রোয়ল্ড ডালের বিখ্যাত গল্প দক্ষিণ থেকে আসা লোকটি। গল্পটি চমকে দেয় যেকোনো পাঠককেই। গল্পকার খুব দক্ষতার সঙ্গেই গল্পটিতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন দক্ষ জাদুকরের মতো। শুরু করেছিলেন একটি শান্ত অবকাশের দৃশ্য দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সে আখ্যানটিকে করে তোলেন অশান্ত। শ্বাসরোধী। এবং শেষে আবার শ্বাসফেলার অবকাশও দেন।
গল্পটি নিয়ে সারা পৃথিবীতে অনেক আলোচনা হয়েছে। একনো হচ্ছে। আগামীতেও হবে বলে মনে হয়। গল্পটিকে মনে করা হয় নবীন গল্পকারদের জন্য একটা,টেক্সট।
এই গল্পটি থেকে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ আলোচনা করা হলো--
১. থিম
দক্ষিণ থেকে আসা লোকটি’ গল্পের প্রধান থিম হলো--কুপথে পরিচালনা ও ঝুঁকি নেওয়া। একটি লাইটার প্রতীকের মধ্যে দিয়ে এই গল্পটির থিম গড়ে উঠেছে।
মোদ্দা কথা--
চারিদিকের কাউকেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কারণ তুমি জানো না তার আসল স্বভাব চরিত্রটি কী ধরনের!
কুপথে পরিচালনা
গল্পের বর্ণনাকারী ছাড়া আর কেউই কাউকে আগে থেকে চেনে না। কার স্বভাব কেমন কেউ জানেই না। প্রথম বর্ণনায় খাটো লোকটিকে একজন অতি শান্ত শিষ্ট ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। মনে হয় তিনি সুস্থ মাথার বেশ ধনী ও সুরূচী সম্পন্ন লোক। যখন তিনি বাজীর প্রস্তাবটি করলেন তখন মনে হয় যে, বেশ উদাসীন ও ধনী বলেই সামান্য কিছু আনন্দ পেতে চাইছেন।
কিন্তু বাজীর দান হিসেবে যখন গাড়ি ও আঙুল কাটার প্রস্তাবটি হওয়ার পরে ধীরে ধীরে বোঝা যেতে লাগল অতি ভয়ঙ্কর লোক।
ঝুঁকি নেওয়া
এই গল্পের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়া বিষয়টা গুব গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায় সব চরিত্রই ঝুঁকি নিয়েছে। একজন অপরিচিত নাবিকের সঙ্গে পটে গিয়ে ঝুঁকি নিয়েছে।
শুরুতে খাটো লোকটি যখন গাড়ি বাজী রাখার প্রস্তাবটি করলেন তখন মার্কিনী নাবিক ছেলেটি তাকে প্রত্যাখ্যান আর উপহাস করে বলল যে, সে এতো বোড় সম্পদ বাজী রাখতে রাজী নয়। খুব বেশি ২৫ সেন্ট বা এক ডলার বাজী রাখতে পারে। এই ছেলেকে গাড়ীর আর কড়ে আঙুল কেটে নেওয়ার বাজীতে রাজী করানোর মতো লক্ষ্য নির্ধারণ করে তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন। এমনকি হোটেলের কালো পরিচারিকাটি টাকা নিয়ে খাটো লোকটির জন্য হাতুড়ি, পেরেক, ছুরি জোগাড় করে দিয়ে একটি ঝুঁকি নিয়েছে। কারণ হোটেল কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে তাকে চাকরি হারাতে পারে। সর্বোপরি ছেলেটি গাড়ির লোভে পড়ে আঙুল হারানোর মতো ঝুঁকি নিয়েছে। ও
প্রতীক : লাইটার
গল্পটিতে লাইতারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এটা ঝুঁকি নেওয়া, বিপদ ও পুরুষালী স্বভাবের প্রতীক। ছেলেটি যখন সবাইকে সিগারেট সাধাছিল তখন সে হয়ে উঠেছিল নেতৃস্থানীয় পুরুষত্বের প্রতীক।
গল্পটির প্লট
গল্পটি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা একজন খাটো বুড়ো লোক কার্লোস এবং হোটেলের সুইমিং পুলের কাছের সাক্ষাৎ হওয়া একজন মার্কিন নাবিক ছেলেকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।
১.
বর্ণনাকারী হোটেল থেকে বাইরে বেরনোর পরিকল্পনা করেন। বার থেকে বিয়ার কিনে সুইমিং পুলের পাশে ছাতার নিচে ডেক চেয়ারে বসেন।
পুলে কজন মার্কিন নাবিক ও ইংলিশ মেয়ে হল্লা। করে স্নান করছিল।
দক্ষিণ আমেরিকার একজন খাটো মতো বুড়ো লোক এসে বর্ণনাকারীর পাশে এসে বসেন।
পরে একজন মার্কিন নাবিক ও ইংলিশ মেয়ে সেখানে এলো। নাবিকটি সবাইকে সিগারেট সাধল। বলল, তার লাইটারটা খুব কাজের। কখনোই জ্বলতে ব্যর্থ হয় না। চাকা ঘষা দিলেই জ্বলে।
২.
খাটো লোকটি ছেলেটিকে একটা বাজী ধরার প্রস্তাব করেন। ছেলেটি যদি একবারও ব্যর্থ না হয়ে একটানা দশবার লাইটারটি জ্বালাতে সক্ষম হয় তবে সে তার ক্যাডিলাক গাড়িটি পাবে। আর যদি ছেলেটি একবার জ্বালাতে ব্যর্থ হয় তবে বাঁহাতের কড়ে আঙুলটি তিনি কেটে নেবেন।
ছেলেটি প্রথমে অরাজী হলেও পরে খাটো বুড়োর কথায় প্রলুদ্ধ হয়ে বাজী ধরতে রাজী হলো। তারা হোটেলে খাটো বুড়োর ঘরে গেল।
৪.
বাজীর মাঝামাঝি আরেকজন বয়স্ক মহিলা এসে বাজীটিতে বাদ সাধেন। তিনি জানান, বুড়ো খাটো লোকটি মানসিকভাবে অসুস্থ। এর আগে এই বাজী ধরে তিনি ৪৭ জন লোকের আঙুল কেটে নিয়েছে। গল্পের শেষে গাড়ির চাবিটি নিতে গেলেন মহিলাটি তখন প্রকাশ পেলো তার হাতের চারটি আঙুল কাটা।
গল্পটির সেটিং
১. সময় :
১৯৪৮ সালে রোয়ল্ড ডাল গল্পটি লিখেছেন। গল্পটি স্থান পাত্র ও ঘটনা বিবেচনায় বলা যায় গল্পটি ১৯৪৮ সালের কাছাকাছি সময়ের গল্প।
২. বস্তুগত সেটিং
গল্পটির স্থান জ্যামাইকা নামের দেশ। দেশটির হোটেল , সুইমিং পুল, হোটেলের রুম,। বাজী সংগঠিত হয় সুইমিং পুল এলাকায়। আর বাজীটি বাস্তবায়িত হয় হোটেল রুমে। ঘটনাটি কোন শহরে ঘটেছিল তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। হোটেলেরও নাম বলা হয়নি।
৩. সামাজিক সেটিং
বেশ কয়েকটি সংস্কৃতিগত লোকের অংশগ্রহণ রয়েছে গল্পটিতে। বর্ণনাকারী একজন বৃটিশ। ধারণা করি তিনি লেখক রোয়ল্ড ডাল নিজেই। নাবিকটি মার্কিনী। মেয়েটি ইংলিশ। কালো পরিচালিকাটি জ্যামাইকান। খাটো বুড়ো লোকটি দক্ষিণ আমেরিকান বলে অনুমাণ করা যায়।
বর্ণনাকারী ও দৃষ্টিভঙ্গী
উত্তম পুরুষে গল্পটি বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করা হয়নি।
গল্পের শুরুতেই উত্তম পুরুষে বলা হচ্ছে--
‘প্রায় সাতটা বেজে গেছে। তাই একটা বিয়ার কিনে বাইরে যাব ভাবছি। তারপর সুইমিং পুলের পাশে একটা ডেক চেয়ার নিয়ে বসব। কিছু সময়ের জন্য বিকেলের সূর্য দেখতে পাব।’
বর্ণনাকারী নিজেকে ‘আমি’ হিসেবে উল্লেখ করায় বোঝা যায় তিনি এই গল্পটিতে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি গল্পটির অন্যতম একটি চরিত্র। তবে তিনি গল্পটির ঘটনাপ্রবাহে কোনো ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করেননি। শুধু ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর সেগুলো পাঠকের কাছে বলেছেন। নিরাসক্তভাবে যা ঘটছে তাই বলছেন--
‘সেখানে দুই সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর চেঁচিয়ে "কার্লোস! কার্লোস" বলতে বলতে ছুটে এলেন। তিনি তার কবজি থাবা দিয়ে ধরলেন। তার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে বিছানার উপর ছুড়ে ফেললেন। তার সাদা স্যুটের কলার টেনে ধরলেন। তারপর খুব জোরে জোরে তাকে ঝাঁকাতে লাগলেন। তার দিকে দ্রুত লয়ে আর গলা উঁচিয়ে কথা বলতে লাগলেন। স্প্যানিশ জাতীয় ভাষায় তিনি প্রচণ্ডভাবে বাক্য ছোটালেন পুরো সময় জুড়ে। এতো জোরে জোরে তিনি ঝাঁকালেন যে তাকে আর দেখতে পারা গেল না। তিনি ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলেন। অস্পষ্ট আর ঘুরন্ত চাকার স্পোকের মতো দ্রুত নড়াচড়া করা একটা রেখা চিহ্ন হয়ে গেলেন।’
তবে তিনি সর্বজ্ঞ নন। চরিত্রগুলোকে আগে থেকে তিনি চেনেন না। তাদের কারো সম্পর্কেই তার কোনো ধারণা নেই। ধারণাও পোষণ করেন না। তবে খাটো বুড়ো লোকটির ব্যাপারে তার কিছুটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করেছে। তিনি তার তৎপরতায় একবার নিজে নিজেকে বলেছেন, --
‘আমাকে অবশ্যই বলতে হচ্ছে যে, লোকটির ভাবসাব মোটেই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তিনি এর বাইরে কিছু একটা করতে চাইছেন। ছেলেটিকে বিব্রত করছেন। একই সঙ্গে তিনি তার কোনো ব্যক্তিগত গোপন ধান্ধাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন বলেও আমার কেনো জানি সন্দেহ হচ্ছে।’
সংলাপ
সংলাপ এবং আখ্যান বর্ণনার ক্ষেত্রে গল্পকার চমৎকার ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। দুটোরই উদ্দেশ্য একটি গল্পকে সফলভাবে উপস্থাপন করা। ছোটো ছোটো ব্যবহার করেছেন বিবরণীর পাশাপাশি। সংলাপ যেন বিবরণের পরিপূরক হয়ে কাজ করেছে। ঘটনাকে থামিয়ে দেয়নি। অর্থবহভাবে আখ্যানকে গতিশীল করেছেন। সংলাপ ও বিবরণীর এই যুথবদ্ধ তৎপরতার জন্যই কখনোই মনে হয় না, আমরা আলাদা করে সংলাপ শুনছি। শুনছি গল্পের চরিত্রকেই। গল্পকারের ভাষ্য নয়।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, গল্পে ছয়টি চরিত্র থাকলেও প্রোটাগনিস্ট-- মার্কিন নাবিক ছেলেটি, এন্টাগনিস্ট খাটো বুড়ো লোকটি এবং মধ্য চরিত্র হিসেবে মহিলাটিই সংলাপ বলেছেন বেশির ভাগ। কিন্তু কথক বা রেফারি ও ইংলিশ মেয়েটি খুব কম কথা বলেছেন। তারা থেকে নউট্রাল চরিত্র হিসেবে। ফলে তাদের ভূমিকা গ্যঊণ বলেই তাদের সংলাপ কম।
সাসপেন্স
গল্পটির শুরুতে ছিল একটি বিকেলের বর্ণনা। হোটেলের সুইমিংপুলের স্নানরত ছেলেমেয়েদের উল্লাস আর ডেক চেয়ারে বসা কয়েকজন মানুষের সন্ধ্যাবিলাসের পরিমিত বিবরণ। খুব সাদামাটা গল্পের মধ্যে নেই কোনো উত্তেজনা। আছে জ্যামাইকার নারিকেল গাছের উপর থেকে বয়ে আসা জোরালো বাতাস আর বিকেলের নরম আলোর স্নিগ্ধতা।
কিন্তু গল্পকার রোয়ল্ড ডাল একটি লাইটারকে কেন্দ্র করে পুরো শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশকে সুকৌশলে ভেঙ্গে দিয়ে করেছেন অশান্ত। পরতে পরতে দাবার পুরে দিয়েছেন টেনশন, সাসপেন্স আর পাঠককে নিয়ে গিয়েছেন চূড়ান্ত উত্তেজনা বা ক্লাইমেক্সে।
সাসপেন্সের স্তরগুলোর লিস্ট--
১.. বাজীর প্রস্তাব

৩. বাজীর দান হিসেবে ক্যাডিলাক গাড়ি

৪. কড়ে আঙুল কাটার প্রস্তাব

৫. ছেলেটির অরাজী হওয়া

৬.শেষে রাজী হওয়া

৭. হোটেলের রুমে গিয়ে বাজীর জন্য প্রস্তুতি--

পেরেক, হাতুড়ি, দড়ি,আনা

৮. সেগুলো দিয়ে ছেলেটির ডান হাত বেঁধে ফেলা

৯. ছুরি উঁচু করে খাটো লোকটির দাঁড়িয়ে থাকা

১০. অষ্টমবারে লাইটার গিয়ে ছেলেটির দ্বিধায় পড়া এবং মনে হয় যেন ছেলেটি সত্যি সত্যি পারবে না। এখানে এসে ক্লাইমেক্স।
--------------------------------------------------------------------------------------------------
উত্তেজনা শুরু হয় হাওয়া থেকে। ছেলেটির কাছে খাটো বুড়ো লোকটি সিগার ধরানোর জন্য লাইটার চান। ছেলেটি লাইটার জ্বালিয়ে দিতে চাইলে তিনি বলেন, এই জোরালো হাওয়ায় লাইটারটি জ্বলবে না। নিভে যাবে। কিন্তু ছেলেটি গর্বের সঙ্গে দাবী করে তার লাইটারটি বিশেষ ধরনের। জোরালো হাওয়ার মধ্যেও জ্বলবে। কখনোই মিস ফায়ার হবে না।
এই বিষয়টা দুই লাইনেই শেষ করা যেতো। যেমন,--
সিগার ধরাবার লাইটারটা দেওয়ার সময় ছেলেটা বলল, এটা কখনোই মিসফায়ার হয় না। শুনে খাটো লোকটি প্রস্তাব করলেন তুমি যদি একটানা
সামান্য সামান্য বর্ণনা আর পারস্পরিক সংলাপের মধ্যে দিয়ে গল্পকার তারিয়ে তারিয়ে গড়ে তুলছেন।"
----কুমিরের চামড়া দিয়ে বানানো কেস থেকে তিনি নিজের জন্য একটি সিগার বের করলেন। আর একটি ছোটো ছুরিও বের করলেন। সেটা দিয়ে সিগারের গোড়া ছাঁচলেন।
"এই যে, তোমাকে আমার লাইটারটা দিতে দাও।" মার্কিন ছেলেটি তার লাইটারটি বাড়িয়ে দিল।
"ওটা এই বাতাসে জ্বলবে না।"
"নিশ্চয়ই ওটা জ্বলবে। ওটা সব সময়েই কাজ করে।"
খাটো মানুষটি মুখ থেকে না ধরানো সিগারটি বের করে আনলেন। মাথাটি একটু তুলে ছেলেটির দিকে তাকালেন।
"সব সময়?" তিনি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন।
"নিশ্চয়, এটা কখনোই জ্বলতে ব্যর্থ হয় না। আমার কাছে কখনোই নয়।"
খাটো মানুষটি মাথাটি তখনো এক দিকে কাত করে রেখেছেন। তিনি তখনো ছেলেটিকে নজর করে দেখছেন। "ভালো। ভালো। তুমি বলছ যে এই বিখ্যাত লাইটারটা কখনোই জ্বলতে ব্যর্থ হয় না। তুমি কি এটাই বলছ?"
"নিশ্চয়ই। " ছেলেটি জবাব দিল। "ঠিক বলেছ।" উনিশ কুড়ি বছর বয়স হবে ছেলেটির। তার লম্বাটে মুখ। রোদে পুড়ে হাল্কা বাদামী দাগ হয়েছে। পাখির মতো চোখা তার নাক। তার বুক অবশ্য খুব বেশি রোদে পোড়া নয়। সেখানেও বাদামী দাগ পড়েছে। তার চুলগুলো সামান্য লাল। ডান হাতে তার লাইটারটি ধরে রেখেছে। তার চাকা ঘষা দেবে দেবে করছে। "আমি কখনোই ব্যর্থ হইনি।" সে বলল হাসতে হাসতে। একটু গর্ব করে বলল। " আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি-- এটা জ্বালতে ব্যর্থ হবো না।"
"এক মিনিট প্লিজ।" ট্রাফিক পুলিশের হাত যেরকম করে গাড়ি থামায় ঠিক সেরকম করে সিগার ধরা হাতটি উঁচু করলেন তিনি। "এখন এক মুহুর্ত মাত্র।" তার গলাটি ছিল কৌতুহলপূর্ণ নরম, তবে চড়া নয়। পুরোটা সময়েই তিনি ছেলেটির দিকে চোখ পেতে রেখেছেন।
"আমরা কি এটার উপরে একটা ছোটো খাটো বাজী ধরব নাকি?" তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। " তোমার লাইটারটি জ্বলে কিনা সেটা নিয়ে একটি ছোটোখাটো বাজী ধরব?"
"অবশ্যই। বাজী ধরব আমি।" ছেলেটি বলল, "কেন ধরব না?"
"তুমি কি বাজী ধরতে পছন্দ করছ?"
"নিশ্চয়ই, আমি সব সময়েই বাজী ধরি।"
এই পর্যন্ত বাজীর প্রস্তাব হলো বটে। কিন্তু টেনশন সৃষ্টি হয়নি। খাটো বুড়ো লোকটা সাধারণ কথাবার্তার চালিয়ে গেলেন। এর মধ্যে থেকে ছেলেটিই বাজীর ক্লু তৈরি করে দিল। বলল, তার লাইটার সব সময়েই জ্বলে। মিস হয় না। এই কথাকে কেন্দ্র করেই তিনি তার বাজীর চালটা পাড়লেন। নিজের ঘাড়ে বাজীর দায় নিলেন না। যেন ছেলেটি ওটা না বললে তিনি বাজীর চিন্তা করতেই পারতেন না। গল্পকার ধীরে ধীরে কিছু এ্যাকশন আর সংলাপের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বাজীর প্রস্তাবনা এনে গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। কোনো তাড়াহুড়া করলেন না।
এরপরে --ছেলেটি রাজী হলো ছোটো একটা বাজীর প্রস্তাবে। কিন্তু খাটো লোকটি বাজীটিকে বড়ো করতে চাইলেন। তিনি বাজী ধরলের তার দামী ক্যাডিলাক গাড়ি।
এটা ছেলেটি বিশ্বাস করতে পারছে না। হাস্যকর মনে করছে। বলছে, লাইটারেত জ্বলানেভার বাজীতে ২৫ সেন্ট কি ১ ডলার ধরা যেতে পারে। গাড়ি কী করে হয়?
আর লোকটি তখন ছেলেটিকে তার একটু আগে জাগ্রত পুরুষালী মেজাজকে খোটা দিয়ে বললেন, সে ভয় পেয়েছে।
আবার তার জাতকেও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলল, মার্কিনীরা এরকমই। তারা বাজীতে ভয় পায়।
ফলে ছেলেটি রাজীই হয়ে গেল। আর তখনি টেনশনের পর্দা চড়তে লাগল। সাসপেন্স শুরু হল। শুরুতে যে শান্ত স্নিগ্ধ বিকেলের পরিস্থিতিটা হয়ে উঠল মহা উত্তেজনাকর।
দ্বন্দ্ব
এখানে দুটি দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
১. নাবিক ছেলেটি বনাম খাটো বুড়ো লোক কার্লোস।
‘এরপর স্তব্ধতা নেমে এলো। আর আমি দেখতে পারলাম, খাটো লোকটি তার বিদঘুটে প্রস্তাব দিয়ে ছেলেটিকে যথেষ্ট বিব্রত করতে সফল হয়েছে। সে সেখানে স্থির হয়ে বসে রইল। এটা স্পষ্ট যে তার মধ্যে এক ধরনের সামান্য উত্তেজনার জন্ম হচ্ছে।’
২. খাটো বুড়ো কার্লোস বনাম তার সঙ্গিনী বয়স্ক মহিলা--
“বাজী ধরার মতো তার কিছুই নেই।” মহিলাটি বললেন, “এ জগতে তার কোনো কিছু নেই। এক কানা কড়িও নেই। সত্যি বলতে কি অনেক অনেক আগে আমি তার কাছ থেকে সব কিছু জিতে নিয়েছি। অনেক সময় লেগেছে এতে--অনেক অনেক সময়। এটা বেশ কঠিন কাজ ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি সব কিছু জিতে নিয়েছি।”
টোন
লেখক রোয়ল্ড ডাল আগোগোড়া এক ধরনের রহস্যময় ভাষা ব্যবহার করেছে। ধীরে ধীরে উত্তেজনা সৃষ্টি করে চরম উত্তেজনায় পৌঁছে দিয়েছেন গল্পটিকে।
ট্যুইস্ট বা চমক
ও হেনরির মতো রোয়ল্ড ডালও অসামান্য ট্যুইস্ট শৈলীটি গল্পে ব্যবহার করেন। পাঠক গল্প পড়তে পড়তে গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েন। ঘটনার দ্বন্দ্ব সংঘাতের সঙ্গে এগিয়ে চলেন।
পাঠক গল্পের পরিণতি নিয়ে আগাম কোনো ধারণা করে নিলেও শেষে ভিন্ন কোনো পরিণতি ঘটে। পাঠক লেখকের কাছে পরাজিত হন। এটা তিনি করেন চমকের পর চমক ব্যবহার করে।
চমক১
বাইরে থেকে মহিলার আগমণ। বাজী থামিয়ে বলেন, কার্লোস মানসিকভাবে অসুস্থ।
অথচ পাঠক কার্লোসের আচরণে সুস্থই মনে করেছে। সুচারুভাবে বাজীর প্রস্তাব করেছেন। নাবিক ছেলেটি গাড়ির প্রলোভন দিয়ে রাজী করিয়েছেন। মারটিনি মদ প্রস্তুত করে সার্ভ করেছেন। কালো পরিচারিকাকে ঘুষ দিয়ে হাতুড়, পেরেক, মাংস কাটা ছুরি আনিয়েছেন। টেবিলে পেরেক পুতেছেন। দড়ি দিয়ে বাঁহাত বেঁধেছেন। এবং ছুরি উচিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
চমক২
লোকটির কোনো সহায় সম্পদ নেই। যে গাড়িটা বাজী ধরেছিল সেটাও তার নয়। মহিলার নিজের।
এখানে খাটো লোকটির স্যুট, সিগার, ক্যাডিলাক গাড়ি, হোটেলের দামী ঘর দেখিয়ে বলেছেন তিনি খুব ধনী। পাঠকও সেটা বিশ্বাস করেছে।
শেষে জানা গেল তিনি নিঃশ্ব।
চমক৩
লোকটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে হয়তো আঙুল কাটার মতো বাজী এই প্রথম ধরে থাকবেন বলে মনে হয়।
কিন্তু মহিলাটি জানালেন-- এর তিনি সাত চল্লিশজন লোকের আঙুল কেটেছেন বাজী জিতে। ২১টি গাড়ি হেরেছেন। তার সবই খুইয়েছেন। এখন নিঃশ্ব।
চমক ৪.
মহিলাটিকে ভালো মনের সঙ্গিনী মনে হয়। কিন্তু তিনি লোকটি সঙ্গে বহুবার বাজী ধরে ধরে তার সহায় সম্পত্তি জিতেছেন। তাকে নিঃশ্ব করে দিয়েছেন। তবুও তার সঙ্গে থাকছেন তার এই ভয়ঙ্কর বাজী খেলাকে নস্যাৎ করার জন্য। তাকে চোখে চোখে রাখছেন। অথচ তার মতো মানসিকভাবে অসুস্থ ভয়ংকর লোকের সঙ্গ পরিত্যাগ করারই তো স্বাভাবিক।
চমক ৫
মহিলাটি যতক্ষণ কথা বলছিলেন ততক্ষণ তাকে স্বাভাবিক মনে হয়েছে। গল্পের শেষাংশে দেখা গেল তারও বাঁহাতের আঙুল কাটা। একটি নয়-- চারটি আঙুল কাটা। বাজীতে চারবার হেরেছেন।
গল্পটিতে যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিলেন গল্পকার, যে লাইটারটি সাচ্ছন্দ্য জ্বালত এবং জ্বালাতো পারত ছেলেটি-- তার হাত বেঁধে আর আঙুলের উপরে ধারালো ছুরি উচিয়ে রেখে লোকটি ছেলেটির নার্ভের উপর মারাত্মক চাপের সৃষ্টি করেছিলেন-- ছেলেটির সহজ জয়কেও করে তুলেছিলেন কঠিন-- এই উত্তেজনাটি যখন চুড়ান্ত শ্বাসরোধী ক্লাইমেক্সে পৌঁছে যায়, মহিলাটি এসে লোকটিকে ঠেলে নিবৃত করে, বাজীকে পণ্ড করে দেয়-- তখন পাঠক হিসেবে আমাদের শ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেন গল্পকার। মনে হয়, আর সব ঝানেলা চুকে গেল। আমরা শান্ত চিত্তে ফেরার কথা ভাবি ঠিক তখনি মহিলাটি একের পর এক চমক দিয়ে আমাদেরকে অচিন্তনীয় পর্বে নিয়ে যান। এবং আমরা শিউরে উঠতে বাধ্য হই এই উন্মাদ লোকটি শিকার হয়েছিলেন এই মহিলাও। একবার নয়-- বহুবার।
মূল গল্পের অনুবাদের লিংক
ক্লিক করুন
ক্লিক করুন
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভাল আলোচনা।
উত্তরমুছুন