বিশ্বদীপ চক্রবর্তী'র গল্প: টেডিড়া

টেডেরছোট ছোট চোখদুটো নিবন্ত টিউব লাইটের মত চিরিক চিরিক করছিল। হোমরা চোমরাদের মুখগোমড়া রাখাই রীতি। অধস্তনের মনে ভীতি জাগায়। তবুও টেবিলের উপর বেঁটে বেঁটে আঙ্গুলের ঘন ঘন টকাস টকাস মনের চাঞ্চল্য প্রকাশে যথেষ্ট। টেবিলের অন্যদিকে উইনিদ্যপু, প্যাডিংটন পাস্তুসো আর যোগী বেরা।
নিজের নিজের চেয়ারের অগ্রভাগে ঝুলতে ঝুলতে সর্বাঙ্গ দিয়ে উদ্বেগ জাহির করছিল। অন্য যে কোন দিন হলে মিটিং শুরুর অপেক্ষায় চেয়ারে হেলান দিয়ে খোশগল্প চলত। আজ শুধু আফসোস আর ফোঁস ফোঁস।

লোরেক দরজা ঠেলে হাঁফাতে ঝাঁপাতে ঢুকেই ঘোষণা করল, অল ক্লিয়ার।

টেডের ছটফটে আঙ্গুলগুলো বোল ভুলে টেবিলের প্রান্তে ঝুলে পড়ল।। ব্যাস, তবেই তো কেল্লা ফতে। কিন্তু এতে কি আর বিমানবন্দরের জেল্লা ফিরবে? দেড় ঘণ্টায় কতগুলো ফ্লাইট বেহাল হল সে খেয়াল আছে?

টেডের টিটকিরিতে লোরেক মুহূর্তের জন্য দমে গেলেও থামল না। সময় তো লাগবেই টেড, সব কিছু চেক না করে তো আর ছাড়তে পারি না। যদি গোলাবারুদ থাকত? 

আজকে সকাল সকাল বেভুলে রাখা একটা টিনের বাক্স উদ্ধার হয় তেইশ নম্বর গেটের সিটিং এরিয়ায়। সঙ্গে সঙ্গে ধুন্দুমার। ভিমরুলের চাকে খোঁচা। সবাই যথারীতি নিজ নিজ বীরত্ব ভুলে নিরাপদ দূরত্বে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। যদিও বাক্সটা নেহাতই গোবেচারা গোত্রীয়।বিমানবন্দরী চাকচিক্য নেই। মাঝারি মাপের, বাইরের গাড় বাদামী রঙ চটে ভিতরের আস্তরণ দাঁত ছিরকুটেছে যত্রতত্র। দশটা পঞ্চাশের শিকাগোর বিমান গত হতেই বেনামী বাক্সোটা নিজেকে জানান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি। নর্থ টার্মিনালের সব যাত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে বাইরের পথ দেখান হল, অন্তত কুড়িটি বিমানের উড়ান ফুরুত। বোমার কলকব্জা ঢিলে করার দলবল হাজির হতেও দেরী করেনি। কিন্তু তাদের কাজের এত তামঝাম, বোমা যে আসলে বোমা নয় সেটা প্রমান করতেও সময় লেগে যায়। লোরেক বার্ণিসন, বিমানবন্দরের সুরক্ষাপ্রধান, তাদের সঙ্গেই ছিল এতক্ষণ।

টেড মনে মনে অষ্টরম্ভা! বললেও মূখে মধু মেরে পরিবেশন করল, কিছু কি পাওয়া গেল? 

বোমা উদ্ধারের চক্করে ফটফটে সাদা চামড়ার লোরেকের মুখ লালচে বেগুনী, কপালে ঘাম। তবূ ঘ্যাম নিতে ছাড়ে না। কিছু পাওয়ার কথা নয়, ছিলও না। রাজ্যের খুচরো কাগজপত্র ছাড়া। কোরির অফিস কাগজগুলো খুঁটিয়ে দেখছে, শিকাগো প্যাসেঞ্জারদের নামের লিস্টও আছে। দেখছে যদি কোন নাম পাওয়া যায়।

এসব টেড আগের থেকেই জানত। মিনিট পনেরো আগেই অ্যাভিয়েশন কন্ট্রোল থেকে পরের বিমানগুলো ছাড়ার সবুজ সঙ্কেত জানিয়েছে।বৃষ্টিশেষের পিঁপড়েদের মত সার দিয়ে যাত্রীরা ফেরত আসতে শুরু করেছে। বারোটা পঁয়ত্রিশের নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট দিয়ে বিমান চলাচল আবার দুরুস্ত হবে। টেড কি এসব জানে না?কিন্তু একজনকে বিশ্বাস করে বসে থাকার বান্দা সে নয়। কার কি ধান্দা সে যাচাই করে দেখতে ভালবাসে।কেউ একটু ফস্কালেই সবার সামনেই টসকে দিতেও ছাড়ে না। টেড রবিনসন বিমানবন্দরের প্রধান, যাকে তাকে হড়কাবার অধিকার তার ষোল আনা।

টেবিলের অন্য পাশের কেউ অবশ্য কিছু জানত না। গ্যাস বেলুনের মত সোজা হয়ে মাথা বাড়ানো চেহারাগুলো এবার ফুস হয়েজামাকাপড়ের ভাঁজের নিশ্চিন্ততায় কেতরে পড়ল।যোগী ফিকে হেসে লোরেকের দিকে হাত বাড়াল, গ্রেট জব লোরেক। বাট অ্যাজ আই টোল্ড, দেয়ারসনাথিং রিয়ালি টু বি প্যানিকড। কে বলছে দেখো! একটু আগেই হালে পানি পাচ্ছিল না, এখন মুখে সুললিতের বানী!

উইনির মনে হল, আরে আমি তো কিছু কইনি। বসের সামনে নিজের দুশ্চিন্তা উগরে দিল, ওইরকম একটা পুরনো বাক্সে কিসের কাগজ থাকতে পারে বল তো?কিছুই না থাকলে গুফি বাক্সের চারপাশে এমন চরকিপাক দিচ্ছিল কেন?

গুফি হল স্নিফার ডগ।

অগোছালো কথাবার্তা বিগ টেডকে বিরক্ত করে। মোটা ভুরু জুড়ে বলল,আজকে কিন্তু আমি এই বাক্স নিয়েকচকচি করতে ডাকিনি। জানতাম এমন কিছু ঘটতে চলেছে। সেটা হতে না দেবার জন্যেইসবাইকে ডাকা।তবু ঘটে গেল! দীর্ঘশ্বাস সহকারে টেড থামল। সবার উপর চোখের সার্চলাইট ঘুরে গেল। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না দেখে খুশি হয়ে খ্যাঁকানি দিল, এইভাবে রোজ রোজ কি বিমান বন্দর বন্ধ রাখতে হবে? একটিবার যদি বোম ফোটে, কাউকে পাবে আর এই রুটে? তখন বোলচাল যাবে ফুটে। সেটাকে আটকানোর জন্য বিমানবন্দরে এমনি সবফেলে যাওয়া জিনিসের ফিরিস্তি চাই। আজকের মিটিং সেইজন্যেই।

বসের সব কথাতেই দেঁতো হাসি হাসে প্যাডি। টেড, ইউ আর আ জিনিয়াস! ভবিষ্যতটা কিভাবে দেখতে পেয়ে যাও? যেন এরকম কিছু ঘটবে এমনি ভাবনা তোমার মাথায় আগের থেকেই ঘুরছিল।

হালকা হাসির ছোঁয়ায় টেডের চোখদুটো নিমেষে আরও ছোট। অন্তত এই বুদ্ধুগুলোর মধ্যে একটা বুঝদার লোক আছে। টেডের পরের কথাগুলোরগরাসে গরাসেসেই আত্মপ্রসাদের ঢেঁকুর। জানি, জানতে হয়। এরকম একটা কিছু যে কোনসময়েইহতে পারে। কিন্তু আমরাই কিসেই সুযোগটা করে দিচ্ছি না?

লোরেকছটফটিয়ে উঠল। কি করে টেড? শিকাগোর বিমান ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই বাক্সটাকে লোকেট করেছি। আর দেখো ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা সামলে নিয়ে সব কিছু কেমনযে কে সেই।

কেদ্দানি দেখিও না। ভেংচে উঠল টেড। আজ করেছো, রোজ করো? সমস্ত ফেলে যাওয়া জিনিষকেই কি এইভাবে যাচাই করে দেখো? ছাই দেখো! লোরেকের বিচলিত চোখের পরোয়া না করে এবার প্রশ্নবান যোগীর দিকে। এরকম ফেলে যাওয়া জিনিস রোজ কতগুলো পাও যোগী?

যোগী বিমান বন্দরের হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্বেশের দিকটা সামলায়। বস জিজ্ঞেস করতেইঝাঁপিয়ে পড়েএকটা কাগজ সামনে বাড়াল। আমি ঠিক বুঝেছি এটাই জানতে চাইবে। দেখোটেড, এই যে লিস্টটা। গত একমাসে এরকম ছশো বাহান্নটা বিভিন্ন জিনিষ ফেলে রেখে গেছে যাত্রীরা।

মাই গড! দ্রুত তালিকায় চোখ বুলাতে থাকে টেড। প্রস্থেটিক লেগস? এটা ছাড়া প্লেনে চড়ল কি করে? টেড হাসলে কেমন বুগবুগে শব্দ হয়। শুনে প্যাডিও তার নারকেল কুচির মত দাঁত মেলে দিল। উইনিখিল্লি দেবার এমন সুযোগ ছড়বে? হয়,এমন হয় টেড। একবার তো একজন প্র্যামশুদ্ধু বাচ্চাকে ফেলে গেছিল। আর এইতো সেদিন -

টেড তার অধিনস্তের খেলো রসিকতায় মোটেই হেলে না। মাঝখানেই নিজের কথা চেলে দিল, লোরেক, কোন নিয়ম আছে যে শুধু বাক্সে করেই বিস্ফোরক ফেলে রাখা যায়?

উইনির প্রতি লোরেকের একটু ইয়ে আছে। মাঝে মাঝেই তাদের একসঙ্গে বসে কফি খেতে দেখা যায়।তার কথাকে বসচেপে দিলে সে তো ক্ষেপে যাবেই। কিন্তু বস তো, তাই মেপে কথা বলতে হয়।উইনির প্রতি একটা ‘ আমি তোমারই সাথী হে’ বলা দৃষ্টি ছুঁড়তে ছুঁড়তেওবিচক্ষণ আধিকারিকের ভঙ্গীটা বজায় রেখে জানাল, না তার কোন মানে নেই। তবে বাইরে একটা ধাতব আস্তরণ তো রাখতেই হয়। যদিও সেটা অন্য কিছুর মোড়কে আড়াল করা যেতেই পারে।

অ! তার মানে লিস্টের সব কটাতেই বিস্ফোরক থাকতে পারে? লোরেক মাথা নেড়ে না বলতেই ঘরের মধ্যে বোম ফাটল। চেক করেছিলে?

ঘরের আবহাওয়া নিমেষে থমথমে, গম্ভীর।কারো মুখে রা নেই। বিগ টেডের পরের প্রশ্ন সেই স্তব্ধতাকে আবার খোঁচাল, এই কদিন আগেই ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে কি হয়েছিল জানো তো?

কেউ জানে লবডঙ্কা!স্প্রিং দেওয়া বুড়োর মত ঘনঘন মাথা নাড়া ছাড়া কেউই কিছু বলল না। টেডএবার সরাসরি যোগীকে প্রশ্ন করল, যোগী, এর মধ্যে কতগুলো জিনিস ফেরত গেছে?

যেসব জিনিষ কেউ নিজের বলেছে, আমরা দিয়ে দিয়েছি। এখনো অবধি সেপ্টেম্বারের একশোরও বেশি জিনিষ যাত্রীরা ক্লেম করে নিয়ে গেছে।

টেড আঁতকে উঠল। চেয়ার থেকে পড়ো পড়ো অবস্থা। বলো কি? তার মানে প্রায় পাঁচশোরও বেশী ফেলে যাওয়া মালপত্র পড়ে রয়েছে? কি করবে ওগুলো নিয়ে?

যোগী বসের জেরার মুখে এবার ঘেমেনেয়ে একাকার। কিন্তু ভাঙবে তবু মচকাবে না। সবজান্তা ভাবটা নাকের ডগায় ঝুলিয়ে জানাল, দামী জিনিসগুলো তিরিশ দিন পেরোলেই আমরা স্কটসবোরো পাঠিয়ে দিই। একেবারে চটজলদি কাজ। ওখানে নিলামে তোলা হয়।

আর বাকীগুলো?

স্ক্র্যাপ।

টেডের কুতকুতে চোখের সার্চলাইট যোগীর উপর। সব? তার মানে বলছো সেপ্টেম্বরের আগের কোন ফেলে যাওয়া জিনিষ আমাদের কাছে নেই? হয় স্কটসবরো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, নাহলে জাঙ্কইয়ার্ডে?

প্যাডি ফার্স্ট বেঞ্চের পড়ুয়া ছাত্রের মত উশখুশ করছিল। ফাঁক পেতেই জানি জানি ভঙ্গীতে বলে উঠল, কক্ষনো না, কক্ষনো না। তিন নম্বর বেল্টের কাছে দুটো স্টোর রুম বন্ধ পড়ে আছে।ওখানে এরকম অনেক জিনিষ রাখা আছে। কয়েক মাস আগেই প্যাডি তার ডিপার্টমেন্টের জন্য বাড়তি জায়গা খুঁজতে খুঁজতে এই দুটো ঘরের সন্ধান পেয়েছিল। কবজা করতে পারেনি।সুযোগ বুঝে আজ তার ঝাল তুলল।

হ্যাঁ, আট নম্বরের পাশেও একটা বন্ধ ঘর আছে। উইনিও তড়বড়িয়ে ওঠে, কে জানে ওখানে কিছু রাখা আছে কি না!

যোগীর সবজান্তাপনায় এবার চিড় ধরছিল।ত ত করে বলল, আমি এই ডিপার্টমেন্টে নতুন তো! জানি না আগেকার কোন জিনিষ রয়ে গেছে কিনা। গিভ মি ফিউ ডেজ, আমি দেখে বলছি।

টেড এবার উইনির উপর চড়াও হল। উইনি, ভবিষ্যতে এইসব জিনিষগুলোকে কিভাবে ট্যাগ করা যায়? এমন কিছু যাতে সহজেই জিনিষের মালিক অবধি পৌঁছে যাওয়া যায়?

টেডের আচমকা প্রশ্নে উইনির মুখের হাসি এক ধাক্কায় তলানিতে। কিন্তু কিন্তু করে মিনমিনে গলায় বলল, ঠিক আছে আমি দেখব টেড। কিন্তু বড্ড খরচ পড়ে যাবে না?

সেটা কি তুমি বুঝবে না আমি? ভাবো। মালিকের পরিচিতি ছাড়া কোন জিনিষ সুরক্ষাদেওয়ালের এদিকে আর আসবে না। ব্যাস! টেবিলে টেডের সজোরে চাপড়ে কফি কাপ উলটে যায় আর কি!  

লোরেক উইনিকে আড়াল করতে নিজের গলা বাড়িয়ে দিল। সেটা খুব সহজেই করা যায় যদি সব কেবিন ব্যাগেজ সিল করে দেওয়া যায়। তবে ওরকম একটা সুরক্ষা দেওয়াল তুলতে হলে আরও লোক বাড়াতে হবে। কে দেবে সেই টাকা? তাছাড়া এতে সুরক্ষার কি উন্নতি হবে সেটাতো বুঝতে পারছি না। 

কিছু করার নেই, সেফটি ফার্স্ট। এয়ারপোর্ট ট্যাক্স বাড়িয়ে টাকা তুলে নেবো। কিন্তু সুরক্ষা ব্যবস্থা ঠিক করতেই হবে। আর যোগী, দুদিনের মধ্যে আমি ফেলে যাওয়া জিনিসের পুরো হিসেব চাই। সব কটাকে নিকেষ না করে শান্তি নেই।

টেডের বশংবদ প্যাডি উশখুস করছিল। সবাইকে কিছু হুকুম দেওয়া হয়েছে, সে বেচারা তামিল করার মত কিছুই পায় নি। কেমন খেলো লাগে না? তাই আগ বাড়িয়ে বলল, আমি ওই দুটো বন্ধ ঘরের চাবি বের করে খুলে দেখছি টেড। আমার মনে হয় ওখানে এখনো এরকম অনেক ফেলে যাওয়া জিনিষ ডাঁই করে রাখা আছে।

আই লাভ দিজ প্রোয়াক্টিভ স্পিরিট প্যাডি, আই নীড লটস ওফ ইট টু মেক দ্য এয়ারপোর্ট সেফ এগেন।

সুযোগ পেয়েইউইনি মাখন। এটা খুব ভাল স্লোগান হবে টেড। মেক দ্য এয়ারপোর্ট সেফ এগেন। যদিও এমন গম্ভীর পরিবেশে এই কথার সঙ্গে খিলখিল হাসির কোন দরকার ছিল না।

উইনির প্রগলভতায় রেগে উঠতে গিয়েও সামলে নিল টেড। ভাল বলেছে তো! মেয়ে হলেও বুদ্ধি আছে! প্রচারপত্রে এটা ঢুকিয়ে দিলে বেশ হয়। টেড রবিনসন এরকম সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করে না। সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণায়মান চেয়ারের দিক বদল করে গিঙ্কোকে ফোন ঘুরাল টেড। গিঙ্কো ইউরিশিরো মার্কেটিং চিফ। ওকে দিয়ে এখুনি এই স্লোগানটাকে দিয়ে কিছু একটা লেখাতে হবে। কাগজগুলো তো বাজে খবরের জন্য মুখিয়ে থাকে, এতক্ষণে আজকের ঘটনাটা তো ব্রেকিং নিউজে। এখুনি কোন কাগজওয়ালা এসে মুখের সামনে মাইক ধরবে। তার জন্য বক্তৃতা আর স্লোগানের জোগান থাকা দরকার। 

চেয়ার পিছনদিকে ঘোরা মানেই সবার ছুটি। যে যার গলি পথে। লোরেক আর উইনির গলাগলি, তাই চলল কফি খেতে। প্যাডি তড়বড় করে অন্যদের গড়বর ধরতে দৌড়াল। সবার আগে কাজ নাবিয়ে বসকে তাক লাগাতে হবে। যোগী তার অফিসের দিকে পা বাড়িয়েছিল। ফেলে যাওয়া জিনিসের কি করবেভেবে বেচারার হাতে হ্যারিকেন। কিন্তু বারো নম্বর গেটের কাছে এসে টিউব লাইট জ্বলে গেল। বিম্বো এটা কি করছে? পাগল হয়ে গেল না কি?

বিম্বোধরা কাস্টোমার কমিউনিকেশনের। সংক্ষেপে বিম্বো। যোগী একবার খিল্লি করেছিল, বিম্বো নামটা পাল্টাও না, শুনলেই মনে হয় মাথায় বুদ্ধি নেই।

তোমার মতো এমন ভোগীর নাম যোগী হলে, আমার নাম ঠিকই আছে।

কি চ্যাটাস চ্যাটাস কথা!

তাছাড়া,আমার ছোটবেলার বন্ধুরা আমাকে এই নামে ডাকত। ওরা তো আর জানত না যেই এই দেশে বিম্বো কথাটার কি মানে। এখন এটাই তো আমার পরিচয়, সেটা বদলাবো কেন?

বোকা মেয়েটা কোনদিনই ছিল না। তাই যোগী সেদিন কথা গিলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আজ কাজকর্ম ছেড়ে ও এটা কি করছে?

বিম্বো স্টারবাকসের কাউন্টারটার বাইরের কফি টেবলে একটা ধুমসো টেডি বেয়ারকে বসানোর চেষ্টায় ছিল। পিছনে দিয়ে একটা হাফ অ্যান্ড হাফের ফ্লাস্কদিয়ে ঠেকা দিয়েও আদুরে ভালূককে সোজা রাখা যাচ্ছে না। বসাচ্ছেআর ধুম পটাশ! বিম্বো বিরক্তিতে হাত পা ছুঁড়ে যোগীকে বলল, যোগী স্যার, একটু হেল্প করবে? প্লিজজজ-

যোগী মনে মনে মুচকি হাসল, আজ কেন? সেদিন যখন আলগোছে হাতটা ধরেছিলাম কিরকম ছটফট করে ছাড়িয়ে নিয়েছিলে! মুখে বলল, তোমার কি আজ কাজ নেই? নাকি বিম্বো ব্রেডের বিজ্ঞাপনে নেবেছো? মেয়েটা খাপচু দেখতে, শরীরটা একদম মাপে মাপে।আঁটসাঁট জামায় বুকটা একদম জমাট। যোগী একদম মজে গেল। এর সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু আমড়াগাছি করাই যায়।চুলোয় যাক টেডের দেওয়া কাজ। ওখানেই ল্যাম্প পোস্ট হয়ে গেল যোগী। তার খোসা ছাড়ানো লিচুর মত চোখদুটো চশমার আড়াল থেকে বিম্বোর বুকে ড্রপ খেল।

বিম্বো এমনিতে যোগীকে একটু তফাতে রাখে। বস হলেও।লুচ্চামি করার সুযোগ দিতে চায় না। ভ্রু কুঁচকে তাকাল, তার মানে?

আর বাবা, বিম্বো ব্রেড খাও নি? ওরা একটা মেক্সিকান বেকারী, আজকাল এদেশে খুব পাওয়া যাচ্ছে। ওদের লোগোটাই তো ভালুকছানার। আই লাভ বিম্বো, একটা অর্থপূর্ণ বিরতি রেখে যোগ করল, মানে ওদের পাঁউরুটিটা আর কি।রোজ খাই, এমনি এমনি। বিম্বো যোগীর রসিকতাকে বেশি কথা মনে করে পাত্তাও দিল না। আমি কোন অ্যাড ক্যাম্পেন করছি না এখানে।

একগাল হেসে আরও দু পা এগিয়ে এল যোগী। তাহলে টেডি বেয়ার নিয়ে কি করছ কচি খুকি আমার? কিছু হেল্প চাইলে বল?

মেয়েটা এবার একটু গলল। বলল, দেখো না, গত শনিবারের মস্কো ফ্লাইটের একটি মেয়ে তার সাধের টেডি বেয়ার ওয়েটিং এরিয়ায় ফেলে চলে গেছিল। এর নাম মিশা। কি কিউট না? বলতে বলতে বিম্বো মিশার গোল গোল গাল টিপে দিল। এখন সে মেয়ে মিশার দুঃখে খাওয়া দাওয়া ছেড়েছে। বিম্বোর পান পাতার মত চোখেও দুঃখ নাও ভাসাল। আমি কি করি বলো? ওর মা আমাদের সঙ্গেচ্যাট করছে। আমি এখন একে নিয়ে এয়ারপোর্টের বিভিন্ন খাবার দোকানের সামনে ছবি তুলছি।ওর মা মেয়েকে মিশার খাওয়ার ছবি দেখিয়ে বোঝাবে যে ও খুব ভাল আছে, এয়ারপোর্টে ছুটি কাটাচ্ছে। দেখো, টিজিআই ফ্রাইডেতে ওর এই ছবিটা। বিম্বো নিজের মোবাইলে তোলা ছবিটা দেখাল। ফ্যাবু না? দেখলেই কাডল করতে ইচ্ছা করে। পুচুক হেসে বলল, আসলে আমিও না টেডি নিয়ে খেলতে ভালবাসতাম। কি নরম আর আদুরে গোপালের মত দেখতে না বলো? গুলুস পুলুস! বলে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল ছেয়ে বাদামী রঙের রাশিয়ান ভালুক পুতুল মিশাকে।

এঈ মুহূর্তে বিম্বোকেও খূব আদূরে লাগছিল। ও কতটা নরম পরখ করতে যোগীরভোগী মনও উশখুস। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে ওস্তাদ যোগী জিজ্ঞেস করল, সে না হয় বুঝলাম।আমায় বলো তুমি মিশাকে খুঁজে পেলে কি ভাবে? এর তো আর কোন নাম ঠিকানা লেখা ছিল না।

একটু অসুবিধা হয়েছিল, কারণ এরকম কাছাকাছি রঙের আরও অনেক টেডি বেয়ার থাকে তো। কিন্তু ওর মা মিশার ছবি পাঠিয়েছিল, তার সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম।

যোগীর লিচু লিচু চোখে সঙ্গে সঙ্গে সজারুর কাঁটার কুটকুট।আচ্ছা, তাই নাকি? অনেক টেডি আছে তোমার কাছে? এই সমস্ত টেডি বেয়ার রাখা আছে কোথায়?

বিম্বো অত বোকা?ধোঁয়া দেখেই আগুনের আঁচ বোঝে। প্রশ্নের ধরন দেখেইরোঁয়া ফুলিয়ে গড়গড় করে উঠল, যোগী তুমি আমাকে হেল্প না করে বরং দেরী করিয়ে দিচ্ছো। আমি ছবি তুলে হোয়াটসাপ না করলে মেয়েটা আজ হয়তো খাবেও না।

এমনি সময় হেই বাই প্রায় ছুটতে ছুটতে হাজির। হাঁফাতে ঝাঁপাতেএসে বলল, বিম্বো, এক্ষুনি আসো। মিস্টার প্যাডিংটন লাগেজ বেল্টের পাশের ঘরদুটোখুলবে বলে ঝাঁপাঝাঁপি করছে।

আচমকা এই ঘোষণায় বিম্বো হতভম্ব। কিন্তু ডাম্বো তো নয়, পরক্ষনেই তেড়েফুঁড়ে উঠল, জালি নাকি? ওর ডিপার্টমেন্টকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ওই ঘর দুটো খালি নেই।

কিন্তু ও দেখতে চায় কি আছে ওই দুটো ঘরে। দাবি করছেবিগ টেডের পারমিশন আছে। আমার কাছে চাবি থাকার কথা। ছিল না বলে হাবিজাবি কথা বলছে। তোমাকে এখুনি আসতে হবে।

দুজনে খাবি খেতে খেতে নিমেষে গায়েব।

প্যাডি বসের কাজ শুরুও করে দিয়েছে!ভেবেই তড়াক তড়াক পায়েযোগী চলল নিজের অফিসের পথে।




মিটিং-এর পর লোরেক আর উইনি হাঁটতে হাঁটতে আসছিল কফি শপে। লোরেকের লম্বা চওড়া চেহারার পাশে উইনিকে লাগে এত্তোটুক। যেন গ্রিজলির পাশে পান্ডা।সাড়ে ছয় ফুট লম্বা লোরেকের পাশে পাশে হাঁটতে গিয়ে দৌড় লাগাতেই যা বাকি রেখেছিল।এমনিতে লোরেক উইনির হাতে হাত গলিয়ে আসে।আস্তে পা চালিয়ে হাঁটে যাতে উইনির অসুবিধা না হয়। কিন্তু আজ মাথা গরম। ঘন ঘন নিজের মনেই মাথা নাড়ছে। টেডের কথা তার একদম ভাল লাগে নি। কফির মাগে চুমুক মেরে বলেই ফেলল, কদিন হয়েছে ও এই এয়ারপোর্টের দায়িত্ব নিয়েছে? কদিন? অথচ সবজান্তা ভাব। অন্তত সিকিউরিটি ড্রিলের কিচ্ছু বোঝে না!

কেন, এরকম কেন বলছো?

উইনির পালটি কথায় লোরেকের ফরসা মুখটা নিমেষে টকটকে লালটি।অবাক হলেও বুঝল কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাদের বন্ধুত্বের তালটি কাটছে। সেও ছেড়ে কথা বলবে কেন? ঝেঁঝে উঠল। কোন একটা লোক তার বাক্স ভুল করে ফেলে গেছে। দোষের মধ্যে বাক্সটার চেহারা সন্দেহজনক। সেটা কি করে সিকিউরিটি ল্যাপস হয়?

উইনি কফির কাপে চামচ নাড়াতে নাড়াতে তখনো বসের হয়ে খেলছিল। সারা এয়ারপোর্টে হইচই তো হয়েছে।

লোরেকের চুপসানো দুঃখটা এবার উপচানো লাভার মত বেরিয়ে এল। ভেবেচিন্তে কথা বল, উইনি। বাক্সের বাইরের চেহারা দেখে সবাইমিথ্যে প্যানিক করেছে। তার টনিক তো আমার কাছে নেই।কিন্তু দেড় ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু কবজাতেও এসে গেছে। পেয়েছে কোন গোলাবারুদ কি হাতিয়ার?কি করে পাওয়া যাবে? আমাদের সিকিউরিটি ড্রিল পেরিয়ে কোন গোলাগুলি আসতে পারে না। এক্সরে করা হয় সমস্ত হ্যান্ড লাগেজ। তবে?

স্টীম ইঞ্জিনের মত ফোঁস ফোঁস করে রাগ বের করে দিয়ে ক্লান্ত বোধ করে লোরেক। এত বড় চেহারার বাহুবলী এখন নেতানো কলি। দেখে উইনির সহানুভূতি ছলকায়। আহারে, তার আলুকভালুকটা যেন আজ কাদায় পড়েছে। কিছুটা বেকায়দায় তো বটেই। হাত বাড়িয়ে লোরেকের থাবার মত হাতের আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে সমবেদনা জানায়। লোরেক ডিয়ার, তুমি মিছিমিছি ভাবছ। টেড তো তোমাকে কিছু বলে নি।

আর কিভাবে বলবে? মেক দ্য এয়ারপোর্ট সেফ আগেন! হাঃ! রাজ্যের বিরক্তি লোরেকের গলায়। তাহলে কি এতদিন আনসেফ ছিল? এটা আমার বদনাম নয় তো কি গুনের কেত্তন?

এই সময়ে মাথার উপরে টিভি থেকে টেডের গলা গমগম করে উঠল। সিএনএনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছে। দুজনেরই চোখ ঘুরল ওদিকেই।

আমরা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি ব্যাপারটা। নো ড্যামেজ ডান। কিন্তু এতদিন আমাদের সুরক্ষা ব্যবস্থায় যে ফাঁক ছিল সেটা স্পষ্ট। সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা হবে। কেউ রেহাই পাবে না। সাময়িক ভাবে সুরক্ষা প্রধান লোরেক ব্রাইনসনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমি আরও কায়দা কানুন বদলাচ্ছি। সময় হলেই সব জানাবো। আই উইল মেক দ্য এয়ারপোর্ট সেফ আগেন।

মাই গড! নিজের গলার স্বরেই চমকে উঠে উইনি চারপাশে তাকাল। মনে হল এয়ারপোর্টের সমস্ত গুঞ্জন যেন এখন তাদের ঘিরেই। নিজের ছোট্ট শরীরটাকে দিয়ে এত বড় লোকটাকে কিভাবে আড়াল করবে বুঝতে পারছিল না। উইনির ডান হাত লোরেকের আঙ্গুলগুলোকে সজোরে জড়িয়ে ধরল। 

লোরেকের মুখে বিস্বাদ থুতু হয়ে জমছিল।। এক্ষুনি কথা হল, কিছুই বলে নি। আর এমনভাবে লাইভ টিভিতে বরখাস্ত হবার খবর পেতে হল?পটাং করে মাথায় রাগ চড়ে গেল। এতদিনের সফল চাকরি জীবনে এরকম দাগ! উইনি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে কাঁধে হাত রাখল।লোরেকের আত্মসম্মান জ্ঞান বড় টনটনে। কিছু করে না বসে।

সে কথা শোনে? এক ঝটকায় কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে। পিছন পিছন উইনি। কোথায় যাচ্ছো এভাবে? মাথা ঠান্ডা রাখো লোরেক, টেক ইট ইজি। তোমার যখন কোন দোষ নেই, বস তোমায় কিছু করতে পারে না।

বরখাস্ত করেছে, এরপরে করার আর কি বাকি আছে? লোরেকের ঘরঘরে গলা অনেকদূর অবধি যাচ্ছিল।

আস্তে, আস্তে কথা বলো লোরেক, কেউ শুনে ফেলবে। উইনির এবার ভয় ধরছিল। লোরেক এমন কিছু বলবে আর সঙ্গে থাকার জন্য তারও না চাকরিতে টান পড়ে।

শুনুক, আমার চাকরি খেয়ে দিয়েছে। এখন শুনলেই বা কি যায় আসে আমার?

উইনির যায় আসে। কিন্তু মুখে সেটা না বলে লোরেককে বোঝাল, আরে বাবা, ওটা তো সাময়িক। তাছাড়া তোমাকে তো কিছু বলেনি, সাক্ষাতকারে বলেছে। এভাবে কেউ কাজ থেকে বরখাস্ত হয়?

সেটাই তো জানতে যাচ্ছি।

রক্ত টগবগ করছে সাড়ে ছ ফুট লোকটার। উইনি এ অবস্থায় ওকে টেডের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেবে না। সব কিছু ভেস্তে যেতে পারে।উইনি শুধু কাঁদতে বাকি রাখে। প্লিজ লোরেক, আমার কথা শোন। এক্ষুনি যাবার দরকার নেই।

লোরেক এসব শোনে? সে যাবেই। উইনি পড়ল মহা ফাঁপরে। তাকেও কি সঙ্গে সঙ্গে যেতে হবে? উই বাবারে! বিগ টেড যদি তাকেও – নিজের লাভ ক্ষতির হিসাবটা কষতেই সব ভালবাসা ধসে ধূর।শুধু জাল কেটে বেরোয় কেমন করে বুঝতে পারছে না। এমন সময়ে দেখে তিন নম্বর লাগেজ বেল্টের কাছে একটা ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্যাডিংটন হেই বাই আর বিম্বোর উপর মহা তম্বি করছে। উইনি লোরেকের হাত ধরে টান দেয়। দেখো বসের চামচা কি হল্লা জুড়েছে এখানে। আজকে এমনিতেই এত কিছু ঘটছে, এর মধ্যে এসব না হলেই কি নয়?

লোরেক একটু থমকাল। সেই সুযোগে উইনি ওকে টেনে নিয়ে চলল কি হচ্ছে দেখতে। কি ব্যাপার প্যাডি, কি হয়েছে?

প্যাডি বোধহয় এখনো লোরেকের বরখাস্ত হবার খবরটা পায় নি। তাই বলল, দেখো লোরেক,টার্মিনালের সুরক্ষার কি দশা! দরজার চাবি পর্যন্ত ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। বন্ধ দরজার পিছনে কি ঘটছে জানবে কি করে? 

লোরেক এমনিতেই রেগে ব্যোম হয়ে ছিল। এবার ফেটে পড়ল। বিমানবন্দরের অ্যাডমিন্সট্রেশনে কতদিন আছো প্যাডি? স্টোররুমের চাবি সামলানো কি সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় আসে?

উইনি ধামা চাপা দেবার ভঙ্গিতে বলল, আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। একটা চাবি যদি হারিয়ে গিয়ে থাকে, ডুপ্লিকেট ব্যবহার করলেই হয়।

না, না তার দরকার নেই। চাবি আমারকাছে আছে তো। কিন্তু দরকারটা কি? বিম্বোরমুখে এখনোদেখনহাসি।

প্যাডিংটন চশমাটা খুলে পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বের করে লেন্স পরিষ্কারের সল্যুশন ছিটিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাঁচ মুছল। ধীরেসুস্থেনাকের উপর আবার চশমাটা এঁটে বলল, টেডের নির্দেশ, টার্মিনাল থেকে সব ফেলে যাওয়া জিনিষ বিদায় করতে হবে, দে আর অল সিকিউরিটি থ্রেট।

ওটা তোমার কাজ কবে থেকে হল প্যাডি?

মানে? বিম্বোর এই বেমক্কা খোঁচায় প্যাডি চটেমটে একসা।

আসলে বলো না এই ঘরটা কবজা করতে চাইছ। চোখ ছিল অনেকদিন ধরে, এই বাহানায় ঘরটা বাগাবে।
দেখেছো তো সুরক্ষাপ্রধান আমার সঙ্গে এসেছে, টেডের নির্দেশ আছে বলেই নাএবার লোরেক মহা ফাঁফরে। বলবে নাকি যে তার চাকরি গেছে? সবার সামনে সেটা বলতেও ইচ্ছা করছে না। আবার তার চাকরিটা যখন নেই, তখন কোন অধিকারে সে দরজা খুলতে জোর করবে?

তার দরকার হল না। হেই বাই হই হই করে উঠল। অত তরজায় কাজ কি? দরজা খুলে দেখতে চাও, খুলছি। গোপন করার মত কিছু তো নেই।

কিন্তু দরজা খুলেই হেই বাইয়ের চোখ ছানাবড়া। চাবি বিম্বোর কাছে রাখা ছিল, কিন্তু এটা কি করেছে ও। ঘর জুড়ে শুধু হরেক কিসিমের স্টাফড ভালুক পুতুল। সাদা, কালো, বাদামী, নীল, ছেয়ে –কোন রং নেই! আয়তনেও কোনটা এক বিঘতে, কোনটা এক ফুটিয়া। কতগুলো আবার আরও বড় আর নাদুদ নুদুস।

এগুলো কে এখানে রেখেছে? চশমার আড়ালে চোখ সরু করে জানতে চায় প্যাডি।

আমি। বিম্বোর গলায় এখন ডুবন্ত নৌকার মাল্লার সাহস।

কেন?

আমার কাজই তো এই। যাত্রীদের ফেলে যাওয়া জিনিষ যত্নে তুলে রাখা যাতে চাইলে দিতে পারি।

ও তাই নাকি? ভেঙ্গিয়ে ওঠে প্যাডি। এসব কি জমিয়ে রাখার কথা? তোমার কোন ম্যানুয়ালে এটা লেখা আছে?

বিম্বো ভাঙবে তবু মচকাবে না। সে পাল্লা দিয়ে প্যাডির সঙ্গে ঝগড়া করে। যাত্রীরা কোন কিছু ফেলে গেলে তিরিশদিন অবধি রাখার নিয়ম।

প্যাডি ততক্ষণে হনহন করে ঘরে ঢুকে টেডি বেয়ারগুলো তুলে তুলে দেখতে থাকে। হঠাত একটা সাদায় কালোয় মেশানো ভালুক দেখে ছলবলিয়ে উঠল। ওসো অ্যান্ডিনো! ঠিক তার বাপ ঠাকুরদার দেশের চশমাধারী ভালুকছানার মত দেখতে। লিমা থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এসে এদেশে বসতি করেছিল প্যাডির ঠাকুরদা। একবার দেশ থেকে ফেরার সময় নাতির জন্য এমনি একটা টেডি এনে দিয়েছিল সিনিয়ার প্যাডিংটন। দেখতে দেখতে চোখ ঝাপসা হয়ে যায় তার। হাতে তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে।

খুব পছন্দ হয়েছে মনে হয়?

ছোটবেলার স্মৃতিতেভিজে টূপূ টুপূ প্যাডি। আজকাল আর দেশে যাওয়া হয় না একদম। ছেলেটাকে এটা উপহার দিতে পারা যায়। নিতে পারি?

ফিচেল হাসল বিম্বো। উঁহু, এখনো তিরিশদিন হয় নি যে।

আবার তিড়িং করে উঠল প্যাডি। তুমি কি বলতে চাও এখানের এতগুলো ভালুক গত একমাসেই জমা হয়েছে।

হয়নি বলে কেন মনে হচ্ছে প্যাডি? এই এয়ারপোর্ট দিয়ে দিনে কতলোক যাতায়াত করে সেটা তো তুমি জানো।   

হেই বাইয়ের এই কথায় কটমট চোখে ওর ল্যাপা পোঁছা মুখটা জরিপ করল প্যাডি। এই দুজনে হাত মিলিয়েছে কেন সেটা বুঝতে হবে। মুখে কিছু না বলে প্যাডি উলটে পালটে আরও কটা ভালুক তুলল। কোথাও কোন ট্যাগ নেই যার থেকে কোন দিন তারিখ পাওয়া যায়। হতাশ হয়ে উইনিকে বলল, এই জন্যই বস বলেছে সব কিছু সঠিকভাবে ট্যাগ করার ব্যাবস্থা করতে।

হাওয়া তার দিকে ঘুরতে উইনি ছটফট করে উঠল। টেডের সঙ্গে কথা হয়েছে আজই। তুমি কি মনে করো আজকেই সব ফেলে যাওয়া জিনিসে ছাপ্পা লাগাতে শুরু করবো?

প্যাডিকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মোটেই খূশি হয় নি। যত তাড়াতাড়ি পারো শুরু করো।

ইয়েস, উই হ্যাভ টু মেক দ্য এয়ারপোর্ট সেফ আগেন। সবার চোখ দরজার দিকে। জ্যামি। তার মুশকো চেহারাটা দরজাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।   

জাম্বাবান্তা ডি সিলভা লোরেকের ডেপুটি।ঘুঁটি বদলেছে, গলার জোরে সেটা বোঝাতে কোন ত্রুটি নেই। লোরেক কেমন যেন কুঁকড়ে গেল, কিন্তু আর সবাই একটু অবাক হয়েই তাকিয়েছিল জ্যামির দিকে। বিম্বো মশকরা করার চেষ্টা করল, জ্যামি এয়ারপোর্টের সুরক্ষার সব দায়িত্ব যেন তুমিই নিয়ে নিয়েছ।

ঠিকই বলেছ। কেন লোরেক কিছু বলেনি? আমিই এখন এই বিমানবন্দরের সুরক্ষাপ্রধান।


বিম্বো ছুটতে পড়তেচলল যোগীর অফিসে। দিশেহারালাগছিল। কি করবে এখন? আর কি বাঁচাতে পারবে না টেডি বেয়ারদের? পাশে পাশে ছুটছিল হেই বাই। কোথায় যাচ্ছো বিম্বো? কি করতে চাও?

বেল্ট এরিয়ার দায়িত্ব হেই বাইয়ের। তার সরু চোখ আর পাতলা ঠোঁটে মুখটা ভাবলেশহীন লাগতে পারে। আদতে খুব ভাল, বিম্বোকে অনেকবার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু বিম্বো ওকে ওখানেই থাকতে বলল। কে জানে প্যাডি যদি আবার ফিরে আসে!   

অফিসে বসে যোগী খুব মনোযোগের সঙ্গে ফেলে যাওয়া জিনিসের খতিয়ান মিলিয়ে দেখছিল। নিয়মমতোতিরিশদিন হয়ে গেলে সবকিছু স্কটসবোরো পাঠিয়ে দেবার কথা। অথবা স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড। কিন্তু তালিকা অনুযায়ী যা দেখা যাচ্ছে, ফেলে যাওয়া জিনিষ সব সময়মতো যে চলে গেছে তেমন নয়। কেন যায়নি তার সদুত্তর সোনিয়ারকাছ থেকেও পাওয়া যায়নি।

সোনিয়া ডিস্পোজাল দেখে। কিন্তু সাজ পোশাক নিয়ে যা ব্যাস্ত! কতটা ঠিকঠাক দেখে সে বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছে যোগীর। কেন যে ব্যালে ড্যান্সারদের মত টুটু স্কার্ট পড়ে, মাথায় বো লাগিয়ে অফিসে আসে রোজ! তাও আবার গোলাপী রঙের!

একসময় ছিলাম তো। ব্যালে ড্যান্সার। তার বাদামী চোখ ছলছলিয়ে বলেছিল সোনিয়া। সার্কাসেও কাজ করেছি। একটা কঠিন কসরতের সময় পা ফসকে পড়ে গিয়ে সবকিছু ছাড়লাম। এই পোশাক আমার সেই জীবনের স্মৃতি।

ব্যালে ড্যান্সার না কচু! বেশ মোটাসোটা চেহারা, কোন ব্যালেতে নেবে? এটা অবশ্য যোগী মনে মনেই বলে। মুখে বলল,কিন্তু সোনিয়া, এখন তো তোমার কাজ যাত্রীদের ফেলে যাওয়া সব জিনিষ স্কটসবোরো পাঠিয়ে দেওয়া। তাহলে সেটা কেন ঠিক সময়ে করছ না।

কেন যোগী, এরকম কেন বলছ? গোলাপি নখ দাঁতে কাটতে কাটতে সোনিয়ার জবাব।

বলছি কারণ আমার এই লিস্টে সেটাই দেখাচ্ছে। দেখেছো তো কি লম্বা একটা লিস্ট হয়ে গেছে। তার মানে বহুদিন ধরে এগুলো ঠিকঠাক যাচ্ছে না।

সোনিয়া ঝুঁকে পড়েছিল যোগীর কম্পিউটার স্ক্রীনে। সাধারণত মেয়েরা তার সামনে ঝুঁকে পড়লে, কিংবা গা ঘেঁষাঘেঁষি করলে যোগী খুশিই হয়। কিন্তু কৃষ্ণবর্ণাদের তার মোটেই পছন্দ নয়। নিজে গাড় বাদামী হলেও। তার ওপর এ মেয়েটা যে কি গন্ধ মেখে আসে কে জানে, মাথা ঝিমঝিম করে।

দেখো যোগী তুমি আমাকে মিথ্যে দোষ দিচ্ছো। এই লিস্টে যে সব জিনিষ দেখাচ্ছে তার কোনটাই ফেলা হবে না কি বিক্রির জন্য পাঠানো হবে সেটা লেখা নেই। আমি তাহলে কি ভাবে ফেলবো? বালুকে বলো।

বালু ওরফে বালাসুব্রামনিয়ামের কাজ জিনিসের মূল্য যাচাই করে দেখা। কোন জিনিশ বিক্রি করে লাভ, কোনগুলো স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে যাবে – হিসেব কষে ঠিক করে। যোগী বূঝল সোনিয়াকে বলে লাভ নেই, বালুকে ধরতে হবে। কিন্তু সোনিয়া এই লিস্টে সব কিছু আছে কি না সেটা কি তুমি জানো?

সোনিয়া এতক্ষণে চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে আড়মোড়া ভাঙছিল। যোগীর গলায় হালকা উত্তেজনার ছোঁয়াকে পাত্তা না দিয়ে বলল, আমার জানার কথা নয়। বিম্বোর কাছে সব কিছু এসে জড়ো হয়। ওর কাজ সেসব লিস্টে আপডেট করার। আমি তো শুধু তিরিশ দিন হয়ে গেলে ঠিকঠিক জায়গায় সব কিছূ পাঠিয়ে দিই।

যোগীর রাগটা বাড়ছিল। এবার দাঁত খিচিয়ে উঠল। বালু যে তিরিশ দিনের পরেও এগুলো পাঠানোর কথা বলছে না, তুমি কেন ওর সঙ্গে কথা বলো নি? ব্যালে ডান্স করছিলে?

সোনিয়ার গলা কান্নায় বুঁজে এলো। যোগী, দ্যাটস ভেরি রুড। আমি বালুর ম্যানেজার নই। তোমার ওকে জিজ্ঞেস করার কথা, আমার নয়।

এমনি নাটকীয় ডায়ালগ ঝেড়েসে তো হনহন করে বেরিয়ে গেল, যোগীর এদিকে মাথায় হাত। টেডের কাছে আবার ডাক পরার আগেই কিছু করতে হবে! বালুকে খবরপাঠাল। বালু সবে লাঞ্চবক্স খুলে তার তেঁতুল ভাত মাইক্রোওয়েভে গরম করছিল। এখন যদি না খেয়ে বসের ঘরে যাওয়ার জন্য দৌড়ায় আবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। দুবার করে গরম করলে কেমন কড়কড়ে হয়ে যায়। সেটা মোটেই ঠিক হবে না। তাই বালু প্রথমে আয়েশ করে তেঁতুল ভাত খেয়ে নিল। বেড়ে হয়েছিল আজ। সম্বর ভাতের থেকেও ভাল। খাওয়া সাঙ্গ করে যখন যোগীর ঘরে পৌছাল তখন তিনি একেবারে টগবগ ফুটছেন। এতক্ষণে আসার সময় হল তোমার?

কেউ কি মারা গেছে? যায়নি। আমি যদি আগে চলে আসতাম তখন আমার তেঁতুল ভাতের গতি হয়ে যেত। আমি কি দিয়ে লাঞ্চ করতাম? আর আজকে তেঁতুল ভাতটা যা হয়েছিল না! জিভে টকাস করে আওয়াজ করে বালু। নতুন একটা গ্রসারি স্টোর হয়েছে আমাদের নেবারহুডে, ইউ শুড ট্রাই দিজ ওয়ান ডে। আনবো একদিন তোমার জন্য?

বালু কখনোই কাফেটারিয়ায় খায় না, অ্যামেরিকান খাবারে নাকি তার অম্বল হয়। কিন্তু তার এইসব খাদ্য বিশ্লেষণে কোন আগ্রহই ছিল না যোগীর। সে সোজা কাজের কথায় এলো। ফেলে যাওয়া জিনিসের তালিকাটা বালুকে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এত জিনিষ কেন জমে যাচ্ছে বালু? ফেলা হবে নাবিক্রির জন্য পাঠান হবে সেটা সময়মত ডিস্পোজালকে জানাচ্ছো না কেন?

বালু বেজারমুখে বসেছিল। ভরপেট ভাত খেলে এই সময়ে তার চোখটা একটু জুড়িয়ে আসে। মস্ত হাই তুলে বলল, অ, এই কথা। এতো তুমি জানো। আমার একার পক্ষে এত লম্বা লিস্ট ধরে সব জিনিষ সময়মত যাচাই করে দেখা সম্ভব নয়। তোমাকে বলেছিলাম এ কাজে আরও লোক চাই, তুমি কি দিয়েছ?

লোক চাই, লোক চাই, লোক চাই! আমার কাছে কি লোক বানানোর মেশিন আছে, যে চাইলেই দিয়ে দেবো।

আমিও কোন যন্তর নই যোগী। আমার যতটুকু সময় ততটাই কাজ এগোবে, না হলে এমনি জমে যাবে জিনিষ। ব্যাস!

যোগী এবার অন্য পথ ধরে। শুনেছ তো লোরেকের খবর। টেড যে কোন সময় যা ইচ্ছা করতে পারে। বুঝতে পারছ তো কি বলছি?

বালু বিন্দাস। চাকরি যাবার ভয় দেখাচ্ছ যোগী? সে ভয় তো যেদিন এদেশে এসেছি তখন থেকেই। কপালে থাকলে হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে?

ও। ঠিক আছে। তাহলে যেগুলো তিরিশ দিনের বেশী হয়ে গেছে আমি সব স্ক্র্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তোমার যা ইচ্ছে। ভালই হল আর কোন ব্যাকলগ রইল না আমার জন্য। উথালপাথালহীন মুখে বলল বালু। আমি তবে যাই। দুলকি চালে বালুর চলে যাওয়ার ছিরি দেখে গাটা রি রি করে উঠল যোগীর। এখন কি করে?

লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বিম্বো ঢুকল তখনই। যোগী এমনিতেই ডাকতে যাচ্ছিল। বিম্বোধরা এসে পড়ায় বালুর উপরের যত রাগ গলগলিয়ে বেরিয়ে এল। সমাজসেবা শেষ হল তোমার? এবার একটু কাজের কথা বলো তবে। যাত্রীরা যেসব জিনিষ ফেলে যায়, সব কি এই লিস্টে এসে গেছে?

অলমোস্ট, কিন্তু কিছু জিনিষ রয়ে গেছে। ফিকে হাসল বিম্বো। আসলে একা হাতে এতসব করতে হয়। সময় পাওয়া যায় না।

সমাজসেবার জন্য বেশ সময় পাচ্ছো কিন্তু। টেডি বেয়ারদের সঙ্গে ছবিও তুলছ।

যোগীর টিটকিরি গায়ে মাখল না বিম্বো, ছবি তোলার ব্যাপারটাও চাপা দেওয়া চাই। কি ব্যাপার জানো? আজকাল সেলফি তুলতে ব্যাস্ত যাত্রীরাও বেশী ভুলমনা হয়ে গেছে। আগের থেকে অনেক বেশী জিনিষ এয়ারপোর্টে ফেলে চলে যাচ্ছে।

ব্যাস, এরও বাহানা শুরু হল, রাগ আর চাপতে পারল না যোগী। সোজা কথায় বলো, যে জিনিষ রয়ে যাচ্ছে, তার সবগুলো এই লিস্টে আসছে কি না।

কি করবে বিম্বো? এখন এও যদি বিগড়ে যায়, টেডি বেয়ারগুলোকে বাঁচাবে কি করে? যা থাকে কপালে, যোগীই তার একমাত্র ভরসা, যে করেই হোক মন গলাতে হবে।সে যোগীর কাছে ঘন হয়ে আসে। এত কাছে যে জোরে নিঃশ্বাস নিলে ছুঁয়ে দিতে পারে। যোগীর লিচু চোখে যে রস গড়াবে তাতে আর আশ্চর্য কি। বিম্বো কান্না মেশানো আদুরে গলায় বলল, যোগী স্যার, হেল্প মি ফ্রম প্যাডি। আমি ট্র্যাক করবো বলেই লিস্টে না থাকা জিনিসগুলো আলাদা ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলাম, প্যাডি দরজা খুলিয়ে হম্বিতম্বি করছে। লিস্টে নেই কেন জানতে চাইছে।

যোগী আলগোছে বিম্বোর কাঁধেহাত রাখল। ধুরন্ধর, চাকে কখন মউ জমে গন্ধে টের পায়। দুপুর থেকে যে ইচ্ছাটা চাগাড় দিচ্ছিল, এবার ঠিক মওকা পাওয়া গেছে। মেয়েটাও যেন তার কাছে ধরা দেওয়ার জন্যই এসেছে আজ। কি লুকোতে চাইছে মেয়েটা? কাজের গাফিলতি থেকে চাকরি যাবার ভয়ে? মনের ভাব চেপে নরম গলায় পুলটিস দিল। কি হয়েছে বিম্বো? কোন ভয় নেই। আমাকে খুলে বল, আমার কাছে কিছু লুকিও না।

আমাকে ফাঁসাবে না তো? সবাই বলে তোমাকে নাকি বিশ্বাস করা যায় না।

না রে বাবা, ওদের এইসব মিথ্যের অর্ধেকও সত্যি নয়।

যোগীর কথার মাথামুন্ডু উদ্ধার করতে না পারলেও, সেটাই আশ্বাসবানী ধরে নিয়ে মেয়েটা একটু নিশ্চিন্ত হয়। ইউ আর মাই রিয়াল ফ্রেন্ড যোগী, সব বলছি। যোগীর আপাত দ্বিধাগ্রস্তহাত এবার খুব সাহসী হয়ে উঠেকাঁধ থেকে পিছলিয়ে নেবে পটাং করে বিম্বোর ব্রায়ের হুকটা খুলে দিল।বিম্বো এতটা ভাবেনি।একেবারে আঁতকে উঠল, নো যোগী নো। কিন্তু বাধায় সে জোর নেই যেটা যোগীর মত ঘাঘু মালকে আটকাতে পারে। সময় নষ্ট করার লোকও সে নয়। তার বাড়ানো নখএখন বিম্বোর শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেকে ছেড়ে দিতে দিতে বিম্বো কাতর গলায় বলল, তুমি ওদের বাঁচিয়ে দেবে তো যোগী? প্রমিস?

যোগীর হাত বিম্বোর বুকের চূড়ায়এসে থমকে গেল। চোখ সরু। অবাক। কাকে বাঁচাবো?

মাই টেডি বেয়ারস। ওদেরই তো রেখেছি আমি ওই দুটো রুমে।

কিন্তু কেন?

ওদের কেউ ক্লেম করেনি। দামও বেশী না। তাই লিস্টে রাখলে বালু এতদিনে স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দিত।

কেন রাখতে হবে ওইগুলোকে?

কি বলছো যোগী? ওই নরম তুলতুলে আদুরে বেয়ারগুলো স্ক্র্যাপড হয়ে যাবে! তুমি ভাবতে পারো? আমরা তো আগে কখনো করিনি।

যোগী এতক্ষণে বিম্বোকে পুরোপুরি নিজের দুইহাতের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। ভাবা হয়ে গিয়েছে কি করতে হবে। বিম্বোর ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে দিল। তুমি ওদের এত ভালবাসো বিম্বো? ওদের জন্য সবকিছু করতে পারো?

বিম্বো হাঁফাচ্ছিল, হ্যাঁ যোগী, আমি সব করতে পারি। কিন্তু ওদের বাঁচাতে হবে। আমি হয় ওদের মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেবো, নাহয় এয়ারপোর্টেই রেখে দেবো। তার জন্যে যা করতে হয় করবো।

নো ওরিস। তুমি যেমন ওদের ভালবাস, আমিও তোমাকে অতটাই ভালবাসি বিম্বো ডিয়ার। আই উইল হেল্প ইউ। কিন্তু নিয়মের মধ্যে থেকে। আগে এক কাজ করো তুমি, সমস্ত টেডিকে এই লিস্টে অ্যাড করে দাও। চলো আমি আর তুমি ওই ঘরে যাই, গিয়ে সমস্ত টেডিকে আজকেই লিস্টের মধ্যে নিয়ে ফেলি।

এমনিতেই এই ঘরে সেফ লাগছিল না যোগীর, কোন মুহূর্তে ব্যালে ডান্সের নৈশব্দে সোনিয়া ঘরে ঢুকে যাবে। বিম্বোর সঙ্গে তাঁকে এই অবস্থায় দেখলে একটা মিথ্যা কানাকানি হবে। তার চাইতে ওই টেডির ঘরটাই ভাল। কাজও হবে, বিম্বোকে নিশ্চিন্তে কাছেও পাওয়া যাবে।

ইটস আ ডিল যোগী? তুমি ওদের বাঁচাবে তো? আশান্বিত বিম্বোকে আরো কাছে টেনে নেয় যোগী। মাই ওয়ার্ডস বেবী, তোমার টেডি বেয়ারদের সব দায়িত্ব আমার।


টেডের ঘরে আজ আবার সবাই। ফারাকের মধ্যে লোরেকের বদলে বুক চিতিয়ে বসেছিল জ্যামি। যোগী যখন ঢুকল প্যাডি সবিস্তারে তার বন্ধ ঘরের অভিযানের কথা বলছিল। শুনতে শুনতে টেড যে কি করবে আর কি করবে না বুঝতে পারছিল না।

কি বলছ? এক ঘর জুড়ে? নামগোত্রহীন সব এখানে এসে জুটল কি করে? তাছাড়া যে কোন সময়ে বিস্ফোরণ হতে পারত।

ওগুলো নেহাতই বাচ্চাদের খেলার টেডি বেয়ার, বিস্ফোরণ কেন হবে? যোগী টেডকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল একবার। শত হলেও বিম্বোকে কথা দিয়েছে।

তুমি কি জানো ওতে গোলাবারুদ আছে কি নেই? টেড তীব্র চোখে ভস্ম করল যোগীকে। জ্যামি তোমার কি মনে হয়? ওগুলো কি শুধুই বাচ্চাদের খেলার টেডি বেয়ার? ক্যান উ কনফার্ম?

কি করে বলবো টেড? এগুলো কোনরকমের সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতার বাইরে রাখা ছিল। যতক্ষণ না একেকটা ধরে ধরে পরখ করে দেখা হচ্ছেএরকম সার্টিফিকেট আমি দিতে পারব না।

তাহলে যোগী? তুমি বলো এগুলো কিভাবে চোখ এড়িয়ে ওই ঘরে গেল? আমাদের এখন কি করা উচিত?

যোগী বুঝল হাওয়া সুবিধের নয়। বিম্বোকে কথা দিয়েছিল ওগুলোকে বাঁচাবে। কিন্তু আপনি বাঁচলে বিম্বোনাম। তাই টেডকে শান্ত করার চেষ্টা করল। টেড, আমি সবগুলোকে লিস্টের মধ্যে নিয়ে নিয়েছি। তিরিশ দিনের মধ্যে কেউ ক্লেম না করলেই আমরা আইনত স্ক্র্যাপ করে দিতে পারব।

জাহান্নমে যাক তোমার তিরিশ দিন। আই উইল স্ক্র্যাপ দেম টুডে। প্যাডি চাবি আনাও। আমরা এখনই সবাই ওখানে যাবো। জ্যামি ওই ঘর থেকে সব কটা টেডিকে বিস্ফোরকের জন্য পরীক্ষা করাও, এখনই। আই উইল মেক দ্য এয়ারপোর্ট সেফ আগেন। আর হ্যাঁ, গিঙ্কোকে বলতে হবে নিউজ চ্যানেলগুলোকে খবর দিতে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই ভাল। হাওয়া মোরগের মত সবার দিক পরিবর্তন হয়ে গেছে, টেডের কথাই ঠিক। আজকেই, আজকেই! সমস্বরে সবাই জানান দিল।

উইনি সবার আগে, সত্যিই তো, এয়ারপোর্ট যদি টেডি বেয়ারে ভরে যায়, আমরা যাবো কোথায়?

প্যাডির জিঘাংসা আরও বেশী। একটাকেও ছাড়া হবে না, সব যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফেরত পাঠাবো।

বিম্বোর সঙ্গে ফুর্তি লোটার কথা পুরোপুরি গিলে ফেলে এতক্ষণে স্বমূর্তি ধরেছে যোগী। তাছাড়া বসের সঙ্গে গলা মেলানোর সুযোগ ছাড়বে কেন? হাত দিয়ে গলা কাটার ভঙ্গী করল, হ্যাঁ, আর তা না হলে স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে।

সবাই মিলেমিশে যাবার হাসি ফুলেফেঁপে উঠছিল ঘরে। নিজেদের জায়গাটা শক্ত রাখতে পারার খুশিও ধরছিল না।

টেড গিঙ্কোকে খবর দিয়ে নিউজ চ্যানেলকে ডাকতে ডাকতে প্যাডি চাবি নিয়ে হাজির।

এবার টেড গটগট করে তিন নম্বর বেল্টের দিকে রওয়ানা দিল। একটু ঝুঁকে, হাত দুটো হাঁটু অবধি ঝুলে পড়েছে। শিকার ধরার আনন্দে আঙ্গুলগুলো খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। তার পিছনে প্যাডি তিড়িং বিড়িং আনন্দে, আজ একটা কাজের মত কাজ করে বসের নেক নজরে পড়া গেছে। জ্যামি বুক ফুলিয়ে চলেছিল। নতুন পদ নেবার দুদিনের মধ্যে এত বড় একটা কাজ করতে পারছে। ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে। উইনি বুঝতে পারছিল এর পরে আর লোরেকের নিজের পদে ফিরে আসার সম্ভাবনা রইল না। একসঙ্গে বসে কফি খাওয়াটা খুম মিস করবে। কি আর করা যাবে। সবাইকে নিজেরটা দেখতে হবে। চললটেডের পিছন পিছন। সবার পিছনে যোগী। ওর নিজের কিছু এসে যায় না। তবে ব্যাপারটা তিরিশ দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারলে বিম্বোর সঙ্গে আর একটু ফস্টি নষ্টি করা যেতো। এর পরে আর ওর ধারে কাছে ঘেঁষা যাবে না।

প্রথম ঘরটায় পৌঁছে চাবি লাগাতে লাগাতে একবার পিছনে ঘুরল প্যাডি। চশমার নিচে চোখদুটো আনন্দে জ্বলজ্বল করছিল। মুখে কান পেঁচানো হাসি। কিন্তু দরজা খুলেই আঁতকে উঠল। একদম খালি, কিচ্ছু নেই। টেড মুখের কাছে বাড়িয়ে দেওয়া মাইকে নিউজ বাইট দিচ্ছিল। থমকে গেল। প্যাডি, অন্য ঘরটা দেখো। প্যাডি পড়ি কি মরি করে অন্য ঘরটা খুলতে দৌড়াল। কিন্তু সে ঘরেও কিছু নেই, সব ভোঁ ভা।

টেড এতক্ষণে রাগে ফেটে পড়বার আগের মুহূর্তে পৌঁছে গেছে।জ্যামি, কোথায় গেল সব? তোমার সুরক্ষা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে?

জ্যামিকে উত্তর দিতে হল না আর।

তিন নম্বর বেল্ট চলতে শুরু করেছিল।তারপর একে একে সব কটাই। বেল্টের উপর একের পর এক বসানো বিভিন্ন আকারের, বিভিং মডেলের টেডি বেয়ার ঘুরে ঘুরে বেরিয়ে আসছিল। সবার হাতেই একটা করে প্ল্যাকার্ড, বক্তব্য একটাই– সেভ মি, টেক মি হোম।

ক্যামেরার মুখ এতক্ষণে বেল্টগুলোর দিকে ঘুরে গেছে। টেড, প্যাডি, জ্যামি, উইনি, যোগীর চোখও। সমস্ত বেল্টে গোল গোল করে ঘুরছে টেডি বেয়ারগুলো। অনেক রঙের, হরেক ঢঙ্গের। ছোট বড়, কিন্তু সবারই একটা থাকার জায়গা চাই। ব্যাগেজ তুলতে আসা যাত্রীরা প্রথমে অবাক। তার পরে একজন একটা ভালুক তুলে নিল। তারপর আর একজন। বেশ হুড়োহুড়িই পড়ে গেল। হেই বাই কনভেয়রের মুখটায় দাঁড়িয়ে ছিল। বিম্বো দৌড়ে গিয়ে তার গালে চকাস করে একটা চুমু খেতেই বুড়ো হেই বাইয়ের চোখ হাসিতে বুঁজে গেল, সেই জন্য টেডের হাত পা ছোঁড়া ভাল করে দেখতেও পেল না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ