সপ্তাহান্তরে হাটে কখনো ঘন বরিষণ দিনগুলোতে আমার বাবা কচু বা কচুশাক বিক্রি করত এক সময়। এ নিয়ে তার একটা বিরাগ ও মনকষ্ট থাকতে পারে বলে ধারণা করি, আবার তা নাও হতে পারে, হয়তো কোন অনুভূতিই ছিলনা সে নিয়ে। হাটে যখন তাকে কেউ এই বলে ডাকত যে ওই ‘কচু-ওয়ালা’, বাবা তখন বলত, “আরে কচু-ওয়ালা কও কেয়া, চোখে দ্যাখও না এইগুলা যে কচুশাক, কচু না, কচুরশাক”। এর গুঢ়ার্থ বোঝার সামর্থ আমার বয়সের কারণেই কম ছিল, ফলে প্রথমে বুঝতাম না ‘কচু-ওয়ালা’ কিংবা ‘কচুশাকওয়ালা’ ডাকলে এমন তফাৎ কী ?
হাটের দিনের আগের সন্ধ্যায়, মোদের বাড়ীর শ্রাবণের ভরা নিচু ভূমির জলে-ডোবা ভিটা হতে যখন বাবা প্রায় ডুবিয়ে কচুশাক তুলতো, পরেরদিন হাটে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি হিসাবে, তখন তার ওইমত কান্ডে মা বলত “কচুর লগে আবার পাতাগুলা লয় কেয়া, পানিকচুর পাতা কেডা খায়, বোঝা বাড়াইয়া লাভ কী?” বাবা উত্তর করত-“কচুর মুড়ার লগে পাতা লইলে তা আর বেচবার জন্য কচু থাকে না, তা হয় ‘কচুশাক’”। বাবা নিজে বিবেচিত হতো ‘বোকার-হদ্দ’ যে ধারণা, সেই মতন লোক, মা তুলনায় তার চাইতেও বেশী বোকা; তো মা বোকা বিবেচনা ক্ষমতায়, সেই ‘কচু ও কচুশাক’এর তফাৎ অথবা তার বিষদ ব্যাখ্যার বিষয় সম্বন্ধে কী বুঝত কে জানে, যদিও ততদিনে আমি এর তফাৎ বুঝতাম ও জানতাম, এবং সত্য হচ্ছে যে, তখনও আমার সে বিষয়ে বোঝার বা জানবার যে বয়স হয়নি সেটাই তর্ক নতুবা গল্পের খাতিরে এখন ধরে নেয়া ভাল। তবে- কী উদ্দেশ্যে বাবা পানিকচুর মুড়া বেচতে গিয়ে সংগে পাতা নিচ্ছে সে সম্পর্কে ভাবতাম মা’কে কখনো বুঝিয়ে বলব যে- কী হেতু বাবা বাড়তি কাজ কচু লয়ে করে থাকে ‘শাক’ ও ‘মুড়া’ প্রসঙ্গে। যেহেতু আমি বাবার সংগে হাটে যেতাম, সে সুবাদে আমার দেখার সুযোগ হত, বাবা কেমন করে তাকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘কচুশাক-ওয়ালা’ডাক প্রত্যাশা করত, ‘কচু-ওয়ালা’ শোনার চাইতে। এটা আমি নিজে বুঝলেও মাকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। কারণ ভাল করে কথা বলায় আমার অসুবিধা ছিল। অর্থাৎ, দীর্ঘ কোন বাক্য শেষ করতে গেলে আমার বাক ক্ষমতা রুদ্ধ হয়ে যেত, বিশেষ করে যদি কিছু বুঝিয়ে বলতে চাইতাম। কোনও বাক্য সম্পুর্ন করতে চাইলেই এ সমস্যা হতো। ‘হা’, ‘না’, ‘জানিনা’, ‘বলব’, ‘যাই’, ‘আসি’, এ রকমসব গুটিকয়েক শব্দসহ আরও কিছু শব্দের দক্ষিণ বরিশালের উচ্চারণে বলতে পারতাম। লোকজন বলত "এইডা হইল যাইয়া অর বাফ-মায়ের অবোধ পোলা, কথা কয় না, কইতে পারেও না"। সেই কথা না বলতে পারা, অবোধ কাল সময়ে যখন হাটে একদিন বাবাকে একজন এসে বলল, “ও ‘কচু-মেয়া’”, বাবা তর উত্তরে যৎসামান্য থেমে থেকে বলে, “কী হইছে? কী হইছে? মোর নাম নাই? এরপর কচুর পাতাগুলোর দিকে তার হাতখানা ধরে বলে, “এই গুলা কী? এইগুলা কী শাক না? কচুর শাক”। ওই লোক তারপর আরও যোগ দেয়; বলে, “আরে ‘কচুর-পো-কচু’, ব্যাচও কচু, আবার গলায় হাঁক দিয়া কথা!”। আমি স্বভাবতই পাশে দাঁড়ানো, বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখতে চাই তারপর বাবা কী করে। আমি অনুভব করতে পারি, বাবা যুক্তিহীন মারমুখী লোকটিকে কিছু অন্তত ফিরিয়ে বলতে চায়, তাকে কচুওয়ালা বলবার উত্তরে, কিন্তু সে বলতে সক্ষম হয়না, স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নিরব, শুধু তাকিয়েই থাকে, তাকিয়েই ছিল। আমি বাবার ওরকম তাকানো দেখে ভেবে রাখি- মাকে বলব, “মা, বাবা তো দেখি আমার মতনই, কথা বলতে পারে না”। যদিও সে কথাও বলতে পারিনা মা’কে, কেনোনা আমার তখনও গুছিয়ে বলার দক্ষতা হয়নি। এমন কী এও ভেবে রেখেছিলাম যে, মাকে বলব- ‘মা সে মুহুর্তে বাবার চোখটা দেখতে কেমন যেন লেগেছিল’। সে চোখ প্রকৃতপক্ষে কেমন লেগেছিল বা তার কারণ সে সবের কোন ব্যাখ্যা যথারীতি জানা ছিল না। তারও অনেক বছর পর জেনেছিলাম বাবার অমন নির্ভিক তাকিয়ে থাকাকে ‘নির্বাক অসহায় তাকানো’ বলা যেতে পারে। যেহেতু তার চোখ দেখতে অত্যন্ত সুন্দর তাই এ উপমাও যুতসই হবে- ‘সুন্দর চোখের নির্বাক তাকানো’। অমন ভাবে তাকানোর সকল অর্থ লয়ে হয়ত বাবা বলতে চেয়েছিল ‘কচু-ওয়ালা না ডেকে কচুশাকওয়ালা ডাকতে পার না’? বড়জোর এটুকুই বলতে চাওয়ার ছিল, হয়ত এইটুকুই চাওয়াও। এই যৎসামান্য যৌক্তিক চাওয়ার কারণ সম্ভবত হাটে-ঘাটে তার মর্যাদার অনুমাত্র সন্তুষ্টি খোঁজা, হয়তো বাড়তি খানিকটা সন্মান অর্জনেরও চেষ্টা ছিল!
হাটের দিনের আগের সন্ধ্যায়, মোদের বাড়ীর শ্রাবণের ভরা নিচু ভূমির জলে-ডোবা ভিটা হতে যখন বাবা প্রায় ডুবিয়ে কচুশাক তুলতো, পরেরদিন হাটে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি হিসাবে, তখন তার ওইমত কান্ডে মা বলত “কচুর লগে আবার পাতাগুলা লয় কেয়া, পানিকচুর পাতা কেডা খায়, বোঝা বাড়াইয়া লাভ কী?” বাবা উত্তর করত-“কচুর মুড়ার লগে পাতা লইলে তা আর বেচবার জন্য কচু থাকে না, তা হয় ‘কচুশাক’”। বাবা নিজে বিবেচিত হতো ‘বোকার-হদ্দ’ যে ধারণা, সেই মতন লোক, মা তুলনায় তার চাইতেও বেশী বোকা; তো মা বোকা বিবেচনা ক্ষমতায়, সেই ‘কচু ও কচুশাক’এর তফাৎ অথবা তার বিষদ ব্যাখ্যার বিষয় সম্বন্ধে কী বুঝত কে জানে, যদিও ততদিনে আমি এর তফাৎ বুঝতাম ও জানতাম, এবং সত্য হচ্ছে যে, তখনও আমার সে বিষয়ে বোঝার বা জানবার যে বয়স হয়নি সেটাই তর্ক নতুবা গল্পের খাতিরে এখন ধরে নেয়া ভাল। তবে- কী উদ্দেশ্যে বাবা পানিকচুর মুড়া বেচতে গিয়ে সংগে পাতা নিচ্ছে সে সম্পর্কে ভাবতাম মা’কে কখনো বুঝিয়ে বলব যে- কী হেতু বাবা বাড়তি কাজ কচু লয়ে করে থাকে ‘শাক’ ও ‘মুড়া’ প্রসঙ্গে। যেহেতু আমি বাবার সংগে হাটে যেতাম, সে সুবাদে আমার দেখার সুযোগ হত, বাবা কেমন করে তাকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘কচুশাক-ওয়ালা’ডাক প্রত্যাশা করত, ‘কচু-ওয়ালা’ শোনার চাইতে। এটা আমি নিজে বুঝলেও মাকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। কারণ ভাল করে কথা বলায় আমার অসুবিধা ছিল। অর্থাৎ, দীর্ঘ কোন বাক্য শেষ করতে গেলে আমার বাক ক্ষমতা রুদ্ধ হয়ে যেত, বিশেষ করে যদি কিছু বুঝিয়ে বলতে চাইতাম। কোনও বাক্য সম্পুর্ন করতে চাইলেই এ সমস্যা হতো। ‘হা’, ‘না’, ‘জানিনা’, ‘বলব’, ‘যাই’, ‘আসি’, এ রকমসব গুটিকয়েক শব্দসহ আরও কিছু শব্দের দক্ষিণ বরিশালের উচ্চারণে বলতে পারতাম। লোকজন বলত "এইডা হইল যাইয়া অর বাফ-মায়ের অবোধ পোলা, কথা কয় না, কইতে পারেও না"। সেই কথা না বলতে পারা, অবোধ কাল সময়ে যখন হাটে একদিন বাবাকে একজন এসে বলল, “ও ‘কচু-মেয়া’”, বাবা তর উত্তরে যৎসামান্য থেমে থেকে বলে, “কী হইছে? কী হইছে? মোর নাম নাই? এরপর কচুর পাতাগুলোর দিকে তার হাতখানা ধরে বলে, “এই গুলা কী? এইগুলা কী শাক না? কচুর শাক”। ওই লোক তারপর আরও যোগ দেয়; বলে, “আরে ‘কচুর-পো-কচু’, ব্যাচও কচু, আবার গলায় হাঁক দিয়া কথা!”। আমি স্বভাবতই পাশে দাঁড়ানো, বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখতে চাই তারপর বাবা কী করে। আমি অনুভব করতে পারি, বাবা যুক্তিহীন মারমুখী লোকটিকে কিছু অন্তত ফিরিয়ে বলতে চায়, তাকে কচুওয়ালা বলবার উত্তরে, কিন্তু সে বলতে সক্ষম হয়না, স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নিরব, শুধু তাকিয়েই থাকে, তাকিয়েই ছিল। আমি বাবার ওরকম তাকানো দেখে ভেবে রাখি- মাকে বলব, “মা, বাবা তো দেখি আমার মতনই, কথা বলতে পারে না”। যদিও সে কথাও বলতে পারিনা মা’কে, কেনোনা আমার তখনও গুছিয়ে বলার দক্ষতা হয়নি। এমন কী এও ভেবে রেখেছিলাম যে, মাকে বলব- ‘মা সে মুহুর্তে বাবার চোখটা দেখতে কেমন যেন লেগেছিল’। সে চোখ প্রকৃতপক্ষে কেমন লেগেছিল বা তার কারণ সে সবের কোন ব্যাখ্যা যথারীতি জানা ছিল না। তারও অনেক বছর পর জেনেছিলাম বাবার অমন নির্ভিক তাকিয়ে থাকাকে ‘নির্বাক অসহায় তাকানো’ বলা যেতে পারে। যেহেতু তার চোখ দেখতে অত্যন্ত সুন্দর তাই এ উপমাও যুতসই হবে- ‘সুন্দর চোখের নির্বাক তাকানো’। অমন ভাবে তাকানোর সকল অর্থ লয়ে হয়ত বাবা বলতে চেয়েছিল ‘কচু-ওয়ালা না ডেকে কচুশাকওয়ালা ডাকতে পার না’? বড়জোর এটুকুই বলতে চাওয়ার ছিল, হয়ত এইটুকুই চাওয়াও। এই যৎসামান্য যৌক্তিক চাওয়ার কারণ সম্ভবত হাটে-ঘাটে তার মর্যাদার অনুমাত্র সন্তুষ্টি খোঁজা, হয়তো বাড়তি খানিকটা সন্মান অর্জনেরও চেষ্টা ছিল!
এসব কিছুর পর এক পর্যায়ে আমি ঢাকায় আসি, এক সাহেবের দপ্তরে চা-নাস্তা দেয়ার কাজে যোগ দেই। পরে জেনেছিলাম সেটা একটা সংবাদপত্রের কার্যালয়। পেশা ভিত্তিক পরিচিতিতে ঠিক ‘কাজের-ছেলে’ না, সম্পাদকের ‘অফিস কক্ষের সহকারী’। এও অবগত হলাম উক্ত দপ্তরের সবাই সাংবাদিক, তারা অতিশয় বড় মানুষজন, অধিকন্ত ভাল মানুষ, তাই আমাকে ‘কাজের-ছেলে’ বা ‘কাজের-লোক’ না ডেকে, 'অফিস-সহকারী' সম্বোধনে ডাকত, আসলে ডাকত কী? বলত। একদিন সম্পাদক স্যারের ঘরে দু’জন অতিথি এসেছেন, তাদের জন্য সিঙ্গারা, চা সহ স্যারের কক্ষে গেছি, উপস্থিত অতিথি-দ্বয়ের একজন ছিলেন নারী,পরে জেনেছি বর্ননায় এহেন নারীকে ‘অপরূপ সুন্দরী’ পরিভাষায় বর্ননা করা যায়, যার পরনে জিনসের প্যান্ট ও ছেলেদের মতন শার্ট। সেই প্রথম কোন নারীকে এমন পোষাকে আমার দেখা, তিনি সম্পাদক স্যারকে বললেন, “আপনাদের অফিসের কাজের ছেলেটির দেখি অপূর্ব চোখ! দেখি দেখি”, তিনি এই বলে হাতের ইঙ্গিতে যেন আমাকে দাঁড়াতে বললেন, যখন আমি টেবিলে চায়ের কাপ, সিঙ্গারার প্লেট রেখে ফিরে যাচ্ছিলাম। সম্পাদক স্যার যখন সে কথার উত্তরে বলছেন যে, ‘হ্যাঁ ও আমাদের অফিস সহকারী’, যখন টেবিলটার পাশে দাঁড়িয়ে বাম হাতে ট্রে-টা ধরে বুকের উপর রেখে ডান হাতের আঙ্গুল চোখের দিকে রেখে বলতে পেরেছিলাম “বাবার মতন”, এরপর কেঁদে ফেললাম। প্রকৃত অর্থে বলতে চেয়েছিলাম, “আমার চোখ হচ্ছে বাবার মতন”, তা আর বলতে পারলাম না। সে সময় অনেকদিন পর আবারো অনুভব করলাম আমি কার্যত তখনো কথা বলতে পারি না। ভদ্র মহিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এরপর ইংরেজিতে যা বললেন তার মর্মার্থ হচ্ছে নাকি ‘আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি, দুঃখিত’ ইত্যাদি। আমি অচিন ভাষার কথার অর্থ না বুঝতে পারলেও যেভাবে তিনি বুকে নিয়েছিলেন তাতে মানুষটির অন্তর উপলব্ধি করায় অসুবিধা হয়নি,কেননা ভাব প্রকাশ করতে না পারার ব্যর্থতার চলাকালে সেভাবে মা ছাড়া অন্য কেউ এমন ভাবে নেয়নি কোনদিন। সম্পাদক স্যার বললেন, “গত মাসে ছেলেটির বাবা মরে গেছে, সে কারণে মনটা নরম আছে। বললাম যা, গ্রামে যা, ঘুরে আয়। ওর ভিন্ন কথা, ওর নাকি মৃত্যু, কবর এমনসব পছন্দ নয়, মা মরেছে নাকি তারও আগে”। আমি শুন্য ট্রে হাতে স্যারের কক্ষ হতে বেরিয়ে আসি তখন। পরে শুনেছি, কে যেন আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল সেই ভদ্র মহিলা হলও আমেরিকার উচ্চ শিক্ষিত ফেরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এরও অনেকপরে দু’একবার ভেবেছি সেই মহিলাকে, জিনস পড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কী আমার উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন লেন্সের চশমা পড়া, জামার হাতা গুটানো সম্পাদক স্যার, এদের খুঁজব, সে আর হয়না। যেসব জায়গায় আমার অভিজ্ঞতায় একদা সামান্যতমও আদর ভালবাসার ছোঁয়া থাকবে সেসবে কস্মিনকালেও আমার ফিরে যাওয়া হয়না, তা কখনোই না।
সেই- সে-ক্ষণে বাবার কচুর-শাক বিষয়ে দেখা অসহায় চোখ, যা কিনা সন্তান হিসাবে আমাকে তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছিল, যেখানে হাটের অতি পরিচিত ‘ল্যাংড়া-খোঁড়া-ভিক্ষুক’, যাকে সবাই ‘মরা’ ডাকত, তো ‘মরা’ আমার উদ্দেশ্যে বলে, “ও ব্যাডা, বেপারীর পো, তোমার বাফরে মানুষেরা ভণ্ড কথা কয়, তুমিও তো দুইডা খামার-গালি দিতে পারো?”। ‘মরা-ভিক্ষুক’এর কথা শুনে যেন বাবা ভাষা ফিরে পায়, ভিক্ষুককে বলে, “না মিতা, বেপারির পো, যার ঠিক মতন জবান নাই, হে দেবে আবার গালি। হ্যার যেন মানুষরে কটুকথা কওনের ক্ষেমতা নাই হয়”। বাবা ‘মরা’কে ‘মিতা’ সম্বোধন করত, যেহেতু তাদের দু’জনের অভিন্ন নাম। আমি খোঁড়ার কথা শুনি আর কাদা খোঁচাতে থাকি পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে, একই সময়ে মনে-মনে বাবাকে কষ্ট দেয়া লোকটিকে অবিরাম গালাগাল দিতে থাকি। আমি মনে-মনে যে কারো চাইতে ভাল এবং বেশি গালাগাল দিতে পারতাম। এত ভালভাবেই অনুচ্চারিত গালিগালাজ চালাতে পারতাম যেন আমি মনের গভীরে গালাগালির এক অসীম খনি, গালাগাল-সম্রাট! এ সময়ে বাবা কাছে এসে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ‘এরে বাজান, যাবি এখন আউখের মিডা দিয়া রুডি খাইতে’। এর পর বাবা ল্যাংড়া ভিক্ষুকের সংগে বলে, “এই আডার রুটি আর মিডার লোভ দেখাইয়াই তো সংগে আনি, আসতে যাইতে নাওয়ের পানি সেচে, এই সবজি হাটে শাকের পাশে একটু লাগলে খাঁড়ায়, কত সাহায্য হয়”। হ্যাঁ, সেটা বাবার একটি ধারণা যে, আমি সামান্য আঁখের মিঠা মিশিয়ে মাঝ-হাটে পচে যাওয়া নাড়ার বাছারী সংলগ্ন ছাপরায় রুটি খাবার লোভে হাটে আসি, নৌকার পানি সেচি, কী ফিরতি কচুশাকের পাঁজা আনতে গেলে আমি বাকী কচুশাক পাহারা দেই। আসলে এসব কোন ব্যাপার না, আমার মনে হত বাবার সঙ্গে থাকাটাই করনীয়, সঙ্গে ছোট্রসব কাজগুলো খারাপ লাগত না।
বাবার কষ্ট হচ্ছিল কী ? যখন কিনা তাকে কেহ একব্যাক্তি “কচুর পো কচু” বলে গালি দিল, না কী ল্যাংড়া খয়রাতির কথায় যখন তাকে এ উত্তর দিতে হলও যে, “যে ছেলের জবান নাই, সে দেবে আবার গালি” কেননা একথা বলবার পরই এসে সেদিন আমার পিঠে যেনবা অসহায় হাত রেখে, আদর করে ওই আটার রুটি খাওয়াতে চাইল আখের মিঠা দিয়া। কেননা আমি তো জানি, হতে পারে এ ধারণা তার ছিল, আমি যে বাবার সকল কাজে থাকি তা ওই আঁখের মিঠায় মাখিয়ে হলুদ বর্ণের আটার রুটি খেতে পারবো সেই লোভে। বাবা যে এমতন ভাবত আমাকে নিয়ে এ ধারণাও ভুল হতে পারে।
এভাবে শুনে থেকেছি, আমার দাদা তার বাবার কাছ হতে এই নিচু ভিটা পেয়েছিলেন, যা কচুর ভিটা নামে খ্যাত, কেনোনা এদের ভাইদের মধ্যে আবার তিনিই ছিলেন বোকা, যথারীতি বোকা নিয়মে কচু-ভুমি দাদার ভাগে পড়েছিল। সম নিয়মে অর্থাৎ বোকা, কী সরল-সোজা শর্তের ধারাবাহিকতায় বাবা উপরোক্ত ভূমির উত্তরাধিকার হয়, যেখানে শ্রাবণ ও ভাদ্রে কচু ছাড়া অন্য কোন ফসলাদি বা ফলন হয়না, শুধু পানিকচু, কচুক্ষেত, পানি কচুর ক্ষেত!
এক বছর এত পরিমান কচু তরকারী খেয়েছি যে তা এখনও মনে আছে, অধিকন্তু সে স্মৃতি কোনদিনই ভোলবার নয়। ক্ষেতের উতপন্ন কচুতে পোষায়নি, বন-কচুও খেতে হয়েছে। সেবার কচুর ফলনও ভাল ছিলনা, উত্তরের উজান হতে পাহাড়ি ঢলের জলে বন্যা নেমেছিল এর সংগে যোগ হয়েছিল সাগর থেকে আসা নোনা জল, কচুরা মরে গিয়েছিল দীর্ঘদিন বেশি জলে ডুবে থাকতে হলো বলে। আমার বয়স সাত-আট হবে সে সময়ে, যতদূর বুঝি। কেবল মরিচের সঙ্গে নুন সহকারে কচুর সিদ্ধ-রান্না হতো, তরকারী রান্নার উপকরণ সমূহের তেল, হলুদ, মরিচ সহ অন্যান্য কিছু কেনার সামর্থ্য মোদের সব গ্রাম সমূহে সে আমলে ছিলনা। ভাতের বদলেই সে কচু খেতে হত। ওই না খেয়ে থাকা, কচু খাওয়া ভুখা-কাল, এসবের জন্য দেখি বেবাক দোষ কতিপয় লোক ‘দ্যাশ-স্বাধীন’এর উপর দিত। আমার বাবা, সুন্দর চোখের গুরুত্বহীন ‘হালিয়া-চাষা’ যার পরিচিতি, তাকে দেখি তার উপযোগী সোজা-সরল করে বলে, “ওরে মেয়ারা, কই কী, কই বোলে, দ্য্যশ স্বাধীন হইলে পর, এই রহম এট্টু আধটু হইয়া থাকে, হইয়া থাকে মেয়ারা, সব ঠিক হইয়া যাইবে একদিন, অতি শিগগিরই, অতি সত্তর”। তার কথা হয়তো কেউ বিশ্বাস করে না, আমি করি, বাবাকে বিশ্বাস করে স্বপন দেখি- একদিন গরম ভাতে, তেল, হলুদ মরিচে রান্না করা অন্যান্য তরকারী- ঝিঙ্গা, রেখা, কাঁকরোলে পুঁই-পাতা দিয়ে, জোয়ারের জলে তুষের গোলায় বানানো চাড়া ফেলে খালে ধরা কাঁঠালি গোদা চিংড়ি ঝোলে ভাত খাব পেট-পুরে, গরুর দুধে কলা মেখে কী রওয়া পড়া খেজুরের মিঠায় পেট ভরে ভাত খাব, বাবার প্রত্যাশায় যেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, খুব শিগগিরই, অতি সত্তর, সেই স্বাধীনতার ফলন আসছে।
এরপর হয়ত নুনে কচুশাক, কচু’র লতা, কচু-মুড়া ও ভাতের-মার না খেয়ে থাকা কমে আসে, কিন্তু মোদের সব গ্রাম সমূহে অভাব, দারিদ্র তেমন কমে না। আগের মতনই বাবার সাথে ফুলতলীর হাটে গেছি কচুশাক লয়ে। ফুটা নৌকায় কাদার-তালি তেমন কার্যকরি হয়না, অঝোরে পানি ওঠে, আমার সারা পথে কাজ- কখনো নারকেলের আইচায় নৌকার পানি সেচা, বৈঠা অথবা লগি ধরা, এমন করে উজান ঠেলে হাটে যাই। কচুশাক নিয়া সবজির হাটে গেছি, বাবা প্রথম পাঁজা কচুশাক রেখে আমাকে দাড় করিয়ে দ্বিতীয় পাঁজা আনতে গেছে নৌকায়,তখন খেয়াল করলাম এক লোক তাড়াহুড়ায় হাটের এ মাথা থেকে ও মাথার দিকে দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেল কিছু একটা বলে, যার অর্থ আমি বুঝি না। তাকে আগেও হাটে দেখেছি, কিন্তু লোকটির দ্রুতগতিতে চলে যাওয়া, তেমন স্বাভাবিক মনে হলও না। ভাবলাম, বাবা দ্বিতীয় বার কচুশাক পাঁজা লয়ে ফিরে এলে, তাকে বলব লোকটির অস্বাভাবিক হেটে যাওয়া সম্পর্কে, বাবা পরের কিস্তি কচুশাক পাঁজা সমেত ফিরলে আমি লোকটির ঐভাবে স্বাভাবিক নয় পা ফেলে যাওয়া প্রসঙ্গে যা বলতে চেয়েছিলাম তা বলতে পারি না, কেননা আমার পক্ষে অভিমত প্রকাশ কিংবা বুঝিয়ে বলবার দক্ষতা অসম্ভব।
বিকলাঙ্গ খয়রাতি সবজির হাটেই দক্ষিণের কোনায় হোগলা বিছিয়ে সামনে পাতিয়ে রাখা মাটির শানকিতে কটা পয়সা ছড়িয়ে এক ধরনের আসন পেতে থাকে, গুনগুনিয়ে মোর্শেদি গান গায়, কখনো মাথা ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকাবে। শানকি পাতা বিকলাঙ্গ ভিক্ষুক বাবার মিতা, এই মিত্যতার হেতু হলো তাদের দুজনার একই নাম। তড়িৎ গতিতে অমন আধাদৌড়ানো লোকটিকে দেখে বাবার মিতা ভিখেরিও আমার মতনই অবাক ও কৌতূহলী নজর রেখেছিল। অস্বাভাবিক হেটে যাওয়া লোকটির অন্যদের সঙ্গে হওয়া কথাবার্তার ভেতরে হয়তো বাবার মিতা কিছু-একটা আঁচ করতে পেরেছিল। বাবা ফিরে এলে, আমি সে প্রসঙ্গে বলতে না পারলেও হয়ত বলতে চাই, ফলে, বলতে চাওয়া চেষ্টার অংশ অনুসারে আমি দুই দিকে তাকাই, অর্থাৎ বাবার দিকে এবং পুবে, যেদিকে লোকটি হেটে গ্যাছে সেই দিকে। বাবা তার ছেলেকে চেনে নিশ্চয়ই, এবং বুঝতে পারে তার ছেলের কিছু বলার আছে, অথচ বলতে পারছি না। বিকলাঙ্গ ভিক্ষুক যখন কিনা ভিক্ষা পাত্র মাটির শানকি-মালসা উপুড় করেছে, কী জন্য তা করেছে কে জানে। মনে হচ্ছে সামান্য অস্থির। বাবা তার দৃষ্টি আকর্ষন করা যায় এমন করে বলে, “মিতা, কী ব্যাপারীর পো, উতলা লাগতেয়াচে ক্যান”? এমন ভঙ্গীতে বাবা এ কথাটি বলে, যেন অঙ্গহীন ভিখেরি’র এ প্রসংগে কথা থাকলে সে এখন নিজের দিক হতে বলবে। বাবা বলেছে এ কারণে- যেহেতু সে জানে আমি কিছু-একটা বলতে চাচ্ছি অথচ বলতে পারছি না, সেটাই মিতার সংগে খোঁজ নিয়ে দেখা। ল্যাংড়া খয়রাতি মাথা না তুলে, অন্যদিকে ফিরেই বলে যেতে থাকে, “এহন দেহি, সুস্থে খয়রাত কইর্যাও এই দ্যাশে খাওন যাইবে না”। সুস্থে ভিক্ষা করেও এদেশে খাওয়া যাবে না ভিখেরীর এমন মন্তব্য শোনবার পর বাবা ধৈর্য ধরে মাটিতে সদ্য নৌকা হতে আনা কচুশাকের পাঁজা পা দিয়ে গোছাতে থাকে পায়ের লেপ্টানো কাদা সহ, আর অপেক্ষা করে তার মিতা ভিখেরি কী বলে তা শুনবার জন্য। বিকলাঙ্গ ভিক্ষুক এরপর থামে ক’মুহূর্তের জন্য, আবার বলে, “মদন রেজাকার একখানা তাউরাস কইর্যা গেল এই খবর দিয়া যে, শ্যাখ সাইবের গুষ্টি শুদ্ধা খুন কইরা ফেলানো হইছে”। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি, সে এক আর্তনাদের চিৎকার দিয়া ওঠে “কী কইলা, কী…?”। বাবাকে যেভাবে জানি, তাতে এরপর সে আরও কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারবে না। কার্যত বলতে সে আর পারেও না। যেহেতু তারও তেমন ভাবে বলবার ক্ষমতা নেই, ছেলে সেটাই পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। সামনে রাখা কচুশাকের পাঁজার উপর ধড়াস করে বাবা বসে পরে, বামহাত খানা ডান দিকের মাটিতে বিছিয়ে, মাথাটা ঝুঁকিয়ে, ডানহাত খানা বুকের উপর, ঘন শ্বাসে। হতে পারে ক’মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল সংগে আত্মজ রয়েছে, যে আত্মজ কিনা প্রায় বধির, প্রায় নির্বাক। তারপর বুকের উপরের ডানহাত সরিয়ে, আমার দিকে হাতখানা বাড়িয়ে, আমার সন্ত্রস্ত মুখের প্রতি চেয়ে, সে কিছু যেন বলতে চায় আমাকেই। মনে হয়, অন্তত সে যা বলতে চায় তা বোধহয় এরকমঃ ‘আয়রে বাজান, আয় কাছে আয়, মুই ভাল আছি, ডরাইস না’। বাবা যে এমন সব সময়ে হতবাক থাকবে সে আমি আর আমার মা ছাড়া কেউ ভাল বলতে পারবে না, অবশ্য মোদের গ্রামের লোকেরাও সেটা জানে। বাবার নামে নাম তার মিতা ভিখেরি নিজের বিছানো হোগলায় আধা শোয়া অবস্থানের ভঙ্গী বদলায়ে উচ্চারন করে, “ওরে মিতা, বইয়া পরলা কেয়া ? সামনে আরও কত কী আছে কেডা জানে, বইয়া পড়লে চলবে”? ঠিক তখনই একই পথে ফের মদন রেজাকার ফিরে আসে, হয়ত শুনতে পায় পঙ্গু ভিখিরির উচ্চারিত ওই বাক্য “বইয়া পরলা কেয়া…” । মদন রেজাকারের হয়ত বুঝতে অসুবিধা হয়না যে বাবা ওই শেখ সাহেব ও তার পরিবারের খুনের খবর শুনে বসে পরেছে। মদন রেজাকার হেটে এই দিকেই আসে, বাবার সাজানো কচুশাকের পাঁজায় লাথি দেয়, থুবড়ে সেই বসে থাকা বাবার কাঁধে দু’হাত দিয়ে নুয়ে ধাক্কা মেরে বলে, “কচুর পো কচু, খাঁড়াও, খাঁড়াও, এই খবরে বইয়া পরছ কেয়া?”। ধাক্কায় কাত হয়ে পরে যাওয়া বাবা দুনিয়া-সেরা সুন্দর নয়নের চাউনিতে মদন রেজাকেরর দিকে চেয়ে থাকে। তখন বাবার মিতা পঙ্গু ভিখেরী তার মতন করে বলে, যাকে কিনা পরোক্ষ প্রতিবাদ হিসাবে নির্নায়ন করা যায়; “আরে মেয়া ক্ষেন্ত দেও, যাও যে কামে যাইতাছিলা, হেই কামে যাও, ও ব্যাডারে ধাক্কাইয়া লাভ কী”। মদন রেজাকার চলে যায়, যাওয়ার আগে অতিরিক্ত একটি লাথি সে দেয় নির্দোষ পরে থাকা জড় কচুশাকের পাঁজার উপর। এছাড়া আরও তিনটি ধাক্কা আগের চেয়েও বেশি শক্তিতে সে দেয় চলে যাওয়ার আগে নিথর বসে পরেথাকা আমার বাবার উপর।
এরপর বাবাকে বুঝবার চেষ্টা করেছি, তার অবস্থান হলও- “যে দেশে শ্যাখ সাইবের মতন মাইনষেরে খুন করা হয় সেই দেশে কচুশাক বেচে লাভ কী?” এইটুকু, অতি সাধারণ সে বিবৃতি, নয়তো তার বিশ্বাস। অতএব সেদিন, সেখানে, সে হাটে আমাদের কচুশাক সেখানেই ওয়ারিশহীন পরে থাকে। বাবা আমাকে নিয়ে নৌকায় ফিরে এলো। আমরা জোয়ারের স্রোতে নৌকায় ঢিমে-তালে বৈঠা মেরে বাড়ী ফিরে এলাম। আসার পথে খালের পারের দু’এক ঘাটের মানুষজনদের ভেতর থেকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করল ‘আজ বাজার দর কী’, বাবা ওইসব প্রশ্নে নিরুত্তর থেকেছিল। মায়ের দেয়া কেরোসিন তেল, রান্নার তেলের বোতলগুলো শূন্য এলো, তেল বিহনে। সে রাত সহ অনেক রাত ঘরে বাতি জ্বলল না, তেল বিহীন রান্না হলও যাবতীয় বন-লতা কিংবা বন-সবজি। প্রথমবারের জন্য ঘটনা একটি ঘটল আমার অভিজ্ঞতায় যে, হাটে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ- আখের মিঠায় মেখে হলুদ বরন আটার রুটি অইদিন খাওয়া হলোনা।
এরপর আমাদিগের দৈনিনন্দিন জীবনে হয়ত আরও খানিকটা বেশি উপোষ থাকতে হয় কচুশাক বেচতে না পারার ফলে, ভাতের মার, কচু, কচুশাক সেদ্ধ-লবণ, মরিচ বা সামান্য হলুদে জাল দিয়ে। এসত্ত্বেও কোনদিন মনে হয়নি যে বাবার এ ব্যাপারে আক্ষেপ আছে, কী বেদনাভর নিভৃত অভিমান। তেমনি আসে দিন, যায়ও আবার, সময়ের ব্যবধানে আমি ঢাকায় আসি, সে আবশ্য আসতেই হয়, বৃত্তি বা পেশা হিসাবে যে মাধ্যমে শুরু করতে হয়, সে পেশা ‘কাজের ছেলে’ বর্ননায় চিহ্নিত । সে পেশায় আমার সবচেয়ে উত্তম চাকরি ছিল একটি পত্রিকার সম্পাদকের কার্যালয়ের ‘কাজের ছেলে’ হিসাবে। সম্ভবত সম্পাদক সাহেব, মানুষের জীবনের যাবতীয় গল্প পছন্দ করতেন, এ ধারণাও হয়, তিনি সম্ভবত ভাবতেন আমিও তার মতনই গল্প পছন্দ করি। কখনো এমন বলেছেন যে, “বুঝলে (তিনি আমাকে অফিসের লোকজনের দেয়া কথিত এক কাব্যিক এবং রাবিন্দ্রিক নাম ধরে ডাকতেন)আমি কাহিনীই বলতে চেয়েছিলাম, ভাগ্যদোষে সাংবাদিক হয়েছি। দ্যাখ, দ্যাখ বলে তিনি লম্বা দম নেন, তারপর বলেন, তোর বাবা, নিচুভুমির কচু, নুনে-জলে সেদ্ধ, তিনিই কিনা বসে পরে ওই খুনের প্রতিবাদ জানান দেয়; ওই পঙ্গু ভিখারির প্রতিরোধ, আদতে এরাই হলও আমাদের নায়ক, যারা তাদের নিজস্ব ঢংগে, এমন এক নিকৃষ্ট-নিষ্ঠুর খুনের প্রতিবাদ করেছে, আমরা নগুরে মধ্যভিত্তরা তা করিনি। আমাদের গ্রামেও সম্পাদক স্যারের ভাষ্য মতনই সে কাহিনীই প্রচলিত রয়েছে যে, কচুশাকওয়ালা আর তার মিতা বন্ধু বিকলাঙ্গ ভিখেরীরাই প্রথম, যারা প্রতিবাদ করেছিলেন শেখ সাহেব ও তার পরিবার হত্যার বিরুদ্ধে। সম্পাদক সাহেব নাকি একসময় ঘুরিয়ে এ বিষয়ে লিখেছিলেন। তিনি একবার তার অফিসে কক্ষে আমাকে ডেকে বললেন, “বস তো দেখি আমার সামনে, নির্ভয়ে”। ততদিনে আমি তাকে চিনেছিলাম, মানে তার সামনে আমার বসতে বাঁধা নেই, সে বুঝতে পেরেছিলাম। বসবার পরে তিনি একটু আবেগ প্রবন হয়ে বললেন, “বুঝলি (তিনি দেয়া নামটা ধরে বেশ আন্তরিক ভাবে ডাকতেন), বুঝলিরে, একদিন তোর বাবা, ওই ল্যাংড়া ভিখেরি এদের অবদানকে বড় করে বিস্তারিত লিখব”। যদিও আমার কোন ধারনা নেই যে, আমার বাবা, বা তার মিতাদের নিয়ে সংবাদপত্রে লিখলে কী ছাপা হলে এমন কিছু হিতকর কিনা। আমি বলি, বস্তুত বলি না, বলতে চাই, অথচ বলতে পারি না, কেঁদে ফেলি, তিনিই বলেন, “কাঁদিস নারে, জানি তুই হয়ত বলতে চাচ্ছিস ‘স্যার সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম’”। আমি মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম, অতঃপর চেয়ার থেকে উঠে সম্পাদক স্যারের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম।
এরও বছর তেরো কী চৌদ্দ সাল পরে আমি অভিবাসী লটারি পেয়ে আমেরিকায় আসি। স্বভাবতই আমার কচু-ভিটার দিকে ফিরে যাওয়ার মাত্রা কমে যেতে থাকে। যতবার গেছি ততবার কচুশাক-ফেরিওয়ালার সমাধী প্রান্তে গেছি। তার সুন্দর চোখকে কল্পনা করেছি। সামনে কচুশাক রেখে খদ্দের আশায় পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা, কচুশাকের পাঁজার উপর বসে পরা, ধাক্কা খাওয়া, এসব স্মৃতিতে হয়ত ক’মুহুর্ত বিচরন করেছি। পুনরায় পুরনো ভিটা পেছনে ফেলে চলে এসেছি। এরপর ৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে জেনেছি স্থানীয় জনসাধারন হাটের নামে ‘ফুলতলীর হাট’এর আগে‘কদম’ শব্দ লাগিয়ে নতুন নামকরন করেছে, ‘কদমফুলতলীর হাট’। নব এ নাম যুক্ত করার ফলে সেদিন ঘটনার প্রতিবাদ করেছে এমন দু’জনের নামই উল্লেখ করা হলো, যে সদৃশ্য নামের ভিত্তিতে তারা মিতা, এখানে কাহিনী হলও এই দু’জনেরই নাম ছিল ‘কদম আলী’। এরপর আমি যখন দু’একবার গ্রামে গেছি তখন গকদমফুলতলীর হাটের সেই স্মৃতির খন্দে মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়েছি, হয়তবা অনিচ্ছাকৃত বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে সেই বাছারির দিকে তাকিয়েছি যেখানে মিঠার হাড়ি, হলুদাভ আটার রুটির বেলবার ও ভাজবার ছাপরা ছিল।
এ জাতীয় বিষয়ে জড়িত থাকা পরবর্তিতে হয়ে ওঠে না । অতি দূরের, যেন অন্য যেকোন মানুষের মতনই সামান্যই আমি জানি মাত্র। এ নিয়মেই সদ্য জানলাম মদন রেজাকারের বেটা, আওয়ামীলীগের মন্ত্রী হয়ছে। অবশ্যই মন্ত্রী হওয়ার পর নিজ গ্রামের হাটের প্রথম সম্বর্ধনা নেয়ার আগেই ওই হাটের নাম বদলাবার ব্যবস্থা করেছে, নতুন নাম রেখেছেন ‘মদিনার হাট’। আমাকে গ্রামের দু’একজনলোক এসে বলেছেন পরক্ষভাবে (যেহেতু এ ধরনের বিষয়ে অনাগ্রহ রয়েছে এবং সেটাই সকলের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছি, ফলে দূর থেকেই আকার ইঙ্গিতে এ প্রসঙ্গে জানাতে হয়)। ভবিষ্যতে যাতে কোনভাবে আর এ নাম বদলাতে না পারে তাই ফন্দি ফিকিরে মন্ত্রীর বাবার নামে নাম ‘মদনের হাট’এর জায়গায় ‘মদিনার হাট’ নামকরণ করে বদলানো হয়েছে।
আমার জীবন বোধে এখন আর এসবের ছোঁয়া বা প্রভাব নেই ধারনা করি। তবে বাবার প্রতি, কিংবা কদম আলীদের প্রতি, সে হোক তারা কচুশাকওয়ালা কী পথের ভিখেরি গোত্রভুক্ত, এ গোত্র ও শ্রেণীর মানবিক মূল্যবোধের প্রতি আবেগ হারাই না, ভাবি সেই নিয়ম, সেই ‘মিতা’ কদম-আলীদের কথা, যে দেশে তারে, অর্থাৎ শ্যাখ সাইবের মতন মানুষরে এমন খুন করা যায়, সে দেশে তো কত কিছুই হতে পারে।
1 মন্তব্যসমূহ
টনটন করছে যেনো কোথায়! হায়, কদম আলী! হায়!
উত্তরমুছুন