তাদের নামার কথা ছিল থানা টাউনে। থানা টাউন মানে ওই রকম, দোকান বাজার থানা পুলিশ অফিস কাছারি লোকলস্করে রমরমা। একজন আসছে দামোদর পেরিয়ে বল্লভপুর, রানিগঞ্জ থেকে, অন্যজন দামোদরের এপারে গাঁ থেকে। তারা দুইজন, সুন্দরী দাসী আর অন্নদারানি, দুই বুড়ি, একজন থুত্থুড়ি, অন্যজন সবে বুড়ি।
সবে বুড়ি অন্নদারানির ঘরে স্বামী আছে, কিন্তু বিছানায় শুয়ে। পুত্র বিদেশবিভূঁয়ে কাজের খোঁজে গিয়ে আর ফেরেনি। স্বামী এখন খুব বুড়ো থুত্থুড়ো, কিন্তু যেহেতু একদিন তাকে উদ্ধার করেছিল, সংসার পেতেছিল তাকে নিয়ে তাই মনে মনে কৃতজ্ঞতা তো আছেই, ছিটেফোঁটা ভালবাসাও যে নেই তা নয়। বুড়ো এখন প্রায় মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে আছে ঘরের কোণে। তার মুখে ভাত দিতে হবে তো। সে হল অন্নদারানি, অন্নহীন রাখে কী করে সংসারকে? খুব বুড়ি সুন্দরীদাসীর অঙ্গে এখন থান কাপড়, আধময়লা ফুটোফাটা, সেলাই-এর উপর সেলাই করা। স্বামী গেছে কোন সকালে, পুত্র গেছে এই বিকেলে, রোগে ভুগে তিনটি বাচ্চা আর জোয়ান বউ ঘরে রেখে। তারা দুজন মেজিয়া থেকে আসছিল ন'পাহাড়ি। কিন্তু ঝিমুনির ঘোরে কখন যে ন'পাহাড়ি পার হয়ে আটমাইল দূরে পাহাড়ের কোলে এই মটুকবনিতে এসে পৌঁছেছে তা খেয়াল হয়নি। কন্ডাক্টরই খেয়াল করে নামিয়ে দিয়েছে বিনাভাড়ার এই দুই বুড়িকে। ন'পাহাড়ি কেউ চেনে না, তবু ঝিমুনির ফাঁকেই কম বুড়ি অন্নদারানির সন্দেহ হয়েছিল। তার গায়ে রাঙা জনতা শাড়ি হাতে ময়লা শাখা লাল প্লাস্টিকের রুলি, তুলনায় সে শক্তি ধরে বেশি, ধাক্কা দিয়েছিল সুন্দরীদাসীকে, ও বুড়ি ওঠ, এস্যা গেছি মনা হয়।
বুড়ি সুন্দরীদাসী প্রায় ঘুমন্ত চোখ খুলে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের জ্বলন্ত পৃথিবী দেখে চোখ বন্ধ করতে করতে বলেছিল, কী রোদ উঠছ্যা গো!
সত্যি। রোদ উঠেছে বটে। এই নিঝুম পাহাড়ের কোলেই বা কী রোদ! যেন কাচের গা, বালি চিক চিক নদীর বুক। আর হাওয়া! তা যেন যজ্ঞিবাড়ির উনুনশালের তাপ। শুধু মন নয় সমস্ত দেহ যেন ভেপে ওঠে। বাসের মধ্যে ঝিমুনির ঘোরে এদের আঁচ বুঝে অন্নদারানির মনে পড়েছিল নিজের বিয়ের ভোজের কথা, খাসিমাংসের স্মৃতি। মাংসমাখা ভাত পাকা তেঁতুল তুল্য। মনে করলেই জিভে জল আসে। সেই একবারই যেন খাওয়া হয়েছিল এ জীবনে, সেই স্মৃতি এখন রোদে ঝলসে কেমন ঘোলাটে হয়ে গেছে। ঘরে পঙ্গু, প্রায় মাংসপিণ্ড হয়ে যাওয়া বুড়োস্বামী, বাইরে আগুন,--তার ভিতরটা শুধু জ্বলে। কে জানে কার বিয়ে হয়েছিল কবে? কোন জন্মে ভোজ হয়েছিল এ সংসারে।
জানালা বন্ধ বাসের ভিতরটা ছিল কেমন আলো আঁধারি, দুই বুড়ি কুঁকড়ে বসেছিল বাসের এক কোণে, অনেক মানুষের পায়ের ধুলোর ওপর। তাদের ঝিমুনি আর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অনেক পরে কন্ডাক্টরের হাঁকডাকে। বাস এই মটুকবনির পাহাড়ের ধারে দুজনকে নামিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল পুরুলিয়ার পথে।
বুঝল প্রথমে সুন্দরীদাসীই, 'ইতো ন'পাহাড়ি নয়গো।'
হুঁ! অন্নদারানি চিন্তিত।
মুর না হয় মাথা খারাপ, হাঁ করত্যা না কর্যা বসি, তা তুই কী করছিলি গো, ও সধবা বুড়ি, তুর ও কি দিক ঠিক নাই?
অন্নদারানি জবাব দিল না, রোদে দাঁড়াতে পারছিল না কেউ। সুন্দরী দাসীর ঘামাচিভরা গা চিড়বিড়িয়ে উঠছে। দুজনে বসল এক আকাশমণির ছায়ায় ধুলোর উপরে, পা মেলিয়ে। এদিকে অফিস কাছারি, লোকজন, দোকানপাঠ নেই। হতভম্ভ হয়ে গেছে দুজনেই। সামনে পাহাড় পিছনে পাহাড়, যেখানে নেমেছে সেও বোধ হয় পাহাড়েরই গা, দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমতল।
যমপুরীতে নিয়ে এলি নাকি ও বউ। বিড় বিড় করে সুন্দর দাসী। রাঙাশাড়ি শাখাসিঁদুরে সবে বুড়ি অন্নদা তখন মাথার ঘোমটা ঘাড়ে ফেলে মাথার উকুন চুলকোয় থাবা মেরে, খালভরা বাসউলা উ কেনে ইখানে নামালো গো, মর মর।
তাপে মাথার উকুনগুলে চঞ্চল হয়েছে খুব | অন্নদারানি অপরিসীম ক্রোধে মাথায় ভিতরে আঙুল চালায়, দীর্ঘ দিন তেল না দেওয়া রুখু চুল বেঁধেছিল সরুপাড় দিয়ে, তা মুহূর্তে খুলে ফেলায় হাওয়ায় চুল ওড়ে, উড়ে যেত চায় যেন মাথা ছাড়িয়ে শুকনো পাতার মত।
ইখন কী উপায়? বিড়বিড় করল থান পরা। উপায় নেই, থমথমে রোদজ্বলা কালো সাপের মত পথ, নিঝুম জলপাহাড়। পথ বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে পশ্চিম ঘেঁষে উত্তরে, ওই দিকেই পুরুলিয়া।
গ্রামখানি খুব বড় নয়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে কিছু ঘর বাড়ি, শুকনো ক্ষেত, ফসল শূন্য ধুধু এই রৌদ্রবেলা বড় নিঃঝুম, কেউ নেই কোথাও, এই বাস স্টপেজে একটা পান সিগারেটের গুমটি অর্ধেক খোলা হয়ে ঝিমুচ্ছে, আর একটা চা তেলে ভাজার দোকানে ফোলা পায়ের এক বুড়ো আধখোলা চোখে কাত হয়ে আছে। কালিপড়া কেটলি, নিভোন উনুন সব যেন ঘুমোচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দুই বুড়ি একে একে সব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে হতাশ ও নিশ্চিন্ত হয়ে আকাশমণি ছায়ায় পাকাপোক্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। এ জায়গায় ভাত কাপড়ের জোগাড় হবে না ঠিক, ভিখ মাগলেও কেউ কিছু দেবে না এও নিশ্চিত। দেখেশুনে মনে হচ্ছে এও এক ভিখমাগা গ্রাম।
বেলা কত হল? সুন্দরী দাসী জিজ্ঞেস করল।
আকাশে তাকায় অন্নদা, বারোটা হব্যা, সুয্যি মাথায়।
তার কম হবেনি?
উহু। অন্নদা ঘাড় নাড়ে। নিশ্চিন্ত হল আবার থান পরা বুড়ি। এক পরম নির্লিপ্তি তার চোখে মুখে ঘনিয়ে এল। অনেককালের পুরোনো অভ্যাসে বুড়ি বুকের কাপড় ফেলে দিল। মুহূর্তে চোখের মণি চঞ্চল হয়ে দেখে নিল অবশ্য, কেউ কোথাও আছে কিনা। তার এই বুকের কাপড় ফেলার ভঙ্গিটি অনেক প্রাচীন, তা সে নিজে জানে। এখনো খোলা জায়গায় আলগা হতে বুক ছম ছম করে।
ঘামে সমস্ত দেহটি ভিজে। রোদ ঘাম উত্তাপ সব মিলে মিশে পুরনো দেহটিকে যেন শুইয়ে ফেলতে চাচ্ছে ধুলোয় ধুলোয়। এ রোদ বড় দুষমন, শুধু শুতে ইচ্ছে করে, তারপরেই ঘুম। থানপরা বিড়বিড় করে, ওলো বারটার পর আর কত হল ? রাঙা শাড়ির অন্নদারানি আবার আকাশ দেখল, সাড়ে বারটা হব্যা।
তার মানে কটা বাজত্যা কটা?
তিরিশ মিনিট হইছে, আর তিরিশ মিনিট আছে একটা বাজত্যা।
কেন? সুন্দরী বুকে হাওয়া করতে করতে জিজ্ঞাসা করে।
ষাট মিনিটে ঘণ্টা হয়।
কে বুলেছে?
অন্নদা এই প্রশ্নে থমকে যায়। মাথার উকুন মারা থামায়। একটু অপ্রতিভ হয়, বলতে যেন ওর সরম লাগে, কালো মুখে কয়েক পলের জন্য লালচে ভাব জেগে ওঠে, সে মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে, সে লোক বুলেছে।
কোন লোক?
বুঝো না! ফোকলা গালে হাসে সুন্দরীদাসী, ভুলিই গিঁইছি তুর সি মরদ ইখনো চিতায় উঠেনি।
তড়িতাহত হল যেন অন্নদা। কেঁপে উঠল ভিতরে ভিতরে। এবুড়ি কি জানে, সে লোক চিতায় উঠব উঠব করছে? একেবারে বসে গেছে, যাকে বলে পড়টে। কোনরকমে ঘষটে ঘষটে ঘর থেকে ভাঙা দাওয়ায় আসতে পারে এই পর্যন্ত। চোখে ভাষা নেই, মাথা বিকল, শুধু প্রাণবায়ুটি আছে বলে তার এই শাখা শাড়ি রয়েছে। | সোয়ামি নিয়ে খুব আহ্লাদ করিস, না? জিজ্ঞেস করেছে সুন্দরীদাসী।
আহ্লাদ! মাথা কাত করল অন্নদা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। আহ্লাদ তো বটেই। হঠাৎ মুখটা কালো হয়ে যায় অন্নদার। কালো মুখ হাতে আড়াল করে সে।
বুড়াবয়সে বুড়োমরদে কী করে ওলো গরবিনী?
নিজিরটা থাকলে বুঝতিস! হিসহিসিয়ে জবাব দেয় অন্নদারানি।
সুন্দরী শুনল কিনা বোঝা যায় না, হয়ত শুনেও না শোনার ভান করে সে চেয়ে আছে মটুকবনির পাহাড়ের দিকে। পাহাড়কে হঠাৎ হঠাৎ মেঘ বলে ভ্রম হয়। উহ! কত কাল যে বৃষ্টি হয়নি এই পাথরের দেশে । দুই বুড়ির মুখ চেনা হয়ে গেছে আজই, মেজিয়ার নদীঘাটে। দামোদরের এপারে মেজিয়া, জেলা বাঁকুড়া, ওপারে বল্লভপুর রানিগঞ্জ, বর্ধমানের মধ্যে পড়ে। সুন্দরী দাসী আসছিল ওপার থেকে এপারে নদী পেরিয়ে। অন্নদারানি যাচ্ছিল এপার থেকে ওপারে, রানিগঞ্জ রেল স্টেশনে। দেখা হয়েছিল নদীমধ্যে, নদীতো এখন শুকনো ধুধু, হেঁটে পার হয় সর্বজনে। এ গেছে নদীর এপারের অর্ধেক, ও এসেছে নদীর ওপারের অর্ধেক।
রাঙা শাড়ির অন্নদারানি শুধিয়েছিল, ওবুড়ি মু যাব অন্ডাল, তা টিরেন আছে না গেছে? থান পরা সুন্দরী জবাব দিয়েছিল, টিরেন তো এই ছাড়ি গেল। আবার দুঘণ্টা বাদে, হাঁ লো নদীঘাট কী এই দিক যায়, মেজিয়া কদ্দুর?
নদী মধ্যে দাঁড়িয়ে সধবা বুড়ি বলেছিল, নদীঘাট থিকে মাইলটাক, কিন্তু টিরেন সত্যি চলি গেল?
না বিশ্বাস হয় তো যা দেখি আয়।
তখন সধবা অন্নদারানি অর এগোয়নি। ঘুরে আবার ফিরতে লেগেছিল ট্রেন যখন দু'ঘন্টা বাদে তখন ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে হয়। অন্ডালে সে কেন যাচ্ছিল তা জানে না, কিন্তু যেতে কোথাও হবে তাই ঘর ছেড়ে বেরোন। ঘরে কারো ভাত জোটে না, না তার, না বুড়োর মুখে কিছু তো ধরতে হবে তাই ঘর ছেড়ে বেরোন। কোথাও না কোথাও, কিছু না কিছুর সন্ধানে বেরোন। সে ঘুরে এসে নদীঘাটে মস্ত এক অশ্বথ গাছের ছায়ায় গালে হাত দিয়ে বসেছিল, আর একটু আগে ঘর থেকে বেরোতে পারলেই অন্ডালে যাওয়া যেত। অন্ডালে গেলে হয়ত ভাত কাপড়ের সুরাহা হত। সুরাহা হতই, হত বলেই না সে পৌঁছনোর আগে ট্রেন ছেড়ে চলে গেল।
থানপরা বুড়িও তার পিছুপিছু এপারে এসে উঠেছিল, তার পাশে গুটিগুটি বসেও ছিল। সামনে নদী হাহা, বালি উড়ানে ঘূর্ণি হচ্ছে হাওয়ায়। থানপরা সুন্দরী তার কাঁধে হাত দিয়েছিল, অন্ডাল কেনে, ঘর কুথায়? বিষণ্ণ আন্নদারানি চকিতে ঘুরেছিল তার দিকে, আপাদমস্তক দেখেছিল বিধবা বুড়িকে। তারপর ফিসফিস করেছিল, ভাত কাপড়ের জুগাড়ে।
চেনাজানা আছে কেউ?
না! মাথা দুলিয়েছিল অন্নদা প্রায় অশ্বথের পাতার মত। চোখ ফেটে জল এসে গিয়েছিল, চেনাজানা! তার চেনাজানা কোথায়? অনেককাল কেউ তার কোনও খোঁজ করে না। বাপের ঘর নিশ্চিহ্ন প্রায়, মা বাপ স্বর্গে গেছে বহুকাল। দুটো ভাই ভিটে বাস্তু বেচে চিনাকুড়ি কয়লা খনিতে সেই যে কাজ করতে গেল আর আসে না।
থানপরা বুড়ি বলেছিল, নদীর ওপারে কাম কাজ নেই তো ভাত কাপড়ের জুগাড় হব্যা কী কর্যা, বল্লভপুর কাগজ কল বন্ধ, অন্ডালে তিন ফ্যাকটিরি বন্ধ, কে পয়সা দিবে, যাও কুথায়?
শুনে একেবারে ভেঙে পড়েছিল সধবা বুড়ি, তবে যাই কুথায়?
বিধবা তখন নিঃঝুম, তাকিয়েছিল নদীর দিকে। এই খরার দিনে নদীরও সাজ বিধবার, রঙ নেই, প্রাণ আছে বলে মনে হয় না।
এবার অন্নদারানি জিজ্ঞেস করেছিল, তা তুমি যাও কুথায়?
ইপারে, গাঁয়ে যাব, মেজিয়া গাঁ।
কার ঘরে, কুটুম আছে?
উ হুঁ! মাথা নেড়েছিল বিধবা বুড়ি, বলেছিল, যাব ভাত কাপড়ের জুগাড়ে।
ইপারে কুথায় ভাত কাপড়, মোরে দিখছ নাই!
কোনে, ইপারে গেরস্ত ঘর নাই, উপোসী বেধবারে দিবে না বিছু?
উপোসী বেধবা! খরায় পড়ছ্য সব, কতকাল বিষ্টি নাই, সব উপোসী হই গিইছে, ইপারে ভাত কাপড় কুথায়?
ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়েছিল তখন থানপরা বুড়ি, তবে যাই কুথায়?
দুজনে একসঙ্গেই যেন উচ্চারণ করেছিল 'তবে যাই কুথায়'। একজন মনে একজন মুখে। সধবা অন্নদারানি বিধবার চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিয়েছিল, কেননা বিধবা তখন নিজের দৃষ্টি স্থির করেছিল সধবার সিঁথির দিকে। অবশেষে সে দৃষ্টিও সরল কিছুক্ষণের জন্য।
দুজনে বসল পরামর্শে। একজন যাচ্ছিল অন্ডলেভাল, একজন আসছিল মেজিয়া। কেউ অন্ডালও গেল না। কেউ মেজিয়াতেও নয়।
নদী ঘাট থেকে ভিখ মাগা মানুষের মতো বাসে উঠল দুজনে। বসল ধুলোর উপরে এক কোণে। কন্ডাক্টর বড় সদয়, তারা তার পা ধরতে ভাড়াটাও ছেড়ে দিল। কিন্তু যেখানে যাবে মনস্থ করে উঠেছিল দুইজন, সেই ন'পাহাড়ি থানা টাউনে, সেখানেও যাওয়া হল না। নামল এসে এই পাহাড়ের ধারে মটুকরনিতে! নদীর ধারে বসেই একে অপরের হাঁড়ির খবর জেনে নিয়েছে যতটা পারে।
অন্নদারানি হা হা রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে সুন্দরীদাসীকে থাবা মারার চেষ্টা করে, হাঁ লো তুর ঘরে তাহলে দুটা সোয়ামী খাকী! বলে জিভ বার করে শুকনো ঠোঁটে বুলিয়ে নেয়, দুটারে চিতায় তুল্যাছিস? সুন্দরীদাসীর তামাটে মুখে মুহূর্তে কিসের যেন ছায়া জড়িয়ে যায়। ছায়া সরতেই চোখ জ্বলে ওঠে। সে মাথা হেলায়, ঘর্মাক্ত বুকে জোরে জোরে ফুঁ দেয়, এমন ভাবে ফুঁ দেয় যেন চুলো জ্বালাচ্ছে। উসকে দিচ্ছে নিভু নিভু আগুন!
ঘরে খাবার লোক কটা? অন্নদারানি উকুন মারতে মারতে আবার জিজ্ঞস করে! হাতের পাঁচ আঙুল দেখায় বিধবাবুড়ি। ছোট বড় মিলিয়ে পাঁচটা।
বউটা ভাতার খেল? ফটাস করে উকুন মারে অন্নদারানি।
মু ও তো পুতও খেলাম। হিসহিস করে জবাব দেয় সুন্দরী।
তু কবে খেলি নিজির ভাতার? আবার জিভের ছুরি ঠোঁটে ঘষে অন্নদা।
সে অনেককাল, গতর থাকতেই। বলে মুখ ঘোরায় বিধবা।
তবে আর কেনে? বলতে বলতে অন্নদারানি তার ময়লা শাখা, লালরুলি সমেত হাতটি যেন সুন্দরীর সামনে সাপের ফণার মত ঘোরায়। বুড়ি বিধবা সুন্দরীদাসী হাঁ করে সেই হাত দেখতে থাকে। বুক ধকধক করে তার। চোখে জ্বালা। দুটো দিন গমের ঘাটো দিয়ে কোনো রকমে আধাপেট ভরিয়েছে ঘরের প্রাণীগুলির। আজ সকালে বেরিয়ে এখন বেলা হাঁই হাঁই। ঘরে তিনটে নাড়ির ধন নেতিয়ে আছে, আর ওই সোয়ামী খাকী পুতের বউ জ্বরে কোঁকাচ্ছে। সে গায়ের ঘামাচি জোরে খুঁটে দেয়, তারপর জিভ বার করে সাপের মত।
হাঁ লো, উ বুড়া সোয়ামী লিয়ে করবি কি?
অন্নদারানি জবাব দেয় না।
মোর তবু পুত ছিল, এখন সে নাই তো নাতিনাতনি আছে, ঘাটের মড়া কেউ নাই।
অন্নদারানির মুখ আরো ফ্যাকাশে হয়ে যায়, চোখ ভারি ঠেকে। নিঃঝুম দুপুরে পাথুরে নৈঃশব্দের ভিতরে অন্নদারানি নিজের চোখের জল গড়ানর শব্দ শুনতে পায় যেন। আর সুন্দরীদাসী বসে তার বুকের ঘাম বুড়ো আঙুলের ধার দিয়ে প্রায় কোদাল চঁচার মত চেঁচে দেয় ধুলোর উপরে। কেউ কারোর মুখ দ্যাখে না অনেকক্ষণ, তারপর বিধবা বুড়িই বলল, চল উঠি।
কুথাকে যাব্যা!
ভিখ মাগব। জবাব দেয় সুন্দরী।
মরণ! হাসে অন্নদারানি, ভিখ মাগত্যা যাব কেনে?
তবে?
তবে কি! রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল সধবা। বেলা হাঁই, হাঁই দুপুর হল। ষাট মিনিটে এক ঘণ্টা, চবিবশ ঘণ্টায় একদিন, সব শিখিয়েছিল ওই লোকটা। এখন তার নিজের মাথার কল বিকল, চিনতে পারে না, মনে রাখতে পারে না। একা ঘরে বসে খাবো খাবো করছে।
অনেককাল বিষ্টি হয়নি, না! আবার মুখ খুলেছে বিধবা।
হাঁ, দামোদরে শুধু বালি, পথে শুধু রোদ আর ঘুন্নী বাতাস।
তুর সোয়ামী তা জানে ?
চমকে যায় অন্নদারানি। রোদে পোড়া মুখ থমথম করতে লাগল। বুক যেন পাহাড় হয়ে গেল, এমনি তার ভার। সত্যি! সোয়ামী বুড়োটা কি তা জানে? কতকাল, কতযুগ যেন বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি হয়নি বলে পথেঘাটে লোক নেই, নদীর এপারে ওপারে কাজ নেই, ভাত নেই, কাপড় নেই। মানুষজন সব পথের কুকুরের মত ঝিমোচ্ছে আর ঘুমোচ্ছে। মাঠ ঘাট সব তার ফাটা পায়ের পাতার মত হয়ে গেছে। ময়লা উড়ছে ধুলো ঢুকছে, হাঁটতে গেলে যন্ত্রণা হচ্ছে। তাতা পাথুরে মাটিতে রাখা যায় না পা! এতসব খবর কি তার পড়ুটে স্বামী জানে? জানে কি ক'দিন আগে মেজিয়ার পাহাড়ে পাতায় পাতায় ঘষে আগুন লেগে গিয়েছিল, সে আগুন এখনো জ্বলছে। বুড়ো কি জানে তার অন্নদারানি ঘর ছেড়ে অন্নের জোগাড়ে বেরিয়েছে। বেরিয়ে অন্ডালে যাবে বলে এই মটুকবনির পাহাড়ের কোলে এক বিধবার পাশে বসে আছে, যার স্বামী পুত্র নেই বটে, নাতিনাতনি নিয়ে সংসার আছে। ও বুড়ো কিচ্ছু জানে না! ঘরের কুটুরিতে অন্ধকার, সেখানেই শুয়ে বসে থাকে। জগতের কোন খোঁজ রাখে না, শুধু মুখের কাছে এটা ওটা ধরতে জিভ বার করে দেয়।
অন্নদারানি বলল, না সে কোনও খপর রাখে না।
সুন্দরীদাসী চমকে গেল হঠাৎ। কী জিজ্ঞেস করেছিল তাও ভুলে গেছে এতক্ষণে, শুধু বলল, কে জানে না ?
জবাব দিল না অন্নদা। দুজনে আবার চুপচাপ পথের দিকে চেয়ে। বাস গেছে মধুকুণ্ডা হয়ে পুরুলিয়া, কখন ফিরবে তাও জানা নেই।
একটু বাদে অন্নদারানি জিজ্ঞেস করে, বেটা কবে মরল ?
মুখ থম থম করে সুন্দরীর, মাথাটা হঠাৎ ফাকা হয়ে যাচ্ছে, খরার মাঠের মত, সে বিড় বিড় করে, কি বললি, ষাটঘণ্টায় ..., হিসেব কর দেখি।
তুর কী মাথা খারাপ হলো?
মলিন হাসল বিধবা, মাথা যে তার খারাপ হচ্ছে দিনদিন তা সে নিজে বুঝতে পারে। স্বামী পুত্র মরলে কার মাথার ঠিক থাকে। আর তারা মরলেও যাদের রেখে গেছে তাদের নিয়ে বুক বাঁধা যায়, কিন্তু বাঁধবে কী করে, দড়াদড়ি কিছুই নেই। না আছে সম্পত্তি না আছে কিছু। বিষ পুঁটুলির মত তিনটে বংশের প্রদীপ ছিঁড়ে খাচ্ছে সর্বক্ষণ, ছেলের বউ মুখ ভার ক'রে চোখের জল ফেলছে দিনরাত। যেন সব দায় তার, এই বুড়ির।
ভাত কাপড়ের জুগাড় হব্যা? অন্নদারানি ফিসফিস করে।
কী জানি। সুন্দরীদাসী মাথা দোলায়।
তুর ঘরে তবু কথাবাত্তা আছে, লাতিপুতি...।
ঘাড় কাত, মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে বিধবা। কথাবার্তা আছে বটে তার ঘরে, কিন্তু সে কেমন কথা তা যদি জানত! ওই কথাবার্তার হাত থেকে রেহাই নেওয়ার জন্যই তো পাথে বেরোন, ধুলোর ভিতরে বসা, যদি ঘেঁটেঘুটে দুআনি এক আনি জুটে যায়।
সোয়ামী খেয়েছে সকালে?
ঘাড় কাত করে অন্নদারানি, মুখে কিছু বলে না। খাওয়াবে কী, আছে কিছু? ওই খাওয়াবার ভয়েই তো ঘর থেকে বেরিয়ে আসা। ইদানীং ওই বুড়োর সামনে দাঁড়াতেও তার ভয় করে। চিলচিৎকার শুনলে গা ছমছম করে, নিঃশ্বাস বদ্ধ হয়ে আসে। মায়াও হয়, রাগও হয়।
জল আছে ইখেনে? সুন্দরী আবার জিজ্ঞেস করল।
আছে কুথাও। বিড়বিড় করল অন্নদারানি।
মোর কাছে মুড়ি আছে, মুড়ি।
তাই! চঞ্চল হয়ে উঠেছে অন্নদারানি, উ থলিতি আছে?
রসো, ঘর থিকে বার হবার সময় বড় নাতিটা বাঁকি দিল।
তুর সুখির সংসার। ফিসফিস করল অন্নদারানি।
সুখের সংসার। ফোকলাগালে মলিন মুখে হাসল বিধবা। লুকিয়ে মুড়িগুলোকে নিয়ে বেরোতে হয়েছে। বিষ পুঁটুলির মত শয়তান নাতি-নাতনিগুলো দেখতে পেলে কেড়ে খেয়ে নিত।
অন্নদারানি বলে, মোর কাছে দুটো টাকা আছে।
টাকা! বিস্মিত হয় সুন্দরীদাসী।
হাঁ, বেরুবার সময় সে লোক আঁচলে বাঁধি দিল। বিড়বিড় করল অন্নদা।
আহা কী সুখের সোয়ামী সংসার, বুড়া হলেও ইসব মনে থাকে তার!
কথাগুলো শুনল অন্নদা। মুখে কিছু বলল না। মুখ অন্ধকার। কী সুখের ঘর তার! এ দু টাকা শেষ সম্বল, নিয়ে বেরিয়ে না পড়লে ওই বুড়োর পেটে আজই চলে যেত। অন্নদারানি তাকিয়ে থাকে নাতি নাতনির ভরা সংসারের বিধবা সুন্দরীদাসীর দিকে। সুন্দরীদাসীও তাকে দেখছে। দুজনে একে অপরকে দেখতে দেখতে ঝিমোয়। এদিকে রোদ্দুরের তেজও কমছে একটু একটু করে। তবে কিনা এ বেলা হলো পাহাড় প্রমাণ, এ বেলা শেষ হতে অনেক কাল বাকি।
ঝিমোতে ঝিমোতে সুন্দরী দাসী জিজ্ঞেস করে, জল কুথায় যে মুড়ি খাবি?
অন্নদা বলল, চল, পখর দেখি, গা ডুবাতে হব্যা, ক্ষুধাও হইছে খুব।
যাবি। চোখ চকচক করে ওঠে থানপরার। দুই বুড়ি উঠল। উঠে হাঁটল। তাতা পিচ রাস্তা ছেড়ে বাঁয়ে ঝোপের ভিতরে রাস্তা দেখল দুজনে। সেই রাস্তা দিয়ে একের পিছনে অন্য, বিধবার পিছনে সধবা যায় যেন তীর্থ যাত্রীর মতো, ঘর্মাক্ত দেহে টলতে টলতে, ঝুঁকতে ঝুঁকতে। এগিয়ে কিছুটা গিয়েই দ্যাখে, হ্যাঁ, বড় জোড়, জলাশয়। রোদে গলন্ত রূপার মত, দুই বুড়ির চোখের মণির মত জল চকচক করে। দুজনে জোড়ের ধারে দাঁড়িয়ে বলল, সিনান করব।
একসঙ্গেই বলল তারা। সারাদিনের অসহ্য তাপে পোড়া ধুলোয়লায় ভরা দেহ তড়াগের জলে ধুয়ে ফেলতে হবে। আহ্, একই সঙ্গে যদি সব ধুয়ে ফেলা যেত, সব, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা!
থানপরা ভাবল সত্যি বুড়ো স্বামী নিয়ে ও কত সুখে আছে, লাল পেড়ে শাড়ি পরা ভাবল, নাতি নাতনি ভরা সংসারের স্বাদই আলাদা।
সুন্দরীদাসী বলল, কাপড় ভিজাব না।
না, এখানে থাকুক, জনমনিষ্যি তো কেউ নাই।
দুজনে ঝাঁপালো অভ্রনীল জলে, ঝাঁপালো অতি সতর্কতায়, চারদিক দেখে কুমারী মেয়ের ত্রস্তসুখে। জলের আড়ালে গিয়ে নিশ্চিন্ত হল। অন্নদা বলল, ঠাণ্ডা।
সুন্দরীদাসী জলে ডুব দিল । আহ্ এমন ঠাণ্ডা জলে তারা কতকাল গা ডোবায়নি। জলে খেলতে খেলতে অন্নদা বলল, হাঁ লো, মুড়ি দিবি তো মোরে?
হাঁ দিব, তুর টাকায় চা মিষ্টি খাওয়া হব্যা তো?
হাঁ হব্যা।
তারপর ওঠার সময় হয়। প্রাচীন দেউলের মত দুটি ভাঙাচোরা নগ্নশরীর জলসিক্ত অবস্থায় উঠে এল জলের উপরে। জল থেকে পাড়ে উঠতেই হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেল দুজনে। কিসের যেন শব্দ হয়, কে যেন আসে! শুকনো পাতার শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুই রমণী সতর্ক হলো, তারপরেই পড়িমরি করে ছুটল দুজনে খোলা কাপড়ের দিকে।
আশ্চর্য! কেউ এল না। তখন বেলা শেষের বাতাস আরম্ভ হয়েছিল। গাছেদের ঘুম ভাঙছিল। দুপুরের ঘুম, রৌদ্রের ঘুম, আলস্যের ঘুম আগুনের হাত থেকে বাঁচার ঘুম। সেই শব্দ বয়ে যাচ্ছিল চারদিকে। তা বুঝতে পেরেই খিক খিক করে হেসে উঠেছে সুন্দরীদাসী, একী! একী হলো, ওলো অন্নদা ?
নিজের দিকে তাকায় সচকিতা অন্নদারানি, তাই তো! এ কী!
কাপড় বদল হয়ে গেছে। সুন্দরীদাসীর অঙ্গে উঠেছে রাঙা শাড়ি, আর অন্নদার গায়ে থান কাপড়। দুজনে নিঃঝুম। থর থর করে কাঁপছে। সত্যি, কেমন হল? আপনা আপনি হল, নাকি এমনই হবে তাই ভেবেছিল দুজনে। দুজনে একসঙ্গে পা ফেলল পথের দিকে। তখন আলো মরছিল, পাহাড়ের ছায়া ঢেকে দিচ্ছিল বিশ্বভুবন।
5 মন্তব্যসমূহ
আশ্চর্য সন্ধ্যের গল্প। অন্নদা, সুন্দরী, ক্ষিদে আর বুভুক্ষার অশ্রুপাত।
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হয়ে গেলাম পড়ে।এই গল্প অনেকদিন মনে থাকবে।গল্পের সংলাপগুলো আমার খুব চেনা।খুব টানল গল্পটা।
উত্তরমুছুনসধবা ও বিধবার সংলাপের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলাম। শেষে অপেক্ষা করছিল একটি চমক। আপনার লেখা থেকে শেখার চেষ্টা করি।
উত্তরমুছুনশাশ্বত !! কী অনিবার্য পরিণতি।
উত্তরমুছুনএ গল্প যেনো বোধির ভেতর থেকে উচ্চারিত। অপার্থিব ঘোরে
উত্তরমুছুন