সালেহা চৌধুরী'র গল্প : ছেলের মত

রোকেয়া বেগম আজ একটু দেরীতে ঘুম থেকে উঠেছেন। স্বামী কবির হোসেন বেশ কিছু আগে উঠে একটা হাঁটাহাঁটি করে কাগজ পড়ছেন। স্ত্রী রোকেয়া সকালেই ওঠেন। কিন্তু আজ দেরী। মাঝে মাঝে এমন হয় তার। সত্তুর পার হবার পর থেকে তাঁর ঘুমের সমস্যা। স্লিপিং পিল খান মাঝে মাঝে। সকলে যখন বলে -- এসব খেলে অভ্যাস হয়ে যায়। না খেলে আর কখনো ঘুম আসবে না তখন কী করবেন। উত্তর দেন -- অনেকদিন তো পৃথিবীর মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম। আর কত। এখন খারাপ অভ্যাস আর ভালো অভ্যাসে খুব কী কিছু যায় আসে। একদিন না হয় এই অভ্যাসের কারণে ঘুমের মধ্যেই চলে যাব।

তবু। লোকজন এরপর তেমন কথা খুঁজে পান না। উপদেশদাতা পাড়াপ্রতিবেশী। দু একজন খালাতো মামাতো ভাইবোন আর ঋতু। মেয়েটা কখনো ওদের ফেলে যেতে পারে না। যখনই ঢাকা থেকে জয়পুরহাট আসে রোকেয়া আর কবির সাহেবের সঙ্গেই কেটে যায় তার প্রায় সময়। নিজের বাড়ির লোকজনও জানে সে নিয়ে কেউ কিছু বলে না। দুই বছর হলো অকাল প্রয়াত ছেলের একজন প্রিয় বন্ধু ঋতু। হঠাৎ করে রক্ত বমি করতে করতে ছেলেটা প্রায় প্রাণশূণ্য অবস্থায় পড়ে ছিল কয়েকদিন। এরপর মারা যায়। কবির উদ্দিন নিজে গিয়ে ছেলেটাকে এনে কাছের গোরস্থানে দাফন করেছিলেন। অনেক বলেছিল পোসাটমর্টেম করাতে, কিন্তু তা আর করানো হয়নি। -যে চলেই গেছে তাকে নিয়ে কেন এত কাটাছেঁড়া। কয়দিন কেন তাকে খবর দেওয়া হয়নি তার উত্তরে আদিত্য বলেছিল -- ও কিছুতেই খবর দিতে দেয়নি। বলেছিল ওরা খুব চিন্তা করে। এইতো দুই একদিনের ভেতর ভালো হব, তখন নিজেই জানাবো। কিন্তু সে ভালো হয়ে ওঠা অন্তরের আর হয়নি। কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি করছিল। একজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করতো ছেলেটা। আদিত্য ওর বন্ধু। ওর সঙ্গেই ও ঘর শেয়ার করতো। সকলে বলে আদিত্য ভালো ছেলে। কিন্তু মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। করিরুল হোসেন এর ডাক নাম অন্তর। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। কবির হোসেন সখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন কবিরুল হোসেন আর মা নাম রেখেছিলেন -- অন্তর। মায়ের মাথার মনি, বাবার গর্ব ও আনন্দ। প্রাণপ্রাচুর্যে উজ্জ্বল এই ছেলেটা চলে গেছে বাবা ও মায়ের কলিজা ছেদ করে। সেই ফুটো কলিজা নিয়ে ওরা জীবনযাপন করেন। ঋতু আসে। খোঁজ খবর করে। এবার ঋতু মেডিকালে শেষ করে হাউস সার্জন হবে দু এক মাসের ভেতর। কথা ছিল ডাক্তারী পাশ করেই অন্তর আর ঋতু বিয়ে করবে। সেটা আর হয় নি। ঋতু এখানকার মেয়ে। ছুটিছাটাতে বাড়িতে আসে। ঢাকায় থাকে। এসেই খালা ও খালুর খোঁজ করে। গল্প করে। আবার কখনো অন্তরের স্মৃতি ভরা বাড়িতে ছল ছল চোখে নানাসব ছবি, বই দেখে চুপচাপ চলে যায়। ঋতু সুন্দর-উজ্জ্বল মেয়ে। এখনো ওর সমস্ত মনে অন্তর। 

এখন ঘুম হয় খালামনি? মায়ের প্রিয় বন্ধুকে এই নামেই ডাকে ও। খালামনি ঋতুর গোলগাল হাত নেড়ে বলেন -- হয়রে মা। আমার ঘুম নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না রে মা। ঋতু খালামনির চুলে তেল মাখিয়ে চুল বেঁধে দিতে দিতে বলে আদুরে গলায় -- খালামনি একসময় আপনার অনেক চুল ছিল তাই না? 

কেন রে মা? 

এখনো কত চুল তাই বলছি। 

তা ছিল রে মা। অন্তর চুল নিয়ে খেলতো। মানে বেনি বেঁধে দিত, তেল মাখিয়ে দিত। এ গল্প ঋতু আগেও শুনেছে। তাই কী ও সময় পেলেই খালামনির কাঁচাপাকা চুল বেঁধে দেয়। অনেকসময় ধরে চিরুণি করে। বলে -- খালামনি আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। রোকেয়া বেগম চোখ মুছতে মুছতে বলেন -- জানিরে মা। তুমি না থাকলে আমরা দুজন আরো অনেকবেশি শূন্য হয়ে যেতাম। 

চিরুণি তেল রাখতে গিয়ে অন্তরের ঘর পার হতে গিয়ে ওর ঘরে একবার যায় ঋতু। ঝকঝকে উজ্জ্বল বোতামের মত অন্তর টেনিস ব্যাট হাতে। অন্য একটা ছবি হাসি হাসি মুখ। বড় জীবন্ত, বড় স্পষ্ট ছবিটা। অন্য দেয়ালে কোন এক শিল্পীর ছবি। সুরাত বা ম’নে কেউ হবে। ওসব নাম অন্তর চলে যাবার পর ঋতু আর তেমন করে শোনে না। ঋতু গান ভালোবাসে কিন্তু ছবি পাগল নয়। ঘরের টেবিলে, ফটোতে ধুলো ঝাড়ে। খাটের বেডকভার টান টান করে। পরিপাটি ঘরদোর পছন্দ ছিল অন্তরের। ঋতু খানিকটা অগোছালো। এ ঘরে এলে ও ঘরটাকে গোছায়। সুন্দর করে। ওদের কথা ছিল -- বিয়ের পর অন্তর ঘর গোছাবে আর ঋতু আর সব কাজ করবে। কতকিছু ভাবনা। কত সব স্বপ্ন! গন উইথ দ্য উইন্ড! ঋতুর বুক চেরা দীর্ঘশ্বাসে দেয়ালের ক্যালেন্ডারের ছবি একটু কেঁপে ওঠে। কিন্তু অন্তরের হাসি হাসি মুখটা ঠিক তেমন আছে। ঋতুকে দেখছে। ঋতু একবার চোখ মোছে। অন্তরের ছবিটা বলছে -- আবার চোখ মুছছো? ঋতালি আমি এখানে ভালোই আছি। তুমিও ভালো থেকো। তারপর ছবিটা স্থির। ঋতু ভাবছে ডাক্তার ঠিক বুঝতে পারলেন না কেন হঠাৎ ওর এমন রক্ত বমি হলো তারপর চলে গেল এবং কাউকে কিছু জানাতে কেন ও নিষেধ করলো। শুনেছে ও -- অন্তর নাকি বলেছিলে এ এমন কী যে বাবা মাকে বলতে হবে। ও এমনি ঠিক হয়ে যাবে। ঋতু তখন দেশের বাইরে। ও ফিরে এসে অন্তরকে আর দেখতে পায়নি। বোনের বাড়ি নেদারলান্ডে গিয়েছিল ও। ওখানে বোনের স্বামী ডিপ্লোম্যাট। ঋতুকে আসা যাওয়ার খরচ দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফিসফিস স্বর, ঋতু বলছে -- কোথায় তুমি অন্তর! কোথায় তুমি? কেউ কোন শব্দ করে না। কেবল বাতাস আর আলো তখনো পাতায় পাতায়। আর ঋতুর ছায়াময় সত্তায় মেঘ। 

দেয়ালের ওপারে পেয়ারা গাছের পাতার ভেতর কিছু আলোর নাচনে একটু ছায়া। ছিট ছিট পাখিটা বসে আছে দেয়ালে। তার পাখার ছায়া। ঋতু ঘর থেকে বের হয়। প্রথম দিকে মনে হতো ও হয়তো আর বাঁচতে পারবে না। কিন্তু কেমন করে সেই নিদাঘ কষ্টটা ফিকে হয়ে গেল আর ও চুপচাপ জীবনের দিকে মুখ ফেরালো। সময়। সকলে বলে “টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার।” সময়ের নিরাময়ী ক্ষমতা। তবু কী অন্তর ওর সারা হ্রদয় জুড়ে নয়? 

রোকেয়া বেগম সেদিন সকালে উঠে মনটা কেমন একটু করুণ করে বসে আছেন। কবির সাহেব বাইরে থেকে হেঁটে এসে প্রশ্ন করলেন -- কী হয়েছে তোমার? 

আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি যা বলেন সে এই -- আজ রাতে অন্তরকে খুব স্পষ্ট ভাবে স্বপ্নে দেখেছেন। বাড়িতে ফিরে আসছে ঢাকা থেকে ওর সেই প্রিয় সুটকেস হাতে। কাঁধে ঝুলছে ল্যাপটপ। আর হাতে স্যুটকেস। বাড়িতে ঢুকেই মায়ের গলা জড়িয়ে বলছে -- এখন কয়দিন তোমার রান্না খেয়ে গোল হয়ে ঢাকা ফিরে যাব। 

কী খাবি? 

কেন তোমার সেই প্রিয় বড়ি দিয়ে মাছ, এঁচোড়ের ডালনা, ছানার পায়েস, মুগডালে মাথা, শর্ষে দিয়ে ইলিশ, মুরগীর দো পেয়াজি এবং এ ছাড়া আর যা তুমি কর সব। তোমার হাতে থাকে অমৃত মা। তুমি নিজেই অমৃত। বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ওঠেন রোকেয়া বেগম। কবির হোসের স্ত্রীর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেন। বলেন -- আসলে খুব ভাবোতো তাই এমন স্বপ্ন। 

রোকেয়ার কান্না থামতেই চায় না। জয়পুরহাটের এ জায়গাটা বেশ একটু নিরিবিলি। রিটায়ার করবার পর বাবার রেখে যাওয়া বাড়িটাকে সুন্দর করেছেন তিনি। তিনি ভেঙ্গে আবার মনের মত করে বানাতে চেয়েছিলেন তা আর হয়নি। কেবল কিছু রদবদল।অন্তর যাওয়া পরে এখন আর বাড়ি সুন্দর করবার মত সেই মন নেই। তিনি আর্কিটেক্ট ছিলেন। কতসব প্ল্যান করতেন। এখন কেবল জীবন কাটানো, দিনাতিপাত করা, যতদিন প্রাণ আছে। ইচ্ছামৃত্যুতো আমাদের কারো হাতে নেই। 

এগারোটার দিকে তিনি বাইরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ মনে হয় কে যেন মাঠ পেরিয়ে হাতে একটা সুটকেস নিয়ে, কাঁধে ল্যাপটপ ঝুলিয়ে তার বাড়ির দিকে আসছে। ‘রোকেয়ার নীড়’। এই নাম রেখেছিলেন তিনি বাড়ির। চশমার কাচ মুছে তিনি ভালো করে তাকান। গায়ে সেই নীলচে ব্লেজার্ড। সেই কর্ডএর ট্রাউজার। আর সারা মুখে ওর বিশ্বজয়ের হাসি। তিনি ভয়ানক একটা আর্তনাদ করতে গিয়ে থেমে যান। -- অন্তর! তুমি অন্তর। 

ছেলেটি এসে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বলে -- আমি অঞ্জন। 

অঞ্জন? কে তুমি? দেখতেও অ›তরের মত। চুলের স্টাইল, কাপড়চোপড়, হাঁটবার স্টাইল সব। এমনকী ঠোঁটে লেগে থাকা এক টুকরো হাসি পর্যন্ত। 

ছেলেটা সুটকেসটা টেনে এনে একটু ক্লান্ত। কপালের ঘাম মুছে বলে -- বাবা আমি একটু বসি? 

বস। তিনি বাবা ডাকে একেবারে নিথর হয়ে ওঠেন। এ যে একেবারে অন্তরের গলা। রোকেয়া বাইরে এসেছে। সারা সকাল সে শুয়েই ছিল। ছেলে ফিরে আসবার ভিভিড স্বপ্নটা ওকে সারা সকাল শুইয়ে রেখেছে। এখন এই ছেলেকে দেখে প্রায় ডুকরে কেঁদে ওঠেন। অঞ্জন খুব ধীরে মায়ের মাথা বুকের ভেতর ধরে রাখে। রোকেয়া বেগমের সারা শরীর কাঁপছে। বলে কাঁদতে কাঁদতে - কে তুমি? ছেলেটার গলাতেও কান্না বলে -- মনে করেন আমি আপনাদের ছেলে অন্তর। আমি ওর বন্ধু ছিলাম। ওকে আমি অনেকদিন থেকে জানতাম। মা আমার ভাগ্য ওর মত নয়। আমার মা বাবা কেউ নেই। আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি মা। চিরকালের লোভ আমার মা ও বাবাকে পাওয়া। বোধকরি আমার সেই লোভই আজ আমাকে এখানে এনেছে। 

দুই বছর হলো ও মারা গেছে। আজ কেন তুমি হঠাৎ? কবির হোসেন প্রশ্ন করেন। 

বাবা দুই বছর আমি বাইরে ছিলাম। সাতদিন হলো ফিরে এসেছি। শুনলাম অন্তর নেই। তাই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসা। যদি অনুমতি করেন কিছুদিন থাকবো। 

রোকেয়া বেগম ছেলেটার চুলে, কপালে, শরীরে আকুল স্পর্শ রেখে বললেন -- এই তো আমাদের অন্তর। ওকেই তো আজ রাতে স্বপ্নে দেখেছি আমি। এত পরিস্কার স্বপ্ন অন্তর মারা যাবার পর আগে দেখিনি। তুমি থাকবে। তুমি আমাদের ফেলে আর কোথাও যাবে না। 

মা বাবা আমি আর কিছু চাই না। কেবল আপনাদের বুকে একটু ঠাঁই দেবেন। আমি স্নেহ-ভালোবাসার কাঙ্গাল মা। 

কবির হোসেন হাত বাড়িয়ে বলেন -- তুমি চিরকালের মত আমাদের বুকে ঠাঁই পেলে। আবেগ! কখনো যা আর কোন কিছু জানতেও চায় না। মানতেও চায় না। বেশ খানিকটা সময় কেটে যায়। 

ছেলেটা পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মোছে। তারপর সযতনে রোকেয়া বেগমের চোখ মুছিয়ে দেয়। বলে -- মা এখন ছেলেতো তোমার কাছে। কেন আর কাঁদছো মা? বাবা বলেন -- চল তোমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাই। একটু বিশ্রাম করে নেমে এসো। ঘরটা দোতালায়। কাল ঋতু এসে ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে গেছে। এখন ও এখানে। 

ঋতু? এখন জয়পুরহাটে? অঞ্জনের সারা মুখ আলো হয়ে যায় ঠিক যেমন অন্তরের। ঋতুর নাম বললেই সারা মুখ উজ্জ্বল। 

ও আসবে। কাল চলে যাবে ঢাকায়। যাবার আগে আসবে। ওর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। এখন ও হাউস সার্জন। 

অঞ্জন ল্যাপটপটা কাঁধে তুলে নেয়। বাশার নামের কাজের ছেলেটা সুটকেস হাতে নেয়। বলে -- খুব ভারী ভাইজান। 

অঞ্জন কোন কথা বলে না। 

বাবা যেতে যেতে বলেন -- তিনতলার তোমার সেই লুকানোর ঘরটা তেমনি আছে। চাবিও আছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে থাকতে তুমি ভালোবাসতে। একবার তোমাকে আর ঋতুকে ওই ঘরে লুকিয়ে রেখে চাবিটা আমি তোমাকে দেইনি। তোমরা একটু ঝগড়া করেছিলে তাই একটু আটকে ােরখেছিলাম। এরপর ভাব। যেন তিনি তাঁর হারানো ছেলে অন্তরের সঙ্গে কথা বলছেন, অঞ্জনের সঙ্গে নয়। 

বাবা! অঞ্জন হাসছে। বলে -- আমরা ঝগড়া করেছিলাম? ঝগড়া মিটে গেলে তারপর দরজা খোলা হবে। তুমি বলেছিলে। বাবা হাসছেন-- তুমি ঘটনা ভোলনি? তুমি তো অঞ্জন। 

আমাকে আপনি অন্তর বলবেন। আমি আপনাদের অন্তর বাবা। আর্কিটেক্ট বাবা ছেলের জন্য তিনতলায় একটা বিশেষ ঘর বানিয়ে ছিলেন। নাম -- অন্তরের জগত। ও ঘরে ভেতর থেকে বের হবার একটি চাবি আছে। আর বাইরে থেকে ভেতরে আসবার বা ঘর খুলবার। বাবা ঘরটাকে সাউন্ডপ্রুফ করেছিলেন। কখনো বলতেন এটা আমার অন্তরের রিসার্চ রুম। আর্কিটেক্ট বাবার চমৎকার একটি সাউন্ড্প্রুফ ঘর ছেলের জন্য। এ সি এখনো সেখানে ঠিকমত কাজ করে। আর খুব বেশি শীত পড়লে একটা ঘর গরম করবার যন্ত্র। বড় প্রিয় ছিল এ ঘর অন্তরের। কখনো যখন একা কাজ করতে চাইতো গোপন ঘরটাতে ঢুকে পড়তো। বাইরে থেকে বুঝবার সাধ্য নেই এখানে একটা ঘর আছে। মনে হয় দেয়ালের অংশ। 

এখন ওরা অন্তরের থাকার ঘরে, গোপন ঘরে নয়। জানালা খুললেই আদিগন্ত মাঠ। একটু দূরে পুকুর। - মাছরাঙ্গাদের বললাম/ গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিল নাম। এমন একটা কবিতা বলেছিল অর্ন্ত ঋতু প্রসঙ্গে। গভীর মেয়ে, নিখাদ মেয়ে। এমন একজন এই যুগে বিরল। ঋতুর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সারা মুখে আলো। বড়ই ভালোবাসতো অন্তর ঋতুকে। সব জানে অঞ্জন। সব জেনেই আজ ও এখানে। বিরাট বড়লোকের এক মাত্র ছেলে অন্তর। ঢাকার গোটা কয়েক ফ্লাট, জমিজমা, শেয়ার, ব্যাংকের টাকার একমাত্র উত্তরাধিকারী। আর এই অঞ্জন ওর মায়ের ভালোবাসা ও বাবার গর্বের কথাও জানে। বেশ খানিকপরে বাবা এসে দরজায় টোকা দেন। বলেন -- বিশ্রাম হলো? 

জ্বি বাবা। সিগারেটটা তাড়াতাড়ি বুঁজিয়ে ফেলে। বাবা হাসছেন -- অভ্যাসটা তোমার আজো গেল না অন্তর। মাথা নিচু করে নবাগত অন্তর বলে -- যাবে বাবা। বাবা ওকে এখন অঞ্জন নয় অন্তর করেই ডাকছেন। 

চল এবার ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা দেখাই। তার আগে তোমার মা তোমাকে খেতে ডাকছেন। 

আসছি বাবা। 

সেইসব প্রিয় খাবার যা অন্তরের পছন্দ ছিল। এত তাড়াতাড়ি যতটুকু পারা যায়। মা ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করেন -- তুই কতদিন থাকবি রে অন্তর? 

কতদিন? আমি যাবই না। যখন তোমরা তাড়িয়ে দেবে তখন যাব। 

তাড়িয়ে দেব। প্রশ্নই ওঠেনা। অন্তরের আর্কিটেক্ট বাবা বলেন। -- কতদিন অন্তরকে বলেছি কী এত চাকরি বাকরি বাইরে থাকা। কিছু না করলেও তো চলে যাবে তোর। ও কথা শোনেনি। খুবই স্বাবলম্বি ছেলে কিনা। বাবার হাত ধরে হাঁটতে পছন্দ করেনি। অঞ্জন সুজির মোহনভোগ আর ফুলকো লুচি খেয়ে হাত ধুয়ে মুছে বলে -- এই অন্তর বাবার হাত ধরে হাঁটতে খুব পছন্দ করবে। এবং পছন্দ করবে মায়ের আঁচলের তলায় থাকতে। বাবা আর ছেলে মাঠের ভেতর দিয়ে, পুকুর পার হয়ে, গাছপালার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পথ চলছেন। বাবা বলছেন -- এই বাড়িটাকে ভেঙ্গে নতুন করবো। আমার আর্কিটেক্ট শিক্ষার সবচেয়ে বড় আর শেষ কাজ। আগেই করতাম। ও চলে গেল মনটা ভেঙ্গে গেল। মনে হয় এবার বাড়িটা শেষ হবে। অনেকটা বিদেশী কায়দায় হবে বাড়িটা। ঢাকায়তো সব অ্যাপার্টমেন্ট। বাড়ি কোথায়? এটা বাড়ি হবে। দেখি নকশা টকশা করি। তারপর একসময় শুরু করা যাবে। চারপাশে বাগান মাঝখানে বাড়ি। আর দোতালায় জালি ঘেরা বারান্দা। যেন বারান্দার ব্যাবিলনের শূন্যদ্যানে দাঁড়িয়ে চারপাশের জগত দেখতে দেখতে আমাদের আবার এই পৃথিবীকে খুব ভালো লাগে। বাবা অনেকদিন পর আজ আবার স্বাভাবিক গল্য়া কথা বলছেন। তার মুখে হাসি। পুরণো পরিকল্পনা আজকের পাওয়া অন্তরকে নিয়ে। 

অন্তর বাবার হাত ধরে বলে -- আপনি খুব খাটাখাটনি করবেন না বাবা। এখন যেমন আছে বাড়িটা মন্দ কী! 

ঠিক আজই নয়। করবো একসময়। বয়স যদিও সত্তুর পার কিন্তু কাজ করবার ইচ্ছেটা আজো আছে। জীবনে শত শত বাড়ির ডিজাইন করেছি। এখন শেষ ডিজাইন নিজের বাড়ি। 

বাবা ও ছেলে যখন ফিরে আসে দুপুর পার হয়ে যায়। ওরা ফিরতেই মা বলেন -- ঋতু আসবে বিকালে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। 

ঋতু। খুশী হয়ে হাসে অঞ্জন বা অন্তর। বলে -- ওকে দেখতে পেলে আমারও ভালো লাগবে। 



ঋতুর পরণে সেই শাড়িটা যেখানে আঁচলে ময়ুর। শাড়িতে ময়ুরের নীলচে পাখার ছাপ। ওর হাত খোঁপায় একটি রজনীগন্ধা। কে ভালবাসতো এমন কোন দৃশ্য! অন্তর। এমন একটা দৃশ্য হয়ে ঋতু এলে ও ক্লিক ক্লিক ক্যামেরায় বন্দি করতো ঋতুকে। অন্তরের মৃত্যুর পর ওর সুটকেসটা পাওয়া যায়নি। যেখানে ঋতুর অনেক ছবি ছিল এবং আরো নানা কিছু। মা বাবার চিঠি, ওর নোটবুক। যা নাম দিয়েছিল অন্তর -- ভালোবাসার নোটবুক। কে যেন চুরি করেছে। চেক বই, কার্ড, গ্যারান্টি কার্ড, এ গুলো বন্ধ করা হয়েছে কিন্তু সুটকেসটা কখনো পাওয়া যায়নি। আরো কত কিছু ছিল। হয়তো ঋতুকে লেখা কোন অসমাপ্ত চিঠি। চিঠি লেখার সখ ছিল অন্তরের। আর্কিটেক্ট বাবার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে! মনটা একেবারে সাহিত্যের রসে টইটুম্বুর। মায়ের মনেও সাহিত্য। চর্চা হয়নি কখনো। কিন্তু তিনি সারাক্ষনই বই পড়তে ভালোবাসতেন। অন্তর সেই শিল্প সাহিত্যের উত্তরাধিকারের ঐশ্বর্যময় একজন। যে এতদিন ছিল না। কিন্তু এখন যে বলছে আমি অন্তর আসলে সত্যিই কী তাই। আবেগপ্রবন বাবা মায়ের সেসব নিয়ে যাচাই বাছাই করবার সময় নেই। আর মায়ের সেই ভিভিড স্বপ্ন! ছেলে ফিরে এসেছে। না তিনি মোটেই যাচাই বাছাই করতে রাজি নন। 

মা বললেন -- বড়ি দিয়ে মাছ হয়েছে আর মুরগীর দোপেঁয়াজি। অঞ্জন মাকে একটু হাগ করে আসে। বলে -- মা আমাকে কোনদিন যেতে বল না। তোমাদের পেয়েছি আমি আর কিছুই চাই না। মা বলেন -- থাক আর কোথাও যেতে হবে না তোমাকে। 

ঋতু আর অঞ্জন পুকুরের পারে বসে আছে। ঋতু তেমন কথা বলছে না। কী সব ভাবছে। বলে অঞ্জন -- ঋতু আমি তোমাকে নিজের করে পাব বলে আসিনি। আসলে আমি মা বাবারস্নেহ-ভালোবাসা পেতে এসেছি। তোমাকে পাওয়া সেতো এক বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। 

পাওয়ার কথা পরে। আগে ভাব হোক। ঋতু বুঝতে পারছে অঞ্জন অন্তরের কার্বনকপি। কথা বলবার ভঙ্গি, কবিতার চরণ, পথ চলতে চলতে যেসব বলতে ভালোবাসতো অন্তর সেইসবই বলছে অঞ্জন। একটু অবাক হয় ঋতু। ও মা বাবার মত আবেগআল্পুত নয় তাই ঘটনার কারণ বুঝতে চেষ্টা করে। কিন্তু তেমন কোন সঠিক উত্তর বা বিশ্লেষণ পায় না। কেবল অ্ঞ্জন বলে -- আমি চিরকাল মা বাবার ভালোবাসা বঞ্চিত একজন। আমি অন্তরকে একবার দেখেছিলাম। ও যার সঙ্গে রুম শেয়ার করতো সেই আদিত্য ছিল আমার চেনা একজন। অন্তরকে একবার দেখেই ভাইএর মত ভালোবেসিছিলাম। দুই বছর পর দেশে এসে শুনি অন্তর মারা গেছে। শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হলো। ভাবলাম দেখি যদি ওঁদের কোন সান্ত¦না দিতে পারি। কারণ আদিত্য হাসতে হাসতে বলেছিল তুই আর অন্তর অনেকটা এক রকমন দেখতে। কেবল তোর গালে ----। থামে অঞ্জন। 

গালে কী? 

তেমন কিছু না। ও এবার অন্য কথা বলে। 

আদিত্য কোথায়? 

ও এখন নিউ জার্সিতে। দেশে ফিরবার ইচ্ছে নেই। শুনেছি এক আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করেছে। 

ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর ঠিক দরজার সামনে হঠাৎ করে একটা বেশালীন কাজ করে অঞ্জন। যে কাজ ঠিক অন্তর করেনি। শরীরটাকে বেশ ভালো করে জানতে চাওয়ার মত কিছু। আর নারী শরীর মানেই তার দুটো আকর্ষনীয় বক্ষ। 

ছি!। লাল হয়ে বলে ঋতু। 

সরি। কেমন একটু মাদকতা ভরা হাসি অঞ্জনের। যে হাসিটা অন্তরের নয়। বলে ও -- সরি। একটু বেবলগা হয়ে পড়েছিলাম। তুমি রাগ করলে নাতো ঋতু। ঋতু কোন কথা বলে না। কিন্তু হ্রদয় যখন কেবল একটু কোমল হয়ে উঠছে সেখানে হঠাৎ এক শক্ত অনুভব নিমেষে ওকে কঠিন করে। একদিন বাবার আটকে রাখা বন্ধ ঘরেও এমন করে শরীর ছুঁতে চায়নি অন্তর। কোন রূঢ় অশালীন ভঙ্গি নয়। কেবল বুকের ভেতর নিয়ে আদর করা। ঋতু যে সময়টাকে এখন মনে করে এবং সত্যিই একটা অমিল খুঁজে পায়। 

কেমন লাগলো মা ওকে? রোকেয়ার কথায় বলে ও কেবল-- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না খালামনি। 

যেতে যেতে একটা কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। বলে -- কাল সকালে ঢাকায় যাব। আবার তিনমাস পরে আসব। তোমরা ভালো থেকো। তারপর রোকেয়াকে একা পেয়ে বলে একবার -- মা ও তোমার ছেলে নয়। ছেলের মত একজন। রোকেয়া বলে -- আল্লাহ আমাদের দুঃখ দেখে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঋতু বলতে চেয়েছিল -- মা একটু সাবধানে থাকবেন। যদিও অ্ঞ্জন আর একবার সরি বলেছিল, তারপরেও। ঋতু বলে -- আমি গেলাম। কিন্তু তুমি মা বাবাকে দেখবে। ওর মনে হয় সবকিছু খুব সহজ নয়। আদিত্যের ঠিকানা জানলে ও অঞ্জনের খোঁজ খবর করতো। আসলে অঞ্জন কে? রোকেয়াকে তো বোঝানো মুশকিল। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন আগের রাতে ছেলে এসেছে পরদিন সকালে যে এসেছে সেইতো তার ছেলে। তাকে কোন কিছু বলতে চাইলে তিনি শুনবেন না। একেবারে দুকুল ছাপানো নদীর মত প্লাবিত দুইজন। বলে ঋতু -- আমি নিয়মিত খোঁজ নেব। 

মা বাবার মাঝখানে অঞ্জন বলে -- আমরা তোমার খোঁজ খবর নেবার আশায় থাকবো। 

ঋতু ঢাকায় গিয়ে চুপ করে বসে না থেকে আদিত্যের ঠিকানা পাবার চেষ্টাা করে। এখন নিউজার্সি আর ঢাকা দূরে নয়। ফেসবুক, ইমেল, ভাইভার, স্কাইপ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির কারণে বোধকরি মঙ্গলগ্রহও দূরে নয়। ও ঠিকই খোঁজ পায়। 

প্রিয় ঋতু 
অঞ্জন আমার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। আমি কয়েকদিন ঢাকার বাইরে ছিলাম যখন অন্তরের শরীর খারাপ হয় আর ও আমাদের ছেড়ে চলে যায়। তখন ওর সঙ্গে ছিল অঞ্জন। শুনেছি একদিন ওরা নাকি বেহেড হবার জন্য কী সব পান টান করেছিল। অন্তর নাকি বলেছিল -- চিরকাল আমি ভালো ছেলে আজ না হয় একটু খারাপ হলাম। এ বোধকরি আঞ্জনের সঙ্গ। তারপরই ওর রক্তবমি শুরু হয়। আমি ফিরবার আগেই ও মারা যায়। বোধকরি সখের এইসব পান টান ওর সহ্য হয়নি। আর আমি এসে গেলে অঞ্জন চলে যায়। ওর তখন বাইরে যাবার একটা সুযোগ এসেছিল। ও বলেছিল -- এইসব গোলমালে কেউ অন্তরের সুটকেসটা কেউ নিয়ে চলে গেছে। তুমি ওর কার্ডটার্ড গুলো বন্ধ করে দিও। তোমাকে নিয়ে লেখা, তোমাদের নিয়ে লেখা নানাসব লেখাটেখা ছিল সুটকেসে। আর অন্তরের সেই সুন্দর ডায়েরি লেখার অভ্যাস। ও তো এক রীতিমত সাহিত্য। ম’নের ছবি আাঁকা সেই ডায়েরির কথা আমি ভুলতে পারি না। বোধকরি সেটাও ছিল সুটকেসে। তোমার নানা ছবি। ওর বাবা মায়ের ছবি। এইসবই তো ছিল সুটকেসে। অঞ্জন কেমন ছেলে? এমন কিছু আমি জানি না যা নিয়ে শংকিত হতে পারি। তবে বিদেশ থেকে ফিরে আসার সঠিক কারণ জানি না। আর তা ছাড়া ও মাঝে মাঝে বিদেশে যায়। ওকে খুব বেশি দেখিনি। হয়তো ওর কখনো বিদেশ ভালো লাগেনি। 
ভালো থেকো 
আদিত্য 

এরপর নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঋতু। শুনেছে ওর নিজের মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বাবা মারা যাবার পর মা একা। বড় দুইভাই বাইরে। মায়ের ইচ্ছা ছিল ওর আর অন্তরের বিয়ের পর কিছুদিন ছেলের কাছে গিয়ে থাকবেন। পরে বলেছিলেন -- নারে ঋতু ওইসব বিদেশ আমার ভালো লাগে না। এখন ঋতু ভাবছে ওর একটা কাজ হয়ে গেলেই ও মাকে এনে কিছুদিন নিজের কাছে রাখবে। ও বিয়ের কথা ভাবে না। বোধকরি অন্তরের স্মৃতি ওর সারা অন্তর জুড়ে। কোনদিন সেই স্মৃতিতে পলিমাটি পড়ে আর এক আশাবৃক্ষ জেগে উঠবে ও জানে না। অঞ্জন? না ছেলেটা ওর মনের মত নয়। অন্তরের মায়ের মত বা ওর বাবার মত এমন ভাবাবেগে ও সবকিছু রঙ্গিন দেখছে না। সবটা যে ঠিক নয় ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে। 

জয়পুরহাটের অন্তরের বাড়িতে দুইদিন ফোন করে কোন উত্তর পেলনা ঋতু। বাড়িতে মাকে ফোন করেও ওদের কোন সঠিক খবর পেল না। ঋতুর মা ওখানে একা যেতে পারে না। যখন ঋতু যায় তিনি ওর সঙ্গে বেড়াতে যান। বোধকরি তিন বছরে তিন বার গেছেন। ঋতুর খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু ও ফট করে যেতেও পারছে না। রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি। ভাবনাচিন্তা করে হঠাৎ সিন্ধান্ত ওর সহকর্মী রশিদের গাড়ি আর ড্রাইভার ধার করে ও জয়পুরহাট যাবে বলে ঠিক করে। মনটা কেন এত অস্থির লাগছে ও বুঝতে পারছে না। সারারাস্তা এক ধরণের মন খারাপের ভেতর ও। ঠিক কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে? 

বাড়ির সামনে একটি পুলিসের গাড়ি এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স। খুব তাড়াতাড়ি নিজের গাড়ি থেকে নামে ঋতু। কবির হোসেন আর রোকেয়া দুজনেই অসুস্থ। অ্যাম্বুলেন্স এসেছে ওদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। বাড়ির কেয়ার টেকার ওদের অসুস্থ দেখে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছে। আশেপাশে কোথাও অঞ্জন নেই। কেয়ারটেকারও বলতে পারে না অঞ্জন কোথায়। 

পুলিসের গাড়ি বলে তারা অঞ্জনের খোঁজে। তবে এখনো পুরো বাড়ি তল্লাশি করেনি। যখন অ্যাম্বুলেন্স চলে যাবে ভালোমত তল্লাশি করবে। 

ঋতু একসময় দোতালায় ওঠে। অঞ্জনের ঘরে ওর জিনিসপত্র তেমনি আছে। চমকে যায় ও অন্তরের ডায়েরি টেবিলে। এই সেই ম’নের ছবি আঁকা ডায়েরি। তাহলে সুটকেস যে চুরি করেছিল সে এই লোক?  

পাতা ওল্টায়। অঞ্জনের নয় অন্তরের ডায়েরি -- আদিত্যের ভাইটার পাল্লায় পড়ে ওসব খাওয়া ঠিক হয়নি। শরীরটা বেশ খারাপ। এরপর কিছু নেই। এক জায়গায় লেখা ঋতুও এখানে নেই। ও থাকলে ভালো হতো। অঞ্জনের সুটকেস খোলে। ওসব কী? নানা সব শিশি বোতল, নানা প্রকার ওষুধ। একটি বোতলে আর্সেনিক। একটা বোতলে বাবর্অচুয়ারেট, এক বোতলে হেমলক বা ওইরকমই কিছু। কী সর্বনাশ ও কী বাবা ও মাকে আর্সেনিক খাইয়েছে? বা অন্য কিছু? কিন্তু ও গেল কোথায়? বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে জিনিসপত্রতো নেবে। আবার নিচে নেমে আসে ও। পুলিসের গাড়িতে যারা বসে আছে তাদের সঙ্গে কথা বলে। 

বিদেশে এক বৃদ্ধাকে মেরে ফেলে, এক মিলিয়ন পাউন্ডের জিনিসপত্র বাঁকিতে কিনে ও চলে এসেছে। বাংলাদেশের হাইকমিশনারের মাধ্যমে অঞ্জনের খোঁজ নিয়ে পুলিস আজ এখানে। বাংলাদেশকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে ওকে খুঁজে বের করতেই তারা অনেক চেষ্টা করে জানতে পেরেছে ওর হদিস। ওর গোপন থাকার কথা।। 

কী করে জানলেন অঞ্জন একজন বৃদ্ধাকে মেরে ফেলেছে? 

জানা গেছে। ওরা বৃদ্ধাকে আর্সেনিক মেশানো ড্রিংক দিত। ছেলের মত থাকতো ও বৃদ্ধার সঙ্গে। পোস্টমর্টেমে বৃদ্ধার শরীরের আর্সেনিক ধরা পড়ে। এ ছাড়া আরো একজন বুড়ো। তাকেও বলেছিল আমি আপনার ছেলের মত। তিনিও অকালে মারা যান। এইসব করে ও বিদেশ থেকে চলে এসেছে। বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রায় এক মিলিয়ন পাউন্ডে কিনে পয়সা না দিয়ে ভেগে এসেছে। আরো নানা চার্জ। ওকে ধরতেই হবে দেশের ইজ্জত বাঁচাতে। কিন্তু ও এমন করে হাওয়া হয়ে গেল কেমন করে। মনে হয় ও এ বাড়িতে নেই। পালিয়ে কোথায় যাবে। 

আমিও বুঝতে পারছি না। 

এ ছাড়াও সকলে মনে করছে এদেশের আরো কিছু মৃত্যুর সঙ্গে ও জড়িত। ওর এক দূর সম্পর্কের চাচা যার বাড়িতে ও থাকতো, ওর এক বন্ধু যার প্রচুর টাকা ছিল, ওর এক বান্ধবী যে ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি, তাদের সকলেরই এমনি ভাবে মৃত্যু হয়। আমার মনে হয় প্রতিটি মৃত্যুর কারণ এক -- আর্সেনিক বা অন্য কোন বিষ। খুব ধীরে ধীরে ও একজনকে মৃত্যুর কাছে পৌঁছে দেয়। 

কিন্তু একজনাকে খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল সে এই বাড়ির ছেলে অন্তর। যাকে বড় এক ডোজ আর্সেনিক ড্রিংকএর সঙ্গে খাইয়ে খুব তাড়াতাড়ি ওকে মুত্যুর কাছে নিয়ে গেছে। বলে ঋতু। বলে আবার -- বোধকরি তখন ওর অপেক্ষা করবার সময় ছিল না। পুলিস অফিসার একজন তরুণ। এমন একটি দায়িত্ব যেখানে দেশের সন্মান জড়ানো ও খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছে। পুলিস অফিসার অঞ্জনের ছবি দেখায়। কেবল বড় একটা আঁচিল ছাড়া ও দেখতে একেবারে অন্তরের মত। এখন অবশ্য সে আঁচিলটা আর নেই। মুখটা এখন পরিচ্ছন্ন, অন্তরের মত, আচিল অপারেশন করে তুলে ফেলেছে। পুরোপুরি অন্তর হয়ে সমস্ত কিছু পেতে চেয়েছে। কত সম্পদ, কত টাকা পয়সা! 

কবির হোসেন ও রোকেয়া বেগম দুজনেই কী মারা যাবেন। প্রশ্ন করে ঋতু। 

একজন হয়তো মারা যাবেন। তিনি রোকেয়া বেগম। কবির হোসেন বেঁচেও যেতে পারেন। 

হাসপাতালের ঘরে উদবিগ্ন মুখে ঋতু বসে। রোকেয়া বেগম মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। কবির হোসেন খানিকটা ভালো। ওদের এখান থেকে সোজা ঢাকা নিয়ে যাওয়া হবে ওদের গুলশানের ফ্লাটে। ভাড়াটে যাওয়ার পর ফ্লাট আর ভাড়া দেওয়া হয়নিকবির হোসেনের ভাইএর ছেলে এখন ওদের দেখাশোনা করবেন। কখন তারা আবার জয়পুরহাটের এই বিশাল খোলামেলা বাড়িতে ফিরে আসবেন কেউ বলতে পারে না। হয়তো এ যাত্রায় দুজনেই বেঁচে যাবেন। ওরা এখনো পুরো ব্যাপার জানেন না। এখনও তাদের ব্রেন ঠিকমত সবকিছু বুঝতে পারছে না। 

হাসিব উদ্দিন চাচা চাচির ওদের দায়িত্ব নেবেন। তিনি নিজেও ডাক্তার। 

পুলিস অঞ্জন অরফে মিহির ওরফে হাবিব ওরফে তানভির ওরফে কাজলের জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। ওকে পাওয়া যায়নি। এ বাড়িতে ও নেই। 

ঋতু থেকে গিয়েছিল আরো দশদিন ছুটি নিয়ে। 

তারপর ওদের সঙ্গে ঢাকা চলেছে। গাড়িটা চলছে। ভালো সুন্দর একটি মাইক্রোবাস। হঠাৎ কবির হোসেন ঋতুর হাত ধরে বলেন -- মা ঋতু তুমি দরজা খুলে অঞ্জনকে বের করেছো তো। যেমন করে মানুষ স্মৃতি ফিরে পায় তেমনি ভাবে স্মৃতি ফিরে পেয়েছেন যেন তিনি। ঋতু একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। 

শোন ঋতু ওকে পুলিস ধরতে আসবে শুনে আমি ওকে চোরা ঘরটাতে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ও বলছিল -- কিছু মিথ্যা কারণে পুলিস ওকে হয়রানী করতে চায়। ও ঘরটার দরজা টরজাতো বোঝার উপায় থাকে না কারো। বলতে পারো আমার আর্টিটেকচার বিদ্যার একটা বড় কাজ ওই ঘর। অন্তর ঘরটাকে খুব ভালোবাসতো। মনে আছে তোমাদের দুজনকে একদিন আটকে রেখেছিলাম। এই স্মৃতিতে তিনি হাসেন। ভেতর থেকে চাবি দিয়ে ঘরটা খোলা যায় আর বাইরে থেকে কেমন করে খোলা যায় সেটা কেবল আমি জানি। অন্তরও জানতো। আর না জানলে পুরো জায়গাটাকেই দেয়ালের অংশ মনে হতে পারে। তুমিও বোধহয় জানো তাই না? কী ভাবে খোলা যায়। ওরা আমাদের অঞ্জনকে ধরতে আসছে এটা আমরা কী করে হতে দিতে পারি মা বল? কবির হোসেনের কাছে অঞ্জন তখনো স্বপ্নে পাওয়া ছেলে। রোকেয়া বেগম ঘুমিয়ে, তাঁর এসব জানবার কথা নয়। 

কবে ওকে আটকে রেখেছিলেন? সাউন্ড প্রুফ চোরা কুঠরিটাতে? 

আজ তারিখ কত মা? 

বাইশে মার্চ বাবা। 

তাহলে দশদিন আগে। বারোই মার্চ অঞ্জনের জন্মদিন ও বলেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল -- আমার ভাগ্য খারাপ বাবা। যাদের ভালোবাসি তারা আমাকে ফেলে চলে যায়। আমি যেতে চাই না বাবা। আপনি আমাকে লুকিয়ে রাখেন। পুলিসরা কেবল মিথ্যা হয়রানী করতে আসছে। 

আমি তাই করেছি মা। ওকে চোরা ঘরটাতে লুকিয়ে রেখেছি। তারপর দুজনেরই পেটের সমস্যা হয়। ওর জন্মদিনে তোমার মা নানা কিছু রান্না করেছিল বোধহয় সেসব খেয়েই মা ঋতু। তিনি তখনো জানেন না এই অঞ্জন এক মহাশয়তান, যার বিবেক বলে কিছু নেই। লোভী এবং হ্রদযহীন। 

কবির হোসেনের হাত নিজের হাতে নিয়ে ঋতু বলে -- সেসব খেয়েই বাবা। বাবা আপনি চিন্তা করবেন না। ও এবার এমন জায়গায় যাবে পৃথিবীর কেউ ওকে আর খুঁজে পাবে না। 

সত্যি মা ঋতু? ছেলের মত অঞ্জন। আমরা চাই ওর ভালো হোক। এ বাড়িতে কতদিন পর আমরা আবার ফিরে আসব কে জানে রে মা। তুমি তাহলে চোরা কুঠরি থেকে ওকে বের করেছো? 

ও ঠিক সেই জায়গায় চলে যাবে বাবা যেখানে অনেকদিন আগেই ওর যাবার কথা। 

কোথায় সে জায়গা? 

সে জায়গা? বাবা আমি জানি জায়গাটাকে বলা হয় ‘লাস্ট ডেসটিনেশন্’। একটা আশ্চর্য মহাদেশ। ঋতু বলে -- আর কিছু ভাবতে হবে না। আপনারা বিশ্রাম করুন। আমি আজ থেকে আপনাদের মেয়ে। 

এমন নাম ‘লাস্ট ডেসটিনেশন’? রকিব উদ্দিন কী যেন ভাবছেন। রোকেয়া বেগম গভীর ঘুমে। পেছনের সিটে তাঁর জন্য ঘুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি এখনো কথা বলছেন না। কে জানে তিনি আবার কথা বলবেন কিনা। 

কত নাম আছে না? কেপ অফ গুড হোপ, কোরাল রিফ, টাইগার বে, স্নেক প্লেস, তারানচুলা ভ্যালি, ফক্সহাউন্ড, তেমনি কোনো নাম বাবা। 

বাবা চোখ বন্ধ করেছেন। তাঁর খুব ক্লান্ত লাগছে। তিনি আর কথা বলতে চান না। চোখ বন্ধ করেন। 

গোপন ঘরের চাবিটা ঋতুর ব্যাগে। বাড়ির আর সব চাবির সঙ্গে। ঋতু ভুলেও চাবি নিয়ে গোপনঘরটা খুলতে যাবে না। দশদিন চলে গেছে। আরো দশমাসও চলে যাবে । খুব ধীরে মৃত্যু এসে গ্রাস করবে ওকে। যেমন করে অনেকে মৃত্যুকে পেয়েছে, ওরই কারনে। ধীরে ধীরে। মহাকালের আকাশে একটি কংকাল ঝুলে থাকবে অনন্তকালের জন্য। 

ঋতুর একটুও খারাপ লাগে না দশদিন আগে একবারও কেন ও সেই ঘরটা খুলে দেখেনি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ