লীনা দিলরুবা : সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প



বাংলাদেশে দশক বিচার করে যেসব কথাসাহিত্যিকের নাম শোনা যায়, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে সেভাবে চিহ্নিত করা যায় না। তিনি যদিও সত্তরের দশকে লেখালেখি আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু স্বেচ্ছাবিরতির কারণে বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর মূল আত্মপ্রকাশ ঘটে আশির দশকে। তাঁকে নির্দিষ্ট দশকের প্রতিনিধি বলা না গেলেও গুণবিচারে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা দেশের মানুষের জীবনের সবচেয়ে গৌরবজ্জ্বল এবং অসাধারণ ঘটনা। স্বাধীন দেশের মানুষ বলে নিজেদের অস্তিত্ব আবিষ্কারের সময়টা গণমানুষের জীবনে তৈরি করেছিল উত্তেজনা, ইতিহাস তাই বলে। একটি পরাধীন দেশের নাগরিক রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার আস্বাদ পাবার পর এদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থাই শুধু নয়, তাদের সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যের ভুবনেও এসেছিল ব্যাপক পরিবর্তন। তখন এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশ ছিল শিক্ষিত, বেশিরভাগই অশিক্ষিত, যাদের একটি বড় অংশ আবার গ্রামাঞ্চলে অথবা মফস্বলে বসবাস করতো। সৈয়দ মনুজুরুল ইসলাম এদেরকে কাছ থেকে দেখেছেন, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এদের জীবনের অতৃপ্তি, হাহাকার, প্রেম-যৌনতা, যাপিত জীবনের সুখ-অসুখের গল্পগুলোকে মোটা দাগে নয়, তাদের গভীর আর্তনাদকে, কান্নার চেনা-অচেনা সুরকে, অসহিষ্ণুতাকে, প্রশ্নকে, বিস্ময়কে, নিষ্পাপতা, বিষণন সরল চিন্তাকে-- সব আলপথ ডিঙিয়ে সাপের মুখে-ব্যাঙের মুখে চুমু খাওয়া মানুষদের মনের কথাকে ভাষার সাধনায় কখনো ধ্বনিময় বাংলা পরিভাষায়, কখনো শ্লেষ বিদ্রুপে, বক্রতায়, কখনো নিরেটভাবে তিনি উঠিয়ে এনেছেন তাঁর গল্পে। শুভ আর অশুভের দ্বন্দ্ব, জগতের কাল্পনিক সুখের ভুবনকে তিনি স্পর্শ করেছেন। হৃদপিণ্ড বন্ধ হওয়া ক্ষতের মরুর দিকে মানুষের অভিযাত্রা কতোটা রোমাঞ্চকর হতে পারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প পড়ে সে-অভিজ্ঞতাও হয়। 

প্রকৃতি এক বিপুল ঔদাসীন্য বজায় রেখে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে যেন মেতে ওঠে এক নিষ্ঠুর খেলায়, জীবন তো তা-ই! জীবন তো আবার এক অবিমিশ্র সংগ্রামের নামও। জীবনের এসব গল্প নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তাঁর বেশিরভাগ গল্প অতি-সংযত যা ছোট গল্পের সংজ্ঞাকে মূল্যায়িত করে, গল্পগুলো বর্ণনার অতি কথন বিবর্জিত, নিজের আবিষ্কৃত একটি ভঙ্গি পাঠকের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অদ্ভুত কিছু শব্দ, কিছু সাধারণ লাইন যোগ করেন, সেই লাইনটি গল্পটির যে শোভা বৃদ্ধি করে সেটি একেবারে অন্যরকম, বোধ করি বাংলা গল্পে এই স্টাইলটি তাঁর একার অধীন। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ‘নোলক’ গল্পের একটি লাইন, ‘কাজেম শেখের বাড়ি শিয়ালকোটে, যদি জানতে চান।’ এই বাক্যটিতে, কমার আগের তথ্যটি কাজেম শেখের বাড়ি কোথায় এ সম্পর্কে তথ্য পরিবেশন করেছে, কমার পরে ‘যদি জানতে চান’ একটি বাড়তি কথা। এই বাড়তি, সাধারণ কথাটি পুরো বাক্যটির যে শ্রী বৃদ্ধি করেছে সেটি গল্পটির প্রতি পাঠককে আগ্রহী করে তোলে। 

নারী-পুরুষের কামনাবৃত্তির বিচিত্র গতি স্থান পেয়েছে ‘চৈত্রঘর’ গল্পে। এ গল্পটি অনেকটা ‘আল মাহমুদ’ ঘরানার। আল মাহমুদ যেমন যৌনতার মধ্য দিয়ে তাবৎ জীবনকে ধরতে চেয়েছেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও গল্পে বারবার যৌনতার কাছে ফিরে গেছেন। ‘চৈত্রঘর’ মনে করিয়ে দেয় আল মাহমুদের ‘জলবেশ্যা’, ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পের কথা। 

শহরের সঙ্গে গ্রাম জীবনের সমান্তরাল বাস্তবতায় বেড়ে ওঠা মইজুদ্দিনকে নিয়ে ‘চৈত্রঘর’। মইজুদ্দিন সরকারি চাকরীজীবী, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব। গ্রামে বড় হয়েছেন, লেখাপড়ার জন্য পরে ঢাকা শহরে চলে যান। তার বেড়ে ওঠার এলাকা রুক্ষ, মঙ্গার আঘাতে রুগ্ন। ধূসর উত্তরবঙ্গ। মা নেই, মইজুদ্দিন বড় হয়েছে সৎ মায়ের কাছে। সৎ মায়ের এক সৎ ভাইয়ের মেয়ে নাসিমাও ফুপুর বাড়িতে আশ্রিতা। যেখানে মইজুদ্দিনও থাকে। দু’জনের বয়সের পার্থক্য এক বছরের। যখন নাসিমার বয়স ষোল হল, মইজুদ্দিনের সতের বছর। এ-বয়সে ছেলেদের যেটি হয়, বয়সন্ধির পরের সময়টায় শরীর উত্তাল, নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। মইজুদ্দিনের সেই উত্তাল অবস্থা। একদিন নাসিমাকে বাড়ির পুকুরে খোলামেলাভাবে আবিষ্কার করে মইজুদ্দিন। সেও নেমে পড়ে পুকুরে। আঁধারের মধ্যে কাছাকাছি আনতে চায় নাসিমাকে। এই দৃশ্য দেখে ফেলে মইজুদ্দিনের সৎ মা, নাসিমার সৎ ফুপু। ফলাফল হয় ভয়াবহ। নাসিমাকে এক শিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়, যে শিক্ষক কি না আগে আরো দুটি বিয়ে করেছিল। অন্যদিকে মইজুদ্দিনকে নানান কৌশল খাটিয়ে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

সেই যে মইজুদ্দিনের শরীর জেগেছিল, সে জাগরণ শরীরেই গুমরে মরেছে, গরল ঢেলে দেবার জায়গা খুঁজে পায়নি মইজুদ্দিন। তখন বস্তুত মনের আবেগ আর দেহের আবেগ নিয়ে মইজুদ্দিন ক্রমাগত খাবি খাচ্ছিল। ক্রমে সে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পায়, এবং এক বিখ্যাত এমএনএর মেয়ে নাদিরা আঞ্জুমকে বিয়ে করে। শরীরের আবেগ মেটাবার বৈধ জায়গা খুঁজে পেয়ে মইজুদ্দিন যখন উত্তেজিত তখন দেখা গেল নাদিরার এসবে কোনো আগ্রহই নেই। নানান প্রতিরোধ তৈরি করে যৌন সম্পর্ককে নাদিরা ক্রমাগত ভীতিকর করে তুললো। এরমধ্যেই তারা একটি পুত্র এবং একটি কন্যার পিতা-মাতা হয়ে যান। স্ত্রীর ওপর খুবই অল্পসময়ের যৌন দখলদারিত্ব বজায় রেখে দুই সন্তানের পিতা হবার পর মইজুদ্দিন অনুভব করলেন, তিনি বঞ্চিত, বুভুক্ষু, ক্ষুধাকাতর। তিনি অনুভব করলেন তার শরীরে চৈত্রের দাবদাহ। নাদিরা স্বামীকে চির-মঙ্গার দেশে একটি বাড়ি তৈরি করার অনুরোধ করে। স্ত্রীর দাবী মেটাতে উদ্যোগ নেন মইজুদ্দিন, এর মধ্যেই নাদিরা দেহত্যাগ করে। বাড়ি তৈরি হয়, বাড়ির নাম দেওয়া হয়, ‘চৈত্রঘর’। মইজুদ্দিনের মেয়ের ডিজাইন করা সেই বাড়ির বারান্দা জাহাজভাঙ্গা কাঠের, ওপরে টালির ছাদ। 

একবার চৈত্রদিনে মইজুদ্দিনের সময় কাটছে ‘চৈত্রঘরে’, লেখক বিহ্বল ভাষায় সেই রুক্ষ-কঠিন সময়ের বর্ণনা করেন--
এক চৈত্রদিনে, প্রচণ্ড দাবদাহে যখন পুড়ে যাচ্ছে মাঠ, ঘাস, তামাকের কাটা ক্ষেত, মাটির ডেলা, বাতাস, বাতাসের ওপর ভর করা আকাশ, জাহাজ-ভাঙ্গা কাঠের বারান্দা আর টালির ছাদ, দরজা জানালা, তার নিজের শরীর এবং ঠোঁট, মইজুদ্দিন চৈত্রঘরের বারান্দায় বসে বসে দেখলেন, আকাশ আর মাটির সঙ্গমে উৎপন্ন হচ্ছে কী তীব্র প্যাশন! সামনে খোলা মাঠ, শূন্য তামাক ক্ষেত, তারপর অনেকটা দূরে জলহীন নদী/খাল। দুপুরের রোদে সব পুড়ে খাক, এবং পুড়তে থাকা সকল দৃশ্যপট থেকে বেরুচ্ছে ভাপ, যেন গরম পানিতে সিদ্ধ হচ্ছে কারো শরীর। ওই ভাপ দেখতে দেখতে তার মনে হল, এ তো রোদের দহনে সৃষ্ট তীব্র তাপের কাঁপন নয়, এ যেন আকাশ আর মাটির, সূর্য এবং পৃথিবীর দীর্ঘ দীর্ঘ সঙ্গম ক্রিয়ার তীব্র তীব্র প্যাশনের সঞ্চরন। 
শরীর আর যৌনতাকে ঘিরে পাঠকের কৌতুহলের সীমাকে লেখক যেন ছড়িয়ে দিতে চান। প্রকৃতিকে স্পর্শ করতে চান নিবিড়ভাবে। লেখক যৌনতার ধারণাকে আশ্রয় করে পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকাকে কৌতুকভরে বিশ্লেষণ করেন--
বারান্দায় বসে বসে প্রতিদিনের এই প্যাশন-প্লে দেখতে দেখতে মইজু্দ্দিনেরর মনে হয় মানুষের জীবনটা খুবই অকিঞ্চিৎকর। তার জীবনের প্যাশন, তার আনন্দ আর উত্তাপ নিতান্তই সামান্য। প্রকৃতির এই মহা-প্যাশনের সামনে হাস্যকর রকম অপ্রতৃল। 
এরপরই মইজুদ্দিনের পরিচয় হয় আলিমনের সঙ্গে। আলিমন বিধবা, আরেকজনের আশ্রয়ে থাকে। সকালের নাস্তা পৌঁছে দিতে মইজুদ্দিনের কাছে তাকে আসতে হয়। আলিমনের ত্রিশ বছরের শরীরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে মইজুদ্দিন। মইজুদ্দিনের মনে হয়, আলিমন এক রহস্য ঘেরা মৃত্তিকা, অথবা ঘাসের চাদরে মোড়া মাঠ, আর তিনি সূর্য। সুতীব্র প্যাশনে আক্রান্ত হয় মইজুদ্দিন, কিন্তু আলিমন তাতে সায় দেয় না। গ্রাম জীবনের বিশুদ্ধ রূপের বাইরে সংকীর্ণতা, কুসংস্কারের যে বিষ সেটি এ-গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, আলিমন মইজুদ্দিনের আহ্বানে সাড়া দিলে সে হয়ত তার আশ্রয়টিই হারাবে, এই বাস্তবতা বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন গ্রামকে ভিন্নভাবে অনুধাবন করায়। অভিমান বা কোনো রহস্যময় কারণে মইজুদ্দিন এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। আলিমন আবার আসে চৈত্রঘরে। এসে দেখে মইজুদ্দিন নেই। আলিমন সেখানে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। গ্রামের মেয়ে আলিমন চৈত্র অনেক দেখেছে, কিন্তু চৈত্রঘরে বসে তার ঘোর লেগে যায়। তার শরীর টান দেয়। নিজের ভেতর অনুভব করে উত্তাপ, ছাই-চাপা আগুন যেন বেরিয়ে পড়তে চাইছে। আলিমনের নিজেকে মাটি মনে হয়, সে কামনা করে, উপরের আকাশ যদি মাটিতে নেমে আসতো! সূর্য নেমে আাসতো নিচে! লেখক লেখেন--

‘আলিমন কাঠের মেঝেতে শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ে আকাশকে ডাকল। সূর্যকে ডাকল। বলল, আমি মাটি, আমাকে পোড়াও।’ 

বিধবা আলিমনের ছিল সমাজের ভয়, শরীরের উত্তাপ নেভাতে মইজুদ্দিনকে নিয়ে সে দ্বিধায় ছিল। এখন? যখন প্রকৃতিকে সে কামনা করছে, শরীরের তাপ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য প্রকৃতির জৈবশক্তির বিশালত্বকে যখন সে অস্বীকার করতে পারছে না, তখন প্রকৃতির সঙ্গে একজন নারীর আলিঙ্গনের অভিনব আকাঙ্খার কারণে মানুষের স্বাভাবিক যৌনবৃত্তির খণ্ডিত অর্থ সংকুচিত হয়ে যায়। অন্যদিকে লেখক যখন বলছেন, সূর্য-মাটি-বৃক্ষ-- প্রকৃতির সন্তানরা সৃষ্টি হয়েছে কোনো এক গভীর সঙ্গমের ফলেই ; তখন মানুষের সন্তানদের প্রকৃতির সন্তান বলার চিরায়ত ধারণার সঙ্গে প্রকৃতিতেও যৌনতা রয়েছে-- এই তাৎপর্যকেও আমরা উপলব্ধি করি। লেখকের চিনিয়ে দেয়া পথে পাঠকের সামনেও উন্মোচিত হয় মানুষের প্যাশনের-আনন্দের ক্ষুদ্র পরিসীমা যা সুবিশাল প্রকৃতির প্যাশনের কাছে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। 

'নোলক’ গল্পটিও গ্রামজীবনে পটভূমিকায় লেখা। এ-গল্পেও যৌনতার মধ্য দিয়ে জীবনকে ধরতে চেয়েছেন লেখক। ‘নোলক’ গল্পে আমরা খুঁজে পাই নানান ইশারা, ইঙ্গিত। খুঁজে পাই এক গভীর চিত্রকল্প। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছোটগল্পের ফর্মগত পরিমিতিবোধের মধ্যে অবস্থান করেন, এ-গল্পে সেই পরিমিতিবোধ উজ্জ্বল। বারই গ্রামের জ্যোৎস্না তার সৌন্দর্যের কারণে এলাকায় খ্যাত, আরেকটি পরিচয় তার আছে, সে খুব ভাল গান গায়, সে খোড়া, ছোটোবেলায় পোলিওতে তার পায়ের এ-অবস্থা হয়। জ্যোৎস্নার সঙ্গে স্থানীয় মকনের সম্পর্ক তৈরি হয়। যৌনতা মকনের জীবনে অমোঘ। লেখক বাঘের দাম্পত্য এবং যৌনজীবনের সঙ্গে মানুষের যৌনতার সংযোগ দেখিয়ে জ্যোৎস্নার সঙ্গে মকনের সম্পর্ককে চিহ্নিত করেন। জ্যোৎস্ননাকে দেখলে মকনের শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে যায়, মকন জ্যোৎস্ননাকে নিজের করে নিতে চায়। জ্যোৎস্নার চারপাশে অনেক ভক্তের দেখা মেলে, গানের গুরু মাক্কু শাহ জ্যোৎস্নাকে নাকে পরার একটি নোলক উপহার দেয়, জ্যোৎস্না সেই নোলক পরিধান করে। কিন্তু মকন এই নোলক পছন্দ করে না। এদিকে দুজনের মধ্যে যৌন সম্পর্কের জেরে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না চায় সন্তানের স্বীকৃতি, চায় বিবাহ, কিন্তু মকন এর কিছুই চায়না। সে ভ্রুণটা ফেলে দিতে চায়, সে এমনকি জ্যোৎস্নাকে বিয়েও করতে রাজি নয়। এ-এক অদ্ভুত প্যারাডক্স, যে রহস্যময়ী নারীর জন্য এমন ব্যাকুলতা, তাকে শরীরে কামনা করে কিন্তু জীবনে জড়াতে চায়না মকন। প্রেমকে একদিকে মহিমান্বিত করা আবার স্বীকৃতি না দেওয়া এবং তার সমাধান হিসেবে জটিল একটি পথ খুঁজে নেবার উদ্যোগ গল্পটিকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। যেই পরিণতিতে জ্যোৎস্নার নাকের নোলক হয়ে পড়ে বড় অনুষঙ্গ। গল্পটিতে মকনের মাধ্যমে সামাজিক নির্যাতনের এক গভীর চিত্র ফুটে উঠেছে। 

অনেকসময় সমাজের ওপরতলার মানুষদের অপরাধের বিচার হয় না, কায়দা করে তাদের অপরাধের দায় কীভাবে নিরপরাধ মানুষের ওপর পড়ে সেই বাস্তবতার শিল্পরূপের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’ । অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এই তিন কাল অতিক্রম করে যার স্থিতি, যে ধর্ম সত্যস্বরূপ, তাকে বলে সত্যধর্ম। সত্যধর্মে মানুষ নিজের কর্মানুসারে আত্মপ্রসাদ বা আত্মগ্লানি ভোগ করে। ডিডেলাসের ঘুড়িতে লেখক বলেন, পৃথিবীতে সত্যধর্ম নাই। নাই বলেই হোসেন মিয়ার গ্যারেজের কর্মচারী ইমান ছুটির দিনেও ঘণ্টা তিনের মত কাজ করে কোন পারিশ্রমিক পায় না, এ সময় সে শখ করে ঘুড়ি ওড়ায়, ঘুড়িটা তাকে লুকিয়েই ওড়াতে হয় কারণ ইমানকে ঘুড়ি ওড়াতে দেখলে হোসেন মিয়া বলেন, তুই একটা বাইচ্চা নাকি যে খালি ঘুড্ডি উড়াইবি? রাখ। গুড্ডি লাটাই রাখ। হাত লাগা। প্লাসটা খুইজ্যা দে।’ আবার পৃথিবীতে হয়ত সত্যধর্ম আছে। নইলে নয়মাস বয়সে ইমান একইদিনে বাপ-মা দুজনকেই হারিয়েছিল। সেই ইমান বড় হল কীভাবে! 

ইমানের বাবা সেতু মিয়া ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। সেই সেতু মিয়া, যার গ্রিক পুরানের মত পুত্র ইকারুসকে ঘুড়ির মত উড়িয়ে দিতে মন চাইত। ইকারুসের মোমের ডানা গলে গিয়ে সে মরে যায়, এখানে ইকারুস রুপি ইমানের বাবা ডিডেলাস মানে সেতু মিয়াই ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে পড়ে মরে যায়। অর্থাৎ গ্রিক পুরানের বিপরীত। হোসেন মিয়ার ভাইও সেদিন পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল, দুজনই সেদিন পরপারে চলে যায়। এজন্য মূলত হোসেন মিয়া ঘুড়ি ওড়ানো পছন্দ করেন না। সঙ্গে ইমানের ওপর কাজ চাপানোর বিষয় তো আছেই।

সাংবাদিক আবদুল মুয়ীদ তালুকদার হোসেন মিয়ার গ্যারেজে তাঁর ভেসপা ঠিক করাতে দেন। ছুটির দিনে হোসেন মিয়া মুয়ীদ এর ভেসপার কাজ করেন কারণ এই সাংবাদিক আবদুল মুয়ীদ তালুকদার হোসেন মিয়ার গ্যারেজটি মেয়র এর লোকের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। হিসাব পরিষ্কার। আমি তোমার জন্য করব, তুমি আমার জন্য। মাঝামাঝি কিছু নেই। 

ইমান গ্যারেজের কাজ সেরে আবার ঘুড়ি ওড়াতে চলে যায়। হঠাৎই ইমান দেখে ঘুড়ি কান্নির অভাবে শুধু ডান দিকে কানাতে কানাতে মাঠের পাশের পাঁচ তলা ফ্ল্যাটের সঙ্গে থাকা নারিকেল গাছে আটকে গেছে। ইমান গাছ বেয়ে ঘুড়ি আনতে যেয়ে চারতলায় একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পায়। মেয়েটির ঊর্ধ্বাঙ্গে কাপড় নেই, সে ইমানের দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিতে চায়, বলে, ‘ভাই আমারে বাঁচাও। আমারে মাইর‌্যা ফেলতাছে।’ হঠাৎ বারান্দার দরজাটি খুলে যায়, ইমান দেখে ঢালকা বাজারের সবার চেনা দারোগা সাহেব উলঙ্গ মেয়েটিকে জাঁপটে ধরেছে। সে ব্যালকনিতে দারোগার স্ত্রীকে দেখল। ইমান দেখল তারা দু’জনে মিলে মেয়েটিকে নিচে ফেলে দিতে। 

ইমান সাংবাদিক মুয়ীদকে ঘটনাটির কথা বলল। মুয়ীদ আর সাবরিনা নীনা মিলে হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করল। ধরা পড়ল দারোগা আর তার স্ত্রী। 

কিন্তু সত্যধর্ম আছে আবার নাই বলে, সত্যধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন দেখল রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট দারোগা ও তার স্ত্রী নয় মামলার নতুন চার্জশীটে দারোগা সাহেবের বাড়ির মূল্যবান জিনিস চুরির দায়ে ইমানকেই অভিযুক্ত করা হল। সেই মৃত মেয়েটি, যার নাম আছমা, বলা হল, ‘আছমা ওই পিচ্চি ইমানের সহযোগিতায় দারোগা সাহেবের ঘরের মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে পাচার করত। ছেলেটা গাছ বেয়ে উঠত, আর আছমা পোঁটলা চালান দিত। ’ অকাট্য যুক্তি।

যেন কাম্যুর আউটসাইডারের নায়ক। মায়ের অন্তেষ্টিক্রিয়ায় উদাসীনতা প্রদর্শন আর কান্না না করার কারণে সমাজের কাছে যে অপরাধী হয়ে যায়, খুনের মামলার দায় অনায়াসে তার ওপর চাপানো যায়, কারণ সে নির্মোহ, খুন সে করতেই পারে। ‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’র ইমানের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক আরেক গরিব আছমার সঙ্গে যোগসাজস করে দারোগার জিনিসপত্র চুরি করা। সমাজ এই গল্প গ্রহণ করতে প্রস্তুত। করেছেও। 

গোর্কি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক শিল্পীই রোম্যান্টিক, কিন্তু সক্রিয় রোম্যান্টিক, নিস্ক্রিয় নয়।’ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সক্রিয় রোম্যান্টিকতার মধ্যে বসবাস করে লেখালেখি করেন। তাঁর গল্প পড়ার অন্যতম আকর্ষণই এই সক্রিয়তা। মানুষের আবেগকে তিনি তীব্র ভাবে স্পর্শ করেন, তাই মুগ্ধতা প্রকাশই যথেষ্ট নয়, তাঁর গল্পগুলো এত দাগ কাটে, বার বার পড়তে ইচ্ছে করে।






লেখক পরিচিতি
লীনা দিলরুবা
প্রবন্ধকার। গল্পকার।
ঢাকায় থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ