চাঁদের ব্লেড


কাজল শাহনেওয়াজ

প্রাক.

চাঁদপুরকে দেখেই মনে হয়েছিল:
আসলে ভালো করে তোমাকে খাওয়াই হয় নি
তাই তো ভালোবাসা চোঁয়া ঢেঁকুর হয়ে উঠছে...

যারা পাগলাঘাট থেকে ষাটনল পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে আসে, তাদের দুর্ভাগ্যের
কথা কাকে বলব? কোন ব্যাঙকে?
দেখার আগমুহূর্তেও মনে হয় নি এরকম কিছু Ñ ঘনিষ্ঠ কারো সাথে দীর্ঘদিন
পরে দেখা হওয়ায় যে পরিমাণ এড্রিনালিনের জল উদ্দীপনার জিভে আসতে
পারে, তাই আসবে। আরো দুচারবার অন্যদের সাথেও এমন হয়েছে Ñ সেই
স্মৃতিও মনে আছে Ñ সেরকমই তো !

চাঁদপুর যেতে হচ্ছে শুনে অনেকেই অনেক উপদেশ দিতে শুরু করল Ñ যা
চিরদিনই আমার বিরক্তি ধরায়। তবুও তাদের উৎসাহের দিকে তাকিয়ে
থাকলাম।
ব্যাঙ্গল, ব্যাঙ্গল, ডাকাতিয়া, জ্ঞা, জ্ঞা, জ্ঞা, জ্ঞা . . .
একটা সিঙ্গেল কেবিন, একটা নদী সঙ্গম, একছাড় বিস্তীর্ণতা, ঢাকা থেকে
চারপাঁচ ঘণ্টার জার্নি। সদরঘাট ছাড়লেই ডেকচেয়ারে হেলান, নদীর বুক
থেকে ঢাকা শহরের দিকে তাকিয়ে Ñ সবকিছু অচেনা হোক Ñ অন্ধকারের
সাথে নগরের আলোর নানারকম কারসাজিতে সবকিছু রূপকথা হয়ে যাচ্ছে;
মাথার উপরে বুড়িগক্সগা ব্রিজ এলেই বাতাসের পরিবর্তন টের পাওয়া যায় Ñ
হঠাৎ করেই শ্বাস নেবার কষ্ট কমে যাবে, বাতাস হাল্কাপাতলা Ñ বোঝা যায়
পিওর, গায়ের রং কিছুটা শ্যামলা, মুখমণ্ডল নিরাকার, ম্বায় আকাশছোঁয়া,
নিজের ভাষা ছাড়াও পৃথিবীর সকল ভাষায় কথা বলতে পারে - নিজে হারায়
না কিন্তু অন্যকে হারাতে সাহায্য করে Ñ হঠাৎ দমকায় ইট ভাটার বাতাস ঢুকে
পড়ে, ভোঁ ভোঁ করতে করতে পাশ কাটিয়ে যায় হুলার হাট থেকে আসা একটা
দোতলা Ñ ওটার সার্চলাইট আলোর ফিতা দিয়ে একবার মেপে নেয়
আপাদমস্তক আমাদের লঞ্চটাকে, যেন দর্জি এসে মাপ নিচ্ছে বড় নদীতে
ভ্রমণের নৌকোট বানাবে বলে।
চাঁদপুর যাওয়া ভারি সহজ :
(আইটিনারারি)
সন্ধ্যা ৬.৩০ জাহাজে ওঠা ঐতিহাসিক বেঙ্গল ওয়াটাওে কোনো এক সময় ষাটনল মহান নদীসঙ্গম, চারদিকে ধুধু, এগারোফোবিয়াকদের জন্য মৃত্যু যন্ত্রণা
রাত ১১.৩০ ঘাটে নামা মধ্যরাতের শহরে কিছু মহান নিশাচর পাশ কাটিয়ে যাবে তারপর সোজা বিছানায় কমরেড আগামী সকালে নদীর ঘুম ভাঙবে
কি? একঘুমে রাত পার করে সকালের কাজ শুরু Ñ কোন সময় নষ্ট নাই, ক্লান্তি
নাই Ñ একহারা ভ্রমণ ও কাজ ও ফিরে আসা Ñ কিন্তু গাড়ি নিয়ে যাবো যে, ওখানে চলাফেরা করতে হবে না?
বুদ্ধি হল : ড্রাইভার পরদিন খুব ভোরে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে এগারোটার মধ্যে পৌঁছাবে Ñ আর আমি রাতে পৌঁছে ওয়াটার বোর্ডেও রেস্টহাউসে উঠব।

প্রথম দিন
ঢাকা থেকে ফোনে ঠিক করে রাখা কর্মকর্তাদের সাথে কতগুলি
সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করি প্রথম দিন। মজনু গাড়ি নিয়ে এগারটার মধ্যেই
পৌঁছেছে। খুব বেশি সমস্যা হয় নাই স্যার। একা একা গান গেয়েই আলাম--
বলতেই বুঝলাম চাঁদপুরে ওর গানের কদর হবে। ও হল ক্ষ্যাপা গায়ক, লোকে
শুনলেও গায়, না শুনলে আরো বেশি! বকালে কৃষি কর্মকর্তার সাথে অ্যাপো. ছিল। জরুরি কাজে ভদ্রলোক হঠাৎ ব্যস্ত হওয়ায় লোক পাঠিয়েছেন। আজকের সাক্ষাৎ আগামীকাল সকালে নিলে অসুবিধা হবে কি? ভদ্রলোকের কাজে সভ্যতার আলো দেখতে পেয়ে চমৎকৃত হলাম। যে করেই হোক আগামী সকালে সময় বের করব। যদিও সবকিছু আগেই ঠিক করে রাখা।

বিকালে কাজ না থাকাতে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেবার জন্য রুমে সংক্ষিপ্ত
উপশয়ন। দোতলা পূর্বমুখী এ দালানটার পোর্টিকোর ওপরটা জাহাজের
ফোরক্যাসলের মতো Ñ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ নয়
আমিই চলেছি য়ুরোপ যাত্রায় ডেক চেয়ারে বসে।
চোখের সামনে ঢাকাগামী হাইওয়ে, দেখা যায় উত্তর-দক্ষিণ বরাবর
রাজধানী পথ।
পুরো অঞ্চলে এই কয়েকশ মিটার পথেই প্রাণচাঞ্চল্য! আর সব ঠাণ্ডা। সব
সাপ-ব্যাঙ-ঝিঝির আণ্ডা। রাতে অন্ধকারের, দিনে উপজেলার সরকারী ঝাণ্ডা
Ñ পতপত করে ওড়ে সব নৈ:শব্দের পাণ্ডা।
সন্ধ্যার আগে একটা রিকশ নিয়ে ইতস্তত বিচরণ করতে বেরোলাম।


নদীর ঘাট ও নদী
শোনরে টাকি চন্দ্রবিন্দু একাত্তুরের ফাঁকি
ফাটকি দিয়ে দেখা গেল টাট্টিখানার ঝাঁকি
উল্টা বাদুর পুল্টা রাদুর জুতার মাপে পা
আকাশ থেকে নেমে এল কাহিল জনতা
হারিয়ে গেল পথের ভিড়ে উদ্দেশ্যহীনতা

সন্ধ্যাটা একদম মুফতে পাওয়া। কর্মক্রমের বাইরে। সাধারণত ঢাকার
বাইরে এলে নৈশভোজের আগ পর্যন্ত সারা দিনের কাজের খতিয়ান লিপিবদ্ধ
করায় লিপ্ত থাকি, টিমের বা একার । মজনু ড্রাইভারকে রাতের জন্য ছেড়ে
দিলাম। ঢিলা কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছি। ভাবতে হল না, রিক্সালা নদীর দিকে
নিয়ে গেল।
বাতাসে নদীর ঘামের গন্ধ পাচ্ছিলাম। এখানে নদীর ক্ষুধা খুব কুখ্যাত Ñ
ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী স্বভাবের। এখানে পদ্মা+মেঘনার মিলিত ধারায় ডাকাতিয়া
বিয়োগ হওয়ায় দেয়ায় যে ঠোডা তৈরি হয়েছে তাতে প্রচণ্ড ঘুর্ণাবর্ত। উমত্ত
ঢেউয়ের তাণ্ডবে মানুষের কানড়বা নৈমিত্তিক, ভাঙন এখানে অবধারিত। এখন
যদিও নদী শান্ত, কিন্তু আমি তার নিষ্ঠুর কামড়ের শব্দ পাচ্ছিলাম...।
কিন্তু তারপরও সব শান্ত। ভাবছিলাম নদীর ভিতর সেই গাজির আস্তানা
আছে তো? এও এক আশ্চর্য বিস¥য় এই মাজারের টিকে থাকা। স্থানীয়রাএকে
মনে করেন অলৌকিক। যদিও পানি বোর্ড কোটি কোটি টাকা খরচ করে যাচ্ছে
ম্বচ্ছর কিন্তু নদীর মন ভরে না। শুধু এই মাজারের কাছে এসে ওর লকলকে
জিভ কিছুটা নরোম, সরু লম্বা একটা চিকন পথের সুতা ধরে রেখেছে ছোট্ট
ভূখণ্ডটাকে Ñ অন্ধকারে আলো জ্বললে দূর থেকে ফ্রেমে বাঁধানো জলে ভাসা
পদ্ম মনে হয়।
ভেবেছিলাম দুএকটা পাগলা বাবার সাক্ষাৎ হবে এখানে। দেখা গেল
মানুষই কম আজ। বিগত ভাঙনে বাজারের একটা বড় অংশ গর্ভে খসে গেছে Ñ
রেলেরও ক্ষতি হয়েছে বিস্তর, ইলিশ-পাইকারদের বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে Ñ
মোটকথা একটা বিশাল বিপর্যয় স্থানীয়বাণিজ্যে Ñ সর্বত্র তার ছাপ। ঘাটে
(+স্টেশনেও) জোরে ক্যাসেট বাজানো Ñ আলো ঝকঝকে Ñ ঢুকতেই পরোটা
ভাজতে থাকার দৃশ্য - ম্যানেজারের ক্যাশ বাক্সের পাশে কাঁচঘেরা মিষ্টির
স্তেপস সাইনবোর্ডে খাসি, মুরগি ও ইলিশ আঁকা রেস্তোরাগুলি সংখ্যায় কমে
গেছে। যে কটা আছে তার বাতিই ঠিকমতো জ্বলছে না। কারা যেন মেঘনার
গভীরতার দিকে মুখ করে বেঞ্চ পেতে রেখেছে। সূর্য ডুবে গেছে, দিনের
আলোও নিভে গেছে, খালি বেঞ্চি দেখে একটু বসি।
বসেই মনে হল: কত দিন পরে বসলাম!
নদীটাকে মনে হচ্ছিল, দেখার জন্য সাজিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যার পরের
একটু একটু বাতাস। নদীতে মন্দমন্দ ঢেউ। নদী সম্পর্কে ছোটবেলার অনুভূতির
কথা মনে করতে চাইলাম। কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। আবার
বর্তমানের কথা ভাবতে চাইলাম। তাও তেমন কোনো গভীর কিছু ভেসে উঠল
না। এলোমেলো, আবছা - কেমন যেন গুমোট গুমোট, মনের পেট ফেঁপেছে
আরকি।
লোকজনের বিক্ষিপ্তভাব। মশা কামড়াচ্ছে। উঠে পড়লাম। খুব বেশি সময়
যায় নি। জেটিতে ঢুঁ মারলে কেমন হয় Ñ স্টিমারঘাটে? এখনো লঞ্চ আসা শুরু
করে নাই। একটা মৃদুমন্দ চাল। দূর থেকে আসা, বিশেষ করে কানেকটিং
ট্রেনের যাত্রীরা সুবিধামতো জায়গা করে নিয়ে অপেক্ষারত। চা দোকানী
অতিরিক্ত খাতির করল পরপর দুপেয়ালা চা পান করার পর। লঞ্চঘাট
অনেকটাই রেলজংশনের মতো। তবে হকারদের সম্ভার দেখলেই নদীর
ব্যাপার বোঝা যায়। অনেকেই পাউরুটি ফেরি করছে Ñ কারো হাতে আবার
ঢাকনা দেয়া এলুমিনিয়াম বালতিতে রসে ডোবানো ছোট ছোট রসগোল্লা
অথবা এ্যই কলে। সমস্ত জেটি আলো করে আছে রাশি রাশি পাকা
সাগরকলা। এক সাইডে ইলিশঅলাদের রাজত্ব। ভৈরব রেলস্টেশনের মতো
লাগছে Ñ শুধু যেখানে রেললাইন থাকবার কথা Ñ সেখানে নদী। উভয়েই
একপ্রকার শূন্যতাকে ধারণ করে। এই আশায় যে, ঘড়ির কাঁটা ধরে হঠাৎ করে
একদল মানুষ এসে চাঁদে নামবে, অন্য দল উঠে যাবে - ক্ষণকালের জন্য
আকাশে উঠবে একফালি ঈদের চাঁদ, আবার দেখতে দেখতেই সব মিলিয়ে
যাবে শুন্য হয়ে যাবে আবার সব।
জেটিতে ছোট ছোট একসার সরকারি কামরা আর তাতে ক্ষুদ্রাকার
নামফলক টাঙানো। লঞ্চের জন্য এত কিছু লাগে নাকি? একখানে দেখি লেখা :
নৌ ফাঁড়ি, এএসপি-র কার্যালয়। চোখ পিটপিট করে তাকাই, কি যেন মনে
হতে চাইছে, ঠিক মনে পড়ছে না... বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয় ভেবে
হাঁটতে শুরু করি, কিছুদূর গিয়ে নদীর দিকে মুখ করে তাকাই এইবার মনে
হবে তো? দেখি, নদী কী করে Ñ আমার মন একটা ধাক্কা খেয়েছে, এবার তো
সে সাড়া না দিয়ে পারবে না Ñ ও মেঘনা নদী Ñ একবার দেখ তো, আমাকে
মনে করিয়ে দাও Ñ এসব ভাবতে ভাবতে আবার ফাঁড়িটার সামনে দিয়ে
দুচক্কর দেই। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, নিশ্চিত হবার জন্য দরোজার ফাঁক দিয়ে
ভিতরে ঢুকি।

পাঁচমিনিট পরের দৃশ্য: আমি গ্যাঁট হয়ে বসে আছি এএসপি সাহেবের
রুমে আর ওদের একজন প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছে স্যারের বাসায় ফোন
করতে! উদয়ভানু কর, এএসপি নৌ Ñ আমার ক্লাশমেট ময়মনসিংহের
উদয়ভানু। কার কাছে যেন শুনেছিলাম ওর খবর, যে, হিলট্রাক্টস থেকে
চাঁদপুরে বদলি হয়েছে। বহুদিন দেখা নাই, তাই খবরটার গুরুত্ব ফিনফিনে
হয়ে গেছিল। এটা ছিল উপেক্ষা না করে ভুলে যাবার মতো প্রাকৃতিক ঘটনা।
বাস্তব অনুপযোগিতার ভবিতব্য। ওর স্টাফরা সত্যিই সজ্জন। ওদের মধ্যে
আবার দুজনকে পাওয়া গেল যাদের দেশ ময়মনসিংহ Ñ ফলে খানিকটা এক্সট্রা
খাতির। ফোনঅলা বলল, স্যার বাসায় নাই,  বলে ফোন ধরে ওপাশে বলতে
লাগলো, স্যারের বন্ধু, ফাঁড়িতে আছেন, তারপর আবার স্তিকারের মুখ
চেপে আমাকে জিজ্ঞেস করে , কোত্থেকে আসছেন স্যার? ঢাকা।  --ও ঢাকা,
ঠিকাছে (ফোনে) অ্যা.. হ্যাঁ, ঢাকা থেকে আসছেন, স্যারের ভার্সিটির বন্ধু
(ফোন রেখে), একটু অপেক্ষা করতে হবে, উনি ৮টার দিকে আসবেন।
আসলে ও আমার কলেজেরও বন্ধু। আবার একইসাথে একই বিষয়ে
য়ুনিভার্সিটিতেও পড়েছি।
-- ঠিকাছে, এখন সাড়ে সাত, আমি একটু ঘুরে আসি কেমন ?
--না, না, বসেন, স্যার চলে আসবে।
--আচ্ছা আচ্ছা, এখনই আসছি, একটা কাজ আছে, কাছেই, এখনই
ফিরব, বলে বুঝাই। কিন্তু আমি নিজেই খানিকটা বিস্মিত Ñ এ্যাতো সুন্দর
ব্যাভার .... পুলিশের? নাহ মেলে না। আবার মনে হয় Ñ হয়তো নদীর
ছোঁওয়া লেগেছে তাই মনটা একটু গলা!
উদয়ভানু আমাকে ওর সুজুকির পিঠে চড়িয়ে উড়াল দিয়ে হেঁটে চলল।
রাস্তায় অসংখ্য মানুষ আর রিকশ Ñ কোথাও কোথাও ভোর বেলার দাড়ির
মতো গিজগিজ করছে, তারই ফাঁক দিয়ে তোরাবোরা পার্বত্যাঞ্চলে বেশ ডাঁটে
চালাল। আমি জীবনে কখনো এই রকম উনিফর্মের এত কাছে আসি নি।
সারাটা পথ প্রায় ওর পিঠে জাপটে থেকে আমার ভিতর একটা পট্টিফাইট
অবস্থার সৃষ্টি হল। কখনো কখনো ওর বাঁ দিকের কোমড়ে ঝোলানো
রিভলবারের গায়ে হাত লেগে যাচ্ছিল, আর তাতেই গরম হয়ে পড়ছিলাম।
এই তো আঙ্গুলের কাছেই ট্রিগারটা। মনে হচ্ছিল মানব জঙ্গল বড্ডো বেশী
ঝামেলার। দেব নাকি ঝেড়ে কয়েকটাকে! রাস্তার উপর টপাটপ
পল্টিখাচ্ছে...আর গলগল করে পালাচ্ছে মুক্তি পাওয়া রক্ত...উহ কী রোমহর্ষক!
একদিন উদয়ভানুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম : কেমন লাগে এই লোহার টুকরাটা ঝুলিয়ে রাখতে? ও বলল, এক সময় আর মনেই থাকে না এটা যে কী! এই
যেন এটা এই তোর কাছে মনে হবে নিজের নুনুর মতো Ñ বলে আর হাসে,
--তবে জানিসই তো, আমাদের কুটুমরা তো ঢাকাই ছবির আদর্শবাদী মাস্তান
নয়, ওদের সামনে এই লোহা না নিয়ে যাওয়া মেয়ে মানুষের সামনে নুনু ছাড়া
যাওয়ার চাইতে মারাত্মক।
এতক্ষণ চাঁদপুর ছিল ধীরলয়ের আনাড়ি, ছোটখাট ব্যর্থ বিষয়িভূত Ñ
মানুষের মুখগুলি ছিল দ্বিমাত্রিক, অনেকেরই প্রোফাইলের ধার নাই Ñ কোনো
গন্ধ ছিল না, আলাদা আলাদা শব্দগুচ্ছও Ñ এমনকি সমাপ্ত করা কোনো
বাক্যও কান ছুঁয়ে যায় নি Ñ গল্পহীন ঘটনাপ্রবাহ ছিল। খানিক আগে দেখা
ইলিশের পাইকারদের ঘুপচিঘরের মতো পাশাপাশি দাড়িকমাহীন বয়ে চলছিল
Ñ মানুষ মানুষের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে, ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে একজন আরেকজনের
হাত বদলাবদলি করছে Ñ একদম বগলের রোমসহ Ñ আবার গোপন
অপারেশনে অবরূদ্ধ হৃদপিণ্ড সীসা দিয়ে মুড়ে ফেলার উৎসব Ñ ইলিশ ও
কাগজের মধ্যে রূপান্তর হচ্ছে Ñ যা কিছুক্ষণ আগে পানি ও ইলিশের লেনদেন
ছিল Ñ কিন্তু হায়! এই জগতে মুদ্রার কাগজের সাথে পানির কোনো সম্পর্ক হল
না Ñ সত্যের ত্রিভুজ সবাই দেখতে পারে না Ñ
উদয়ভানু আমাকে হঠাৎই ভাবনার জগৎ থেকে টেনে বের করে নিয়ে
এল। ও বুঝতে পারছে আমি কেবলি চমকাচ্ছি Ñ আর ও আমাকে দফায় দফায়
চমকাতে চমকাতে চমচমের মধ্যে এনে ফেলল। এটা একটা স্থবিরতাÑ মিষ্টির
জগতে। আমি ওকে যতই ন্না না বলছি Ñ ও ততই ফেরৎ কাঁটার মতো হয়ে
চলে যাচ্ছে Ñ আমি বলি : চমচম না তো, বালিশ ! ও বলে : কোলবালিশ।
দোকানের সপ্রতিভ ছোকরা বলে : স্যার, বালিশ এখানে পাবেন না,
পাওয়া যাবে নেত্রকোণা, ৫/৭ কেজির বালিশ তো যখনতখন অর্ডার ছাড়াই।
আমি ওকে ভ্রুনাচিয়ে বলি: বাড়ি কই, নাগরপুর? হ্যাঁ স্যার, কেমনে বুঝলেন?
ও তো আমার শ্বশুরবাড়ি। ওর পক্ষ থেকে এবার আরেকপ্রস্থ Ñ এবারে জামাই
চমচম আদর। উদয়ভানুর হাত থেকে পালিয়ে কাল্পনিক শ্যালকের হাতে চমচম
Ñ শ্বাসরূদ্ধকর! এ অবস্থাথেকে মুক্তির জন্য বিধাতার কাছে নাজাত কামনা
করলাম Ñ যত উপায় জানা আছে Ñ সেমেটিক পুরান টেস্টামেন্ট থেকে নতুন
টেস্টামেন্ট Ñ চীনাদের কনফুসিয়ান, মধ্যযুগের সিরিয়ান মনোফাইসাইট বা
আল ইরাকের নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান বিশ্বাস; কোরান, ত্রিপিটক, গীতা,
গ্রন্থসাহেব, জরথুস্ত¿ীয় পার্সি প্রার্থনা Ñ এমনকি বাহাঈদের সর্বাধুনিক কায়দার
ছোট মুনাজাত করেও, মনে হয় সব উপায় ব্যর্থ হল। প্রাক্তন গল্পকার যখন
রাষ্ট্রের সেবক, তার সমস্তচমকপ্রদতা তো মিষ্টিমুখর হবেই; তাও আবার
বাল্যবন্ধু বলে কথা!
বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ সময় লাগল। আমার এই প্রাক্তন-গল্পকারবতর্
মান-পুলিশ বন্ধুটা সংক্ষিপ্ত সময়ে বহু জায়গায় গেল, অনেক কাজ সেরে
এল, তারপরও বলল, ‘পুরানবাজারে যাওয়া হল না!সংক্ষিপ্ততম সময়ে এত
কাজ করে এবার একটু হাসল! বড়ই তেলতেলে সেই হাসি। বুকের জেবে
অনেকক্ষণ থেকে টুকরা কাগজগুলি রাখছিল, বাসায় ফিরে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই
নিচু একটা টেবলে সব ঢেলে দিল। আমাকে ইশারা করল ওদিকে। আমি
কোনো পাত্তা দেই নি প্রমে, বারবার ওর ইশারায় কএকটা টুকরা তুলি, দেখি
তাতে লেখা:

নেড়ে চেড়ে দেখলাম, সবই এরকম Ñ কোনোটা সদরঘাট থেকে ছেড়ে আসা
লঞ্চের, কোনোটা ট্যাংকার থেকে নামানো তেলখাত। ও বলল : এরকম
ডজন ডজন খাত আছে, সব শিখতে হচ্ছে। হিলট্রাক্টে ছিল শুধু গাছ, আর
এখানে যে কত কি! সবই অবশ্য নৌ-ঘটিত। আমার বৌ আবার সাঁতার
জানেনা। এখন বাঁচার জন্য সব শিখতে হচ্ছে, বৌয়ের সাঁতার, আমার শ্লিপ।
--সবচে বড় খাত কোনটা?
--এখনো পাই নাই, শুনেছি যে বছর--কোকো বা সাগর টাইপের
কোনো তিনতলা ডোবে, সেবার চলে মোচ্ছব! বড় বড় ড্রাগের চালানও মার
খেয়ে যায় তখন!
মূল শহরটা খুবই গাদাগাদি করা, নদী ভাঙা শহর যেমন হয় আরকি! শহর
এখন নদী থেকে দূরের দিকে প্রসারিত হচ্ছে Ñ কিন্তু একটা পুরনো শহরের মূল
পরিচয় তো তার আদি চেহারায় Ñ যেখানে গাদাগাদি করা মানুষ ও তাদের
প্রয়োজন-লেনদেন- হিসাবনিকাশ-বিচারশাসনক্ষমতা ঘনীভুত হয়ে থাকে
আর বিরবির করে প্রলাপ ডাকে শহরের নাগরিকতা সারা দিনমান।
উদয়ভানু অনর্গল বলে যাচ্ছিল। বলতে বলতে পুরনো দিন মনে করিয়ে
দিচ্ছিল। ওর যা গল্প জানি, দেখি সবই আমার মনে আছে Ñ তবুও ওর মুখে
আবার শুনছিলাম। ভঙ্গি পর্যন্ত বদলে গেছে ওর। কথার মধ্যে হাত নাড়ানো
বেড়েছে, তবে তাতে বেশ জেস্ট আছে। বিগত দিনের হাড্ডিসার, একটু ন্যুব্জ,
আর ধূসর দেহভাষা আজ সম্পূর্ণ রঙিন। স্বাস্থ্য , পেশী আর সব প্রাক্তন ধূসর
মেরুমজ্জা, সবই নাচে গানে ভরপুর। সেই প্রাক্তন অভিমানি গল্পকারের
কোনো ছায়াকণাও দেখতে পাচ্ছিলাম না ওর ভিতর। কলেজে ওঠার পর যখন
জানল গল্প লেখার আগে কবিতা জানতে হয় ও বেশ অবাকই হয়েছিল। এ
কেমন কথা, কেউ কি শুনেছে তারাশংকর কবিতা পাঠের আসরে দাঁড়িয়ে
স্বরচিত কবিতা পড়ছে! সহপাঠি লেখকেরা ওকে কবিতা পড়াতে ব্যস্ত হয়ে
পড়লে ও বলে, না, তোমাদের কায়দা আমি মানি না। আমার গল্প দারিদ্রের,
কবিতায় দারিদ্র দাঁড়ায় না। শুয়ে পড়া জিনিসে আমার আস্থানাই। এভাবেই
তো এতদিন লিখেছি। ওগুলি তাহলে চলছে না? ঠিক আছে, তাহলে বিদায়,
আমার ১০০ কচি গল্প! অগিড়বপাতে ভস্মীভূত সেই গল্প সকল আর কি মাথা
তোলে নাই ওর ভিতর? আমার জানা নাই, তবে একদা লাল নিশানের নেশা
ওকে পেয়েছিল। সে আরেক গল্প!
উদয়ভানুর বাসায় গেলাম না আর রাতে। বাসা চিনিয়ে, সুজুকি চালিয়ে
আমাকে রেস্টহাউসে নামিয়ে দিয়ে গেল। যাবার সময় কেয়ারটেকারকে কী
যেন বলে গেল। আর সে রাত থেকেই কেয়ারটেকারের আচরণে এক
অভূতপূর্ব উৎসাহ দেখতে পেলাম। আমাকে খেতে দিয়ে Ñ সেই সময়ের
মধ্যেই ও দুইনম্বর ভিআইপি কুটিরে আমার ইহজাগতিক মালছামানা সযতেড়ব
সাজিয়ে রেখে আমাকে চমকাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। ডাইনিং থেকে যখন
উপরে উঠছি Ñ ও পানির বোতল নিয়ে আমার পিছু পিছু আসছিল এবং
একসময় আমার হাঁটার দিক বদলে দেবার জন্য বলল: ঐদিকে স্যার! আমি
বিহ¡লতায় চমকালাম! ও যেন এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
--ভিআইপি রুমে, স্যার
বুঝলাম উদয়ভানুর অনুপ্রবেশ। ওর খাকি হাত কতদূর যেতে পারে তার
একটা ছোট্ট নমুনা।
একসময় দেশের সেরা রেস্টহাউসগুলি ছিল ওয়াটারবোর্ডের, আর সেরা
পাচকরাও ওদের। যারা জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ায় তারা সবাই এরকম মতই
দেবে। তবে এই পাচকরা আবার একইসাথে ডাকাতও। এমন দুর্ধর্ষ ডাকাতরা
এরকম চমৎকার পাক করে কিভাবে তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার!
যেখানে যত বড় প্রজেক্ট, সেখানকার রেস্টহাউস ততো খান্দানি। তবে
গলা কাটার কায়দা সর্বত্র এক। ধরো মুরগি ভাই, করো হে জবাই Ñ হেইয়ো।
এদের ডাকাতির এমন এক গল্প :
ভোলায় যা হয়েছিল, এক কথায় অনবদ্য। এক প্রভাতে ঢাকা থেকে
আমাদের ভ্রাম্যমাণ পুরো দল হৈচৈ কর্তে কর্তে নেমে এল কোকো লঞ্চ থেকে।
সেই অতি ভোরেই ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল ঢাকা থেকে আগের দিন আগত গাড়ি Ñ
যা কিনা বিশেষ ব্যবস্থায় বরিশাল থেকে দুটা বড় নৌকা পাশাপাশি জোড়া
দিয়ে বয়ে আনা হয়েছে। দূষণমুক্ত ভোলার সকাল বেলাটা পেট্রোলের গন্ধ
ছিটাতে ছিটাতে আমরা এসে থামলাম সোজা খাবার টেবিলে। দেখি থরে থরে
সাজানো এলাহি ব্যাপার। আর চারিদিকে দাঁড়ানো উদ্যোগী সেবকরা (বড় বড়
কাজ নেই, ঠিকাদারও ঠাণ্ডা, তাই আরকি)। বাজার থেকে তুলে এনেছে যা
পেরেছে। আমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতারা ওদের ছলনায় ভুলে গেলেন। প্রতিদিনই
শুনি, আহ, কী প্যাঙ্গাসই না খাওয়াল, আহ, পাবদার কী সাইস!
আমরা শুনি আর হাসি।
--তোমার নাম কী হে?
--যে ষাঢ়, পাবেল।
--আর তোমার?
--মামুন!
--ভালো কী খাবার পাওয়া যায় হে?
--হে হে হে ষার, সবই সোম্ভাব! যা চান
--লবস্টার?
--হা ষার, যত বড় চান!
--লে আও
--আজ্ঞে ষার, আজকাই আনবুনে!
সত্যিই, এত বড় চিংড়ি শুধু থাই এয়ারের বিজ্ঞাপনেই দেখা গেছে
এতদিন।
দিন দশেক পর সেই দিন হাজির হল। লঞ্চে ওঠার আগ পর্যন্ত কেউ
কোনো কথা নয়। না আমরা, না ওরা। তবে ওদের সবাইকে দেখাচ্ছিল প্রবল
বৈষ্ণব, মুখে একদম রা-টা নেই। নেই তো নেই, একেবারে মাঝ নদীতক।
মনে হচ্ছিল কোনো এক আতংকে ওরা টংকার ছড়াচ্ছে। মুখ খুলল মাঝ
মেঘনায়। কে যেন জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন বিল দিলেন?কোনো কথা নেই
তখনো। অনেকক্ষণ পর খালেক সাহেব কেবল বললেন : ভাই, ঢাকা গিয়ে
কাউরে বলবা না, কেমন? তা হলে শোনো, ডাকাতের ব্যাটারা একদম ছিলে
দিয়েছে। বিলে দিয়েছে খাসির অংক, আর জিজ্ঞেস করলে বললো এটাই
সেই লবষ্টারের দাম Ñ তখন মনে হয়েছিল একটা ছুরি থাকলে ওর জীবনের
শেষ লবষ্টার ওখানেই রান্না করিয়ে দেই।
আমরা বললাম, কেন, জানেন না, এখন যে তেমন প্রজেক্ট নাই ওদের,
ঠিকাদারও ঝনঝন করে না, আপনারা ছিলেন ঐ ঠিকাদারখেকোদের কাছে
জামাই।
--ঠিকাছে, ওদের নাম দিলাম পোতা পাবেল আর হোগা মামু’, খালেক
সাহেব বিরবির করে কী যেন বলেন। আমরা আর ওদের শোকের কাছে
দাঁড়াই না।
উদয়ভানুর বাসায় ১৭ প্রস্ত প্রাতঃরাশ। ঘণ্টা দেড়েক লাগল। এর মধ্যে
গল্প জমে উঠল। আমাদের চেনা শোনা কে কোথায়। রবি, সতরঞ্চি, গুডু,
ভুষাণ এরা সবাই এখন এখানে। অনেক সিনিয়র জুনিয়র আছে। অনেকেই
আসে। অনেকের তো কাজও থাকে Ñ তা কখনো সখনো দরকার হয় বৈকি !
--ও হো আরেকজন আছে Ñ তোর শিষ্যা Ñ তিয়াতিশা। আমি অবশ্য কিছুদিন
আগে তার সামান্য কাজে লাগছিলাম। খুবই সামান্য। সেই ফাঁকে পরিচয়টা
নতুন হল আরকি।
তিয়াতিশা! বলে কী লোকটা। আমি আশ্চর্য হই। সাবাস উদয়ভানু Ñ
আমার চমকাবার কোনো শেষ নাই। সত্যিকারেই। তোর নাম দিলাম উদয়
চমক ভানু। নামটা বেশ না? ইউ চমক ভানু!
একেবারেই কিছু লিখিস না ?
ও দ্রুত মাথা নাড়ে। সম্ভাব না। একেবারেই অ-সো-ম্ভা-ব। বানানো
জীবনের ভিতরে থেকে গল্প বানানো যায় না। একটা আসল লাগে। জীবন
থাকতে হয় Ñ ক্ষমা, উদারতা, সম্মান, শান্তনা বহু কিছুর সিমেন্ট লাগে লিখতে
গেলে। যা দেখা যায় না তাও লাগে। শুধু বর্বরতা, ক্রোধ, বিতৃষ্ণা, হতাশার
বালি দিয়ে গল্প বানানো যায় না। তুই ঠিকই বলেছিলি একদিন, কবিতা
লাগে, তবে আমি ভেবেছিলাম কবিতা মানে ছন্দ, কিন্তু এখন বুঝি, গল্প কী
চায়। আর তা জীবনের কোথায় থাকে।
--তবে তো ভালোই, সবই বুঝিস যখন, তা হলে লেখ!
--আসলের সন্ধানে বানানোর মধ্যে ঢুকে পড়া যায় না। এ যুগে পুলিশের
পক্ষে গল্পলেখা হাস্যকর। যেমন হাস্যকর বাংলা সাবজেক্টের শিক্ষকেরও।
--মানে?
--সে আরেকদিন হবেনে
কিন্তু তিয়াতিশাকে নিয়ে ও কী যেন বলছিল! পুলিশি সহায়তার দরকার
হল কেন?
তিয়াতিশা
সারা দিনে ধারাবাহিক কতগুলি সাক্ষাৎ ইত্যাদি হল। ক্রমশ চাঁদপুর
বিষয়ক জ্ঞানী হয়ে উঠছি। ফিরে যাবার সময় অনেক ধরণের জ্ঞান ও তার
বিভিনড়ব প্রকার মাপ ও ম্যাপ বিষয়ক বিভিনড়ব প্রকার আলোচনার লিখিতরূপ
সাথে থাকবে। আগেই প্রতিদিনের সবকিছু ঠিকমত পরিকল্পিত আছে। কী
করতে চাই তার একটা স্পষ্টধারণাও আছে।
সারা দিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঠিক করার চেষ্টা করলাম তিয়াতিশার
সাথে কিভাবে দেখা করা যায়। দেখা হলে তারপর কী হবে? আমি যে ভেবেও
আনন্দ পাচ্ছি। কিন্তু এমন কেনো হচ্ছে? কোন কারণ নেই Ñ কারণ ওর
সাথেও উদয়ভানুর মতো বহুদিন পরে দেখা হবার সম্ভাবনা। আর এটা ঠিক ও
আমার খানিকটা শিষ্যস্থানীয়তো বটেই, খানিকটা মধুরও। সেইজন্যই।
দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়াটাই একটা মহান কারণ। নিজেকে একটা সাসপেন্সে
রাখলাম Ñ উদয়ভানুকে বলিনি বিকালে আমি কী করব বা তারপরে। কিন্তু ও
হঠাৎ করে ফেণী চলে গেল, ভিভিআইপি ডিউটি, পরশু ফিরবে Ñ আমি ভীষণ
একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেলাম। এই বেলাটা না হয় খুঁজতে গেল Ñ তারপর
থেকে কাল কী হবে উদয়ভানু বিহনে। ওর মধ্যে একটা জৈবতা মুক্তি পেয়েছে Ñ
সেই জিনিসের খেলা খুব উপভোগ্য Ñ আমি তো পানি ছাড়াই গিলছি!
তিয়াতিশাকে তার বাসা সমেত পাওয়া গেল। গেটে একটু সমস্যায়
পড়তে পড়তে পাক খেয়ে বেরিয়ে এসেছি। মনেই ছিল না এ নাম যেখানেই
চলুক দারোয়ানের কানে কোন ভাটিয়ালি গাইবে না। তার জন্য অন্য কোনো
নাম Ñ স্বাক্ষর অনুনাদী, রয়েছে, আমাকে তাই ব্যবহার করতে হবে Ñ চেষ্টার
একেবারে শেষ মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, তাই ঘরে ঢুকেই বলি : তোমার
বাবামায়ের ট্রাপে পড়ে আজ প্রায় জেলের ভাতই খেতে হত, নিদেনপক্ষে
উদয়-চমক-ভানুর চা।
ও রীতিমতো ব্যতিব্যস্তহয়ে পড়ল : --কী হয়েছে, কী Ñ আমার বাবামা
এখানে এল কখন Ñ আর ওরাইবা এখন কোথায় Ñ আর প্রথম কথা হচ্ছে :
হয়েছেটা কী ? কোত্থেকে এমন করে চমক দিয়ে এলেন?
--তোমার আর কোনো বোন নেই বলে তোমার নাম রেখেছে দুজনের Ñ
আর এই নামের চমকে তোমার আসল নাম যায় হারিয়ে, আমি তো ভুলেই
বসেছিলাম, তাবাসসুম গুলফাম আরা Ñ কে এমন লম্বা রেলগাড়ি মনে রাখবে,
যেখানে রয়েছে তিয়াতিশার মতো দুটা ছোট্ট মুক্তাদানা, একটা হারালেও
অসুবিধা নাই, অন্যটা আরেকটার মতো।
তিয়াতিশা হাসতে হাসতে হাসতে আসতে লাগল, আস্তেআস্তেআসতে
চেষ্টা করল Ñ কিন্তু তা কি পারে, ধ্রাম ধ্রাম করে একদম কাছে এসে ব্রেক
করল Ñ মানে এরকম মনে হল Ñ এখন এগারবছরের খুকিটা হলে তাই করত
আরকি, ভাবভঙ্গিতে তা বোঝা গেল।
--হায় আল্লা, তুমি তো দেখি ভারী হয়ে গেছ, কোন রেশনের চাল চিবাও
গো শুনি!
--আজ্ঞে নিজের রেশনের। নিজের ঘাম বিক্রিরি করি।
--শুনেছি তোমার রক্ত নাকি পানশে, কেমন একটা মুরগির গন্ধ !
--কে বলেছে Ñ মশারা ?
--হা হা হা !!
--এখন মুরগির নাম শুনতে পার তো, পাঙ্গাশীনি? কই বাসায় আর কে কে
সঙ্গে থাকে?
--আমি আর রাউল।
--ওর ড্যাড ?
--অন্য শহরে। চাকুরি।
আমি তিয়াতিশার দিকে তাকালাম : কতদিন?
--বছরখানেক। ও বিদেশ থেকে ফিরে। তখন থেকে প্রসিতভর্ত্তৃকা!
দরকারের চাইতে অপর্যাপ্ত স্পেসÑ মাঝারি রকম গোছানো।
কেমন আছ গো পটের বিবি ? দশ বছর পরে দেখা!
য়ুনিভার্সিটির জুনিয়র, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রাণের ফিঙে!
দশ বছরে দেখি সময় তোমাকে বর দিয়েছে।
আবার কবরও দিয়েছে!
তাকিয়ে দেখি, সত্যি সত্যিই কি তিয়াতিশা অপরূপা হয়েছে। আর তখনই
চোখে পড়ল Ñ খানিকটা যেন উদাসীনতাও। নাকি ভুল!
--হায় হায় কতদিন পর দেখা Ñ মনেই পড়ে না। কেমন আছেন, কোত্থেকে
খবর পেলেন আমার কথা Ñ ক তো দি ন হল কোন খোঁজইতো নাই!
সত্যিকারের আবেগ আর আতিথেয়তা পরস্পরকে হারিয়ে দেবার চেষ্টা
করেই চলেছে।
--ভালোই তো দেখছি। এ বয়সে একা জীবন কাটাচ্ছ, অশোক বনে
সীতা!
--সে তো কত আগে থেকেই। বিয়ের পরের বছরই জাপান। ছয় বছর
একা কাটালাম Ñ ও যদিও গেল একবছর পর Ñ দুজন দূরের দুই শহরে। বাস্তবে একাই। এখন এটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়!
--স্বাভাবিক করে নিয়েছ বলে! এখানেই থাকবে তাহলে ?
--যে কয়টা দিন রাউলকে কাছে রাখতে পারব। ও যেদিন কোথাও পড়তে
যাবার মতো বয়স পাবে Ñ সেদিন আরো ব্যস্তহয়ে যাব। পাঙ্গাস মাছের
বাসার জন্য কোন মাটি ভালো তা খুঁজে বার করতে থাকব, মাছের জন্ম
বিশুদ্ধতা ঠেকাব। এতেই যে সব মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে তাও না। তবে এসব
গবেষণা তদারকি কাজের একটা তাৎক্ষণিক আনন্দ আছে Ñ চোখের সামনে
ফল দেখা যায়!
ঝোঁক ছিল ল্যাবের কাজে। জিন কারসাজি করে কতরকমের যে মজার
মাছ বানানো যায় Ñ আমার পাঠ্য ছিল ওসব গবেষণার বিষয়। জানেন Ñ
আঁশবিহীন মাছের যৌন আচরণ বিষয়ে একজন ওস্তাদদ লোক আমি Ñ বলে
মুচকি হাসে : তবে এটার অন্য পিঠও যে আছে তা টের পাচ্ছি Ñ পিছলা
মাছের যৌনতা কেন, আমি এখন সব হাঁস মুরগি ভেড়া হনুমান সোনাব্যাঙ
বাতাসী মাছ পুদিনা পাতা রাঘব বোয়াল থেকে শুরু করে
চিলময়নাদোয়েলকোয়েল পাতিকাক ভোদড় - এমনকি আঁশঅলা মানুষের হাই
তোলার মেসেজও বুঝি অকপটে! বলে আমার দিকে তাকিয়ে ওর সেই
বিখ্যাত নিষ্পাপ কামনামদির হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে দিল, চোখের নিচে
ফোলা প্যাড একটু কুঁচকে, চোখকোণে হালকা রেডিয়াল আলোক রেখা
ছড়িয়ে। চোখও আগের চেয়ে আরো চিকচিক করছে।
এই অদ্ভূত অবস্থাবেশিক্ষণ থাকল না Ñ অদ্ভূত আতিথেয়তায়। যেন খাবার
লোক ছিল না Ñ এইভাবে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সর্বপ্রকার আয়োজন
চলল। বিকাল থেকে টানা প্রাকডিনার Ñ অসংখ্য গল্প আর খাদ্য মুড়িভাজার
মতো উড়তে লাগল। স্মৃতির দুপুরবেলা নদীর দিকে তাকিয়ে ভিজে ওঠার
বাষ্পে দিব্যি রানড়বা করল শাদা ইলিশ, বিশ্বকবির জন্মদিনের বিকেলে নুরুল
আনোয়ারের শিষ্যদের গীতবিস্তারের মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দিয়ে শুধু শুধু
ফাঁকা রাস্তায় হাটা আর সেই মধুর নৈ:শব্দে ভাজা হতে থাকল --ছাডা ইচা
নানা প্রকার সোনালি মথুরা ঘুরে বেড়াতে লাগল দশবছর আগেকার বনেপ্রান্তরে Ñ আর এদিকে টেবিল ভরে উঠল সুখাদ্যে, সুঘ্রাণে, সুপরিবেশনায় Ñ
একেবারে জাপানি চেরি লোকাল বরিশাইল্যা ওমে।
সেই সময় ও ছিল ওর গ্রপের সর্দার। প্রথম মহিলা নাটক পরিচালক।
আমরা ক্রমাগত উৎসাহ ও শেল্টার দিয়ে যেতাম। প্রথমটা প্রবলভাবে
বুঝতে দিয়ে। দ্বিতীয়টা কোনোভাবেই বুঝতে না দিয়ে।
কোলের শিশু কোলেই ভালো, রেখ না তাকে কার্নিশে
জামা বা জুতা নষ্ট হবে লাগে যদি কাঁচা বার্নিশে
আযান শেষ হবার সাথে সাথে কাকেরা মোলায়েম কা কা কা শুরু
করেছিল, এমনকি সদ্যফোটা দুসপ্তার বাচ্চাটা পর্যন্ত ঘুম ভেঙে তার পাপেটের
মতো গলা টানা দিয়ে ব্লাডার-লাল-মুখ ব্যাদান করে রইল। তারপর হাঁসের
মতো প্যাঁকপ্যাঁক করতে লাগল Ñ শব্দহীন। সমস্তকাকসমাজ ইংরাজিতে ক্রো
ক্রো করে উঠল Ñ তার মানে ভোরের আযান একপ্রকার প্রভাবক Ñ
অভিভাবকের মতো পারিবারিক আত্মা বিতরণ করে Ñ আমরা এর নাম দিতে
পারি : ভোরের ইথার। মার্কনির মতো আমরাও বলি : মাধ্যম বলে তো একটা
কিছু লাগবে Ñ নাকি ?
ডিম Ñ গণিতের একটা বিশাল অনুপ্রেরণা, বিশেষ করে রাত জেগে যারা
যুক্তি চর্চা করে আর প্রভাতে দেরি করে প্রাত:রাশ করে...ব্যর্থতার রাত শেষে
নাস্তার পেটে তাদের অবশেষ থাকে এমন গোল ডিম্ব।জানেন, শ্লেÑ úট পরিবর্তনের দাগ আঁকে না, এমনকি কোনো দাগই রাখে না জীবনে Ñ হায়রে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষিত পাথর, তোরও এমন এক
পাথর স্বভাব... কিন্তু পদ্মর ঘন পলির ভিতর শ্লেট রঙের কাদার গোল্লা যখন
উঠে আসে Ñ ভুলে সব কিছু, মনে হয় এই তো পাথর কিন্তু সব অপূর্ব,
অসাধারণ, অসামান্য, গোলাকার...!
লতে বলতে খাপছাড়া কথার উত্তেজনায় ওর মিঠাশ্যামলা থেকে
চিনাবাদামী হওয়া গাল সনড়ব্যাসী সিঁদুরের আভা পায়, সেই আগের দিনের
মতো তিরতির করে ঘেমে ওঠে। শীতের র‌্যাপার গায়ে দিতে হয় না। বেশ
মুটিয়েছে Ñ বিপদজনকভাবে দেহের বিপদজনক জায়গাগুলিকে হারিয়ে
ফেলছে Ñ যদিও আশার কথা মনে হচ্ছে ওর ব্লেড এখনো দারুণভাবে কাটে।
তবে বুঝলাম ওকে দেখে Ñ মেয়েদের ব্লেড কোনো একটা নির্দিষ্ট কিছুকে ভর
করে বসে থাকে না Ñ সবার আলাদা আলাদা ধার, আলাদা আলাদা নখ
লুকিয়ে রাখার কায়দা। সারা মুখটাতে ওর ছড়িয়ে আছে সেই আকর্ষণ Ñ বা
রূপসুষমতা Ñ বা ব্লেড। আর সকল পুরুষ গাল এগিয়ে যায় ঐ ব্লেডের কাছে।
আগে একবার চেষ্টা করেছিলাম Ñ বেশ আগে Ñ ব্লেডের স্তপর্শ পাবার
সুযোগ সুবিধা হয় নি তখন আর এরকম বিশেষ করে আসেও নি তো ও! তাই
এবার একেবারে প্রথম থেকেই শুরু করে দিলাম।
--তিতিশা Ñ তুমি কি তাহলে রাউলকে নিয়েই Ñ
ও যেন বুঝতেই পারল না, এমন ভাবে আমার ট্র্যাপ এড়িয়ে গিয়ে গীত
গাইবার পাঁয়তারা করছিল, থামিয়ে দিলাম।
--বরং চল বাইরে যাওয়া যাক, নিদেনপক্ষে বিদেশী লোনের টাকার একটা
ড্রাইভ! ওকে ক্ষেপিয়ে তাতিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম।
এবার ও থেমে গেল Ñ এমন করে থেমে গেল যে মনে হল সব কিছু থেমে
গেল Ñ টিভিটাও যেন। কোথায় যেন কারা কথা বলছিল Ñ তারাও Ñ
সাথেসাথেই যে বুঝতে পারল Ñ ওর এইমাত্র করা নিশ্চুপতা কতটা ছন্দকাটা।
তাড়াতাড়ি সামলে নিল যেন Ñ তারপরও এইমাত্র ওর বাৎসল্যের তীব্রতার
মাপের একটা ঝলক দেখা গেল !
ও আমার দিকে তাকানো শেষ করল যখন আমি কেবল শেষ করেছি
--ড্রাই শব্দটা।
তারপরও তাকিয়ে থাকল। ও কি আমার স্থিরতা মাপছে? অস্থির করতে
চাইছে নিজেকে? বেশ খানিকপর নিজেই বিড়বিড় করল : ড্রাইভে যাব...
ড্রাইভে যাব...। আমার দিকে তাকিয়ে বলল : সারা দেশতো ভেজে
খেয়েছেন, এতদিনে ড্রাইভের স্বাদ মেটেনি?
--আরে না, না, চেষ্টাইতো থামে নাই, সেই ৮৯ তে একবার জীবনে
ড্রাইভের হুড়াহুড়ি লেগেছিল আর তারপর এই আজকে Ñ সবকিছু কেমন
পাৎলা আর হাল্কা হয়ে গেছে না Ñ এত দিনে?
--বলেন কী, এক্কেবারে হো.মো.এরশাদের বেদিশা অবস্থা। আগের মতো
লাগছে, দেখেন কেমন হাসি এসে যাচ্ছে। একটু হাসব নাকি। টকটকটা কেটে
যাচ্ছে, তাইনা?
--চলুন আপনার ড্রাইভে!
এখন সন্ধ্যা। ও ই দিক ঠিক করল, দক্ষিণ বরাবর। তবে বিদেশী লোনের
টাকার গাড়ি নয়; কষ্টে বাঁচিয়ে রাখা জাপানি ইয়েনের সখের জিনিস !
--বাহ্ দারুণ তো! অর্ডার দিয়ে বানানো নাকি !
ও সতেরখানা হয়ে গেল আহ্লাদে।
--আমি কিন্তু রাস্তায় ড্রাইভ করি না!
মানে? ওহ্ বুঝেছি। না, না ভাবতে হবে না। আর যেদিকে যাব, চেনা না
হলে ওখানে ড্রাইভ করা সুমাখারেরও কম্ম নয়, তাও আবার রাতে। তবে
অদ্ভূত। আর আজ বুঝি চাঁদের তের।--তোমার। বিজবিজ করে আমি
ভুরভুরি ছাড়ি। আমার শ্বাস বড়বড় হল কয়েকবার। ফুসফুসে অক্সিজেনের বড়
অভাব।
মাছ হয়ে পড়েছি যেন!
পানির মতো একটা নরোম পদার্থ চাই Ñ সারা গায় জড়িয়ে রাখবে আর
ভাসিয়ে রাখবে Ñ আর সবটাই আঠালো, মায়ামমতার ঘন সিরাপে। একটা
মানুষের আত্মার কিছুটা, অথবা কিছুটা ছিটকে আসা পদার্থ।
--বেতনের টাকায় গাড়ির তেল কেনা হয় না বলে বের করা হয় না।
আবার বেচতেও ইচ্ছা হয় না। তাই এটার নাম দিয়েছি --মধ্যবিত্তের
টানাপোড়েন। কেমন হয়েছে নামটা ?
--এটাও মনে হয় কোম্পানিতে অর্ডার দিয়ে আনানো!
--আপনার ৭২ আরপিএম কাটা রেকর্ড চালান কী করে ? ঐ যে কিসব
পিনটিন লাগে Ñ সাপ্লাই পাওয়া যায়?
--তোমার গাড়ি গান গায় না?
--আমার গাড়িতে চলতি পথে গান শোনা ও ধূমপান দুটাই নিষিদ্ধ!
--এতসব নিষিদ্ধ জিনিস আপডেট কর কিভাবে?
--এখানে এত সময় Ñ শুধু তেলই নাই!
--এইটাই তো দুনিয়ার আসল দীর্ঘশ্বাস ! তেল নাই তেল নাই!
আমরা খুব শীঘ্রই একটা বাঁধের ওপর এসে পড়লাম। কোথাও চমৎকার
প্রশস্ত, টানটান মাটির পেভমেন্ট Ñ কোথাও আবার চিকন হতে হতে
বিপদজনক সরু, ঘন ঘন রেইনকাট পথ জুড়ে Ñ চেনা চোখই কেবল দক্ষতা
দেখানোর সুযোগ পায় আর অক্ষত ফিরতে পারে।
আস্তে আস্তে চালাচ্ছিল। বুঝলাম কেবল দক্ষ নয়, রসজ্ঞও হয়ে উঠেছে
তি.তি.।
অন্ধকার হওয়াতে কৌতুহলী মানুষের অবুঝ চোখের নিষ্ঠুর সারল্যমাখা
চাহনির প্রকোপ ছিল না। তবে যখন চা খেতে নামলাম বুঝলাম এখানকার
লোকজন ওকে ভালোই চেনে। কেউ কোনো নখরা করল না।
সবার সাথেই ওর পুরনো কথার রেশ ধরে আলাপ চালিয়ে যেতে
দেখলাম।
কিছুদিন আগেও একবার ভেবেছিলাম ওর কথা। অনেকদিন দেখা হয় না
এমন কয়েকজন প্রায়ই কল্পনায় হানা দেয়। তবে যাদের ব্লেডের ধার ছিল Ñ
ওরাই ফিরে ফিরে আসে Ñ অন্যরা হারিয়ে থাকে সেলফের অন্য বইগুলোর
মতো Ñ যেদিন বইটা খোলা হবে, সেদিনই ফিরে আসবে ওরা Ñ আপাতত
স্মৃতির ক্রয়োজনিক চেম্বারে সাময়িক শব হয়ে থাকুক।
যাদের স্মরণে ঝরে আমার এড্রিনালিন রস
পিকআপ ধরনের উঁচু চাকার ছোটগাড়ি, বোঝা যায় গ্রামের রাস্তার জন্য এ
ক্লাশ Ñ আরামও আছে ভিতরে Ñ তবে লাক্সারি নাই, সিগারেট লাইটার নাই Ñ
যদিও অ্যাশট্রে আছে। তাতেই চলবে।
আস্তেআস্তেফাঁকা হয়ে ওঠে দুপাশ। চাঁদও বেশ তীব্র। ও কি যেন একটু
সুর গাইল Ñ আমি সাঁ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম Ñ আর এটুকু
করতেই উত্তেজনায় আমি ভিজে গেলাম যেন Ñ তারপর আরো একটু ফাঁকা
জায়গায় এলাম। চারদিকে কয়েকমাইল সুনসান, আমার কেমন ভয় করছে Ñ
অজানা জায়গার ভয় শরীরে এসে লাগছে, যতটা না মনে Ñ আগেড়বয়াস্তে¿র ভয়
প্রধাণত Ñ যার হাতেই থাকুক, এমন জায়গায় ওটা কথা বলবেই Ñ
ও তখন গাড়ির সবকিছু বন্ধ করে দরোজাগুলি খুলে দিল। তারপর কিছু
একটা খুটখাট করল Ñ
--চলুন একটু হাঁটি Ñ
আমরা গিয়ে দশফুট দূরে ঘাসের ওপর বসি।
--তোমার কি অনেক সাহস হয়েছে ?
--নান্না তো, না, কি বললেন Ñ সাহস ? না, না, আগের মতোই, না,
বরং কমেছে!
আমরা চুপচাপ। কোথাও কিছু নড়াচড়া করছে না। বা জ্যোৎøার ভারী
আলোতে কোনো নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে না।
দেবব্রত গাইতে শুরু করল। একটা গাইল। চুপচাপ অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ
পর আবার একটা গাইল। চুপ।
আবার একটা। চুপ।
পরপর কয়েকটা। চুপ।
গান শুনছি। গাওয়া থেমে যাচ্ছে। মাথার ভিতর গান বাজছে। একটা
শুনছি Ñ মাথার মধ্যে গান গাইছে কেউ। কেউ এসে উল্টে না দিলেও উল্টে
যাচ্ছে।
প্রথমে কিছুক্ষণ থামাটা বোঝা যাচ্ছিল Ñ একসময় আর শূন্যতা বলতে কিছু
ছিল না Ñ সারাক্ষণ গান বাজছিল Ñ বা হয়তো ও মাঝে মাঝে গাচ্ছিল Ñ বা
হয়তো আমিই গাচ্ছি Ñ এমন করে চলল ঘণ্টাখানেক।
সামনের দিকে তাকিয়ে পাশাপাশি বসে থাকলাম। কিন্তু কোনো কথা হল
না।
আমাদের দুজনের ফাঁকা জায়গাটার মধ্যে হঠাৎ একটা অচেনা বধ্যভূমি
এসে বসল। ও নিজে নিজেই একটু শিশিরিয়ে উঠল।
আরো আধাঘণ্টা গান।
এবার হেমন্ত।
এবার গানের মধ্যে মিউট নাই বললেই চলে।
একসময় আমি ওর হাতটা নিলাম (না ও নিলো Ñ না ও হাত বাড়িয়ে
দিল)। হাত হল হাত Ñ পশু আর মানুষের মাঝখানের হাইফেন। একসময় মনে
হয় Ñ আঙুলগুলি একএকটি স্বাধীন চিন্তা ও প্রকাশকেন্দ্র। দেহের সবকিছু
সরাসরি মস্তিষ্কই করবে Ñ এটা বোধহয় ঠিক নয় Ñ প্রতিটা প্রত্যঙ্গের নিজস্ব
কোড অব কন্ডাক্ট আছে Ñ চিন্তাভাবনা আছে Ñ তাকে আর সবকিছুর জন্য বুদ্ধি
নিতে হয় না। কখনো কখনো সে অনুমতি ছাড়া। যেমন এখন। মস্তিষ্কের মূলত
কোনো কাজ নাই এখন Ñ দূর থেকে দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকে সে।
আমরা তাকিয়ে থাকি বহুদূরের দিকে Ñ চাঁদের ঘন আলো যেখানে আরো
ঘন হয়ে চরাচরকে অদৃশ্য করে রেখেছে Ñ উঁচু নিচুর ঢেউ দেখা যাচ্ছে Ñ কিন্তু
কোনো স্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে না।
আমি আস্তেকরে ওর কোলের ওপর মাথাটা রাখি। ও কি বুঝল না,
এভাবে প্রকারান্তরে আমি শুলামই। মনে হচ্ছে চোখ বুজে আছি Ñ অথচ না Ñ
আসলে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না আমরা কী চাই। ও কি জানে ও কী
চায়!
আমার নাকমুখচোখ নিয়ে ও খেলতে থাকে। চুল নিয়ে বিলি কাটে। মাঝে
মাঝে হাতের ফাঁক থেকে দেখি কত ঘন সনিড়ববদ্ধ ওর মুখাবয়ব। খুব কাছ থেকে
ওর চোখের অন্ধকারে আমার চোখ আটকে যায়। হঠাৎ শব্দের গ্যাপটাইম।
অতলের খেলা।
যা যেখানে যেভাবে ছিল Ñ অনন্তকাল আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ  
হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। একজন আরেকজনকে এপাশ ওপাশ দেখতে
থাকি Ñ অথবা তাকিয়ে থাকি Ñ কিছুই দেখি না Ñ শুধু আমাদের চোখের তারা
বড় হয়ে যায় Ñ যেন সখ করে আমরা চোখে দিয়েছি বেলাডোনা Ñ আর
আবেগ গলে গলে পড়ছে চোখের বিস্ফারিত মণি থেকে। উপরের দিক থেকে
একজোড়া ভ্রুনিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। একসময় আরো কাছে এসে পড়ে
ওর চোখজোড়া, আমার ঠোঁটজোড়ার ওপর; চোখের পাতা দিয়ে আমার
ঠোঁটজোড়া একটু ফাঁক করে Ñ আমিও হালকায়, প্রায় জবু বু হয়ে শুধুমাত্র ভ্রুও
পাতা নাড়িয়ে ওর স্পর্শের সাড়া দিতে যাই, ভয় হয় পাছে এই মুহূর্তটা উড়ে
যায় অবিশ্বাস্য হয়ে, সামান্য একটু বেশি নড়াচড়ায়!
ও তো সাইবেরিয়ার মেয়ে। সেই কতটুকু থেকে দেখেছি। ১৩ ক্লাশে ভর্তি
হল আমাদের হাতে হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখনা লাগার আগে থেকেই ওর
ছিল পূরনো ডানা। মফ:স্বল শহরের ডানা Ñ ব্লেড নাই। আমাদের ব্লেড থেকে
ওকে একটু ধার দেই। ও ছিল মনোযোগী Ñ মনে মনে অনেক যোগসাধনা
করতে পারত। আর সর্দারীটা ওর রগে রগে, জেলাশহরের মাথার-বাষ্পসাপ্ল
পাইকারী দাদাদের খাটতে হয়নি। লাউয়ের নিচে শুকিয়ে যাওয়া ফুলটির
মতো লেগে ছিল মাত্র জড়তাগুলি। আপনাআপনিই খসে যাচ্ছিল।
জানতাম ওর দরকার সুযোগ নয়, শক্তি। প্রথমটা ও নিজেই বের করে
নেবে। ওর বোঝা দরকার সর্বাগ্রে, সীমাহীনতাই যে ওর সীমানা Ñ একথাটা।
এ তো মুখে মুখ রেখে বললাম আর হয়ে গেল Ñ তা নয়। নতুন যুগের
নারীরা ইন্ডিভিজুয়াল হতে শিখছে। সহজে তৃপ্তি হয় না। কিন্তু আমরাও তো কম
গুরু নই। হাসতে হাসতে সনড়ব্যাস জীবনের পাঠ নিচ্ছি প্রবল কেরিয়ার
ব্যায়ামের জিমখানায়। স্বপেড়বর ডালপালা ছাঁটতে ছাঁটতে একসময় আমাদের
হাতে এসে পৌছুল। আমাদের খুব রহস্যময়তা ছিল ক্যাম্পাসজুড়ে। একটা
প্রায় হাইস্কুলের পরিবেশ ছিল ক্যাম্পাসের সর্বত্র। অট্টালিকা শোভিত একটা
অজপাড়াগাঁ জুনিয়র হাইস্কুল। মাস্টার শাহেবগণ পোড়ানো ঢেউটিন Ñ
বিদ্যার স্তম্ভ একেকজন Ñ কোনো বিএসসি স্যার নাই, সব ননম্যাট্রিক Ñ
ওরকম একটা স্যাঁৎসেঁতে জরায়ুতে ইঞ্জেক্ট করতে চাইলাম বুনো ষাঁড়ের
বীর্য Ñ বড়জোর তীরে তীরে চিরুণীর দাঁত উঠত পোষা ব্রহ্মপুত্রে Ñ আমরা
সেখানে তরঙ্গে তোরঙ্গে ঘাড়ের ওপর ঢেউ তুলে তার মাথায় বসে থাকতাম
Ñ আর সময়টাও ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে নোংরা সময়, ব্যক্তির রিক্ততার
কাল, আশির দশক। ডানা নিয়ে এলে, সে ডানায় উড়াল দেবার শক্তি ছিল না।
আমাদের ডাবল খাটনি, তন্ত্র মন্ত্র যন্ত্র, তিনটাই চিনিয়ে দিতে হত।
নাটক করবে Ñ প্রথম মহিলা পরিচালকের গৌরব Ñ কিন্তু একটা ডোবার
মধ্যে তো অলিম্পিক জয় হবে না! তাছাড়া চারদিকে সব কুঁচুটে কুঁচিকুঁচি
চিংড়ির চ্যাংড়ামি। তাই মহড়ায় বসে থেকে ক্রিটিক্যাল ক্রিটিসিজম করা থেকে
প্রদর্শনীর দিন দুষ্টু ছেলেদের বলে দেওয়া Ñ দেখরে বালকেরা, জীবনে তোরা
খুব বেশি ভালো কাজ করার সুযোগ পাবি বলে মনে হয় না; আজ একটা
সুযোগ এসেছে, সুযোগটাকে কাজে লাগা। যা, আজকে সন্ধ্যায়
অডিটরিয়ামের সকল দেখাশোনার দায়িত্ব তোদের। আমরা শুনতে চাই না,
ওরা শোর জন্য বটের চারা পাবে কোথায় Ñ বা টিকিট আটকাবে কে বা
লাফাঙ্গারা বেয়াদপি করবে না এই দায়িত্ব কে নেবে Ñ বলতেও চাই না
কিভাবে এসব হবে Ñ সব তোদের ওপর। এখন গিয়ে আপুর সাথে দেখা করে
সবকিছু জেনে নে। সন্ধ্যায় মার্কেটে এসে বলবি তোদের পরিকল্পনা। যা,
এখন ভাগ।
সামনের সারিতে বসে ওদের ওসব দেখতেও হত। আবার একদিন
বিকালে দেখি সবাই মিলে ধরে বসল, কেমন হয়েছে Ñ এবং বলতে বাধ্য হই,
এই ঐতিহাসিক রজনী ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবে Ñ হে মহিলা, তুমি রতড়ব,
তোমার সহকর্মী ও অভিনেতারা সফল রতড়বচূর্ণ Ñ হে মণিমাণিক্যরা, তোমাদের
প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে চাঁদও ঈর্ষান্বিত Ñ দেখবে তো চল আজ নৌবিহারে Ñ এই
জ্যোৎস্নালোকে Ñ চর পেরিয়ে আরো গভীর চন্দ্রচরাচরে Ñ
সকলেই হৈ চৈ করে সেই অভিযান সমর্থন করেছিল। আমাদের সেই
সনড়ব্যাস জীবনে বালিকারা কেবল নর্ম সহচরী হতে পারত। নদীর পারের
পাঠশালায় ওরা রহস্যময়দের ভয়াল সাহচর্যে আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত ছিল
যদিও। আর কখনো কখনো কেউ কেউ কারো সাহচর্যে শীর্ষের শক্তি পেত,
এছাড়া আর কিছু নয়। কেননা ব্লেড ধার করা যায় না, যদি না তা ধারালো হয়
নিজে থেকেই।
কিন্তু হায়, তিয়াতিশার বেলাডোনা চোখ থেকে একি ধারাজল, জ্যোৎøার
রূপালি আভায় ঝরঝর করে উঠছে, দিগন্তপ্লাবি; আমি আমার ভয় ভুলে
গিয়েছিলাম আগেই, এবার কল্পনার কোলে মাথা রাখা আর ভ্রুচুম্বনের কথাও
বিস্মৃত হয়ে যাই। তাকিয়ে দেখি, আমাদের সখের শিষ্য উড়তে পারার আগেই
যেটুকু উড়েছিল, আজ আর তার ডানা সে স্মৃতিও বহন করতে পারছে না। ওর
নিজস্বতা হারিয়ে গেছে নিজেরই বিষাদের কাছে, যেখানে ও আর কাঁদার
জায়গাটুকুও রাখেনি। নিজের পরিতৃপ্তির কাছে একটা সহজ মানে চেয়েছিল,
পেয়েছে যে তারো চেয়ে কম। যেন কোনো ফায়দা উঠল না এই জীবনে।
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০০৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ