গল্পটি নিয়ে আলাপ--
গল্পপাঠ :
গল্পপাঠ :
গল্পটি কখন ও কোথায় লিখেছেন?
নীহারুল ইসলাম :
এবছর খুব বেশি গল্প লেখা হয়নি। তবু যে-ক’টি লিখেছি, তার মধ্যে থেকে সেরা গল্পটি বেছে নেওয়া মুশকিল। তবু কী জানি কেন, এই মুহুর্তে ‘পুরনো অ্যালবাম’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে। লিখেছিলাম গত আগস্টে ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকার সম্পাদক এবং আমার দাদা-বন্ধু জয়ন্ত দে’র তাড়নায়। সে আমাকে বার বার গল্প চেয়ে ফোন করছিল, মেসেজ পাঠাচ্ছিল। কী করি- অগত্যা লিখতে বসেছিলাম। গত ১৩ অক্টোবর ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়েছে।
গল্পপাঠ :
গল্পটি লেখার সময়ে কি কাজ করছিলেন, কি পড়াশুনা করছিলেন বা কি লিখছিলেন?
নীহারুল ইসলাম :
শুধু গল্পটি লেখার সময়ে নয়, গত এক বছর যাবৎ পেশাগত কারণে আমাকে একটা ট্রেনিং নিতে হচ্ছে। মূলত ছুটির দিনগুলিতে আমার এই ট্রেনিং। তা নিয়ে একটু পড়াশোনা, অ্যাসাইনমেন্ট লেখা এসবই করতে হচ্ছে। এটা চলবে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তাই তেমন কিছু পড়া হয়ে ওঠেনি, কিছু ছোটগল্প ছাড়া।
গল্পপাঠ :
গল্পটির বীজ কীভাবে পেয়েছিলেন?
নীহারুল ইসলাম :
জয়ন্তদা যখন আমাকে গল্পের জন্য তাগাদা দিচ্ছে, সেই সময়ে আমার এক মামাতো ভাই মারা যায়। বয়সে একটু বড় হলেও যে ছিল আমার সবসময়ের সঙ্গী। তার মৃত্যুসংবাদটা শুনতেই আমি যেন শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম। আর কোন তাড়না থেকে কে জানে, সঙ্গে সঙ্গে অ্যালবাম খুলে তার ছবি খুঁজতে বসেছিলাম। তারপর বাইক চড়ে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম তার লাশের সামনে। আর তার মৃত মুখ দেখে গল্পের বীজ নয়, গোটা গল্পটিই আমার মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিংবা বলা যেতে পারে- আগে থেকেই আঁকা হয়েছিল, মামাতো ভাইয়ের মৃত্যু গল্পটির প্রকাশ ঘটাল মাত্র।
গল্পপাঠ :
এই বীজ নিয়ে কাজ গল্প লিখতে আগ্রহী হলেন কেন? কেন মনে হলো এই বিষয় নিয়ে গল্পটি লিখবেন?
নীহারুল ইসলাম :
বলতেই পারি- এই গল্পটির ক্ষেত্রে আমি অন্তত কোনও আগ্রহ দেখাই নি। বরং বলা যেতে পারে গল্পটি নিজেই একপ্রকার জোর করে আমার কাছ থেকে মুক্তি খুঁজে নিল।
গল্পপাঠ :
গল্পটি কতদিন ধরে লিখেছেন? কতবার কাটাকুটি করেছেন?
নীহারুল ইসলাম :
এক সিটিং-এ বসে লেখা গল্প। তবে তিনবার কাটাকুটি করেছি এইমাত্র।
গল্পপাঠ :
লিখতে লিখতে কি মূল ভাবনা পালটে গেছে?
নীহারুল ইসলাম :
না। আগেই বললাম, গল্পটি আমার ভিতরে তৈরি হয়েই ছিল।
গল্পপাঠ :
গল্পটি লেখার পরে প্রথম পাঠক কে ছিলেন?
নীহারুল ইসলাম :
ইদানিং আমার যে-কোনও লেখার প্রথম পাঠক ভাই-বন্ধু সোমনাথ চক্রবর্তী। লালগোলা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। হালি শহরের ছেলে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খুব ভালো শিল্পী (বেহালা)।
গল্পপাঠ :
লেখার পরে কি মনে হয়েছে, যা লিখতে চেয়েছিলেন তা কি লিখতে পেরেছেন?
নীহারুল ইসলাম :
প্রথমে মনে হয়েছিল হয়ত পারিনি। কিন্তু প্রথম পাঠে সোমনাথ যেভাবে প্রশংসা করেছিল তাতে মনে হয়েছিল, পেরেছি। তারপর প্রকাশ হওয়ার পর সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, গৌর বৈরাগী, বিশ্বজিৎ পাণ্ডা, অমিত ভট্টাচার্য এবং খোদ সম্পাদক জয়ন্ত দে’র মতো মানুষেরা যখন গল্পটির প্রসঙ্গে ফোন করে বাহবা জানিয়েছিলেন, মনে হয়েছিল- হ্যাঁ পেরেছি।

নীহারুল ইসলাম'এর ছোটগল্প
পুরনো অ্যালবাম
কুতুভাই মারা গেছেন।
দুঃসংবাদটা কিভাবে পেলাম যেন! আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার নানাবাড়ির পেছন দিকের সেই বাঁশবনটি, যেখানে ঢুকে কুতুভাই সময় অসময়ে তার কবেকার হারানো কাজলাদিদিকে খুঁজে বেড়াত।
কাজলাদিদিকে আমি চিনতাম না। তবে কুতুভাইকে চিনতাম। ভাল নাম কুতুবুদ্দিন সেখ। সে ছিল আমার শৈশবের সঙ্গী। আমিও তার সঙ্গে ওই বাঁশবনে তার কাজলাদিদিকে কতদিন খুঁজে বেড়িয়েছি।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল আব্বার সেই পুরনো অ্যালবামটিকে। অল্পস্বল্প হলেও যার ভেতরে আটকানো আছে আমার শৈশবকাল। আমার শৈশবকাল বলতে, নানাবাড়িতে আমি যাদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছিলাম। কুতুভাই ছিল তাদেরই একজন। যদিও এক মা ছাড়া কুতুভাইয়ের আর কেউ ছিল না। অন্তত আমি কখনও চোখে দেখিনি। কুতুভায়ের মা হাসবতী বেওয়া আমার নানাবাড়ির হাঁড়িহেসেল সামলাত। আর কুতুভাই ছিল আমার নানাবাড়ির রাখাল।
বেশি খুঁজতে হয় না, মায়ের বাক্সে সযত্নে রাখা ছিল সেই অ্যালবাম, খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। আজ কত বছর আব্বা নেই, সবকিছু ছেড়ে একদিন আচমকা কোথায় নিখোঁজ গেছেন। অথচ তাঁর অ্যালবামটি যেমনকার তেমনিই রাখা আছে।
মায়ের বাক্স থেকে বের করে অ্যালবামটি আমি হাতে নিয়েছি। এখনই এর পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করব। কুতুভায়ের ফোটো কোথায় আছে চটজলদি খুঁজে বের করব। ফেসবুকে সাঁটাব। স্ট্যাটাস লিখব। এখন আমার কত কাজ!
আজকাল আমরা নিজেদের সঙ্গে নিজেরাই এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় মেতে রয়েছি। ভাল হোক কিংবা খারাপ- কোনও একটি বিষয় পেলে বুঝে না বুঝে তা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করি। কে আগে পোস্ট দিতে পারি, প্রতিনিয়ত সেই চেষ্টা করে যাওয়াটাই যেন আমাদের প্রধান কাজ।
এছাড়া আর কী-ই বা করার আছে? এখন আমাদের হাতে সময় বড্ড কম। সেটা পুষিয়ে নিতেই হয়ত আমরা আমাদের সব সম্পর্কই ওই ফেসবুকে সীমাবদ্ধ রেখেছি। সেটা জন্মের শুভেচ্ছা জানানো হোক কিংবা মৃত্যুর শোক প্রকাশ- এমন কি কাফনদাফন পর্যন্ত আমরা ফেসবুকেই সম্পন্ন করি। এখন আমাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। সামনাসামনি দেখা হলেও কারও সঙ্গে কারও তেমন কথা বলা লাগে না। নিভৃতে বসে হাতের স্মার্ট ফোনের কী-বোর্ডে আঙুল টিপে ইশারা ইশারায় সব কথা অদ্ভূত ভাবে হয়ে যায়। এমন কি তালাক পর্যন্ত। সত্যিই এরকম এক আজব দুনিয়ায় আমরা আজ এসে দাঁড়িয়েছি।
এরকম আজব দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে তাহলে আর এমন খাঁ খাঁ দুপুরে এই আক্রার পেট্রোল পুড়িয়ে কষ্ট করে অতদূর নানাগ্রামে যাওয়া কেন? আমি যে কুতুভায়ের কত কাছের ছিলাম, প্রমাণ করতে ফেসবুকে তার ফোটো সহ যুৎসই একটা স্ট্যাটাস দিলেই কাফি। লোকে জেনে যাবে আমি কত দরদী মানুষ! আমি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, এমন কী- বাড়ির রাখালের কত খোঁজ রাখি!
অ্যালবামটি খুলতেই প্রথমেই দেখি আমার হাকিমনানাকে। আমার হাকিমনানা মানে ‘হাকিমসাহেব’। মানুষটা ইংরেজ আমলে জুরির হাকিম ছিলেন। তাই ওই নামেই তাঁকে সবাই চিনত, ওই নামেই ডাকত। এখনও আমি কোথাও কোথাও পরিচিত হই ‘হাকিমসাহেবের নাতি’ হিসেবেই। যদিও হাকিমনানার আসল নাম ছিল আব্দুল হাই মিঞা। সেটা অবশ্য আমি বহুদিন পরে জেনেছিলাম। যেদিন আইসক্রিম খাওয়ার জন্য পয়সা চুরি করতে গিয়ে মায়ের বাক্সে নানার পাসপোর্টখানা পেয়েছিলাম। সেই ষাটের দশকের পাশপোর্ট। সরকারি সিলমোহরের সঙ্গে ‘১৯৬৫’ সালের উল্লেখ ছিল। তার মানে আমার জন্মের ঠিক দু’বছর আগের। হাকিমনানা সেবছর হজে যান। তাও আবার পানি-জাহাজে চড়ে। আরব সাগর পেরিয়ে সেই পবিত্র মক্কা-মদিনায়।
মায়ের কাছে এইসব তথ্য জেনেছিলাম আমি। নানাকে জিগ্যেস করে আরও কিছু জানব, বিশেষ করে তাঁর পানি-জাহাজে চড়ার অভিজ্ঞতার কথা, সেটা আমার কিসমতে জোটেনি, কেননা ততদিনে আমি আমার জীবনের প্রথম মৃত্যু দেখে ফেলেছি।
হ্যাঁ, আমি আমার জীবনে প্রথম যে মৃত্যুটা দেখেছিলাম সেটা ছিল ওই হাকিমনানারই। আজও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। সেদিন খুব ভোর ভোর আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বাইরে থেকে আমার কানে ভেসে এসেছিল অদ্ভূত অথচ ভয়ঙ্কর মন কেমন করা গুণগুণ আওয়াজ! আমি হয়ত ভয় পেয়েছিলাম! না হলে বিছানায় যে আমার পাশে মা নেই তা বুঝব কী করে? অগত্যা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিলাম মায়ের খোঁজে। আর দেখেছিলাম নানাবাড়িতে প্রচুর মানুষের ভিড়। তাছাড়াও আর যা চোখে পড়েছিল তা হল, নানাবাড়ির আটচালার বারান্দার মেঝেতে খেজুরপাতার বিছাবুনি চাটায়ের ওপর বিছানো বিছানায় আমার হাকিমনানা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা। সাদা চাদরে ঢাকা তাঁর শরীর। শুধু মুখটা খোলা। সেই খোলা মুখে খুব জোরে জোরে শ্বাস নিতে চাইছেন তিনি, কিন্তু পারছেন না। তাঁর সূর্মা লাগা চোখ দু’টি পুরোপুরি বন্ধও নেই, আবার খোলাও নেই। দেখে মনে হচ্ছিল হাকিমনানার বুকের ওপর অদৃশ্য এমন কেউ একজন চড়ে বসে আছে, যে পারলে যেন তক্ষুণি দম বন্ধ করে হাকিমনানাকে মেরে ফেলবে!
দম বন্ধ করে মেরে ফেলার ব্যাপারটা আমার অনুভবে এসেছিল এই কারণে যে, তখন মাঝে মাঝে অমন অদৃশ্য কেউ আমার বুকের ওপরেও চড়ে বসত, আমাকেও দমবন্ধ করে মারতে চাইত। কিন্তু আমাকে মারতে পারত না। বিছানায় আমার পাশে আমার মা শুয়ে থাকতেন। আর মায়ের স্পর্শ আমার শরীরে এমন তাকত সৃষ্টি করত যে, আমি সেই অদৃশ্য কাউকে দু’হাতে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় লাফিয়ে উঠে বসতাম। সেই ‘অদৃশ্য কেউ’ আর কেউ নয়, আজরাইল ফেরেস্তা। এ কথা বলেছিল কুতুভাই। সঙ্গে এও বলেছিল যার মা নেই তার জান কবজ করে নিয়ে যায় ওই ফেরেস্তা। আর তার সেকথা মনে পড়তেই আমার খুব দুশ্চিন্তা হয়েছিল। কেননা, আমার মা থাকলেও হাকিমনানার মা ছিলেন না। তাহলে কি হাকিমনানা শেষপর্যন্ত মরেই যাবেন? কে জানে, সেই ভয়েই হয়ত হাকিমনানা নিজের সূর্মা লাগা চোখ না পারছেন পুরোপুরি খুলতে, না পারছেন নিশ্চিন্ত হয়ে বন্ধ রাখতে!
কোনও কিছু বুঝতে না পেরে আমার তখন খুব কান্না পাচ্ছিল। অথচ নানাবাড়ির কোথাও কান্নার কোনও ছিটেফোঁটা ছিল না। তবে সেই মন কেমন করা অদ্ভূত ভয়ংকর গুণগুণ আওয়াজ ছিল। আসলে শুয়ে থাকা হাকিমনানার পাশে বসে প্রতিবেশী মেয়েরা তখন খোদার উদ্দেশে কোরাণ পাঠ করছিল হাকিমনানার আরোগ্য চেয়ে। কিংবা তাঁর পরকালের জন্য দোয়া চেয়ে। তাদের মধ্যে আমার মা-ও ছিলেন।
মাকে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ আগে পাওয়া ভয়টা আমার মনে রীতিমতো তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা কী ঘটতে যাচ্ছে, সত্যিই আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আবার এটাও হতে পারে, তখন হয়ত আমি কিছুই বুঝতে চাইছিলাম না, মায়ের কোলে কিভাবে পৌঁছব শুধু সেকথাটাই ভাবছিলাম। তাই বুঝি কোনও রকমে ভিড় ঠেলে ঠেলে গিয়ে একসময় আমি মায়ের কোলে গিয়ে আছড়ে পড়েছিলাম। আর কাঁদতে কাঁদতে মাকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘মা- নানার কী হয়েছে গো?’ আমার প্রশ্নে মায়ের কোরাণপাঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনও উত্তর করতে পারেন নি, শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। যেখানে আমার হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠার কথা, সেখানে আমার মা কাঁদছেন!
সেদিন আমি অবাক হয়ে নিজের কান্না ভুলে মায়ের কান্না দেখেছিলাম।
না, এই বয়সে আমি আর মায়ের সেই কান্নামাখা মুখ স্মরণ করতে চাই না। বরং মায়ের সেই হাসিমাখা ফোটোখানা দেখতে চাই। এই অ্যালবামেই রয়েছে সেটা। আমি আবার অ্যালবামের পৃষ্ঠা ওল্টাই। এবারে পেয়ে যাই মায়ের সেই হাসিমাখা ফোটোখানা। যেখানে কিসের আনন্দে যেন মা খুব হাসছেন! আর তাঁর সেই হাসি দেখে নানাবাড়ির কাজের খালা হাসমতী বেওয়া বলছেন, ‘অত হাসিস না বহিন- বেশি হাসলে বিটিছেল্যার কপালে সুখ সহে না, দুখ নেমি আসে।’
যদিও সেই ফোটোতে হাসমতী খালার কোনও অস্তিত্ব নেই। তবে মা আছেন। আর আছে মায়ের হাসি। ওই ছোট বয়সে আমি জেনেছিলাম মায়ের ওই হাসি ছিল তাঁর নব যৌবনের হাসি! কুতুভায়ের মুখেই শুনেছিলাম, আমার আব্বা তুলেছিলেন এই ফোটো তাঁর ‘আগফা ক্লিক থ্রি’ ক্যামেরায়। সেই ষাটের দশকের প্রথম দিকে, যখন তিনি কলেজ পাশ দিয়ে বেকার অবস্থায় মায়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছেন।
আচ্ছা, অ্যালবাম খুলে আমি এত ‘মা’ ‘মা’ করছি কেন? এখন মাকে দেখতে তো আর আমি অ্যালবাম খুলে বসিনি, আমি অ্যালবাম খুলে বসেছি আমার শৈশবের বন্ধু কুতুভাইকে খুঁজতে। কিছুক্ষণ আগে যার মৃত্যু হয়েছে।
আমি আবার অ্যালবামের পৃষ্টা ওল্টাই। আর এবারে দেখতে পাই আমাদের শৈশবের সেই ফোটোখানা, যেখানে দ্বিতীয় সারিতে বাম দিক থেকে প্রথমেই দাঁড়িয়ে আছে আমার মামাতো ভাই ইমরান, তার পাশে মামাতো বোন ছোট্ট মাসুদা, তার পাশে আমি নিজে একা দাঁড়িয়ে। আর আমাদের পেছনে ছোটমামা। তাহলে কুতুভাই কই? যতদূর মনে পড়ছে এই ফোটোতেই তো সে ছিল! খালি গায়ে, কোমরে গামছা কষে ঠিক আমার পাশে তার দাঁড়িয়ে থাকার কথা!
আমি ভাল করে ফোটোখানাকে আবার দেখি। এমনকি গোটা অ্যালবামে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজি।
কিন্তু না, কুতুভাই কোথাও নেই। ছোটমামার পেছনে শুধু একটা গরুর গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আর একেবারে পেছনে অন্ধকার সেই বাঁশবন। যেখান থেকে শুধু আমার নানার পরিবারের কেউ মারা গেলে তার দাফনের জন্য বাঁশ কাটা হতো। হাকিমনানার দাফনের জন্যেও বাঁশ কাটা হয়েছিল ওই বাঁশবন থেকেই। কেটেছিল নানাবাড়ির কাজের মানুষ তোতামামা আর কাসিমনানা। পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে এঁদের সবাইকে খুঁজে পাই। তাহলে কুতুভাই কোথায় গেল? ছেলেবেলায় সে যেমন তার কাজলাদিদিকে খুঁজে বেড়াত ওই বাঁশবনে, আজকেও কি তাহলে সে এই অ্যালবাম থেকে বেরিয়ে তার কাজলাদিদিকে খুঁজতে ওই বাঁশবনে গিয়ে ঢুকেছে?
আমার কেমন সন্দেহ হয়। ছেলেবেলায় কতবার তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে শেষপর্যন্ত ওই বাঁশবনেই পেয়েছি। আর তার মুখে শুনেছি তার সেই আকুতি ভরা গান –
‘ বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই? ’
কী জানি আমার শুধু সন্দেহ হয় না, রীতিমতো বিশ্বাস জন্মায় এই অ্যালবাম থেকে বেরিয়ে কুতুভাই তাহলে সত্যিই তার কাজলাদিদিকে খুঁজতে গিয়ে ঢুকেছে ওই বাঁশবনে।
বাঁশবনটাকে আমার খুব স্মরণ হয়। বাশবনটা যেন আমাকে ডাকে। আমি আর দেরি করি না, মোটরবাইক চড়ে বেরিয়ে পড়ি।
দুই
আমার চোখের সামনে ভাসছে যেন পঞ্চাশ বছর আগেকার একটা অলীক সময়। যে সময়ে আমি জন্মেছিলাম। তারপর একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলাম। শৈশব কেটেছিল যাদের সঙ্গে তারাও ছিল সব এক একজন সুন্দর মানুষ। তারা কে বেঁচে আছে কে বেঁচে নেই কিছুই জানি না। কতদিন যাই না নানাবাড়ি, নানার গ্রামে। যাবোই বা কী করে? নানার পরিবারের কেউ তো আর থাকে না সেখানে!
এইসব ভাবতে ভাবতে আমি কখন কিভাবে গঙ্গা পেরিয়ে পৌঁছে যাই নানার গ্রামে, একেবারে কুতুভাইদের বাড়ির দরজায়, টের পাই না। যখন টের পাই, অবাক না হয়ে পারি না। এ কী! মৃত্যুবাড়ির দরজায় মানুষের ভিড় কই? শোকই বা কোথায়?
মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে আমি এদিক ওদিক তাকাই। কোথাও কাউকে দেখতে পাই না। এমন কি বাড়ির ভেতর থেকেও সেই অদ্ভূত অথচ ভয়ঙ্কর মন কেমন করা গুণগুণ আওয়াজ তো দূর, অন্য কোনও আওয়াজও ভেসে আসে না। তাহলে কি কুতুভায়ের মৃত্যু সংবাদটা নিছকই রটনা?
নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়। নিশ্চয় ভুল খবর পেয়ে এসে হাজির হয়েছি। ফিরে চলে আসব কি না ভাবছি। হঠাৎ দেখি এক ত্থুরত্থুরে বুড়োকে কুতুভায়ের বাড়ির দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে।
আমার মনে পড়ে যায় কাসিমনানাকে। কিন্তু কাসিমনানা এতদিন বেঁচে থাকবেন কী করে? একজন মানুষের কি এত বছর বেঁচে থাকা সম্ভব?
আমি কিছু বলব, তার আগেই লোকটি বলে উঠলেন, কে ভাই আপনি? কতি থেকি আসিছেন?
আমি আমার পরিচয় দিলাম। লোকটি তা শুনে প্রায় ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, এ জনমে জি আর দেখা হবে ভাবিনি খো মামু। একেই বুঝি বোলে তকদীরের খেল!
মামু সম্বোধন করছে! তাহলে কি আমার তোতামামা!
এমন ভাবনা থেকেই আমি বলে উঠলাম, কে- তোতামামা?
- হ’ মামু। চিনতে পারোনি? কী করে চিনবা? সেই কুন ছোটবেলায় দেখ্যাছো! তা দূয়ারে দাঁড়িন কেনি, ভিতরে এসো।
তোতামামা আমাকে জড়িয়ে কুতুভায়ের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।
আমি দেখলাম, বাড়ির আঙিনায় লাশবাহী খাটে কুতুভাই শুয়ে আছে। তার সারা শরীর সাদা কাফনে মোড়া। সাধারণের শেষ দেখা দেখবার জন্য শুধু মুখটা খোলা। অথচ তাকে শেষবারের মতো দেখার কোনও লোক নেই। শুধু তার লাশবাহী খাট ছুঁয়ে বসে আছেন এক মহিলা। নিস্পলক দৃষ্টি তাঁর।
কিন্তু কে এই মহিলা? কুতুভায়ের সেই কাজলাদিদি! যাকে কুতুভাই খুঁজে বেড়াত বাঁশবনে!

লেখক পরিচিতি
নীহারুল ইসলাম
‘সাগরভিলা’ , লালগোলা।। মুর্শিদাবাদ।। ৭৪২১৪৮।। পশ্চিমবঙ্গ।। ভারতবর্ষ।।
নীহারুল ইসলাম
‘সাগরভিলা’ , লালগোলা।। মুর্শিদাবাদ।। ৭৪২১৪৮।। পশ্চিমবঙ্গ।। ভারতবর্ষ।।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (কলা)।
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
১। পঞ্চব্যাধের শিকার পর্ব (গল্প) ১৯৯৬, দিবারাত্রির কাব্য প্রকাশনী-চম্পাহাটি;
২। জেনা (গল্প) ২০০০, প্রচ্ছায়া-বারাসাত ;
৩। আগুনদৃষ্টি ও কালোবিড়াল (গল্প) ২০০৪, আকাশ-বহরমপুর;
৪। ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা (গল্প) ২০০৮, দীপ-কলকাতা ;
৫। মজনু হবার রূপকথা (দু’টি নভেলার সংকলন) ২০১২, খোঁজ-লালগোলা ;
৬। জনম দৌড় (উপন্যাস) ২০১২, করুণা-কলকাতা;
৭। ঘাট আঘাটের বৃত্তান্ত (গল্প) ২০১৪, অভিযান-কলকাতা;
৮। বাবরনামা (গল্প) ২০১৪; আকাশ-বহরমপুর;
৯। ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা (গল্প) পুনর্মুদ্রণ ২০১৬, সৃষ্টিসুখ-কলকাতা।
১০। নস্রুদ্দিন খোজার কিস্সা ২০১৮, সৃষ্টিসুখ-কলকাতা।
১১। পিরনানার জ্বিন, আবিষ্কার প্রকাশনী-কলকাতা, ২০১৮।
১২। ‘ইঁদুর, ইঁদুরের গর্ত, ধান এবং লখিরাম’ – (২০১৮) সপ্তম গল্পসংকলন,‘আলকাপ’, বহরমপুর। ১৩। ‘জমিন আসমান’ – (২০১৮) অষ্টম গল্পসংকলন, ‘নিউ ভারত সাহিত্য কুটির’, কলকাতা।
১৪। ‘ইচ্ছাপুতুল’ – (২০১৮) তৃতীয় উপন্যাস, ‘সৃষ্টিসুখ’, কলকাতা।
২০০০ থেকে ‘খোঁজ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনা।
প্রাপ্তি- সাহিত্য আকাদেমি’র ট্রাভেল গ্রান্ট পেয়ে জুনিয়র লেখক হিসাবে কেরালা ভ্রমণ ২০০৪, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক ‘ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার ২০১০’, ‘ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত ‘সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কার ২০১০’, ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান ‘উত্তর বাংলা পদক ২০১১’, কলকাতা লিট্ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র প্রদত্ত ‘শ্রীমতী লিপি সরকার নিবেদিত ছোটগল্পকার সম্মাননা ২০১৩’, ‘গল্পমেলা পুরস্কার ২০১৫’, ‘মল্লার সম্মান ২০১৮।
২০০০ থেকে ‘খোঁজ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনা।
প্রাপ্তি- সাহিত্য আকাদেমি’র ট্রাভেল গ্রান্ট পেয়ে জুনিয়র লেখক হিসাবে কেরালা ভ্রমণ ২০০৪, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক ‘ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার ২০১০’, ‘ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত ‘সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কার ২০১০’, ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান ‘উত্তর বাংলা পদক ২০১১’, কলকাতা লিট্ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র প্রদত্ত ‘শ্রীমতী লিপি সরকার নিবেদিত ছোটগল্পকার সম্মাননা ২০১৩’, ‘গল্পমেলা পুরস্কার ২০১৫’, ‘মল্লার সম্মান ২০১৮।
0 মন্তব্যসমূহ