একটি ভাবগত বিপ্লবের মুখোমুখি

আনোয়ার শাহাদাত

পাবলিক লাইব্রেরি ভবনটির আকৃতি বিশাল জলজাহাজের মতো। দুটো রাস্তা দুদিকে গেছে লাইব্রেরিটাকে ফেঁড়ে। একটি কিসেনা বুলভার্ড অন্যটি মেইন স্ট্রিট। দুদিকের প্রসস্থ সিঁড়ি ধরে লাইব্রেরিতে ঢোকা যায়। লাইব্রেরির প্রধান সিঁড়ি ও মেইন স্ট্রিটের উল্টা দিকে নতুন স্টার বাক্স কফি-শপ খুলেছে। স্টার বাক্স কফি-শপের সামনে দাঁড়ায়ে প্যানারোমিক চোখে তাকালে এবং তাকিয়েওয়ালা যদি আমেরিকায় অভিবাসী হয় তাহলে প্রথমে তার চোখে পড়বে ওই পাবলিক লাইব্রেরির গাঢ় ধূসর রঙের সিঁড়ি , এবং সিঁড়িতে খোদাই করে লেখা প্রায় অর্ধ শ’খানেক ভাষার ছোট-ছোট সব বাক্য। নিউইয়র্ক তথা আমেরিকার ‘মোস্ট ডাইভার্সিফাইড’ এলাকা বলে খ্যাত নিউইর্ক কুইন্সের এই লাইব্রেরির পাথরসিঁড়িতে খোদাই করে লেখা বাক্যগুলোর মধ্যে বাংলাও রয়েছে। ‘বাংলা’ যে বাক্যটি জ্বল-জ্বল করে গাঢ় ধূসর সিঁড়িতে তা হলো ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরী’।

বাংলাদেশের আদি সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী দলের নেতা জনাব ফরিদউদ্দিন মাহতাব স্টার বাক্স কফি শপের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলায় লেখা ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরী’ দেখেন এবং পড়েন। ভেতরে ‘খানিকটা’র চেয়ে অধিক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি, এবং মনে মনে একটি সংলাপও আওরান, ‘ভাষা হিসেবে বাংলার অগ্রযাত্রা কে রুধিবে এ ভুবনে।’

স্টার বাক্স-এর সামনে থেকে সিঁড়ির ওপর দিয়ে তাকালে রাস্তা কিসেনা বুলভার্ড পার করে চোখে পড়বে চশমার দোকানের সাইন--‘ক্রিয়েটিভ অপটিক্যাল’ ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্ট ‘ব্যাংকো’, তারপরে ‘নাইন্টি নাইন সেন্ট’-এর দোকান। যার পুরো সাইন বোর্ডটিতেই বড় করে লেখা রয়েছে ইংরেজি সংখ্যা হরফে ‘৯৯ সেন্ট স্টোর’, তার পরে হার্ডওয়ারের দোকান। এভাবে একটার পর একটা।স্টার বাক্স-এর এক ডলার পঁচাশি সেন্ট দামের-আমেরিকার সবচেয়ে দামি-চা পান করাবার পরে সঙ্গী সোহরাব মাহমুদ টিপু ফরিদউদ্দিনকে প্রথমে লাইব্রেরি দর্শনের প্রস্তাব করে। এবং সঙ্গী সাংবাদিকের প্রস্তাব মত তারা ফ্লাশিং পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢোকেন। আদি সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদী দলের নেতা লাইব্রেরির ভেতরে দেখেন। দেখে তিনি অভিভূত হন এবং আরো হতে থাকেন এর বিশালত্ব দেখে। এমন নয়, এই প্রথম নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাব অভিভূত হচ্ছেন। তিনি এর আগে তিনাধিকবার আমেরিকায় এসেছেন এবং যথারীতি অভিভূত হয়েছেন। এখনও হচ্ছেন, এবং তিনি ধরেই নিয়েছেন যতবারই আমেরিকায় আসবেন ততবারই এ দেশটির যাবতীয় জিনিস দেখে অবাক এবং অভিভূত হবেন।

ফ্লাশিং পাবলিক লাইব্রেরির ভিনদেশী ভাষার গ্রন্থ বিভাগে নেতার সঙ্গী সোহরাব মাহমুদ টিপু নেতাকে নিয়ে গেলে তার আর এক দফা অবাক ও অভিভূত হওয়াল পালা শুরু হয় সারি সারি শত শত বাংলা বইয়ের সংগ্রহ দেখে। আবারও নেতা আবেগাপ্লুত হন বাংলার অপ্রতিরোধ্য বিজয় দেখে! (এখানে নেতার আবেগ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা-যুদ্ধপূর্ব বরিশালের লঞ্চ ঘাটের বায়স্কোপওয়ালা বিশ্বনাথের বিখ্যাত ‘কী চমৎকার দেখা গেছে’ সংলাপটি খুব যুৎসই মনে হচ্ছে) আবার নেতার অভ্যাসবশত সন্দেহও হয় এই ভেবে যে আমেরিকার মত জায়গায় কেন তারা বাংলা বই রেখেছে। নেতার মনে হয় সেই সারা জীবনের ব্যবহৃত দলের ভেতর শত্র“র বিরুদ্ধে কথিত অপবাদ। যে শালা ‘সি আই এ-র এজেন্ট’-এর কাজ, নয়তো এই বই রাখা! তার মনে হয় এসব নিশ্চয়ই সি আই এ-র কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ! নেতার এ কথা মনে হওয়ার পর আবার নিজের প্রতিই একটু লজ্জা হয় অন্য কথা ভেবে, যে তিনি সারা জীবনই ওই অপবাদ শত্র“র বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন মিথ্যা ও অন্যায়ভাবে। কেননা তিনি সব সময় জানতেন যে দলের ভেতর তার এবং তার গ্র“প থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তি সি আই এ-র এজেন্ট দূরে থাক এমন কি দেশী সরকারের দালাল হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। তারপরও উপমহাদেশে বাম দলগুলোতে অন্তর্দলীয় শত্র“ ঘায়েল করতে এর চেয়ে মোক্ষম অপবাদ আর কার্যকর হতে দেখা যায়নি। কিন্তু তিনি বাম রাজনীতির শুরু থেকেই জানতেন যে এ ধরনের অপবাদ প্রধানত মিথ্যা। তারা সি আই এ-র এজেন্ট খুঁজে পেতেন যত না সি আই এ-র প্রকৃত দলগুলোর মধ্যে, তার চেয়ে নিজ বামঘেষা সি আই এ-বিরোধী দলের মধ্যে।

যাহোক, তারপর নেতা পরিকল্পনা করেন এই আমেরিকার লাইব্রেরিতে অভিবাসী বাঙালীদের পড়বার সুবিধার জন্য রাখা বইয়ের উপর তিনি ঢাকায় ফিরে কলাম লিখবেন। তিনি দৈনিক দিনরাত পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক। তার মন্দ লাগে না যখন তার বক্তৃতার আগে তার সম্পর্কে বলা হয়, ‘এবারে বক্তৃতা করবেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট এবং বিশিষ্ট কলামিস্ট জনাব ফরিদউদ্দিন মাহতাব’। তিনি মনে মনে এই কলামের একটি নামও ঠিক করেন ‘বাঙালীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিজয়। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, এভাবে সিরিজে চলতে থাকবে।আদি সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী দলের নেতার হাত সহসাই নিউইয়র্কের ফ্লাশিং লাইব্রেরির বাংলা গ্রন্থের সংগ্রহের ওপর চলে যায়। তিনি এমনভাবে বইসমূহের ওপর হাত বোলাতে থাকেন যেন ছেলেবেলায় তার বাবা--যিনি বিশাল সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন-দোনালা বন্দুক ও পাইক-পিয়াদা, মটর বাইক, লঞ্চ করে সুন্দর বনে শিকার শেষে তিনটে বড় হরিণ ও দুটো বাচ্চা হরিণ সহ ফিরে এসেছেন। কিশোর ফরিদউদ্দিন মাহতাব সেই ছোট হরিণ দুটোর গায়ে পশমের ওপর দুই হাত বুলাচ্ছেন, আদর করছেন। বাংলা বইয়ের এ বিজয়ে (নেতার মতে) নেতার অভিভূত হওয়ার দৃশ্য এমন কিছু নিভৃত ঘটনা নয়, বরং এর স্বাক্ষী নিউইয়র্কে তার ওদিনের সঙ্গী সোহরাব মাহমুদ টিপু। সাম্যবাদী নেতার এই আবেগাপ্লুত হওয়ার ঘটনা নিয়ে সোহরাব মাহমুদ টিপুও তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা করে ফেলে যে সে একটি ফিচার লিখবে নিউইয়র্কের স্থানীয় বাংলা পত্রিকায়।

সোহরাব মাহমুদ টিপু নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত অনেকগুলো বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকার একটির প্রতিবেদক এবং ইতোমধ্যে ‘তুখোড়’ প্রতিবেদকের নাম কুড়িয়েছে। অভিবাসী বাংগালিরা এই তুখোড় প্রতিবেদককে শ্রদ্ধার চোখেই দেখে থাকে, যেভাবে সাধারণ বাঙালীরা সাংবাদিকদের মহান মনে করে থাকে। প্রতিবেদক সোহরাব টিপু তার নিউইয়র্কের সাংবাদিক জীবনের সফলতা ও স্বীকৃতি অর্জন করেছে প্রধানত অভিবাসী বাঙালীদের ভেতরে ‘পরকীয়ার নিষ্ঠুর পরিণতি’ ‘কার বধূয়া চলিয়া গেল কারইবা আঙিনা ধরে’ কিংবা ‘বাঙালী ললনা কৃঞ্চাঙ্গ যুবকের হাত ধরিয়া বাহির হইয়া গেল’ ধরনের প্রতিবেদন রচনা করে।সাংবাদিক লেখার একটি ফর্মও ভেবে ফেলে কীভাবে সাম্যবাদী নেতাকে নিয়ে এই আবেগাপ্লুত হওয়ার ঘটনাকে আরো স্পর্শকাতর করে তোলা যায়। হঠাৎ তার এও মনে হয়--তা দীর্ঘ সাম্যবাদী নেতার হাত ধরে চলে গেলে লিখতে জোসটা আরো বাড়তো। অর্থাৎ কিনা প্রকৃত জোসিয়ান হয়ে ‘কমিটমেন্ট’ থেকে একটা লেখা। সাংবাদিক মনে মনে একথা চিন্তা করে একটু হাসে, একটু লজ্জিতও হয়। কেননা সম্মানিত এ নেতাকে জড়িয়ে অন্যের বউ চলে গেল কি বেরিয়ে গেল ধরনের কথা ভাবা ঠিক নয়। তবে এও ভাবে সাংবাদিক যে, সে রকমটি হলে তার লিখতে এমন কোনো অসুবিধা হতো না, কেবল একটি বাক্য জুড়ে দিলেই ব্যাপারটি বৈধতা হতো না , কেবল একটি বাক্য জুড়ে দিলেই ব্যাপারটি বৈধতা পেয়ে যেত যে ‘মার্কস বলেছেন’। সে যাক, সাংবাদিক সোহরাব মাহমুদ টিপু নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে একটি অসাধারণ প্রতিবেদন সে রচনা করবে নেতার এই আবেগাপ্লুত হওয়ার দৃশ্য নিয়ে।

সাম্যবাদী দলের নেতার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অতি মাত্রায় প্রখর, তিনিও টের পান সাংবাদিক তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। অতএব, তার উচিৎ সাংবাদিককে পর্যবেক্ষণ করবার আরো সুযোগ করে দেওয়া। তিনি তাই করেন, আরো আবেগ আনার চেষ্টা করেন, চোখের মুখের ভাবখানা এমন করেন যেন সাংবাদিক লিখতে পারে ‘তিনির (তার) দেশপ্রেমের আবেগে চোখের কোনাখান-খানায় জল জমেছে, যেন জলবন্যা!’নেতা বইগুলো নেড়ে-চেড়ে দেখেন। মূলত নিউইয়র্কের বাংলা কাগজের প্রতিবেদককে দেখাতে থাকেন। দেশপ্রেমের নমুনা ও দৃষ্টান্ত। বইগুলো নেতার মধ্যে প্রবল জলোচ্ছাসের আকারে দেশপ্রেমের বোধ জাগায়। কিন্তু তিনি মুষড়ে পড়েন যখন দেখেন এই বইগুলো লাইব্রেরিতে সরবরাহ করেছে অন্য একটি দেশের প্রতিষ্ঠান। তা হোক তারা বাংলায়ই কথা বলে, তবুও তারা তো অন্যদেশী, বাংলাদেশী নয়। ধর্মপ্রসঙ্গ না হয় বাদই থাক। সাম্যবাদী কমিউনিস্ট হিসেবে সে প্রসঙ্গ বাদ দেয়া উচিৎ বলেও তিনি মনে করেন। কেননা ধর্ম একজন কমিউনিস্টের কাছে প্রধান বিষয় নয়। (কী চমৎকার, কী চমৎকার) যদিও কৃষ্টি হিসেবে জনসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের সেন্টিমেন্টকে সম্মান দেখানোর জন্যে দলের পোলিটব্যুারো লোকদেখানো ধর্মচর্চা অনুমোদন করেছে। দল মনে করে ধর্মীয় পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ জনসাধারণের সšত্তষ্টিক্রমে অনুসরণ করা যেতে পারে। পোলিটব্যুারো এই ঘোষণার আগেও পরে আরো যে বাক্যটি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো ‘মার্কস বলেছেন।’

নেতা প্রতিবেদক সোহরাব মাহমুদ টিপুকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হন যে, যারা এই বই নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিকে সরবরাহ করেছে তারা অন্যদেশী কিনা এবং ওই প্রতিষ্ঠানটি যে বা যারা পরিচালনা করে থাকে তারাও বাংলাদেশীদের ধর্মের বিপরীত ধর্মের কিনা।

তখন থেকে নেতার ভেতরটায় দেশপ্রেমের আগুন ক্যালিফোর্নিয়ার মলিবু কি নিউ মেক্সিকো অথবা ফ্লোরিডা বন্য আগুনের মত সাড়া হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সাড়া পৃথিবীর বনগুলো দেশপ্রেমের আগুনে পুড়ে অঙ্গার করে ফেলতে ইচ্ছে করছে আদি সাম্যবাদী দলের নেতার। ইচ্ছে করে জনশূন্য প্রান্তরে কল্পিত জনজাগরণের বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবের সাত মার্চের ভাষনের কণ্ঠের সবটুকু শক্তি দিয়ে বক্তৃতা করে জনগণকে বোঝাতে যে, এই হচ্ছে দেশপ্রেম, এই হচ্ছে এই, এবং ইত্যাদি সব। সে খুব স্পষ্ট নয় এখন কী করে নিজের সুবিধা মত আবেগের ভাবনা দেশপ্রেমের সংজ্ঞার আওতাভুক্ত হয়। দেশপ্রেমের বিমূর্ত এই ধারণার অস্তিত্ব না থাকলে এই সংজ্ঞার তাত্ত্বিকগণ ও এই তত্ত্ব তরিকার পীর-ভাই সাম্যবাদী নেতাদের অসুবিধে যে হতো তা পরিষ্কার হতে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। নেতার দেশপ্রেমের আগুনে তখন জ্বলছে ভারতের প্রদেশ ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে আমেরিকা অভিবাসী পরিচালিত বাংলা বইয়ের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মুক্ত বাণিজ্যধারা। দেশপ্রেম কীভাবে আগুনে পরিণত হয়, এবং সে আগুন কীভাবে তার রাষ্ট্রধর্মের বিপরীত ধর্মের মানুষকে পুড়িয়ে ছাইভষ্ম করে ফেলে তা উপলব্ধি না করতে পারলে বলা যায় ব্যর্থতারই এক ভয়াবহ নমুনা। এটাই যে মানবজন্মের প্রধান দ্বন্দ্ব তার ‘বলে গেছেন মার্কস’, (সাম্যবাদী দলের নেতারা শ্রমিকদের সামনে মার্কসের নাম নিতে কখনো ‘মার্কস ভাই’ বলে থাকেন, শ্রমিকদের সামনে মার্কসের নাম নিতে কখনো ‘মার্কস ভাই’ বলে থাকেন, শ্রমিকদের বোঝাতে যে তারা মার্কসের কত কাছের লোক। যেমন সে সময়ের সাংবাদিকরা তাদের স্মৃতিচারণে শেখ মুজিবকে ‘মুজিব ভাই’ বলে বোঝাতে চান তারা যে কত কাছের লোক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। শ্রমিকরা জানে না কে জনাব কাল মার্কস আর কেই বা কে।

নেতা নিজের ভেতরে পরিষ্কার টের পান দেশপ্রেমের উত্তাপ। তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন দেশপ্রেম কখন কী ভাবে কী ফর্মে ভেতরে জাগ্রত হয়। এ নিয়ে তিনি এক সময় একটি পুস্তিকা রচনা করতে চেয়েছিলেন। (পুস্তিকাটি রচিত হলে আজ হয়তো নিজের লেখা সেই পুস্তিকাখানি আমেরিকার এই লাইব্রেরিতে দেখতে পেতেন, তা ভাবতে নেতার মন্দ লাগে না।) সময়াভাবে হয়ে ওঠেনি তবে পরিকল্পনা এখনো আছে। কারণ তার অনেকবারই মনে হয়েছে জাতীয়তাবাদীদের ভেতরে জাগ্রত দেশপ্রেমের উত্থালপাতাল নিয়ে দুনিয়ায় পর্যাপ্ত তত্ত্ব নেই। পল্টনের অফিসে কর্মীদের সামনে অবশ্য এ নিয়ে তিনি একাধিকবার কথাও বলেছেন। আদি সাম্যবাদী দলের নেতার সে সব বক্তব্য দলের কর্মীরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছে এবং অবশ্যই বিশ্বাস করেছে যে কখনো কখনো কি কোথাও কোথাও ওই বিদেশী মার্কস-এর চেয়ে তাদের নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাব অনেক বেশি বোঝেন। ফরিদউদ্দিন মাহতাব কিছুটা রাগান্বিত এবং অবাক স্বরে বলেছেন যে কীভাবে মার্কস-এর মত একজন তাত্ত্বিক মানুষের ভেতরকার দেশপ্রেমের তোলপাড় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে ভুলে গেলেন! এর পর তিনি দেশপ্রেমের উন্মাদনা সম্পর্কে তার মতবাদ প্রকাশ করেন। তখন কর্মীরা তাদের সকল কর্মতৎপরতা বন্ধ করে তাত্ত্বিক নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাবের কথা শুনেছে। যে কর্মী কেটলি থেকে চা ঢালছিল সেও থেমে পড়ে, ডালভাঙা কলের পুষ্টিহীনতায় শুকিয়ে যাওয়া শ্রমিক তার নাকের অঝোর সর্দিঝাড়া থামিয়ে চেয়ে থাকে নেতার মতবাদ শোনার জন্য। নেতার মতবাদ বর্ণনার সময় যে উপস্থিতদের মুক ও বধির ভঙ্গীতে শোনা উচিৎ সে সম্পর্কে নেতা বিভিন্ন সময় নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তার দেশপ্রেমের তত্ত্বে বলেন: ‘দেশপ্রেম হচ্ছে এক ধরনের ক্রোধ ও ঘৃণা।’ এটুকু বলবার পর কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লে তিনি বিস্তারিত বর্ণনা দেন কীভাবে ক্রোধ ও ঘৃণা দেশপ্রেমে রূপ লাভ করে। নিজের দেশের প্রেম জাগ্রত করতে চাইলে অন্য দেশের প্রতি পুঞ্জিভূত করতে হবে ক্রোধ-ঘৃণা ও ক্ষোভ। কার্যত অন্য দেশের সব কিছুর প্রতি এই অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে, বিশেষত শত্র“ রাষ্ট্র কী? নেতা এর উত্তরে বলেন এটা আপনাকে বুঝে নিতে হবে, এ মুহূর্তে আমাদের শত্র“রাষ্ট্র ভারত, তার ভূখণ্ড, তার সংস্কৃতি, তার ধর্ম, তার গণতন্ত্র ইত্যাদি। এরপরও একজন শ্রমিক-কর্মী জানতে চায়, কিন্তু স্বাধীনতার সময় তো ভারত আমাদের যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে। নেতা তখন বলেন এগুলো তোমরা বুঝবে না, এসব গ্লোবাল পলিটিক্স। এরপর তিনি আবার বলতে থাকেন, ‘মাও এবং মার্কস বলেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।’ নেতার বয়ান ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ সম্পর্কে আদমজি জুটমিল প্রতিনিধি বাহাউদ্দিন মনে মনে একটি বাক্য উচ্চারণ করে। তা হলো, চোঁদানির পুত, সব নিজের রাজাকারী মাও আর মার্কস-এর নামে চালায়।

বাহাউদ্দিন সাম্যবাদী দলের নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাবকে একটু বেশি চেনে ক্ষুদ্র অপরাপর নেতা-কর্মীদের চেয়ে। অবশ্য তার একটি কারণ আছে। বছর দশেক আগে আমেরিকার দেওয়া ইমিগ্রেশন লটারি ওপি ওয়ানে বাহাউদ্দিনের বি এ পাশ ছেলে বিজয়ী হলে বাহাউদ্দিন যথারীতি সে সংবাদ নিয়ে দলনেতার কাছে আসে। নেতা সামন্ত প্রথায় চিৎকার দিয়ে ফেটে পড়েন, বলেন, ‘তা কী করে হয়, সাম্রাজ্যবাদীদের শিকার তৃতীয় বিশ্বের এই দরিদ্র দেশের একজন কমরেডপুত্র কিনা চলে যাবে সেই সাম্রাজ্যবাদেরই হাতকে শক্তিশালী করতে! কমরেড আপনারই পুত্র কিনা আমাদের-আপনার, আপনার অপরাপর সন্তানের রক্ত শুষে নিতে সাহায্য করবে! এ অবমাননাকর, কমরেডপুত্র কিনা হবে সাম্রাজ্যবাদের দোসর! এ অবমাননাকর, কমরেডপুত্র কিনা হবে সাম্রাজ্যবাদের দোসর! আপনি এই মুহূর্তে ফেরান তাকে এ পর্যন্ত বলে নেতা থামেন একটু।

এবং আবার বলা শুরু করেন, না হলে, চেয়ার‌্যান মাও এবং কমরেড চারু মজুমদার নির্দেশিত পথ অনুসরণে দল আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আদমজি জুট মিল শ্রমিক নেতা বাহাউদ্দিনের রয়েছে অসম্ভব ঘৃণা। কিন্তু সামান্য একটু সমস্যা এখানে বাহাউদ্দিনের পরিবারে দেখা দেয়। লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত বাহাউদ্দিনের স্ত্রী নড়ে-চড়ে বিছানায় উঠে ছেলের মা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘বাজান আমার অসুখের চিকিৎসা এবারে করাইতে পারবি?’ ফলে ব্যাপারটা আর বাহাউদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, ছেলে ও মরতে পরে থাকা মায়ের বেঁচে থাকার স্বপ্নে পরিণত হয় আমেরিকার গ্রীন কার্ড লটারী ওপি ওয়ান। তারপরও বাহাউদ্দিন ভাবে, দলনেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাবের সঙ্গে আলোচনা করে এক ধরনের সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে। সে অনুযায়ীই আদি সাম্যবাদী দলের নেতার কাছে দলের নিবেদিত শ্রমিক নেতা আলোচনা করতে চায়। কিন্তু নেতা রাগে ফেটে পড়েন গোত্রপ্রধানের মত চিৎকার দিয়ে। আদমজি শ্রমিক নেতা বাহাউদ্দিন অনুভব করে বড় নেতার কাছে সে যেন প্রাকসভ্য যুগের দাস। তবুও কিছুটা সাহস করে পাল্টা প্রশ্ন করে তবে যে আপনার দুই ছেলে ও এক মেয়ে ওই আমেরিকাতেই থাকে।

আদি সাম্যবাদী দলের নেতা একটু চুপ করে থাকেন এমন ভাবে যেন এর চেয়ে নাবালকসুলভ কথা তিনি এর আগে কখনো শোনেননি। না, যেন কেউ এমন কথা শোনায়নি আগে, যেন এর চেয়ে নিম্নমানের, ‘গ্রাম্য’, নিচু শ্রেণীর রসিকতা পূর্বে তার সঙ্গে কেউ করেনি। তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তার কথা বলার চাপযুক্ত উচ্চস্বর নিচে নেমে আসে। অনেকটা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে মৃতুস্বরে যা বলেন তার অর্থ দাড়ায় মজুর বাহাউদ্দিনের ছেলে আর নেতা ফরিদউদ্দীন মাহতাবের সন্তান এক কথা নয় কেননা নেতার ছেলে মেয়েদের রয়েছে এক সুমহান পারিবারিক ঐতিহ্য। নেতার বাবা ছিলেন পাকিস্তানের বিরাট কর্মকর্তা, তারও পিতাজান ও প্র-পিতামহরা ছিলেন বৃটিশ শাসনামলে হিন্দু জমিদারদের পাশাপাশি যে সব মুসলমান জমিদাররা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন তাদেরই দলভুক্ত। তারও পূর্ব বংশাবলি নাকি এদেশে এসেছিলেন মোঘল আমলে মধ্যপ্রাচ্যের কি মধ্য এশিয়ার কোনো ভূখণ্ডের অভিজাত পরিবার থেকে। যারা নাকি প্রতিশ্র“তিবদ্ধ ছিলেন মানুষের কল্যাণের জন্য, সেই প্রতিশ্র“তি থেকেই তারা ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন এই বাংলায় নিম্নবর্গীয় বহু দেবতায় বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে। শ’ কয়েক বছর আগে তলদেশ বর্গীয় হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত, আর এখন শ্রমিক বাহাউদ্দিনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেতার ছেলেমেয়েদের তুলনা আকাশ-পাতাল অবাস্তব (নেতা আকাশ-পাতাল কথাটা বলবার সময় ‘বামন হয়ে চাঁদ’ জাতীয় কথাবার্তাও অবশ্য বলেন)।

সে সব কথাই আদি সাম্যবাদী দলের নেতা সদম্ভে ঘোষণা করেন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের আদি সাম্যবাদী দলের নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাবের দেশপ্রেমের উত্তাপে নিউইয়র্ক কুইন্স-এর ফ্লাশিং পাবলিক লাইব্রেরির আন্তর্জাতিক বইয়ের বিভাগে রাখা বাংলা বইগুলো পুড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। তিনি টের পাচ্ছেন আগুন দাউ দাউ করে তার ভেতরে জ্বলছে। তার ঘৃণা হয় এই পাবলিক লাইব্রেরির প্রতি নিউইয়র্কের প্রতি, তথা পুরো আমেরিকার প্রতি। নেতার সূত্র অনুযায়ী এই অগ্নিই প্রমাণ করে তার দেশপ্রেম এখন কত শক্তিশালী। তিনি আরো নিশ্চিত হন আমেরিকা যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রই। তা না হলে তারা কেন বাংলা বইয়ের সংগ্রহ বাংলাদেশের শত্র“রাষ্ট্রের পরিবেশকের কাছ থেকে নেবে। তার আরো স্পষ্ট মনে হয় লাইব্রেরির সিঁড়ির ওপর যে লাইনটি লেখা বাংলা ভাষার প্রতীক হিসেবে সেটিও লিখেছেন ভিনদেশী কবি যার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার ধর্মবিশ্বাস ছিল নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাবের দেশ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্মের বিপরীত অবস্থানে। নেতার সঙ্গী সাংবাদিক সোহরাব মাহমুদ টিপুও সমগোত্রীয় অনুভূতির লোক। সেও এই দেশপ্রেমের আগুনে পুড়ে উজ্জ্বীবিত। দেশপ্রেম এখন তাদেরকে বাধ্য করে ওই মুহূর্তে লাইব্রেরি ত্যাগ করতে। তারা লাইব্রেরির বাইরে বেরিয়ে এসে সেই সিঁড়ি এলাকায় দাঁড়ায়। যার দুদিকে দুই রাস্তা--একটি মেইন স্ট্রিট অপরটি কিসেনা বুলভার্ড।সৃজনশীল প্রতিবেদক সোহরাব মাহমুদ টিপুর তখন একটি ভিন্ন আইডিয়ার কথা মনে হয়। সে নেতাকে বলে, ‘নেতা আপনার জুতা দিয়ে সিঁড়িতে খোদাই করে লেখা ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরী’ লেখাটি ঘষতে থাকেন যেন মুছে ফেলতে চাচ্ছেন, আমি সেই দৃশ্য ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাই। এবং একদিন আমি নিশ্চিত বাংলার জাগ্রত জনতা প্রাণভরে দেখবে তাদের নেতা কীভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুছে দিতে চাচ্ছেন যাবতীয় শত্র“চিহ্ন। নেতাও একমত হন সাংবাদিকের এই বৈপ্লবিক ধারণায়।

তিনি রাজি হন। তার মনে যেন ছিল এমন এক সৃজনশীল কর্মতৎপরতা যা কিনা সম্ভাবনার দ্বার একদিন জাগ্রত জনতার কাছে উন্মুক্ত করে দেবে। যদিও দুজনের কারোরই স্পষ্ট ধারণা নেই এসব ভারি কথার অর্থ কী দাঁড়ায় অথবা ওই পাথর খোদাই করে লেখা মুছতে চাওয়ার মধ্যে প্রকৃত বিপ্লব কোথায়? নেতা তাই করেন, অনুগত ভক্ত সাংবাদিকের পরামর্শে ফ্লাশিং পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বাংলা হরফে লেখা ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়েরি’ মুছতে চেষ্টা করেন। আদি বাম সাম্যবাদী দলের নেতা ফরিউদ্দিন মাহতাব আরো মনে করেন এখন তার কিছুটা ক্যামেরা অ্যাকশনও দেখানো উচিৎ। যেন ছবিটি বহু বছর পরে ‘জাগ্রত জনতা’ দেখে প্রকৃত দেশপ্রেমের উন্মাদনায় মত্ত হতে পারে। তিনি হাত দুটো উপরে তোলেন এবং অনভ্যস্ত পায়ের কালো রঙের পে’ লেস থেকে কেনা জুতায় সেই লেখা মুছতে চেষ্টা করেন। তার নতুন স্যুটও অনভ্যস্ততায় কেপে কেপে ওঠে। এক ভিন্ন ধরনের ছন্দে ছবির জন্য পোজ দিতে থাকেন ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়েরি, মুছে মুছে। হ্যাঁ, দলীয় পয়সায় কেনা তার নতুন স্যুট ও পে’ লেসের কম দামের চামড়া নয় এমন জুতার স্বার্থকতা ফুটে ওঠে আরো যখন তার নতুন জুতার গোড়ালির ভেতর অংশে লেখা দেখতে পান ‘মেড ইন চায়না’। তার মনে হতে থাকে চেয়ারম্যান মাও যেন জুতার গোড়ালির ভেতর থেকে প্রকৃত বিপ্লবী অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন। তার মনে হয় সেই অনুপ্রেরণাই এখন সার্থক দেশপ্রেমের ক্রোধ সৃষ্টি করেছে।

তাদেরর ফটো সেশন শেষ হলে আদি সাম্যবাদি দলের নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাব নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক সোহরাব মাহমুদ টিপুকে বলেন, ‘কমরেড এবারে অন্য কিছু করতে হবে।’ কমরেড টিপু প্র¯ত্ততই ছিল যেন। সে এবারে ফ্লাশিং পাবলিক লাইব্রেরির উল্টোদিকে যে দিকে কিসেনা বুলভার্ড সেই রাস্তার ওপারে যেখানে নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকান সেখানে নিয়ে যায়। তার আগে অনেকটা ট্যুর গাইডের মত সাংবাদিক টিপু আদি সাম্যবাদী দলের নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাবকে নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকান সম্পর্কে ধারণা দেয় যে এই দোকানের যে কোনো জিনিসের দামই এক ডলারের চেয়ে এক সেন্ট কম, অর্থাৎ নাইন্টি নাইন সেন্ট। সে আরো বুঝিয়ে বলে, কখনো দু’তিনটা জিনিস মিলেও ওই নাইন্টি নাইন সেন্ট হয়। এ ধরনের দোকান খুবই লাভজনক তাদের জন্য যারা কম দামে কিনতে চায়। সোহরাব মাহমুদ আরো যোগ করে, ‘ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির এই এক অসুবিধা। বোঝা যায় না এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায় বা এরা দুজন কী মনে করে। তারা নাইন্টি নাই সেন্টের দোকানে ঢোকে এবং দোকানের যাবতীয় জিনিস দেখতে থাকে।আদি সাম্যবাদী দলের নেতা ফরিউদ্দিন মাহতাব অবাক হয়ে দেখতে থাকেন চেয়ারম্যান কমরেড মাও-এর তথা তার দেশ চায়নার কী তাজ্জব আমেরিকা বিজয় এই নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকানের মাধ্যমে। হাজার রকমারি জিনিসের ওপরে ছাপ্পর মেরে লেখা ‘মেড ইন চায়না’।

তিনি এত খুশি বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও হননি। তার খুব খুশি লাগছে, এর আগে যেমন ফ্লাশিং লাইব্রেরির সামনের সিঁড়িতে বাংলা লেখা দেখে এবং পরে লাইব্রেরির ভেতরে বাংলা বইয়ের সংগ্রহ দেখে বুক ভরে উঠেছিল ঠিক তেমনি আবারও আমেরিকায় চায়নার এই বিজয় দেখে তার বুকের ভেতরটা ফুলে উঠতে থাকে। যদিও এর আগের বারে ফুলে ওঠা বুক সংকুচিত হয়েছিল বই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও অন্য দেশী ভিন্নধর্মী কবির লেখা ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়েরি’ দেখে। সে ক্রোধ আবারও ভালোবাসা ও আদর্শগত গর্বে পরিণত হতে থাকে নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকানে গণচীনের আমেরিকা বিজয় দেখে।

নেতার মনে পড়ে বছর কয়েক আগে যখন প্রথম দিকে ঢাকায় গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রির প্রচলন হয় সেই কারখানায় প্রস্তুত জামা-কাপড় এই আমেরিকায় পাঠানো হবে শুনে আদি সাম্যবাদি দল একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। ঢাকায় আমেরিকান দুতাবাসের অদূরে সেই বিক্ষোভ সমাবেশে তারা চারুকলা ইনস্টিটিউশনের কর্মীদের বানানো আমেরিকান পতাকায় আগুন লাগিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা শেষে খেলেছিল এবং নেতা বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমার দেশের শ্রমের বিনিময়ে বানানো কাপড় পড়বে ওই সাম্রাজ্যবাদী রক্তচোষক দেশের মানুষ, তা আমরা হতে দিতে পারি না, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তা প্রতিরোধ করবো’, ইত্যাদি।

এ প্রসঙ্গেই নেতার মনে পড়ে তার ছেলের ঘরের এবং মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনীদের গায়ে যেমন ‘মেড ইন চায়না’র জামা কাপড় দেখেছেন তেমনি ‘মেড ইন বাংলাদেশে’র গায়ে সেই সব পোশাক দেখে নেতার দেশের শিশু শ্রমিকদের জন্য গর্ব বোধ হয়। নেতা এও পরিকল্পনা করেন যে তার দৈনিক দিনরাত পত্রিকায় কলামে লিখবেন যে তার নাতিরা কী বিশুদ্ধ আমেরিকান ইংরেজিতে কথা বলে এবং নিম্নবর্গীয়দের ভাষা একদম বলতে পারে না।

নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকানে চীনের এই বিজয় দেখে বেরিয়ে আসার মুখে দোকানের মালিক কী মনে করে তার পরিচয় দেয় এবং বলে তার দেশ পাকিস্তান। সে এই দোকানের মালিক। ‘হামারা মুসলমান এবং বেরাদারেন ইসলাম’ জাতীয় কথাবার্তা তাদের মধ্যে হয়। নেতা আনন্দিত ও উৎফুল্লিত, তার আদর্শের দেশ চায়নার নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকানে দ্রব্যাদির বিজয় দেখে এবং যার স্বত্বাধিকারী কিনা একজন ধর্মভিত্তিক পাকভ্রাতা। আদি সাম্যবাদি দলের নেতা ফরিদউদ্দিন মাহতাব ও অনুগত সাংবাদিক টিপুর আনন্দের সীমা থাকে না পাকিস্তানী ভাইয়ের দোকানের মাধ্যমে চীনের আমেরিকা বিজয় দেখে। তারা নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকান থেকে বেরিয়ে আসে এবং মনে মনে নিউইয়র্ক কুইন্সের ফ্লাশিং পাবলিক লাটইব্রেরির চাইতে পাকিস্তানী নাগরিকের মালিকানাধীন এ দোকানটির তাৎপর্য, প্রয়োজনীয়তা ও সফলতা অনেক বেশি সাব্যস্ত করে। কেননা এর সঙ্গে রয়েছে একটা আদর্শগত সম্পর্ক যা অন্তর আত্মা থেকে উৎসারিত (ডুগ-ডুগা-ডুগ, কী চমৎকার লাইগা গেছে)।

তারা দুজনের সমস্বরে শ্লোগান দিতে থাকে, ‘মেড ইন চায়না জিন্দাবাদ! পাকভ্রাতা জিন্দাবাদ! নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকান জিন্দাবাদ!’ (ডুগ-ডুগা-ডুগ বরিশাল লঞ্চঘাটের বায়েস্কোপওয়ালা বিশ্বনাথের হাতের ডুগডুগিতে অশেষ বাদ্য বাজতে থাকে)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. গল্পটি এক টানে পড়লাম, যদিও লেখাটি দীর্ঘ বাক্যে ভরপুর। খু উ ব ভালো লাগলো। কাজেম আলী বরগুনার এক লোক হিসেবে এক বড়লোকের ( লেখক পরিচয় গৌণ) বাড়িতে যে আচরণ করেছে তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে অসমতা দেখানোর সাথে উপেক্ষা করার ইঙ্গিতও শিখিয়ে দিয়েছে। এ এক কৌশলী বয়ান।সাথে মুক্তিযুদ্ধ যোগ হয়ে একে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

    উত্তরমুছুন