মিসেজ় মেরিওয়েদারের তাড়নায়, ডঃ মীডকে কিছু একটা করতেই হল। খবরের কাগজে একটা চিঠি পাঠালেন – অবশ্য রেট বাটলারের নাম করে নয় – কিন্তু সবাই বুঝতে পারবে। সম্পাদকমশাই ব্যাপারটার নাটকীয় গুরুত্ব অনুধাবন করে সেটা ছাপলেন কাগজের দ্বিতীয় পাতায় – যেটা প্রচলিত ধারাকে ভাঙার মতই একটা চমকপ্রদ ঘটনা – কারন প্রথম দুটো পাতায়, ক্রীতদাস, খচ্চর, লাঙ্গল কেনা বেচা,গুপ্ত রোগের চিকিৎসা, গর্ভপাত এবং পুরুষদের হৃত যৌবন পুনরুদ্ধারের সমস্যা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দিয়ে ভরা থাকত।
সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে ফাটকাবাজ, মুনাফাবাজ আর সরকারী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে যে প্রবল ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের উন্মেষ ঘটল, ডঃ মীডের চিঠিটাকে তারই প্রথম স্ফুলিঙ্গ বলা যেতে পারে। চার্লসটন বন্দর ইয়াঙ্কি যুদ্ধজাহাজের পরাক্রমে কার্যতঃ বন্ধ হয়ে যাবার পরে, উইলমিংডন বন্দর – যেটা এখন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চোরাচালানের কেন্দ্র – সেটার কাজ-কারবার রীতিমত খোলাখুলিভাবে কলঙ্কজনক হয়ে দাঁড়াল। ফাটকাবাজেরা উইলমিংডন বন্দরে এসে জাহাজ থেকে সব মাল সস্তায় কিনে নিয়ে গোপনে মজুত করে দাম বাড়ার অপেক্ষা করত। দাম বেড়েই যেত। প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের অভাবে মাসে মাসে দাম লাফ মেরে বাড়তে থাকত। সাধারণ মানুষকে হয় সেই সব জিনিষ ছাড়াই চালিয়ে নিতে হত, নয়ত ফাটকাবাজদের নির্ধারিত দামে কিনতে হত। গরীব আর নিম্নমধ্যবিত্ত লোকেদের খুব কষ্ট করে দিন গুজরান করতে হত। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কনফেডারেট টাকার দাম হু হু করে পড়ে যেতে লাগল – আর ততই মানুষের মধ্যে বিলাসের সমগ্রীর চাহিদা পাগলের মত বেড়ে যেতে লাগল। চোরাচালানকারীদের যেখানে অপরিহার্য জিনিষ নিয়ে আসার কথা, সেখানে ওরা জাহাজ বেশি দামের বিলাস সামগ্রী দিয়ে বোঝাই করে নিয়ে আসত। ফলে প্রত্যহিক প্রয়োজনের জিনিষ পাওয়া যেত না। লোকেরা এইসব বিলাসের সামগ্রী পাগলের মত কিনত – ভাবত হয়ত আগামীকাল এগুলোর দাম আরও বেড়ে যাবে।
পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো হয়ে উঠল উইলমিংডন থেকে রিচমণ্ডে আসার একটাই মাত্র রেলপথ থাকার জন্য। পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে, হাজার হাজার ব্যারেল ময়দা আর বাক্স বাক্স বেকন মাঝের স্টেশনগুলোতে পড়ে পড়ে নষ্ট হতে লাগল অথচ পাচারকারীরা সব সময়ই মদ, ওড়না, কফি উইলমিংডনে পৌঁছানোর দু’দিনের মধ্যে পরিবহনের বন্দোবস্ত করে রিচমণ্ডে পাঠিয়ে দিতে পারত।
অনেকদিন ধরেই একটা কানাগুষো শোনা যাচ্ছিল – এখন সেটা খোলাখুলি আলোচনা হতে লাগল – যে রেট বাটলার নিজের চারটে জাহাজের জিনিষপত্রই শুধু অপার্থিব দামে বিক্রি করেন তাই নয়, অন্যদের জাহাজের মালপত্রও কিনে নিয়ে দাম না বাড়া পর্যন্ত মজুত করে রাখতেন। বলা হত এইসব পাচার করা মাল কেনবার জন্য যে সংঘ স্থাপিত হয়েছিল, উনি তার প্রধান ছিলেন। এই সংঘের সম্পদের পরিমাণ কয়েক লক্ষ ডলার ছিল। এর প্রধান কার্যালয় ছিল উইলমিংডনে। এই শহরে, এমনকি রিচমণ্ডেও, এঁদের দখলে বেশ কিছু গুদাম ছিল। এই সব গুদামে এঁরা খাবারদাবার আর কাপড়চোপড় চড়া দামের অপেক্ষায় মজুত করে রাখতেন। এর ফলে সৈনিক এবং জনসাধারণকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছিল, আর তাই রেট বাটলার এবং অন্যান্য পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এঁদের উষ্মাও গোপন থাকত না।
“কনফেডারেসির নৌবহরে এমন অনেকে পাচারকারীই আছেন,” ডাক্তার চিঠির শেষের দিকে লিখেছেন, “যাঁরা নিঃস্বার্থ ভাবে তাঁদের জীবন এবং অর্থের ঝুঁকি নিয়ে। কনফেডারেসি যাতে বেঁচে থাকতে পারে তার জন্য আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত দক্ষিণের মানুষের হৃদয়ে তাঁদের ত্যাগ স্বীকার লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। যে সামান্য লাভের বিনিময়ে তাঁরা এই ঝুঁকি নেন, সেটা নিয়ে কারও মনে কোন ক্ষোভ নেই। এঁরা নিঃস্বার্থ ভদ্রলোক, আমরা এঁদের সম্মান করি। এঁদের সম্বন্ধে আমি কিছু বলছি না।
“কিন্তু এমন অনেক ইতর লোক আছে, যারা পাচারকারীর ছদ্মবেশে, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সব মানুষরূপী শকুনরা যারা মুনাফার জন্য সাটিন আর লেসের পোশাক নিয়ে আসছে, অথচ যে সব সৈনিকেরা আমাদের মহত্তম উদ্দেশ্যের কারনে যুদ্ধ করছে অথচ কুইনিনের অভাবে মারা পড়ছে, যারা চা আর কফি আনতে পারছে, কিন্তু আমাদের বীরেরা মর্ফিয়ার অভাবে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, সেই সব হয়রান মানুষের যথাযথ ক্রোধ আর ঘৃণার দিকে আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। এই সব পিশাচদের প্রতি আমার ঘৃণা ব্যক্ত করতে চাইছি যারা রবার্ট লীর অনুগামীদের রক্ত শোষণ করছে, যারা পাচারকারীদের নাম দেশপ্রেমীদের কাছে কলঙ্কিত করছে। এই সব সামাজিক জঞ্জালদের – যারা ভাল পোশাক আর চকচকে জুতো পরে ঘোরাফেরা করছে – তাঁদের কেমন করে আমরা সহ্য করতে পারি, যখন আমাদের ছেলেরা খালি পায়ে লড়াই করে চলেছে? যখন আমাদের সৈন্যরা তাঁবুর বাইরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আগুন পোয়াচ্ছে আর বাসী বেকন খেয়ে জীবনধারন করছে, তখন আমরা কেমন করে এদের শ্যাম্পেন পান করা আর দামি আহারের বিলাসিতা সহ্য করতে পারি? আমি সমস্ত অনুগ কনফেডারেটদের কাছে এদের বহিষ্কার করার আবেদন জানাচ্ছি।”
অ্যাটলান্টার মানুষ পড়ল, আর একজন বিজ্ঞ মানুষের পরামর্শ মেনে নিয়ে, অনুগত কনফেডারেট হিসেবে রেটকে উচ্ছেদ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হল।
১৮৬২ সালে যে সব বাড়িতে রেটের প্রবেশাধিকার ছিল, ১৮৬৩ সালে তার মধ্যে মাত্র আন্ট পিটিপ্যাটের বাড়িতেই সেটা বজায় রইল। আর মেলানি না থাকলে, সেখানেও হয়ত তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হত না। যখনই উনি শহরে আসতেন, আন্ট পিটি বেজায় অস্বস্তিতে থাকতেন। উনি ওঁর বাড়িতে আসলে মিস পিটির বন্ধুবান্ধবরা কি বলাবলি করতেন, সেটা সম্বন্ধে মিস পিটি খুব ভাল রকম ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু রেটযে ওঁর বাড়িতে স্বাগত নন, সেটা বলে দেওয়ার সৎ সাহস ওঁর মধ্যে ছিল না। যখনই উনি অ্যাটলান্টায় পদার্পণ করতেন তখন উনি মেয়েদের শাসাতেন যে রেট বাটলার ওঁর বাড়িতে এলেই উনি নিজে তাঁকে দরজা থেকেই বিদায় করে দেবেন। কিন্তু যখনই উনি হাতে একটা ছোট্ট গিফটের প্যাকেট নিয়ে এসে মুখে ওঁর তারিফ করতে থাকতেন, তখনই উনি গলে যেতেন।
“আমি কি করব ভেবে পাই না,” উনি মিনমিন করে কৈফিয়ত দিতেন। “উনি আমার দিকে তাকালেই – আমি খুব ভয় পেয়ে যাই আর ভাবি আমি যদি না বলি, উনি কি না কি করে বসবেন। ওঁর এত বদনাম! তোমাদের কি মনে হয় উনি আমাকে আঘাত করবেন – না – না ওহ – যদি চার্লি বেঁচে থাকত! স্কারলেট – তুমি ওঁকে বলে দিও এখানে আর না আসতে – হ্যা ভদ্রভাবে বলবে নিশ্চয়ই। আমি জানি! তুমিই ওঁকে আস্কারা দাও। শহরের সবাই সেই কথাই বলে। ধর তোমার মা জানতে পারলেন – আমাকে কি বলবেন বল তো? মেলি, তোমার ওঁকে অত সম্মান দেখানোর কিছু নেই। ওঁকে অত আগ্রহ দেখানোর দরকার নেই – একটু দূরত্ব রেখে চলবে। আচ্ছা মেলি – তোমার কি মনে হয় – আমার হেনরিকে একটা চিঠি লেখা উচিত – ও ক্যাপটেন বাটলারের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলবে?”
“না আমার সেরকম মনে হয় না,” মেলি বলল। “আর আমি ওঁর কোন অসম্মান করতেও পারব না। আমি মনে করি সবাই ক্যাপটেন বাটলারের সঙ্গে অকৃতজ্ঞ ব্যবহার করছেন। মিসেজ় মেরিওয়েদার কিংবা ডঃ মীড যেরকম বলছেন, উনি কিছুতেই অত খারাপ হতে পারেন না। উনি কখনও উপোষী মানুষের মুখের খাবার ছিনিয়ে নেবেন না। এই তো আমাকে উনি একশ ডলার দিয়েছিলেন অনাথদের জন্য। আমি জানি, উনি আমাদের সবার মতই দেশপ্রেমিক এবং অনুগত – শুধু উদ্ধত স্বভাবের জন্য আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন না। পুরুষমানুষ উদ্ধত হলে ভয়ানক একগুঁয়ে হয়ে যায় সে তো তুমি ভাল করেই জান।”
পুরুষমানুষ সম্বন্ধে আন্ট পিটির ধারণা খুবই কম ছিল – সে তিনি উদ্ধত হন বা নাই হন। তাই তিনি স্থূল হাত দুটো নাড়িয়ে তাঁর অসহায়তা ব্যক্ত করলেন। স্কারলেটও অনেক দিন থেকেই মেলানির এই সবার মধ্যে ভালত্ব দেখার অভ্যেসটা গা সইয়ে নিয়েছিল। মেলানি এক নম্বরের বোকা, তাই ও শোধরানোর নয়।
রেট যে মোটেই দেশপ্রেমিক নয়, এটা স্কারলেট ভাল করেই জানত, তবে কারও কাছে স্বীকার করবে না সেটা। এতে ওর কিছুই এসে যায় না। উনি যে সমস্ত ছোটখাটো উপহার নাসাউ থেকে ওর জন্য নিয়ে আসেন – যেটুকে একজন লেডি কোন পুরুষমানুষের কাছ থেকে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে গ্রহণ করতে পারে – সেটাই ওর কাছে জরুরি। এই আক্রার বাজারে – কোথা থেকে ও এই সব সুঁচ, চুলের কাঁটা, বনবন পাবে – যদি ওঁকে এখানে আসতে মানা করে দেয়? তার থেকে দায়িত্বটা আন্ট পিটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাই অনেক সোজা – উনিই তো পরিবারে সবার থেকে বড় – সবার অভিভাবক – আর ভাল মন্দ বিবেচনা করার ব্যাপারে শেষ কথা। রেটের আসা যাওয়া নিয়ে শহরের লোক যে ওর সম্বন্ধেও কানাকানি করে, সেটা স্কারলেট জানে। তবে অ্যাটলান্টার নজরে মেলানি উইল্কস কোনও অন্যায় করতে পারে না। তাই যতক্ষণ মেলানি রেটের সমর্থনে কথা বলবে, ততক্ষণ ওরও রেটের আসা যাওয়া নিয়ে খানিকটা রেখে ঢেকেই মন্তব্য করবে।
অবশ্য যদি রেট বাটলার ওঁর এই দেশদ্রোহিতা পরিহার করে চলেন, তবে তার থেকে কিছুই আর ভাল হতে পারে না। তাহলে পীচ স্ট্রীট ধরে ওঁর সঙ্গে যখন হেঁটে যায় তখন সবাই যে ওকে এড়িয়ে যায় – এই অস্বস্তিতে পড়তে হয় না।
“যদি আপনি এওরকম মনেই করেন তো সেটা গলা বাজিয়ে বলার কি দরকার?” একদিন ওঁকে তিরস্কারও করেছিল। আপনার যা ইচ্ছে ভাবুন, কিন্তু মুখ তো বন্ধ রাখতে পারেন! তাহলে তো কোন ঝামেলা হয় না!”
“সেটাতোমার অভ্যেস, তাই নয় কি? আমার সবুজ চোখো ভণ্ড! স্কারলেট, হায় স্কারলেট, আমি তোমার কাছ থেকে আরও একটু সাহস আশা করেছিলাম! আমি ভাবতাম আইরিশরা রাখ ঢাক করে কিছু বলে না – শয়তানদেরও হার মানায়। সত্যি করে বল তো, মাঝে মাঝে তোমার মনে হয় না মনের ঝাল খোলাখুলি ঝেড়ে নিলেই ভাল হয়?”
“সেটা সত্যি,” স্কারলেট খানিক অনিচ্ছাসহকারে স্বীকার করেছিল। “সকাল সন্ধ্যে মহান যুদ্ধের কথা শুনতে শউনতে আমি বিরক্ত হয়ে যাই। কিন্তু সত্যি বলতে কি, রেট বাটলার, সে সব বলে ফেললে, কেউ আমার সঙ্গে কথাই বলবে না। আর কোন ছেলেই আমার সঙ্গে নাচতেও চাইবে না!”
“হ্যা ঠিকই বলেছ। নাচের সঙ্গী পাওয়ার জন্য যে কোন মূল্যই মেটানো যায়। তোমার এই আত্মসংযম খুবই প্রশংসার যোগ্য। তবে কি জান, আমার আবার এই গুণটা তত নেই। আর যত সুবিধেই থাকুক না কেন, আমি দেশপ্রেম, আদর্শবাদ এসবের ভান করতে পারি না। এই যুদ্ধের শেষে নিঃস্ব হয়ে যাবার মত বোকা দেশপ্রেমিক অনেক আছে। না দেশপ্রেমিকের তালিকা উজ্জ্বল করার জন্য, না নিঃস্ব হয়ে যাবার জন্য, আমাকে তাদের খুব একটা দরকার নেই। ওদের গৌরবান্বিত হতে দাও – ওরা সেটার উপযুক্ত। একটা সত্যি কথা বলছি – আর বছরখানেকের মধ্যে ওদের শুধু ওই গৌরব ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।”
“আমার মনে হয় এভাবে বলে আপনি আপনার কদর্য মনের পরিচয় দিচ্ছেন। আপনি ভাল করেই জানেন ইংল্যাণ্ড আর ফ্রান্স আমাদের সমর্থনে খুব শীগগিরই এগিয়ে ___”
“বল কি স্কারলেট! তুমি নিশ্চয়ই আজকাল খবরের কাগজ পড়ছ। একেবারে অবাক করে দিলে! খবরদার, একদম পড়া বন্ধ করে দাও। পড়লে মেয়েদের বুদ্ধিশুদ্ধি সব গুলিয়ে যায়। যাই হোক – তোমাকে বলি – আমি ইংল্যাণ্ডে ছিলাম – একমাসও হয়নি এখনও। ইংল্যাণ্ড কনফেডারেসিকে কখনও সাহায্য করবে না – এ আমি বলে রাখলাম। ইংল্যাণ্ড পরাজিত দলের ওপর বাজী রাখে না কখনও। এইজন্যই ওর নাম ইংল্যাণ্ড। আর যে স্থূল ওলন্দাজ মহিলা এখন সিংহাসনে আসীন, তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তাই তিনি কোনমতেই ক্রীতদাসপ্রথাকে সমর্থন করবেন না। ইংল্যাণ্ডের কারখানা বন্ধ হয়ে যাক, দরকার হলে সেই কারখানার শ্রমিকরা না খেতে পেয়ে মরে যাক, তবুও কোনমতেই ক্রীতদাসপ্রথাকে সমর্থন করে আঘাত হানা চলবে না। আর ফ্রান্সের কথা যদি বল – নেপোলিয়নের দূর্বল অনুকরণ যিনি এখন দেশ সামলাচ্ছেন - উনি এখন মেক্সিকোতে ফরাসী আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত। আমাদের দিকে নজর দেবার সময়ই নেই। বলতে গেলে এই যুদ্ধ ওঁর কাছে আশীর্বাদস্বরুপ – কারন আমরা নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত থেকে ওঁর ব্যাপারে নাক গলাতে পারব না। নাহ স্কারলেট এই বিদেশ থেকে সাহায্য আসার ব্যাপারটা দক্ষিণের মনোবল বাড়িয়ে রাখার জন্য খবরের কাগজগুলোর একটা চাল। কনফেডারেসির কোন আশা নেই। কনফেডারেসি এখন উটের মত নিজের কুঁজের জলের ওপর ভরসা রেখে চলছে – কিন্তু কূঁজ যত বড়ই হোক না কেন, একদিন না একদিন তা নিঃশেষিত হবে। আমি ধরে নিয়েছি বড়জোর আর ছ’মাস আমার এই পাচারের কাজ চলতে পারে, তারপর আমার ছুটি। এরপর কাজ করা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। এরপর আমার জাহাজগুলো কোন বোকা ইংরেজের কাছে বিক্রী করে দেব – যে ভাববে দৃষ্টি এড়িয়ে পাচারের কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। অবশ্য আমি সেটা নিয়ে ভাবিত নই। আমি অনেক টাকা করে নিয়েছি, সবই ইংল্যাণ্ডের ব্যাঙ্কে সোনা হিসেবে জমা করা আছে। এই মূল্যহীন কাগজের টাকায় নয়।”
যেমন সব সময়ই হয়, উনি যা কিছু বলেন, সেটা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়। অন্যরা এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করতে পারে, কিন্তু স্কারলেটের মনে হয় কথাগুলো খুবই যুক্তিযুক্ত আর সত্যি। তবু মনে হয় এগুলোকে ভ্রান্ত মনে করে ওর বিস্মিত হয়ে রাগে ফেটে পড়া উচিত। সেই রকম কোন অনুভুতি ওর মধ্যে আসে না, কিন্তু ভান করে যেন ও খুব ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়েছে। এটাই নিজেকে ইজ্জতদার আর লেডিসুলভ প্রমাণ করার একটা উপায় বলে মনে করে ও।
“আমার মনে হয়, ক্যাপটেন বাটলার, ডঃ মীড যে কথাগুলো লিখেছেন সেগুলো ঠিকই। নিজের সম্মান ফিরে পাওয়ার জন্য, আপনার উচিত জাহাজগুলো বিক্রী করে দেবার পর সেনাবাহিনীতে গিয়ে নাম লেখানো। আপনি ওয়েস্ট পয়েন্টের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আর ____”
“তুমি তো দেখছি একজন ধর্মপ্রচারকের মত জ্ঞান দিতে শুরু করলে, যেমন দীক্ষা দেওয়ার আগে ওঁরা ভাষণ দিয়ে থাকেন! ধর আমি যদি সম্মান ফিরে পেতে না চাই? যে সমাজ আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আমি কেন সেই সমাজের জন্য লড়াই করব? বরং এই সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে গেলেই আমি খুশি হব।”
“আমি এরকম কোন ব্যবস্থার কথা শুনিনি,” একটু রেগে গিয়েই বলল ও।
“ও তাই নাকি? অথচ তুমি এই ব্যবস্থার একটা অঙ্গ – যেম আগে আমিও ছিলাম। আর আমি বাজী রেখে বলতে পারি, এই ব্যবস্থাটাকে তুমি মোটেই পছন্দ করনা – যেমন আমিও করি না। কেন আমাকে বাটলার পরিবারের কুলাঙ্গার বলা হয়? – সেটা এই জন্যই – অন্য কোন কারনে নয়। আমি চার্লসটনের আচার বিচারের সঙ্গে খাপ খাই না – আমি খাওয়াতেও পারিনি। চার্লসটন এই দক্ষিণী উন্নাসিকতারই অংশ – একটু বেশি রকমের উন্নাসিক বলা যেতে পারে। জনিনা এটা কতটা বিরক্তিকর – তুমি এখনও বুঝেছ কিনা? কত জিনিষ – সবাইকে মেনে চলতেই হবে – কেন না আবহমান কাল ধরে সবাই মেনে এসেছে! ঠিক একই ভাবে – কতগুলো জিনিষ – যেটা একেবারেই নির্দোষ – কিছুতেই করা যাবে না – কারন কখনওই সেটা করা হয়নি! এই সব হাজার ধরনের অর্থহীন ব্যাপার আমাকে রীতিমত উত্ত্যক্ত করে তোলে। সেই অল্পবয়সী মেয়ে্র ঘটনাটা – যাকে আমি বিয়ে করিনি – তুমি নিশ্চয়ই শুনে থাকবে – ওটা তো ওদের একটা বাহানা ছিল। কেবল মাত্র অন্ধকার হবার আগে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারিনি বলে – তাও একটা বিপর্যয়ের জন্য – একটা বোকা, বিরক্তিকর মেয়েকে বিয়ে করে ফেলতে হবে কোন যুক্তিতে? আর ওর ওই ট্যারাচোখো ভাইটা – কেন ওকে আমার দিকে গুলি চালাবার অনুমতি দিল – যেখানে আমি সোজা তাকিয়ে গুলি চালাতে পারি? যদি আমি ভদ্রলোক হতাম, তাহলে ছেলেটাকে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে দিতাম – তাতে হয়ত বাটলারদের কলঙ্কমোচন হত। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে ভালবাসি – আর বেশ আনন্দেই বেছে আছি। যখন দেখি আমার ভাই – চার্লসটনের জ্ঞানবৃদ্ধদের কথায় ওঠে বসে – আর ওর মোটাসোটা বউ আর ধানের খেত নিয়ে নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন করে – তখন বুঝি নিয়ম ভাঙ্গার লাভটা কোথায়! স্কারলেট আমাদের এই দক্ষিণের রীতিনীতি, মধ্যযুগের সমন্ত্রতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মত সেকেলে। ব্যবস্থাটা এখনও চলছে – এটাই সব থেকে আশ্চর্যের। এই ব্যবস্থা উঠে যাওয়া দরকার – আর সেটাই ধীরে ধীরে হচ্ছে। আর তুমি চাইছ যে ডঃ মীডের মত বক্তৃতাবাজ মানুষের কথা মেনে নিয়ে এই যুদ্ধকে মহান আর পবিত্র বলে মনে করব? আর ড্রামের আওয়াজে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছুটে ভার্জিনিয়া গিয়ে মার্স রবার্টের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেব? কতটা বোকা তুমি আমাকে ভাব? পদাঘাতকারীর পদচুম্বন করা আমার ধাতে নেই। এখন দক্ষিণের সাথে আমার পাল্লা সমান হয়েছে। একসময় দক্ষিণের লোক আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে উপোস করাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাকে উপোস করতে হয়নি। এখন দক্ষিণের এই মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমি অনেক অর্থ উপার্জন করে নিয়েছি – আমার জন্মসিদ্ধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য।”
“আমি মনে করি আপনি নীচ আর অর্থলোলুপ,” স্কারলেটের মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এল। উনি যা যা বললেন, তার বেশিরভাগই ওর মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল – যেমন ব্যক্তিগত কথাবার্তা ছাড়া কোন কিছুই ওর মাথায় ঢুকতে চায় না। কিন্তু কিছু কিছু কথা মনে হল ফেলে দেবার মত নয়। ভাল মানুষ বলে যাঁদের নাম করা হয় তাঁদের অনেকে কাজকর্ম কেমন যেন বোকার মত মনে হয়। এই যেমন ওকে ভান করতে হয় যে ও খুব দুঃখী, কিন্তু সত্যিই তো আর তা নয়! যেদিন ও মেলায় নেচেছিল সেদিন সকলে কিরকম বিস্মিতই না হয়েছিল! আর যখনই ও অন্য কমবয়সী ছেলেমেয়েদের থেকে আলাদারকম কিছু বলে কিংবা করে, তখন সকলে কিরকম চোখ কপালে তুলে ওকে দেখে! কিন্তু তবুও যে ঐতিহ্যকে ও নিজেও পছন্দ করে না, সেটার নিন্দা শুনে ওর গায়ে লাগল। এই সব মানুষদের মধ্যে – যাঁরা ওর আলপটকা কথাবার্তা শুনেও ভদ্রভাবে না শোনার ভান করে থাকেন – ও অনেকখানি সময় কাটিয়ে দিয়েছে।
“অর্থলোলুপ? না, আমি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। হয়ত সেটা অর্থলোলুপ কথাটারই সমার্থক। অন্তত যাঁরা আমার মত অতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নন তাঁরা আমাকে তাই বলবেন। যে কোন অনুগত কনফেডারেট – ১৮৬১ সালে যদি তার কাছে এক হাজার ডলার থাকত – তাহলে আমি যেটা করেছি সেটাই করতে পারত। তবে সেই সুযোগ সদ্ব্যবহার করার মত অর্থলোলুপ খুব কমই ছিল। যেমন ধর, ফোর্ট সামটারের পতনের ঠিক পরে পরেই – যখনও অবরোধ তৈরি হয়নি – আমি বেশ কয়েক হাজার তুলোর গাঁঠরি খুব সস্তায় কিনে নিয়ে ইংল্যাণ্ডে নিয়ে চলে যাই। সেগুলো এখনও লিভারপুলের গুদামে ধরে রাখা আছে। বিক্রি করিনি। আমি অপেক্ষা করছি যখন ইংলিশ মিলগুলোতে তুলোর সঙ্কট তৈরি হবে আর যে দাম চাইব সেই দামে বিক্রি করতে পারব। আশ্চর্য হব না যদি প্রতি পাউণ্ডে আমি এক ডলার করে দাম পেয়ে যাই!”
“যখন হাতি গাছে চড়তে পারবে তখন আপনি প্রতি পাউণ্ডে এক ডলার দামপাবেন!”
“আমার বিশ্বাস পাব। এখনই এক পাউণ্ডের দাম বাহাত্তর সেন্ট হয়ে গেছে। এই যুদ্ধ শেষ হলে আমি একজন ধনী ব্যক্তি হয়ে যাব, কারন স্কারলেট, আমি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন – না না অর্থলোলুপ! একবার তোমাকে বলেছিলাম না – অর্থ উপার্জনের জন্য দুটো সময় খুব ভাল – এক, যখন একটা দেশে উন্নয়ন হচ্ছে – আর দুই, যখন দেশটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের সময় অর্থোপার্জনের গতি ধীরে হয়, আর ধ্বংসের সময় দ্রুতগতিতে। কথাটা মনে রেখো। কখনও কাজে লেগে যেতে পারে।”
“আপনার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ,” গলায় যতখানি শ্লেষ মেশানো যায় ততখানি মিশিয়ে স্কারলেট বলল। “কিন্তু আমার এই উপদেশের প্রয়োজন নেই। আপনি কি মনে করেন আমার বাপী একজন ভিখারি? আমার যত টাকার দরকার তিনিই আমাকে দিতে পারবেন। তাছাড়া চার্লসের সম্পত্তিও আছে।”
“মনে হয় অভিজাত ফরাসীরাও তোমার মত করেই ভাবত – গিলোটিনে মাথা দেবার আগে পর্যন্ত!”
মাঝে মাঝেই স্কারলেটকে রেট বোঝাতেন যে ও যখন সব রকম সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, তখন ওর শোকের পোশাক পরে থাকার কোন মানেই হয় না। উনি ঝলমলে রঙের পোশাক পছন্দ করতেন। স্কারলেট যে শোকের পোশাক পরত আর ক্রেপের যে অবগুণ্ঠন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝুলে থাকত, সেটা দেখলে ওঁর কেমন হাস্যকর মনে হত আর উনি খানিকটা ক্ষুব্ধ বোধ করতেন। কিন্তু ও সেই নিষ্প্রভ পোশাক আর অবগুন্ঠন পরিত্যাক করার সাহস পায়নি, কারন ও জানত বেশ অনেক বছর কেটে যাবার আগেই ও যদি বর্ণময় পোশাক পরতে শুরু করে দেয় তাহলে শহরের লোকেরা ওর সম্বন্ধে নানা রকম কথা বলতে শুরু করবে। এছাড়া ও মায়ের কাছেই বা কি কৈফিয়ত দেবে?
রেট ওকে খোলাখুলি বলেছিলেন যে ওই ক্রেপের অবগুণ্ঠনে ওকে ঠিক কাকের মত দেখায় আর কালো পোশাকে ওর বয়স অন্তত দশ বছর বেশি লাগে। ওঁর এই অমার্জিত মন্তব্য শুনে স্কারলেট ছুটে আয়নার কাছে গিয়ে দেখেছিল যে সত্যিই ওকে আঠেরো না আটাশ বছরের লাগে!
“আমার মনে হয়েছিলতুমি নিজেকে মিসেজ় মেরিওয়েদারের মত মোটেই দেখাতে চাও না,” উপহাসের সুরে রেট বলেছিলেন। “আর ওই ওড়না পরে শোক দেখানোর – যে শোক তুমি কোনদিন অনুভবও করনি – মত রুচি তোমার নেই। এটা নিয়ে আমি বাজী ধরতে রাজী আছি। আগামী দু’মাসের মধ্যেই আমি তোমাকে ওই বনেট আর ওড়নার বদলে প্যারিসে তৈরি সুন্দর পোশাকে তোমাকে দেখতে চাই।”
“না না – একদম না –এটা নিয়ে আর কোন কথা নয়,” স্কারলেট বলে উঠল – চার্লসের প্রসঙ্গ উঠতে একটু উত্যক্ত। রেট তখন উইলমিংডনে যাভবার পরিকল্পনা করছিলেন – অল্প হেসে বিদায় নিলেন।
বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে, গ্রীষ্মের এক উজ্জ্বল সকালে উনি ফিরে এলেন – হাতে একটা সুদৃশ্য টুপির বাক্স। স্কারলেটকে বাড়িতে একা পেয়ে বাক্সটা খুললেন। ভেতরে অনেক টিসু পেপার দিয়ে মোড়ানো একটা বনেট – সেটা এতই সুন্দর যে স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল, “কি সুন্দর বনেট!” তারপর ওটা তুলে নিল। আজকাল নতুন পোশাক ছুঁয়ে দেখা দূরে থাক, দেখবার সুযোগও হয় না। তাই ওর মনে হল এর থেকে সুন্দর বনেট বুঝি আর হয় না। গাঢ় সবুজ রঙের টাফেটা কাপড় দিয়ে তৈরি, ভেতরে হাল্কা সবুজ সিল্কের লাইনিং দেওয়া। যে রিবন দিয়ে বনেটটা থুতনির তলায় বাঁধা হবে সেগুলোও হালকা সবুজ রঙের আর অনেকটা লম্বা। আর এই সুন্দর টুপির প্রান্ত থেকে উটপাখির সুন্দর পালক দিয়ে সাজানো।
“এটা পরে দেখ,” রেট হেসে বললেন।
ও দৌড়ে ঘরের অন্যপ্রান্তে রাখা আয়নার কাছে চলে গিয়ে বনেটটা মাথায় পরল। চুল গুলোকে পেছনে সরিয়ে দিল, যাতে কানের দুলগুলো দেখা যায়। তারপর থুতনির নীচে রিবন বেঁধে দিল।
“কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?” একপায়ে ভর দিয়ে ওঁর দিকে ঘুরে গিয়ে আর মাথাটা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, যাতে পালকগুলো দুলে ওঠে। ওঁর চোখে অনুমোদন আসার আগেই ও বুঝে গিয়েছিল যে ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ওকে খুব আকর্ষণীয় লাগছিল আর লাইনিং-এর হালকা সবুজ রঙের জন্য ওর চোখ দুটো পান্নার মত চকচক করছিল।
“ওহ রেট – এটা কার বনেট? আমি এটা কিনতে চাই – দরকার হলে আমার শেষ টাকাটাও এর জন্য দিতে রাজী!”
“ওটা তোমারই বনেট,” উনি বললেন। “এরকম সবুজ রঙ আর কাকেই বা মানাবে? তুমি কি জানো না তোমার চোখের রঙ আমার মনে ছিল?”
“আপনি কি সত্যিই এটা আমার জন্য তৈরি করিয়ে এনেছেন?”
“হ্যা, আর এই দেখ বাক্সের ওপর লেখা আছে ‘র্যু দ্য লা প্যে’ – অবশ্য যদি কথাটার তোমার কাছে কিছু মানে থাকে!”
না ওর কাছে এটার কোন মানেই নেই। ও শুধু আয়নার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে নিজের প্রতিচ্ছায়া দেখতে লাগল। এখন ওর কাছে একটা জিনিষই গুরুত্বপূর্ণ – সেটা হল গত দুবছরের মধ্যে ও সব থেকে সুন্দর টুপি মাথায় দিয়েছে আর ওকে খুব সুন্দর লাগছে। এটা দিয়ে ও কত কিছু করতে পারবে! কিন্তু হঠাৎ ওর মুখ শুকিয়ে গেল।
“কি হল তোমার পছন্দ হয়নি?”
“ভীষণ পছন্দ হয়েছে – শুধু আমার ভাবতে খারাপ লাগছে যে এই সুন্দর সবুজ রঙটাকে কালো ক্রেপ দিয়ে ঢেকে নিতে হবে আর এই পালকগুলোকে কালো রঙ করিয়ে নিতে হবে।”
উনি খুব চট করে ওর পাশে চলে গেলেন আর দক্ষহাতে রিবনের ফাঁস খুলে টুপিটা খুলে নিয়ে বাক্সে ঢুকিয়ে ফেললেন।
“এ কি করছেন? আপনি বললেন যে এটা আমার!”
“কিন্তু এটাকে শোক প্রকাশ করবার বনেটে বদলাবার জন্য নয়! আমি অন্য কোন সুন্দরী মেয়ে – যার সবুজ চোখ আছে – আর যে আমার রুচিকে সম্মান করতে জানে – তাঁকে খুঁজে নিয়ে এটা দেব।”
“না কিছুতেই না! এটা না পেলে আমি মরেই যাব! ওহ রেট, এরকম করবেন না। এটা আমাকেই নিতে দিন!”
“আর এটাকেও তোমার অন্যান্য টুপির মত ভয়াবহ করে তোলার জন্য?”
বাক্সটাকে ও দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল। ওই সুন্দর জিনিষটা – যেটাতে ওকে সুন্দর আর অল্পবয়সী দেখাচ্ছে – সেটা অন্য কোন মেয়েকে দিয়ে দেওয়া হবে! কক্খনো না! পিটি আর মেলানির কথা ভেবে একটু ভয় হল। এলেনের কথাও মনে হল – তাঁকেই বা কি বলবে! শেষ পর্যন্ত অহমিকার জয় হল।
“আমি এটা বদলাব না। কথা দিচ্ছি। নিন এবার এটা আমাকে নিতে দিন।”
একটু বিদ্রূপের হাসি হেসে বাক্সটা ওকে দিলেন। স্কারলেট টুপিটা আবার পরিপাটি করে পরে নিল।
“কত দাম?” ও হঠাৎ জিজ্ঞেস করল। আমার কাছে পঞ্চাশ ডলার আছে এখন – পরের মাসে ___”
“কনফেডারেটের টাকায় এর দাম হবে প্রায় দু’হাজার ডলার,” ওর বিষন্ন মুখ দেখে অল্প একটু হেসে বললেন।
“ওরে বাবা – ধরুন আমি এখন আপনাকে পঞ্চাশ ডলার দিচ্ছি – তারপরে যখন পাব ____”
“এর জন্য কোন টাকা লাগবে না,” উনি বললেন। এটা একটা উপহার।”
স্কারলেটের চোয়াল ঝুলে পড়ল। পুরুষ মানুষের কাছ থেকে উপহার নেবার ব্যাপারে নিয়মগুলো খুব স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে।
“শুধু চকোলেট আর ফুল,” এলেন কতবার বলেছেন, “বড় জোর কবিতার একটা বই, কিংবা একটা অ্যালবাম, বা ফ্লোরিডা ওয়াটারের একটা ছোট বোতল – বাস এটুকুই কোন লেডি একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে উপহার হিসেবে নিতে পারেন। কোন দামী উপহার তো কখনওই না – এমনকি তোমার প্রেমিকের কাছ থেকেও না। কোন গয়নাগাটি কিংবা পোশাক – এমনকি দস্তানা কিংবা রুমালও নয়। যদি তুমি এগুলো গ্রহণ কর তাহলে ভদ্রলোক ভাববেন যে তুমি লেডি নও, আর তোমার কাছ থেকে অবাঞ্ছিত সুযোগ নেবেন।”
“হে ভগবান,” স্কারলেট ভাবল – প্রথমে একবার আয়নায় নিজেকে দেখল, তারপর রেটের দূর্জ্ঞেয় মুখের দিকে তাকাল। “এটা আমি নেব না এ কথা আমি ওঁকে বলতেই পারব না। জিনিষটা ভারি সুন্দর। যদি উনি একটু অবাঞ্ছিত কোন সুযোগ নিতে চান – যদি ছোটখাটো কোন কিছু দাবী করেন – তাহলে আপত্তি করব না।” তারপরই নিজের এই ভাবনার কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে চোখমুখ রাঙা হয়ে গেল।
“আমি – আমি আপনাকে – পঞ্চাশ ডলার দিচ্ছি ___”
“যদি দাও তাহলে আমি সেটা নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দেব – অথবা তোমার নামে ওই টাকায় পুজো দেব। মনে হয় পুজো দিলে তোমার আত্মা শান্তি পাবে!”
খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্কারলেট হেসে ফেলল। সবুজ টুপির তলায় ওর হাসির প্রতিফলন দেখে ও সঙ্গে ওর মনকে শক্ত করে নিল।
“আপনি আমার সঙ্গে কি করতে চান?”
“ভাল ভাল উপহার দিয়ে ভুলিয়ে তোমার বালিকাসুলভ মনটা নষ্ট করে দিতে চাই যাতে তুমি আমার বশ হয়ে যাও,” উনি বললেন। “শুধু চকোলেট আর ফুল, সোনা, একজন ভদ্রলোকের কাছে থেকে আর কিছু নেবে না,” উনি নকল করে বললেন, আর স্কারলেট হেসে উঠল।
“আপনি ভীষণ চালাক আর কুচক্রী, রেট বাটলার, আর আপনি ভাল করেই জানেন যে এই বনেটটা এতই সুন্দর যে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারব না।”
ওঁর দৃষ্টিতে সৌন্দর্যের তারিফের সাথে সাথে উপহাসেরও ছোঁয়া।
“হ্যা তুমি নিশ্চয়ই মিস পিটিকে বলতে পার যে তুমি আমাকে টাফেটার আর সবুজ সিল্কের নমুনা দিয়েছিলে, আর বনেটের একটা ছবি এঁকে দিয়েছিলে আর আমি তোমার কাছ থেকে পঞ্চাশ ডলার উশুল করে নিয়েছি।”
“আমি বলব একশ ডলার – আর উনি শহরময় বলে বেড়াবেন – আর সবাই হিসেয় জ্বলে যাবে আর বলবে যে আমি কিরকম বেহিসেবী হয়ে গেছি। কিন্তু রেট আপনি আমার জন্য আর কখনও এত দামী কোন জিনিষ আনবেন না । আপনি এটা এনে দিয়েছেন আমি তার জন্য খুবই কৃতজ্ঞ, কিন্তু এর পরে অন্য কিছু আমি নিতে পারব না।”
“তাই নাকি! ভাল কথা। কিন্তু আমার যতদিন ইচ্ছে করবে আমি তোমার জন্য উপহার নিয়ে আসব আর যতক্ষণ সেই উপহার তোমার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। এই বনেটের সঙ্গে মানানসই গাঢ় সবুজ রঙের সিল্কের ফ্রক নিয়ে আসব তোমার জন্য। আর আগে থেকেই জানিয়ে রাখছি যে আমি খুব দয়ালু বলে এসব করছি না। আমি তোমাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছি – বনেট, চুড়ি এসব দিয়ে যাতে তুমি গাড্ডায় পড়ে যাও। সব সময় মনে রেখো কোন কারন ছাড়া আমি কিছু করি না। আর কাউকে আমি কিছু দিই না বিনিময়ে কিছু পাবার আশা না রেখে। আমি সব কিছুর মূল্য বুঝে নিই।”
ওঁর কালো চোখ দুটো ওর মুখের ওপর ঘোরাফেরা করে ঠোঁটের ওপর গিয়ে থেমে গেল।
স্কারলেট চোখ নীচু করে ফেলল। মনে মনে প্রবল উত্তেজনা। তাহলে উনি অবাঞ্ছিত সুযোগ নিতে চাইছেন – ঠিক যেমনটা এলেন বলেছিলেন! হয়ত উনি ওকে চুমু খেতে চান কিংবা চুমু খাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। মনের এই অশান্ত অবস্থায় ও বুঝতে পারল না উনি কোনটা করতে চাইছেন। না বললে উনি ওর মাথা থেকে বনেটটা টেনে খুলে নিয়ে অন্য কোন মেয়েকে দিয়ে দেবেন। আর যদি ও রাজী হয়ে যায় তাহলে হয়ত একটা নির্দোষ চুম্বন করবেন আর ভবিষ্যতে আরও সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে আসবেন – আরও একটা চুম্বনের লোভে! পুরুষ্মানুষরা চুমু খাওয়ার জন্য কেন যে এত লালায়িত থাকে? আর একটা চুমু খাওয়ার পরেই ওরা মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায় নিজেদের দূর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে – অবশ্য যদি মেয়েটা বুদ্ধি করে যদি দ্বিতীয় চুমু খাওয়ার ব্যাপারে ধানাই পানাই করে! রেট বাটলার ওর প্রেমে পড়ে চুম্বন ভিক্ষা করছে – ব্যাপারটা বেশ মজার হবে! হ্যা ওঁকে চুম্বন করতে বাধা দেবে না।
কিন্তু রেট বাটলার ওকে চুমবন করার কোন চেষ্টাই করলেন না। ও আড়চোখে ওঁকে দেখল, আর প্রশ্রয় দেবার ভঙ্গীতে বলল,
“তাহলে আপনি সব সময় মূল্য বুঝে নেন – তাই না? আপনি তাহলে আমার কাছ থেকে কি চান?”
“সেটা দেখা যাবে।”
“ভাল কথা – যদি আপনি ভেবে থাকেন ওই বনেটের মূল্য দেবার জন্য আমি আপনাকে বিয়ে করব – তাহলে শুনে নিন – আমি রাজী নই,” তেরছাভাবে মাথাটা তুলে খুব নির্ভিকস্বরে বলল। বনেটের পালকগুলো দুলে উঠল।
ওঁর গোঁপের তলা দিয়ে সাদা দাতগুলো ঝিলিক দিল।
“মহাশয়া ওই ভেবেই সুখে থাকুন। আমি আপনাকে কিংবা অন্য কাউকেই বিয়ে করতে ইচ্ছুক নই। আমি বিয়ে করার লোক নই।”
“তাই নাকি!” ও চেঁচিয়ে উঠল বেশ খানিকটা অবাক হয়েই – আর বুঝতে পারল যে অবাঞ্ছিত সুযোগ নেবার জন্য উনি বদ্ধপরিকর। “আমি আপনাকে একটা চুম্বন পর্যন্ত দিতে রাজী নই!”
“তাহলে তোমার ঠোটদুটো ওরকম করে কুঁচকে রেখেছ কেন?”
“ওহ!” চমকে উঠে আয়নায় এক ঝলক দেখতে পেল ওর লাল ঠোঁটদুটো সত্যি সত্যি চুমু খাবার মত করে রেখেছে। রেগে গিয়ে আবার “ওহ” বলে চেঁচিয়ে উঠল। মেঝের ওপর পদাঘাত করে বলল, “আপনার মত ভয়ঙ্কর লোক আর আমি কখনও দেখিনি। যদি আপনার সঙ্গে আর আমার কোনদিন দেখা নাও হয়, তাহলেও আমার কিছু এসে যাবে না!”
“যদি সত্যিই তোমার সেরকম মনে হয় তাহলে ওই বনেটটাতে পদাঘাত করা উচিত ছিল। রেগে গেলে তোমাকে কি ভালই না লাগে! তুমিও বোধহয় জান! নাও স্কারলেট তুমি বনেটটাকে পা দিয়ে ভেঙ্গে দাও যাতে আমি বুঝতে পারি তুমি আমার আর আমার উপহার সম্বন্ধে কি মনে কর!”
“খবরদার, বনেটটায় আপনি হাত লাগাবেন না!” ওটা আঁকড়ে ধরে পিছিয়ে গিয়ে বলল। উনি মৃদু হেসে এগিয়ে এসে ওর হাতদুটো নিজের হাতে তুলে নিলেন।
“ওহ স্কারলেট তুমি এতই ছেলেমানুষ যে আমার বুকে মোচড় দিচ্ছে,” উনি বললেন। “যেমন তুমি চাইছ, আমি তোমাকে একটা চুম্বন করব,” তারপর অবহেলাভরে একটু নীচু হয়ে, গোঁপ দিয়ে ওর গালে সামান্য স্পর্শ করলেন। “এবার বল, শোভনতা বজায় রাখবার জন্য তুমি আমার গালে চড় মারবে?”
বিদ্রোহী ঠোঁট নিয়ে ওঁর কালো গভীর চোখে তাকাতেই দেখল সেখানে শুধুই আমোদের ছোঁয়া। ও জোরে হেসে উঠল। কি পেছনেই না উনি লাগতে পারেন। বিরক্ত লাগে! যদি উনি ওকে বিয়ে করতে না চান – এমনকি চুমুও খেতে না চান – তাহলে কি চান উনি? যদি উনি ওর প্রেমে না পড়ে থাকেন, তাহলে এত ঘন ঘন আসেনই বা কেন আর এত উপহারই বা কেন নিয়ে আসেন?
“সেটাই ভাল স্কারলেট,” উনি বললেন। “ আমি তোমার জীবনে কুপ্রভাব বিস্তার করছি। যদি তোমার ভাল চাও, তাহলে আমাকে দূর করে দাও - অবশ্য যদি পেরে ওঠ। আমাকে দূর করে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু আমি তোমার জন্য মোটেই ভাল নই।”
“সত্যি কি তাই?”
“তুমি বুঝতে পারনি? সেই মেলায় তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার পর থেকে তোমার সুনাম একেবারে লাটে উঠেছে! আর এর জন্য আমিই সব থেকে বেশি দায়ী। কে তোমাকে নাচবার জন্য উস্কে দিয়েছিল? কে তোমাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিল যে আমাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য মহতও নয় পবিত্রও নয়? কে তোমাকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল যে পুরুষ্মানুষরা বোকার মত বড় বড় নীতির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ফেলে? এই যে সব বুড়িরা তোমাকে নিয়ে নানান কথা বলেন – কে তাঁদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে? কে তোমাকে অনেক বছর ধরে শোক মানানোর হাত থেকে বের করে এনেছে? আর সব শেষে – ভদ্রলোকের কাছ থেকে যে ধরনের উপহার নেওয়া যায় না – নিলে আর ভদ্রমহিলা থাকা যায় না – সে ধরনের উপহার নিতে বাধ্য করেছে?”
“অতখানি আত্মসন্তুষ্টিতে ডুবে যাবেন না ক্যাপ্টেন বাটলার। তেমন কিছু কলঙ্কজনক কাজ আমি করিনি। যা যা করেছি – আপনার সাহায্য ছাড়াও আমি করতাম।”
“আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে,” ওঁর কণ্ঠস্বর শান্ত আর গম্ভীর শোনাল। “তাহলে তুমি এখনও তুমি চার্লস হ্যামিল্টনের শোকসন্তপ্তা বিধবাই থেকে যেতে আর সকলে তোমার আহতদের সেবা করার জন্য জয়ধ্বনীকরত। কিন্তু কালক্রমে তুমি ___”
কিন্তু ও কিছুই শুনছিল না। ও আবার আয়নায় আনন্দিতচিত্তে নিজেকে দেখছিল। ভাবছিল আজই বিকেলে এই বনেটটা পরে হাসপাতালে যাবে – আরোগ্যকামীদের জন্য ফুল নিয়ে।
ওঁর শেষ কথাগুলোতে যে বাস্তবের ছোঁয়া আছে সেটা ওর মাথায় ঢুকল না। ও বুঝতেই পারল না যে রেট ওকে বৈধব্যের কারাগার থেকে টেনে বের করে এনেছেন যাতে সে অবিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে রেষারেষি করতে পারে – যখন কিনা ওর এই খুকী সেজে থাকার দিন পার হয়ে যাওয়ার কথা ছিল! এটাও বুঝতে পারল না, যে ওঁর সহায়তায় ও এলেনের শেখানো রাস্তা ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পরিবর্তন এত আস্তে আস্তে এসেছে যে একটা নিয়ম ভাঙ্গার সঙ্গে অন্য একটা নিয়ম ভাঙ্গাকে সংযুক্ত করতে পারছিল না। আর এঁদের কোনটার সাথেই ও রেটের অবদানকে মেনে নিতে পারছিল না। ওর মাথায়ই আসেনি, ওঁর উৎসাহেই লেডি হবার জন্য মায়ের দেওয়া উপদেশ আর সমাজবিধির কড়া নিয়মগুলোকে ও অগ্রাহ্য করতে শিখেছিল।
ও শুধু ভাবল যে বনেটটা এতদিনের ব্যবহার করা সব বনেটের থেকেই বেশি সুন্দর – আর এর জন্য ওর একটা পয়সাও খরচ হয়নি – আর রেট নিশ্চয়ই ওর প্রেমে পড়েছেন – স্বীকার করুন চাই না করুন। আর এটা ওঁকে দিয়ে স্বীকার করিয়েই ছাড়তে হবে।
পরের দিন সকালবেলা হাতে চিরুনি নিয়ে আর ঠোটে ধরা অনেকগুলো চুলের কাঁটা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। চুল বাঁধবার এক বিশেষ ধরনের “কয়ফার” যেটা মেবেলের কথায় রাজধানী রিচমণ্ডে (মেবেল সদ্য সেখানে ওর বরের কাছ থেকে ঘুরে এসেছে) খুব আলোড়ন তুলেছে। ওটার নাম দেওয়া হয়েছে “বেড়াল, ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর”। কিন্তু ওটা লাগানো বেশ শক্ত কাজ। চুলটাকে মাথার মাঝখান থেকে ভাগ করতে হবে। তিনটে থাকে চুলের দৈর্ঘের ক্রমবর্ধমানতা অনুযায়ী মাথার দুপাশে সাজাতে হবে। দীর্ঘতম এবং যেটা সবথেকে কাছে থাকবে সেটা হল “বেড়াল”। “বেড়াল” আর ধেড়ে ইঁদুর” সামলে নেওয়া যাচ্ছে। মুশকিল বাধাচ্ছে “নেংটি ইঁদুর”। বার বার চুলের কাটার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে হয়রানের একশেষ করে ছাড়ছে। কিন্তু ও পণ করে নিয়েছে যে ওটা ওকে সামলে নিতেই হবে। কারন রেট সাপারের সময় আসবেন। উনি যে কোন নতুন ধরনের সাজসজ্জা লক্ষ্য করে মন্তব্য করে থাকেন।
এই সব কসরত করতে করতে ও যখন ঘেমে নেয়ে উঠেছে, তখন ও নিচের হলে হাল্কা পায়ে কারো দৌড়ে আসার শব্দ পেল। বুঝল মেলানি হাসপাতাল থেকে ফিরল। তারপর শুনতে পেল একসাথে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ও উঠে আসছে। ও একটা চুলের কাঁটা হাতে ধরে একটু থেমে গেল। নিশচয়ই গুরুতর কিছু গণ্ডগোল হয়েছে কারন মেলানির চলাফেরার মধ্যে ঠিক একজন মধ্যবয়সি মহিলার আভিজাত্য কাজ করে। ও দরজার খুলে দিল। মেলানি দৌড়ে ভেতরে এল – ওর চোখে মুখে আতঙ্ক – এক অপরাধ সচেতন শিশুর মত লাগছে।
গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। বনেটটা মাথা থেকে খুলে গিয়ে কাঁধের ওপর ঝুলে আছে আর পোশাকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর হাতে কিছু একটা ধরা আছে। আর সস্তার পারফিউমের গন্ধে ঘরটা ভরে গেল।
“ওহ স্কারলেট!” ও কেঁদে উঠল। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় ডুবে গেল। “আন্টি কি বাড়ি ফিরেছেন? ও ফেরেননি? ভগবান দয়া করেছেন! স্কারলেট আমি এতটা মনঃক্ষুন্ন হয়েছি যে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে! আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম স্কারলেট – আর আঙ্কল পীটার আমার নামে আন্টিকে নালিশ করবে বলে শাসিয়েছে!”
“কি নালিশ করবে?”
“যে আমি কথা বলছিলাম – ঐ মিস – মিসেজ় –,” মেলানি রুমাল দিয়ে ঘেমে ওঠা মুখের ওপর হাওয়া করতে থাকল। “ওই যে সেই মহিলা – যার চুলগুলো লাল – বেল ওয়াটলিং!”
“কিন্তু কেন মেলি?” স্কারলেট খুব আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
সেই লালচুলো মহিলা যাকে আটলান্টা আসার প্রথম দিনেই স্কারলেট দেখেছিল – এতদিনে বুঝে গেছে বেল ওয়াটলিং এই শহরের সব থেকে বদনাম মহিলা। সৈন্যদের সাথে সাথে অনেক বেশ্যাই শহরে এসে গেছে। কিন্তু এদের মধ্যে বেল ওয়াটলিং সব থেকে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে – ওর উজ্জ্বলবর্ণের চুল আর জমকালো পোশাকের জন্য। পীচট্রী স্ট্রীট কিংবা কোন অভিজাত এলাকায় ওকে খুবই কম দেখা যায়। কিন্তু কালেভদ্রে দেখা গেলেও লেডিরা তাড়াতাড়ি সেই স্থান ত্যাগ করে যান ওর ছোঁয়াচ বাঁচাতে। আর মেলানি কি না ওর সঙ্গেই গল্প করছিল! আঙ্কল পীটারের রেগে যাবার যথেষ্ট কারন আছে!
“আন্ট পিটি জানতে পারলে আমি মরেই যাব! তুমি জানোই তো উনি কান্নাকাটি করবেন আর শহরের সবাইকে বলে দেবেন – আর ছোট হয়ে যাব,” ফোঁপাতে ফোঁপাতে মেলানি বলল। “কিন্তু জানো আমার দোষ ছিল না। আমি – আমি ওর কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারিনি। সেটা অসভ্যতা হত! স্কারলেট, আমার ওর জন্য খারাপ লাগছিল। কি মনে হয় তোমার, এরকম মনে হওয়া খারাপ?”
তখন স্কারলেটের নৈতিকতা নিয়ে ভাববার ইচ্ছেই ছিল না। সব সদ্বংশজাত সরল মেয়েদের মত, ওরও বেশ্যাদের সম্বন্ধে অসীম কৌতুহল ছিল।
“কি চাইছিল ও? কথাবার্তা কেমন বলে?”
“ওর কথাবার্তা একেবারেই ব্যাকরণ না মেনে, কিন্তু তবুও ও চেষ্টা করছিল খুব মার্জিতভাবে কথা বলার – বেচারা! যখন হাসপাতাল থেকে বেরোলাম, তখনও আঙ্কল পীটার গাড়ি নিয়ে পৌঁছোয়নি। ভাবলাম হেঁটেই বাড়ি ফিরব। যখন আমি এমার্সনদের উঠোনের কাছে পৌঁছলাম, তখন ও হেজের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ভগবানকে ধন্যবাদ, যে এমার্সনরা ম্যাকনে থাকেন। ও বলল, “মিসেজ় উইল্কস, দয়া করে আমার সাথে দু’মিনিট কথা বলুন” – আমি জানিনা আমার নাম ও কি করে জানতে পারল! আমার মনে হল আমার দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া উচিত – কিন্তু স্কারলেট কি বলব ওর মুখ এত বিষন্ন দেখাল – আর এত মিনতি করে বলল – আমি পালাতে পারলাম না। ও একটা কালো পোশাক পরে ছিল – আর কালো বনেট। মুখে কোন রঙচঙ লাগায়নি – আর ওকে সত্যি বলছি খুবই ভদ্র দেখাচ্ছিল – শুধু লাল চুল বাদে। আমি কিছু বলার আগেই ও বলল, “আমি জানি আমার আপনার সঙ্গে কথা বলার উচিত নয় – কিন্তু আমি ঐ বুড়ী মাগী মিসেজ় এলসিং-এর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম – কিন্তু উনি পালিয়ে গেলেন আমাকে দেখেই”।
“সত্যি বলছ – ও ওঁকে বুড়ী মাগী বলেছে? স্কারলেট হেসে গড়িয়ে পড়ল।
“হেসো না। এটা মজার কোন ব্যাপারই নয়। মনে হল – মিস – মানে ওই মহিলা হাসপাতালের জন্য কিছু করতে চায়। তুমি ভাবতে পার! ও প্রতিদিন সকালে নার্সের কাজ করতে চেয়েছিল – শুনে মিসেজ় এলসিং – প্রায় মূর্চ্ছা গেছিলেন আর ওকে হাসপাতাল থেকে বের করিয়ে দিয়েছেন! তারপর ও বলল, “আমিও কিছু করতে চাই – আমিও তো আপনারই মত একজন কনফেডারেট – তাই না?” স্কারলেট ওর সাহায্য করার কথা শুনে আমার এত ভাল লাগল! যে আমাদের এই উদ্দেশ্যর জন্য সাহায্য করতে চায় – সে তেমন খারাপ হতেই পারেনা। এরকম ভাবে ভাবার জন্য আমি কি খারাপ হয়ে গেলাম?”
“আরে মেলি, খারাপ হলে কি এসে যায়? আর কি বলল?”
“ও বলল, যে সমস্ত মেয়েরা হাসপাতালের কাছ দিয়ে যায় ও তাদের লক্ষ্য করে – আমাকে দেখে নাকি ওর মনে হয়েছে আমি খুব দয়ালু। তাই ও আমাকে ডেকেছে। ওর কাছে কিছু টাকা আছে – ও চায় সেটা আমি নিয়ে হাসপাতালের জন্য ব্যবহার করি – আর কাউকে যেন না বলি সেটা কোথা থেকে এসেছে। ও বলল, মিসেজ় এলসিং যদি জানতে পারেন ওই টাকা কি ধরনের তাহলে উনি সেটা কাজে লাগাতেই দেবেন না। কি ধরনের টাকা! এই কথাটা শুনেই তো আমি ভাবলাম অজ্ঞান হয়ে যাব। শুনে এত খারাপ লাগল যে আমি ওর কাছ থেকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যেতে চাইছিলাম। আমি শুধু বললাম, ‘হ্যা নিশ্চয়ই, তুমি কত ভাল’ বা এই ধরনের কিছু বোকা বোকা কথা বলেছিলাম। ও হেসে বলল, ‘তুমি একজন সত্যিকারের ক্রিশ্চান’ এই বলে আমার হাতে এই নোংরা রুমালটা গুঁজে দিল। উঃ, তুমি গন্ধটা পাচ্ছ?”
মেলানি একটা ছেলেদের রুমাল তুলে ধরল, যথেষ্ট ময়লা আর উগ্র পারফিউম দেওয়া। ওর মধ্যে কয়েকটা কয়েন বাঁধা রয়েছে।
“ও আমাকে ধন্যবাদ দিল, আর বলল, প্রত্যেক সপ্তাহে আমাকে কিছু কিছু টাকা এনে দেবে – ঠিক তখনই আঙ্কল পীটার আমাকে দেখতে পেল!” বলে মেলি একেবারে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বালিশে মাথা গুঁজে দিল। “আর যখন দেখল আমার সাথে কে রয়েছে তখন আমাকে ভীষণ জোরে ধমকে দিল! আমাকে এখনও কেউ কখনও জোরে ধমকায় নি। তারপর বলল, ‘তুমি এক্ষুনি গাড়িতে উঠে বোসো।’ আমি অবশ্য তাই করলাম। কিন্তু সারা রাস্তা আমাকে বকতে বকতে এল – আমাকে কিছু বলতে পর্যন্ত দিল না। বলল, ও আন্ট পিটিকে সব বলে দেবে। স্কারলেট, তুমি নীচে গিয়ে ওকে বল যেন ও না বলে। হয়ত ও তোমার কথা শুনবে। আমি ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলেছি শুনলে আন্ট পিটি মরেই যাবে! তুমি ওকে বলবে তো?”
“বলব। কিন্তু তার আগে দেখা যাক কত টাকা আছে এতে। বেশ ভারী লাগছে কিন্তু।”
ও রুমালের গিটটা খুলে ফেলতেই বিছানার ওপরে বেশ কিছু সোনার মুদ্রা বিছানার ওপর গড়িয়ে পড়ল।
“স্কারলেট, এখানে পঞ্চাশ ডলার আছে! আর সোনায়!” মেলানি অবাক হয়ে চকচকে মুদ্রাগুলো গুনতে গুনতে বলে উঠল। “এখন বল – এই ধরনের টাকা – মানে যে ভাবে এটা রোজগার করা হয়েছে – সেগুলো আমাদের ছেলেদের জন্য ব্যবহার করা উচিত? তোমার কি মনে হয় না ঈশ্বর বুঝতে পারবেন – যে ও সাহায্য করতে চেয়েছিল – আর এই টাকায় কলঙ্ক লেগে থাকার ব্যাপারটা উনি গ্রাহ্যের মধ্যে আনবেন না? যখনই আমার মনে হয় কত কিছু হাস্পাতালের জন্য কেনা দরকার _____”
কিন্তু স্কারলেটের কানে কিছুই ঢুকছিল না। স্কারলেট ওই নোংরা রুমালটার দিকে তাকিয়েছিল আর লজ্জায় আর রাগে ওর গা জ্বলছিল। রুমালের এক কোনে নক্সা করে লেখা ছিল “R.K.B.” ওর সব থেকে ওপরের ড্রয়ারে ঠিক এই রকম নক্সা করা একটা রুমাল আছে। মাত্র গতকালই কুড়িয়ে নেওয়া কিছু বুনোফুল বাঁধবার জন্য রেট ওটা ওকে ধার দিয়েছিলেন! আজ রাত্রে সাপারে যখন উনি আসবেন, তখন ফেরত দেবে বলে ভেবে রেখেছিল।
তার মানে ওই নোংরা মহিলার সঙ্গে রেটের সম্পর্ক আছে আর উনিই ওই টাকা ওকে দিয়েছেন। এই ভাবেই তাহলে হাসপাতালকে সাহায্য করবার টাকাটা এসেছে। অবরোধের সোনা! ভাবাই যায় না, ওই নরকের কীটের সঙ্গে মেলামেশা করে, আবার ওঁর কোন ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয়! আর ও কিনা ভেবেছিল উনি ওকে ভালবেসে ফেলেছেন! এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে সেটা হতেই পারে না।
স্কারলেটের কাছে খারাপ মেয়েমানুষ আর তাদের কার্যকলাপ খুবই রহস্যাবৃত আর ঘৃণা উদ্রেককারী। ও জানত এইসব মেয়েরা পুরুষমানুষের কাছে যে কারনে প্রশ্রয় পায় সেটা কোন ভদ্রমহিলাই মুখে আনেন না – যদিও আনেন সেটা নেহাতই নিজেদের মধ্যে কানাকানি করার জন্য – কিংবা পরোক্ষভাবে বা অনেক রেখে ঢেকে। ও সব সময় ভাবত এই সব মেয়েদের কাছে কেবল ছোটলোক আর নীচ মানুষই যায়। ও ভাবতেই পারেনি যাঁরা ভুদ্রলোক – মানে যাঁরা ভদ্র পরিবারে আমন্ত্রিত হন – যাঁদের সঙ্গে ও নাচে যোগ দেয় – তাঁরা এরকম কাজ করতে পারেন। ওর চিন্তা করার এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল – যেটা বলতে গেলে খুবই ভীতিপ্রদ। হয়ত সব পুরুষমানুষই এটা করে থাকে! শুধু যে তাঁরা তাঁদের স্ত্রীদের এই অশোভন কাজ করতে বাধ্য করেন তাই নয়, এমনকি এঁরা পতিতা মহিলাদের কাছেও যান টাকা দিয়ে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য! পুরুষজাতটাই ঘৃণ্য, আর রেট বাটলার হলেন ঘৃণ্যতম!

“ওফ,” অত্যন্ত উষ্মার সঙ্গে ও ভাবল, “আমি যদি লেডি না হতাম, তাহলে কত কথাই না ওই জঘন্য লোকটার মুখের ওপর বলে দিতে পারতাম!”
রুমালটা হাতে লুকিয়ে নিয়ে ও নীচে চলে গেল আঙ্কল পীটারের খোঁজ করতে। যাবার সময় উনোনের কাছে এসে ওর মধ্যে রুমালটাকে ফেলে দিল আর নিষ্ফল আক্রোশে ওটা পুড়ে যেতে দেখল।
0 মন্তব্যসমূহ