চে গেছিলাম সে রাতে। যত রাত বাড়ছিল তত জোছনা গাঢ়তর হচ্ছিল, চোখ সরাচ্ছিলাম না পাইন গাছটা থেকে। প্রায়ই মনে হচ্ছিল বুঝি বেড়ালটার চকচকে চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছিল আমার, অবশ্য এ বিভ্রম বৈ কিছু নয়।
একটা মোটা সোয়েটার পরলাম, জিন্স পরলাম। টেবিল থেকে কয়েনগুলো নিয়ে পকেটে পুরে বের হলাম। ইজুমির হয়তো ঘুম আসছিল না, বাইরে বের হয়েছে হাঁটতে। এছাড়া আর কী হবে। বাতাস নেই আর। আমার নিজের টেনিস সু নুড়িপাথর মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দই কেবল কানে আসছিল আমার, অতিনাটকীয় কোনো ফিল্মি আবহসংগীতের মতো। ভাবলাম ইজুমি হয়তো সৈকতের দিকে গেছে, আর কোথায় যাবে। একটাই পথ সৈকতের দিকে, অতএব এ পথেই তার খোঁজ মিলবে। পথের দুধারের বাড়িগুলোর আলো নেভানো, চাঁদের আলোয় পায়ের তলার জমিন এমন রূপালি হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে এ সমুদ্রের তলদেশের দৃশ্য।
সৈকতের দিকের রাস্তাটায় যেতে যেতে মাঝপথে আমি একটা আবছা গানের আওয়াজ পেয়ে থমকে গেলাম। প্রথম মনে হলো হ্যালুসিনেশন, বায়ুচাপ কমলে কানে যেমন শব্দ হয় তেমন। কিন্তু কান পাতার পর আমি সুরটা টের পেলাম। দমবন্ধ করে উত্কর্ণ হয়ে শুনতে চেষ্টা করলাম, মনটাকে দেহগহ্বরের দারুণ অন্ধকারে একেবারে ডুবিয়ে দিয়ে চিনতে চেষ্টা করলাম, এ কিসের সুর। কেউ কোনো একটা যন্ত্র বাজাচ্ছে, বাজনাটা নিচু আওয়াজে বাজছে। কী যন্ত্র এটা? ম্যান্ডোলিন? ‘জোর্বা দ্য গ্রিক’-এ অ্যান্থনি কুইন যেমন বাজিয়েছিল? বাজুকি? কিন্তু এত রাতে বাজুকি বাজাবে কে? কোথায়ই বা?
***
সুরটা আসছে পাহাড়ের উপরের সেই গ্রামটা থেকে, ব্যায়াম করার জন্য যে গ্রামটায় আমরা প্রতিদিন পাহাড় ডিঙিয়ে যাই। মোড়ের কাছে এসে ভাবছিলাম কোন দিকে যাব, কী করব। ইজুমি হয়তো এ সুরটাই শুনেছে। সুর শুনলে সে সেই দিকে যাবেই।
মোড়ের ডানদিকে রওনা হলাম, চড়াইয়ের দিকে চললাম, যে চড়াইটুকু আমি তন্নতন্ন করে চিনি। এ পথে কোনো গাছ নেই। পাহাড়ের ছায়ায় হাঁটু অব্দি কাঁটাঝোপ। যতই এগোই, সুরটা তত স্পষ্ট হয়। সুরটা যেন একটু চেনা চেনা লাগে, উৎসবের সুর যেন, পাহাড়ি গ্রামটার কোনো ভোজসভায় শুনেছিলাম এমনই সুর। মাত্র সেদিন সৈকতে বসে আমরা একটা বিয়ের শোভাযাত্রা দেখেছিলাম। নিশ্চয়ই বিয়ে উপলক্ষে ভোজ চলছে এত রাত অব্দি।
ঠিক তক্ষুনি অদৃশ্য হয়ে গেলাম আমি। হয়তো এ জোছনায় কিংবা এ মাঝরাত্রির বাজনায় ভূতগ্রস্ত হয়ে প্রতি পদক্ষেপে যেন চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি। আমার পরিচয় হারিয়ে যাচ্ছে। সেই প্লেনে করে মিসরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়কার অনুভূতি। এ জোছনায় হেঁটে যাওয়া লোকটা যেন আমি নই, আমার আদলে গড়া একটা প্লাস্টারের মূর্তি। আমার হাতটা মুখে বোলালাম, মুখটা আমার বলে মনে হলো না। হাতটাও আমার মনে হলো না। আমার বুকের রক্ত তীব্রবেগে আছড়ে পড়ছে সারা শরীরে। এ শরীর প্লাস্টারের পাপেট যেন বা একটা ভুডু করার পুতুল, যাতে কোনো জাদুকর সামান্য সময়ের জন্য জীবন ফুঁকে দিয়েছে, স্বাভাবিক সত্যিকার জীবনের উজ্জ্বল আভা সেখানে অনুপস্থিত। এই আমার আপাতশরীর, এই আমার নকল পেশি কেবল মুদ্রাগুলো পালন করে যাচ্ছে। কোনো এক বলির কাজে উৎসর্গীকৃত পুতুল বৈ আমি কিছু নই।
তাহলে আমার আসল আমি কোথায়?
হঠাৎ কোত্থেকে ইজুমির গলার আওয়াজ ভেসে এল। সে বলল, ‘তোমার আসল আমিকে বেড়ালে খেয়ে ফেলেছে। এই যতক্ষণ তুমি এখানে দাঁড়িয়ে ছিলে, ততক্ষণে বুভুক্ষু বেড়ালরা তোমাকে চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে। বাকি রয়েছে শুধু হাড় ক’খানা।’
আমি চারদিকে তাকাই, এও বিভ্রম, অবশ্যই।
আমার চারদিকে পাথর ছড়ানো জমিন, ছোট ছোট কাঁটাঝোপ আর সেগুলোর খুদে খুদে ছায়া। ইজুমির স্বরটা এসেছে আমার মাথার ভেতর থেকে।
নিজেকে বললাম, এসব বাজে চিন্তা বাদ দিতে হবে। যেন বিশাল একটা ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া ঠেকাতে সমুদ্রতলের একটা পাথর আঁকড়ে দম বন্ধ করে আছি। ঢেউটা তো একসময় আমায় পেরিয়ে যাবে। এ নিশ্চয় ঘোর, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে বিকল হওয়া মনের কারসাজি। যা কিছু সত্যিকারের, যা কিছু বাস্তব, তা আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে আমায়। আমি পকেট হাতড়ে কয়েনগুলো হাতে নিই, আমার হাতের ঘামে ভিজে ওঠে সেগুলো।
আমি প্রাণপণে অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করি। উনোকিতে আমার রৌদ্রঢালা অ্যাপার্টমেন্টটার কথা ভাবি। রেকর্ডের সংগ্রহটার কথা ভাবি, আমার ছোট্ট নিজস্ব জ্যাজ কালেকশন, পঞ্চাশের আর ষাটের দশকের সাদা জ্যাজ পিয়ানিস্টদের কথা ভাবি, লেনি ত্রিস্তানো, আল হেগ, ক্লদ উইলিয়ামসন, লু লেভি, রাস ফ্রিম্যান। বেশির ভাগ অ্যালবামই আর বাজারে নেই, অনেক চেষ্টাচরিত্র করে আর পয়সা ঢেলে এ সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলাম আমি। রেকর্ডশপগুলোতে সারাবেলা ঘুরে ঘুরে, অন্যান্য কালেক্টরদের কাছ থেকে অন্য জিনিসের বিনিময়ে ধীরে ধীরে আমার আর্কাইভ গড়ে তুলেছিলাম আমি। বাজনাগুলো একেবারে সেরা পারফরম্যান্স বলা যাবে না কিন্তু পুরনো রেকর্ডের বাজনায় ওই অনন্য অন্তরঙ্গতার আবহ আমার খুব ভালো লাগত। জগত্টা যদি শুধুই সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে তৈরি হতো তাহলে তা বড্ড একঘেয়ে জায়গা হতো, তাই না? সেই রেকর্ডের জ্যাকেটগুলোর প্রতিটা খুঁটিনাটি মনে পড়ছে আমার, মনে পড়ছে আমার হাতে তাদের ভার।
কিন্তু এসবই তো চিরতরে হারিয়ে গেছে, আমিই আপন হাতে বিলোপ করেছি তাদের। ইহজীবনে আর কখনো সেই রেকর্ডগুলো শুনব না আমি।
আমার মনে পড়ছে ইজুমিকে চুমু খাওয়ার সময় পাওয়া তামাকের গন্ধ, তার ঠোঁট আর জিভের স্পর্শ। আমি আমার দু’চোখ বন্ধ করলাম। আমার তাকে পাশে চাই, তার হাতখানা আমার হাতের মুঠোয় চাই, যেমন করে সে মিসরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ধরে রেখেছিল তেমন করে, আর কখনো ছেড়ে দেব না তাকে।
ঢেউটা মস্ত হতে হতে অবশেষে আমাকে পার হয়ে গেল, সুরটুকুও।
ভোজসভার লোকগুলো কি বাজনা থামিয়ে দিল? নিশ্চয়ই তাই। রাত প্রায় ১টা বাজে। কিংবা হয়তো এ বাজনাটা আসলে বাজেইনি কখনো, সেটাও তো সম্ভব। আমি আর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আবার চোখ মুদলাম, নিজের সচেতনতার ভেতর ডুব দিলাম, একটা ওজনদার সরু রেখা টেনে দিলাম সেই অন্ধকারের ভেতর। কিন্তু তবু কিছুই শুনতে পেলাম না। একটা প্রতিধ্বনি অব্দি নয়।
হাতঘড়ি দেখতে গেলাম, এতক্ষণে টের পেলাম হাতঘড়ি পরিনি। শ্বাস ফেলে পকেটে হাত পুরলাম। সময়ে কী দরকার। আকাশে তাকালাম, ঠাণ্ডা হিম এক খণ্ড পাথরের মতো জেগে আছে চাঁদ, তার ত্বক সময়ের অত্যাচারে ক্ষয়ীভূত। ক্যান্সারের মতো জেগে আছে চাঁদের পৃষ্ঠের তাবত ক্ষত। চাঁদের আলো কত বিচিত্র খেলা খেলায় মানুষের মনে। কত বেড়ালকে অদৃশ্য করে দেয়। ইজুমিকেও অদৃশ্য করে দেয়। হয়তো এসবই খুব যত্ন করে করা কোরিওগ্রাফি, সেই সে রাত থেকে প্রতিটি মুদ্রা সযত্নে ভেবে নেয়া।
আমি দু’হাত ছড়িয়ে টানটান করলাম শরীর, আড়মোড়া ভাঙলাম, আঙুল অব্দি টানলাম। আরেকটু যাব নাকি ফিরে যাব? ইজুমি কোথায় গেছে? ওকে ছাড়া কেমন হবে আমার এ বেঁচে থাকাটা? এ জলাবদ্ধ দ্বীপে কেমন করে বেঁচে থাকব? এ অস্থায়ী-ভঙ্গুর-সাময়িক আমিটুকুকে সে-ই তো আগলে রেখেছিল।
আরো চড়াই টপকাতে থাকি আমি। এতটুকু এসেছি যখন, এইটুকু পার হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠি তবে। খতিয়ে দেখি সত্যিই বাজনা বাজছিল কিনা? আমার নিজের চোখে দেখা চাই সেটা, সামান্য নিশানাও যদি থাকে সেই বাজনাটার। ৫ মিনিটে চূড়ায় উঠে গেলাম আমি। দক্ষিণে পাহাড়টা ঢালু হতে হতে মিশেছে সমুদ্রে, ওই যে সৈকত আর ঘুমঘুম এ শহর। সৈকতের রাস্তায় ইতিউতি রাস্তার আলো। পাহাড়ের উল্টো দিকটা অন্ধকার। একটু আগেই যে এখানে একটা জলজ্যান্ত ভোজসভায় বাজনা বাজছিল, তেমন মোটেই মনে হচ্ছে না।
বাড়ি ফিরে এসে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি খেলাম। ঘুমোতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম এল না। পূব আকাশে ঊষার আভাস দেখা দেয়ার আগ অব্দি চাঁদের হাতে বাঁধা রইলাম আমি। হঠাৎ বেড়ালগুলোকে মনে পড়ল আমার, একটা তালাবদ্ধ অ্যাপার্টমেন্টে আটকা পড়ে ক্ষুধায় মৃতপ্রায়। আমি— আসল আমি তো কবেই মরে গেছি কিন্তু ওরা জীবন্ত, খুবলে খাচ্ছে আমার মাংস, আমার কলজেতে কামড় দিচ্ছে, আমার রক্ত চুষছে, গিলে খাচ্ছে আমার পুরুষাঙ্গ। বহুদূর থেকে যেন আমি শুনতে পেলাম আমার মগজ হুশহাশ করে চেটেপুটে খাওয়ার শব্দ। ম্যাকবেথের ডাইনিদের মতো তিনখানা চঞ্চল বেড়াল আমার ভাঙা করোটি ঘিরে ধরে আছে, ভেতরের ঘন ক্বাথ চুমুক মেরে খাচ্ছে। তাদের খসখসে জিভের ডগার ছোঁয়াচ লাগছে আমার চৈতন্যের প্রতিটি নরম ভাঁজে, প্রতিবার চেটে নেয়ার সময় ঘষা খেয়ে ফুলকি জ্বলছে আর নিভছে।
0 মন্তব্যসমূহ