সালেহা চৌধুরী'র গল্প : পাহাড়ের বাড়ি

দশ ভাইবোনের মধ্যে হিরণ সাত নম্বর। একটা ছোট কাজ করতেন বাবা। আনন্দ বলতে বোধকরি স্ত্রীকে রাতে কাছে পাওয়া। আর কিই বা ছিল যা দিয়ে আনন্দ করা যায়। দিনের পর দিন লিটালারিলি ডাল ভাত। এই দশ জনের ভেতর সাত নম্বর হিরণ একেবারে ঝক ঝকে উজ্জ্বল সোনার বোতাম। প্রতি ক্লাশে প্রথম হতে হতে একদিন ও আর্টিটেকচার পাশ করলো। ওর পড়াশুনা দেখতেন ওর এক ফিলানথ্রপিস্ট মামা।
মামার নিজের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না। হিরনকে পড়ার খরচ এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরো নানা খরচ দিতেন। ফলে ভাইবোনের ঈর্ষা কুড়িয়ে তরতরিয়ে এক ক্লাশ থেকে আর এক ক্লাশে উঠতে উঠতে আর্কিটেকচারে প্রথম হলো ও। বাবা আনোয়ার বললেন -- এইবারে কি করবা আমার বাবা। 

কি আবার চাকরি। তবে আমি বাইরে যাব। এবং পর্বতের বাড়ি নিয়ে গবেষণা করবো। 

বাবা বললেন -- আমি তোমার সব কথা যে বুঝবো সেটা ঠিক না। আমি টেনেটুনে বি এ পাশ। একটা ছোটখাটো কাজ করি। উপরিসুপুরির একটু আধটু সুবিধা বলে তোমরা দশভাইবোন এখনো ভাত কাপড় পাও। পর্বতের বাড়ি? সেটা কেমন? 

তুমি তো বললে বুঝবে না। 

আচ্ছা। ঠিক আছে। বাবা পান খান। বলেন -- তুমি চিরকালই অন্যরকম। দেখ মাথায় কি খেয়াল চাপছে সেটা এখন কর। 

যে ঘরটিতে আরো পাঁচ ভাইএর সঙ্গে ঘর শেয়ার করে হিরণ সেটা ওরই পরিকল্পনায় তিন তলা আর দোতালা ব্যাংকবেডে ঘরের ভেতর একটু খোলা মেলা ভাব আছে। এক পাশে তিনতলা বাংকবেড অন্যপাশে দুইতলা বাংকবেড। কাঞ্চন, আপন, রতন, শোভন আর হিরণের ঘর। পরিকল্পনা ওর। ওই নিজে এক কাঠ মিস্ত্রির সঙ্গে কাজ করে এমন ব্যাংকবেড বানিয়েছে। সারি সারি ছোট বেডের চাইতে বাংকবেড অনেক সুবিধার এই কারণে। সেবারে ফিলানথ্রপিস্ট মামা কোরবানি ঈদে দুটো খাসি কোরবানি না দিয়ে ওকে দুটো খাসির দাম দিয়েছিল। তাই দিয়ে ও এসব করেছে ও। মামা ওসব গরুখাসির প্রাণসংহার পছন্দ করেন না। 

মানুষ মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ সহ্য হয় না। হিরণ প্রায়ই বলে। আমি চলে যাব অন্য এক দেশে। সেখানে আমি একটা পাহাড় কিনবো। আর সেই পাহাড়ের উপর বাড়ি বানিয়ে আমি একা থাকবো। বাড়িতে তেরো জন। দেশে সতেরো আঠারো কোটি। রতন কথা শুনছিল। বলে -- হিরণ ভাই সেই বাড়িতে তুমি আমারে নিয়া যাইয়ো। আমি তোমার সঙ্গে থাকবো। 

না। কেউ থাকবে না আমার সঙ্গে। ঘর বাড়ি স্বাধীনতা আমি কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চাই না। 

একা থাকবা? রতন কেবল কলেজে ঢুকেছে ও ভাইকে প্রশ্ন করে। 

একা। আমি প্রথমে পাহাড়ের বাড়ি নিয়ে পি এইচ ডি করবো। তারপর নিজের জন্য একটা বাড়ি বানাবো। আহা কি সুন্দর সব দৃশ্য থাকবে আমার চারপাশে। জানালা খুললেই মানুষের মাথা দেখার ইচ্ছা নাই। বানে তুফানে, এ্যকসিডেন্টে, গাড়ি চাপা, বাস চাপা পরা, রোজদিন এত মারা যাবার পরেও মানুষ তো কমে না। ঘটনা কি? দুইকোটি সাগরে ভেসে যেতে পারে। না হলে মাটি ফাঁক হয়ে ভেতরে যেতে পারে। না হলে উড়ে যেতে পারে। তাতে দেশের তো ক্ষতি হবে না। হিরণ ওর নিজের ল্যাপটপে কি সব দেখছে মুখ না তুলে বলে এমন সব কথা রতনকে। রতন চলে যায়। ও জানে বাইরে যাওয়াটা ওর জন্য কঠিন কিছু না। তবে ভাবছে যাবে কোথায়? অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা কোথায়? কোথায় আছে মনের মত পাহাড় যেখানে ও বাড়ি বানিয়ে একা থাকবে। খুঁজতে খুঁজতে ঠিক করে আমেরিকার ওয়েস্টকোস্ট বা পশ্চিমের বেলাভূমির কাছাকাছি কোথাও ও থাকবে। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি নেবে তারপর পাহাড়ের উপরে নিজের বাড়ি। কিনে নেবে এক খাবলা পাহাড়। একেবারে সিন্ধান্ত নেওয়া শেষ। আর এই পৃথিবীতে হিরণ আনোয়ারের মত মেধাবী ও পরিশ্রমী একজন যদি প্রতিজ্ঞা করে সেটা হবে না তাতো হতে পারে না। 

মা বলেন -- তুই নাকি দূরে চলে যাবি হিরণ? 

যাব। তোমার আর নয়জন থাকবে তাদের নিয়ে থাকো। 

তুই কি কোনদিন আর ফিরে আসবি না। 

না। নানাসব মানুষের ঘিনঘিনে ভ্যাপসা গরমের দেশে আমি থাকতে চাই না। কারো কারো অবস্থা গরু ছাগলের চেয়েও খারাপ। একে কি বেঁচে থাকা বলে বল? 

মা কিছু বলেন না। কেবল নিজের মন্তব্য জানান -- একটা ভালো কাজ টাজ পেলে এই দেশেই চিম্বুক পাহাড়ে একটা বাড়ি বানিয়ে থাকিস। একটা পাহাড় নাকি কিনতে চাস? 

চাই। তবে সেটা এখানে নয়। চিম্বুক পাহাড়? ওখানেও প্রচুর মানুষ। দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। এই দেশ থেকে আমাকে দূরে কোথাও যেতে হবে। 

মা কিছু বলেন না। এখানে সেখানে দরখাস্ত করতে করতে ও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার পড়বার সুযোগ পায়। দুই বছরে মাস্টরস করে তারপর ও যা ভাবছে করবে। অনেক জায়গাতেই পাহাড় কেনা যায় মানে পাহাড়ের উপরে বাড়ি বানানো যায়। অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, জামাইকা। সব বাদ দিয়ে হিরণ পছন্দ করে পশ্চিম আমেরিকা। যাকে বলে ওয়েস্টকোস্ট। কালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি কোন এক জায়গা। যেখানে আছে গ্রান্ড কানিয়নের মত বিস্ময় তারি আশেপাশে কোথায়। তার আগে ওর আর্কিটেকচারের মাস্টার্সটা শেষ করতে হবে। ও পছন্দ করে ‘কালিফোর্নিয়া য়ুনিভার্সিটি অফ আর্কিটেকচার’। সেখানে দরখাস্ত করে। তারা ওকে যোগ দিতে বলে। কারণ ওদেশে যাবার জন্য যে ইংরাজি পরীক্ষা! সেটাতে ও খুব ভালো করেছে। অনেক নাম্বার পেয়েছে ও। এ ছাড়া ক্লাশ ওয়ান থেকে বিপুল বিপুল নাম্বারে ও সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। শেষ পরীক্ষা আর্কিটেকচারেও দারুণ ভালো করেছে। অর্নাস পাওয়া আর্কিটেকচার বা ইঞ্জিনিয়ারিং কঠিন সেটা ও পেয়েছে। ও খবর নিয়ে জেনেছে সেই বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী কি শিখতে চায় তার মডুল সে নিজে তৈরী করতে পারে। মানে নিজের সিলেবাস নিজে। ও ঠিক করে পর্বতের বাড়ি বা মাউনটেন হাউজিংএ পড়াশুনা করবে। দুই বছরের কোর্স। নিজে একটা সিলেবাস বানিয়ে নেবে। 

একদিন শুভসময়ে বাড়ির সকলকে কাঁদিয়ে হিরণ আনোয়ার প্লেনে উঠে বসে। রতন হাত ধরে বলে -- যখন তোমার অনেক বড় চাকরি হবে আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে ভাইয়া। বলতে চেয়েছিল -- না। সেটা হবে না। কিন্তু ভাইএর কান্নাকাতর মুখ তাকে এমন শক্ত কথা বলতে বাধা দেয়। পকেট থেকে রুমাল বের করে কেবল চোখ মুছিয়ে দেয়। বাবা আবু আনোয়ার বলেন কেবল-- পড়াশুনার ব্যাপারে তোমাকে কোনদিন উপদেশ দেইনি। এখনো দেব না। কেবল বলবো -- নিজের দিকে খেয়াল রাখবা। তুমি তো আর্কিটেকচারে কেবল রেকর্ডই ভাঙ্গো নাই কলের গানও ভাঙ্গছো। 

সকলে হাসে। বলে -- বাবা এখনও কলের গান বলে। 

মা বলেন -- সাদা মেয়ের পাল্লায় পড়বা না। 

না। আমার অন্য কাজ থাকবে। 

তারপর? যা ভেবেছিল তাই। খুব তাড়াতাড়ি এম এসসি হয়ে গেল। যখন প্রফেসর ওকে উপদেশ দিলেন -- এবার পি এইচডিটা করে ফেল। হিরন উত্তর দেয় -- না। কারণ আমি যদি পি এইচ ডি করি সেটা হবে মাউন্টেনের বাড়ি নিয়ে। কিন্তু স্যার ওই ব্যাপারে আমার সব জানা হয়ে গেছে। নতুন কিছু বলবার নাই। পর্বতের বাড়ির প্রধান কথা হলো চারপাশের প্লানটেশন বা গাছপালা লাগানো। যেন সবুজ শ্যামলিমা থাকে আমাদের চারপাশে। স্যার আমি জেনেছি কোন গাছগুলো ওইসব বৈরী আবহাওয়ায় বেঁচে থাকতে পারে। ফ্লোরা আর ফওনার ব্যাপার গুলো জানা ভালো। যেসব জীবজন্তু আছে তারা আমাদের বন্ধু কিম্বা বন্ধু নয়। আর গাছ বিহীন বসবাসও ঠিক হবে না। এসব নিয়ে পড়াশুনা করছি। পর্বতে কোন কোন গাছ বেঁচে থাকে সেসব জানছি, আরো জানতে হবে। 

স্যার কিছু বলেন না। হিরণ নামের এই পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি যা বলেছে সব সত্যি। ছেলেটা অসম্ভব মেধাবী। 

চাকরিটা ওর হলো। ও এই য়ুনিভার্সিটিতেই পড়াবে ও। ঠিক করলো -- এবার পর্বতের বাড়ির কাজ শুরু করবে। ও পছন্দ করলো -- ডিয়াবলো পাহাড়ে বাড়ি করতে। ক্রোটেসাস পিরিয়ডে নব্বই বা একশো মিলিয়ন আগে এইসব পাহাড়ের সৃষ্টি। বোধকরি বিশাল কোন বিষ্ফোরনে মাটি এবং নানাসব ধাতু মিলে এইসব পাহাড় সৃষ্টি করেছে। হিরণের সবচেয়ে ভালো লাগলো একখানা পর্বতের লেক। ঝকঝকে পানি। সেখান থেকে পানির লাইন টানা যাবে। এরপরেও শোবার ঘরের জানালা দিয়ে একখানা জলপ্রপাত যদি দেখা যায় মন্দ হয় না। হিরণ আনোয়ার নামের পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির এক মেধাবী বাঙালি সমস্ত মেধা দিয়ে সৃষ্টি করে একটি প্রপাত। যাকে শোবার ঘরের জানালা আর বসার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায়। পানির গভীর শব্দ ওকে আনন্দিত করে। ও দেখেছে এই পাহাড়ের এখানে ওখানে বেশ কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তি বাস করেন। ওদের কারণে ওখানে নানা সব সুন্দর সুন্দর বাড়ি আছে। কিন্তু ও সেইসব জন মানবের সঙ্গে থাকতে চায় না। আসলে ও কারো সঙ্গেই থাকতে চায় না। পর্বতের শেষ বাড়ি থেকে ওর বাড়ির দূরত্ব হতে হবে অন্তত আধমাইল। চারপাশের মানুষ বিবর্জিত একখানা বাড়ি। এইসব করতে গিয়ে য়ুনিভার্সিটির চাকরি গেল। মনে মনে খুশী হলো। মনে মনে বলে -- ওসব নিয়ম করে পড়ানো টড়ানো আমার নয়। ওর মত মেধাবী লোকের কাজের অভাব? এবার এমনএকটা কাজ পেল যেটা ল্যাপটপে করা যায়। ‘এ্যাডভাইজার এ্যান্ড কনসালটান্ট অফ কালিফোর্নিয়া মডার্ন আর্কিটেকচারাল ফামর্’। মাসে একদিন মিটিং করা বা লোকজনের সঙ্গে দেখা করা। বাঁকি সময় নিজের বাড়িতে বসে ল্যাপটপে সবকিছু করা। আদেশ, উপদেশ, পরামর্শ সবকিছু। বেশ চমৎকার! এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? বললো -- এটাই আমার জন্য উপযুক্ত। ওসব পড়ানো টড়ানো, গিজগিজে ছাত্র ছাত্রীর আমার দরকার নাই। অর্থাত মানুষ নেই চারপাশে এমন কোন জীবনের জন্য বড় বেশি কাতরতা ওর। ছোটবেলায় একটা ঘরে পাঁচজন, দেশে সতেরো কোটি মানুষ, যেখানে পড়াশুনা করেছে উপচে পড়া ছাত্রছাত্রী। রাস্তায় মানুষ মনে হয় সব মেলায় চলেছে। কাজেই সে একা থাকবে পাহাড়ের বাড়িতে। আর নানা সব বাড়িঘরের পরিকল্পনা করবে। পৃথিবীতে জমি কমে আসছে। কাজেই এইসব পাহাড় পর্বতকেই একদিন অনেককে বেছে নিতে হবে। তবে ওর নিজস্ব কারণ -- মানুষ বিবর্জিত জীবন চাই আমার। 

জায়গাটা সানফ্রান্সিকোর পূর্বদিকের সাগর ঘেসে। জন স্টাইনবেকের আদি নিবাস সালিনাস ভ্যালির দক্ষিনে। চমৎকার ডিয়াবলো রেঞ্জ। ডিয়াবলো পাহাড়ের নিচে দিয়ে চলে গেছে সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালা। নিচের দিকে সাপারেল গাছের সারি। যত উপরে ওঠা যায় গাছের সংখ্যা কমতে থাকে। সে সমস্যা কি করে ঠিক করতে হয় সে নিয়ে ইতোমধ্যে প্রচুর গবেষণা করেছে। মোটামুটি সমস্যার সমাধান ও জানে। নীল ওক, সাধারণ ওক, পাইন, কনিফার এবং আরো কিছু গাছপালা হতে পারে এখানে। এইসব গাছগুলো বাড়ির চারপাশে লাগাবে ও। বাড়ি আর গাছ একসঙ্গে বেড়ে উঠবে। যারা বাড়ি করতে ওকে সাহায্য করছে তাদের জন্য ওরই বানানো এক রোপওয়েতে তাদের আসতে হয়েছে। দুটো রোপওয়ে সোলার এনার্জিতে চলে। একটা বড়। যখন জিনিস পত্র আনতে হয় বড়টা ব্যবহার করে। আর ছোটটা দুইজন মানুষের জন্য ঠিক আছে। দুই তিনজন একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। সাশ্রয়ী সোলার এনার্জিতে এসব চলে। এইসবে যা খরচ হলো সেটা বিশাল একটা অংক। ওর গবেষণার বিষয় বলে খরচ খানিকটা কম হয়েছে। ভবিষ্যতে ওর বাড়িটা একটা মহান পর্বতে নতুন ধরণের বাড়ি-সৃষ্টির উদাহরণ হবে। এ খরচ টুকু ওকে মেনে নিতে হয়েছে। ‘জলপ্রপাত’ নামের বাড়ির ছবি এবং বানানোর সবকিছু অনলাইনে। যারা দেখতে চায় তাদের বলেন -- অনলাইরে দেখতে। দু একজন কর্তব্যক্তি দেখে গেছেন। ধন্য ধন্য করেছেন। পুরো বাড়ি করতে লেগেছে ওর দুই বছর। ডিয়াবলো পাহাড়ের শেষ বাড়ি থেকে আধমাইল ওই রোপ ওয়ে দিয়ে ওকে যেতে আসতে হয়। ওরা যতটুবু পারে সাহায্য করে। বাঁকিটা ও নিজেই করে। দুটো ঘর। দুটো বাথরুম। একটা রান্নাঘরে। কাচ ঘেরা একটা বসার ঘর। ডিজাইন ওর নিজের। ওইসব কাচ লাগানো বা ছাদ বানানো ও সবকিছুই একা এক হাতে করে ফেলে। দুই বার হেলিকাপটরে কিছু মেটেরিয়াল পেয়েছে ও। অনেক খরচও হয়েছে। বাট হু কেয়ারস! টাকার কষ্টে নেই এই মেধাবী ছেলে। বেশ চমৎকার সুন্দর একখানা বাড়ি হয়ে গেল। অনেকটা জাপানি কায়দায়। ঢালু ছাদ আর ভাঙ্গেনা এমন সব মেটিরিয়ালের বেশ ছবির মত একখানা বাড়ি। ‘বিয়িং এ্যালোন পয়েন্ট’ এমন একটা নাম ভেবেছিল। এখন ও নাম বদলে নাম দিয়েছে -- জলপ্রপাত। বাংলা নাম। ও ল্যাপটপে লেখে -- মানুষ আজকাল নিজে নিজে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। আমি এই অঞ্চলে একা। ওরা বলে এইসব জায়গায় নাকি নানাসব ভুত প্রেতের কারবার আছে। রহস্যময় বাতির আলো, হন্টিং, ক্রিপটোজুওলজি, আরো কত কি। ওসব আমাকে বিশ্বাস করতে হবে নাকি? যদি থাকে ওরা থাকবে ওদের মত আমি থাকবো আমার মত সমস্যা কি? এখানে আছে সোনালি বাজ পাখি, লাল লেজের চিল, কালো লেজের হরিণ, দুটো একটা ভাল্লুকও আছে। ওরা সব আমার প্রতিবেশী। মানুষ নয়। আমার মানুষের দরকার নাই। যে খক করে সামনে থুতু ফেলে আর অন্যের জীবনে নাক গলায় নাকের সর্দি ঝাড়তে ঝাড়তে। আমি আমার মত থাকবো। কয়েকটা বাজপাখি আসে। খাবার পায়। কালো লেজের হরিণ দুই একবার এসেছে। ও বলে -- বন্ধুরা ভয় নাই। আমি তোমাদের শিকার করবো না। 

একটা পোস্টবক্সে ও চিঠি পায়। বাড়ি থেকে কখনো। রতন লেখে -- ভাইয়া কেমন আছো? আমি অনার্স পাশ করেছি। এম এ হয়ে গেলে তোমার কাছে আসবো। আমি ইংরাজিতে এম এ করছি। যদিও আজকাল ইমেল, ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার, মোবাইল, চিঠি লেখালেখি নেই তবু ও পোস্ট বক্সটা রেখেছে। অফিসের ভারী ভারী কাগজপত্র আর অন্যান্য কারণে। রতন যখন মনের কথা বলতে চায় পোস্টবক্সটা ব্যবহার করে। বাংলায় সুন্দর চিঠি লেখে। কেন যে রতনকে পোস্টবক্সের ঠিকানা জানিয়েছে নিজে জানে না। 

রতনের এই আসবার ইচ্ছাতে ও কোন সায় দেয় না।ও কোন উত্তরও নয়। তবু রতন নিয়মিত বাড়ির খবর পাঠায়। লিখেছে -- দুই বোনেরা নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছেন। বাবার কোন খরচ লাগেনি। বড় ভাইয়া বিয়েতে প্রচুর দান সামগ্রী পেয়েছেন। এই কারণে একটা বাড়ি ভাড়া করে বউ নিয়ে চলে গেছেন। যেন দুধসাদা ফ্রিজে কোন দাগ না লাগে, নতুন আসবাবে যেন ধুলো না পড়ে আর বউএর হাতে যেন কোন হলুদের ঝোপ না লাগে। মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে রান্নাবাড়ি তিনি করবেন না। তিনি ভাইয়াকে বলে দিয়েছেন -- তোমাদের বাড়িতে দাসীগিরি করতে আমি আসিনি। 

হিরণ জানে আর সকলে ওকে বলে স্বার্থপর। কারণ? ও বাড়িতে কোন টাকাপয়সা পাঠায় না। না পাঠানোর কারন? ওর মতে এতটুকু একটা বাড়িতে বাবার উচিত ছিল না এতগুলো সন্তানকে পৃথিবীতে আনা। এই কি ওর স্বার্থপরতার যুক্তি? হয়তো। রতন লিখেছে -- পাঁচভাইএর ঘরে এখন তিনজন। ছোট বাংকবেডটা একজন চেয়ে নিয়েছে। ফলে ঘরে এখন বাতাস আর আলো আসতে পারে। তোমার পরিকল্পনার ঘর। তুমি আসলে একটা জিনিয়াস তুমি নিজে কি সেটা জানো? 

হিরণ চিঠি পড়ে, হাসে। তবে ওর ফেলে আসা জীবন, ভাইবোন, বাবা, কাউকে মিস করে না। কেবল মাঝে মাঝে মনে পড়ে মায়ের রান্নার কথা। কত সাধারণ জিনিসে কত অসাধারণ হতো সব কিছু। আলুরখোসা ভাজি, ডালেরই বা কত রকমফের। যেন এই ডালভাতকে অমৃত করতে তিনি কতটা সৃষ্টিশীল হতে পারেন তারই সাধনা সারাক্ষণ। মাকে সুখী মানুষ মনে হয়। 

ঘুম থেকে ওঠে আটটায়। একটু যোগাভ্যাস করে। বাইরের ছোট ব্যালকনিতে বসে চারপাশে তাকায়। নীল বার্চ বেড়ে উঠছে। পাইনের বনের বাতাস চারপাশে খেলা করে। বাড়ির চারপাশের গাছ গুলোতে নতুন পাতা। বসন্ত শুরু হয়ে গেছে। শীত এখানে অনেক। শীতে মাইনাস ডিগ্রি । তখন ডিমের মত বাড়ির ভেতর তাপ আর উষ্ণতা ওকে খুশী রাখবে। সোলার এনার্জি, থারমাল এনার্জি সুশোভিত বাড়ি। একটা গ্রিনহাউস করেছে। যেখানে অনেক কিছু লাগায় ও। ফসলে খুশী হয়। ঘরে ঘরে সুশোভন কাঠকয়লার চুলোর প্যাটার্নে ফায়ার। এ ছাড়াও আছে ঘর গরম করবার সবচাইতে আধুনিক বিধিব্যবস্থা। 

সেদিন সকালে উঠে মনে হলো -- বসন্ত বলে ঠান্ডা ভাব আছে। এইতো কিছুদিন পর এসে যাবে গ্রীষ্ণ। ওর পছন্দের তাপভরা ঘরে ও নাশতা খায়। পরিজ আর ডিম, ফল। সকালের নাশতায় ছোট মিষ্টি মুলো ওর গ্রীন হাউসে জন্মায়। আরো নানা কিছু। জীবনে ভালো কিছু করতে গেলে ভালো খাবার জরুরি। যতক্ষণ পারা যায় শরীরটাকে কাজ করবার উপযুক্ত রাখতে হবে। তারপর ল্যাপটপে অফিস করে যতক্ষণ প্রয়োজন হয়। এক ফাঁকে দুপুরের খাবার। মজার স্যান্ডউইচ না হলে পাই টাই। দরকার হলে দড়ির পথ বেয়ে নিচের পৃথিবীতে যায়। একটু হেঁটে, ঘুরে আসে। বড় বড় দোকান ওর যাবার জায়গা নয়। কারণ সেখানে অনেক মানুষ। গাড়িটা রেখেছে একটা গ্যারেজে। সেখান থেকে গাড়িটা নিয়ে দূরে কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে ঘন্টা দুয়েক হাঁটাহাঁটি করে ফিরে আসে। নিজের জগতে। রাতে বই পড়ে। সিনেমা দেখে। না হলে আর কিছু। নিজের গবেষণার কথা যাদের জানানোর কথা জানায়। তারপর ঘুম। বেশ আছি আমি। অপনমনে বলে। এই ভাবে কেটে যায় এক বছর তিনমাস। পড়াশুনা চাকরি সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ বছর পার করে ও। 

কখনো জানালায় দুএকটা এমন প্রাণী ওর চোখে পড়ে। মনে হয় প্রানী গুলো ওকে পছন্দ করে। যে মানুষ ওদের নিজস্ব জগতে এসেছে তাকে ওরা বোধকরি মেনে নেয়। তবে একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে ও দেখতে পায় একটা অদ্ভুত প্রাণী। যেন পাখাওয়ালা ডায়নাসোর। জানালা দিয়ে ওকে দেখছে। ক্রিপটোজুওলজিতে এমন এক জীবের কথা ও শুনেছে। ওরা নাকি এখনো বেঁচে আছে। এবং ওরা নিজের মত থাকে। মানুষকে পছন্দ করে না। ও চোখ ঘসতে ঘসতে বলে -- তুমি তোমার মত থাকো। আমি আমার মত থাকবো। কিন্তু সেই প্রানী যে ওকে পছন্দ করছে না ও বুঝতে পারে। ও পাশ ফেরে। বলে -- তোমার রাগ দেখে আমি পালিয়ে যাব এমন মনে করো না। এরপর ঘুমিয়ে যায়। 

পরদিন ঘুম ভাঙ্গে জ্বর জ্বর শরীরে। সব রকম ওষুধ আছে ওর মেডিসিন কাবার্ডে। সেখান থেকে জ্বর কমাবার একটা ওষুধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে। মনে পড়ছে ওর -- জুলি বলে যে ছাত্রী ওকে খব পছন্দ করেছিল তার কথা। কত ভাবেই না ভালোলাগা জানিয়েছিল। বলেছিল -- আমার পৃথিবীতে যদি মানুষের সংখ্যা কমতে কমতে একজন হয় আর সেই একজন যদি আপনি হন আমার কোন অসুবিধা হবে না। উত্তর দিয়েছিলেন -- আমার হবে। আপাতত নিজের সঙ্গ ছাড়া আর কোন সঙ্গ নয়। তাই বোধকরি এখনো তেমন কোন বন্ধনে জড়িয়ে পড়েনি। পড়তেও চায় না। কেবল একত্রিশ বছর বয়স ওর। আরো নয় বছর পর চিন্তা করবে। এখন অনেক গবেষণা ও পড়াশুনার ব্যাপার আছে। একজন এসে খাবলে খাবলে ওর সময় কেড়ে নেবে সেটা হতে পারে না। মেয়েরা বড় বেশি দাবী করে। সব মেয়েরা ওর মা নয়। যিনি সব মেনে নেন এবং তারপরেও সুখী থাকেন। জুলি নয় বা জেসমিন ও নয়। হয়তো একদিন একজন বিদূষী আর্কিটেক্ট বন্ধু ওর জীবনে আসতে পারে। তখন দুজনে মিলে মরুভূমিতে বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করবে। সে একদিন এখন নয়। ওর অনেক কিছু দেবার আছে এই পৃথিবীতে। বই লিখবে। পেপার তৈরী করবে। কত কাজ। কেবল তো একটা পর্বতের বাড়ি। আরো হতে পারে। 

রতন আরো জানিয়েছে -- বাবার কাজটায় রিটায়ার হয়ে গেছে। তিনি কোথায় যেন আর একটা কাজ পেয়েছেন। মা টেনেটুনে সব দিক সামলান। 

যখন জ্বরটা কমে ওর মনে পড়ে কিছু খাবার আনবার কথা। একটা নয় দুটো ফ্রিজে অনেক খাবার আছে। তারপরেও ও একটু বাইরে যাবে বলে ঠিক করে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটে গিয়ে রোপওয়ে। সেখানে পনেরো মিনিট গেলে ডিয়াবলো পাহাড়ের অন্যসব পাহাড়ের বাড়ির জনপদে যাওয়া যায়। সেখানে দোকান আছে। তবে ভালো কিছু পেতে গেলে আরো একটু দূরে যেতে হয়। নিচে একটা গ্যারেজে ওর ছোটখাটো একটা গাড়ি আছে। 

শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে বলে খুব বেশি সময় বাইরে থাকে না। কিছু সওদাপাতি নিয়ে রোপওয়ে বেয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে চায়। ঠিক যখন বাড়ির কাছে এসে নামবে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। এরপর আর মনে নেই। 

অনেক বাজ পাখি ওকে দেখেছিল। কালো লেজের হরিণ দুই একবার এসে ঘুরে গেছে। পাখিরা কিচ কিচ করে খুঁজে এনেছিল আর সব পাখিদের। হরিণ আর কয়েকটা হরিণকে। একটা গাছে আটকে তারপর নিচে পড়ে গিয়ে পাহাড়ে আটকে ছিল হিরণ প্রায় দুইদিন। তখন গ্রীষ্ণ কেবল শুরু হয়েছে। ফলে মরে যায়নি বা জমে যায়নি। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে ও অবাক হয়ে ভাবে কোথায়? মনে করতে পারে পড়ে যাবার কথা। তারপর? একজন সেবাপরায়ন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল কাছে আসে। প্রশ্ন করেন - কেমন আছেন এখন? নল চোং শরীরে। ওরা সারিয়ে তুলতে বন্ধপরিকর। 

হিরণ উত্তর দেয় -- আমি ভালো। কোথায় আমি? 

হাসপাতালে। হিরণ বুঝতে চেষ্টা করে এই কথার কি অর্থ। 

কবে থেকে? 

গতকাল সকাল থেকে। আপনার কোন জ্ঞান ছিল না। এয়ারঅ্যাম্বুলেন্স আপনাকে উদ্ধার করে আনে। ভাগ্য ভালো আপনার। ভয়ানক কোন ক্ষতি হয়নি। আপনি একেবারে সুস্থ হবেন অল্পদিনের মধ্যে। 

নার্স একটু থেমে বলে -- ভুল বললাম। আপনাকে দেখতে পেয়েছিল একটা ছেলে। ও পাহাড়ে ফসিল সংগ্রহ করতে গিয়েছিল। ওই খবর দিয়েছিল। না হলে কি হতো বলা যায় না। 

ছেলে? কোথায় ও? 

কাল এসে দেখে গেছে। আজ আবার আসতে পারে। 

হিরণ একা। একা থাকতে চেয়েছিল। বাঁকি জীবন সেই বাড়িটাতে যেখানে কোন মানুষ নাই। পাখিরা কখনো আসে। আর দুএকটি প্রাণী। মনে পড়ছে সেই ডায়নাসোরের মত প্রাণীকে। যে জানালায় ওকে দেখেছিল আগুন চোখে। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল সেই ডায়নাসোর দাঁড়িয়ে আছে কাছে কোথাও। সব মনের ভুল। ওসব প্রাণীর কথা লোকের বানানো। এখন চারপাশে মানুষ। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, ডিনার লেডি। কি ভাবছে হিরণ? সতেরোকোটি মানুষের গিজগিজে জগত থেকে মানুষ বিবর্জিত পৃথিবীতে আসতে চেয়েছিল ও। 

বিকেলে ছেলেটি আসে। খুব বেশি নয় বয়স। উনিশ টুনিশ হবে। আসবার সময় রতনকে যতটুকু দেখেছিল ততটুকুই হবে। লাজুক মুখে কাছে এসে দাঁড়ায়। একটা বড় কাজ করবার কারণে যেসব প্রশংসা ও শুনছে সেসবেই লজ্জা। ছেলেটাকে ধন্যবাদ দেয়। স্নেহের চোখে তাকায়। বলে -- তোমাকে একটা বড় রিওয়ার্ড দেওয়া দরকার। 

ছেলেটা হাসে। বলে -- ওসবের দরকার নেই স্যার। 

হিরণ ছেলেটাকে কাছে বসতে বলে। একজন মানুষ তার জীবন বাঁচিয়েছে। নতুন করে কি ভাবছে হিরণ আনোয়ার। ছেলেটা দেখতে রতনের মত। ছেলেটার হাতের মুঠি নিজের হাতে মুঠো করে ধরে। 
প্রিয় রতন আমি তোর আসবার টিকিট আর স্পনসরশিপ পাঠালাম। চলে আয়। আর চুপ করে মায়ের হাতে এই টাকা গুলো দিস। মনের মত কিছু রাঁধতে যেন পারেন। বাবাকে বলিস না। খপ করে মায়ের হাত থেকে সব নিয়ে নেবেন।
আয়। আমার বাড়িতে আমি একা। দুজনে মিলে ভালো সময় কাটবে। এখানে তোকে আর একটা এম এ করতে হবে। তারপর? দেদার লিখবি। তোর লেখার হাত ভালো।
--তোর ভাইয়া হিরণ। 
পি এস -- আসবার সময় মায়ের আলুর খোসার তরকারির রেসিপিটা আনিস। এখানে প্রচুর আলু। খোসার ব্যবহার কেউ জানে না। সেই তরকারির স্বাদ মুখে লেগে আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ