দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ে'র গল্প: কমেডিয়ান

সাদেক খুড়োকে দেখলেই আমরা কৌতুক শুনতে চাইতাম।

বাজারের মাঝখানে, চায়ের দোকানে কিংবা গ্রিনরুমে; সাক্ষাতের পর প্রথম কথাই ছিলো,

‘একটা কৌতুক শুনাও, খুড়ো।’

খুড়োর কৌতুকের ভান্ডারও ছিলো অসীম। যে কোনো জায়গায় বসে দুই চারটে কৌতুক শুনিয়ে দিতে পারতো।


সাদেক খুড়ো ছিলো একাধারে কমেডিয়ান আর মেকআপ ম্যান।

শীতকালে খুড়োর বিরাট একটা ডিমান্ড ছিলো। পাড়ায় পাড়ায় যাত্রা হতো। সেখানে মেকআপ করার জন্য তাকে লাগতোই। এ ছাড়া প্রায় সব পালায় কমেডিয়ান হিসেবে তার একটা রোল বাধা ছিলো। কোনো কোনো পালায় এমন রোল না থাকলে আয়োজকরা বানিয়েও দিতো।

তবে যাত্রাটা সাদেক খুড়োর পেশা ছিলো না। পেশায় সে ছিলো একজন দালাল। না, গরু-ঘোড়া কিংবা জমির দালাল না। সে ভারতে লোক আনা নেয়া করতো।

আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমাদের এলাকার লোকেরা পাসপোর্ট বানিয়ে, ভিসা লাগিয়ে ভারতে যেতো না। সেটা একটা হাঙ্গামার ব্যাপার ছিলো। তার চেয়ে অনেক সোজা ছিলো সাদেক খুড়োকে পাঁচ শ টাকা দেওয়া। ওই পাঁচ শ টাকার মধ্যে যাওয়ার খরচ, পথে দুই বেলা খাওয়া এবং বর্ডারে রাত কাটানোর বন্দোবস্ত করে ফেলতো সে। ফলে এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় দালাল ছিলো সাদেক খুড়ো।

খুড়োর সাথে ইন্ডিয়া যাওয়াটা একটা অ্যাডভেঞ্চার গল্পের মতো ব্যাপার ছিলো।

প্রথমে লোকাল বাসে করে বেনাপোল পর্যন্ত যেতে হতো। তারপর খুড়ো বর্ডারে এক বাড়িতে নিয়ে রাখতো তার লোকজন। রাত হলে সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে টর্চের আলোয় নিশব্দে বাগান ধরে হাটতে হতো। এই হাটতে হাটতেই কখন সীমানা পার হয়ে যেতো লোকগুলো। ভোর হলে বনগা রেল স্টেশনে পৌছে যেতো খুড়োর লোকজন। সেখান থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদহ পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া ছিলো খুড়োর কাজ।

এই বর্ননাটা যত সহজ শুনলেন, ব্যাপারটা অতো সোজা না। এর মধ্যে বিএসএফের তাড়া, রাতে পথ হারিয়ে ফেলা কিংবা নালায় পড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো যোগ করে নিতে হবে।

আমি কখনো সাদেক খুড়োর সাথে ইন্ডিয়া যাইনি। তবে ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে পথ এমন মুখস্থ হয়েছে যে, বর্ডারে কেউ কিছু না বললে আমি হয়তো চলেও যেতে পারবো।

ইন্ডিয়া না গেলে কী হবে, সাদেক খুড়োর সাথে আমার খাতিরটা ছিলো অন্য লেভেলের।

বাবা-জ্যাঠার সাথে পালা করেছে সে। এখন আমাদের সাথেও করছে। বাবা-জ্যাঠার মেক আপ করেছে। এখন আমাদেরও করছে। ফলে আমাদের ওপর তার একটা কতৃর্ত্ব ছিলো। আমাকে মেক আপ করাতে করাতে বলতো,

‘তুই এতো মোটা হচ্ছিস কেনো, বাবা?’

‘তুমি একটা কৌতুক শুনাও। ওজন কমে যাবে হাসতে হাসতে।’

‘মজা করিস না। কৌতুক পরে শুনাবো। আগে ওজন কমা।’

‘চেষ্টা তো করি কাবু হওয়ার। হতে পারি না, খুড়ো।’

‘হাঁট, হাঁট। আর ভাত খাবি কম। আমি রোজ ৭-৮ মাইল হাঁটি।’

সে খুড়োর শরীর দেখলেই বোঝা যায়। টিনটিনে লম্বা শরীর; মাথায় চুল বলে এখন আর প্রায় কিছু নেই। অথচ কাকা গল্প করেন, একসময় নাকি ঝাকড়া চুল ছিলো। সময়টা খুড়োর চলে গেলেও অভিনয়টা যায়নি। এখনও মঞ্চে উঠে দিব্যি কৌতুক বলে বলে লোক হাসাতে পারে।

সাধারণত ভাঁড়ের চরিত্র করে। কিচ্ছু না। হঠাৎ কোনো একটা ক্যারেক্টারের সাথে মঞ্চে উঠতো। উঠে একটা দুটো কৌতুক বলতো। আজকের দিনের স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানের মতো ব্যাপার আর কী।

আবার কখনো কখনো সাদেক খুড়োর একটা জুড়িদার থাকতো। তার সাথে মঞ্চে উঠে কিছু সার্কাস্টিক ব্যাপার স্যাপার করতো।

খুড়ো আর তার জুড়িদার মঞ্চে উঠলো। দু জনই কিছু বিকট অঙ্গভঙ্গি করে লোক হাসালো। খুড়োকে তার সঙ্গী বললো,

‘পচা?’

‘কীইই...?’

‘জীবনে কখনো বৌয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করেছিস?’

পচা হেসে বললো,

‘আমার তো বৌই নেই। ধার করবো কেমন করে?’

‘ও আচ্ছা। শোন, প্রথম কথা হলো, বিয়ে করবি না। আর বিয়ে করলেও বৌয়ের কাছ থেকে ধার করবি না।’

‘কেনো বলো তো।’

‘আমি একবার বৌয়ের কাছ থেকে এক শ টাকা ধার করেছিলাম। সাত বার ফেরত দিয়েছি। এখনও ধার শোধ হয়নি।’

পুরোনো সব বস্তা পচা কৌতুক আর কী। এই করেই লোকেদের হাসাতো।

তবে একবার বিবেক করেছিলো।

আগে প্রায় সব যাত্রায় একটা বিবেক চরিত্র থাকতো। পুরো যাত্রার কাহিনীর সাথে এই লোকের কোনো সম্পর্ক থাকতো না। ক্রাইসিসের পর সে মঞ্চে উঠে কোনো একটা দুঃখের গান করে চলে যেতো। ‘একটি পয়সা’ নামে এক যাত্রায় ছিলো লম্বা একটা বিবেকের রোল। সেই বিবেকের শুধু গান না, কিছু ডায়লগও ছিলো।

সেই পালায় ‘একটি পয়সা দাও গো বাবু’ গান গেয়ে খুব সাড়া ফেলে দিয়েছিলো খুড়ো; হিন্দি গানের সুরে গান আর কী!

অনেক বছর হয় সাদেক খুড়োর দেখা নেই।

ইদানিং যাত্রা আর হয় না বললেই চলে। হলেও সেখানে মেকআপ ম্যান আসে শহর থেকে। লোকেরা এখন পাসপোর্ট-ভিসা শিখে গেছে। ফলে সাদেক খুড়োর আর খুব একটা খোঁজই পড়ে না।

এবার যখন আমরা অনেক কাল পর যাত্রা করতে চাইলাম, তখন আড্ডাতে খুড়োর নাম উঠে এলো। কে একজন রসিকতা করে বললো,

‘একটা কমেডিয়ান রাখা দরকার। মাঝে মাঝে উঠে একটু লোক হাসাবে।’

আমার মনে পড়ে গেলো, সাদেক খুড়োর কথা,

‘আমাগো সেই সাদেক খুড়ো কী বেঁচে আছে? তাহলে তারেই একবার নিয়ে আসলে হয়।’

সবাই দেখা গেলো মজাচ্ছলে শুরু হওয়া কথাটাকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। সবাই বললো, তাহলে সাদেক খুড়োকে খুঁজে বের করা যাক।

কিন্তু খুড়োকে পাওয়া যাবে কোথায়?

সাদেক খুড়োকে সবসময় ম্যানেজ করতো আশিষ। সে এখন ঢাকায় থাকে। ফলে তাকে ফোন করা হলো। আশিষ জানালো, খুড়োর বাড়ি মসনি স্কুলের পাশে। ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।

অভিযান শুরু করলাম আমি আর কাদের বাবু।

আমার মোটর সাইকেলে করে মসনি চললাম। স্কুলের আশেপাশে যাকেই জিজ্ঞেস করি, কেউ সাদেক খুড়োর বাড়ির সন্ধান দিতে পারে না। একটা অল্প বয়সী ছেলেকে দাঁড় করালাম,

‘ভাই, সাদেক খুড়োর বাড়ি কোনটা জানেন?’

‘সাদেক খুড়ো কেডা?’

‘যাত্রা অভিনয় করতো। মেকআপ করতো।’

‘যাত্রার কথা আমি জানি না।’

পাশ থেকে একটু বয়সী একটা লোক আমাদের ডাক দিলো,

‘আপনেরা সাদেক দালালরে খোঁজেন?’

তখন মনে পড়ে গেলো খুড়োর আসল পরিচয়টা। আমি লাফ দিয়ে বললাম,

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সাদেক দালাল।’

‘তার বাড়ি তো এই পাশেই। কিন্তু সে কী এখন আর কাজ পারবে?’

‘কেনো? কি হইছে?’

‘শরীর খারাপ। সংসারের অবস্থা আরও খারাপ।’

সংসারের অবস্থা যে খারাপ, সেটা উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই বুঝলাম।

একটা একচালা টিনের ঘর। টিনগুলো খসে খসে পড়ছে। ঘরের বেড়া বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গেছে; কোনোক্রমে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা। মাটির দাওয়া; তাদের একটু লেপাপোছা হয় না তাও মনে হয় অনেককাল হয়ে গেছে। বাড়ির মধ্যে কোনো জনপ্রাণীর ছায়া নেই। তাহলে কী খুড়ো বাড়িতে নেই?

তারপরও ডাক দিলাম,

‘সাদেক খুড়ো আছ?’

কেউ সাড়া দিলো না। আরেকটু জোরে হাঁক দিলাম,

‘ও খুড়ো।’

এবার ভেতর থেকে একটা নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

‘কেডা?’

‘আমরা শ্রীরামপুর থেকে আইছি। সাদেক খুড়োরে খুঁজি।’

এবার ভাঙা দরজাটা সতর্কভাবে সরিয়ে এক মহিলা বের হয়ে এলো। পরনে একটা ময়লা বাসী কাপড়। দেখেই বোঝা যায়, দারিদ্রের শেষ সীমায় বাস করছে এরা। মহিলা এসে বললেন,

‘বাবা তো উঠতে পারে না। আপনেরা কথা বলবেন?’

উঠতে পারে না, শুনে অনেকটাই কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে গিয়েছিলো। তারপরও একেবারে উঠোনে এসে কথা না বলে গেলে কেমন হয়। তাই চললাম ভেতরে।

প্রস্রাব আর কেরোসিনের একটা মেশানো গন্ধে বমি ঠেলে আসতে চাইলো। একটা বাঁশের মাচার ওপর কয়েকটা কাঁথা পেচানো অবস্থায় পড়ে আছে সাদেক খুড়ো। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম,

‘খুড়ো, চিনতে পারো?’

‘হ। আমাগো ফটিকদার ভাইপো-দেবা। বয়।’

বলে এবার ভেতরের দিকে মুখ করে বললো,

‘ওগো দুটো টুল দেও।’

‘থাইক। টুল লাগবে না। তুমি আছ কেমন?’

মুখটা ফেরালো খুড়ো,

‘আল্লাহ নেয় না। তাই পড়ে আছি।’

সবাই একটু চুপ করে রইলাম। খুড়োই মুখ খুললো,

‘আইছিলি কেনো? যাত্রা করবি?’

‘হ। তোমার সংসার চলে কেমন করে?’

‘ওই পুতের বৌটা মাইনষের বাড়ি কাজ করে।’

‘তোমার ছলডার কী হইছে? সে কাজ কাম করে না?’

খুড়ো ওই অবস্থায় একটু ডুকরে উঠলো,

‘সে তো আইজ দুই বছর আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরছে।’

এখন চাইলে আমরা সেই গলায় দড়ির গল্প শুনতে পারি। কিন্তু এই ভয়াবহ দুর্গন্ধের মধ্যে বসে এই গরীবি গল্প শুনতে আর ভালো লাগছে না। এখন উঠতে পারলেই বাঁচি।

আমি খুড়োকে বললাম,

‘তাহলে আমরা উঠি, খুড়ো।’

খুড়ো একটু হেসে বললো,

‘একটা কৌতুক শুনবি?’

‘এই অবস্থায় কৌতুক?’

‘হ। আজকাল লোকেরা তো কৌতুক বলেও টাকা পায়। তুই কৌতুক শুনে আমারে বিশটা টাকা দিস।’

আমি চুপ মেরে রইলাম। তারপর বললাম,

‘কৌতুক বলা লাগবে না। আমি তোমারে টাকা দিচ্ছি।’

‘নাহ। ফাও টাকা নেবো না।’

কৌতুক শুনে টাকা দিয়ে বের হচ্ছিলাম। এবার মনে হয় মুক্তি মিললো। তখন পেছন থেকে খুড়ো ডাকলো,

‘ছেলেটা কেনো মরলো, জানিস?’

‘কেনো?’

‘ওরে ওর বন্ধুরা দালালের পোলা বলতো, তাই।’

‘কও কী!’

‘হ। আমি কতো বোঝালাম। কতো বললাম যে, আমি দালাল না, আমি কমেডিয়ান। কিন্তু পোলাডা বুঝলোই না। তোরা বল, আমি কমেডিয়ান না?’
লেখক পরিচিতি:
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
গল্পকার।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ