দীপেন ভট্টাচার্য'এর গল্প : শ্যাতোয়ান্ত

সকালটা প্রায় শেষ যাচ্ছিল যখন মিস্টার শ্যাতোয়ান্ত বলল, “জানালার পর্দা খুলে দাও।” 

এতক্ষণ যা কিনা মনে হয়েছিল দেয়াল­–যাতে সাঁটা ছিল বহু বিমূর্ত ছবি–তা মিলিয়ে গিয়ে দেখা দিল জানালার বাইরে পেঁজা তুলোর মত বাতাসে তুষার কণার বিচলন। ঘরের ভেতর বাজছিল জোহান সেবাস্টিয়ান বাখের ‘বাতাস’।
রাস্তার ওপাড়ে এক বহুতল বাড়ির ২৬তম তলা। ফ্রিজ খুলে কমলার রসের বোতল বার করে টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসে ঢালে শ্যাতোয়ান্ত। গ্লাসটা নিয়ে খোলা জানালার সামনে দাঁড়ায়। তুষারের তুলোর নৃত্যের পেছনে, সামনের বহুতল বাড়িটির বাদামী দেয়ালে দেখা যাচ্ছে সাজানো সারি সারি চৌকো বদ্ধ জানালা। সেদিকে তাকিয়ে শ্যাতোয়ান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বদ্ধ জানালাগুলির পেছনের অধিবাসীদের সম্পর্কে তার কৌতূহল অপরিসীম। শহরটাকে বুঝে উঠতে চাইছে সে।

রাতে ঐ জানালাগুলির পেছনে আলো জ্বলে। ছায়া দেখে শ্যাতোয়ান্ত। খেলা করে বাচ্চারা। রান্না করে কোনো তরুণ, চুল বাঁধে কোনো তরুণী, এক প্রৌঢ় ভায়োলিন বাজায়। রাতের অন্ধকারে ভায়োলিনের সুর ভেসে আসে নিচে রাস্তার যাতায়াত ব্যবস্থার শব্দের ওপর দিয়ে। এখনো কেউ অযান্ত্রিক ভায়োলিন বাজায়, আশ্চর্য হয়েছিল শ্যাতোয়ান্ত। আর চুল বেঁধেছিল যে তরুণী তাকে আর একবার একটা কাপ মুখে তুলতে দেখেছিল। এসবই ছিল ছায়ানৃত্য। কিন্তু একবার, হেমন্তের এক সকালে, জানালা খুলে নিচু হয়ে বড় রাস্তাটা দেখছিল সেই তরুণী, কালো চুল ছড়িয়ে পড়েছিল তার সারা মাথা আর মুখমণ্ডল ঢেকে। তারপরে, সে যখন জানালাটা বন্ধ করে দিচ্ছিল, তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল শ্যাতোয়ান্তের। এত্দূর থেকেও তার চোখের দীপ্তি যেন সে দেখেছিল। 

গতকাল একটা মিটিং ছিল, ঘরে বসে ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণেই কথা হল সহকর্মীদের সাথে, শহরের একপ্রান্তে তাদের কোম্পানির একটা আবাসিক দালান ছিল। সেটা ভেঙে পার্ক করা হবে। ঘরে বসেই তার ঘনকের সাহায্যে নক্সা করে প্রকৌশলী শ্যাতোয়ান্ত। ঘনককে আগে বলা হত কম্পিউটার। শ্যাতোয়ান্তের ঘনকটি জানালার পাশেই টেবিলের ওপর বসানো, ঘন আয়তনের ধূসর রঙের বাক্সটির প্রতিটি দিক ১০ সেন্টিমিটারের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এই ঘনক, তার সঙ্গে আন্তর্জালে আরো অনেক ঘনকের সঙ্গে যোগাযোগ। 

ঐ শতাব্দীর শেষে বর্ণমালা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হচ্ছিল। মনোযোগ না দিলে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো স্মৃতিতে নোঙর ফেলে না, তেমনই স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ, এমনকি অক্ষরমালার বাইরে গাণিতিক সংখ্যাগুলো এক অবরোহী কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছিল, কিন্তু নাগরিকরা খেয়াল করছিল না। তারা তাদের সর্বক্ষণের সাথী–ছোট থেকে বড়, আবার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম গণনাযন্ত্রগুলোকে–মৌখিক আদেশ দিয়ে চালাত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বসমূহের সাথে তারা মতামত বিনিময় করত শব্দের মাধ্যমে। এই সভ্যতার স্লোগান হল ‘ধ্বনিই একমাত্র বার্তাবাহক, জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করার জন্য কন্ঠনালী নিসৃত দীঘল তরঙ্গের কোনো বিকল্প নেই’। তাই যেদিন শ্যাতোয়ান্ত দেখল নতুন ঘনকে কিবোর্ড নেই সে’দিন সে আশ্চর্য হল না। নাগরিকেরা কি-বোর্ড থেকে মুক্তি পেয়ে বলল, “আপদ বিদায় হয়েছে, হাতের আঙ্গুল দিয়ে অক্ষর টিপে কব্জীতে ‘কার্পেল টানেলের’ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে।” এর বহু বছর আগেই অবশ্য তারা কাগজের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছিল। কলমের কারখানাগুলোও উঠে গিয়েছিল বহুদিন। আধুনিক হস্তলিপিও ঐতিহাসিক হল, সুমেরীয় কিউনিফর্ম, মিশরীয় হিরোগ্লিফ, সিন্ধুনদের প্রতীকগুলোর সাথে প্রত্নতত্ত্বের সংগ্রহশালায় ঠাঁই পেল। 

ক্ষুদ্র যন্ত্রে মানুষ প্রথমে চিরকুট লিখত, তাকে এসএমএস, টেক্সটিং এসব বলত। ধীরে ধীরে ছোট চিরকুট সঙ্কেতে পরিণত হল। মানুষ যেন ফিরে গেল সুমেরীয় কিউনিফর্মে, তারপর সেটাও পরিত্যাগ করল। ততদিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই সভ্যতার জটিল অংশগুলি দেখত। কি-বোর্ডবিহীন ঘনককে এখন শুধুমাত্র কথা দিয়ে চালাতে হয়। শ্যাতোয়ান্তের প্রজন্ম হাতে লিখতে শেখে নি, তারা কথা বলতে পারে, জটিল অঙ্কও ঘনকের সাহায্যে সমাধান করতে পারে, পড়তে পারে কিন্তু লিখতে পারে না। শহর পরিচালনা পর্ষদ যে কোনো লেখাকে নিরুৎসাহিত করত। 

শ্যাতোয়ান্ত সামনের বাড়িটির দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে শুধু প্রকৌশলী নয়, সে নতুন গল্প লিখতে চায়। জানলা থেকে ফিরে এসে সে টেবিলের ওপর রাখা ঘনকের সামনে বসে। ঘনককে বলে, “ঘনক, আমি একটা নতুন গল্প লিখব।” ঘনক উত্তর দিল, “নতুন গল্প সৃষ্টির পথ কন্টকময়।” ঘনকের কন্ঠ ছিল অনুশীলনপ্রাপ্ত নাট্যশিল্পীর মতো। শ্যাতোয়ান্ত ঘনকের কথা অগ্রাহ্য করল, বলল, “শুরুর বাক্যটা হবে ­–পৃথিবী তখন এতই নতুন ছিল যে কোনো বস্তুর নাম ছিল না, আঙুল দিয়ে সেগুলো দেখিয়ে দিতে হত।” 

ঘনকের গলায় শ্লেষ, বলে, “তুমি ঠাট্টা করছ, এই বাক্যটি তো লেখা যাবে না, কারণ এর মতই একটি বাক্য গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ তাঁর নিসঙ্গতার শতবর্ষ বইটিতে ব্যবহার করেছেন।’ শ্যাতোয়ান্ত দাঁতে দাঁত চেপে ঘনক সম্বন্ধে অশ্রাব্য কিছু বলল, ঘনক সেটা বুঝতে পারল। বলল, “এতে আমার কিছু করার নেই, নকল করে গল্প লেখা একেবারেই বারণ।” 

শ্যাতোয়ান্ত বলল, “ঠিক আছে। ওটা লিখতে হবে না। লেখ, ঐ প্রাচীন পৃথিবীতে একটি বড় বটগাছ ছিল, একদিন একদল বক সেই গাছের মাথায় এসে বসল, দূর থেকে মনে হল গাছের মাথা থোকা থোকা সাদা ফুলে ভরে গেছে।” 

ঘনকের বাতি জ্বলে নেভে, বলে, “তোমাকে এটার জন্য দোষ দেব না, তুমি এনার লেখার সঙ্গে পরিচিত নও। এরকম একটি বাক্য পাওয়া যাবে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের আরণ্যক বইটিতে।” বিভূতিভূষণের নাম শ্যাতোয়ান্ত শোনে নি, কিন্তু ঘনক পৃথিবীর যাবতীয় লিখিত সম্পদকে মুহূর্তের মধ্য দেখে নিতে পারে। নকল করার ব্যাপারে বিশেষ সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। গত দশ বছরে কোনো মৌলিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয় নি, কারণ শহরের যাবতীয় ঘনকের প্রতি নির্দেশই আছে যদি কোনো বাক্য অতীতে সৃষ্ট সাহিত্যের একটি বাক্যর সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ বা অংশতভাবে এক হয়, এমনকি যদি ভাবগতভাবে মিল পাওয়া যায় তবে সেটি নকল বলে বিবেচ্য হবে, এবং ঘনক ঐ লেখককে সাহায্য করবে না। বলাই বাহুল্য শর্তটি কঠিন। ঘনককে এড়িয়ে হাতের লেখায় নতুন রচনা শহর পরিচালনা পর্ষদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। 

শ্যাতোয়ান্ত হাল ছেড়ে দেয়। তার প্রতিটি সকালই এভাবে শুরু হয়, প্রতিটি সকালেই সে ভাবে যদি আজ ঘনককে ফাঁকি দেয়া যায়। তুষারপাত কমলে লিফট দিয়ে নিচে নেমে আসে সে। ৩৫ নম্বরের বাসটা তার দালানের সামনেই থামে। সেটি দিয়ে অনেক সময় কাছেই একটা বাজারে শাকসব্জি কিনতে যায় সে। শুনেছে বাসটার শেষ স্টপেজ শহরের একটা পুরোনো অংশে যে অংশটা এখনো ভেঙে ফেলা হয় নি। ৩৫ নম্বর বাসে ওঠে সে। যেতে যেতে সব যাত্রী নেমে যায়। শেষ গন্তব্যে বাস থামলে সে চালককে জিজ্ঞেস করে এখানে কোনো পুরোনো দিনের দোকান আছে কিনা। চালক বোঝে না শ্যাতোয়ান্ত কী বলতে চাইছে, একটু সন্দেহের চোখে তাকায় তার দিকে, তারপরে দূরের কিছু বাড়ির দিকে হাত তুলে দেখায়, বলে, “ঐদিকে কিছু মানুষ থাকে, ওদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।” 

শহরটা এখানে হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়ে গেছে, এরপর তুষার ঢাকা প্রান্তর। বাড়িগুলোর কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শ্যাতোয়ান্তের হাতের আঙুল জমে যায়। সারি সারি দোতলা পুরোনো বাড়ি। প্রথম বাড়ির দরজায় টোকা দিলে এক বয়স্ক পুরুষ দরজা খোলে। শ্যাতোয়ান্ত বলে, “আমি কাগজের খোঁজ করছি। আপনার কাছে কি সাদা লেখার কাগজ পাওয়া যাবে?” মানুষটি যেন প্রশ্নটিতে আশ্চর্য হয় না, কিন্তু মাথা নেড়ে না বলে দরজা বন্ধ করে দেয়। শীতটা আরো গাঢ় হয়ে ওঠে। পরপর আরো চারটা দরজায় টোকা দেয় শ্যাতোয়ান্ত, অবশেষ পঞ্চম বাড়িটির দরজা খোলে এক দৃঢ়-মেরুদণ্ডী প্রৌঢ়া। কাগজের কথা শুনে সে তাকে ভেতরে এসে বসতে বলে। অন্ধকার, কিন্তু উষ্ণ ঘরটি পুরোনো আসবাবপত্রে ভর্তি। প্রৌঢ়া ভেতর থেকে এক বান্ডিল সাদা কাগজ নিয়ে আসে। লোভীর মত সেটা তার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নেয় শ্যাতোয়ান্ত। আঙুল দিয়ে অনুভব করতে চায় কাগজের রুক্ষ কোমলতা। “কত?” জিজ্ঞেস করে সে। “এক শ ফ্র্যাঙ্ক,” বলে প্রৌঢ়া। “আমার কাছে দু শ ফ্র্যাঙ্কের একটা বাজার করার কার্ড আছে, সেটা নিতে পারেন। ক্রেডিট কার্ড তো ব্যবহার করা যাবে না। আপনাকে বাকি এক শ ফ্র্যাঙ্ক ফেরত দিতে হবে না।” “ঠিক আছে, সেটা দিতে পারেন। আপনার কলম লাগবে না?” “কলম?” কলমের কথাটা মনেই ছিল না শ্যাতোয়ান্তের। প্রৌঢ়া হাসে, বলে, “কলম ছাড়া কাগজ তো অচল।” শ্যাতোয়ান্ত কৃতজ্ঞতা বোধ করে। বের হবার সময় প্রৌঢ়া বলে, “আমার কাগজের ভান্ডার প্রায় শেষ। যা লিখবেন তা যেন অমূল্য হয়।” কলম আর কাগজের বান্ডিলটা ব্যাগে ঢোকায় শ্যাতোয়ান্ত। 

বাড়ি ফিরে শোবার ঘরে ঢোকে শ্যাতোয়ান্ত, ঘনক এখানে তাকে দেখতে পাবে না। ব্যাগটা খুলে কলমটা বের করে। খাটে বসে সে খুব যত্ন সহকারে লেখে শ, তারপর ত, তারপর ‘শ্যাতোয়ান্ত’। না, ভুলে যায় নি, চল্লিশ বছর আগে তার মা তাকে যা শিখিয়েছিলেন কিছুটা হলেও সে ধরে রেখেছে। শ’য়ের বক্রতায়, ন আর ত এর যুক্তাক্ষরে মোহিত হয়ে যায় শ্যাতোয়ান্ত। হাতের স্পর্শে সৃষ্ট অক্ষর, স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কের সঙ্গে সরাসরি তার যোগাযোগ। আহা! 

পরদিন খুব ভোরে তার উঁচু দালানের নিচে নেমে শ্যাতোয়ান্ত অপেক্ষা করে। আজ আকাশ নীল, গতকালের স্তূপীকৃত তুষারের ওপর সূর্য ঝলকাচ্ছে। অপেক্ষা করে যতক্ষণ না তার পা জমে যায়, তারপর সেই তরুণী বের হয় সামনের বাড়ি থেকে। তার মুখমণ্ডলের পরিলেখ খুব ভাল করে চেনে শ্যাতোয়ান্ত। রাস্তা পার হয়ে দৌড়ে তার কাছে যায় সে, বলে, “মিজ, আপনার জন্য আমার একটা উপহার আছে।” তরুণী এরকম অচেনা একটি মানুষের সম্বোধনে হতচকিত হয়। সে দেরি করে না, তরুণীর হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ গুঁজে দেয়। তরুণী অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে হাতের কাগজটার দিকে চেয়ে থাকে। শ্যাতোয়ান্ত বলে, “এটা আপনার জন্য।” এই বলে তরুণীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাস্তা পার হয়ে ঢুকে যায় তার বিল্ডিংএ। 

ঘরে ফিরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে তরুণীর ফ্ল্যাটের দিকে, যদি সে তার জানালাটা খোলে। দুপুর গড়িয়ে যায়, শীতের ছোট দিন ফুরিয়ে আসে, সূর্য দক্ষিণ দিগন্ত ঘেষে পশ্চিমে এগোতে থাকে। কিন্তু তরুণীর জানালা বন্ধ থাকে। সন্ধ্যা হবার আগে শ্যাতোয়ান্তের দরজায় কে যেন টোকা দেয়। এ সময়ে কারুরই আসার কথা নয়, আর এলেও নিচের দরজা তার খুলতে পারার কথা নয়। কাজেই সে যে শহর পরিচালনা পর্ষদ থেকে এসেছে এ নিয়ে শ্যাতোয়ান্তের সন্দেহ থাকে না। দরজা খুললে ধূসর পোষাকের আগন্তুক ঘরে ঢুকে পড়ে, পরিচয় দেবার ধার ধারে না, বলে, “মিস্টার শ্যাতোয়ান্ত, আপনি আপনার প্রতিভাকে নষ্ট করছেন, অপাত্রে দান যাকে বলে।” দীর্ঘাঙ্গ মানুষটির মাথায় পুরোনো দিনের হ্যাট। জানালার কাছে যেয়ে নিচে তাকায়, বলে, “আপনার ফ্ল্যাটটি তো ভালই। আর প্রকৌশলী হিসেবেও আপনার নাম আছে, তা যার যে কাজ তার মধ্যে থাকাই কি ভাল নয়?” শ্যাতোয়ান্ত বোঝে তার কাজটি গোপন থাকে নি। আগন্তুক বলে, “আমার নাম, শ্যালুর, বিশেষ গোয়েন্দা শ্যালুর। আমাদের কাছে খবর এল আপনি চোরাকারবারিদের কাছ থেকে কাগজ কিনেছেন।” গতকালের প্রৌঢ়াকে চোরাকারবারি হিসেবে চিত্রিত করা শ্যাতোয়ান্তের কাছে হাস্যকর মনে হয়। 

শ্যালুর বলে, “উলুবনে মুক্তা ছড়াতে নেই। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তারা কবিতা-টবিতা বোঝে না, তারা আপনার প্রকৌশলী ব্যাজ কেড়ে নেবার জন্য প্রস্তুত, তার সাথে এই সুন্দর ফ্ল্যাটটিকেও।” এই বলে শ্যালুর তার কোটের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে। শ্যাতোয়ান্ত কাগজের পাতাটাকে চিনতে পারে। “তো আমি যা বলছিলাম, যার যা কাজ তার মধ্যে থাকাই ভাল নয় কি?” বলে শ্যালুর কাগজটা খুলতে খুলতে, “আপনি হলেন প্রকৌশলী, তা আপনার মাথায় চাপল কবিতার ভূত। কীরকম কবিতা লিখলেন আপনি?” কাগজটা তার চোখের সামনে তুলে নাটকীয় ভঙ্গীতে শ্যালুর পড়ে, “শীতলতায় ডুবে যায় নরম শিশিরকণা/ জানালায় জমে কঠিন স্ফটিকখণ্ড/ তবু তোমার প্রতিলেখ ভেসে ওঠে/ তোমার উষ্ণতার ছোঁয়া ভাসে/ উদাসীন শহরের অতৃপ্ত বাতাসে। হা হা হা, এটা কবিতা হল? আপনার নামটির যা অর্থ তাতে আমি অনেক কিছু আশা করেছিলাম।” 

সত্যিই এটা কবিতা হয় নি। শ্যাতোয়ান্ত লজ্জায় মাথা নোয়ায়। শ্যালুর বলে, “কবিতাটি কোনো পদের হয় নি সেটা একটা ট্র্যাজেডি বটে, কিন্তু তার থেকেও বড় ট্র্যাজেডি কী জানেন? যাকে উদ্দেশ্য করে এই কবিতা লিখেছেন সে তার একটি কথাও বুঝতে পারে নি।” 

এই শহরের সব কিছুই অলীক, শ্যাতোয়ান্ত ভাবে। 

“তবে অন্য দিক দেখলে বলতে হবে ভালই হয়েছে, এই কবিতার অত্যাচার থেকে সে বেঁচেছে।” এই বলে হা হা করে আবার হাসে শ্যালুর। বলতে থাকে, “আপনার হদিশ কে দিল জানেন? আপনি তাকে কাগজটা দিলে সে জিনিসটা কী না বুঝতে পেরে সোজা গোয়েন্দা দপ্তরে হাজির। ভেবেছিল আপনার বোধহয় কোনো সাহায্যের প্রয়োজন। হা হা। তো আমরা কাগজ আর তার কালি দেখে প্রথমেই বুঝে নিলাম সেটা কোথা থেকে আসছে। তবে এর আগেই ২০০ ফ্র্যাঙ্কের একটা বাজারের কার্ড বেনামে ব্যবহার করার সময় এক প্রৌঢ়ার নাম আন্তর্জালে নথিভুক্ত হয়। তো তাকে খুঁজে পেতে বেশী অসুবিধা হয় নি। সেই প্রৌঢ়ার সব কাগজ আর কলম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ঘাবড়াবেন না, আমরা অমানুষ নই। তাকে আপাতত কোনো সাজা দেয়া হচ্ছে না। আর এটা আপনার প্রথম অপরাধ, আপনার প্রকৌশলী ব্যাজ আমরা কেড়ে নিচ্ছি না। আমাকে শুধু কাগজগুলো আর কলমটা দিয়ে দিন। এরপরে আর কবি সাজবার চেষ্টা করবেন না।” 

কাগজ আর কলম বাজেয়াপ্ত করে শ্যালুর চলে গেলে ঘনক শ্যাতোয়ান্তকে বলে, “আমাকে বলতেই পারতে যে তুমি ঐ তরুণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলে। আন্তর্জালে এই শহরের সব খুঁটিনাটি আমার নখদর্পণে। সে যে পড়তে পারে না সেটা তোমাকে আগেই বলে দিতে পারতাম। এ শহরে কে পড়তে পারে, বল? এত কষ্ট করে, আমার কাছ থেকে লুকিয়ে, তোমাকে কবিতা লিখতে হত না। আর যে ছাঁইপাশ লিখেছ তার থেকে অনেক ভাল কবিতা আমি লিখে দিতে পারতাম। তুমি বোধহয় জানো না ‘যুদ্ধ ও পরবর্তী শান্তি’ নামে আমার ৩ মিলিয়ন শব্দের একটা উপন্যাস পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। লেখক হিসাবে আমার নাম হচ্ছে।” 

এই শহরে এখন শুধুমাত্র ঘনকেরাই উপন্যাস লেখে। 

আরো রাত হলে শোবার ঘরে যায় শ্যাতোয়ান্ত, বিছানার ম্যাট্রেসের নিচ থেকে বের করে আনে একটা কলম আর একটা সাদা কাগজ। প্রৌঢ়া তাকে দুটো কলম দিয়েছিল, শ্যালুর একটা নিয়ে গেছে; এই কলমটা ও একটা কাগজ সে লুকিয়ে রেখেছিলে। খাটে বসে কলম দিয়ে পরম যত্নে ও ভালবাসায় কাগজে খুব ছোট অক্ষর ফুটিয়ে তোলে সে, “আমার মা আমার নাম রেখেছিলেন শ্যাতোয়ান্ত। শ্যাতোয়ান্ত অর্থ হল মণি প্রতিফলিত উজ্জ্বলতা। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমি লিখে যাচ্ছি এই শহরের কাহিনি….”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভাল লাগলো। ভবিষ্যৎ সমাজের একটা নমুনা পাওয়া গেলো। হাসিও পেলো বেচারা শ্যাতোয়ান্তের জন্য আবার খারাপও লাগলো বেশিদিন বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য, কারণ তারা বোধহয় "নতুন সমাজে" জঞ্জালই হয়।

    উত্তরমুছুন