নাদের আলির কেবল এই।
বেগুন আনতে দেবো তো সবচে বড়টা। ঝিঙে, তো আধবুড়ো বিচিওলা সবচে হাম্বা সাইজের। মুর্গী পর্যন্ত দাম্বা ঠ্যাংওলা ঘেসো গদ্গদানি মিন্সে মাংস। গত বার কাঁচা আমের টক খেতে ইচ্ছে গেলো, তো বল্লাম- নাদের আলি, যা খান কয় কচি কচি আন। পাঁচফোড়ন দিয়ে সাঁতলে লঙ্কা ঠেসে খাই। হা-বজ্জাত আধবুড়োটা আনল কি জানেন? ইয়া গাদ্ধার ফজলি সাইজের আধা পাকা দুইখান আম। গাটাই যা সব্জে। ভেতরে ভ্যাজভ্যাজে, হাফ্সি, নিমিষ্টে। না আছে মিষ্টি, না আছে স্বাদ।
তেলেবেগুনে হয়ে পাটকেল আনতে গেছি- হুড়মুড় করে পায়ে পড়ে বলে- 'আপনারই ভালা কল্লাম- একই দামে আরও হাফ পাউণ্ড বেশী'। পাউন্ড দেখাস শালা ! হাড়বজ্জাত ! সায়েবের চাকরী করস্? সায়েবের ঘরে চাকরী করেছিল কদিন নাদের। পুরো সাহেব। দার্জিলিং এর ইংরেজ সাহেব। তার মেম মারা যেতে সাহেব ফিরে যায় ওয়েল্স এর এক ছোট গাঁয়ে। সেখানে তার মা শুয়ে আছেন। তার পাশেই দেশের মাটিতে এক টুকরো জমিতে সে দাফন হবে, এই তার শেষ খোয়াইশ। তো এই দস্তুর সে ইংরেজী কয় খাসা। শালাকে তাই পুষিনা এমনি এমনি। তবে এ রোগের কি বালাই নেই গো। সারা জীবন জ্বালিয়ে মাল্লে। আমি গজ-গজানি করছি এই সুযোগে নাদের আলী বুঝলে যে ঠাণ্ডা মারছি, ভিজে জল হব এই, সেইপানা তালে শালা পাটকেলটা কুড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা লাগালে। মিহি সুরে পাল্টা গজ-গজানি দেবে এইবার। বলবে- ভালার কাল কোন-কালে ছিল তা কে জানে। তারপর মুড়মুড়ে চিঁড়ে আর শাদা ধবধবে কুড়মুড়ে আলু-ভাজা দেবে। সঙ্গে কাঁসার গ্লাসে দুধ-চা। এই গ্লাস, মা মরার কালে নাদের কে ধরিয়ে দিয়ে গেস্ল। বলেছিল- নাদের, রুপোর তো আর কাল রইলনা। সবই গেছে। এই কাঁসার গেলাস গুলো যত্নে রাখবি। দেখবি সারা দিনে যেন 'জল থেকে চা'টা এই সোনামাখা গেলাসে বুড়ো আমার খায়। এতে পিত্তি পড়েনা। চা খেলে চায়ের বিষ ঢিমে হয়ে যায়। নাদের মাথায় ঠেকিয়ে গেলাস সেই যে রান্নাঘরে নামিয়ে আনল, সেই চলছে। মা গেছে এগার বছর সাড়ে তিন মাস, আর বংশের শেষ জেনানা ভীমপিসি গেলো এই সাড়ে পাঁচ বছর হোল। বছরে একবার গঙ্গাসাগর যেতে পিসি এসে উঠত এখেনে, তবে নাদেরের রান্নাঘরে পা মাড়াতোনা। কিন্তু খাবারঘর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে খুঁটিনাটি সব দেখে রাখত। সঙ্গে আনত বিন্তে'কে। সে বিন্তেই চিলেকোঠার ঘরে পিসির জলতোলা, ভাত ফুটোনো সব করত। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় আমার মা কেন এই ম্লেচ্ছ হারামজাদাকে আমদানী করেছিল তা নিয়ে পানভরা গালে গাল দিতে দিতে বেরিয়ে যেত। তবে পিসি ছিল নারকেল ফল। লোকের দুখ-মাখা মুখ দেখলে ফটাস্ করে নারকেল ফেটে জল-শাঁস সব বেরিয়ে পড়ত। যাবার সময় বিন্তে'র হাতে টাকা কটা ছুঁড়ে দিয়ে ঝনন ঝনন পানের বাটা গুছোতে গুছোতে বলত- 'যা মিন্সেকে বল লুঙ্গী-গামছা কিনে পরতে। একেবারে গেছে। আমাদের বুড়োর কি আর সময় আছে, যে, চোখ দিয়ে দেখে। মুরুব্বী মানুষ, তার ঘরে কাজ করছিস আর ভালো লুঙ্গী কিনতে পারিস না মড়া। এইদিকে ফোন তুলে ইঞ্জিরি বলে দেখো পোঁদ ফাটিয়ে দিচ্ছে'। বলে- থুঃ। লাল লাল খয়ের মাখা থুথু পিন্কি দিয়ে ছড়িয়ে যেত খরখরে ছাদের সবুজ ছ্যাতাপরা কলের পারে। পিক্ ফেলতেন, না, তা নাদের আলীর উদ্দ্যেশে, বিন্তে তা বুঝতে না পেরে হাবা মেরে খানিক দাঁড়িয়ে তবেই টাকা ক'টা নিয়ে গুঁড়িগুঁড়ি এগুতো।
নাদের আলীকে আমিও কম চোখে চোখে রাখিনা। আজকাল বিদেশী প্রকাশকের আমদানী হয়েছে। মা এসব দেখে যেতে পারলনা । তবে খান দশেক পুরস্কার মায়ের কালেই পাওয়া হয়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল ধূর্জটি চন্দ্র পাব। মা যেদিন যায়, সেদিন খবর এলো ধূর্জটি দিয়েছে। নাদেরই সব সামলে ছিল একা হাতে। ফোন ধরা, কমিটির কাছে চিঠি দেয়া। পাল্টা চিঠি লেখা। সবই ইংরেজিতে। খাঁটি সায়েবী। অমন গালভরা শব্দের থান থান ইংরেজী আমার তিনকুলে কেউ কোনোদিন লেখেনি।
নাদেরকে কতবার বলেছি- নাদের আমার কাছে আর কটা টাকা পাও? বল যদি কোন চেনা আপিসে তোমার জন্যে একটা পার্টটাইম দেখি। ইংরেজিতে চিঠিচাপাটি লেখাতে চায় এরকম অনেক লোক জানা আছে। দু'পয়সা আসবে, সে টাকা দিয়ে ভবিষ্যতে সঞ্চয় কি সামান্য দু'এক ছিটে জমিজায়গাও করে রাখতে পারবে। দেশে জমি থাকলে একটা ঘর তুলেও থেকে যেতে পারবে। বলতো খাওয়ার দোকানও একটা দিই। রান্নার এতো শখ তোমার। তা সে বোকার মরণ এসব কিছুই সে কোন দিনও করবে না। তার নাকি আরাম- গুনে গুনে গোটা ধনে, জিরে, মোগলাই মশল্লা বিছোতে- নরম তুলতুল মাংস-খন্ডের ওপরে। মুখখান সে আগুনের কাছে নিয়ে মাংসের দুই পিঠ আদর করে উলটে উলটে সেঁক খাওয়াবে আর সুঘ্রাণে তার দুই চোখ মুদে আসবে। কয়লার উনুনের পাক খাওয়া ধোঁয়া ধরে ধরে সে সরু সরু মুদে আসা চোখে এমন ত্যারচা করে ঈশান পানে দেখবে, যেন প্রাচীন নবী। যেন খোদ পয়গম্বরকে প্রত্যক্ষ করছে- 'লা এলাহা এল্লাল্লাহ্, মোহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ্'। আবার এইভাবে কাবাবের শিক ধরা বাঁ হাত কখনো মাথা থেকে অল্প ওপরে উঠে থাকবে, থুতনিটা এমন করে এগিয়ে থাকবে যেন ডি মেজরে বাখ্ এর চতুর্থ সিম্ফনি বাজাবার হুকুম দিচ্ছে।
বাবা মারা যাবার পর আমার আর ইংরেজি ইশকুলে যাওয়া হলনা। দু'বছর দার্জিলিং এ ছিলাম। ক্লাস থ্রী অবধি। তখনই এইসব গানবাজনা, অ্যাংলো, ইংরেজী কচকচির যা একটু আধটু আভাস-আলো পেয়েছিলুম। বাবা মারা গেলো। আমারও শুরু না হতেই শেষ। মা বল্ল- 'বাবা গেলো, ছেলেকে আর ছেড়ে থাকবনা'। ইংরেজী ইস্কুলের সেই ইতি। শুধু পাহাড়ের ধোঁয়া মাখা কুয়াশার স্মৃতি হয়ে জেগে রইল, আধঘুমে শোনা টিচার্স কোয়ার্টার্স থেকে ভেসে আসা মোহাচ্ছন্ন বাখ, মোটসার্ট। বহুদূর বাদামী বেদনা ভরা, গ্যাসলাইটের আলোয় পাথুরে দেওয়ালে নরম মসের গায়ে না দেখা ইয়োরোপের পুরানো শহরের ফুটপাথের স্মৃতি। আমি ভর্তি হলাম বাড়ির পাশের বাংলা ইশকুলে। সেখানে নতুন করে একে চন্দ্র আর 'কুমোরপাড়ার..' শিখতে থাকলুম।
এতো বড় বাড়িতে মা আর দিনরাতের ভাত-কাপড়ের সুধামাসি। আর, আমি মানুষ হচ্ছি। ইশকুল যাচ্ছি। টায়েটুয়ে বা মোটামুটি পাশ করছি। খুলনার প্রাক্তন জমিদারী, জমিজিরেত সময়মত বেচে চলে আসতে পেরেছিলেন বাবা। সেই টাকা সব ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা ছিল। একটা ওষুধের কারবারও চালাচ্ছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর মা সেই কারবার বেচেও টাকা গচ্ছিত রাখলেন। বাড়ির সামনের দিকটা ভাড়া দিলেন সরকারী ব্যাঙ্ককে। তখন ব্যাঙ্ক সবে রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছে। টাকা খুবই কম। শশীকাকা মাকে সুবুদ্ধি দিয়েছিলেন- 'এই বেলা দিয়ে দ্যাও। সরকারী আপিস। পাকা বন্দোবস্ত। দিনে দিনে টাকা বাড়বে। বাড়ির সারাই সুরাইও ব্যাঙ্ক করে নেবে'। পরে, এমনকি সারাই করতে হলে তার জন্যে নাকি ধারও মিলতে পারে। মা সেই ব্যবস্থাই করলেন। সেই টাকায় এখনও আমার মাস-খরচ দিব্যি চলে। টাকা বেড়ে এখন হয়েছে ঠিক এগারো গুন। মাঝে বাবার এক বন্ধুর ব্যবস্থপনায় এক ধাক্কায় ভাড়া বাড়িয়ে বাজারদরের কাছাকাছি করা হয়েছিলো। তারপর থেকে বাড়াতে আর কষ্ট হয়নি কখনও।
নাদেরের সাথে আমার আলাপও হল সেই দার্জিলিং-এই । আমি দার্জিলিং ছাড়ার পর আর একবারই মাত্র ফেরত গেছিলাম, বছর বাইশ বাদ। সে তখন সুখা শুয়োরের চর্বির ব্যবসা করছে। আর রাতে হলুদ নিভন্ত আলোজ্বলা গুমটি দোকানে রোটি-সব্জি। এড্উইন বলেছিল- ঘুপচি দেখতে হলেও এ মোটে হেলা ফেলা করার দোকান নয়। সামান্য স্কোয়াশের সবজির যা সোয়াদ। আর যদি তার মেজাজ খুশ থাকে, তবে তো শাহীই-শাহী।বেলাগম খুশবুদার বোলবালা। চাই কি, সেদিন সে বানিয়ে ফেলবে- কুরমা, বোটি কাবাব, পেশোয়ারী নান। তবে সবই কিস্মত। যদি আপনার ভাগ্যে থাকে। যদি সেদিন তার মেজাজ খুশ থাকে। এই 'সে'- টিই হল নাদের আলী।এক ইংরেজ সায়েবের খানসামা ছিল। সায়েব যাওয়ার সময় বেশ খানিকটা টাকা দিয়ে গেছিল। তা দিয়ে ব্যবসা করে লোকসান হয়ে সব খুইয়েছে। তাও যা ছিল তার বেশ অনেকটা চিটফান্ডে গেছে। এনিয়ে তার ক্ষোভ মাত্র নেই। তার কথা হল- 'ও বড়লোক হওয়া আমার ধাতে নেই'। সামান্য কিছু যা পরে ছিল তা দিয়ে কবরের জমি কিনেছে। তারা মুর্শিদাবাদের লোক। মরলে মড়া কে নিয়ে যাবে এইসব সাত পাঁচ ভেবে গ্রামের জমিতেই ঠাই কিনেছে।
'যাক মরাটা নিশ্চিন্তি। এবার বাঁচার কথাটা পাকা করতে হবে'। বলে সে ঝুলে পড়ল আমার সাথে। এ ক'দিনে কি এক অজানা গেরোয় আমাকে তার বিস্তর মনে ধরেছে। বল্লাম- 'তুমি ইংরিজি জানো, অফিস-টফিসে পিওন বা ফোন ধরার কাজ পাবে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের চেয়েও তুমি এগিয়ে। পশ্চিম বাংলায় গত দশ বছরে বাংলা মিডিয়ামে ছেলে মেয়েরা ছেলেভুলোনো ইংলিশ পড়ে পাশ করেছে। তুমি খাঁটি ইংরেজি জানা লোক, চিঠি কি, দিস্তে দিস্তে কব্তে অব্ধি লিখে ফেলতে পারো। অনেক প্রাইভেট জায়গায় কাজ পাবে তুমি। নাদের আলীর ডাকনাম গোঁয়ার আলী। এডউইনই কথায় কথায় বলেছিল। তাকে নাকি অনেক নামকরা হোটেল-রেস্টুরেন্ট-নিতে চে'ছিল। সে নাকি এককথায় ফিরিয়ে দিয়েছে। আমার কথা শুনে নাদীর আলী খ্যাঁক ক্যাঁক করে হাসে।তার জর্দার ছোপ পড়া পীতাভ দাঁতগুলি প্রাচীন গুহার মত দরজাবিহীন বেরিয়ে থাকে। বলে- 'আমার আবার আপিসের কাজ কি কত্তা, আমি তো ইশকুলেই যাইনি কখনও'। 'তাতে কি?'- আমি বলি। 'সরকারী আপিস তো আর না। আমি তো সব প্রকাশকদেরই চিনি, তাদের অনেকেই কাজ দিতে পারে তোমায়। বলত, কথা বলে দেখি'।
আসলে নাদের আমার চেয়ে ভালো ইংরিজি লেখে। সে কথা তাকে আমি একদম জানতে দিইনি। বলেছি বাংলা আমার মা, মাতৃভাষার সাধনাই আমার সব। নাদেরও কখনো বুঝতে পারেনি। সন্দেহ করেনি। একবার তাকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নেব ভেবেছিলাম। শুরুও করেছিলাম। এখন ইংরেজিতে অনুবাদ হচ্ছে সব। তার নাকি ছক আলাদা। খাজা খাজা উপন্যাস ও অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। আমি এতোগুলো পুরস্কার পেয়ে বসে আছি। অন্য ভাষায় আমার অনুবাদ হয়েছে। সরকারী পুরস্কার দিয়েছে, কিন্তু ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি। নাদের যে সাহেবী ইঞ্জিরি জানে, তা একবার এক কাছের প্রকাশক কি করে জানি টের পেয়ে যায়। সে তো সস্তায় অনুবাদ হয়ে যাবে ভেবে আটখানা।সক্কাল সক্কাল এক ধামা হিমসাগর আর আর দু’বয়াম সিউরির খাস মোরব্বা নিয়ে হাজির। আর নাদেরের জন্যে বেনারসি জর্দা। আহা কি তার বাস, কি খুশবু। খুলতেই গোটা বাড়ি ম ম করে উঠল। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে বলেই ফেল্ল।সে তার প্রকাশনার কিছু বই অনুবাদ করিয়ে নিতে চায়। অন্যদের বই অনুবাদ হবে ভেবে আমারটা ভেতরটা উশখুশ করলেও মুখের ওপর না করতে পারিনা। তার ওপর নাদের এর ভবিষ্যৎও ভালো হতে পারে। আমি যদি মরে-টরে যাই, তবে এইসব কাজ করে চালিয়ে নিতে পারবে। তবে আমি বেঁচে থাকতে সে আমার কাজ কিছুতেই ছাড়বেনা। যত বলি- আমার বয়েস হচ্ছে। আমাদের বংশে অল্প আয়ু। মাঝে মাঝে এখনই নানান ব্যামোর আভাস পাই। তা, নাদেরের তাতে হেলদোল নেই। তার শুধু একটিই দাবী- আমার আগে সে মরলে আমি যেন তার শরীরটা মুর্শিদাবাদে তার জমিতে দাফনের ব্যবস্থা করি । বলাই বাহুল্য, প্রকাশক নাদেরকে বলে সুবিধে করতে পারেনি। আমার খাওয়া-দাওয়ার বিঘ্ন হবে এই অজুহাতে সে ভাগিয়েই দিচ্ছিল প্রায়। আমিই প্রস্তাব দিলুম, বেশতো, খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে পর তো অন্তত ঘণ্টা খানেক বসে লিখতে পারো। তোমায়তো কোথাও যেতে হবেনা। বাড়ি বসে বই উলটে লিখে যাবে। উপরি দুটো পয়সাও আসবে। তা গাঁইগুই করে নিমরাজি হল যদিবা, এদিকে হলকি, নাদের কিছুতেই দু'পাতার বেশী পাতা উল্টোতে পারেনা। বই দেখলেই তার নাকি ঘুম পায়। আর সে কি ঢুলুনি ভরা ফুরফুরে ঘুমরে বাবা। পাখার হাওয়ায় বইয়ের পাতা, পাণ্ডুলিপি উড়ছে, আর কলম ধরা তার হাত চামর এর মত সেই খোলা পাণ্ডুলিপির ব্যজন করছে। এহল শুরুর দিক। তারপর মাথা তার এলে পড়বে ডানপাশে। বেশীরভাগই ডানদিকে কাৎ করে। আর তারপরই শুরু হয়ে যাবে ঝিমুনি। ফুরফুর করে ডাকবে নাক। আর হা করে থাকা ঠোঁটের ফাঁক থেকে ভুরভুর করে বেরোবে মিহি জর্দার বেনারসি খুশবু। সেই আমেজে আমারও চলে আসে ঘুম। ঘুমঘোরে হাল্কা স্বপ্ন দেখি। মিঠে বেনারসি জর্দার আবেশ নিয়ে আমি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছি মনিকর্নিকার ঘাটে। তার আশেপাশে। সন্ধ্যের মায়াবী আলোয় মাঝ গঙ্গায় বজরার ওপর বসে আছি। দুর থেকে গগণ ঠাকুরের তেলরঙের মত হেমন্ত-হলুদ ঘাট।সন্ধ্যারতির আগুনে টুপটুপ, ঝিলমিল করছে। জলে ভেসে চলেছে ডোঙ্গা, তাতে মাটির প্রদীপ, লাল-শাদা ফুল। ঘাটে কারা অপেক্ষা করছেন ডোঙ্গা ভাসিয়ে, কার আয়ু কতদূর যায়। তাকিয়ে আছে চোখগুলি কোটর থেকে নির্নিমেষ। ভাঙ্গা পুরনো ঘাটের কাছে ভেড়ে নৌকা। গোলানো মর্মর-হলুদ ভাঙ্গা বাড়ির গায় আজানু লম্বা কোট পড়া এক মানুষ। বিলিতি পায়জামা পায়। গভীর উজ্জ্বল দীপ্তিময় চোখদুটি তাকিয়ে ঠায়। খেড়োর মত খাতা বগলে। হাতে শর। চালচিত্রের মত আন্ধার হল। লাল ডুবোডুবো সূর্য জলের ওপর। এখুনি দেবে ঝাঁপ , কালো হবে প্রসারিত জল। কবি লিখছেন এক একটি ঝিম অক্ষরে- কানে আসে জলদ স্বর- বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে। পলকা শব্দে চটকা ভাঙ্গে। কাঁসার গেলাসে জলটি টলটল করে ওঠে। এইভাবে কেটে যায়। সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা। মাঝরাত। নাদের ঝিমিয়ে যায় আর আমি পড়ে পড়ে আধাঘুমে স্বপ্ন ভাবি। শেষমেশ প্রকাশক ঘুরে ঘুরে হাল ছেড়ে দ্যায়। বাড়ি আসাও বন্ধ করলেন তারপর। আমার বইও ছাপেননি অনেকদিন । ভেবেছেন ভাংচি দেওয়ার হাত সম্পুর্ন আমার। প্রকাশক গেলেও, মনে মনে খুশী হই। অন্যদের বইগুলো সস্তায় অনুবাদ হওয়াটা কিছুটা আটকাল। কিন্তু হলে হবেকি। তারপর ওই একই কারণে নাদের আমারও অনুবাদ করতে পারেনা। সেই এক। বই-খাতা নিয়ে বসলেই ঘুমিয়ে পরে। আর চোখের সামনে নাকি কালোকালো, গুঁড়িগুঁড়ি দেখে। দু'পাতার বেশী একটানা লিখতে পারেনা। আর সে লেখা যদি 'গল্প' হয়, তবে তার মাথা একদম গুলিয়ে যায়। এদিকে আমার নিজের লেখাও অনুবাদ হচ্ছেনা দেখে সে প্রকাশক ফের কদিন আমার বাড়ি আনাগোনা শুরু করলেন। তারপর নিজে প্রত্যক্ষ করে প্রত্যয় হয় তার। আর অনুবাদের দুরাশাও সমূলে নিকেশ হয়। দুপক্ষেরই।
কারণ আমিও সে লোভ ত্যাগ করলাম শেষমেশ। ভাবলুম- এই বেশ ভালো আছি। বেশী লোভে কাজ নেই। সায়েবী ইংরেজি জানলেই হয়না। বড় কোন কাজ, লেগে থাকা এসবের মানসিকতাই নেই তার। থাকলে নিজেই নিজের খুদ্দারি করত। আমার মত মধ্যকাব্যির মনিব বেছে নিতনা। তার থেকে যা পাই তাই কিছু কম না। চিঠিটা, দরখাস্তটা এই সব তো সে খাঁটি ইংরেজিতে লিখেই দ্যায়। আমাকে কোনই হ্যাপা পোয়াতে হয়না। আর ইংরেজি- কি বলব, যেন কালো গরুর দুধ, যেমন মিষ্টি তেমনই বাহারে শব্দ। আমার ছোটতে মা কালো গরুর দুধ খাওয়াতেন। তখনো উত্তর কলকাতায় খাটাল ছিল। এক কালো গরু বাঁধাধরা ছিল তার। ঘোষেদের ছেলে দুধে খড়-পাতা ভিজিয়ে সাইকেলের পিছনে বেধে দুধ দিতে আসত। আর অ্যালুমিনিয়ামের ছোট এক ক্যানে আমার জন্যে কালো গরুর দুধ। একবার পেটের ব্যামো হওয়ায় ভীম-পিসি ছাগলের দুধ খেতে বলে গেসল। সেও মা খাইয়েছিল পাঁচ মাস।
তারপর যখন স্বাস্থ্য ফিরল তখন ওজন হয়ে দাঁড়াল- চার কুড়ি আশি- আশি কেজি।
*****************
আজ নাদেরের কথা বড় বেশী করে মনে আসছে। তাইই হবার। রুস্তমের চিঠি এসেছে সকাল সকাল। আসারই কথা ছিল। নাদের বেঁচে থাকতে জানতাম- সে আমার জীবনের অবিচ্ছিন্ন হিস্যা। মায়ের মতই সেও আমার সারাজীবনের গায়ের খোসা হয়ে থাকবে। মরলেও ভুলতে পারবনা। অনুবাদ হয়ে বই বেরিয়েছে শুনলে সেই সবচে খুশী হত।
আজ সকালে উঠেই সব পুরনো কথা মনে পড়ছে। রুস্তম মেইল করেছে কাল- লিখেছে যে চিঠি পাঠিয়েছে।আমার তবে পেয়ে যাওয়ার কথা। আনন্দের জৌলুসে কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আজ সকালে হতেই উঠে আগে মেইল বাক্স খুল্লাম। হ্যাঁ এসেছে। একটা গোব্দা চিঠি। খুলতেই ভেতরে রুস্তমের হাতে লেখা তুলোট মত মোটকা কাগজে চিঠি, আর তার ভেতরে আরেক খাম। মখমলী লাল রঙের। খামের ওপরে সোনালী ছাপে লেখা- ফ্রম- ভ্যু। কোন বানান-টানান ভুল নেই তো। একি যন্তর নাম রে বাবা। এরাই পুরস্কার দিয়েছে? পুরস্কারই যখন, নামটাতো ঠিকমত হওয়া দরকার। না- কিনা পুটকে, এক অক্ষর- ভ্যু।
হয়েছিল কি- নাদেরের এক খান ঘুম-ঘোরে করা এক-আধখান অনুবাদ থেকে গিয়েছিল। আমার ডেস্কেই। আর গেলবার শীতে আমার দুরসম্পর্কের ভাগ্নে রুস্তম এসেছিলো তার স্প্যানিশ বান্ধবীকে নিয়ে। তারা বরাবরই এলাহাবাদের লোক। তাদের সাথে আগে মেলামেশাও বিশেষ ছিলনা তেমন। ইদানীং আমি পুরস্কার-টুরস্কার পাওয়ায়, আমার নাম হয়েছে ভেবে অনেক আত্মীয়ই গায়ে পড়ে ফোন দ্যায়। দেখা-টেখাও করে যায়। তা রুস্তম এলো তার স্প্যানিশ বন্ধুনীকে নিয়ে। কলকাতা নিয়ে তার কি লেখালেখির কাজ। আমি লেখক, সেই ভেবে রুস্তম তাকে আমার বাড়িও ঘোরাতে চায়। তাকে আমার প্রাইজ, মেডেল এইসব দেখিয়ে-টেখিয়ে বড়সড় ফিরিস্তি দিলে আমার সম্পর্কে। সে তখন বায়না করে বসলে- তাকে কিছু পড়ে শোনাতে হবে। কিন্তু সে ছাতার বাংলা কি বা পড়বো। কি পড়ে শোনাই এই ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল। ভাবলাম খুঁজে দেখি।দেখি নাদেরের করা অনুবাদের আধখানা নোট। এইটিই কেঁদে-ককিয়ে সে খানিক শেষ করেছিলো। কিন্তু গল্পের শেষটা তো নেই। রুস্তম বল্ল- ওটা আমি তোমার গপ্পের বই থকে মুখে মুখে বলে দেবো মামা। তুমি আগাটাতো শোনাও। সে পুরো বলব কি, আধখানা পড়ে যেই থেমেছি তার কোঁকড়া চুল বন্ধুনী এসে জড়িয়ে আমায় এই চুমু দ্যায় কি ওই চুমু দ্যায়। আমি তো কাঠ। রুস্তম ও বিপাক।কোনমতে হযবরল করে বল্লাম- আরো দুটো পাতা ছিল। কিন্তু সে আর তা অবধি পৌঁছলনা। সে তখন আমার হাত জড়িয়ে ইনিয়েবিনিয়ে নানা কিছু বলেই চলেছে।
আমার অনুবাদটা সে তৎক্ষণাৎ নিয়ে গিসলো। আর খান কয়েক দু'এক লাইন আধা অনুবাদ। নাদেরের ঘুমঘোরে করা।সেই গুলো পড়ে তো তার বিরাট হুলুস্থুল। পরে অনুবাদটা গুলো ফেরত দিয়ে গেল। বল্ল- তোমার বইয়ের কপিগুলো আমায় সব দাও- দীজ মাস্ট বী ট্রান্সলেটেড ইন স্প্যানিশ।
এরপর কয়েকমাস কেটে গেছে।
হঠাৎ রুস্তম একদিন মেইল করে বল্ল- তার বন্ধুনীটি আমার সব গপ্পের বই চায়, লোক দিয়ে অনুবাদ করাবে। সেইমত, তাদের ঠিকানায় পোস্ট করে দিলাম বই। অনেক টাকা লাগল, কিন্তু অনুবাদ হবে বই, তাও স্প্যানিশ ভাষায়, শুনেই উথলে উঠলাম। তবে তারা এখন থাকে স্পেইনে না, গুয়াতেমালায়। কি এক সরকারী প্রোজেক্টে কাজ করে। সে যাক।
মাঝে মাঝে রুস্তম লেখে আমায়। বাংলা থকে ইংরেজির কাজ নাকি তাকেই করতে হচ্ছে। ভালোরকম পয়সা পাচ্ছে নিশ্চিৎ। নয়ত পরস্য, দুরস্য মামার জন্যে এহেন আবদার সহ্য করার বিদ্যেসাগর-ভাগ্নে তিনি নন। হবেনই বা কেন। সাত কুলের মশা মারলেও একবিন্দু রক্ত পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। সে যাক। হচ্ছে যে, এইই তো আমি ভাবিনি। আমায় পয়সা না দিক। আমার তো অভাব নেই তেমন। তবে, রুস্তমের বান্ধবী বলেছে, অনুবাদের পর কিছু পয়সা আমায় দেবে।
তারপর হঠাৎ চিঠি। বই বেরুবে। আমি আর অনুবাদের কপি দেখতে চাইনা। সে ভাষার কিবা বুঝব। শুধু ইমেইলে খবর রাখি। রুস্তম জানায়- তারা রাতারাতি অনুবাদ চায়। তার বন্ধুনীর তাড়নায় সে অনুবাদ করতে থাকে।
বই বেরুবে-বেরুবে। আর তারপরই রুস্তমের এই গাব্দা চিঠি। একটা ওর হাতে লেখা আর ভেতরে এই নীল বর্ডার দেওয়া লাল সুন্দর খামটা।
সে লিখছে- সে খুবই লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। লিখছে - তাড়া থাকায়, আমাকে বা তার বান্ধবীকে সে কিছুই জানায়নি। রুস্তম লিখছে- সে আমাকে না জানিয়েই আমার কিছু গল্প কাটছাঁট করে, মানে স্রেফ প্রায় আধখানা করে ছোট স্যাম্পেলে অনুবাদ করে দ্যায়। মানে তিরিশ পাতারটা বিশ, দশ পাতারটা পাঁচ । এইরকম করে আর কি। পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই। এক বার, দুবার, তিনবার পড়ি। না, এইতো.. একথাই লিখছে। লিখছে- তাড়াহুড়োয় ওর যেগুলো শক্ত মনে হয়েছে বাদ দিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলো পরে আবার সময় নিয়ে অ্যাড করে দেবে। রাগ, দুঃখ, আগুন, অভিশাপ কিছুই করার টাইম পেলুমনা। কারণ তার পরের লাইনেই লিখছে- ওদের নাকি 'এই র্যান্ডম নেস', ওপেন এন্ডেড ব্যাপারটাই দারুণ লেগেছে।প্রভূত প্রশংসা দেখে সে আর নতুন কিছু যোগ করার সাহস পায়নি। তারা নাকি রাতারাতি ছাপতে চায়। কি এক পুরস্কারের দিন ঘনিয়ে আসছে। তার আগেই ছেপে একখান কপি পাঠিয়ে দিতে হবে কতৃপক্ষকে। ফলে আর সংযোজনের কথা ভুলেও তোলেনি রুস্তম । এইরকম প্রশংসার শেষে গপ্প পালটানো ঠিক হবেনা ভেবে, ফাইনাল করে ফেলেছে। শেষ লাইনে চোখ গেল- আমার অগ্রিমও আজই পাঠাচ্ছে।
এই পর্যন্ত পড়ে মাথায় বন্দুক ফাটবার কথা ছিল- কিন্তু সাথেসাথেই এই আরেক চিঠি।এই নীল বর্ডারের মিহি একখানা চিঠি। কি, না আমি পুরস্কার পেয়েছি। রুস্তম কারসাজি করেই দুখানা চিঠি একসাথে পোষ্ট করেছে। যাতে আমি বোবা, গোবুচন্দ্র হয়ে যাই। একটি কথাও না বলতে পারি।পুরস্কার, তাও বিদেশী। আবার টাকা। সুদূর গুয়াতেমালার।এই প্রথম বিশ্ব সাহিত্যে ওরা পুরস্কার চালু করেছে। আমিই প্রথম আন্তর্জাতিক প্রাপক। এরপর নাকি অনেক নাম হবে। এমব্যাসি থেকে পুরস্কার দেবে। আজকাল যেসব লিটারেরি উৎসব হয়, বিদেশী লেখকদের এনে, সেখানে আমারও পাত পড়বে।পেলাম তো পেলাম- 'ভ্যু' - এই নাকি পুরস্কারের নাম? কোন একটা বড় নামের পুরস্কারতো দিতে পারত। একেতো আধখানা গল্পের জ্বালায় জান জ্বালা করছে, তায় লোকে জিজ্ঞেস করলে কি বলব তাই ভাবতে লাগলাম। আধা ছেঁড়া, কানকাটা, নাক মুড়োনো, ল্যাজ মচ্কানো আধখানা করে গপ্প। আমার ভাগ্যটাই খারাপ হবে- নয়ত এর'ম সব হয়ে হয়েও হয়না।কি ভেবেছিলাম কি হল। ভাবলাম বুঝি স্পেইন থেকে অনুবাদ হবে, হল গুয়াতেমালায়। কালই নিশ্চয়ই সব জানাজানি হবে- কাগজের লোক আসবে। আর আমি নাম জিজ্ঞেস করলে বলব- ভ্যু! আর যখন জানতে পারবে, চেনা গল্প গুলো আমি পালটেছি। তখন কি বলব- নতুন লেখা, মডিফাই করেছি?? মনটাই বেজার মেরে গেলো।
নাহ্, কদিন আর এখানে থাকবনা। গা-ঢাকা দিয়ে কদিন ঘুরে আসব। বিদেশ না ছাই। শুনেছি তো গরীব দেশ। ইউ.কে, আমেরিকার পুরস্কার তো আর না। আর আমার দিশি পুরস্কারের কি কমতি আছে। তা না, শুধু শুধু লোককে টিপ্পনী কাটতে দেয়া- 'পুরস্কারের নামখানা তো খাসা কাকা। কোথাকার, না গুয়েতেমালার'। এইসবই তো শুনতে হবে। সব রুস্তমের কারবার। একবার জিজ্ঞেস অবধি করল না। ভাবলি, বিদেশ শুনেই নাল পরবে !! এতো আমার লেখাই না। রুস্তমের ইচ্ছেমত কারসাজি। তবে কেই বা লেখক? কাকেই বা পুরস্কার? প্রত্যাখ্যান করবো আমি। হয়তো এতক্ষণে সবাই জেনে গেছে। রুস্তম বলেছে- এমব্যাসি থেকে যোগাযোগ করবে।
নাহ্, দুদিন গা ঢাকা দেবো। পাড়ার মান্কে ছোঁড়াকে বলব দুদিন বাড়ি পাহারা থাকতে। খুব চোর বেড়েছে এদিকে। দামী জিনিশ, মেডেল, সব বাক্সয় ভরে রেখে যাবো।
মনের খ্যাচ কাটাতে সত্যিসত্যি দোকানের দিকে হাঁটা দিলাম। পুরোনো বাজারের ভেতর স্যুটকেসের দোকান। এখনও বাঙ্গালী মালিক আছে। কতদিন থাকবে জানিনা যদিও। বাকী সব দোকানতো বাঙ্গালীর হাত থেকে গেছে।
এতে সব আঁটবে তো? ঘুড়িয়ে দেখি ।
-হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই সবচে বড় সাইজ।
-ছোট মনে হচ্ছে।
সন্দেহ যায় না। এতো পুরস্কার, মানপত্র, ঘড়ি, শাল, ছাতা। সবই রাখতে হবে। আলমারিতে আর আঁটেনা।
-এর চে’ বড় পাবেন না বাবু। অর্ডারও নে’য়া হয় না।
তিনখানা স্যুটকেস নিয়ে বাড়ি ফিরি। সারা দুপুরভর তাতে সব ভর্তি করে ছাদের ঘরে তালা দিয়ে রাখি।
রাতে এক গ্লাস দুধ খাই। আজ আর খেলামনা । বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
মশারীর ভেতর আবছা আলো আসে। জন্ম ইস্তক শুনে আসছি পাশের বাড়ির বিরানব্বইয়ের খুড়ো প্রতিরাতে কলে দম দিয়ে একই গান বাজায়। উমা বসুর ঈষৎ অনুনাসিকে বেজে চলে- আমি আধো ফোটা ছোট তারা। আহা উমা বসু। ছিল এক মারকাটারি গায়িকা। তেমন তার চালচলন, রূপ। মায়ের কাছে এর নাম কত যে শুনেছি। মা বিয়ের আগে এই উত্তর কলকাতাতেই থাকতেন। মার বড় দিদি ছিলেন দিলিপ কুমার রায়ের সাক্ষাত ছাত্রী। সেখানে উমা বসু নামী এক সম্ভ্রান্ত সুন্দরী মেয়ে রোজ এসে গান তুলতেন। মা বলতেন তার বিয়ের পর খুলনার বাড়িতে বাবাকে বলে পুরনো দোকান খুঁজে একটা রেকর্ড আনিয়েছিলেন। যেমন রূপ তেমন গুণ। মার কাছেই শোনা- খুব অল্পবয়েসে প্রাণ হারিয়েছিল তার। জীবনভর রোজ এই গান শুনে শুনে উমা বসুর মুখটিও মনে মোমের মত ঘন জমাট হয়ে আছে।
মসৃণ মীড়ের বুনুনি শুনতে শুনতে চোখ লেগে যায়।
অনেক পুরনো এক সুবাস আসে। গন্ধ নিতে নিতে ছাদের ঘরের সামনে এসে জিরোই।দেখি দরোজা সম্পুর্ন খোলা। স্যুটকেসের ভেতর থেকে নাদেরের জর্দার মিহি গন্ধ পাই। গন্ধে ম ম করে ওঠে একফালি ছাদ।স্যুটকেসের ডালাটা স্প্রিং এর মত নড়ে ওঠে। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে খুলি। পুরস্কার, ছাতা-পাতি সব কই? বাক্সভরা শুধু শাদা শাদা তুলতুল লোমওলা পাখী কয়খান আর ছানাপোনা বিল বিল করছে। ছানা পাখীদের ডানাগুলো তিলতিল করে কাঁপছে। আর নাদের আলী তার ওপর বুক দিয়ে 'দ' হয়ে মৃদু মৃদু ডানা ঝাপটা দিছে । ক্ষীণ গলায় বলি- নাদের আলী, তুমি কি পাখী বাঁধছ ? নাদের অমনিই 'দ' হয়ে ডানা ঝাপটায়- 'ভাঙ্গর দিচ্ছি কত্তা। পাখির উড়াল।' 'ভাঙ্গর দিচ্ছ কেন, নাদের আলী?' নাদের ডানা ঝাপটানো শেষে উঠে দাঁড়ায়। পুরনো মাটির গন্ধ তার ডানায়। সে এখন সম্পুর্ন উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে ঝুরো ঝুরো মাটি। নাদের মৃদু ঘড়ঘড়ে গলায় বলে- এতো বড় স্যুটকেস নিয়ে কি করবেন কত্তা। একা মানুষ, ছোটই ভালো। বলে সে টিপিটিপি এগিয়ে আমার পুরনো উইংসাং পেনটাতে কালি ঢালতে থাকে।সুলেখার রয়্যাল ব্লু। জর্দা আর পুরনো সুলেখা কালির গন্ধে চাদ্দিক ভুরভুর করে ওঠে। কতকাল পেন খুলে কালি ভরা হয়না। কালিটার গন্ধের একটা পাতলা ঝাঁঝ আছে। লেখকের হাত থেকে কালিমা বিদায় নিয়েছে বহুকাল।
আধখানা চাঁদ। কিন্তু তার গা ভরা শোভায় ভ্রম হচ্ছে যেন পুর্ন চাঁদ। তার গা বেয়ে আলো নেমেছে সরলরেখায়। আমার বারান্দার ভাঙ্গা টবে। জং ধরা বাতিল বালতিতে।
আমার লেখার টেবিলে। কাঁসার গেলাসে। আমি দেখি- তাতে টইটম্বুর ক্ষীরপানা দুধ। হাতে ধরে আছে নাদের। মা তার বেতো হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলছেন- 'বুড়ো আমার। সারাদিন কত ঘোরাঘুরি করেছিস। এটুক খেয়ে নে।'
গরমে ফাঁস লেগে যায়। হাঁসফাঁস করে উঠে যাই। স্বপ্ন দেখছিলুম। পাখা চলে গেছে। বাইরে খোলা বারান্দায় একটা বিড়ি ধরিয়ে বসি। লাল সুতোয় বাঁধা বিড়ির তোড়া। সবুজ মেয়েমানুষের মুখ আঁকা পাতলা কাগজ। তাতে ছাপা আছে- বাসন্তী বিড়ি। বিড়ির তাড়ার প্যাকেটের গায়ে অসমীয়াতেও লেখা আছে কিছু। নাদেরের লাগানো মালতী গাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। মালতী গাছের গায়ে চাঁদ লেগে ছায়া এসে পড়েছে।সে ছায়া আবার প্রতিফলনের মত গিয়ে পড়েছে দেরাজের ওপর রাখা মায়ের হলদে মেরে যাওয়া ছবিটার গায়ে। ছায়ার প্রতিফলন হয়। সেতো আলোর ওধার। তার নিজের আর কৎটুকু। অন্যের আকার, অন্যের আলো। সেতো চাঁদেরও। নিজের আর কৎটুকু, সবই ধার, তবু আলো তো তারও। তার আলো তো তারই। রাতের আকাশে সেই রাজা, কে তখন বলবে এ আলো তার না, অন্যের কারসাজি।
বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে এখন। বেশ শীতল লাগছে। আরামখানা এমন যেন গরমদিনে বুকখোলা আদ্দির গিলে-কাটা পাঞ্জাবী। কি মনোরম। জীবন জুড়িয়ে গেল । চোখ মুদে এলো। আরামের সুখ খেয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো- হু। আরে, হু! কি তৃপ্তির এই এক অক্ষর- এই হু। তবে তো, আরে- 'ভ্যু'। নিজের মনেই বলে উঠি। চমৎকার। কি মিষ্টি! ভ্যু! তাই তো। মিষ্টিই তো। কালতো এমন লাগেনি। নিজের নেয়াপাতি ভুঁড়ি, বুকের লোমশ উপত্যকা, সবেতে হাত বোলাই। সবই ভারী ভালো লাগছে এখন।
আহা, না হয় ছোটই বা করে দিল। আমারই তো গল্প। আধাও আমার, পুরোও আমার। কোথায় বা শুরু, কোথায় বা শেষ।কোনটা যে দড় লেখা কোনটা যে দুয়ো, কে যে বড় লেখক, কে যে অনামা ! এই যে রামায়ণ, তা কি বাল্মীকির আদৌ! কে যে কখন ফুটি ফুটি দু চার কলম চালিয়েছে, কেটে ছেঁটে দিয়েছে, যুগ যুগ ধরে, তাইবা কে বা কবে জানে। কত ফেলনা লেখাই তো গাদিগাদি নাম পায়। আর মনিমুক্তো লেখা কত, কার্নিশে, উঠোনে সবার চোখের আড়ালে নয়নতারার মত ফুটে থাকে। তারা সব মুরুব্বী মানুষ, পুরোটা পড়ুক না পড়ুক, পড়ে আমোদ যে পেয়েছে সেই বড় নয় কি!
লেখাটা কেটে-ছেঁটে একটু ছোট হয়ে গেল।
এই যা।
সে এমনকি আর বড় কথা !
0 মন্তব্যসমূহ