গল্পপাঠ :
গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন ?
সাগরিকা রায় :
গল্প অনেকদিন ধরেই শুরু হয়ে যায় বুকের গভীরে। স্তরে স্তরে জমে উঠতে থাকে নিজের অজান্তে। কিন্তু লিখব ভাবিনি। স্থির জানতাম আমাকে পড়ে যেতে হবে অনন্তকাল ধরে। একটা ছবি চোখের সামনে চামুন্ডা নৃত্য করতো। আমার বেডরুমের চারটে দেওয়াল জুড়ে সারি সারি বই। আমার চাকা লাগানো খাটে শুয়ে তাদের কাছে ইচ্ছেমতো পৌঁছে যাব। আর অনাদিকাল ধরে আমার বাড়ির চারপাশ জুড়ে বৃষ্টি থাকবে !
স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি সে অর্থে। আর তাই হয়তো বইএর দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াতে নিজেই লিখতে বসে গিয়েছি।
স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি সে অর্থে। আর তাই হয়তো বইএর দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াতে নিজেই লিখতে বসে গিয়েছি।
গল্পপাঠ :
শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল ?
সাগরিকা রায় :
ক্লাস সেভেনে একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখেছিলাম। সেটি প্রকাশিত হয় উদয়ন নামের একটি ক্লাবের পত্রিকায়। যদিও কাকে থ্রিলার বলে, বা তার বিভিন্ন ভাগ সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান ছিল না। অপরাধপ্রবণতা ছিল গল্পের মুখ্য বিষয়। আসলে সমবয়সীদের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলাম পড়ার বাতিকের জন্য। বইমাতাল আমি। পরবর্তীতে শুরু করি বসুমতী পত্রিকায়। একটি ছোটদের গল্প দিয়ে। বড়দের জন্য লিখতে গিয়ে বিস্তার বিষয়টা খুব ভালভাবে রপ্ত করিনি তখন। কিন্তু নিজের দোষ ত্রুটি নিজেই ধরে ফেলতে পারা, অত্যন্ত কৌতূহলের সঙ্গে অন্যের লেখা পর্যবেক্ষণ করা... নিজের লেখাকে অন্যের লেখা বলে মনে করে পড়া...এগুলো আমাকে ঠেলে নিজেকে ভাঙতে। এসব প্রথম দিকে ছিলনা। কিন্তু তাড়না ছিল। তাগিদ ছিল। আছেও।
গল্পপাঠ :
গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন ?
সাগরিকা রায় :
প্রস্তুতি ছিল পড়ার মধ্য দিয়ে। দেশভাগের গল্প, স্বাধীনতার গল্প, স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গের গল্প,হাংরি জেনারেশনের সমসাময়িক শাস্ত্রবিরোধী বাংলা ছোটগল্পের আন্দোলনের গল্প। প্রথম ওয়ার্ল্ড ওয়্যারের পরের শিল্প সাহিত্য আন্দোলনের তাপ পড়ল সর্বত্র। বিট জেনারেশন,ডাডাইজম,স্যরিয়ালিজম, পোস্ট মর্ডানিজম...প্রচলিতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রচলিত মূল্যবোধকে অস্বীকার করা, নান্দনিকতার গোড়ায় আঘাত করার ইচ্ছে...সবটাই শিল্পে সাহিত্যে ছড়িয়ে পড়ল। উলটে পালটে নানান ছন্দে গল্পরা সামনে এসেছে। পাঠই আমার প্রস্তুতি।
গল্পপাঠ :
আপনার গল্প লেখার কৌশল বা ক্রাফট কী ?
সাগরিকা রায় :
খুব ভেবে চিন্তে কিছু করিনা। তবে খানিকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গল্প বলতে ভালবাসি। ধরুন কমেডিয়ান যখন স্টেজে হাসাতে ওঠেন, তিনি নিজে হাসেন না। অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবে কঠিন বিষয়কে বুঝিয়ে দেন, আমার সেভাবে গল্প বলতে ভাল লাগে। নির্মান বিনির্মাণ পুনর্নির্মান সচেতনভাবে মেনে চলি,এমন নয়। ইচ্ছেমতো গল্প বলি। তবে ,হ্যাঁ,গল্পের প্রথম লাইন আমার কাছে গুরুত্ব পায়।
গল্পপাঠ :
গল্পের বীজ কিভাবে পান ?
সাগরিকা রায় :
সুকুমার রায়ের গোষ্ঠমামার মত ফাঁদ পেতে থাকি কখন পাখি এসে ধরা দেয় ! ভেসে ভেসে বীজ এসে পড়ে ছোট কোন ঘটনা, ছিটকে আসা কোন ছিন্ন সংলাপে। কখন সে আসবে কেউ জানি না। এসে পড়লে রক্তকণিকার বেগ বেড়ে যায়।
গল্পপাঠ :
গল্পের বীজের বিস্তার কিভাবে ঘটান ?
সাগরিকা রায় :
বীজটা ধরে ফেলার পর শুরু হয় লালন। ঘোল থেকে মাখন বের করা। বীজ মাটিতে রোপণ হল। জল পড়তে শুরু হল। বাতাস, আলো, হাওয়া...শেকড় গভীরে যাচ্ছে...ক্রমে মূল কান্ড থেকে উঠে আসছে ডালপালা। লেখা শুরু হতেই আরোপিত হছে রঙীন পাতা,কখনও রঙ মুছে যাচ্ছে ঝড় ঝাঁপটায়...! শেষে ফুল ফুটে উঠতে সব যন্ত্রণার শেষ !
গল্পপাঠ :
শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবেন ? বা কাহিনীকাঠামো বা প্লট নিয়ে ভাবেন ?
সাগরিকা রায় :
বিষয় আসে আগে। এটাই হয় সাধারণত। পরে কাঠামো।
গল্পপাঠ :
গল্পের চরিত্রগুলো কিভাবে আসে ?
সাগরিকা রায় :
একটি বক্তব্যকে সামনে আনতে যারা সাহায্য করবে বলে ঠিক করি, তারা সারি দিয়ে দাঁড়ায় আমার সামনে। বেছে নিয়ে শুরু করি। কখনও এমন হয়,একজন এল। সে একাই ডিঙ্গি বেয়ে যাচ্ছে,ক্রমে তাকে এগিয়ে দিতে আসে আরেকজন। এভাবে চরিত্র আসে আমার গল্পে। আসলে মূল চরিত্র মানুষ হোক বা কাহিনী , তাকে আগলে রাখে চরিত্ররা। যেমন গন উইথ দ্য উইন্ডের গৃহযুদ্ধ,বা বিভূতিভূষণের ইছামতী,বা অমর মিত্রর বহ্নিলতা...পরিবেশ-পরিস্থিতি এরাই মূল চরিত্র। তাকে বিস্তার ঘটাতে আসছে যারা তারাই হয়ে ওঠে মূল চরিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে থাকা এক একটি চরিত্র।
গল্পপাঠ :
শুরুতে কতটা চরিত্র আসে ? তারা কি শেষ পর্যন্ত থাকে?
সাগরিকা রায় :
বিশেষ চরিত্রকে রংরূপে সাহায্য করতে আসে যারা, তাদের যতটুকু থাকার,তারা ততটুকুই রাখে নিজেকে।
গল্পপাঠ :
আপনি কি বিশেষ কোন চরিত্রকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে লেখেন ?
সাগরিকা রায় :
বিশেষ চরিত্রটি যদি আমার বক্তব্যকে পরিস্ফুট করতে সাহায্য করে,তাকে গুরুত্ব না দিলে সে আমাকে সাহায্য করবে কেন ?
গল্পপাঠ :
চরিত্রদের মধ্যে আপনার চেনা জানা চরিত্র কি এসেছে ? অথবা নিজে কি কোন চরিত্রের মধ্যে চলে আসেন ?
সাগরিকা রায় :
আজন্ম যা দেখেছি,যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি,সেসব জড়িয়েই তো আছি। এদের ফেলে চলে যেতে পারিনা। এই চরিত্রদের মধ্যে নিজেও মিলেমিশে যাই কখনও।
গল্পপাঠ :
গল্পগুলোর দ্বন্ধ-সংঘাত কিভাবে নির্মাণ করেন ?
সাগরিকা রায় :
দ্বন্ধ-সঙ্ঘাত সৃষ্টিতে আসে নস্টালজিয়া । এর সঙ্গে সংলাপ,পরিবেশ,গল্পের চরিত্র আর ভাষা গল্পের দ্বন্ধ-সংঘাতে তাল মেলাতে সাহায্য করে।
গল্পপাঠ :
গল্পের পরিণতি কি আগেই ভেবে রাখেন ?
সাগরিকা রায় :
হ্যাঁ। একটা বীজ যে মুহূর্তে উড়ে এসে পড়ল,তার ফুল ফুটে উঠল গোপনে। তৎক্ষণাৎ। ফুলটাকে আগেই দেখতে পাই।
গল্পপাঠ :
একটি গল্প কদিন ধরে লেখেন ?এর ভাষা-ভঙ্গিতে কী ধরণের শৈলী ব্যবহার করেন ?
সাগরিকা রায় :
সাধারণত দ্রুত লিখতে পছন্দ করি। যতক্ষণ না আমার আমার ভাবনাটাকে উগড়ে দিতে পারছি মনোমত করে,ততক্ষণ অশান্তিতে ভুগি। আবার সময়ের অভাবে যথেষ্ট সময় লেগেছে একটা গল্প লিখে শেষ করতে,এমনও হয়েছে।
আর গল্পের মেজাজ, পরিবেশ অনুযায়ী ভাষা ব্যবহার করতে ভালবাসি। একটা গল্পকে ফুটিয়ে তুলতে ভাষা,পরিবেশ সাহায্য করে। গ্রাম্য চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে ভাষা যেমন হবে,শহুরে চরিত্রর ক্ষেত্রে তেমন হবেনা। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ যেভাবে কথা বলে, প্রপার কলকাতার মানুষ সেভাবে বলে না। অঞ্চলটাকে মনে রাখা জরুরী । আর সময় জরুরী কম নয়। এই মুহূর্তে যে শব্দ উঠে আসছে ভাষায়, সেই শব্দ পাঁচবছর আগে ছিলনা। কাল-কে মনে রাখার চেষ্টা করে থাকি।
গল্পপাঠ :
অনেক লেখক রাইটার্স ব্লকে ভোগেন। আপনার ক্ষেত্রে কি এরকম ঘটনা ঘটেছে? ঘটলে আপনি কিভাবে দূর করেন ?
সাগরিকা রায় :
ঘটেছে। একাধিকবার। তবে এই সময়কে আমি ছুটি হিসেবে নিয়ে থাকি। ল্যাপি অফ রাখি। একটা ডায়েরি কাছাকাছি থাকে। আর পড়ি। পড়ার জন্য মাঝে মাঝে রাইটার্স ব্লক হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। বিভিন্ন ধাঁচের লেখা পড়ি। তবে ভালবাসি ছোটগল্প পড়তে। ইচ্ছেমত পড়া আর পড়া। এভাবেই ফের একটা সময় বীজটা এসে ঝুপ করে পড়ে। ল্যাপি অন হয়...! গল্পরা আসে চুপিচুপি।
গল্পপাঠ :
গল্পটিতে কি কিছু বলতে চান ?
সাগরিকা রায় :
বলতে চাই। জীবন-জগতের ভাঙ্গন এর কথা বলতে চাই। সাধারণ মানুশের কথা বলতে চাই। মাটির মানুশের কথা বলতে ভাল লাগে। ভাঙন থেকে উত্তরণের কথা বলতে চাই।
গল্পপাঠ :
গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হন ?
সাগরিকা রায় :
না, সন্তুষ্টি সবসময় আসে, এমন নয়।
গল্পপাঠ :
আপনি কি মনে করেন যা বলতে চেয়েছিলেন,সেটা বলতে পেরেছেন ?
সাগরিকা রায় :
কখনও মনে হয় পেরেছি। আবার প্রিন্ট হয়ে যাওয়ার পরে অশান্তি শুরু হয়। মনে হয়, যা বলার ছিল,তা যেন ঠিকঠাক বলা হল না।
গল্পপাঠ :
আপনার গল্প পাঠক কেন পছন্দ করে ?
সাগরিকা রায় :
পাঠকের থেকে যে ফিডব্যাক পাই,তা থেকে বুঝি, আমার লেখার সঙ্গে পাঠক একাত্ম হতে পারে। আমার চরিতরা পাঠকের চেনা মনে হয় হয়তো, এটাই কারণ।
গল্পপাঠ :
আপনার প্রিয় গল্পকার কে কে ? কেন তাঁদেরকে আদর্শ মনে হয় ?
সাগরিকা রায় :
অজস্র । আমার টমাস হার্ডি,আর্নেস্ট হেমিং ওয়ে যেমন পছন্দ,তেমনি বিভূতিভূষণ, শরদিন্দু,অমর মিত্র,আফসার আমেদ,নলিনী বেরা ,ভগীরথ মিশ্র, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়...!
মাটির গল্প, মানুষকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেখতে জানেন যাঁরা, তাঁদের খুঁজি সবসময়। আবার কখনও ভাষার সৌকর্য, ইতিহাসকে জীবন্ত দলিলে পরিণত করাটা আমাকে আবিষ্ট করে শরদিন্দুর লেখায় । এই সময়ের কিছু লেখকের কথা বলতে হয়। শমীক ঘোষ, অরিন্দম বসু, ...!
গল্পপাঠ :
কার জন্য গল্প লেখেন ? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন ? লিখলে কেন লেখেন ? পাঠকের কথা যদি মাথায় না থাকে, তাহলে কেন থাকে না ?
সাগরিকা রায় :
আমি প্রথমে পাঠক, পরে লেখক। সুতরাং আমার লেখা প্রথমে পাঠকের জন্য বলতে আমার জন্যই বলা যায়। একটি গল্পকে জন্ম দিতে যে যন্ত্রণা,তা তখনই সফল হয়,যখন গল্পটি আমার ভাবনাকে সার্থক রূপ দেয়। নিজে তুষ্ট হলে পরে আর ভাবিনা। মনে হয় একজন পাঠকের তো ভাল লেগেছে। কারণ পাঠক ছাড়া লেখকের অস্তিত্ব কোথায় ?
1 মন্তব্যসমূহ
চার দেওয়াল ঘেরা বইয়ের তাকের শখ আমারও :)
উত্তরমুছুনদ্রুত লেখা : হ্যা - এটা একটা প্র্যাকটিস - মানে একজন কারিগর হিসাবে আমি চাই আমার কোনো কাজ এক সিটিংএ করে ফেলতে, মানে কাজের প্রতি ইমোশন - সেটা যেনো সম্পৃক্ত থাকে সেই অনুযায়ী| রবি ঠাকুরের ছবি সম্পর্কে কথাও পরেছিলাম হয়তো - ভাবনা আর চিত্রায়ন এদুটোর সময়ের তারতম্য যাতে না থাকে সেকারণে উনিও দ্রুত আঁকতেন|
রাইটার্স ব্লক নিয়ে যেকথা বললেন এবং তার যা সমাধান দিলেন - পারফেক্ট|
সমগ্র সাক্ষাতকারটি অত্যন্ত প্রানবন্ত এবং উত্সাহদ্দিপক, দুজনকেই প্রচুর ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা|