মানস চৌধুরী
আমি হিসেব করার চেষ্টা করি মায়ের বানানো কত নম্বর সোয়েটার এটা। মানে
আমি যখন থেকে মাকে সোয়েটার বানাতে দেখি। দিদিমা বলেছেন, মার
অভ্যাস সেই কিশোরী বেলা থেকে, যখন স্কুলে পড়েন। বছর কয়েকের সাক্ষী
আমার বাবাও। আর আমার কাল হচ্ছে যখন থেকে জ্ঞান। তারপরও হিসেবটা
সোজা নয়। মা প্রচুর সোয়েটার বানিয়েছেন। পয়লায় ভাইবোন-স্বামীর জন্য,
তারপর পাড়াপড়শি। পাড়াপড়শির বরাতে পরে নতুন বুনন শিক্ষার্থী। শেষে
মায়ের সন্তানেরা। মানে আমার বোন আর আমি। প্রতিটি গরমের মৌসুম ধরে
মায়ের সোয়েটার বানিয়ে চলা। আর শীতের মৌসুম আসবার আগেই সেগুলো
বিলি বণ্টন। ভাইবোন, সন্তান কিংবা পড়শি। আমার
মনে হয় এবারের
সোয়েটারটা আমার জন্য বানানো মায়ের সাত নম্বর। হতে পারে। আবার
বেশিও হতে পারে। সর্ষে ফুলের থেকে অনেক ঘন একটা হলুদ রঙ। তার মধ্যে
কালো দুইটা ডোরা দাগ। এই দাগ দু’টা দিতে অনেক কসরত করতে হচ্ছে
মাকে। খাড়াখাড়ি বলে। আর বুক পর্যন্ত গলা চেরা। অনেকটা টি-শার্টের মত।
একটা পকেটও আমার খায়েশ। মাকে ঘন ঘন আলাপ করতে হচ্ছে আমার সঙ্গে
আমি আসলে ঠিক কিভাবে সোয়েটারটা চাচ্ছি। আমার সর্বশেষ সোয়েটারটাতে
আরও সময় আর মনোযোগ নিয়োগ করেছেন তিনি। তাঁর মুখের স্মিত হাসি
আর ক্ষিপ্র হাতে সোয়েটার বোনা দেখে আমার মনে হয় তিনি এবার আমার
আগ্রহ জয় করবার সনিড়বকটে আছেন।
সর্ষে ফুলের চেয়ে ঘন বললে এই হলুদটাকে প্রায় বোঝাই যায় না। প্রায়
লক্ষ্মী প্রতিমার গায়ে যে হলুদ রঙটা করা হয় সেরকম। বাসন্তী রঙ বললে
হয়তো বোঝা যায়। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে বাসন্তী রঙ বলতে লোকজন এত রকম
রঙ বোঝে যে শেষে রঙটা আর নির্দিষ্ট করাই এক কঠিন কাজ। অবশ্য এটাও
ঠিক যে লক্ষ্মী প্রতিমার রঙ বলেও তেমন কিছু বোঝানো সহজ নয়। আমি
নিজেও কতটা স্মৃতি থেকে আর কতটা কল্পনা থেকে এই তুলনা টানি তা এক
রহস্য। লক্ষ্মী প্রতিমা তো দেখি না সেই কবে থেকে! কত হবে? দুই যুগেরও
বেশি। রঙটা হবে হলুদ-বাটা হলুদ। পাটার উপর প্র মে শুকনো হলুদ রাখতেন
মা। একটু ভিজিয়ে নাকি ধুয়ে! তারপর পুতাকে খাড়া করে ধরে একপ্রান্ত দিয়ে
বার কয়েক পেটাতেন হলুদের দানাগুলোকে। পাটা থেকে ছিটকে পালাতো সেগুলো।
মা আবার
তুলে ধুয়ে বা ভিজিয়ে পাটার ওপর রাখতেন। আবার
পেটাতেন। পাশে ধ্যাবড়া মেরে বসে, কিংবা পিঁড়ি-পাছায় আমি অনেক কথা
জিজ্ঞেস করতাম মাকে।
‘এগুলোকে পেটাও কেন তুমি?’
‘ছেঁচি বাবা!’
‘ছেঁচ কেন? না ছেঁচে বাটতে পার না?’
‘না ছেঁচলে বাটতে তো কষ্ট
হবে।’
‘এগুলো পড়ে যায় কেন?’ একটু থেমে আমি আবার
জিজ্ঞেস করি।
‘পিছলে যায় সোনা।’
‘আচ্ছা ছেঁচলে তোমার বাটতে
কষ্ট হয় না, না!’
এবারে মা আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন। আর পাটাপুতার শব্দ একটানা
সুরের মত বাজতে থাকে। অনেকটা ধাতব মাদকতা। আবার ধাতব নয়, পাথুরে
শব্দই কেবল। ঘষতে ঘষতে শব্দটা বাড়তেই থাকে। মা আবার আধবাটা হলুদ
গুছিয়ে পাটায় জড়ো করেন। পুতা চালালে এবারে শব্দটা প্রমে কম থাকে।
তারপর আবার বাড়তে থাকে। মার চোখ নিজের দুইহাতের দিকে, পাটার
দিকে, হলুদের দিকে। এই সময়টাতে
মা বোধহয় কিছু ভাবেন। ভেবে নেবার
সময় হিসেবে ওই একটানা ধাতব বা পাথুরে শব্দের আবহটাকে মা বেছে নেন।
অনেক বার কথা বলতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে। না, তখন মনে হয়নি। পরে
অনেকবার ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে। তারপর হলুদ কিংবা অন্য কিছু
বাটা শেষ করে মা হাতের তালু দিয়ে জড়ো করতেন। কখনো কখনো
আঙুলগুলো দিয়ে। সবশেষে সুপুরি গাছের খোলের টুকরো দিয়ে খসখস শব্দে
হলুদ-বাটা শেষ। মাঝে মাঝে আঙুল দিয়ে জড়ো করতে গিয়ে চকিতে হাত
টেনে নিতেন মুখের কাছে। মায়ের হাতের নখগুলো তখন হলুদে মাখামাখি।
মায়ের কি সাদা নখ কখনো ছিল? সম্ভবত ছিল। ছোটবেলায়। মানে মায়ের
ছোটবেলায়। সবারই তাই থাকে। কারো কারো বেশি সাদা। আর কারো কারো
লালচে একটা আভা, গোলাপি রঙের নখ। আমার
মায়ের নখ সবসময়েই
হলদেটে দেখেছি। কিন্তু সেটা আবার অন্য হলুদ। নখগুলো সব ক্ষয়ে ক্ষয়ে
ভেতরের দিকে বেঁকে গেছে। বিশেষ করে তর্জনী আর মধ্যমা। ক্ষয়ে, আর
পাতলা হয়ে, আর ভেতরের দিকে ঢুকে
ওগুলো পাশের মাংসপিণ্ডকে নাজুক
করে দিয়েছে। এক এক দিন মা পাটা থেকে চকিতে হাত তুলে অস্ফুটে বলতেন
‘উহ!’ আর পাশের বাটিতে তখন ঘন
রঙের বাটা হলুদ। নখের মত নয়। ঘন
উজ্জ্বল হলুদ, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
আমার হলুদ সোয়েটারটার মত।
কিন্তু এগুলো বহু আগের কথা। হলুদ সোয়েটার ঢের ঢের পরের কথা। মা
এখনো পাটায় বাটেন। কিন্তু সেই দৃশ্য আমার মনে জড়ো হয় না। জড়ো হওয়া
দৃশ্যাবলী পুরনো।
বুনন শিক্ষার্থীরা মায়ের দারুণ মনোযোগী। নিবিড় কৌতুহলে নতুন নতুন
পাঠ নিত। মার হাত তখন উলের কাঁটা আর উলে আসা যাওয়া করছে। আর
একবার কাঁটার সরু প্রান্ত উঠে যায় উপরের দিকে মুখ করে, আবার নেমে
আসে। আবার ভোঁতা প্রান্ত উঠে যায় তখন। যখন ডান হাতের কাঁটা উপরের
দিকে ওঠে, তখন বাম হাতের কাঁটা
নামে। এভাবে দ্রুত, μমশ আরো দ্রুত,
কিন্তু ভীষণ ছন্দময়। আর মা তখন স্মিতমুখে দুইটা ঘর রাখেন, আর একটা ঘর
ছেড়ে উল্টো করে তোলেন বা এরকম কোনো নিয়ম। নিশ্চিত স্মৃতি তাঁর। ছন্দে
তাঁর যতি পড়ে না। বরং গতি বাড়তে থাকে শুধু। তাঁর ছাত্রীদের চোখ তখন
নিবিষ্ট মায়ের আঙুলগুলোতে। আর তাঁর আঙুলের ডগায় নখ। ক্ষয়ে ক্ষয়ে
ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া। মায়ের ছাত্রীদেরও অনেকেরই নখ তাঁরই মত।
এক একটা দিন তাদের আলোচনা ছিল নখ নিয়ে। মশলা বাটা আর হেঁশেল
ঘরের কাজ তাদের। এই এক নখের ঐক্য। কিন্তু উল বুনতে বুনতে, বোনা
দেখাতে দেখাতে, আর বোনা দেখতে দেখতে
তাদের মধ্যে কখনো নখ নিয়ে
আলাপ চলে না। চলে উল আর বুনন নিয়ে।
‘দিদি, আপনার উল দেখে মনেই হয় না
পুরাতন। একদম নতুনের মত
ঝলমল করছে।’
উলের পরিচর্যা নিয়ে মায়ের তারিফ করেন তাঁরা। আর মা, আবারো স্মিত
মুখে, সেই তারিফ পৌঁছে দেন
বাবাকে।
‘আমার তো কিছুই করতে হয়
না। ওদের বাবা তো মেয়েলোকের থেকেও
বেশি। কেনা, খোলা, ধোয়া, দলা বানানো সবই তো উনিই
করে। আমি বুনলেই
উনি খুশি।’
মুগ্ধভাবে পুরাতন কথাগুলোই শুনতে থাকে মায়ের ছাত্রীরা, তাঁর বুনন
ছাত্রী। এই এত বছর বাদেও পুরাতন সোয়েটার তাঁদের কাছে নিক্সন। যুদ্ধের
কথা ভোলেননি তাঁরা, ভোলেন না সহজে। সেই
স্মৃতি আর এত কদরের
পুরাতন সোয়েটার, আর তার উল কিভাবে একত্রে
নিক্সন শব্দ হয়ে তাঁদের
মাথার মধ্যে ঘোরে তা দৈনন্দিন এক বিস্ময়। রঙ বাছাই প্রায় সময়ে মা-ই বলে
দিতেন। একেক দিন বাবা চটের ব্যাগে করে এতগুলো পুরাতন সোয়েটার এনে
ফেলতেন মেঝেতে, যেটাতে পা ফেলতেও ভারি
কষ্ট। আর সঙ্গে ধারাবর্ণনা।
‘আর এটা বুঝলা...এটা হলো
বটল গ্রীন, একটা চকলেট কালারেরও
আনলাম...খয়েরিটা দেখ না...এটাতে ওর অবশ্য মানাবে না। ভাবলাম নিয়ে
আসি। ফেরৎ তো দেয়াই যাবে। নিজে পছন্দ করে নাও।’
বাবার ইংরেজিতে রঙবিদ্যা বেশিদূর এগোয় না। কিন্তু কোনো পক্ষেরই
তাতে খুশির কোনো কমতি হয় না। পরম হাসি মুখে নিক্সনের সোয়েটার
দেখতে থাকেন তাঁরা। বাছাই করতে থাকেন কোনটা নেয়া হবে। এতগুলো
কিনে আনা হয়নি। বাছাই করে না নেয়া গুলো ফেরৎ দিয়ে আসা হবে। শুধু রঙ
পছন্দ হলেই তো হলো না! উলটা কেমন, ধুলেই কি চকচকে ভাবটা ফিরে
আসবে--নানারকম শলাপরামর্শ করা
লাগে। সবচেয়ে বড় ঝামেলা হচ্ছে কিছু
সোয়েটারে উল কাটা থাকে। সেগুলো খুললে টুকরা টুকরা উল আসে। কাজ হয়
না। ফলে খুব মনোযোগ দিয়ে সেলাই দেখতে হয়। বাছাইটা একটা দীর্ঘকালের
কাজ। আর দুইটা মানুষের পরম উত্তেজনার, আমাদেরও। পাশে দাঁড়িয়ে
কোমরে হাত রেখে কিংবা হাঁটু গেড়ে নেড়ে চেড়ে।
‘ধুলা কিন্তু, হাঁচবি!’ সতর্ক করে দেন মা।
নিক্সনের ভিড়ে হলুদ বাটা হলুদটা চোখে পড়তেই চনমন করে উঠলো মন।
এইটাই না? এইটাই তো খুঁজছি। ততক্ষণে
মায়েরও চোখ আটকেছে সেটাতে।
টেনে বের করেছেন উপরে। পোকাগুলোরও তেমনি। চোখ টানে। হলুদ বাটা
সোয়েটার পরে যখন ঘুরছি সেই শীতে, গাদা গাদা পোকা। রাস্তার পাশে
পাটখড়ির বেড়া। বেড়ার ওপারে শীতের সর্ষে, ফুলে হলুদ হয়ে আছে সব। তার
ওপর খই ফোটার মত পোকা। পাশ দিয়ে সোয়েটার পরে যেতেই একগাদা
দলছুট পোকা ছুটে আসে। নাকে মুখে উড়তে থাকে। তারপর সোয়েটারে এসে
এতগুলো বসে থাকে। সেই সমেত ঘরে ফিরি আমি। মাঝে মাঝে চোখ জ্বালা
নিয়ে। উড়তে উড়তে বেহুঁশ পোকারা চোখের মধ্যে বসে। বসেই মরে যায় আর
আমায় জ্বলিয়ে মারে। বানানোর পর বাড়িতে যে কদিন পরেছি সোয়েটারটা।
‘দ্যাখ। এই হলুদটা দ্যাখ।
হলুদ হলুদ করছিলি না!’
মা আবিষ্কারের উত্তেজনায় ভুরু কুঁচকে তাকান আমার দিকে। হাতে তাঁর
হলুদ বাটা হলুদ উলের সোয়েটার। ওঁরা বলেন জাম্পার। নিক্সনের হলে
জাম্পার। আর সেটা খুলে আবার বানালে সোয়েটার। বাবাও পরম আগ্রহ নিয়ে
ত্যারছা ঘাড়ে তাকিয়ে থাকেন। আবিষ্কারটা প্র মত তাঁর। আমিও কিন্তু ভুরু
কুঁচকে তাকাই। জাম্পারের দিকে তাকাই। যথাসম্ভব দ্বিধাগ্রস্ত আমার মন। ঠিক
এই হলুদটাই আমি খুঁজছি কিনা! ঠিক এই রঙটাই আমি বেছে নিলে আরও ভাল
কোনো রঙ খুঁজে পাওয়া থেকে বঞ্চিত হব কিনা! হাজার হলেও আমি ঠিক
বাছাই করছি কিনা সেটা নির্ভর করে সোয়েটারটা পরার পর বন্ধুরা কী বলে তার
ওপর। এত আগে এইসব সম্ভাবনা নিয়ে ভেবে ভেবে আমার দ্বিধা কিছুতেই
কমে না, বাড়তেই থাকে। মায়ের আগ্রহ
উলের ভালমন্দ নিয়ে। ধুলে কেমন রঙ
হবে, রঙ থাকবে কিনা। বুনতেই বা
কেমন লাগবে। ৮ নম্বর কাঁটা আর ১০
নম্বর কাঁটার মধ্যে কোনটা ঠিক হবে এসব নিয়ে বাবার সঙ্গে তাঁর অকারণ
পরামর্শ চলতে থাকে। এসব ক্ষেত্রে বাবার জ্ঞান নগণ্য। কিন্তু মার তাতে কিছু
এসে যায় না। তাঁর স্বগতোক্তিতে চলে না। নতুন আরেক সোয়েটার বয়নের
উত্তেজনা তখন তাঁর চোখে মুখে। হয়তো শ্রান্তিও। কীজানি!
যখন ইত্যাকার পরিকল্পনা শেষ, তখন আমার দ্বিধা প্রায় শঙ্কার আকার
নিয়েছে। এই তো কেনা হলো বলে! এরপর? এরপর কী হবে? আমি সর্বশেষ
সুযোগে ভুল না করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাই। নিক্সনের স্তূপ থেকে
অস্থিরভাবে এটা ওটা টেনে বার করি। এমনকি অর্থহীন যে লেজটা বেরিয়ে
আছে সেটাও টেনে উপরে তুলি। দোকানে যে এর থেকে ভাল রঙগুলো থাকতে
পারে সেই সম্ভাবনা ঘোষণা দিতে থাকি। আমার স্বগতোক্তি দাবির মত শোনাতে
থাকে। নিজের কানেও। তাতে আমি খানিক খুশিই হয়ে উঠি। আমার বিপণড়বতা
যে ক্রোধের আকার নিয়েছে তাতেই
আমি খুশি। আর তাতে বিপনড়বতাটা বাবার
ভেতর সংμামিত হয়। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছেলের জন্য সবচেয়ে ভাল
উলটা তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি এই বিপনড়বতা। তিনি অবশ্য স্বগতোক্তিই
করতে থাকেন। কয়টা দোকান ঘুরে তিনি সবচেয়ে ভাল উল নিয়ে এসেছেন।
সেটাই তিনি বলতে থাকেন। প্রায় বিড়বিড় করে।
বাইরে উঠানে টানা তারের উপর কাপড় শুকায়। তার পাশে গুঁড়া সাবানে
ধোয়া জাম্পার খোলা নিক্সনের উল সকালের রোদে ঝুলতে থাকে। সেই রোদের
হলুদ আলোয় হলুদ বাটা উল আমার নজরে ধরে। আমার সেদিনের দ্বিধা নিয়ে,
ক্রোধ নিয়ে কিছু বিব্রত হই।
মাকে আর বলা হয় না আমার সে কথা, বাবাকেও
না। শুধু আমার প্রগল্ভতায় মা আন্দাজ করে নেন।
পরের বার যখন বাড়ি গেছি, ১০ নম্বর কাঁটায় তখন হলুদ বাটা উলের
সোয়েটার বোনা হতে থাকে। আমার জন্য মায়ের সাত নম্বর সোয়েটার। রঙটা
তখন আমার দ্বিধা পুরা জয় করে ফেলেছে। মায়ের মুখে স্মিত হাসি। মা উল
বুনে চলেন। টুকরো টুকরো কথায় না দেখা জগতের খোঁজ নেন। যে জগতে
তাঁর ছেলে এই সোয়েটার পরে ঘুরে বেড়াবে। জগৎটা তাঁর অচেনা।
একেবারেই। আর এই জগতেই তাঁর সোয়েটার ঘুরবে। তাঁর সৃষ্টির
দর্শকমণ্ডলী। তাঁর সৃষ্টির জগৎ।
‘তোর বন্ধুরা দেখে কী বলবে?’ মা জিজ্ঞেস করেন।
‘ভালো বলবে।’ আমার খুবই সংক্ষিপ্ত
উত্তর। মা আমার দিকে তাকিয়ে
থাকেন।
‘ওদের সবার মা সোয়েটার
বানাতে পারে?’ একটু থেমে থেমে মা জানতে
চান।
‘কী করে বলব? এটা কি জিজ্ঞেস করা যায়?’
‘কেন, ওরা শীতে কী পরে? সোয়েটার পরে না?’
‘জ্যাকেট পরে, ব্লেজারও পরে।’
মার মুখে ভুরু কোঁচকানো জিজ্ঞাসা। শূন্য চোখে মা দেখে নেন সেই
পোশাক মনে মনে। সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছেলের বয়েসি ছেলেরা। হাস্য, লাস্য,
হল্লা, হুল্লোড়, গায়ে তাদের জ্যাকেট আর বে−জার।
‘বে−জারটা আবার কী?’
আমার ব্যাখ্যা শুনে আবার বলেন:
‘ও, কোট।’
তারপর খানিকক্ষণ চুপ। তারপর উলের দিকে আর কাঁটার দিকে তাকিয়ে
থেকে প্রায় নিজের কাছে জানতে চান:
‘শাল সোয়েটার কি উঠেই গেল
দেশ থেকে!’
‘শাল মা একেবারে সেকেলে
হয়ে গেছে।’
‘মেয়েরা নিশ্চয়ই পরে।’
খানিকক্ষণ ভেবে মা এবারে স্পষ্ট গলায় বলেন। আমি না করতে পারি না।
মা এবারে মনে মনে তাঁর প্রশড়ব সাজিয়ে নেন। যে বিষয়ে আলাপ চলছে তাতে
মার আরো কিছু জানার বাকি।
‘জ্যাকেট আর কোটের অনেক
দাম না?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক দাম।’
‘ঢাকাতেই পাওয়া যায়?’
‘কী যে বল না মা!’
নিজের অজ্ঞতায় মা খানিক অস্বস্তিতে পড়েন। তারপর আবার অনেক ক্ষণ
চুপচাপ। আমি বইয়ের পাতাতেই চোখ পেতে থাকি। মাকে মাঝে মাঝে দেখি।
একটু আড়াল চোখে। কিসে যেন মগড়ব হয়ে আছেন।
‘কেউ কেউ নিশ্চয়ই সেকেন্ড
হ্যান্ড পরে, নারে?’
‘তা দু’এক জন পরে বোধহয়।’ এ ব্যাপারে আমার নিশ্চিত
জ্ঞান থাকলেও
মার কাছে সেটা খোলাসা করি না।
‘ওদের মা যদি সোয়েটার
বানাতে পারতো তাহলে হয়তো সোয়েটারই
পরতো।’
তাঁর গলায় এবার নিশ্চিত øেহ আর সন্তোষের ছোঁয়া,
মমতাও। এই
সূত্রেই
মা আরো কিছু বলবার আগেই আমি তাঁর ভুল জ্ঞান নিমেষে শুধরে দিতে ব্যস্ত
হয়ে উঠি।
‘মা, বানানো সোয়েটার তো কেউ
পরে না আজকাল। অনেকের মা-ই
সোয়েটার বানায়।’
এরপর তাঁর মাথায় বা মুখে তেমন কিছুই আসে না। একটা বোবা বোবা
চাউনি দিয়ে তিনি কাঁটার দিকে দেখেন। আবার আমার মুখের দিকে দেখেন।
আমার গলার স্বর বুঝবার চেষ্টা করেন।
‘তুই যে বললি সোয়েটারই পরে
না!’
‘ওগুলো তো পুলওভার!’ জোর দিয়ে বলি আমি।
‘ও, কেনা সোয়েটার। দেখতে ভাল
লাগে?’
‘দারুণ! খুবই সুন্দর সব
ছাপা থাকে।’
‘মেশিনে বানানো কত সুবিধা!’ এই কটা কথাই বলেন মা।
বাইরের রোদ যখন আরেকটু ধরে এসেছে মা তখন শুয়ে শরৎচন্দ্রের বই
নিয়েছেন হাতে। সোয়েটার বানানোর নেশা চেপে গেলে মা দুপুরে প্রায় সজাগই
থাকেন। রানড়বাক্লান্ত মা প্রতি দুপুরে একটু শুয়ে নেন। বই পড়েন। সোয়েটার
বানানোর কালে বই পড়াটা সোয়েটারে দেন। আজ আবার বই নিয়েছেন। কিন্তু
পড়লেন না তেমন। খানিকক্ষণ ছাদের দিকে চেয়ে চেয়ে নানারকম দৃষ্টি
দিলেন। আড়চোখে আমি সে দৃষ্টি পাঠ করি না।
‘তোর মনে আছে তোকে একটা
বেড়াল-অলা সোয়েটার বানিয়ে
দিয়েছিলাম? তোর ছোটবেলায়।’
তার উত্তরে আমি কেবল হ্যাঁ বলি।
**
হলুদ বাটা সোয়েটার নিয়ে এরপর আমার সঙ্গে মায়ের আর দুইবার আলাপ
হয়। মা বলেন দুইবার, আমি একবার। প্রম বার ঘটে
পরের শীতে যখন বাড়ি
আসি।
‘তোকে তো সোয়েটারটা পরতে
দেখি না বাবা! পরিস ইনিভার্সিটিতে?’
‘হ্যাঁ পরি তো!’
আমার স্বরে মা আর কিছু জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেন না।
পরের বার প্রায় শীত শেষে আমি যখন জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বাড়ি ফিরি মা
আমার দিকে তাকিয়েই থাকেন। প্রতিবারই বাড়ি আসবার সময় দরজায় ঢুকবার
মুখে মা আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকেন। এবারেও। কিন্তু আমার
মনে হয় মা এবারে আমার জ্যাকেটের দিকে চেয়ে রইলেন। ঢাকায় ফিরবার
দুইদিন আগে মা আমার সঙ্গে সোয়েটার প্রসঙ্গে আবার আলাপ তুললেন।
তুলবার আগে দু’বার সামনে দিয়ে ঘুরে
গেলেন। তারপর প্রায় ছাদের দিকে
তাকিয়ে কথা বললেন:
‘তুই যদি সোয়েটারটা না
পরিস বাবা, আমাকে কি দিয়ে দিবি?’
আমি মার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে রাজি হই। বেশ দ্রুত। এই সম্মতিতে
মাকে ঊচ্ছ্বসিত দেখায় না।
‘উলটা বেশ ভাল। খুলে আবার
বানানো যাবে। চোখের যে অবস্থা, কদিন
আর বানাতে পারব!’
এবারের কথাগুলো মা মশারীর স্ট্যান্ডে ঝোলানো জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে
বলেন।
0 মন্তব্যসমূহ