"তুই বিন্দা দাসের ঘর নু তার বউকে তুলিয়া লেইলু… পিরীত"
"তাকে আবার হাসপাতাল নু ঘর ছাড়তে গেলু… পিরীত"
"গোবিন্দর সাথে শাট হয়্যা আমাকে লাইন ছাড়লুনি… পিরীত"
"আমার টোটোর পিছনে পিছনে হাঁক দউঠু… এটা কার সাথে পিরীত রে কামাল! সব পিরীত শেষ! শেষ।"
তুই মোর সাথে এমনটা করতে পারলু!
অবিরাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থামার পর থেকে মোসলেম অনর্গল বকে যায়। এটা তার রাগ নয়। কামাল তার বন্ধুরই মত। একসাথে এতদিন বাসস্ট্যান্ড থেকে খেয়াঘাট অব্দি টোটো চালিয়ে এসেছে। টোটো চালানোর আগে থেকে তারা দুজন দুজনে কথা চালাত। কিন্তু আজ যা হয়ে গেছে, তার পর থেকে কামালের মুখ দেখতে চায় না সে।
--কী লাভ হইল তোর!
যেন কত কত বছরের এক দলা কফ গলার কাছে এসে স্বর ধরিয়ে দিয়েছে। পুরু কাচের চশমার ভেতর মোসলেমের ঘোলাটে চোখগুলো অস্বাভাবিক বড় দেখায়। রাগ আর বিস্ময়ে তার চোখ এখন চশমার ভেতর ভরে গেছে।
নিজের টোটোর ভেতর বসে বসে যে কথাগুলো মোসলেম শুরু করেছিল, সেই কথায় তার আজকের সারাদিনের ক্ষতির খতিয়ান আছে। কামাল আর সে দুজনেই একই রুটে টোটো চালায়। বাসস্ট্যান্ড থেকে খেয়া ঘাট। ঘাটে গিয়ে খেয়া ধরায়। খেয়া ধরে।
দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বিকেলের বাজারটা। এরকম দিন আগেও গেছে, যেদিন মোসলেম বা কামালকে কয়েকটা মাত্র টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু আজ তো তা নয়, আজ কামাল ধোঁকা দিয়ে দাঁও মেরেছে। যে কামাল তার কাছের জন!
অভিমান হচ্ছে মোসলেমের। আজকের সারাদিনের উপার্জনে কেউ কাঁটা চুবিয়ে গেছে ভেবে তার সারা শরীর রাগে গরগর করে। কামাল ঠায় বসে আছে তারই পাশে তার নিজের টোটোতে। আজ আর কোনো যাত্রী আসবে না। বিকেলের বৃষ্টিতে বাজারে যেন মড়ক লেগে গেছে। দুপুর অব্দি যা হয়েছে হয়েছে, এবার ঘরে ফেরার পালা।
বিন্দা দাসের বউকে তোলার কথা ছিল মোসলেমের। ওই দিকের পাড়াতে ওইই ভাড়া খাটে।
তারপর স্ট্যান্ড থেকে বেরোনোর সময় কামাল টোটোটা গড়াতে গড়াতে একটু সময় খায়। পরের টোটো মোসলেমের। তখন যাত্রী ছিল বলে কিছু বলেনি মোসলেম। কিন্তু এখন ওই ব্যাপারটাকেও সে কামালের চক্রান্ত বলেই মনে করে।
এখন কামাল মোসলেমকে কিছুই বলবে না। বন্ধু হয়। বন্ধুর ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু কামালও নিরুপায়। আজ কারোরই বাজার তেমন ভালো যায়নি। এখন কিছু না বলে মোসলেমকে সে কাল সকালে একটু জড়িয়ে ধরবে। বুঝিয়ে বলবে। এখন একটা কথাও সে বলবে না। একটাও উত্তর করবে না। সে মোসলেমকে খুব চেনে। নিজের ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে মোসলেমকে কত শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে! সেদিন অনেক দোকান ঘুরে ঘুরে ঘরের গাছের সুপারিগুলো বিক্রি করেছে মোসলেম। কামাল তার সঙ্গেই ছিল। স্কুল মাস্টার অসিত জানার সেই ভাইটা যেদিন তড়িঘড়ি খেয়া ধরতে গিয়ে কে, সি, পালের ছাতাটা ফেলে গিয়েছিল মোসলেমের টোটোতে, ফেরত দেয়নি মোসলেম। কামালকে কানে কানে বলে সেটা সরিয়ে রেখে দিয়েছিল। মোসলেম ভালো মানুষ, কামাল জানে।
এইতো অবস্থা! নাই নাই করে প্রায় খান দশেক টোটো চলে ওই রুটেই। খেয়ার নৌকা অতখানি মানুষ উগরায় না বা গেলে না, যত মানুষ ভাগ ভাগ হয়ে এক টোটো থেকে অন্য টোটোতে মিশে যায়। দিনের শেষে তবুও যা হত বা হয়, তা সময়কে বোকা বানিয়েই। স্ট্যান্ড থেকে ধীর গতিতে গড়াতে গড়াতে সবাই সময় খায়। আগের টোটো থেকে নিজের দূরত্ব তৈরি করে। দৈবাৎ একটা আধটা যাত্রী জুটে যেতে পারে ভেবে। লাইনে চলা ছাড়া এক একটা পাড়ায় এক একজনের খাতির আছে। লাইন ছেড়ে কখনও একটা ফাটকা ভাড়ায় নিজেদের দিন পুষিয়ে নিতে পারে তারা।
কাছের একজন এমন করে ফাঁকি দিয়ে গেল তাকে! মোসলেমকে এখন রাগ অভিমান আর হিংসা পালা করে নাড়ায়। ভেতরে ভেতরে। বাইরে থেকে তাকে অস্পষ্ট দেখায়। এমনিতে রোগা পাতলা চেহারা নিয়ে সে সেইই বিকেল থেকে টোটোর ভেতর সেঁধিয়ে আছে। তার উপর স্ট্যান্ডের আলো পড়ে ভিজে রাস্তাকে এত চকচকে করেছে যে কোনো মানুষকেই স্পষ্ট দেখা যায় না।
পকেটের দিকে তাকায় মোসলেম। কয়েকটা দশ টাকা আর কুড়ি টাকার নেতিয়ে যাওয়া নোটে একশ টাকার একটু উপরে অায় হয়েছে। এর মধ্যে থেকে আবার ইউনিয়নকে কুড়ি টাকা দিতে হবে। মাথাটা হঠাৎ করেই কত ভারী লাগে মোসলেমের। মাত্র এই ক'টা টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে বলে, না আরো অনেক কিছু ভেবে!
--দেখ্, আমি ত কুনোদিন তোর পিছনে লাগিনি।
--এটা আসিফ করলে তবুও ভাবতি…
কামাল এই প্রথম একটা কিছু বলতে যায়। হয়তো সহানুভূতিই। মাথা ঠাণ্ডা করতে বলে মোসলেমকে। শুরুর শব্দটাও শুরু হয়নি, তার আগেই মোসলেম গলা বার করে তেড়ে যায়,
--তুই একটাও কথা কইবুনি… শালা চামার। বিন্দা দাসের বৌ কি তোর পিরীতের নাঙ হয়?
পাগলের মত লাগে মোসলেমকে।
কামাল এবার একটু ফোঁস না করে থাকতে পারে না। তার ব্যবসা আর লাইনের উপর তার সংসার চলে যে!
স্ট্যান্ডের উজ্জ্বল আলোর তলায় দু' চারটা থেকে দশ বারোটা লোক জমা হয়। তারা একে অন্যকে ঈশারা করে। অনেক উঁচু থেকে আলো পড়ছিল বলে তাদের মুখ আর চোখ স্পষ্ট নয়। এমন দৃশ্য দেখার জন্য এমন আলোই উপযুক্ত। তারই মধ্যে দু' একজন তাদের থামতে বলে। কামাল - মোসলেম থামেনি।
এরই মধ্যে আবার বৃষ্টি এল গুমরে থাকা রাগের মত করে। যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে 'বিন্দা দাসের বৌ' আর 'পিরীতের নাঙ' জাতীয় শব্দগুলোর মধ্যে থেকে গড়িয়ে পড়া রস মাখছিল, তারা ভিজে যাওয়ার ভয়ে আলগা আলগা হয়ে গেল। স্ট্যান্ডে আলো আরো আবছায়া হয়ে এল। এমন আলোতেই বেরিয়ে এল কয়েকটা লোম ওঠা কুকুর। হঠাৎ দেখলে যাদের খুব সুন্দর মনে হয়। স্ট্যান্ড ছেড়ে গেল না কেবল কামাল আর মোসলেম। এমনিতে টোটোওয়ালারা থাকে রাত প্রায় দশটা অব্দি। কিন্তু আজ সময়ে জল ঢুকেছে। কামাল যেন এখনও একটা লজ্জা কোলে নিয়ে বসে আছে। টোটোর সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেই ঝরে পড়বে।
স্ট্যান্ডের দোকানগুলো সব বন্ধ শুধু একটা পান গুমটি খোলা আছে। বৃষ্টি হচ্ছে বলে তার ঝাঁপ নামানো। জনশূন্য বাস স্ট্যান্ডে দৃশ্যত আর কোনো মানুষ নেই। রাত বাড়লে খেয়াও বন্ধ। আজ আবার এমন বাদলা রাতে মানুষের অভাবে খেয়াও তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে বোধহয়। যে টোটোগুলো খেয়া ঘাট থেকে ফেরার, তারা ফিরে যে যার বাড়ি চলে গেছে। যাওয়ার সময় কেউ মোসলেমকে বোঝায়। কেউ কামালকে। তারা সবাই নিজের নিজের বাজার খারাপের কথা ছোঁড়ে। কেবল কামাল আর মোসলেম এখনও স্থির বসে আছে নিজের নিজের টোটোতে।
প্রায় নির্জন স্ট্যান্ডে দুজন লোক একে অপরের দিকে না তাকিয়ে মানুষের কথা ভাবছে। তাদের মধ্যে আর কথা কাটাকাটি নেই। মোসলেমের রাগ থিতিয়ে গেছে। এখন শুধু মানুষের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে তার। মানুষের কেমন হওয়া উচিৎ সে জানে না, তবে আজ কামাল যা করল মানুষের এমন করা উচিৎ নয়, সে বোঝে। আর বোঝে যে, কামালেরও বোঝা উচিত। কামাল কি জানে না তার ঘরের অবস্থা কেমন!
--সব জানে।
--সব বুঝে শাল্লা…
কামাল আরো ফাঁকা হওয়ার অপেক্ষা করছে। অনেক লোকজনের কাছে বিন্দা দাসের বউয়ের সঙ্গে তাকে এমনভাবে লাগিয়ে দিতে পারল মোসলেম! তার ব্যবসা যদি হোঁচট খায়! ওই পাড়ায় কোন্ মুখ নিয়ে সে গাড়ি ঢোকাবে!
আজকের বিকেলের হঠাৎ বৃষ্টির মত একটা লোক আসে। গুঁড়ি বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গিয়ে সে চটজলদি জানতে চায়--
--নন্দবাড় যাবু?
--হ…
--এদিকে আইস…
মোসলেম বলে। কামাল বলে।
দুজনেই একসঙ্গে বলে।
একসঙ্গে চুপ করে যায় দুজনেই।
বিমূঢ় স্থির হয়ে থাকে আগন্তুক যাত্রী। টোটো দুটোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুয়াশার সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগেই যেন একটা তাড়না থেকে লোকটা উঠে পড়ে কামালের গাড়িতে।
--চল্…
এখানে কামালের কিছুই করার নেই। সে দ্বিতীয়বার ডাকেনি। নেমে যেতে বলাও তো ব্যবসায়িক ধৃষ্টতা!
মসৃণ একটা শব্দ তুলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায় কামাল।
--তোকে আমি ছাড়বোনি, দেখ্যা লুবো …মার্যা ফেলবো…
অস্তিত্বের চিৎকার এমনই মিলিয়ে যায়। কেঁপে কেঁপে। বোধহয় অস্তিত্বকে ধরে বেঁধে কারো চোখে গুঁজে দিতেই। মোসলেমের নিজের কানেই কথাটা কত জোরালো অথচ অসহায় লাগল। নির্জন স্ট্যান্ডে সেই শেষ পান গুমটির ঝাঁপ না পড়লে এই কথাগুলোর প্রতিধ্বনিতেই হয়তো পাগল হয়ে যেতে পারত মোসলেম।
স্ট্যান্ডের আলো থেকে টোটোটা মিলিয়ে যাওয়া অব্দি সেইদিকে তাকিয়ে থাকে মোসলেম।
--একটুকু লজ্জাউ নেই! শাল্লা চষমখোর…
--গায়ে কি আদৌ মানুষের রক্ত আছে!
বাতি স্তম্ভের আলো থেকে বৃষ্টির কুয়াশা উবে গেছে। কয়েকটা কুকুর জমা জল বাঁচিয়ে কীসব শুঁকে শুঁকে এদিক সেদিক হচ্ছে।
--একবার কইতে ত পারত যে, তুই লিয়্যা যা…
মোসলেম এখন বুঝতে পারছে, কামাল সব ইচ্ছা করেই করেছে।
রাগে কাঁপতে থাকে মোসলেম। একটা কুকুর শুঁকতে শুঁকতে তার পায়ের কাছে চলে আসে। আরো একটু কাছে আসার অপেক্ষা করে মোসলেম। তারপর আলো ভেদ করা একটা চিৎকার… সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। ইচ্ছে করছে এখুনি গাড়ির একসেলেরেটরটা জোর করে মুড়ে কামালকে ধরে ফেলে। টুঁটিটা টিপে ধরে তার।
এমন সময় কেউ একটা হাত রাখে তার পিঠের উপর। নিজের ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিল মোসলেম, চমকে ওঠে।
--একশ টাকা দুবু?
--দুবু কি?
পেছন ফেরে মোসলেম। একটা রোগা খর্বাকার জামা সর্বস্ব লোক দাঁড়িয়ে আছে তার টোটোর পাশেই! মাথার ছায়ায় লোকটার মুখ আবছায়া দেখা যায়।
এতদিন এই লাইনে কাজ করছে মোসলেম। বাজারের অনেক লোককে চেনে। অথচ এই লোকটাকে কোনোদিন সে দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। লোকটা তখনও রোগা লিকলিকে হাতটা বাড়িয়ে রেখেছে তার দিকে।
এই প্রথম মোসলেমের হুঁশ হল। একহাতে পকেটটা চেপে ধরে সে।
স্থির অমোঘ গলায় লোকটা বলে যায়,
--একশ টা টাকা দে। অক্ষুনি অকে শেষ কর্যা দুবো…
--কাকে! কামালকে! কী কয় লোকটা!
সারা গায়ে হিম বয়ে যায় মোসলেমের।
কোনো কথা বের হয় না তার। অথচ এই মোসলেমই একটু আগে গলা ফাটাচ্ছিল। কথায় কথায় মেরে ফেলার হুমকি আর মরে যাওয়ার শাপ দিচ্ছিল। কিন্তু সে তো রাগের বশে! তাছাড়া এই লোকটাই বা কে!
টোটোর উপর বসে আছে মোসলেম। ডান হাতটা একটু মুড়ে দিলেই এগিয়ে যেতে পারে সে কিন্তু এই লোকটার নাগাল থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে কি! কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই হতাশ হয় মোসলেম। এই লোকটা প্রথম থেকেই তাদের সব কাটাকাটি কথা শুনেছে! শুধু তাই নয়, একটু আগে তো বাসস্ট্যান্ড একেবারে নির্জন ছিল! কোথায় কেমনভাবে দাঁড়িয়েছিল লোকটা! নিজেকে যে এতখানি আড়াল করে রাখতে পারে, তার কাছ থেকে পালানোর কোনো উপায় আছে কি!
লোকটার হাতে টোটোর ছাদের ছায়া পড়েছে। কত বড় একটা তালু মোসলেমের মুখের সামনে ভেসে আছে! যতটা সম্ভব নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিতেই লোকটার গলা কেঁপে কেঁপে ওঠে,
--আচ্ছা, পঞ্চাশটা টাকা দে…মিস হবেনি সত্যি কইঠি…
আতংক আর ঘোঁত পাকানো কান্না উঠে আসতে চাইছে মোসলেমের গলা দিয়ে!
"পঞ্চাশ টাকার চেয়ে ত বেশীই রোজগার করচি আজকে।"
খুব সাবধানে বাম হাতে পকেটটা চেপে ধরে মোসলেম। ডান হাতটা একসেলেরেটরে।
0 মন্তব্যসমূহ