এই অহংবোধ থেকে উপন্যাস নিল ব্যক্তির প্রতি পক্ষপাতিত্ব। সমাজে ব্যক্তি থাকে বটে, সমাজ তাকে লালন করে, কিন্তু মানুষের মনোজগতে প্রতিনিয়ত ঘটে যায় যে অসংখ্য পরিবর্তন, তাদের অনুভব করতে গেলে শুধু সমাজের দিকে তাকালে চলবে না। সমাজের পরিবর্তন মানুষের ভেতরের জগৎটিকে নাড়ায় সত্য, কিন্তু ওইখানে যে অনেক বিস্ফোরণ ঘটে, ধসে পড়ে বহু দরদালান, অথবা জন্ম হয় নতুন নিসর্গের, নন্দনকাননের, তার সঙ্গে সংগতি থাকে না ওইসব পরিবর্তনের, সবসময়। আধুনিকৰাদ মানুষের ভেতরের অনুবিশ্বে মেলে ধরে তার আতশ কাচ। তাই বলে সমাজ উপেক্ষিত হয় না। বস্তুত আধুনিকবাদ, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে – সমাজের নানা সংকট ও সমস্যাকে উপজীব্য করে। তাছাড়া এই আন্দোলন ইউরোপীয় আদর্শগুলি থেকে একটু দূরে একটি ভিন্ন পথ করে নিতে চেয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্যের। ওই বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলের সমাজবাস্তবতা ইউরোপ থেকে ভিন্ন- - সেখানে এই শতাব্দীর শেষ দশকে এসেও সামরিকবাদ এবং একনায়কতন্ত্র একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ধর্ম এক সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রভাব ফেলে-- এইখানে যত গির্জা আছে, তারা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এই ভিন্ন সমাজবাস্তবতা, ধর্মচিন্তা, সমাজ সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং জলবায়ু -- এবং এর সঙ্গে আদিবাসীদের দীর্ঘ এবং উন্নত বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণ – এসবই একটি নতুন ভিত্তি স্থাপন করেছে আধুনিকবাদের। ইউরোপে যত আধুনিক আন্দোলন হয়েছে শিল্পসাহিত্যে তাদের নামকরণের ভিত্তি হয়েছে আঙ্গিক বা শৈলীগত বৈশিষ্ট্য যেমন প্রতীকবাদ, প্রকাশবাদ, প্রভাববাদ, কিউববাদ, দাদাবাদ। কিন্তু লাতিন আমেরিকার আন্দোলনগুলির নামকরণের পেছনে ছিল সামাজিক চিন্তা এবং সমাজচেতনা। Mundonovismo বা নব্য পৃথিবীবাদ, অথবা আধুনিক সমাজচিন্তাকে ধারণ করে বিকশিত হয়েছে। তবে আধুনিকবাদ যখন উপন্যাসে (বিস্তৃত অর্থে, ফিকশনে), প্রতিফলিত হয়েছে, তখন তার ক্রমাগত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিকের বিষয়টিও গুরুত্ব অর্জন করেছে। এবং এই উত্তর-আধুনিকতার যুগে প্রকাশ বিশিষ্ট একটি স্বতন্ত্র বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐন্দ্রজালিক বা জাদুবাস্তবতা বা Magic realism-এর যে-কোনো আলোচনায় এই বক্তব্যের একটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
দুই
আধুনিকবাদ যখন কবিতায় শুরু হয়, আঙ্গিকের বিষয়টি স্বভাবতই গুরুত্ব পায়, কারণ এই ধারায় কবিরা স্পেনীয় সাহিত্যে তেমন প্রকাশ-বৈচিত্র্যের সন্ধান না পেলেও ফরাসি বা জার্মান আধুনিকবাদে তাকে আবিষ্কার করেন। এই আন্দোলন কিছুটা হলেও কলাকৈবল্যবাদের শিকার হয়েছিল। উরুগুয়ের হুলিও হেরেরা ঈ-রেইসিগের (১৮৭৫-১৯১০) মতো মডার্নিস্তা কবিদের ছিল নান্দনিক একটি দীর্ঘ দৃষ্টি। তারা সময় ও ইতিহাসকে যেভাবে দেখতেন, তাতে নন্দনচিন্তাটি থাকত প্রধান, যেন জীবনের পরিপাটি সুন্দর মুহূর্তগুলি ধরে রাখাই একজন কবির সকল কাজ। কিন্তু হেরেরা রেইসিগের কবিতাতেও সমাজের চলমান ছবিটি খুব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও, আবছায়াভাবে প্রতিফলিত হতো। অনেক কবি রোমান্টিকতার মেজাজটি কাটিয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু আধুনিকবাদে পা রেখে তারা অনুভব করলেন, নতুন একটি জাতীয় কাব্যধারা যা স্পেনের কবিতা থেকে স্বতন্ত্র, ইউরোপীয় কবিতা থেকেও স্বতন্ত্র -- সৃষ্টি করছেন তারা। এই বিশ্বাসটি তাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকে উদ্ভূত। সমাজবাস্তবতা এইভাবেই রোমান্টিক কবিদেরও প্রভাবিত করেছিল। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে আধুনিকবাদের সুন্দর প্রকাশগুলিও সমাজচেতনার কাছে ছিল বিশ্বস্ত।
তিন
লাতিন আমেরিকার ছোটগল্প ও উপন্যাস এখন যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তাতে আত্মসচেতনতা অথবা সমাজচেতনাকে কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষেত্র বলে মনে হওয়া সম্ভব নয়। এ দুয়ের সংমিশ্রণে যে সাহিত্য রচিত হয় যা এই শতাব্দীতে ইংরেজি ভাষায় হেনরি জেমস অথবা আর্নস্ট হেমিংওয়ে লিখে গেছেন, তা-ও এই সাহিত্যের পরিচয় নয়। বরং ফ্রানৎস কাফকা যেমন আত্মসচেতনতাকে অস্তিত্ববাদী চিন্তার শেষ ধাপে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং ব্যক্তির মনোজগতের দূরবর্তী স্থানটুকুতেও তার মাধ্যমে প্রবেশ করেছিলেন, তা-ই যেন এই সাহিত্য করতে চাইছে। এদিকে সমাজচেতনার যে তীব্র প্রকাশটি আমরা এমিল জোলা বা ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে পাই তা লাতিন আমেরিকান ফিকশনেও অর্জনের বিষয় নয় – সমাজবাস্তবতাকে একটি ভিন্ন মাত্রায়, যেখানে কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের সম্মিলন হয় এক অত্যাশ্চর্য রসায়নে, সেখানে চিন্তাকে নিয়ে যাওয়াই যেন এই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। জাদুবাস্তবতার পরিচয়টি এই বিচিত্রধর্মী চিন্তার মধ্যে আমরা পাই, যে চিন্তায় কাফকা এবং আলবেয়ার কামুর সঙ্গে পরাবাস্তববাদী ভাবনায় কোথায় যেন একটি সম্মিলন হয়। যে বাস্তব আমাদের প্রতিদিনের, তার থেকে বেরিয়ে আসা একধরনের পরিত্রাণ অথবা উত্থান বটে, কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিকতার ঘটনাগুলি কখনই আমাদের নিস্তার দেয় না। বরং, ঠিক যে মুহূর্তে বাস্তবতাকে আমরা পেছনে ফেলে আসতে চাইছি, ঠিক সে মুহূর্তে বাস্তবের চেহারাটাই পাল্টে যায়। এই চেহারা পাল্টানো কিন্তু কোনো আকৃতিগত পরিবর্তনের বিষয় নয় বরং প্রকৃতি বদলে যাওয়া, যেতে থাকা। ক্রমশ পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে যেখানে বস্তুরও নেই কোনো সুনির্দিষ্ট মাত্রা, সেখানে ওই বস্তুর সংস্পর্শ থেকে আমরা কতটা বিচ্ছিন্ন হতে পারি। আর, বিচ্ছিন্ন যদি হই, তাহলে ওই বিচ্ছিন্নতা ঘটতে না ঘটতে পূর্বতন শর্তগুলিও তো সব বদলে যেতে পারে এবং আমাদের বিচ্ছিন্নতার কার্যকারণ সূত্রটিই অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। জাদুবাস্তবতা ক্রমাগত বিভ্রম সৃষ্টি করে বাস্তবের অবস্থান নিয়ে : আমরা কল্পনাকে খুব শক্তিশালী দেখি, মুহূর্তকে শক্তিশালী দেখি, এবং এই মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে মানুষের পদচারণাকে তার একটি ক্রমবিলীয়মান পৃথিবীতে টিকে থাকার উপায় হিসেবে দেখি। মানুষ এই সাহিত্যে তার অস্তিত্বকে ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে দেখে, অথবা একটি তুর্কি আয়নায় প্রতিফলিত হতে দেখে এবং এই জীবনের অস্বচ্ছ অথবা বাঁকাচোরা চেহারা তাকে যুগপৎ চিন্তিত এবং কৌতুকাক্রান্ত করে। এই মানুষ যখন এইভাবে আকৃতি/সংগতি বদলে যাওয়া বস্তুকে দেখে হাসে, অথবা বিস্মিতভাবে নিজের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চায়, তখন বস্তুর প্রেক্ষাপট, তার সময়, ইতিহাস বা দেশের বিস্তৃত পেছনভূমিটি অবধারিতভাবে উঠে আসে। এজন্য জাদুবাস্তবতার উপন্যাসে প্রেক্ষাপটটি অত্যন্ত মূল্যবান, ইতিহাসটি অত্যন্ত মূল্যবান। অন্য যে কারণ এই গুরুত্বের পেছনে, তা হলো উপন্যাসে বিধৃত জীবনের একটি referent হিসেবে ওই প্রেক্ষাপটটি প্রয়োজনীয়। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর সাম্প্রতিক একটি উপন্যাস, দি জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিনথ--এ লিখেছেন সিমন বলিভারকে নিয়ে, এবং ইতিহাস ওই উপন্যাসে শুধু প্রেক্ষাপট নয়, কাহিনির একটি চলমান মাত্রাও। জাদুবাস্তবতা আত্মসচেতনতার বিষয়টিকেও এত বিক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করে যে, ব্যক্তি তার নিজেকে নিয়েই একসময় বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়। আত্মসচেতন হওয়াই যে অস্তিত্বের প্রথম শর্ত, এই ধারার উপন্যাস তা অস্বীকার করে। বরং আত্মসচেতনতা এবং অনস্তিত্ব কীভাবে সম্পর্কিত, সেটি হয়ে দাঁড়ায় তার অবলোকনের বিষয়। দেখা যায়, যে মুহূর্তে মানুষ নিজেকে অস্তিত্বের কেন্দ্রে অনুভব করে সবচেয়ে প্রবলভাবে, সেই মুহূর্ত থেকে তার পায়ের নিচের ভূমিটি শিথিল হতে থাকে। একসময় মানুষ নিজেকে অনস্তিত্বের অনিশ্চয়তায় সঁপে দিয়ে একটু নিশ্চয়তার আশা করে।
চার
গার্সিয়া মার্কেজের ‘ল্যাবিরিনথ’ অথবা গোলকধাঁধার প্রসঙ্গে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের একটি মৌলিক প্রবণতার কথা এসে যায়। জাদুবাস্তবতা ব্যক্তিকে ক্রমাগত যে অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয়, তা শেষমেশ গোলকধাঁধা এবং ইঁদুরের গল্পে রূপ নেয়। গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তা নেই, ইঁদুরটিও দীর্ঘ সময় ছুটে বেরিয়ে হয়তো তা জেনে ফেলেছে। কিন্তু সেই জ্ঞান তাকে তার উর্ধ্বশ্বাস পরিত্রাণস্পৃহা থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে না। ধ্রুপদী সাহিত্য ধরে নেয় -- এবং আমাদেরও এরূপ একটি চিন্তা লালন করতে অনুপ্রাণিত করে যে -- একটি গোলকধাঁধা (প্রধানত, নিয়তি), যখন নানা অন্ধগলির সমন্বয়ে আমাদের সামনে জীবনের একটি প্রতীক তুলে ধরে, তখন মানুষের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় রাস্তা খুঁজে নেওয়া। শেষ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে এরূপ আশা জাগ্রত থাকে, অথবা থাকতে হয় যে, পরিত্রাণ হয়তো পরবর্তী মোড়টি ঘুরলেই পাওয়া যায়। এই আশাবাদ একসময় হয়ে দাঁড়ায় জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু জাদুবাস্তবতার উপন্যাসে গোলকধাঁধায় নিপতিত মানুষ পরিত্রাণ নেই জেনেও ছুটতে থাকে, এই ছোটাই তার আনন্দ। ইঁদুরের উপমাটি এখানে প্রয়োগ করলে জিনিসটি এভাবে দেখা যায় যে, ইঁদুর যতই জানছে তার পরিত্রাণ নেই, সে তার আশাহীন ছোটাছুটিকেই জীবনের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ অভিযাত্রা বলে ধরে নেয়। হয়তো এমনও হতে পারে যে, পরিত্রাণ না পাওয়াটাই সমূহ আনন্দের পাওয়া থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায়। জাদুবাস্তবতার উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীরা এমন একটি জগৎ তৈরি করে নেয়, যা আপাতদৃষ্টিতে অন্ধকার বা উত্থানহীন হলেও সেখানে রঙের ও আলোর উদ্ভাস, গন্ধের এবং স্পর্শের উল্লাসটি থাকে গুপ্ত। যখন কল্পনা প্রসারিত হয়, একটি ভারি মুহুর্ত হয়ে যায় হালকা, নির্ভার । জাদুবাস্তবতা, ইন্দ্রজালে যেমন বাস্তবতা ও মায়ার মধ্যে স্থান পরিবর্তন। বাস্তবতার সমস্ত অবয়বকে পাল্টে দেয় তেমনি এক পৃথিবীকে মূর্ত করে যার কোনো মাত্রাই প্রথাসিদ্ধ নয়, পরিচিত নয়, অথচ এক একটি মুহূর্তে যা অসম্ভব আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়ায়।
পাঁচ
বলতে গেলে লাতিন আমেরিকান ফিকশনের প্রায় সর্বত্র এই বিভ্রম সৃষ্টিকারী গোলকধাঁধার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে, এবং এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই সাহিত্যের একটি প্রতীক পরিচয়ও। গার্সিয়া মার্কেজ অথবা ভার্গাস ইয়োসার একটি উপন্যাস যখন আমরা পড়তে বসি, একটি সাক্ষাৎ গোলকধাঁধায় আমরা ঢুকে পড়ি। কিন্তু এই যে কানাগলির পর কানাগলি অতিক্রম করে আমরা চলতে থাকি, তা কিন্তু চলার আনন্দকে কেড়ে নেয় না। কোনো কানাগলিই বাইরের রাস্তাটিকে দেখাতে পারে না, অথচ এই জ্ঞান নিয়েও আমরা ওই কানাগলির শেষ প্রান্তটি পর্যন্ত ছুঁয়ে আসি, কারণ ওই ছুঁয়ে আসার মধ্যেই আমাদের মুহূর্তের নির্বাণ। তাছাড়া, চলতে চলতে যখন খেয়াল করি যে দুপাশের দৃশ্যপট মুহুর্মুহু পরিবর্তিত হচ্ছে, সূর্য উঠছে, নিভছে এক অনভ্যস্ত ভূগোলে, আলো ও অন্ধকার তৈরি করছে এক বিভ্রমের জগৎ কারণ তাদের আপেক্ষিক বৈশিষ্ট্যগুলিও স্থান পরিবর্তন করে নিচ্ছে, তখন এই মায়ার জগৎটিকেই বেশি আকর্ষণীয় বাস্তবতা বলে মনে হয়।
এবং সেই গোলকধাঁধা যখন অবধারিত প্রক্রিয়ায় নিজেদের ভেতরে আমরা আবিষ্কার করি, তখন সকল দৃশ্যমান বস্তুর ভেতর দিয়ে যেন ভিন্ন এক দিগন্ত উঁকি দেয়। আমরা ভয়, শঙ্কা, করুণা, ঔৎসুক্য ও নিস্পৃহতার নামহীন রসায়নে আপ্লুত হতে থাকি। লাতিন আমেরিকার যে দেশে সমাজবাস্তবতা যত নৃশংস তত ওই রসায়নের সক্রিয়তা। কিন্তু ফুয়েন্তেসের মতো তীব্র অনুভূতি ও তীক্ষ দৃষ্টির লেখকও সমাজবাস্তবতাকে একটি ভেতরের বাস্তবতায় পদার্পণের প্রবেশভূমি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। প্রায়শই দেখা যায়, বাইরের বর্ণনাটি নিখুঁত, রাস্তাঘাট, বাজারহাট, মাঠ-প্রান্তর-নিসর্গের সকল খুঁটিনাটি যথাস্থানে আছে; কিন্তু আমরা জানি, অচিরেই এই দৃশ্যের ওপর অনুভবের একটি চাদর পড়বে; আমরা জানি, যে মুহূর্তে মনোজগতের বিশাল উত্থান-পতন সূচিত হবে, ব্যক্তির অনিশ্চয়তা এবং তার অস্তিত্ববাদী চিন্তায়, সে মুহর্তে পর্দা দুলে উঠবে। কিন্তু জাদুবাস্তবতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, জীবনের হালকা মুহূর্তগুলিতে, যেখানে কৌতুকের অনুভূতি প্রধান, তারা ব্যক্তিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। যেখানে কাফকা শেষ দৃশ্যের ওপর অন্ধকার যবনিকা টেনে দেন, ক্যামু ফেলেন অন্ধকার মঞ্চে কিছু সুক্ষ্ম সন্ধানী আলো, সেখানে গার্সিয়া মার্কেজ অথবা ভার্গাস ইয়োসা কিছু হালকা আলোয় লাল-নীল রঙের ছোপ ফেলে খুব ওজনহীন করে দেন মুহূর্তটিকে -- ওজনহীন এবং কৌতুকের, অথচ, বিষয়বস্তু তাদের মোটেও সহজ নয়, হালকা নয়। জীবনকে দেখার মধ্যে তাঁদের কোনো দার্শনিক ভার নেই। যেহেতু জাদুবাস্তবতা ব্যক্তির ভেতরেই সন্ধান করে তার মুক্তি, তার কানাগলিতেও একটি বিশাল সম্ভাবনার উদ্বোধন ঘটাতে হয়, এবং তা ঘটাতে হয় জীবনের সকল মুহূর্তের সমান আরোপিত ওজনটি সরিয়ে দিয়ে।
ছয়
হোর্হে লুই বোর্হেসের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম কনটেম্পরারি লিটারেচার-এর ১৯৭০ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যায়। সে সাক্ষাৎকারের দুটি বিষয় আমাকে অনেক ভাবনার খোরাক দিয়েছে। প্রশ্নকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বোর্হেসের লেখায় ওই গোলকধাঁধার প্রতীকটি কেন বারে বারে আসে। জবাবে বোর্হেস বলেন, কিংবদন্তির গোলকধাঁধায় মানুষ ও মিনোটরের যে অবস্থান, তাতে তারা পরস্পরকে অর্থবহ করে। মিনোটর মানুষটিকে ভক্ষণ করবে বলে তাড়া করছে, আর মানুষটি আজীবন ওই গোলকধাঁধায় ঘুরছে। একসময় দেখা গেল মিনেটরের পদচিহ্ন তার সামনে এবং সেই মুহূর্তে সে-ই হয়ে গেল মিনোটরকে তাড়িয়ে বেড়ানো শক্তি। মানুষ ও মিনোটরের এই সহঅবস্থান, অর্থাৎ মানুষ ও তার ভয়, অথবা তার নির্জন অথবা কৌতূহল অথবা নিস্পৃহতা -- এমনভাবে সংশ্লিষ্ট হতে হয় যে তারা যে-কোনো মুহূর্তে স্থান বদল করে, তাহলেই শুধু অর্থপূর্ণ হয় ওই গোলকধাঁধার রহস্যটি। চেস্টারটনের একটি উক্তি উদ্ধৃত করেন বোর্হেস ‘মানুষ যা ভয় করে তা হলো, ‘একটি কেন্দ্রহীন গোলকধাঁধা।' এখানে কেন্দ্র মানে ওই মিনোটর অথবা মানুষের ভয়, অথবা তার বিনাশী প্রেম, অথবা তার অর্থহীন অস্তিত্ব। জাদুবাস্তবতায় এই চিন্তাটি প্রধান হয় যে, যদি কিছু ভীতিপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে তার কারণ হচ্ছে এই যে, তা অর্থহীন। অর্থহীন বলেই ভীতিপূর্ণ কিন্তু মানুষের নির্বাণ এইখানে যে, সে ক্রমাগত একটি অর্থ আবিষ্কার করতে চায়, সফলও হয়তো হয়; কারণ গোলকধাঁধার দেয়ালে মিনোটরের কল্পিত ছায়াই তার জন্য যথেষ্ট অর্থের ভিত্তি। বোর্হেস অন্য যে বিষয়টির অবতারণা করেন, তা হলো নিদ্রাহীনতার। তাঁর নিজস্ব ওই রোগটি ছিল নিদ্রাহীনতার, কিন্তু নিদ্রাহীনতার যে সাংঘাতিক স্বচ্ছতা থাকে, যাকে বোর্হেস বলেন terrible lucidity, তা কেন জানি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিদ্রাহীনতার সবচেয়ে কষ্টকর মুহূর্তেও মানুষ আবিষ্ট হয় না, ক্লিষ্ট হতে হতে স্মৃতি হারায় না; চিত্রকল্প তার থাকে অটুট। লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের যে জগৎ তা ওই নিদ্রাহীনতা অথবা ইনসম্নিয়ার, যেখানে কষ্ট আছে, কিন্তু কষ্টের ভেতর দিয়ে এক অবিশ্বাস্য স্বচ্ছতায় পৃথিবীকে দেখা হয়; যেন জেগে থাকাটা শাস্তিস্বরূপ, নিদ্রাহরণ একটি শাস্তি; অথচ, একসময় ওই শাস্তিই যেন লোভনীয় হয়ে ওঠে। নিদ্রারহিত মানুষ যখন বোঝাপড়া করে নিজের সঙ্গে, তার পৃথিবী আশ্চর্য কান্তিময় হয়ে ওঠে -- সে রাতের যাবতীয় শব্দ শোনে; বরং বলা যায় যাবতীয় শব্দের জন্য তার ইন্দ্রিয় উৎকর্ণ হয়ে থাকে। সে রাতের এক অদৃশ্যপূর্ব বিভা প্রত্যক্ষণ করে – যা নিদ্রিত মানুষের অগোচরে ঘটে যায় তার জন্য। নিদ্রিত মানুষ হয়তো স্বপ্ন দেখে – সে অন্য জগৎ। কিন্তু নিদ্রাহীন মানুষ বাস্তবের ভেতর দিয়ে অন্য এক কুহকী বাস্তবকে আবিষ্কার করে।
সাত
গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসটিতে যে গোলকধাঁধার বর্ণনা আছে, তা সিমন বলিভারের বাইরে এবং ভেতরে। মধ্যচল্লিশে অকালবৃদ্ধ এই অকুতোভয় যোদ্ধা ও জেনারেল তাঁর বন্ধুবান্ধব, সহযোদ্ধা অথবা সহযোগীদের থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছেন, তাঁর পৃথিবীটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, তিনি ক্রমাগত নানা অন্ধগলির রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছেন এবং একসময় পরিচিত সব দৃশ্যপট রূপ ধারণ করেছে অপরিচিতের। তিনি ওই গোলকধাঁধায় হঠাৎ মিনেটরের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছেন -- বোর্হেসের সেই মিনোটর যার উপস্থিতি ছাড়া ওই ল্যাবিরিনথের কোনো অর্থ হয় না, অথচ যে সমূহ বিনাশ সাধনে উদ্যত সেই তাড়িত মানুষের। এই মিনোটর আসলে বলিভারের নিজস্ব, একান্ত গোপন একটি ভয়- - যে ভয় তাকে পতনের প্রান্ত পর্যন্ত ঠেলে দেয়। উপন্যাসটিতে দক্ষিণ আমেরিকার যে নিসর্গ চিত্রিত হয়, তা যেন কোনো তাড়িত জীবনের উৎপ্রেক্ষা, যেন এইমাত্র সমস্ত দৃশ্যপট গলে যাবে কোনো অপার্থিব আলোয় এবং জেগে থাকবে এক আকর্ষণীয় অবর্ণনীয় বীভৎসতা।
গার্সিয়া মার্কেজ বলিভারের দ্রিাহীনতাকেও পুঁজি করেন, কিন্তু সেই নিদ্রাহীনতা তার পচনশীল, পতনোন্মুখ পৃথিবীর নিয়তি -- এইভাবে তিনি হাজির করেন। বলিভারের terrible lucidity আমাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়, এবং আমরা ওই স্বচ্ছতায় নিজেদের পৃথিবীকেও দেখি। ভার্গাস ইয়োসার উপন্যাসটিও ভিন্ন একটি গোলকধাঁধার সৃষ্টি করে, তবে তা আপন যৌনতার, যৌন উৎকল্পনার। সৎমায়ের প্রশংসা বা ইন প্রেইজ অফ স্টেপমাদার একটি সুবিন্যস্ত এবং সুনির্মিত উপন্যাস, মানুষের যৌন প্রবৃত্তিগুলিকে একটি ভিন্ন আলোকে উপস্থাপনা যার লক্ষ্য। সৎমাটির নাম ডনা লুক্রেসিয়া, সংপুত্রটি মাত্র দশ-এগারো বছরের বালক যার নাম আলফনসো : স্বামী পঞ্চাশোর্ধ্ব - ডন রিগোবার্তো। এই ত্রিভুজে আরো একটি মানুষ যুক্ত হয়, শক্তসমর্থ, সুন্দরী, কৃষ্ণকায় পরিচারিকা, যার নাম জাস্টিনিয়ানা। লুক্রেসিয়ার বয়স যদিও চল্লিশ, এবং পূর্বে একটি বিয়ে তার ভেঙে গেছে কিছু বেদনা ও ক্ষতের স্মৃতি রেখে, রিগোবার্তোর সঙ্গে তার নতুন জীবন শুরু হয় একধরনের যৌন পরিপূর্ণতা দিয়ে, যা একাধারে বাস্তব ও ফ্যান্টাসির সংমিশ্রণ। রিগোবার্তো তার এই প্রৌঢ় বেলায় যেন নতুন করে জেগে ওঠে, তার ফ্যান্টাসিগুলি - এবং ভার্গাস ইয়োসা অনেক ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ স্বরূপ বর্ণনা দেন -- তার ভেতর এক অবিশ্বাস্য শিহরণ জাগিয়ে তোলে। লুক্রেসিয়ার জেগে ওঠাও এক নান্দনিক উত্থান; আমাদের মনে হবে যেন যৌনতা কোনো সুপ্তি থেকে তার অবচেতনকে জাগ্রত করেছে, যেন সে মুক্তি পেয়েছে কোনো কঠিন বন্ধন থেকে। কিন্তু একটি দৃশ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আসলে মানুষ খুব বেশিদূর যেতে পারে না --যেতে চায় না, তাই। বাথরুমের ভেতর নগ্ন লুক্রেসিয়া, আর ঘুলঘুলি দিয়ে তাকে দেখছে সৎপুত্র আলফনসো। লুক্রেসিয়া জানে, সে বুঝতে পেরেছে সৎপুত্রটি দেখছে তাকে। তাই, যেন যৌনতার সাক্ষী প্রয়োজন, যেন সবচেয়ে নির্জন যৌনসুখের মুহূর্তগুলি একপর দর্শকের সামনে উন্মোচিত হয় -- এরকম হয়েই আসছে মানুষের সৃষ্টি থেকে -- লুক্রেসিয়া নিজেকে আরো মেলে ধরে। তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যত আকর্ষণ ছিল, সব সে ওই বালকটির জন্য খুলে দেয়।
বালকটির কথা তখন না বলাই ভালো। কিন্তু ভার্গাস ইয়োসা ওই মুহূর্তটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, আমরা বুঝতে পারি, লুক্রেসিয়া প্রবিষ্ট হয়েছে একটি গোলকধাঁধায় এবং আলফনসো তার মিনোটর। আবার ওই বালকটির জন্যও খাটে কথাটি, এবং তার মিনোটর লুক্রেসিয়া। এই যৌনতার ল্যাবিরিনথ থেকে মুক্তি নেই -- না মানুষের, না মিনেটরের; কিন্তু তারা ওখানে পরস্পরের তাড়না করে, তাড়নাই তাদের খেলা, তাদের Game. এই তাড়াই সৃষ্টি করে। সুখ, সৃষ্টি করে সৌন্দর্য।
জাদুবাস্তবতা এইভাবে জগৎকে ভিন্ন একটি মাত্রায় উপস্থাপন করে। এই জগৎ আমাদের, আমরা একে চিনি, আবার চিনিও না। কিন্তু চেনা-অচেনার বিভ্রমে ডুবে যেতে আমাদের ভালো লাগে। আমরা হালকা হতে থাকি।
মে, ১৯৯২
0 মন্তব্যসমূহ