অমর মিত্র
নবনীতা দেবসেন ছিলেন দশভুজা লেখক। উপন্যাস লিখেছেন কম, কিন্তু অসামান্য সব গল্প, অপূর্ব ভ্রমণ কাহিনি, সাহিত্যের প্রবন্ধ...তিনি লিখেছেন। এখন এই একাশি বছরেও সচল ছিল। ভালবাসার বারান্দা পড়তে হয়। না পড়লে কত কিছুর স্বাদে বঞ্চিত হতে হয়, তা বঞ্চিতজন জানবেন কী করে? মনে করুণ ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’ প্রবন্ধটির কথা।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের শশী এবং আলব্যের কামুর প্লেগ উপন্যাসের ডাঃ রিও কে নিয়ে তুলনা মূলক সেই আলোচনা। কামুর আউটসাইডারের খুনী প্রতিনায়ক যে এই পৃথিবীতে নিজেকে অচেনা এক মানুষ মনে করত, নতুন দর্শন নিয়ে এসেছিল, সে-ই প্লেগ উপন্যাসের ডাঃ রিও, পুতুল নাচের ইতিকথার শশী। অল্প বয়সে পড়ে বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম পৃথিবীর সেরা উপন্যাসের সঙ্গে একাসনে বসা বাংলা উপন্যাসটিকেও। সাহিত্যের নানা প্রবন্ধে তিনি মৌলিক। বহুদিন তাঁকে পড়া হবে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের শশী এবং আলব্যের কামুর প্লেগ উপন্যাসের ডাঃ রিও কে নিয়ে তুলনা মূলক সেই আলোচনা। কামুর আউটসাইডারের খুনী প্রতিনায়ক যে এই পৃথিবীতে নিজেকে অচেনা এক মানুষ মনে করত, নতুন দর্শন নিয়ে এসেছিল, সে-ই প্লেগ উপন্যাসের ডাঃ রিও, পুতুল নাচের ইতিকথার শশী। অল্প বয়সে পড়ে বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম পৃথিবীর সেরা উপন্যাসের সঙ্গে একাসনে বসা বাংলা উপন্যাসটিকেও। সাহিত্যের নানা প্রবন্ধে তিনি মৌলিক। বহুদিন তাঁকে পড়া হবে।
তিনি গল্প লিখেছেন কম। যা লেখেন তার ভিতরে অমলিন হাস্য-পরিহাস লুকিয়ে থাকে। তা সে রামায়ণ কাহিনি থেকে বের করে আনা নতুন গল্প হোক কিংবা আমাদের দৈনন্দিনতা নিয়ে গল্প হোক। আর এই সূক্ষ্ম পরিহাসের ভিতরে কোথাও একটা লুকিয়ে থাকে সময়কে চিনিয়ে দেওয়ার চিহ্নগুলি। নবনীতা দেবসেনের লেখায় অতি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের জায়গাটি থাকলেও, নির্মল হাসির অংশটি বেশি। পড়ার পর মন স্নিগ্ধ হয়ে যায়। মেধা এবং রুচির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা তাঁর গল্প বিষয় এবং লেখার গুণে আলাদা। নবনীতাদির গল্প কিংবা ভ্রমণ কাহিনি জুড়ে থাকে আশ্চয তিযর্ক এক দেখার ভঙ্গী। মনে পড়ে সেই কেদার বদ্রী যাওয়ার অনুপম ভ্রমণ কাহিনি, ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’। যাবেন তিনি নিছক হিমালয় ভ্রমণে, আনন্দ যাত্রায়। চেনা জানা মানুষজনের প্রায় নিখরচায়, বিনা পরিশ্রমে কেদারনাথ, বদ্রীনাথে পুজো দেওয়ার, পুণ্য অর্জনের এমন ভাল ব্যবস্থা আর কী হতে পারে? সবাই ধরিয়ে দিচ্ছে লিস্ট। তাদের হয়ে তাদের জন্য মানত করা থেকে, মনোস্কামনা পূর্ণ হওয়ার পুজো নিবেদন সবই তাঁকে করতে হবে স্বজন পরিজন হিতায়। সেই যাত্রা পথ হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ আনন্দ পরিহাসে অতুলনীয়। মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর প্রথম জীবনে লেখা একটি গল্প, ‘মঁসিয়ে হুলোর হলিডে’ গল্পের কথা। কালো লেজ মোটা হুলো পালাতে গিয়ে বাড়ির কার্নিশে গিয়ে পড়েছে। মেসোমশায়। মেনি বিড়াল মাসি হলে সেই হুলো মেসো তো নিশ্চয়। বিড়াল উদ্ধার নিয়ে সেই গল্প মাঝরাতে হল্লা বাঁধিয়ে দিল পাড়ায়। আহা, মনে আছে পড়তে পড়তে আমিও সেই মেসোমশায়কে উদ্ধারে সামিল হলাম। কলকাতা শহরে পাড়া বেড়ানি দুষ্ট বেড়ালরা কমে গেছে অনেক। নেইই বলা যায়। কিন্তু যখন ছিল, সেই বছর চল্লিশ আগে, এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার। কিন্তু ‘মঁসিয়ে হুলোর হলিডে’ তা হয়নি। পড়তে পড়তে আমি বেলগেছে থেকে ভালোবাসায় চলে গেছি মধ্যরাতে। দমকল এলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছি কী করে কী হয়। কালো লেজ মোটা হুলো কী করেন, উদ্ধারকারী দমকলই বা কী করে। নবনীতা দেবসেন বাংলা ছোটগল্পের বিলীয়মান এই ধারাটির শেষ লেখক যেন। কী স্নিগ্ধতা তাঁর গল্পে। নির্মল হাস্য পরিহাস। অনুপম গদ্য ভাষায় লেখা এইসব গল্পের কোনো তুলনা নেই। দুই মেয়ে আর মা, কার্নিশে হুলো, ডাক দিচ্ছে বিপদে পড়ে। এমনিতে সে মহাদুষ্ট। বাজার থেকে আনা জ্যান্ত মাছও নিয়ে পালায় ভুরিভোজের জন্য। তবু জীব তো। জীবে প্রেম করলেই ঈশ্বরের সেবা। এমন সুযোগই বা ছাড়বে কেন গৃহী মানুষ ?
আর এক গল্প, ‘এক্সপ্রেস’ এর কথা বলি। এক্সপ্রেস কিছুই না, শুধু কলকাতার এক সকালে এক্সপ্রেস বাসে অফিস যাত্রা। সেই কলকাতা এখন আর নেই। এক তরুণী বাসের অপেক্ষায়। রাসবিহারি এভিনিউয়ে বাস আসছে বাদুড় ঝোলা হয়ে। আর সেই বাস থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, এক্সপ্রেস, এক্সপ্রেস, উঠবেন না, উঠবেন না, লেডিজ, উঠবেন না। এক্সপ্রেস বাস প্যাসেঞ্জার গাদিয়ে ছুটছে অফিস পাড়ার দিকে, আর স্টপেজে স্টপেজে যাত্রীর অপেক্ষা। থামছে, থামছে না, ছুটছে গরগর করে। সঙ্গে ছুটছে বাসে গাদানো প্যাসেঞ্জারের দল। তাদের খুব তাড়া। সময়ে আপিস পৌঁছতে হবে। বাস থামতে না থামতে কেউ কেউ, অবাক করা দক্ষতায়, ঝাঁপিয়ে পড়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে বাসের ভিতর। তিনিও একটিতে পড়িমরি করে ঢুকে পড়লেন। শুনতে হলো, কলকাতায় এত বাস থাকতে এরা যে কেন এক্সপ্রেসে ওঠেন--!
কখন যে ভিতরে ঢুকে গেছেন সেই লেডিজ প্যাসেঞ্জার! বসতেও পেরেছেন। তাঁর পাশে, ঘটি পুটুলি নিয়ে এক বৃদ্ধা, ধরাই যায় কালিঘাটের যাত্রী। এ হলো সেই হারানো কলকাতার একদিন। বাসের ভিতরের মানুষজন, টিকা-টিপ্পনি নিয়ে গল্প। আর সেই টিপ্পনির বহর কী, স্বীকার করি তোমাদের নেহরুর পরে কেউ নেই, কিন্তু সেখানেই তো নেহরু ফেলিওর। এই গল্পের ভিতর দিয়ে সময়ের একটা চেহারা পাওয়া যায়, পরিহাসে পরিহাসে, নানান ক্ষুদ্রতার উন্মোচনের ভিতর দিয়ে গল্প পৌছয় এক স্নিগ্ধ অনুভবে। যাত্রীদের নানা উদ্বেগ বয়ে নিয়ে এক্সপ্রেস চলছিল না এক্সপ্রেসের মতো করে, শেষমেশ স্পীড তোলে। পথের দুধারে ছড়ানো সবুজ, কড়া রোদে ঝকঝকে সোনালি, তার চেয়ে বাসের ভিতরের একটি মেয়ের শাড়ির সবুজ অনেক সুন্দর। বাইরে চেয়ে চেয়ে হঠাৎ মনে পড়ল, বালিগঞ্জ সারকুলার রোড, বসন্ত চলে গেছে তবুও কৃষ্ণচূড়ায় কৃষ্ণচূড়ায় রাস্তাটা অসহ্য সুচিত্র।
১৯৫৮-য় লেখা এই গল্পের অনুভব আমাকে মুগ্ধ করে। পরিহাস করতে করতে শেষ অবধি এক মায়াবী আলোয় সব কিছুকে মুড়ে দিলেন তিনি। প্রত্যাখ্যানের এক্সপ্রেসকে গ্রহণ করতে কোনো অসুবিধে হয় না। এই গল্প আমরা লিখতে পারি না। অবাক হয়ে পুরোন কলকাতাকে অনুভব করতে থাকি।
আর এক গল্প ‘পরীক্ষা’। পরীক্ষা গল্পটিতে কী আশ্চর্য একটি কিশোরীকে এঁকেছেন তিনি, সঙ্গে তার মা, তিনিই গল্প কথক। নবনীতাদির এই গল্পও উত্তম পুরুষে লেখা। দুই মেয়ে, তাদের দিদিমা আর মা। বড় মেয়েটি পনের, মাধ্যমিক দেবে, কিন্তু কোথায় দেবে, কী নিয়ে দেবে, কখন পড়ে, পরীক্ষা দিয়ে কী হয় হয়, প্রায় এমন দার্শনিকতায় ডুবে থাকে কন্যাটি। পরীক্ষার চেয়ে টিভিতে চিত্রমালা, ব্যাডমিন্টন, আগাথা ক্রিস্টি আর ঘুম অনেক ভাল। প্রি-টেস্টের চেয়ে টেস্টে সাবজেক্টে সাবজেক্টে দু নম্বর করে কমেছে, ইতিহাসে উনতিরিশ থেকে সাতাশ। তাহলে ফাইনালে ওটা পঁচিশ না হয়ে যায় না। অঙ্কের টিউটর অলোকবাবু একদিন খাম সমেত টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, ও টাকা তিনি নিতে পারবেন না, এত মাসে তিনি একটাও অঙ্ক করাতে পারেন নি তাঁর ছাত্রীকে দিয়ে। খাতা ভর্তি অঙ্ক তাঁর নিজের কষে দেওয়া। নিজে কষেছেন বলে অন্যের কাছ থেকে টাকা নেবেন কেন?
মেয়ে পড়ে না, অথচ পরীক্ষা সামনে। মা তার টেস্টের ওই খারাপ রেজাল্টের পর নতুন টিউটর খুঁজে হয়রাণ। ইতিহাসের জন্য এক বোনপোকে ধরে আনা হল, তিনি চাইলেন সিলেবাস। তা তো ছাত্রীর জানা নেই। মানে ছিল, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে। সে ফোন করে জেনে নিচ্ছে। ফাইনাল আর তিন মাস, সিলেবাস জানে না। টিউটর খাতা কলম চাইলেন, খাতা আছে, কলম নেই। বোন ইস্কুলে নিয়ে গেছে কলম, পেনসিল আছে, কাজ হবে? পেনসিল ক্ষয়ে ক্ষয়ে এত ছোট যে হাতে ধরা যায় না। তো একটা ঢাকনিতে ফিট করে পেনসিল ধরা গেল হাতে। গল্প এই রকম।
মায়ের মাথা খারাপ হয়ে যেতে লাগল মেয়ের পরীক্ষা নিয়ে। স্যারের জন্য চা ডালমুট এল, স্যার ওসব খান না। মেয়ে ডালমুট চিবোয় আর তাঁকে অনুরোধ করে তার জন্য বরাদ্দ দুধ সন্দেশ বরং স্যার খান, তাতে তাঁর লিভার পাকস্থলি ঠিক থাকবে। নতুন স্যার ছাত্রীর মাকে বলে, মেয়ে ভাল, বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে, কিন্তু মহা ফাঁকিবাজ, মেয়ের মা কেন দ্যাখেন না মেয়েকে ?
তিনি তো দিন-রাত্তির লেখালেখি পদ্যফদ্য নিয়ে আছেন, সময় কই ? কিন্তু মেয়েকে নিজে না পড়ালে হয়? মা কী পড়াবেন, ইংরিজি আর বাংলা, কিন্তু বাংলা বই তো নেই, এ বছর কেনা হয় নি......।
গল্প যত এগোয়, মায়ের সঙ্গে পাঠকেরও মাথায় গোলমাল হয়ে যেতে থাকে। বাংলার সিলেবাসও মেয়ের কাছে নেই। বাংলা নেই, অঙ্ক নেই। ফোন করে করে সিলেবাস জানা হচ্ছে। পরীক্ষা শিয়রে। তাতে কী, মেয়ের ঘুম, চিত্রমালা, সিনেমা, বুক ফেয়ার সব আছে। মা পাঁচটার সময় ডেকে দেন মেয়েকে। তারপর ঘুমিয়ে পড়েন। আবার সাড়ে পাঁচটার সময় ডেকে দেন। ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর আবার উঠে সাড়ে ছটার সময় ডেকে দেন।
অসামান্য এই গল্পের যে কত পরত আছে, কত যে ভালবাসা আছে এই গল্পে। সেই কন্যাটির প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয়ে যায়। কী অনায়াসে সে সিলেবাস, বই, খাতা কলম হারিয়ে ফেলে নিরূদ্বেগে পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে থাকে। সে কেন, তার মা, বোন, দিদিমা, সবাই যে যার মতো করে তৈরি হতে থাকে।
সতেরই এপ্রিল থেকে পরীক্ষা, চোদ্দই এপ্রিল, পয়লা বৈশাখে মায়ের কাছে আমন্ত্রণ আসে এক সাহিত্য সভার। কলকাতার বাইরে। মেয়ে চোখ বড় বড় করে শুনে, মাকে বলে, চলো না মা, কী সুন্দর, ভাল লাগবে। আহা আমাদের দেশে হবে এই মেয়ে কবে। এই গল্পের প্রতিটি পংক্তি ভরে আছে এক অবাক করা আনন্দে। তারপর তো পরীক্ষা আসে। মেয়ে আড় বাঁশি বাজাতে বাজাতে পরীক্ষা ডেকে আনে অবশেষে। তারপর যা হয়। থাক। হে পাঠক, পড়ুন এই গল্প। জীবনের এই আনন্দ প্রত্যক্ষ করুন। এমন গল্প পড়িনি যেমন আগে। পরেও এই স্বাদের গল্প পড়া হবে কি না সন্দেহ। গদ্যভাষাও কত নির্মেদ আর নির্ভার হতে পারে তা নবনীতাদির লেখা পড়লে শেখা যায়। শিখেছি। ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে কম নয়। কিন্তু তা নিতান্তই ব্যক্তিগত। সাহিত্যের কথাই হোক সাহিত্যিকের প্রয়াণে।
লেখক পরিচিতি
অমর মিত্র
কথাসাহিত্যিক
লেখক পরিচিতি
অমর মিত্র
কথাসাহিত্যিক
0 মন্তব্যসমূহ