কাজী লাবণ্য'এর গল্প: ধূসর জোছনা





(১)

-আমরা যাচ্ছি কোথায় বলবি তো।

গাড়ি মিরপুর রোড ধরে ছুটে চলেছে। ঢাকা শহরে অবশ্য গাড়ি ছুটে চলে না, ধুঁকে ধুঁকে চলে। এই মুহূর্তে ছুটছে, রায়হানের মুখে কথা নেই। হাসি হাসি মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছে। সায়েন্সল্যাবের সামনে এসে জ্যামে আটকে পড়ল গাড়ি। এবারে সে মুখ ফিরিয়ে বলল,
-শোন, ছয় বছর দুই মাস তেরদিন আগে আমি এই মেস ছেড়ে গেছি। ছয় বছর আগে তুই এই শার্ট গায়ে দিয়ে ঠিক এই টাইমে টিউশ্যনিতে যাইতি। তখন দুইটা করতি এখন কয়টা করিস জানি না, তবে আজও সেই টিউশ্যনিতে যাস। আর কত রে! আর কত এই টোকাইয়ের জীবন! এবারে নিজেকে বদলা।
-তা আমরা কি নিজেকে বদলাতেই যাচ্ছি? জ্যাম ছুটে গেলে রায়হান উত্তর না দিয়ে স্টিয়ারিং হুইলে মনোযোগী হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে আমার দিকে ফিরে বলল,

-শোন, ঘাওরামি করিস না। সময়ের ছাঁচে নিজেকে নরম ডোয়ের মত করে সাজাতে হয়। অপেক্ষা কিম্বা চেষ্টা তো কম করলি না। জীবন থেকে হারিয়ে গেল বছরের পর বছর। এবারে একটু নড়েচড়ে বোস। বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আয়। সবুজ ধূসর হয়েছে, মধ্য গগনের সূর্য হেলতে শুরু করেছে, স্বপ্ন ভেঙে গেছে আয় আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখি। নতুন করে বাঁচতে চেষ্টা করি, কেবল আমি যা বলি মন দিয়ে শুনবি। কিরে শুনবি তো!
ঘাড় ঘুরিয়ে পরিপুর্ণ চোখ ওর চোখে রেখে শ্রান্ত আমি বলি,

–হ্যাঁ শুনব।
-ওকে, চল এবার।
ঢাকা কলেজের উল্টোদিকে অবস্থিত বদরুদোজ্জা মার্কেটে ঢুকলাম। সেখান থেকে দেখে দেখে, বেছে বেছে কিছু শার্ট, ব্লেজার, জিন্সের প্যান্ট, আর টাই কেনা হল। কেনা হলো মানে রায়হানই কিনলো, প্যাকেটগুলো দুজনে মিলে হাতে নিয়ে বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসার পর সে ধানমন্ডির দিকে চলতে লাগল। একটি দামী রেস্তোরাঁর সামনে এসে গাড়ি রাখল। উপরে গিয়ে আমরা একটা টেবিলে বসে পড়লাম।
-কি খাবি বল।
-যা খাওয়াবি। সে অর্ডার দিলে একটু পরেই চলে এলো ধোঁয়া ওড়া সুঘ্রাণযুক্ত বিরিয়ানি, রেজালা, চিকেন আর বোরহানি। আমার পছন্দের খাবারগুলোই বলেছে। অথচ রায়হান বোরহানি মুখেও দেয় না, ওর নাকি বমি পায় তবে বিরিয়ানি ওর খুব পছন্দের। এখন সে নিজের জন্য নিয়েছে মাশরুম স্যালাদ, চিকেন স্যুপ আর অরেঞ্জ জ্যুস।
-এটা কি হল! তুই খাবি না!
-না রে আমি আর ওসব খাই না। তুই খা। এইত আমি এগুলো খাচ্ছি।
-আজব তো, তুই খাবি না তো অর্ডার করলি কেন?
-তোকে খাওয়াব বলে। নে নে খেয়ে নে। তোকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে আবার কাজে যেতে হবে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে বলে,
– হ্যাঁ রাতেও কাজ থাকে।
ফিরতি পথে আর তেমন কথা হলো না। মেসের সামনে নামিয়ে দিয়ে কাপড়ের প্যাকেটগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-পরশু সন্ধ্যা ঠিক ছয়টায় আমি আসব।
-পরশু?
-কেন নয়? শুভস্য শীঘ্রম অশুভস্য কালহরনং বুঝলি, তুই ভাল করে গোসল করে এই ড্রেস পরে রেডি থাকবি। ব্লেজার পরতে ভুলিস না। আমি তোকে কল দেব। তোর আগের ফোন নম্বরই তো আছে। বলেই হুশ করে বেরিয়ে গেল।


(২)
মনসুরাবাদ হাউজিং এর একটি মেসে আমরা বহুদিন ধরে থাকি। পাশ করে বেরুনোর পর থেকেই। সেসময় চোখের স্বপ্ন ছিল প্রগাঢ় সবুজ, ধমনির রক্তে ছিল তারুন্যের প্রাবল্য। অটুট আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করেছি, এখন বিসিএস পরীক্ষা দেব আর সরকারী চাকরির বাড়ি, গাড়ি, পিওন, আর্দালি হাঁকাব। পরীক্ষা দিতে দিতে, সময়ের সাথে সাথে সেসব সবুজ ফিকে হতে হতে আজ ধুসর, ধূলট। স্বপ্ন আর স্বপ্ন নেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বিসিএস পরীক্ষা দেবার বয়স পেরিয়ে গেছে। বেসরকারী কোন চাকরিও ধরা দেয়নি।

আমরা পাঁচ বন্ধু একসাথে এখানে এসেছিলাম। একে একে চারজন চলে গেছে। বিসিএস নামক বৈতরণী পারের চেষ্টায় জানবাজি রাখতে রাখতে বয়সসীমা পেরিয়ে গেছে। তবে ওই হীরার হরিণ আরিফের হাতে ধরা দিয়েছিল। আরিফ এখন বড় অফিসার। নিজের অফিসে সুদৃশ্য টেবিলের ওপাশে সটান বসে থাকে, শোনা যায় বেকার বন্ধুদেরকে সে এখন নাকি তেমন চিনতে পারে না।

শুভ’র বিসিএস হয়নি অন্যকিছু করতে না পেরে গ্রামে গিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে টার্কি মুরগির চাষে মন দিয়েছে, শুনেছি সে খারাপ করছে না। রায়হান ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে অজানায় চলে গেছে, কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না। মোবাইল ফোনের সিমকার্ড পর্যন্ত পালটে ফেলেছে। আমি আর রুপম আছি। রুপম একটা এনজিওতে কাজ করছে। সদ্য ওকে লালমনিরহাটের এক গ্রামে বদলি করা হয়েছে। অনিচ্ছা স্বত্বেও সে গতরাতে চলে গেল।

সবাই চলে গেছে বলে মেস কিন্তু ফাঁকা নেই। দুর্ভাগারা সৌভাগ্যের চাবিটির লক্ষ্যে সিট ভরাতে ঠিক এসে জুটে যায়। যারা আছে তারা বলা চলে আমার অপরিচিত আর জুনিয়র।

একমাত্র বন্ধু, সঙ্গী রুপম চলে যাওয়াতে আমি বড্ড একা হয়ে গেলাম। বুঝিনি, এতটা খারাপ লাগবে। সারাদিন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম। সন্ধ্যার ধূপছায়া আঁধার ছেয়ে যাচ্ছে এই মেসবাড়ি সহ চারপাশে। ঝাঁকে ঝাঁকে মহিলা মশককুল বেড়িয়ে পড়েছে তাদের রাগ সঙ্গীত আর ডেঙ্গুসহ নানা অসুখের জীবানু নিয়ে। টিউশনিতে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতে হবে। ছাত্রটির সামনে এসএসসি পরীক্ষা। উঠে কাপড় চেঞ্জ করে সিঁড়ি দিয়ে নামছি কানে এলো আমার নাম ধরে কে যেন কি বলছে নিচের সিকিউরিটির কাছে। কণ্ঠস্বর পরিচিত লাগছে, নিচে নেমে আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। রায়হান খোঁজ করছে আমি আছি কিনা। এত বছর পরে রায়হান আমার সামনে এটা অবিশ্বাস্য লাগছে তার চেয়েও অবিশ্বাস্য রায়হানের চাকচিক্যময় চেহারাসুরত। আশিরনখ গ্লামার যেন ঠিকরে পড়ছে। হাতের সিগারেট ছুঁড়ে দিয়ে কাছে এগিয়ে এলো
-আজ তুই টিউশ্যনিতে যাচ্ছিস না। আমার সাথে যাবি...
-তুই! এতদিন কোথায় ছিলি! কোত্থেকে এলি!
-সেসব কথা পরে হবে। তুই আমার সাথে চল তো আগে।
-আমাকে টিউশ্যনিতে যেতে হবে তুই ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক আমি আসছি।
-আচ্ছা। জলদি ফিরবি কিন্তু। এই যে চাচা আমার গাড়িটা একটু দেখবেন। সিকিউরিটিকে বলে ঠোঁট গোল করে শিষ দিতে দিতে সে সিড়ির দিকে এগুতে থাকে। রায়হানের গাড়ি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি হনহন করে হাঁটতে থাকি। ভাবতে থাকি রায়হান কার গাড়ি নিয়ে এসেছে? নিজের নাকি! তা কি করে সম্ভব! কি জানি হতেও পারে। কত অবিশ্বাস্য ঘটনাই তো ঘটছে জগতে। রায়হানের হালচাল তাহলে পালটে গেছে। ওর তবে ‘দিন’ ফিরেছে। ফিরুক ফিরুক বন্ধুদের ‘দিন’ ফিরলে ভালই লাগে। আর রায়হান আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। বাড়িতে ওর বাবা মা বোন ওর দিকে আশা নিয়ে চেয়ে থাকত। তাদের আশা হয়ত পুরন হয়েছে।
কেবল কি ওরই?

আমারও বাবা নেই। বাড়িতে একা মা আর ছোট ভাই দুটি যাদের জন্য কখনই কিছু করতে পারিনি। বর্তমানে, ছোটটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পদের সবগুলো ধাপ একে একে পার করেছে। চাকুরির পাকা বন্দোবস্ত হবে যদি সে তিনলাখ টাকা দিতে পারে। অবশ্য আমাকে আর কেউ কিছু জানায় না। তবে শুনতে পাই। খুব ইচ্ছে করে, ওর চাকরির সর্বশেষ ধাপটা যদি পার করে দিতে পারতাম...তিন লাখ...
এরপরই রায়হান আমাকে নিয়ে বদরুদ্দোয়া মার্কেটে শপিং করতে চলে যায়। বদরুদ্দোজা মার্কেট হলো সেই মার্কেট যেখানে গার্মেন্টসের রপ্তানী অযোগ্য ড্রেসগুলো অনেক সস্তায় বিকায়। সস্তা হলেও সেগুলো মানসম্মত, ফ্যাসানেবল এবং আরামদায়ক।



(৩)
দুপুরে খেয়ে দেয়ে শুয়ে আছি, আজ রায়হানের আসার কথা। আদতেই কি সে আসবে! আদতেই কি আমার কিছু একটা হবে! রায়হান সেদিন বলেছিল ‘টোকাই’য়ের জীবন, সত্যিতো এই মেসবাড়িতে কাটিয়ে দিলেম এতোগুলো বছর। টিউশ্যনি করতে করতে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয়ে ফেললাম নিজেও ক্ষয়ে গেলাম। না লাগলাম পরিবারের কাজে, না মিললো নিজের পরিবার।

আচ্ছা, রায়হান কি করে! আমাকেই বা কিসে ঢুকাবে! কেমন একটা সন্দেহে ডুবে গেলাম। সন্দেহের বাষ্পটা চুয়েচুয়ে ঢুকে পড়ল চিন্তায়। সান্ধ্য আঁধারে চিন্তাটা ক্রমশ যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে। গুটিয়ে যাচ্ছে। গুটোতে গুটোতে একটা গিরগিটি হয়ে গেল। সেখান থেকে কেন্নো, আরও ছোট হচ্ছে। একেবারে ছোট মাছি হয়ে গেল। মাছিটা মুখের চারপাশে উড়ছে। অপেক্ষা করতে করতে কখন তন্দ্রা এলো। তন্দ্রা গিয়ে ঘুমের গভীরে প্রবেশ করে আমাকে সন্দেহের হাত থেকে বাঁচিয়ে প্রশান্তি এনে দিল।

এক রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর, একে মশা তার সাথে আবার লোডশেডিং। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। মশার কামড়ে ঘুম ভাঙলে আলুথালু বিছানায় উঠে বসি, দেখি রাত দশটা বাজে। লাল পেটফোলা মশাগুলো উড়তে না পেরে চারপাশে পরে আছে, রায়হান আসেনি।

এক সপ্তাহ পরে শনিবারে টিউশ্যনিতে যাবার জন্য রেডি হচ্ছি তখুনি রায়হানের ফোন এলো। টিউশ্যনিতে না গিয়ে আমি রায়হানের সাথে চললাম।

গাড়ি ছুটে চলেছে। ছুটিরদিন হওয়াতে রাস্তা মোটামুটি চলার মত আছে। পরিচিত এলাকা পেড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে পশ এলাকার দিকে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি কোন প্রশ্ন করব না। রায়হান হাসতে হাসতে বলেছে, এল ডোরাডো যাচ্ছি কথা বলিস না। সময় তোকে বলে দিবে কি করতে হবে। সে আমার জন্য একটা পারফিউম এনেছে। গাড়িতে ওঠার পর বলল নে স্প্রে কর এটা তোর জন্য। তোকে তো ব্র্যাড পিটের চেয়েও হ্যান্ডসাম লাগছে রে। শোন, কিছুদিনের মধ্যে তুই রিংরোডের ওই ফিটনেস সেন্টারে ভর্তি হয়ে যাস।
বিভিন্ন রাস্তায় চলার পরে শেষ পর্যন্ত গাড়ি এসে থামল দেশের ধনাঢ্য এলাকার একটি নান্দনিক বহুতল সুরম্য ভবনের সামনে।
রায়হানের কাছে কার্ড ছিল, আমরা পাঞ্চ করে ভেতরে ঢুকলাম।
সুসজ্জিত স্পেস। সুইমিং পুল ঘিরে বসার আয়োজন। পুলের পানি কেমন যেন জমাটবাঁধা নীলচে সবুজ। কি একটা মৃদু সুর বেজে যাচ্ছে। ছোট ছোট টেবিল ঘিরে নিচু গদিমোড়া চেয়ারে মানুষজন বসা। অবাক হয়ে দেখলাম বেশিরভাগই নারী, বিগত যৌবনা বললে অসম্মান করা হবে। তারা অভিজ্ঞ নারী, যাদের কাছে বয়স কেবল একটা সংখ্যা। তাঁদের পড়ন্ত সৌন্দর্যের মখমলি ডানার পালক উড়ছে জায়গাটা জুড়ে। হাইড করা উৎসের নরম আলোক বিচ্ছুরণ তাদের চুল, নাকের ডগা, কানের পাথরে প্রতিফলিত হয়ে ঝিকমিক করছে। যেন স্রোতস্বিনী নদীর জলে রৌদ্রের ঝলকানি। কয়েকজনের মুখ খুব পরিচিত লাগল, দুম করে মনে পড়ল আরে! এরা তো সেলিব্রেটি। টিভিপর্দায়, পত্রিকায়, বহুবার দেখেছি। কিছু প্রিয়মুখও আছে এখানে।
রায়হান আমাকে ঢোকার মুখে কেবল বলেছে কেউ যদি পছন্দ করে, তার পছন্দে সায় দিবি, সাড়া দিবি। ওর কথা কিছুই বুঝিনি, তবে কিছু একটা ব্যাপার আছে, যা চেতনার জানালায় অস্বস্তিকর উঁকি মারছে। এখানে রায়হানকে অনেকেই চেনে। রায়হান বা আমার বয়সী বেশ কিছু স্মার্ট ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিম্বা কোন টেবিলে কাউকে সঙ্গ দিচ্ছে। কিছু টেবিলে ষোড়শোপচার। রঙিন পানীয়।
নারীরা কৃত্রিম রঙে রাঙানো। তাঁদের চেহারা, তাঁদের পোষাক, তাঁদের সেটিং চুল, তাঁদের ব্যক্তিত্ব থেকে ঠিকরে পড়ছে দ্যুতি, বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। তারপরও মনে হচ্ছে, কোথায় যেন এক মলিনতা, এক দীনতা লুকিয়ে আছে পারিপাট্যের ভাঁজে ভাঁজে।
রায়হান এসে আমাকে নিয়ে একটু সরে এসে মৃদুস্বরে বলল
-দ্যাখ এই মানুষগুলোকে তুই ভালবাসতে পারিস। করুণা করতে পারিস। ঘৃণাও করতে পারিস। তোর ব্যাপার। জীবন আমাদেরকে সত্যি কিছু দেয়নি। লড়াই আমরা কম কিছু করিনি, যোগ্যতাও আমাদের কম ছিল না, তবু কোনো সুযোগ আমাদের জোটেনি। শুধু সোনালি সময় হুহু করে পেছনে চলে গেছে।
এরাও হয়ত কেউ কেউ প্রতারিত হয়েছে জীবনের কাছে। আমরা এদেরকে কিছু দেবার বিনিময়ে নিজের জীবনকে কিছুটা সহজ করে নিতে পারি। আমি একটুপরে চলে যাব। একজনের সাথে থাইল্যান্ড যাচ্ছি। সপ্তাহ খানিকের জন্য। মন চাইলে কাজে লেগে যা। ফিরে এসে কথা হবে, ইনিই আমাকে ওই গাড়িটা গিফট করেছিল।

ঘুরে দাঁড়ালাম। মেসে ফিরব। সাবান ডলে একটা গোসল দেব। কাল থেকে টিউশ্যনিতে যাব। আরেকটা টিউশ্যনির খোঁজে ছিলাম পেয়ে গেলে সেটাও শুরু করব। মোট হবে চারটে। নাহয় আর চারটে খুঁজে নেব। তারপর একা এক পাহাড়ের সমতলে গিয়ে নির্মল বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেব। সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাব। এক ভোরে নবারুণের সাতরঙ ডানায় মেখে রঙিন এক পরিযায়ী পাখি এসে গান গেয়ে ঘুম ভাঙালে ভাঙবে নতুবা ভাঙবে না। এ লোকালয় এ সমাজ আর আমায় টানে না।

রায়হান এসে কানে কানে বলল আমাকে নাকি কে ডাকছে। গেলাম, বয়সী বটের ঝিলিমিলি পাতার মত নারী বসতে বলল। হালকা খাবারের সাথে চলল কথা বলা। ঝকঝকে গ্লাসে তিনি ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন, আমার দিকেও ঠেলে দিলেন। তিনি কথা বলছেন আমি হ্যাঁ হু করে চলেছি। এরপর তিনি বললেন,
-ওকে, চল এবার ওঠা যাক। অদূর থেকে সকলের অলক্ষ্যে রায়হান সায় জানিয়ে চোখ টিপে দিল। উঠে দাঁড়ালাম চলে যাব বলে। লম্বা লম্বা পদক্ষেপে ওই নারীকে পেছনে ফেলে, রায়হানের এল ডোরাডো পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি বেরুবার দরজার দিকে, মশা, মাছি, লোডশেডিং এ ভরা আমার মেস, আমার ঠিকানা, আমার গন্তব্যের দিকে।

পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি রায়হান অবাক ও ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ওই নারীও কখন যেন দ্রুত আমার পাশে চলে এলেন, তিনি কি যেন বলে উঠলেন, তাঁর পা হঠাত টলে উঠল...
অকস্মাৎ, নিজের অজান্তে হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি এলিয়ে পড়লেন আরেক রায়হানের বাহুডোরে।





লেখক পরিচিতি
কাজী লাবণ্য
কবি। গল্পকার।
ঢাকায় থাকেন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ