অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত'র গল্প : ঘর কইনু বাহির

বিভাস বেরিয়ে যাচ্ছে বুঝি। তাকাতে ভয় করে। ট্রাউজার্স আর শার্ট পরেই যাচ্ছে। গলায় টাই ঝুলছে। কোট বুঝি অফিসেই থাকে। কিংবা কোট বুঝি লাগে না আজকাল। নিয়ে যেতে অফিসের গাড়ি এসেছে বোধহয়। কী রকম টান হয়ে গটগট করে চলে যাচ্ছে দেখ না। এদিক ওদিক একটু চেয়ে দেখবার নাম নেই।

‘এই শোন।' 
বিভাস দাঁড়াল। 
'একটা টাকা দিতে পারিস?' খুব আস্তে করে বললেন সুরেশ্বর।

পকেট থেকে পার্সটা বার করে ঘরগুলো দেখল বিভাস। বললে, 'খুচরো টাকা নেই। শুধু দুটো দশ টাকার নোট। কিছু ভাঙতি আছে। ভাঙতি দিলে চলবে?' 

সুরেশ্বর কথা বললেন না। যেমন খবরের কাগজে চোখ দিয়ে ছিলেন তেমনি চোখ দিয়ে রইলেন। 

‘মাকে বলে যাই।' সারা বারান্দা আবার হেঁটে গিয়ে রান্নাঘরে মায়ালতার সামনে এসে দাঁড়াল বিভাস। বললে, 'মা, বাবা একটা টাকা চেয়েছে। দিয়ে দিয়ো।' বলে আবার গটগট করে বেরিয়ে গেল। নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। 

‘তুই দিবিনে তো দিবিনে, সোজা চলে যা। বাহাদুরি করে আবার মাকে বলতে যাওয়া কেন?' 

যা ভেবেছিল, যথাসময়ে মায়ালতা তেড়ে এল : 'টাকা— টাকা দিয়ে কী হবে?' সুরেশ্বর চুপ করে রইলেন। 

'কী দরকার টাকার?' 

কী একটা নিদারুণ খবর যেন এড়িয়ে গেছে এমনি তীক্ষ্ণ চোখে খবরের কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন সুরেশ্বর। 

‘দরকার তো আমার কাছে চাইলেই হয়।' 

একবার মায়ালতার মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করল সুরেশ্বরের। বুড়ো বয়সের আরও অনেক লোভের মত এ লোভও দমন করলেন। 

‘নিজের টাকা থাকতে ছেলের কাছে কে হাত পাতে?' 

নিজের টাকা! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি-ফেলি করেও ফেললেন না সুরেশ্বর। 

রিটায়ার করার সঙ্গে সঙ্গেই থোক টাকাটা দিয়ে এই বাড়িখানা কিনেছিলেন সুরেশ্বর। নিচের তলায় ভাড়াটে ছিল, তাতে কী, উপরটা তো ফাঁকা পাওয়া গেল। একমাত্র ছেলে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সংসার, উপরের তিনখানা ঘরে কুলিয়ে যাবে আপাতত। পরে আস্তে-সুস্থে ভাড়াটেকে উঠিয়ে দিয়ে বসা যাবে বিস্তৃত হয়ে। 

বাড়ি কিনে অল্প টাকাই ছিল ব্যাঙ্কে। কিন্তু আয় তো কিছু আছে এখনও। আছে মাসিক পেনসন আর বাড়িভাড়া। অবশ্য উপরালাকে চরম তুষ্ট করতে পারেননি বলে শেষ পর্যন্ত উন্নতিতে কনফার্মড হতে পারেননি, তাই পেনসনের টাকাটা যেমন হওয়া উচিত ছিল তেমন হয়নি। দলের লোকেদের তুলনায় থেকে গিয়েছে বিকলাঙ্গ। আর ভাড়াটেও মান্ধাতার আমল থেকে চলে এসেছে বলে ভাড়াটাও কৃশকায়। 

এ সমস্তই, মায়ালতার বিচারে, ডাহা অযোগ্যতা। নইলে শেষ ধাপে পৌঁছে চুড়োর সঙ্গে ঝগড়া করে কে? আর একটা ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করার মত যার হিম্মত নেই তাকে অথর্ব বলে না তো কী বলে! 

'কতগুলো টাকার লোকসান!' সর্বক্ষণই হা-হুতাশ লেগে আছে মায়ালতার মুখে : 'পেনশনটা প্রমাণসই থাকলে ভাবনার কিছু ছিল না। মুখপোড়া ভাড়াটেটা যদি উঠে যেত তা হলে তিনগুণ ভাড়ায় অনায়াসে নতুন পত্তন হতে পারত। এক মুঠেই একরাশ সেলামি ওঠো,' থেকে থেকে সুরেশ্বরের গায়ে ঠেলা মেরেছে মায়ালতা : 'একটা ফিকির বার কর না, এককালে তো কত ডিসমিস করেছ, হতভাগাকে দাও না ঘোল খাইয়ে।' 

সুরেশ্বর শুকনো মুখে হেসেছে : 'নিজে ডিক্রি-ডিসমিস করা এক কথা, পরের হাতে ডিক্রি পাওয়া বা ডিসমিস খাওয়া অন্য কথা।' 

'তেমন যদি পুরুষ হতে হৈ-চৈ করেই তাড়িয়ে দিতে পারতে লোকটাকে।' 

'আহা, কী যে বলো! এতগুলো কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ভদ্রলোক যাবে কোথায়?' 

‘যাবে কোথায়! তার জন্যে হতচ্ছাড়া আমাদের ঘাড়ে পড়ে থাকবে?' মায়ালতা সর্বাঙ্গে ঝেঁকে উঠল : 'অন্তত লোকটাকে মুখে বলতে পার তো!' 

‘বলতে গেলে শোনে নাকি কেউ?' 

'অন্তত একটা কথা-কাটাকাটির তে চান্স হয়।' 

'কথা-কাটাকাটি থেকে মাথা-ফাটাফাটি। শেষকালে শ্রীঘর।' 

'তা হলেও তো বুঝতাম একটা পুরুষের ঘর করছি।' ঘৃণায় বিষিয়ে উঠেছে মায়ালতা : 'এমন অক্ষম আর অপদার্থ দেখিনি কোথাও। জজ না হয়ে একটা পেয়াদা হলেই তো পারতে।' 

‘জজের চেয়ে পেয়াদার ক্ষমতা বেশি। পেয়াদা হতে হলে ভাগ্য চাই।' 

তবু এরই মধ্যে সামান্য ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করেছেন সুরেশ্বর। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটা তার ও মায়ালতার নামে একত্র করে নিয়েছেন। তাদের দুজনের মধ্যে যে 

কেউ যখন খুশি লেনদেন করতে পারবেন। 

'এটা ভাল হল না?' সন্তপ্তকে প্রবোধ দেবার চেষ্টায় বললেন সুরেশ্বর : এমন পর্যন্ত হয়েছে, ব্যাঙ্কে স্বামীর অগাধ টাকা মারা যাবার পর স্ত্রীর হাতে পয়সা নেই, শ্রাদ্ধ করতে পারে না। স্বামীর টাকায় হাত দেবার অধিকার নেই, যেহেতু অ্যাকাউন্ট শুধু স্বামীর নামে। সাকসেশান সার্টিফিকেট নাও, পরে টাকায় হকদার হবে। ততদিন শ্রাদ্ধ স্থগিত থাক!' 

'কী সর্বনাশের কথা!' 

‘তার চেয়ে এটা ভাল হল না? অন্তত ঐ দুরবস্থার হাত থেকে তো বাঁচলে! এ তুমি ইচ্ছেমত চেক কেটে টাকা তুললে, কারুর তোয়াক্কা রাখলে না, কাউকে দিতে হলে চেক ক্রশ করে দিলে, টাকা তুলতেও হল না। ব্যবস্থাটা ভাল নয়?' 

‘মন্দ কী।' 

সুরেশ্বর মায়ালতাকে সযত্নে শিখিয়ে দিলেন কী করে চেক কাটতে হয়। তারপরে আর যায় কোথা! 

মায়ালতা চেক আর পাশ-বই নিজের ব্যাক্সে বন্ধ করল। যদি টাকা তুলতে হয় আমি তুলব, তোমার তোলবার কী দরকার! 

'না, আমার আর কী দরকার!' কান চুলকোলেন সুরেশ্বর। 

'তোমার দরকার পড়বে মরে গেলে, শ্রাদ্ধের সময়। সে আমি বুঝব।' 

মায়ালতা এটা ধরে রেখেছে সুরেশ্বরই আগে মরবেন। 

'ধরব না কেন?' ঝটকা দিয়ে বলে উঠল মায়ালতা, যে আগে জন্মায়, সেই আগে মরে।' 

তা মরুক, কিন্তু ব্যাঙ্কে নতুন টাকার আমদানি কই? সামান্য যা আছে তা আছে, কিন্তু জমার ঘরে নতুন টাকা না পড়লে চেক কেটে সুখ কই মায়ালতার? যা আছে তাই যদি সে তুলে তুলে শেষ করে দেয়, তবে তো শ্রাদ্ধ দূরের কথা মুখাগ্নিও হবে না। 

তাই জমার ঘরে আমদানি বাড়াও। 

ভাড়ার টাকাটা মায়ালতা নগদ পায় আর তা তো সংসারই পুরো গ্রাস করে। পেনশনের টাকাটা ব্যাঙ্কে জমা পড়ে। কিন্তু মায়ালতা সেটা পুরো তুলতে চায় না। যদি সেটাও সম্পূর্ণ তুলে আনে তা হলে সেটাও সংসার আত্মসাৎ করবে। তা হলে রইল কী মায়ালতার? তা হলে ঢং করে আর জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা কেন? 

টানাটানি তবু যায় না কিছুতেই। 

কত ব্যয়সংক্ষেপ হয়েছে, তবুও না। শার্ট কোট প্যান্ট উঠে গেছে—দর্জির খরচ বলতে কিছু নেই। ধোপাও ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আগে-আগে জুতোর কালিই বা কত লাগত। এখন তো জুতো স্বাভাবিক হয়ে রয়েছে। আগে আগে লোকজন আসত, চায়ের পেয়ালার চাকচিক্য ছিল। এখন চায়ের পেয়ালার ডাঁটি ভেঙে গেলেই তো সামঞ্জস্য থাকে, আর যদি পেয়ালার বদলে কাচের গ্লাস আসে, তাও বা বেমানান কোথায়। বলে, চায়ের কাপ রিটায়ার করেছে। কদিন পরে গ্লাসের বদলে খুরি আসে কিনা তাই দেখ। তার মানে, বাজার কঠিন হলে আরও হাতটান। আগে-আগে ইংরিজি-বাংলা দুখানা খবরের কাগজ আসত, এখন ইংরিজিখানা উঠে গিয়েছে। কাগজ-কালি-কলমও ওঠার মধ্যে। আগে-আগে ক্কচিৎ কখনও বই-টই কেনাকাটা ছিল, সে এখন স্বপ্নের কথা। যদি পড়তে চাও তো, মায়ালতা যে আট আনা চাঁদা দিয়ে লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছে সে লাইব্রেরি থেকে মায়ালতার ফরমাশমত গল্প-উপন্যাস নিয়ে এস আর, মায়ালতা ছুটি দিলে, তাই একটু নাড়া-চাড়ো। তাই লেখাপড়ার খরচ বলতেও না থাকার মধ্যে। আগে এক প্রধান খরচ ছিল সিগারেট। দিয়ে থুয়ে দিনে আগে তিন প্যাকেটে হত। এখন তো দেওয়া নেই, তাই এক প্যাকেটই যথেষ্ট। আর রিটায়ার করার পর সিগারেটেরও জাতে পতিত হওয়া বিধেয়। আর বাজার আরও চড়া হলে সিগারেট যে খাকির পোশাক পরে আসবে তার জন্যে সুরেশ্বর প্রস্তুত। 

এমনি এক কলে-ইঁদুর-পড়া অবস্থায় সুরেশ্বর বলেছিলেন : 'পেনশনের গোটা টাকাটাই তুলে নিলে পার। আমার একটা হাত-খরচের টাকা হয়।' 

‘হাত-খরচ? তোমার কোন্ খরচ মেটানো হয় না শুনি? এর উপর আবার কিসের জন্যে দরকার?' মায়ালতা তুমুল করে ছাড়ল : 'টাকা নিয়ে কোথাও যাবে নাকি লুকিয়ে?' 

কতক্ষণ চুপ করে ছিলেন সুরেশ্বর। পরে বললেন, বলবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন, তবু বললেন, 'পেনশন থেকে সেভিং হয় কোনদিন শুনিনি।' 

‘শুনবে কেন? এবার দেখ। তেমন হাতে পড়লে হয়।' মায়ালতা চলে যাচ্ছিল, বিষ সম্পূর্ণ ঢালা হয়নি বলে আবার ফিরল : কী আমার পেনশন আর কী আমার সেভিং। সব মেরে দিলে নগদ ক'টা টাকা আর আমার জন্যে রেখে যাবে শুনি? যখন তোমার হাত-খরচের জন্য টাকার দরকার, তখন ফের আরেকটা চাকরি নাও। যাও, ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দরবার কর।' 

কী কুক্ষণে কথাটা তুলেছিলেন সুরেশ্বর, কেঁচো হয়ে রইলেন। 

কিন্তু সেই থেকে মায়ালতা এক মন্ত্র জপতে লাগল অনুক্ষণ : 'ওঠ, বেরোও, এর-ওর বাড়ি গিয়ে দেখা কর। একটা কিছু বাগিয়ে নাও। আউট হয়ে যাবার পরেও যদু মধু সবাই আবার মাঠে নামছে, তুমি কেন দলছাড়া হয়ে থাকবে? ওকে দিলে আমাকে দেবেন না কেন, এই যুক্তিতে আদায় করে ছাড়বে। নাও, ওঠ, দাড়ি কামাও।' 

চিরকাল তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে কেটেছে। রিটায়ার করার পর, সুরেশ্বর ভেবেছিলেন, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকবেন প্রাণ ভরে, দেয়ালের ঘড়িতে একটার পর একটা বেজে গেলেও চঞ্চল হবেন না। কী শান্তি, কোমরে আর বেল্ট আঁটতে হবে না, জুতোয় নিচু হয়ে বাঁধতে হবে না ফিতে, আর গলায় পরাতে হবে না সেই দুর্ধর্ষ 'কলার'। কী না জানি করলাম, কি না জানি করি নি, কী না জানি জানি করা উচিত, সর্বক্ষণ কাটবে না এই বিবেকের উদ্বেগে। ঘুমুতে পারবেন নিশ্চিন্ত হয়ে। জাগতে পারবেন নির্মলতায়। 

'কই, উঠলে?' ঘরে ঢুকে ফ্যান বন্ধ করে দিল মায়ালতা। 

তবু যদি আরও গড়িমসি করতে চান সুরেশ্বর, মশারির চার কোণ খুলে দিয়ে মায়ালতা তাঁকে পল-চাপা দেবার ব্যবস্থা করবে। 

সুতরাং বাধ্য ছেলের মত উঠে পড়। 

তবু এক-আধবার বলেছেন সুরেশ্বর, 'আর গোলামি করব না।' 

'এত সব যারা চাকরি করছে, গোলামি করছে?' 

'তা ছাড়া আবার কী!' 

‘মোটেই না, দেশসেবা করছে।' 

‘নিজের পেটের সেবা করছে। পেটের সেবাই দেশসেবা। আমি না বাঁচলে আবার দেশ কী!' 

'তবে সবাই যা করছে তুমিও তাই করবে।' 

'তবু উচ্চের গোলামি সহ্য হয়, তুচ্ছের গোলামি সহ্য হয় না।' 

ও সব কোন যুক্তিই শোনবার মত নয়। মোটকথা টাকা চাই, আর টাকা মানেই আরও টাকা। সুতরাং ক্লৈব্য ত্যাগ করে ওঠ, বেরিয়ে পড়। মায়ালতার ব্যাঙ্ক একাউন্টের সম্মান রাখ। 

‘সন্ধেয় মঠে-মন্দিরে যাই পাঠ-ঠাট শুনতে, কখনও যা কোন সভা-সমিতিতে, মায়ালতা আপসোস করে : 'কত ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হয়, সবাই কেমন স্বামীর নামে উজ্জ্বল হয়ে আছে, অমুক স্পেশাল অফিসরের, অমুক জয়েন্ট সেক্রেটারির, অমুক ট্রাইবিউন্যাল জজের স্ত্রী আর আমি? কিছু বলতে কইতে পারি না, লজ্জায় মাটি হয়ে থাকি। অনেক চাপাচাপি করলে বলি, রিটায়ার করেছি। সবাই কপালে চোখ তুলে বলে, সে কী, এরই মধ্যে রিটায়ার করেছেন? মুখখানি এখনও পুরন্ত, শরীর দিব্যি আঁটসাঁট, এখুনি পাততাড়ি গুটোবেন কী! একটা কিছু ধরে আবার ঝুলে পড়ুন। শেকড় গেলে কী হয়, ঝুরি তো আছে।' এবার বুঝি কথা নাকের ভিতর দিয়ে আসতে থাকে : 'কিন্তু আমার দুঃখের কথা কে বোঝে, কাকে বা বলি। কী এক অপদার্থ অকর্মণ্যের হাতে পড়েছি। সব মুছে-টুছে বিধবা সেজে বসেছি স্বামী থাকতে।' 

অগত্যা বেরোতে হয় সুরেশ্বরকে। এ দরজায় ও দরজায় গিয়ে ধন্না দিতে হয়। বোকা-বোকা মুখ করে বসতে হয় জড়সড় হয়ে। 

বলা বাহুল্য কিছুই হয় না। হয়ত বা সুরেশ্বরের নিজের জন্যেই হয় না। চোখে মুখে আনতে পারে না দীনহীন কাঙাল-কাঙাল কাকুতি। পায়ে-পড়া ব্যাকুলতা। চাকরি না পেলে মরে যাব শেষ হয়ে যাব এই নিঃশব্দ আর্তনাদ। 

সারা জীবন চাকরি করে এসে শেষ জীবনে আবার এই চাকরির উমেদারি —পার্কের রেলিঙ ধরে হাঁপ নেন সুরেশ্বর। 

বাড়ি ফিরেও সুখ নেই। আবার তাড়া। আবার গলাধাক্কা। 

'দুপুরে অফিসে গিয়ে হয়নি, সকালে-সন্ধেয় এবার বাড়িতে যাও। আমি পয়সা দিচ্ছি, ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে নাও না-হয়। 

আগে ঘড়ি তাড়া দিয়ে ফিরেছে এখন থেকে তাড়া দিচ্ছে মায়ালতার ধমক। 

'তোমার না দুপুর দুটোর সময় দেখা করবার কথা?' মায়ালতা হুমকে ওঠে : 'এখুনি শুয়ে পড়লে কী।' 

চোখে একটা জাস্তব অসহায়তা নিয়ে সুরেশ্বর বললেন, 'একটুখানি গড়িয়ে নি। এই একটুখানি। ঠিক সময়ে উঠে পড়ব দেখো।' 

'না, বিশ্বাস নেই। ঘুম সব কিছু ভণ্ডুল করতে পারে। তা ছাড়া দুপুরের ঘুমে মুখ ভীষণ বোদা দেখাবে, একেবারেই স্মার্ট লাগবে না।' প্রায় চাবুকের হাত তোলে মায়ালতা : 'উহু চলবে না গড়ানো। উঠে পড়।' 

অগত্যা উঠে পড়তে হয় সুরেশ্বরকে। 

'এ কী দাড়ি কামাবার ছিরি! চোয়ালের নিচে সব রয়ে গিয়েছে।' সাজাগোজায়ও 

মনোযোগ দেয় মায়ালতা : 'আর যাই কর সঙ্গে ঐ ছাতাটা নিয়ো না।' 

'নইলে রোদ্দুরে মাথা ধরে যে।' 

'ছাই ধরে। ঘৃণায় কিলবিল করে ওঠে মায়ালতা : 'এইটুকু সহ্য করতে না পারলে আর পুরুষ কী!' 

‘চাপরাশী তো আর নেই। এই ছত্র সিংই এখন চাপরাশী।' লঘু হবার চেষ্টা করেন সুরেশ্বর, আদরের ভঙ্গিতে তাকান ছাতার দিকে। 

'ঐ ছাতাটা দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি মার।' 

অগত্যা ছাতাটাকে রেখে যেতে হয়। 

রোদে-জলে ষাঁড়ে-কুকুরে ছাতাছাড়াই সুরেশ্বরের গতায়াত। কিন্তু সমস্ত নিষ্ফল। সমস্ত পাথরে কোপ। সুরেশ্বর ছাড়া দেশসেবা হচ্ছে না এমন কোথাও কারু বিন্দুবিসর্গ ভাব নেই। 

তবু, গরু শিং ছাড়লেও মায়ালতা তাড়া ছাড়ে না। 

'ওঠ, নিজের ডিপার্টমেন্টে না হলে না হবে, মার্কেটে আরও ঢের-ঢের চাকরি আছে। দেবা মিত্তির তো তোমারও সিনিয়র। ডিপার্টমেন্টে না পেয়ে কর্পোরেশনে ঢুকেছে।' 

‘দেখি—' 

বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলেই যেন সুরেশ্বরের মুক্তি। গড়ের মাঠে, দুপুরে, যারা গাছতলায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে, তাদের দিকে শ্যামল স্নেহে তাকিয়ে থাকেন সুরেশ্বর। ইচ্ছে করে ওদের শান্তির সমতলে তিনিও অমনি শোন পাশটিতে, ঘুমিয়ে পড়েন। 

কখনও কখনও বা একটু কোমলের দিকে যায় মায়ালতা। বলে, 'দাঁড়াও, তোমার সামনের এই পাকা চুল কটা তুলে দিই।' 

বাঁশি-ভোলা হরিণশিশুর মত এগিয়ে আসেন সুরেশ্বর। কিন্তু সামনের চুল তুলতে গিয়ে মায়ালতা হঠাৎ জুলপির চুল ধরে টান মেরে বসবে এ কল্পনাও করতে পারতেন না। সুবেশ্বরের চোখে জল এসে যায়। 

কিন্তু ভবী কিছুতে ভোল না। 

'কর্পোরেশনে না হোক, কোন কোম্পানির ম্যানেজারি পাও না? বড়বাজারে ঘোরো না দিনকতক।' 

কখনও কখনও কোথাও একেবারে যানই না সুরেশ্বর। হাটে কলা, নৈবেদ্যায় নমো করে বসে থাকেন পার্কে। বসে-বসে, যা এতদিন দেখেননি চাকুরে জীবনে, দুপুর দেখেন, দুপুরের রোদ দেখেন। 

সন্ধের দিকে বাড়ি ফেরেন গরুচোরের মত মুখ করে। 

'কিছু হল ?' 

মুখেই তা প্রকাশ পায়, কথায় আর বলতে হয় না। 

'তোমার দ্বারা আবার হবে? তুমি অকর্মার ঢেঁকি, ষাঁড়ের গোবর—' শেষে একেবারে মর্মমূলে ঘা মারে মায়ালতা : 'নইলে জজিয়তিতে কনফার্মড হও না—' 

তবে ছেড়ে দাও। আমি মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকি। 

না, ছাড়বে না মায়ালতা। চাকরি না পাও একটা ইস্কুল-মাস্টারি? 

মন্দ কী। তাও তো মানুষে করে! 

‘কিন্তু আমি কি মানুষ?' 

একটু বুঝি মায়া হয় মায়ালতার। বলে, আমার কী! তোমার ভালর জন্যেই বলা। বাড়িতে ঠায় বসে থাকলে শরীর ভেঙে যাবে। কাজেকর্মের মধ্যে থাকলেই বরং ভাল থাকবে, বাহাত্তুরে পাবে না। নিষ্কর্মার আর কাজ কী! শুধু আহার, নিদ্রা আর ক্রোধ।' 

হায়, ক্রোধ কবে গেছে দেশান্তরী হয়ে। 

লোকে তো একটা প্রাইভেট টিউশানিও পায়? তাই দেখ না চেষ্টা করে। 

'কাকে পড়াব?' প্রায় আকাশ থেকে পড়বার মত মুখ করলেন সুরেশ্বর। 

'তা খুঁজেপেতে দেখ না। কত লোকের তো গার্ডিয়ান টিউটার থাকে—' 

'তা থাকে। কিন্তু আমি পড়াব কী।' 

'পড়াবে আমার মুণ্ডু।' 

'কিছু কি লেখাপড়া শিখেছি যে পড়াব বলে সাহস করব?' 

'তবে কিছুতেই যখন আয় বাড়াবার মুরোদ নেই, তখন, মায়ালতা ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখাল : 'তখন হাতখরচ না, এই।' 

আয়ের পথ মায়ালতাই বার করল। একটা চাকর ছিল, তাকে তুলে দিয়ে মায়ালতা ঝি রাখল। চাকর সুরেশ্বরের দু-একটা ফুট-ফরমাশ খাটত, স্নানের আগে তেল মাখিয়ে দিত, টিপে দিত গা হাত-পা, সেটা বন্ধ হল। যার আয় নেই তার আবার আরাম কিসের? চাকরের চেয়ে ঝি-এর খরচ কম, আর দৈনিক বাজারটা যদি এখন সুরেশ্বর করেন, তা হলে আরও সাশ্রয় হয়। 

তার অর্থ বাড়িতে চাকর দিয়ে মাসাজ না করিয়ে বাজারের ভিড়ে গিয়ে দলাইমলাই হোন। 

'নাও, ওঠ, চাকর' নেই, বাজারটা করে আন।' মায়ালতা একটা জলজ্যান্ত পরোয়ানা হয়ে ওঠে : 'ফর্দ করে লিখে নাও, যেন ছেড়ে না আসো।' 

ফর্দ করে লিখে নিলেন সুরেশ্বর। আইটেম তো বেশি নয়, লিখে না নিলেও চলত, এমনি করুণ করে তাকালেন। কে জানে কী, স্মৃতিশক্তি বলে তো কিছু আর আশা করে না ঐ গোবরভরা মাথার মধ্যে, তাই মায়ালতা সাবধান হয়। বলে, দরটাও পাশে-পাশে লিখে নাও। 

এ মন্দ হয়নি একরকম। প্রিডিসেসর-ইন-অফিস বরখাস্ত চাকরটাকে মনে-মনে প্রণাম করলেন সুরেশ্বর। ওর দেওয়া দরটাই ফর্দে তুলে দিয়েছে মায়ালতা। তাতে প্রায় পাঁচ-ছ আনার ব্যবধান। 

প্রথম দিন চুরির পয়সা দিয়ে গরম-গরম জিলিপি খেলেন সুরেশ্বর। খোলা থেকে নামছে এমন জিলিপি কতদিন খাননি। দ্বিতীয় দিন দেখলেন কাচের বোয়মে সদ্যভাজা ভেজিটেবল চপ। তাই খেলেন একটা আর তৃতীয় দিন—তৃতীয় দিনই ধরা পড়লেন। 

‘ঐ কাপড়টা ছেড়ে এই কাপড়টা পরো।' মায়ালতা হুকুম জারি করল : 'ধোপা এসেছে।' 

বাঁচানো পয়সা কটা পকেটে রাখলে বেজে উঠতে পারে ভেবে সতর্ক হয়েই ট্যাঁকে গুঁজেছিলেন সুরেশ্বর, এখন কাপড়টা ছাড়তে যেতেই বিশ্বাসঘাতকেরা মেঝের উপর পড়ল ছত্রখান হয়ে। 

'এ পয়সা এল কোত্থেকে?' 

'বাজার থেকে বাঁচিয়েছি।' 

'বাঁচিয়েছ তো, আমাকে ফেরত দাও নি কেন?' 

'এই তো যাচ্ছিলাম দিতে।' 

‘যাচ্ছিলে তো ট্যাঁকে গুঁজেছ কেন?' মায়ালতা আর আচ্ছাদন মানল না, যা চাকরকে বলতেও সাহস পেত না তাই বলল : 'চোর কোথাকার!' 

ম্লান চোখে হাসলেন সুরেশ্বর : 'নিজের টাকা নিজে নিলে চুরি করা হয়?' 

‘হয় না? চোরের বেলায় স্বত্বের কথা কী, দখলের কথা।' মায়ালতা ঝলসে উঠল : আমার দখল থেকে সরিয়ে নিচ্ছ পয়সা, আমার অনুমতি না নিয়ে, অন্যায়রূপে লাভবান হবার জন্যে। চুরি নয়? আইনের এই রকম জ্ঞান বলেই তো কিছু হল না। শুধু চোর? চোরের বেহদ্দ—বাটপাড়।' 

চোরাই মাল, রদ্দি কটা নয়া পয়সা, মায়ালতা কুড়োল মেঝের থেকে। কুড়িয়ে বাঁধল আঁচলে। 

সদ্য-সদ্য খরচ করে এলেই পারতেন, নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন সুরেশ্বর। জানেন সঞ্চয়ই যত অনর্থ, তবু সেই সঞ্চয়ই করতে গেলেন। 

চাকরিতে কনফার্মড হতে পারলেন না সুরেশ্বর। বাজার ঝি-এর হাতে চলে গেল। জুনিয়র এসে সুপারসিড করলে। 

তবু কি রেহাই আছে? 

'এই, ওঠ, ধোপাকে তাগাদা দিয়ে এস।' 

'কই উঠলে, গেলে ইলেকট্রিক মিস্তিরির কাছে?' 

'গতরখানা একবার নাড়াও, বিভাসের নামে মানত আছে, পুরুতঠাকুরকে খবর দাও।' 

সুরেশ্বরকে মায়ালতা শুকনো সেরেস্তায় বদলি করেছে, যেখানে শুধু খাটনি—মান নেই মুনাফা নেই, পোষানি নেই এক কণা। 

শুধু তাড়ার পরে তাড়া। বল মা 'তাড়া', দাঁড়াই কোথা? 

'এই, ওঠ, গয়লা দুধ দুইছে, দাঁড়াবে এস।' 

'কই উঠলে, কয়লাটা মেপে নাও।' ‘ 

'শোন, বেরুচ্ছি, এসে যেন দেখি ওষুধটা এনে রেখেছ।' 

হতশ্রদ্ধাব মধ্যে এমনি করেই দিন যাবে? 

না, ভাগ্য মুখ তুলে চাইল। ফক্স কোম্পানিতে বিভাসের সাহেবি গ্রেড চাকরি হল। স্টাটিঙ-এই সাড়ে চারশো। 

আহ্লাদে আটখানা হলেন সুরেশ্বর। আশার দোকান দিয়ে বসলেন। এবার তা হলে সচ্ছল হবে সংসার। সুরেশ্বরের হাতে আসবে এখন হাতখরচ। 

‘না বিভাসের মাইনের এক টাকাও এ সংসারে যাবে না। এ সংসার তোমার।' ফরমান জারি করল মায়ালতা। 

'তবে ওকে সংসারী কর।' 

'তাই করব। তোমাকে বলতে হবে না। তার আগে ভাড়াটে তাড়াও। জায়গা খোলসা কর।' 

বিভাস মাতৃভক্ত। জীবনে অনেক উন্নতি করবে। মাইনে থেকে মাকে মাস-মাস 

পঞ্চাশ টাকা হাত-খরচ দেয়। বাবাকে দেবার কী দরকার বাবার তো পেনশনই আছে। কিন্তু সে পেনশনের কী হাল তা দেখেও দেখতে চায় না। মাইনের বাকি টাকা নিজের হাত-খরচ বাদ দিয়ে এখানে ওখানে সঞ্চয় করে। ইনসিওরই করেছে কুড়ি হাজার। মায়ে-পোয়ে এক জোট। 

একটা টাকা চাইলাম, ভাঙানি নেই বলে দিল না। ভাঙানি নেই তো, দশ টাকার একটা নোটই দিয়ে যা। দশ টাকা দিলে কি আর চণ্ডীপাঠ অশুদ্ধ হত? বেশ তো, নেই, দিলিনে, কিন্তু তোর মাকে বলে যাবার কী দরকার? তোর মাকে এখন সামলাই কী করে? 

সুরেশ্বরের মনে হল ওরা মায়ে-পোয়ে মিলে ঠেঙিয়ে একদিন মেরে ফেলবে তাঁকে। বুড়ো গরুর বিয়েন শেষ হয়ে গিয়েছে, এখন এটাকে কসাইয়ের হাতে তুলে দাও। 

'কই, বললে না তো টাকার কী দরকার!' মায়ালতা খেকিয়ে উঠল। 

'বিভাসের ঐ সম্বন্ধটার জন্যে শ্যামবাজারে যাবার কথা ছিল না, তারই ট্রাম ভাড়া।' 

'সে তো শুক্কুরবার—আজ কী?' 

'ও, শুক্রবার নাকি? আমার খেয়াল ছিল না—' 

'আর সে ট্রাম ভাড়া আমি দেব। তুমি খোকার কাছে চাইতে গেলে কোন লজ্জায়?' 

‘না, না, তা হলে ঠিক আছে। আর চাইব না কোনদিন।' চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন সুরেশ্বর। 

মনে-মনে প্রার্থনা করলেন, হে ভগবান, বিভাসেব বউ যেন দজ্জাল হয়, মুখরা হয়, শাশুড়িকে যেন ছেঁচা দেয়, কোণঠাসা করে, আর অপমানে জর্জর হয়ে সেদিন যেন সুরেশ্বরের কাছে খুব আপন হয়ে অন্তরঙ্গ হয়ে এসে বসে। স্বামীর থেকে স্নেহ নেয়, উপশম নেয়। 

মাকে বলে যাই! তর্জন-তাড়ন ছাড়া আর কোন ব্যবস্থাই করল না মায়ালতা। 'একবার কোর্টে যেয়ো।' উপদেশ দিয়ে গেল পালটা। 

'আজ তো দিন নয়।' ভয়ে-ভয়ে বললেন সুরেশ্বর। 

‘দিন না হোক, তবু ঘুরে আসতে ক্ষতি কী। তদবির কিছু আর লাগবে নাকি জিজ্ঞেস করতে পার উকিলকে।' 

'যাব।' 

বিকেলে, যেমন যান, পার্কে গেলেন সুরেশ্বর। কিন্তু যে বেঞ্চিতে বসেন আজ সেদিকে গেলেন না, দূরে-দূরে ঘুরতে লাগলেন। ছোটর দল বেঞ্চির চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল, দাদু কই, লজেন্স কই! দাদু কই, টফি কই? দাদু কই, কই আমাদের ডাবল বাবল? 

ঐ, ঐ দাদু। কেউ-কেউ বুঝি দেখতে পেয়েছে দুর থেকে। ছুটে পাকড়াও করেছে। জামার পকেট ধরে টানাটানি করছে। দাও, দাও, ওরা না আসতে আমাদের দিয়ে দাও চকোলেট। দিয়ে দাও ললিপপ। 

ছলছলে চোখে সুরেশ্বর বললেন, 'আজ কিছু আনতে পারিনি।' ছেলেমেয়ের দল বিশ্বাস করতে চায় না। পকেট হাতড়াবার জন্যে হামলা করে। 

'সত্যিই নেই। সত্যিই আনতে পারিনি।' 

'আনতে পারনি তো এসেছ কেন?' 

এই কথাটাই ভাবতে-ভাবতে বাড়ি ফিরলেন সুরেশ্বর। আনতে পারনি তো এসেছ কেন?' সঙ্গে করে যদি সৌভাগ্য আর সাফল্য আনতে পারিনি তবে এসেছি কেন পৃথিবীতে? কোন্ কর্মে লাগতে? এসেছ কেন? যখন জান দুই হাত শূন্য, তখন কেন এসেছ, কোন্ অহঙ্কারে? এসেছ শুধু নয়, থাকছ, ঘোরাফেরা করছ। কেন, কেন? 

বাড়ি এলে মায়ালতা জিজ্ঞেস করল, সিনিয়র যে দিলে, কী বলছে? 

'বলছে আশা কম।' 

'কেন, কম কেন?' ঝিকিয়ে উঠল মায়ালতা।' 

'ঘর দরকার, সেইজন্যেই তো উচ্ছেদ চাই। সিনিয়র বলছেন, উপরে আপনাদের তিনখানা ঘর আছে, তিনখানাই তো যথেষ্ট।' 

'যথেষ্ট? এ কী রকম সিনিয়র?' 

'বলছেন, তিনটি মোটে আপনারা প্রাণী, বিয়ে করে বউ নিয়ে বিভাস একখানা ঘরে থাকতে পারে অনায়াসে। তার জন্যে নিচের ঘরের দরকার নেই।' 

'দরকার নেই? আধুনিক দম্পতি একখানা ঘরে কুলিয়ে উঠতে পারে?' 

'বলছেন, আপনি আর আপনার স্ত্রী যদি এক ঘরে থাকেন তবে তৃতীয় ঘরটাও তো বিভাস নিতে পারে বিয়ের পর।' 

'আমি আর তুমি এক ঘরেই তো আছি, তাই বলে, তুমি একটা এক্স-জজ, তোমার একটা বৈঠকখানা চাই না?' অশেষ কৃপার চোখে সুরেশ্বরের দিকে তাকাল মায়ালতা। বললে, 'এ সিনিয়রে চলবে না। তুমি হাইকোর্ট থেকে উকিল আন।' 

'দরকার-ব্যাপারটা দু পক্ষে তৌল করে দেখতে হবে কিনা। আমি না, উকিল বলছেন, আইন বলছেন,' অপরাধীর মত মুখ করলেন সুরেশ্বর : 'যেখানে আমাদের তিনজনের জন্যে তিনখানা, সেখানে নিচে দশজনের জন্যে তিনখানা। ওদের দরকারটাও তো আইন দেখবে।' 

'ছাই দেখবে। তুমি ব্যারিস্টার লাগাও।' রি-রি করতে লাগল মায়ালতা : 'আধুনিক দম্পতিকে এক ঘরেই আবদ্ধ করে রাখতে চায় এ আইন আইনই নয়। আর বাপ যতক্ষণ না ছেড়ে দিচ্ছে ততক্ষণ তার বসবার ঘরটা ছেলে দখল করে কী করে? ছেলে কি জবরদস্ত হয়ে বাপকে তাড়াবে? তুমি বিলেতফেরত ব্যারিস্টার লাগাও, দেশী ব্র্যান্ডের কাছে যেয়ো না, বিলেতফেরতই বুঝবে আধুনিক দম্পতির তাৎপর্য।' 

'তাই লাগাব।' 

শুনানির দিন সকাল থেকেই মায়ালতার তাড়ার ঘণ্টা বেজে চলেছে। উঠলে? ঘুম ভাঙল? ওঠ, দাড়ি কামাও। স্নান করে এস। পুজো সারো চটপট। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। অত আজ বিতং করে খেতে হবে না। দইয়ের ফোঁটা নাও। পূর্ণঘট দেখে যাও। 

ঠিক সময়েই রওনা করিয়ে দিয়েছে মায়ালতা। দুষ্টু ভাড়াটের অনেক মুলতুবি নেওয়ার পর আজ শেষ দিন নির্ধারিত। 

কথা আছে, কোর্টে গিয়ে সুরেশ্বর যদি বোঝেন শুনানি হবে, বিভাসের অফিসে ফোন করে দেবে, সে যেন এসে হাজিরা দেয়। উকিল বলেছে, বাপ আর ছেলের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। 

সেই উদ্দেশেই সুরেশ্বর চলেছেন কোর্টে। আর সর্বক্ষণ মনে-মনে প্রার্থনা করছেন, ভগবান, মামলায় যেন হার হয়। গরিব ভাড়াটেকে যেন উৎখাত হয়ে অতগুলি কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে বেরুতে না হয় রাস্তায়। ধারে-কর্জে-খরচে না-তল হয়ে যেতে হয়। উপরে তিনখানা ঘরে মায়ালতার আর বিভাসের আর তার নতুন বধুর স্থান হয়ে যাবে। 

চিরকাল এজলাসেই বসেছেন সুরেশ্বর, আজ সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন। প্রায় একটার সময় বিভাস ফোন পেল, শিগগির কোর্টে চলে এস। ট্যাক্সি করে চলে এল বিভাস। কী, ব্যাপার কী? 

'কই, তোমার বাবা সুরেশ্বরবাবু তো আসেননি কোর্টে।' 

'আসেননি?' 

'না। মামলা ডিসমিসড ফর ডিফল্ট হয়ে গিয়েছে।' 

'সে কী সাংঘাতিক কথা। আসেনইনি কোর্টে।' নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগল বিভাস : 'বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরলে, এ রকমই হয় বোধ হয়।' 

ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি এল বিভাস। 

বললে, 'বুড়ো কোর্টেই যায়নি। মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছে।' 

'সে কী!' মায়ালতা দেয়াল ধরে সামলাল নিজেকে। 

'রাস্তায় কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত।' 

রাস্তায় নয়, রেল লাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে। 

সনাক্ত করতে দেরি হল না। পোস্টমর্টেমও এড়ানো গেল। ঘর-ঘর করে ঘুরছে, ঘুরছে ঘরের খোঁজে, এমনি একটা পাগলামির ছিট ছিল মাথায়, এটাও পুলিশকে বোঝাতে বাধল না। পুলিশ ছেড়ে দিল। 

খণ্ড বিখণ্ড দেহটা ঢাকা, শুধু মুখটা বাইরে বার করা, ঘুমে স্নিগ্ধ প্রশান্ত সে মুখ, খাটিয়াটা তোলা হল দোতলার বারান্দায়। 

'এখানে কেন?' গর্জে উঠল মায়ালতা : 'নিয়ে যাও নিচে, বাইরে। চিরকাল তাড়িয়েছি, ঘরের বার করে দিয়েছি। আজ আবার সখ করে উঠে এসেছে কেন? নিয়ে যাও। চলে যাও। বেরিয়ে যাও। এখানে আসবার দরকার নেই। না, নেই। কিছুমাত্র না। কোন ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেনি। বাড়ি দিয়েছে, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট দিয়েছে, ঘর খালি করে দিয়েছে। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, বলছি—' 

সিঁড়ি দিয়ে আবার নামিয়ে নিল খাট। 

চকিতে ছুটে এল মায়ালতা। বললে, 'একটু দেখি।' 

কপালের থেকে মাথার চুলগুলি আস্তে তুলে দিল মাথায়। কানে-কানে বলার মত করে বললে, 'বিদেশে ট্রান্সফার হয়ে চলেছ। তুমি তো জান, ছ-মাস পর্যন্ত স্ত্রীর টি-এ ভ্যালিড থাকে। এই ছ মাসের মধ্যেই নিয়ে যাবে আমাকে। টি-এ খেলাপ করবে না। ভুলবে না কিন্তু। জীবনে যত বারই তুমি হারো, শেষবার হারলে না, হেরেও জিতিয়ে দিলে মামলা। ঠিক নিয়ে যেয়ো আমাকে। আমিই তোমার বিল-এর হিসেব নিখুঁত করে রাখব।' 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ