পাপড়ি রহমান
সরল তটরেখা ধরে নদী যখন বইতে থাকে তখন তাকে দেখায় অবিকল মরা ঢোড়ার মতো। যেন সে
তার আবছা হলদেটে উদর এইমাত্র উল্টে দিয়ে স্থির হয়েছে। তুরাগ নদীর এই দিকটাও তেমন।
ঠিক মরা ঢোড়ার হলদেটে পেটের মতো। তবুও এই সরল তটভূমিতে নিস্তেজ ও ঘোলাজলের ঢেউ এসে
সমান তালে দুলে দুলে যায়। দুলতে দুলতে কখনোবা তট ছাড়িয়ে আরো খানিকটা ভেতরে ঢুকে
পড়ে। এতটাই ভেতরে যে, যেখানে বহু পুরাতন এক
বটবৃক্ষের ছায়া ঘন হতে হতে প্রায়ান্ধকার হয়ে আছে। এই বটবৃক্ষের আছে কুণ্ডলি পাকানো
সরিসৃপের মতা অজস্র বয়সী ঝুরি। যারা মাটি ফুঁড়ে নেহায়েত সখের বশে ভেতরে ঢুকে
পড়েছে। ঢুকে পড়েই খামচে ধরেছে মাটির শরীর। এই যে বটের ঝুরি আর মাটির ভাবসাব তাও
যেন প্রাচীন রহস্যের মতো। তুরাগের অন্যান্য তটভূমির চাইতে এই দিকটা এখনো বেশ নিরিবিলি।
ছায়াচ্ছন্ন ও জিন-ভূতের কিসসা-কাহিনীতে ভরপুর। তুরাগের এই তীরে প্রায়ই শোনা যায়
জিন বা ভূতের হরেক রকম কারসাজি। কখনো ধড়হীন মুণ্ডু বা হাত-পা বিহীন লাশের খবর।
এইরকম নানান কিসিম থাকা সত্ত্বেও তুরাগের এই তট মানুষের আনাগোনাবিহীন হয়ে ওঠে নাই।
বরং এইখানে মানুষ আসে জোড়বেধে। জিন-বা ভূতের কারসাজি দেখতে অথবা বটের ছায়া, অজস্র ঝুরি অথবা বেশ
কয়েকটা হিজলের আড়াল-আবডালের আশায়। ফলে ধারণা করা যায় তুরাগের এই দিকটার জল স্থির
জিন-ভূতের কুমন্ত্রণায়। জলের এই স্থিরতা মানুষের প্রেম ঘন হওয়ার জন্যও উপযোগি বটে।
ফাল্গুন-চৈত্রে সূর্য তার বেদম রোষ ঢালে আর ছারখার করে দিতে চায় যত ছায়া। সবুজ
গাছেদের মায়া-মমতা জ্বালিয়ে কুঁকড়িয়ে মুকড়িয়ে দিতে চায়। যেন তাদের অবয়বে
ন্যাড়া-টুন্ডার ছাপ লেগে থাকে। কিন্তু সূর্যের এত রোষ, তাপের ভেতরও এই বটবৃক্ষের
যেন ছায়ার কমতি নাই। সারি বাধা হিজলের আড়াল-আবড়ালের কমতি নাই। এ এক আশ্চয্যি
কারবার বটে! মরাধরা-শুকনা পত্ররাজির শিরা-উপশিরার ভেতর তারা যেন শীতলতা লুকিয়ে
রাখে। রাজ্যির জলকণা গোপন করে রাখে। অথচ মাত্র সামান্য অদূরেই তুরাগের উষ্ণজল।
তাতে ঘোলাভাব আর কাদা-প্যাকলার তীব্র গন্ধ। এমন নদীতে চলমান নাওগুলার বেহাল দশা। প্রায়ই
সেসব চড়ায় আটকে পড়ে। মাঝিদের হাতে তখন আর বৈঠা নাই। খালি লগির কারবার। বাঁশের লগির
ধাক্কা-ধুক্কায় আটকানো নাও জলে ভাসে। নাও আটকানো, জলের উষ্ণতা, কাদা-পচা-গন্ধ দেখে দেখেই বটের ছায়া যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর
হয়। ছায়া যত দীর্ঘ হয় জল যেন তত দূরে সরতে থাকে। সরতে সরতে জল তখন এতটুকুন।
তুরাগকে তখন আর নদী মনে হয় না। মনে হয় বাঁধ দিয়ে আটকানো কোনো খাল-যার জল শুকাতে
শুকাতে লম্বা কাছি হয়ে গেছে। এই এক কাণ্ড। চৈত্র এবং শ্রাবণের ফারাক। ঢলঢলে বর্ষায়
যখন মাছের ঘাই প্রকটভাবে দৃশ্যমান, চৈত্র এলেই অন্য ধাত। কাছির মতো নিস্তেজ জলে মলা-ঢেলা দূরে থাক ভুলে দুই-একটা চ্যালা-চাপিলারও
ফালাফালি নাই। থাকবে কি করে- উষ্ণ জলের উপর মাথা তুলতে কোন মাছেরই বা দায় পড়েছে?
মেহেরুন বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস মেরে বসে এই সমস্ত বেশ ভালো করেই খেয়াল করে।
মুকাজ্জেলের আসতে যেদিন বেশি বিলম্ব হয়। সেদিন সে শুনে আসা কিসসা-কাহিনীর হদিস
করে। অথবা অদৃশ্য জিন-ভূতের। প্রায় ম্যালাদিন হয়ে গেলেও সে সারিবন্ধ হিজল বা
বটগাছের ছায়া অথবা ডালপালাতে ভূত-পেতœীর আছর হতে দেখে নাই। মেহেরুন প্রায়ই চুল খুলে ভরদুপুরেই
আসে। কখনো লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে। মেহেরুনের খুব ইচ্ছা তাকে জিন-ভূত বা খবিশ যে
কোনো কিছু একটা ধরুক। কিন্তু সেসব তাকে ধরে না। তবে না ধরলেও মুকাজ্জেলের সঙ্গে
তার পরিচয়ের প্রথম দিনটা বেশ খটকার মতো লেগে আছে। মেহেরুনের স্বামী আব্দুল কুদ্দুস
তাকে সেদিন বেদম পিটিয়েছিল। দোষের মধ্যে দোষ বলতে আব্দুল কুদ্দুসের গলায় কারো
কামড়ের দাগ। কণ্ঠার হাড়ের সামান্য উপরে একেবারে আধুলির মতো সিন্দুরে লাল দেখে
মেহেরুন জানতে চেয়েছিল-
‘ইয়াল্লা, তুমার গলার মইধ্যে এইডা
কি হৈল?’
আব্দুল কুদ্দুসের নিরসক্ত উত্তর-
‘কই? কই-কুনহানে?’
বলতে বলতে সে বাথরুমের দরোজা গলিয়ে আয়নার সামনে। রাজহাঁসের মতো গলা উঁচিয়ে যেন
কিছুই হয় নাই এমনভাব ধরে বলেছিল-
‘ওহ এইডা! এইডা! দাঁড়ি
কামানের সমুয় ব্লেড লাগছে বুধহয়।’
‘ব্লেড! এমুন গলার মধ্যে
কি মানইষের দাঁড়ি গজায়নি?
দাঁড়ি গজায় গালে, থোতনায় আর হের চাইরপাশে।’
মেহেরুন এইকথা বলেছে কি বলে নাই-আর যাবে কই? আব্দুল কুদ্দুস একেবারে জলাতঙ্কে আক্রান্ত কুকুরের মতো
ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেহেরুনের উপর। মেহেরুনও ছাড়ে নাই। সেও সামনে দাঁত নখ, হাত চালিয়েছিল। আব্দুল
কদ্দুস তখন বেপরোয়া। হুঙ্কার দিয়ে বলেছিল-
‘বেশ্যামাগি বাইর হ আমার
বাড়ি থিক্যা।’
মেহেরুন তখন থমকেছে। কই যাবে সে বের হয়ে?
কিন্তু সে বের না হতে চাইলেও আব্দুল কদ্দুস তাকে ছাড়ে নাই। ধাক্কা দিয়ে দরজার
বাইরে ফেলে দিয়েছে। ফের বলেছে-
‘বাইর হ আমার বাড়ি
থিক্যা-বেশ্যামাগি। ’
ফলে মেহেরুনের ঘরে টেকা দায়।
কোনো রকমে কিছু টাকা ব্যাগে নিয়ে বাসে চেপেছে।
বাস তাকে নিয়ে এসেছে আশুলিয়া। অতঃপর তুরাগনদীর এই তটভূমিতে।
তুরাগের তীরে এলেও মেহেরুনের মন শান্ত হয় নাই। আব্দুল কুদ্দুসের মারধরে তার
সমস্ত শরীরে অসম্ভব বেদনা। নাক-মুখ-চোখে রক্ত জমাট বাধা। এইসব নিয়ে সে বসেছিল একটা
টংঘরের বেঞ্চিতে চা খাওয়ার জন্য। তখন মুকাজ্জেলও একই বেঞ্চিতে বসা। হয়তো চা খেতে
সেও এসেছিল। অথবা হতে পারে মেহেরুন ছিল তার দৃষ্টির ভেতরই। পাশাপাশি বসে চা খাওয়া।
ক্রমে, এক-দুই বা তিনকথা। তারও
পরে মুকাজ্জেল নিজ থেকেই মেহেরুনকে মোবাইল নাম্বার দিয়েছিল। এবং মেহেরুনকে বাসে
তুলে দিতে গিয়ে নিজেও উঠে পড়েছিল একই বাসে। ওই দিন মুকাজ্জেল সারারাস্তায় প্রায়
কোনো কথাই বলে নাই। একরকম নির্বাক থেকে মেহেরুনকে সে ইব্রাহীমপুর পৌঁছে দিয়েছিল।
০২.
টের ঝুরিতে হেলান দিয়ে বসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে মুকাজ্জেল তাকিয়ে ছিল আসমানে।
সকালের রোদ্দুর এখনো মিঠে। তেজ দেখিয়ে হনহন করে মাথার উপর চড়ে বসে নাই। ফলে পৃথিবী
তেমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নাই।
মুকাজ্জেল এই মিঠে রোদের ভেতর মেহেরুনের জন্য অপেক্ষা করছিল। সকাল সকালই তার
আসার কথা কিন্তু সে এখনো এসে পৌঁছায় নাই। গত দিন পনের হলো আব্দুল কুদ্দুস তাকে
নজরবন্দি করে রেখেছে। মুকাজ্জেলের পাঠানো এসএমএস পড়ে ফেলেছে আব্দুল কুদ্দুস। সেই
থেকে একেবারে কারফিউ দিয়ে তক্কে তক্কে আছে। মেহেরুনকে হাতেনাতে ধরার। অবশ্য কারফিউ
জারির আগে বেদম মারধর করতে সে ভোলে নাই। তার এক কথা-
‘তুই মোবাইল ব্যবহার করতে
পারবি না। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকবো ততক্ষণ মোবাইল পাবি। আমি না থাকলে মোবাইল বন্ধ
রাখবি।’
কুদ্দুসের এসব কথার প্রতিউত্তর মেহেরুন করে নাই। নিত্য নিত্যই এই ঝগড়া-ঝাটি আর
মারপিট কারই বা ভালো লাগে?
ফলে মেহেরুন
চুপচাপই থাকে। এর মাঝে একদিন বাইরে বেরিয়ে সে ফোন করে মুকাজ্জলকে বিস্তারিত বলেছে।
আজকে এখানে আসবে এমন কথাই হয়েছে।
মুকাজ্জেল আজকে আগেই এসেছে। ঘণ্টা দেড়েক ধরে প্রায় এক প্যাকেট সিগারেট ছাই
করেছে। ভাড়া করা নৌকার মাঝি বার চারেক ঘুরে গেছে। কিন্তু মেহেরুন এসে পৌঁছায় নাই।
বটগাছের এই বিস্তর ছায়ায় বসে বসে শরীর তপ্ত হয়ে উঠলে নৌকা ভাড়া নেয়া যায়।
নৌকায় সওয়ারী হলে নিজেদের হাঁসের মতো ভাসিয়ে দেয়া যায়।
মাঝি জল বেয়ে বেশ দূরে গেলে পর্দাও ফেলা যায়। পর্দা ফেললে অন্ধকার ছইয়ের ভেতর
ঘণ্টা দুয়েক কাটানো যেতে পারে। অপেক্ষামান মুকাজ্জেল ক্রমে অস্থির হয়ে ওঠে।
অনতিদূরের ঘাট থেকে প্রায় ৪-৫টা নাও এর মাঝেই হাঁস হয়ে ভেসে গেছে। মুকাজ্জেল
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে। মেহেরুন না এলে সে আজ অন্ততঃ এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
মুকাজ্জেল বিষাদক্লিষ্ট হয়ে ওঠে। আর তক্ষুণি কিনা বটবৃক্ষের বিস্তৃত ছায়া কেঁপে
যায়। গাছের ডাল-ঘনপাতা নাড়িয়ে দিয়ে একজোড়া বক এসে বসে। ডানা গুটিয়ে ত্রাসে
এদিক-ওদিক তাকায়। হয়তো ভালো করে দেখে নেয় কোনো শিকারি তাদের লক্ষ্য করে কিনা।
নিশ্চিন্ত হয়ে ডালা মেলে বসে থাকে। মুকাজ্জেল বুঝতে পারে এই যুগল রোদ্দুর মেখে
নিচ্ছে শরীরে। তখন বটের ছায়া গাঢ় থেকে আরো গাঢ়তর হয়। আর মুকাজ্জেল হঠাৎ কেঁপে ওঠে।
তার শীত শীত লাগে। হেমন্তের হাওয়া হঠাৎ যেমন জানিয়ে দেয় শীত নামতে বড় বেশি বিলম্ব
নাই।
মুকাজ্জেল এই রকম হীমহীম অনুভবের ভেতর দিয়ে দেখতে পায় মেহেরুনের খয়েরী ওড়না
বাতাসে ওড়ে। আর ডালে বসা বগিটা যেন পত্র-পল্লব ভেঙেচুরে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
মেহেরুনের পড়নে খয়েরী ফুটকি-ফুটকি সালোয়ার কামিজ। কামিজটা পুরু কাঁধ আর বুকের
উপর তীব্র চেপে আছে। মুকাজ্জেল হাত বাড়িয়ে খয়েরী ফুটকি স্পর্শ করে। অতঃপর
মেহেরুনের গলা, বুকের উপরের অংশ। বকের
পালকের মতো কোমল উষ্ণতা। এই উষ্ণতা নিয়ে মেহেরুনের ত্বক নেমে গেছে স্তনের চড়াই
পেরিয়ে পায়ের আঙুলে আঙুলে।
মেহেরুনও বটের ঝুরিতে হেলান দিয়ে বসলে মুকাজ্জেল ফের তাকে স্পর্শ করে।
মুকাজ্জেলের তখন হাত কেঁপে উঠে। ঠোঁট
কেঁপে উঠে। উরুর মধ্যিখান থেকে চ্যাংমাছ মাথা তুলে পরনের প্যান্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে
পড়তে চায়। মুকাজ্জেলের চোখ জলে ভরে উঠতে
চায়। সে কম্পিত কণ্ঠে বলে-
‘ম্যালাদিন বাদে বগির ফইড় ছুঁইলাম।’
শুনে মেহেরুন অবাক চোখে তাকায়-
‘ফইড়? সেইটা কি?’
‘আমাগো ছোডুকালে খালি
বগাবগি ধইরা আনতো মাইনষে। আর আমরা খাইতাম বগের গোশত। বগ জবাই হইলে সেইটার কণ্ঠ
থিক্যা ফইড় তুইল্যা রাইখ্যা দিতাম।’
‘কেন বকের ফইড় তুলতা কেন?
‘ফইড় তুইল্যা কাঁচের
বৈয়ামে ভইরা থুইতাম। তখন তো আমাগো খালি হাত কাটতো। পাও কাটতো। হাঁটু কাটতো। কনুই
কাইট্যা যাইতো। খেলতাম বা যুদি নাও খেলতাম তাও আমাগো কেমনে জানি বেবাক কাটতো। কাটা
জায়াগায় বগের ফইড় লাগাইয়া দিলেই রক্ত পড়া থাইম্যা যাইত।’
মেহেরুন এমন কথা কম্নিনকালেও শোনে নাই। সে শুনতে শুনতে চোখ বুঁজে ফেলে। তখন
তার মনে হয় তারও যেন পিঠের উপর দুইটা ডানা আছে। পালকময় ডানা। যে ডানা দিয়ে সে
মুহূর্তে বকপাখির মতো শূন্যে উড়াল দিতে পারে। মেহেরুনের মনে হয় সাদা সাদা
কোমল-পেলব-নরম ফইড়ের গুচ্ছ ক্রমশঃ ঢেকে দিচ্ছে তার শরীর।
রোদ্দুর তখন তুরাগের জলে রূপালি রোশনাই ঢেলে দিয়েছে। আর মাঝিরা অপেক্ষা করছে
আগাম বায়না করা সওয়ারীদের জন্য। মেহেরুন উড়াল দিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসতেই দুলে ওঠে
নৌকা। ভেসে চলে ক্রমশঃ। আর মুকাজ্জেল জিব আর ঠোঁট দিয়ে তুলতে থাকে ফইড়। ফইড়ের পর
ফইড়। কোমল-পেলব-নরম।
শুভ্র-সাদা-উজ্জ্বল ফইড়ে নৌকা বোঝাই হয়ে যায়। মুকাজ্জেলের তবু যেন কোনো
ক্লান্তি নাই। সে ফইড় তুলতে তুলতে বকপাখির শরীর খালি করে ফেলে। পালক খসানো পাখি উদোম
পড়ে থাকে। অনুজ্জল আলোতে তাকে দেখায় ভোরে ফুটে থাকা সাদা শাপলার মতো। বকপাখি নৌকার
পাটাতনে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে। শুয়েই থাকে। সামান্য নড়বে বা একটা উড়াল-তেমন শক্তি
বকপাখিটার আপাতত নাই।
০৩.
বৈশাখের এক-আধলা বৃষ্টিতে বটবৃক্ষ যত ছায়াচ্ছন্ন হয়েছে, এইখানে জিন-ভূতের
কিসসা-কাহিনীও তত বিস্তার লাভ করেছে। তুরাগের ঘোলা জলে দুই-চারদিন বৃষ্টির জল পড়ে
তা আরো ঘোলা দেখায়। এই ঘোলা জলের উপর তখন সওয়ারীসহ নাও ভাসে। আর মাঝির হাতের লগি
জোরে সোরে পড়ে।
বটবৃক্ষের ছায়া-মায়া পেছনে ফেলে মেহেরুন যখন নাওয়ে ওঠে তখন শুধু তার চোখ দুটো
জ্বলে ওঠে। যেন কালবৈশাখি ভর করে আছে কালো মনির ভেতর। পাটাতনের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে
মুকাজ্জেল সিগারেটের পর সিগারেট জ্বালিয়ে যায়। নাওয়ের মাঝি ততক্ষণে নোঙর গেঁথে সরে
গেছে দূরে। তার মাথার কালো ছাতাটিরও আর নিশানা দেখা যায় না।
মেহেরুন ব্যাগ থেকে নতুন কেনা ছুরিটা বের করার আগে মুকাজ্জেলকে চুমু খায়।
দীর্ঘ চুমু। উত্তপ্ত লাভার মতো চুমু।
মুকাজ্জেল চোখ মুঁদে থাকে। হয়তো বকের পালক স্পর্শের আনন্দ তাকে বিহ্বল করে রাখে।
মুকাজ্জেলের চোখ বোঁজা অবস্থাতেই মেহেরুন তার পেটে ছুরি বসায়। দুইহাতে শক্ত করে বাট চেপে ধরে সে পুন: পুন: ছুরি বসায়। মুকাজ্জেল
চোখ বুঁজেই চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু তখন হঠাৎ করে কালবৈশাখী শুরু হয় নাকি কোনো
দামাল হাওয়া ছুটে আসে ধরা যায় না। ফলে মুকাজ্জেলের আর্তচিৎকার ওই বাতাসের বিভ্রাটে
ঢুকে পড়ে।
মেহেরুন তখন একটানে নাওয়ের নোঙর তুলে ফেলে। জলের উপর নাও ঠেলে দেবার আগে
পরিপূর্ণ চোখে চারপাশে তাকায়। রোদ্দুরের খরতাপে ম্রিয়মান মনে হয়। গলুই থেকে
মেহেরুন যখন ছইয়ের ভেতরে ঢোকে মুকাজ্জেল তখন চপচপা রক্তের ভেতর শুয়ে আছে। হঠাৎ আসা
কালবৈশাখী নাকি দামাল হাওয়ায় নৌকা তখন মাঝনদীতে। মুকাজ্জেলের তখন চিৎকার করার
ক্ষমতাও নিঃশেষ। সে শুধু বোবা হয়ে মেহেরুনের হাতের ছুরির দিকে তাকিয়ে থাকে।
মেহেরুন তখন পরনের কামিজ খুলে ফেলে। গলার নিচে ছুরির পোঁচ দিলে সাদা রঙ ঝিলিক
দিয়েই রক্তের ভেতর ডুবে যায়। মেহেরুন বুকের মাঝখান থেকে চামড়া-মাংস কেটে এনে
মুকাজ্জেলের ক্ষতস্থানে বসিয়ে দেয়। কিন্তু তাতে রক্তপাত থামে না। মেহেরুন তখন ব্রা
খুলে নিজের পুষ্ট স্তনের একটি কেটে ফেলে ক্ষতস্থানে চেপে ধরে। কিন্তু বলকিয়ে ওঠা
মুকাজ্জেলের রক্তপাত তাতে চাপা দেয়া যায় না। মেহেরুন তার অন্য স্তনটিও কাটে এবং
রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা চালায়।
রক্ত প্রপাত থামানোর চেষ্টাতে মেহেরুন নিজের দুই স্তন কাটে। অতঃপর হাতের নিচের
মাংসে ছুরি চালায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। বরং মেহেরুন নিজেই রক্তের নদীর ভেতর
ডুবে যেতে থাকে। বাইরের তখন আলো প্রায় নাই। সূর্য কি হঠাৎ ডুব দিয়েছে তুরাগের জলে? মেহেরুনের এতসব ভাবনার
ভেতর দিয়ে বয়ে যেতে থাকে মুকাজ্জেলের মোবাইলের নতুন সিমের নাম্বার, যা তাকে টংঘরের চায়ের
দোকানদার দিয়েছিল। তার মনে পড়ে ম্যালদিন সে মুকাজ্জেলের খোঁজ করতে পারে নাই। মনে
পড়ে মুকাজ্জেলের বিরক্তিসূচক বাক্য-
‘মাইয়ামানুষ নিয়া মুশকিল।
কাজ-কাম-নাইক্কা সারাদিন খালি ফোন টিপে।’
এইসবের ভেতরও মেহেরুন নিজের শরীরের ত্বক-মাংস ক্রমাগত কেটে চলে। আসলে সে
মুকাজ্জেলের রক্তপাত থামাতে চায়। কিন্তু মেহেরুন অবাক-বিস্ময়ে দেখে বকের ফইড়ের
স্তুপ ডুবিয়ে দিয়ে বুদবুদ করে রক্ত উপচে উঠছে। উঠছে তো উঠছেই। তার তাদের নৌকাও
বাতাসের টানে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে।
কালবৈশাখী না দামাল হাওয়ার তোড়ে বটের ছিন্নভিন্ন পাতারাশিও তখন নদীর জলে
ভাসমান। তাদের সাথে মেহেরুনও একসময় ভাসতে শুরু করে। শরীর উজাড় করে বকের পালকে
মুকাজ্জেলকে ঢেকে দেয়া সত্ত্বেও কোনো সাড়া
পাওয়া যায় না। কিন্তু মুকাজ্জেলতো মেহেরুনকে বলেছিল-
‘বগের ফইড় লাগাইয়া দিলে
রক্ত পড়া থাইমা যায়।’
তবে কি মুকাজ্জেল ভুল বলেছিল?
ভুল অথবা শুদ্ধের ভেতর তুরাগের জলে স্রোত বাড়ে। তুখা স্রোত ।
পরদিন তুরাগের এই তটরেখায় জিন-ভূতের কিসসার সঙ্গে আরো একটি ধন্দ যুক্ত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ