মাহবুব আজাদ
"ঐ যে পাখি! বকপাখি!" উৎফুল্ল স্বরে
বলে ফাকমিদুল হক।
রমণ সুমহান বেজায় বিরক্ত হন। ফাকমিদুলকে ইদানীং আর সহ্য হচ্ছে না তার। নির্বোধ লোকের সঙ্গ তিনি অপছন্দ করেন না, কিন্তু সেই নির্বোধ যদি তার প্রাপ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করে, তার ওপর চটবার বৈধ কারণ তৈরি হয় বই কি। ফাকমিদুলকে পশ্চাদ্দেশে একটা লাথি মেরে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দিতে ইচ্ছা করে তার, কিন্তু জীবনের সায়াহ্নে এসে তিনি বুঝতে শিখেছেন, ক্রোধ তার মহত্তম অবস্থানে পৌঁছায় সংবৃত হয়ে। তিনি মনের একটি কুঠুরি খুলে একটা চেরাগ বার করেন, তারপর রাগের দৈত্যটাকে পুরে ফেলেন তার ভেতর। ফাকমিদুলের পশ্চাদ্দেশে কোনো কিছুই এখন করতে যাওয়া সমীচীন হবে না। এখন মিত্রতার সময়।
কিন্তু ফাকমিদুল কাজটা কঠিন করে তোলে মুহুর্মুহু! "ঐ যে আরেকটা পাখি! কাকপাখি!"
ওমর ফারুকও বিরক্ত হয় ফাকমিদুলের ওপর। বেটা এক বছর মার্কিন দেশে থেকে এসে হিলারি ক্লিনটনের মতো আচরণ করছে। তুই তো ব্যাটা গ্রামের ছেলে, লুঙ্গি পরে গ্রামের স্কুলে যেতি, আর এখন বকপাখি কাকপাখি কপচাচ্ছিস? দুইদিনের বৈরাগী আর কাকে বলে?
ড্রাইভার বদি হাসে মিটিমিটি। ওমর ফারুক প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্যে বলে, "ফাকমিদুল ভাই, লেখাটা এনেছেন সাথে করে?"
ফাকমিদুল এবার একটু সিরিয়াস হয়, জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, "আমার কি লেখা বগলতলায় নিয়ে ঘুরতে হবে নাকি? সবকিছু মাথায় আছে। ভুলে যায়েন না, আমি একজন শিক্ষক। প্রতিদিন হাজার হাজার বেয়াদব ছেলেমেয়ের সামনে লেকচার দেই। আপনার মতো হাটেমাঠেঘাটে বক্তৃতা দিয়ে রাজনীতি করে বড় হই নাই ঠিকই, কিন্তু লোকজনের সামনে কথা বলার অভ্যাস আমার আছে।"
রমণ সুমহানের মুখে পাতলা একটা হাসি খেলে যায়। লেগে যা নারদ নারদ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বাম স্টান্টবাজ ওমর ফারুকের সাথে সাদা প্যানেলঘনিষ্ঠ ফাকমিদুল হকের মধ্যে কিছু খিটিমিটি তো লাগাই স্বাভাবিক। এলজিইডির এবড়োখেবড়ো রাস্তায় মাইক্রোবাসে ঝাঁকি খেতে খেতে চলার সময়টা তাহলে নেহায়েত নিরস কাটবে না।
ইদ্রিস ফকির বদিকে পথ দেখায়। "হ্যাঁ সামনে নিয়া রাখেন। এর পর আর যাইবে না গাড়ি। রাস্তা নাই। হাইট্যা যাইতে হইবে।"
ফাকমিদুল উৎকণ্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করে, "কত দূর?"
ইদ্রিস ফকির ঠাণ্ডা হাসি হেসে বলে, "বেশি দূর না স্যার। দশ পোনারো মিনিট হাটতে হইবে। তারপরেই পউছিয়া যাইবেন। গরীব মানুষ তো। সরকারি রাস্তা কি গরীবের বাড়ির পাশ দিয়া যায় কখনো?"
রমণ সুমহান একটা চাদর জড়িয়ে নেন গায়ে। "সবকিছু ঠিক আছে না ফকির সাহেব?"
ইদ্রিস ফকির হাসে মিটিমিটি। "সব কি আর ঠিক থাকে স্যার? তাদের মেয়ে ইন্তেকাল করছে। দ্যাখেন যদি একটু বুঝাইয়া শুনাইয়া ...।"
ওমর ফারুকের কানে যায় না সব কথা। সে একটু অস্থির হয়ে ভাবে টাকার কথা। তাদের প্রত্যেকে দেড় লাখ করে পাবে কাজটা উদ্ধার হলে। একটা নতুন ল্যাপটপ কিনতে হবে তাকে, সেটা এই খ্যাপের টাকা থেকেই কেনা যাবে তাহলে। পুরোনো ল্যাপটপটার ব্যাটারি খুব সমস্যা করছে। জরুরি সব লেখার ফাঁকে ব্যাটারি ডুকরে উঠে কাঁদতে থাকে।
খ্যাপটা যোগাড় করে এনেছেন রমণ সুমহানই। তিনি পাকা লোক, জহুরির চোখ, তাছাড়া কড়াইল বস্তিতে গবেষণার কাজে সময় কাটিয়েছেন বিস্তর। গণ্ডগোল কীভাবে লাগে, কীভাবে এগোয়, আর কীভাবে নিরসন হয়, সবই তাঁর নখদর্পণে। আর শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামে এসব গণ্ডগোল কড়াইল বস্তির তুলনায় শতগুণে নিরীহ, বিশেষ করে ভিক্টিম যেখানে দরিদ্র ভূমিহীন।
স্থানীয় প্রতিনিধিই ইদ্রিস ফকিরকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো। ইদ্রিস ফকিরও বাতাসে বড় হয়নি, অনেক লোক চরিয়েই তবে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হয়েছে সে। রমণ সুমহানের চোখ দেখেই বাকিটা পড়ে নিয়েছে সে।
ধর্ষক মাহবুব পলাতক, কিন্তু তার আত্মীয়স্বজনেরা তো আছে আশেপাশেই। তারা যথেষ্ট বিত্তশালীও। ধানী জমি আছে প্রচুর, আর ছেলের জান বাঁচানো নিয়ে কথা, দরকার হলে তারা কিছু ধানী জমি বন্ধকও রাখবে। এক লক্ষ করে তিনজনকে তিন লক্ষ আর স্থানীয় প্রতিনিধিকে পঞ্চাশ হাজার, মোট সাড়ে তিন লাখের প্রস্তাব দিয়েছিলো ইদ্রিস। দরদাম করাটা সংস্কৃতিরই অংশ, তাই রমণ সুমহান তাকে মিষ্টি হেসে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সাত লাখ টাকা দিয়ে মিটমাটের প্রস্তাবটা যে ইদ্রিস হেনার বড় ভাইকে দিয়েছিলো, সে সম্পর্কে তাঁরা অবগত আছেন। এরপর আর ঝামেলা করেনি ইদ্রিস, মোট সাড়ে পাঁচ লক্ষের চুক্তি হয়েছে। স্থানীয় প্রতিনিধি এক লক্ষ পেলেই খুশি।
মাঘ মাসের শেষে এসে শহরে মরে যায় শীত, কিন্তু চামটা গ্রামে তার পাট্টা পতপত করে উড়ছে। গায়ে ভালোমতো চাদর জড়িয়ে নেন রমণ সুমহান। হামবাগ ওমর ফারুক পরে আছে মোটা ফ্লিসের জ্যাকেট, ফাকমিদুল স্যুট পরার সুযোগ পেয়ে সেটা আর ফসকায়নি। রমণ সুমহান মনে মনে দাঁত বার করে হাসেন। এদের কোনো ধারণাই নেই নিম্নবর্গীয়পনা সম্পর্কে। যে আলোচনা হতে যাচ্ছে সামনে, সে আলোচনায় এরা ফ্লোরই পাবে না এই শহুরে জামাকাপড় পরে। তার মতো চাদর গায়ে ছোটোখাটো মানুষের কথাই শুনবে দরবেশ খাঁ। ঐ ফ্লিসের জ্যাকেট আর উলি কটনের স্যুট অবশ্য কাজে আসবে, একটা অচেনা আবহাওয়া তৈরি করতে। সেটারও দরকার আছে। কিন্তু মঞ্চে সেগুলো নেহায়েতই কাটা সৈনিক।
রমণ সুমহান ইদ্রিস ফকিরের সাথে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকেন, পেছনে বকের মতো পা ফেলতে ফেলতে আসে ফাকমিদুল আর ওমর ফারুক।
"আগে কখনও এসেছেন শরিয়তপুর?" ওমর ফারুক জানতে চায়।
ফাকমিদুল গোমড়া মুখে বলে, "না। শরিয়তপুর আসবো কেন? কী আছে এখানে?"
ওমর ফারুক চুপ করে যায়। লোকটার সঙ্গে স্বাভাবিক আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়াই দায় হয়েছে। ব্লগে এক পশলা চোদা খেয়ে সেইরকম ক্ষেপে আছে ব্যাটা, যাকে পায় তার ওপরই ঝাল ঝাড়ে। মনে মনে হাসে ওমর ফারুক। লবিইস্ট টিচারগুলার সমস্যা সম্পর্কে সে পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল। এরা জানে এদের দৌড় সীমিত। শিক্ষার পরিধি আর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে এরা ভেড়ার চামড়া খুলে নেকড়ের দাঁত বের করে খিঁচাতে থাকে।
ওমর ফারুক মুখে বলে, "কিছু নাই। এমনিই জিজ্ঞেস করা। আপনি কথা বলতে না চাইলে ঠিকাছে।"
এবার ফাকমিদুল একটু নরম হয়, সে গোঁ গোঁ করে বলে, "না আমার এদিকটায় আসা হয় নাই। আমি আসলে অ্যাকাডেমিক লোক ছিলাম বরাবরই। ঘোরাঘুরি আমার তেমন পোষায় না। আমি স্কলার মানুষ, জ্ঞানের সৈকতে নুড়ি কুড়াই, বই পড়ি, ব্লগ লিখি, ব্লগ ইস্টাডি করি ... আমার কি মাদারিপুর শরিয়তপুরে ঘোরার টাইম আছে?"
ওমর ফারুক কিছু বলে না, সে নিজেও আগে শরিয়তপুর আসেনি কখনও। পদ্মার নিচে তার আসার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও।
ফাকমিদুল বলে, "আচ্ছা, অনেক কিছু বলতে হবে নাকি? অল্প কথায় কাজ সারা যায় না?"
ওমর ফারুক বলে, "দ্যাখেন, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। অল্প কথায় কাজ হলে আর বেশি কথা বলতে হবে না।"
ফাকমিদুল একটু চুপ করে থেকে বলে, "না ... মানে, পত্রিকায় লেখার তো ধরেন একটা মাপ আছে। এক হাজার শব্দ, দেড় হাজার শব্দ ... তো সেইজন্য ভাবছিলাম আর কি।"
ওমর ফারুক চেষ্টা করেও গলার স্বর থেকে কৌতুক মুছতে পারে না, "এটা তো আর শব্দ ধরে বিল করছেন না। ফ্ল্যাট রেট।"
ফাকমিদুল বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে।
রমণ সুমহান ইচ্ছা করেই এ দু'জন থেকে একটু দূরে হাঁটছেন। ওমর ফারুক ছেলেটা এর আগে একবার সামান্য বেয়াদবি করেছিলো তার সাথে, নিশ্চিন্দিপুরকে পচিয়ে দৈনিক কচুবনে পাঠানো একটা লেখা এক দিন ধরে রেখেছিলো সে। এরপর শাহজাদ সরীসৃপ ভাইকে বিচার দিতে হয়েছিলো। শাহজাদ সরীসৃপ ভাইয়ের ঝাড়ি খেয়ে তারপর লেখাটা ঢোকায় ওমর ফারুক। এই বেয়াদবিটা পছন্দ হয়নি তার। সব বেটাই নিজের গণ্ডির ভেতরে ক্ষমতা দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।
আর ফাকমিদুলের ওপর তার ক্ষোভের কারণটা অন্য। শাহজাদ সরীসৃপ ভাইয়ের সাথে ইদানীং সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না, লোকটা কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছে, ফেসবুকে নকল নামে অ্যাকাউন্ট করে রমণ সুমহানই শাহজাদ সরীসৃপের কবিতার কঠোর সব পোঁদপোড়ানো সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন। রমণ সুমহান এসব ব্যাপারে যদিও খুব সাবধান থাকেন, কিন্তু কোথাও একটা কিছু গড়বড় হয়েছে নিশ্চয়ই। সেই থেকে দৈনিক কচুবন থেকে তার কাছে আর তেমন একটা লেখা চাওয়া হয় না ইদানীং। ফেসবুকে পল্লব মোহাকে টোকা দিয়েছিলেন তিনি, সেও আবোলতাবোল কথা বলে কেটে পড়েছে। অথচ তিনি জানেন, ইসলামাবাদ ব্লগে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে পল্লব মোহাই মেহেরযৌবন সিনেমার কেসটায় ফাকমিদুলের কাছ থেকে লেখা চেয়ে নিয়েছে। পল্লব মোহার উচিত হয়নি এভাবে তাকে টপকে ফাকমিদুলের কাছে যাওয়ার। বিশেষ করে পল্লব যখন জানে, তিনি সিনেমালোচনা নিয়ে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামার পথে হাঁটছিলেন। নতুন কিছু কথা টুকে রেখেছেন তিনি ৎসিগমুন্ট বোমান আর জ্যাঁ বদ্রিয়ার লেখা থেকে, সেগুলো চমৎকার ফিট করে যেতো মেহেরযৌবনের সাথে। ডিরেক্টর মেয়েটা বেশ মোটা টাকা খরচ করছে বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে পত্রিকা আর টিভিতে সমর্থন আদায়ের জন্য, আর তারও কিছু টাকা দরকার ছিলো এই মুহূর্তে। পল্লব মোহাকে তিনি চটাতে চান না, বিপদে আপদে লোকটা ফিউশন চৌধুরী নিকে ভালোই সাপোর্ট দেয় তাকে, এই খ্যাপ ফসকানোর কারণে তিনি ফাকমিদুলের ওপর তাই যথার্থ ও বিশুদ্ধভাবে চটে আছেন।
হাঁটতে হাঁটতে চারজনের ছোট্টো দলটা চলে আসে দরবেশ খাঁর কুঁড়ের কাছে। একেবারে হতদরিদ্র লোকের ভিটা নয়, কিন্তু দৈন্যের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা হালকা কান্নার সুর ভেসে আসছে দূর থেকে, বাতাসে আগরবাতির বাসি ঘ্রাণ।
শয়তানও বুঝবে, কেউ মারা গেছে এ বাড়িতে।
হেনা নামের মেয়েটির ভাগ্য সর্বার্থেই খারাপ। প্রতিবেশী মাহবুব দীর্ঘ সময় ধরেই নিশ্চয়ই উত্ত্যক্ত করে আসছিলো মেয়েটিকে, সেদিন রাতে সে আর তর সহ্য করতে পারেনি। হেনা কেন বের হয়েছিলো রাতে বাড়ি থেকে? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নিশ্চয়ই। সালিশে যদিও মাতবররা বলেছে অন্য কথা। কোনো ধর্মভীরু বালেগ মেয়ে কেন যাবে এত রাতে মাহবুবের নাগালের ভেতরে? তার দিলে ময়লা ছিলো। মাহবুবের গামছাটার মতোই ময়লা, যেটা দিয়ে সে হেনার হাত আর মুখ বেঁধে তাকে ধর্ষণ করেছিলো।
রমণ সুমহানের মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে ওঠে দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে। একটা গল্প কি হয় না এ নিয়ে? পরিত্যক্ত একটা ঘরে এই বিপন্না কিশোরীকে বেঁধে প্রবল ধর্ষণে লিপ্ত এক কাপুরুষ। মেয়েটার মুখের বাঁধন হঠাৎ ছুটে গেলো, সে সারা শরীরের শক্তি ফুসফুসে সঞ্চয় করে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলো, "বাঁচান! আব্বা গো, বাঁচান!"
মাহবুবের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী হবে? সে মেয়েটার ভেতর থেকে নিজেকে বের করে আনবে? নাকি গলা টিপে ধরবে হেনার? নাকি আবার গামছা দিয়ে মুখটা ভালোমতো বাঁধার চেষ্টা করবে? কিন্তু হেনা ততক্ষণে এই পশুর হাত থেকে রক্ষার একমাত্র অস্ত্রটি আঁকড়ে ধরেছে, সে তীব্র, তীক্ষ্ণ, অভ্রভেদী আর্তনাদে চামটা গ্রামকে জাগিয়ে তুলেছে, "বাঁচান! আল্লার দোহাই লাগে, বাঁচান!"
রমণ সুমহান কল্পনায় দেখতে পান নিদ্রিত ভূমিহীন ক্ষেতমজুর দরবেশকে। দরবেশের ঘুমের প্রলেপ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে শুরু করে, স্বপ্ন থেকে তন্দ্রায় নেমে সে শোনে পরিচিত কণ্ঠের আর্তনাদ। পাশের ঘরে খচমচ করে শব্দ হয়, তার ছেলে ইকবাল জেগে উঠে বলছে, হ্যানায় চিল্লাইতেছে না? অ মা, হ্যানায় চিল্লাইতেছে তো? হ্যানায় কই?
এরপর আরো কয়েক মিনিট লাগে তাদের লাঠি হাতে বের হতে। ওদিকে মাহবুব তার শিশ্নের যাবতীয় রক্ত হারিয়ে ন্যুব্জ, সে দ্রুত উঠে লুঙ্গি ঠিক করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কিন্তু মাহবুবের খরভাষ স্ত্রী শিল্পীও ঘুম থেকে উঠে গেছে, সে উঠানে বেরিয়ে এসেছে একটা দা হাতে।
মাহবুবের কলেজপড়ুয়া ছোটো ভাই নিপু বুঝতে পারে ঘটনা কী হয়েছে, সে ঘরে ঢুকে আলুথালু হেনার গালে প্রকাণ্ড এক চড় কষায়। হেনা তখন ছেঁড়া সালোয়ার কোমরে জড়ো করে বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করছে, তার ঊরুমূলে ছোপ ছোপ রক্ত, নিপুর চড় খেয়ে সে পড়ে যায়। তার কণ্ঠ ছিঁড়ে আরেকটা চিৎকার বেরিয়ে আসে, "আব্বা! আব্বা গো!"
এরপর কী হয়? দরবেশ আর ইকবাল কি লাঠি আর দা হাতে ঢুকে পড়ে মাহবুবদের ভিটায়? তারা কি দেখতে পায়, তাদের কন্যা ও বোন কীভাবে একটি কাপড়ের স্তুপের মতো পড়ে আছে ঐ অন্ধকার ঘরের মেঝেতে, তাকে লাথি মারছে শিল্পী, হিসহিস করে বলছে, হ্যাটামারানি খানকি, এই আছেলে তোর মনে? বাজারে গিয়া ঘর নিতে পারিস না?
রমণ সুমহান প্রবল উত্থান টের পান নিজের অন্দরে। গল্প লেখা যায় হেনাকে নিয়ে। শক্ত একটা গল্প। ৎসিগমুন্ট বোমানের তরল ভয়ের তত্ত্বটা ওখানে ফিট করে দেয়া যাবে অনায়াসে। এটা শুধু এক ধর্ষণের গল্পই নয়, বরং ধর্ষণ পরবর্তী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের গল্পও বটে। ধর্ষণ মানেই সালিশ, পাংশু মুখে বসে আছে হেনা, তার সামনে প্রবল সব সমাজপতি, মাহবুব নিখোঁজ। ঐ সালিশের অংশটুকু তিনি পুরো মুনশিয়ানায় ফুটিয়ে তুলবেন। দেখাবেন ধর্ষণ কী করে একটি ব্যক্তিক অপরাধের পাশাপাশি একটি সামাজিক সমাভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি মানুষের ভূমিকা আছে মাহবুব আর হেনার মধ্যে ঘটে যাওয়া যৌন সংস্পর্শের সাথে। এই ভূমিকাগুলো আসে না গল্পে। শুধু ধর্ষক আর ধর্ষিতার চোখ দিয়ে ধর্ষণকে দেখার সময় পার করে এসেছে পৃথিবী। একটা গল্প হতেই পারে হেনাকে নিয়ে।
দোররার ঘায়ে হেনার অসুস্থ হয়ে পড়া, তারপর তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে গিয়েও সমাজপতিদের চাপে আবার ফিরিয়ে আনা, তারপর অবস্থার অবনতি হলে আবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, এবং সেখানে হেনার মৃত্যু নিয়ে তিনি আপাতত কিছু লিখবেন না। টু মাচ মেলোড্রামা রুইনস আ গুড প্লট। মেলোড্রামা ছেঁটে বাকিটুকুকে তিনি কয়েকমাস সময় নিয়ে সাজাবেন। ধর্ষণ পরবর্তী মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড এই গল্পে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া ওটা ৎসিগমুন্ট বোমানের তত্ত্বের সাথে যায়ও না। ভালো একটা থিওরি শুধু শুধু ফ্যাক্টের মুখে ফেলে পচিয়ে কী লাভ?
ইদ্রিস ফকির হাঁক দেয়, "ইকবাল, আছোনি ঘরে?"
দরজা খোলার পর ভেতরে একটা মলিন কুপির আলো উঠানে এসে পড়ে কাঁপা পায়ে, লম্বাচওড়া এক যুবকের দেহরেখা সে আলোর পথ আটকে দাঁড়ায়। "ইদ্রিস কাকা?"
ইদ্রিস ফকির সোৎসাহে বলেন, "এনারা সাম্বাদিক। ঢাকা থিকা আয়েছেন। তগো লগে কথা বলবেন।"
ইকবাল সতর্কভাবে বলে, "আব্বারে ডাকমু?"
ইদ্রিস ফকির সস্নেহে হাসে টেনে টেনে। "আবার দরবেশ ভাইরে এর মইধ্যে টানবি ক্যান? তুই ত বাড়ির বড় পোলা,
তোর লগে কথা বললেই কাম হইবে।"
ইকবাল মলিন গলায় বলে, "সালামালিকুম।"
ফাকমিদুল এগিয়ে এসে কাশে। "ওয়ালাইকুম সালাম। আমি ফাকমিদুল হক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তুমি নিশ্চয়ই হেনার ভাই? ... নাইস টু মিট ইউ। কীসে পড় তুমি?"
ইকবাল সন্দিগ্ধ গলায় বলে, "আমি পড়ি না।"
ফাকমিদুল বলে, "দ্যাটস ব্যাড। আচ্ছা, তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই আমরা। তুমি নিশ্চয়ই জানো, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন দোহে তৃণসম দহে? এখন দ্যাখো, আমরা এই ঘৃণার রাজনীতি আর কতদিন করে যাবো?"
ইকবাল বলে, "আমি তো ইদ্রিস কাকারে বইলা দিছি, আমরা বিচার চাই। টাকাপয়সা দিয়া আমাগোরে চুপ করাইবা ক্যান কাকা? আমার বইনের জানডার একডা দাম আছেলে না?"
ফাকমিদুল একটা হাত উঁচিয়ে ধরেন, "এগজ্যাক্টলি! কিন্তু দাম দিয়ে কি আর জান পাওয়া যায়? দ্যাখো, যা হয়ে গেছে, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক, কিন্তু তোমাকে সামনে আগাতে হবে।"
ওমর ফারুক বলে, "দ্যাখো ইকবাল, আমরা এই খবরটা শুনে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি। আমি জানি, তোমার বোন আর মাহবুবের মধ্যে ভালোবাসাটা অপরাধী ...।"
ইকবাল গর্জে ওঠে, "কীয়ের ভালোবাসা? হ্যায় জোর কইরা আমার বইনের ইজ্জত কাড়ছে, তার শ্লেলতাহানি করছে, তারপর ব্যাকটিতে মিল্লা তারে মাইরা খুন করছে। হাসপাতালে নিয়া গেছিলাম, হ্যারা কইছে খবরদার নিবি না, ফিরাইয়া আন!" তার গলা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে।
রমণ সুমহান খুব সতর্ক চোখে দেখেন, ইকবালের হাতের নাগালে কোনো লাঠি কিংবা দা আছে কি না। ছোটো দা ছুঁড়ে মারলে খুব বিপজ্জনক অস্ত্র হয়।
ওমর ফারুক বলে, "না ইকবাল, তুমি ভুল বুঝছো। মাহবুব আর হেনার মধ্যে ভালোবাসা হতেই পারে। এখন তুমি শোকাতপ্ত, তাই বুঝতে পারচো না, ধর্ষক আর ধর্ষিতা, নিহত ও হত্যাকারী কীভাবে পরস্পরকে ভালবাসতে পারে? এর উত্তর আছে আমার কাছে। প্রথমত, উভয়ের মন থেকে ঘটনাটির স্মৃতি মুছে ফেলে যুদ্ধ ও সংঘাতের বাইরের জমিনে তাদের নিয়ে যেতে হবে। হেনা তো মারাই গেল, এখন তার অভিজ্ঞতাটা এবং ইতিহাসটাকেও যদি নাই করে দিতো পারো, তাহলে সেই শূন্য সময়, সেই ফাঁকা স্পেসে তাদের মিলবার একটা সুযোগ থাকলেও থাকতে পারে।"
ইকবাল বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলে, "আমনে কী কন বোজতেসি না? কীয়ের ভালোবাসা ...?"
ওমর ফারুক থামে না, সে হাত তোলে ট্রাফিকের পুলিশের মতো। তার কপালে জ্বলে ওঠা ট্রাফিকের লালবাতি দেখে ইকবাল থেমে যায়। ওমর ফারুক বলে চলে, "এই ভালবাসার সাক্ষী হতে হলে দর্শকদেরও সব ভুলে যেতে হয়, চলে যেতে হয় ইতিহাস, ভূমি, মানুষ আর স্মৃতির বাইরের সেই শূন্যস্থানে। কিন্তু স্মৃতি, যন্ত্রণা, ভয় ও ঘৃণা দ্বারা ভারাক্রান্ত একটি গ্রামে কীভাবে তা সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই ভালবাসাটা হয় অপরাধী এবং পাত্রপাত্রীদের হতে হয় অভিযুক্ত। তারা হারিয়ে যায় এবং প্রত্যাখ্যাত হয়। যেমন হয়েছে মাহবুব আর হেনা। তাদের নিষিদ্ধ প্রেম হওয়ার আরেকটি পথ হলো, সময়কে উল্টোদিকে প্রবাহিত করে খোদ নির্যাতনের ঘটনাটিকে অতীতেই রদ করা, ঘটতে না দেওয়া। কিন্তু এ দুটোর কোনোটাই সম্ভব নয়। সম্ভব একমাত্র ভবিষ্যতে, যখন উভয় পক্ষ একটা রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে নতুনভাবে মানবিক বন্ধন নির্মাণ করবে, সৃষ্টি করবে নতুন ইতিহাস এবং নতুন বাস্তবতা। তাই ইকবাল, তোমাকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে রিকনসিলিয়েশনের জন্য। ঘৃণা নয়, পরস্পর সমঝোতার ভিত্তিতে হাঁটতে হবে নতুন পথে।"
ইকবাল চিৎকার করে ওঠে, "আমনে এইগুলি কী কইতে আছেন?"
ফাকমিদুল এগিয়ে আসে। "থামেন ফারুক, আপনি বেশি প্যাচান সব সময়। ... ইকবাল, শোনো। তুমি দুনিয়ার অনেক কিছুই বোঝো না। আমরা ঢাকায় থাকি, গবেষণা করি, অনেক কিছু জানি। যা বলি মন দিয়ে শুনে যাও শুধু। তোমার প্রতিক্রিয়ার যে গড় বৈশিষ্ট্য, তাতে মূলত আত্মীয়তার চেতনার বিপরীতে উল্লম্ব অবস্থানে রেখে ঘটনাটি বিচার করা হয়েছে। আমি হেনার মৃত্যুর ঘটনাটি বিচার করতে চাই বাংলাদেশের অন্যান্য সামাজিক সঙ্কটেরসঙ্গে আনুভূমিকভাবে। তার সঙ্গে মেলাতে চাই জাতি-রাষ্ট্র ধারণার। জাতি-রাষ্ট্র যদি বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায় একটি ইমাজিনড কমিউনিটি অথবা গায়ত্রী স্পিভাকের ভাষায় আর্টিফিশিয়াল কনস্ট্রাক্ট হয়ে থাকে, তবে তার কল্পিত ঐক্য ও সংহতির জন্য লাগাতারভাবে একটি আদর্শ জাতীয়তার অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে হয় এবং স্টুয়ার্ট হলের মতে কিছু রেপ্রিজেন্টেশন-পদ্ধতির মাধ্যমে এই নির্মাণের কাজটি করতে হয়, সেই অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্যও ...।"
এইবার দরবেশ খাঁ বেরিয়ে আসে ঘরের স্বল্পালোকিত আয়তন ছেড়ে। ছেলের মতো সেও দীর্ঘাঙ্গ, কিন্তু কৃশ। ফাকমিদুল দুই পা পিছিয়ে যায়।
ভাঙা গলায় দরবেশ খাঁ বলে, "আমরা কিছু চাই না। আমার মাইয়াডারে মাইরা ফালাইছে। বিচার চাইছি শুধু। একটা কচি মাইয়া, পয়সা ছেল না তারে ভাল খাওয়াইতে পরাইতে পারলাম না, ইস্কুলে দেছেলাম কুলাইতে পারলাম না। কিন্তু সে তো কোনো অপরাধ করে নাই। তারে এইভাবে বেইজ্জত কইরা, সবার সামনে বিচার কইরা আবার মাটিতে ফালাইয়া দোররা মারল। আমনেরা বড় শহরের লোক, বিচার করেন।"
রমণ সুমহান এবার একটা সিগারেট ধরান। ইকবাল নিরুপায় মথের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সেই সিগারেটের আগুনের দিকে।
রমণ সুমহান বলেন, "আপনার আরেকটা মাইয়া আছে না? তার তো একটা গতি করা লাগবে, নাকি?"
দরবেশ খাঁ কাঁপা গলায় বলেন, "হ্যাঁ, আমার ছোডো মাইয়াটা ... সারাদিন কিসু খায় নাই, তার বুবুর লাইগ্যা কানতে কানতে মাইয়াডা শ্যাষ ...!"
রমণ সুমহান কথা বাড়ান না। তিনি কড়াইল বস্তিতে গবেষণার সময় প্রচুর ঝগড়া কাছ থেকে দেখেছেন, মিটমাটের ব্যাপারে তিনি ভালো বোঝেন, বিশেষ করে কিছু ঝগড়া যেখানে তিনি নিজেই লাগিয়ে দিয়েছিলেন গবেষণার অংশ হিসেবে। তিনি সংক্ষেপে বলেন, "আপনার কপাল খারাপ দরবেশ ভাই। আপনার মেয়ের নামে অনেক কথা চইলা গেছে বিভিন্ন পেপারে। তারা পয়সা খাইয়া কী না কী লেখে কোনো ঠিক নাই। আমরা আপনার দুঃখ বুঝি। আমরা আপনারে অনুরোধ করতেছি, মামলা মকদ্দমায় যাইয়েন না। মাহবুব তো আর দোররা মারে নাই হেনারে। মারছে? সে একটা বলদ, ভুল কইরা জ্বিনের আছরে একটা কাম কইরা ফালাইছে। সে তো আপনার আত্মীয়ই হয় একরকম। তো ঘরে ঘরে এইসব মকদ্দমা কইরা কি টিকতে পারবেন? করেন তো খ্যাতের বদলির কাম। এদের সাথে বিবাদ কইরা পারবেন না। তারচেয়ে মাহবুব গ্রামে ফিরলে জুতা মাইরেন। যা-ই করেন, মাইয়া ফিরত পাইবেন না। ছোটো মাইয়ার পড়াশোনা বিয়াশাদির কিছু খরচাপাতি দিবে তারা, ভালমতো ব্যবস্থা দেখেন। ফারুক, ফাকমিদুল, চলেন আমরা যাই। আসি, স্লামালিকুম।"
ফাকমিদুল বলে, "এই প্রতিশোধ অথবা প্রতিরোধের ডাইকোটমি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে, ধূসর জায়গাগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে ...।"
রমণ সুমহান হ্যাঁচকা টান দেন তার হাত ধরে, "চলেন তো!"
ইদ্রিস ফকির মিহি গলায় আরো কয়েকটা বাক্য বিনিময় করে দরবেশের সাথে। রমণ সুমহান জোরে পা চালান।
ওমর ফারুক চুপ করে থাকে, ফাকমিদুল বক বক করে যায়, "এই ব্যাপারটা বুঝতে হবে, এই ডিসকার্সিভ আলোচনাটা হওয়া জরুরি। ধর্ষণ হলেই লোকজন একেবারে পাগল হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদী জঙ্গি দিয়ে দেশটা ছেয়ে গেছে, কেউ একটু ডিকনস্ট্রাক্ট করতে চায় না ধর্ষণের টেক্সটটাকে ...।"
ওমর ফারুক বলে, "ফাকমিদুল ভাই, কালকে ডিসির অফিসের সামনে বক্তৃতা দিতে হবে কিন্তু। দেইখেন, গলায় কাশি যেন বসে না যায়!"
ফাকমিদুল চুপ করে যায়।
ইদ্রিস ফকির কিছুক্ষণ পর জোর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে ধরে ফেলে তাদের । উৎফুল্ল গলায় বলে, "স্যার আপনেরা বড় কামেল আদমি। কদমবুছিটা কইরা ফালামু স্যার?"
রমণ সুমহান তরল গলায় বলেন, "সালামি দিমু না কিন্তু! দেড় লাখ পুরাটাই দিতে হইব।"
ইদ্রিস ফকির খুশির হাসি হাসে।
মাইক্রোবাস নাক ঘুরিয়ে চামটা গ্রাম ছেড়ে চলে যায় অন্য পৃথিবীর দিকে। সেই পৃথিবীতে একটা পাঁচশো সিসি নরটন মোটরসাইকেলের একমাত্র সিলিণ্ডারে কাঁপন তুলে আর্জেন্টিনার আকাশের নিচে ছুটে বেড়ায় হবুডাক্তার এরনেস্তো। আর দৈনিক কচুবনের মাইক্রোবাসে চড়ে প্রাক্তন বাম ওমর ফারুক হিসাব কষে, পরশুদিন তাকে যেতে হবে খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙা উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামে এক ধর্ষিতা আদিবাসীর ধর্ষকের সাথে রিকনসিলিয়েশনের কাজে।
রমণ সুমহান বেজায় বিরক্ত হন। ফাকমিদুলকে ইদানীং আর সহ্য হচ্ছে না তার। নির্বোধ লোকের সঙ্গ তিনি অপছন্দ করেন না, কিন্তু সেই নির্বোধ যদি তার প্রাপ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করে, তার ওপর চটবার বৈধ কারণ তৈরি হয় বই কি। ফাকমিদুলকে পশ্চাদ্দেশে একটা লাথি মেরে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দিতে ইচ্ছা করে তার, কিন্তু জীবনের সায়াহ্নে এসে তিনি বুঝতে শিখেছেন, ক্রোধ তার মহত্তম অবস্থানে পৌঁছায় সংবৃত হয়ে। তিনি মনের একটি কুঠুরি খুলে একটা চেরাগ বার করেন, তারপর রাগের দৈত্যটাকে পুরে ফেলেন তার ভেতর। ফাকমিদুলের পশ্চাদ্দেশে কোনো কিছুই এখন করতে যাওয়া সমীচীন হবে না। এখন মিত্রতার সময়।
কিন্তু ফাকমিদুল কাজটা কঠিন করে তোলে মুহুর্মুহু! "ঐ যে আরেকটা পাখি! কাকপাখি!"
ওমর ফারুকও বিরক্ত হয় ফাকমিদুলের ওপর। বেটা এক বছর মার্কিন দেশে থেকে এসে হিলারি ক্লিনটনের মতো আচরণ করছে। তুই তো ব্যাটা গ্রামের ছেলে, লুঙ্গি পরে গ্রামের স্কুলে যেতি, আর এখন বকপাখি কাকপাখি কপচাচ্ছিস? দুইদিনের বৈরাগী আর কাকে বলে?
ড্রাইভার বদি হাসে মিটিমিটি। ওমর ফারুক প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্যে বলে, "ফাকমিদুল ভাই, লেখাটা এনেছেন সাথে করে?"
ফাকমিদুল এবার একটু সিরিয়াস হয়, জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, "আমার কি লেখা বগলতলায় নিয়ে ঘুরতে হবে নাকি? সবকিছু মাথায় আছে। ভুলে যায়েন না, আমি একজন শিক্ষক। প্রতিদিন হাজার হাজার বেয়াদব ছেলেমেয়ের সামনে লেকচার দেই। আপনার মতো হাটেমাঠেঘাটে বক্তৃতা দিয়ে রাজনীতি করে বড় হই নাই ঠিকই, কিন্তু লোকজনের সামনে কথা বলার অভ্যাস আমার আছে।"
রমণ সুমহানের মুখে পাতলা একটা হাসি খেলে যায়। লেগে যা নারদ নারদ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বাম স্টান্টবাজ ওমর ফারুকের সাথে সাদা প্যানেলঘনিষ্ঠ ফাকমিদুল হকের মধ্যে কিছু খিটিমিটি তো লাগাই স্বাভাবিক। এলজিইডির এবড়োখেবড়ো রাস্তায় মাইক্রোবাসে ঝাঁকি খেতে খেতে চলার সময়টা তাহলে নেহায়েত নিরস কাটবে না।
ইদ্রিস ফকির বদিকে পথ দেখায়। "হ্যাঁ সামনে নিয়া রাখেন। এর পর আর যাইবে না গাড়ি। রাস্তা নাই। হাইট্যা যাইতে হইবে।"
ফাকমিদুল উৎকণ্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করে, "কত দূর?"
ইদ্রিস ফকির ঠাণ্ডা হাসি হেসে বলে, "বেশি দূর না স্যার। দশ পোনারো মিনিট হাটতে হইবে। তারপরেই পউছিয়া যাইবেন। গরীব মানুষ তো। সরকারি রাস্তা কি গরীবের বাড়ির পাশ দিয়া যায় কখনো?"
রমণ সুমহান একটা চাদর জড়িয়ে নেন গায়ে। "সবকিছু ঠিক আছে না ফকির সাহেব?"
ইদ্রিস ফকির হাসে মিটিমিটি। "সব কি আর ঠিক থাকে স্যার? তাদের মেয়ে ইন্তেকাল করছে। দ্যাখেন যদি একটু বুঝাইয়া শুনাইয়া ...।"
ওমর ফারুকের কানে যায় না সব কথা। সে একটু অস্থির হয়ে ভাবে টাকার কথা। তাদের প্রত্যেকে দেড় লাখ করে পাবে কাজটা উদ্ধার হলে। একটা নতুন ল্যাপটপ কিনতে হবে তাকে, সেটা এই খ্যাপের টাকা থেকেই কেনা যাবে তাহলে। পুরোনো ল্যাপটপটার ব্যাটারি খুব সমস্যা করছে। জরুরি সব লেখার ফাঁকে ব্যাটারি ডুকরে উঠে কাঁদতে থাকে।
খ্যাপটা যোগাড় করে এনেছেন রমণ সুমহানই। তিনি পাকা লোক, জহুরির চোখ, তাছাড়া কড়াইল বস্তিতে গবেষণার কাজে সময় কাটিয়েছেন বিস্তর। গণ্ডগোল কীভাবে লাগে, কীভাবে এগোয়, আর কীভাবে নিরসন হয়, সবই তাঁর নখদর্পণে। আর শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামে এসব গণ্ডগোল কড়াইল বস্তির তুলনায় শতগুণে নিরীহ, বিশেষ করে ভিক্টিম যেখানে দরিদ্র ভূমিহীন।
স্থানীয় প্রতিনিধিই ইদ্রিস ফকিরকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো। ইদ্রিস ফকিরও বাতাসে বড় হয়নি, অনেক লোক চরিয়েই তবে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হয়েছে সে। রমণ সুমহানের চোখ দেখেই বাকিটা পড়ে নিয়েছে সে।
ধর্ষক মাহবুব পলাতক, কিন্তু তার আত্মীয়স্বজনেরা তো আছে আশেপাশেই। তারা যথেষ্ট বিত্তশালীও। ধানী জমি আছে প্রচুর, আর ছেলের জান বাঁচানো নিয়ে কথা, দরকার হলে তারা কিছু ধানী জমি বন্ধকও রাখবে। এক লক্ষ করে তিনজনকে তিন লক্ষ আর স্থানীয় প্রতিনিধিকে পঞ্চাশ হাজার, মোট সাড়ে তিন লাখের প্রস্তাব দিয়েছিলো ইদ্রিস। দরদাম করাটা সংস্কৃতিরই অংশ, তাই রমণ সুমহান তাকে মিষ্টি হেসে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সাত লাখ টাকা দিয়ে মিটমাটের প্রস্তাবটা যে ইদ্রিস হেনার বড় ভাইকে দিয়েছিলো, সে সম্পর্কে তাঁরা অবগত আছেন। এরপর আর ঝামেলা করেনি ইদ্রিস, মোট সাড়ে পাঁচ লক্ষের চুক্তি হয়েছে। স্থানীয় প্রতিনিধি এক লক্ষ পেলেই খুশি।
মাঘ মাসের শেষে এসে শহরে মরে যায় শীত, কিন্তু চামটা গ্রামে তার পাট্টা পতপত করে উড়ছে। গায়ে ভালোমতো চাদর জড়িয়ে নেন রমণ সুমহান। হামবাগ ওমর ফারুক পরে আছে মোটা ফ্লিসের জ্যাকেট, ফাকমিদুল স্যুট পরার সুযোগ পেয়ে সেটা আর ফসকায়নি। রমণ সুমহান মনে মনে দাঁত বার করে হাসেন। এদের কোনো ধারণাই নেই নিম্নবর্গীয়পনা সম্পর্কে। যে আলোচনা হতে যাচ্ছে সামনে, সে আলোচনায় এরা ফ্লোরই পাবে না এই শহুরে জামাকাপড় পরে। তার মতো চাদর গায়ে ছোটোখাটো মানুষের কথাই শুনবে দরবেশ খাঁ। ঐ ফ্লিসের জ্যাকেট আর উলি কটনের স্যুট অবশ্য কাজে আসবে, একটা অচেনা আবহাওয়া তৈরি করতে। সেটারও দরকার আছে। কিন্তু মঞ্চে সেগুলো নেহায়েতই কাটা সৈনিক।
রমণ সুমহান ইদ্রিস ফকিরের সাথে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকেন, পেছনে বকের মতো পা ফেলতে ফেলতে আসে ফাকমিদুল আর ওমর ফারুক।
"আগে কখনও এসেছেন শরিয়তপুর?" ওমর ফারুক জানতে চায়।
ফাকমিদুল গোমড়া মুখে বলে, "না। শরিয়তপুর আসবো কেন? কী আছে এখানে?"
ওমর ফারুক চুপ করে যায়। লোকটার সঙ্গে স্বাভাবিক আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়াই দায় হয়েছে। ব্লগে এক পশলা চোদা খেয়ে সেইরকম ক্ষেপে আছে ব্যাটা, যাকে পায় তার ওপরই ঝাল ঝাড়ে। মনে মনে হাসে ওমর ফারুক। লবিইস্ট টিচারগুলার সমস্যা সম্পর্কে সে পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল। এরা জানে এদের দৌড় সীমিত। শিক্ষার পরিধি আর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে এরা ভেড়ার চামড়া খুলে নেকড়ের দাঁত বের করে খিঁচাতে থাকে।
ওমর ফারুক মুখে বলে, "কিছু নাই। এমনিই জিজ্ঞেস করা। আপনি কথা বলতে না চাইলে ঠিকাছে।"
এবার ফাকমিদুল একটু নরম হয়, সে গোঁ গোঁ করে বলে, "না আমার এদিকটায় আসা হয় নাই। আমি আসলে অ্যাকাডেমিক লোক ছিলাম বরাবরই। ঘোরাঘুরি আমার তেমন পোষায় না। আমি স্কলার মানুষ, জ্ঞানের সৈকতে নুড়ি কুড়াই, বই পড়ি, ব্লগ লিখি, ব্লগ ইস্টাডি করি ... আমার কি মাদারিপুর শরিয়তপুরে ঘোরার টাইম আছে?"
ওমর ফারুক কিছু বলে না, সে নিজেও আগে শরিয়তপুর আসেনি কখনও। পদ্মার নিচে তার আসার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও।
ফাকমিদুল বলে, "আচ্ছা, অনেক কিছু বলতে হবে নাকি? অল্প কথায় কাজ সারা যায় না?"
ওমর ফারুক বলে, "দ্যাখেন, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। অল্প কথায় কাজ হলে আর বেশি কথা বলতে হবে না।"
ফাকমিদুল একটু চুপ করে থেকে বলে, "না ... মানে, পত্রিকায় লেখার তো ধরেন একটা মাপ আছে। এক হাজার শব্দ, দেড় হাজার শব্দ ... তো সেইজন্য ভাবছিলাম আর কি।"
ওমর ফারুক চেষ্টা করেও গলার স্বর থেকে কৌতুক মুছতে পারে না, "এটা তো আর শব্দ ধরে বিল করছেন না। ফ্ল্যাট রেট।"
ফাকমিদুল বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে।
রমণ সুমহান ইচ্ছা করেই এ দু'জন থেকে একটু দূরে হাঁটছেন। ওমর ফারুক ছেলেটা এর আগে একবার সামান্য বেয়াদবি করেছিলো তার সাথে, নিশ্চিন্দিপুরকে পচিয়ে দৈনিক কচুবনে পাঠানো একটা লেখা এক দিন ধরে রেখেছিলো সে। এরপর শাহজাদ সরীসৃপ ভাইকে বিচার দিতে হয়েছিলো। শাহজাদ সরীসৃপ ভাইয়ের ঝাড়ি খেয়ে তারপর লেখাটা ঢোকায় ওমর ফারুক। এই বেয়াদবিটা পছন্দ হয়নি তার। সব বেটাই নিজের গণ্ডির ভেতরে ক্ষমতা দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।
আর ফাকমিদুলের ওপর তার ক্ষোভের কারণটা অন্য। শাহজাদ সরীসৃপ ভাইয়ের সাথে ইদানীং সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না, লোকটা কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছে, ফেসবুকে নকল নামে অ্যাকাউন্ট করে রমণ সুমহানই শাহজাদ সরীসৃপের কবিতার কঠোর সব পোঁদপোড়ানো সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন। রমণ সুমহান এসব ব্যাপারে যদিও খুব সাবধান থাকেন, কিন্তু কোথাও একটা কিছু গড়বড় হয়েছে নিশ্চয়ই। সেই থেকে দৈনিক কচুবন থেকে তার কাছে আর তেমন একটা লেখা চাওয়া হয় না ইদানীং। ফেসবুকে পল্লব মোহাকে টোকা দিয়েছিলেন তিনি, সেও আবোলতাবোল কথা বলে কেটে পড়েছে। অথচ তিনি জানেন, ইসলামাবাদ ব্লগে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে পল্লব মোহাই মেহেরযৌবন সিনেমার কেসটায় ফাকমিদুলের কাছ থেকে লেখা চেয়ে নিয়েছে। পল্লব মোহার উচিত হয়নি এভাবে তাকে টপকে ফাকমিদুলের কাছে যাওয়ার। বিশেষ করে পল্লব যখন জানে, তিনি সিনেমালোচনা নিয়ে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামার পথে হাঁটছিলেন। নতুন কিছু কথা টুকে রেখেছেন তিনি ৎসিগমুন্ট বোমান আর জ্যাঁ বদ্রিয়ার লেখা থেকে, সেগুলো চমৎকার ফিট করে যেতো মেহেরযৌবনের সাথে। ডিরেক্টর মেয়েটা বেশ মোটা টাকা খরচ করছে বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে পত্রিকা আর টিভিতে সমর্থন আদায়ের জন্য, আর তারও কিছু টাকা দরকার ছিলো এই মুহূর্তে। পল্লব মোহাকে তিনি চটাতে চান না, বিপদে আপদে লোকটা ফিউশন চৌধুরী নিকে ভালোই সাপোর্ট দেয় তাকে, এই খ্যাপ ফসকানোর কারণে তিনি ফাকমিদুলের ওপর তাই যথার্থ ও বিশুদ্ধভাবে চটে আছেন।
হাঁটতে হাঁটতে চারজনের ছোট্টো দলটা চলে আসে দরবেশ খাঁর কুঁড়ের কাছে। একেবারে হতদরিদ্র লোকের ভিটা নয়, কিন্তু দৈন্যের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা হালকা কান্নার সুর ভেসে আসছে দূর থেকে, বাতাসে আগরবাতির বাসি ঘ্রাণ।
শয়তানও বুঝবে, কেউ মারা গেছে এ বাড়িতে।
হেনা নামের মেয়েটির ভাগ্য সর্বার্থেই খারাপ। প্রতিবেশী মাহবুব দীর্ঘ সময় ধরেই নিশ্চয়ই উত্ত্যক্ত করে আসছিলো মেয়েটিকে, সেদিন রাতে সে আর তর সহ্য করতে পারেনি। হেনা কেন বের হয়েছিলো রাতে বাড়ি থেকে? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নিশ্চয়ই। সালিশে যদিও মাতবররা বলেছে অন্য কথা। কোনো ধর্মভীরু বালেগ মেয়ে কেন যাবে এত রাতে মাহবুবের নাগালের ভেতরে? তার দিলে ময়লা ছিলো। মাহবুবের গামছাটার মতোই ময়লা, যেটা দিয়ে সে হেনার হাত আর মুখ বেঁধে তাকে ধর্ষণ করেছিলো।
রমণ সুমহানের মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে ওঠে দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে। একটা গল্প কি হয় না এ নিয়ে? পরিত্যক্ত একটা ঘরে এই বিপন্না কিশোরীকে বেঁধে প্রবল ধর্ষণে লিপ্ত এক কাপুরুষ। মেয়েটার মুখের বাঁধন হঠাৎ ছুটে গেলো, সে সারা শরীরের শক্তি ফুসফুসে সঞ্চয় করে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলো, "বাঁচান! আব্বা গো, বাঁচান!"
মাহবুবের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী হবে? সে মেয়েটার ভেতর থেকে নিজেকে বের করে আনবে? নাকি গলা টিপে ধরবে হেনার? নাকি আবার গামছা দিয়ে মুখটা ভালোমতো বাঁধার চেষ্টা করবে? কিন্তু হেনা ততক্ষণে এই পশুর হাত থেকে রক্ষার একমাত্র অস্ত্রটি আঁকড়ে ধরেছে, সে তীব্র, তীক্ষ্ণ, অভ্রভেদী আর্তনাদে চামটা গ্রামকে জাগিয়ে তুলেছে, "বাঁচান! আল্লার দোহাই লাগে, বাঁচান!"
রমণ সুমহান কল্পনায় দেখতে পান নিদ্রিত ভূমিহীন ক্ষেতমজুর দরবেশকে। দরবেশের ঘুমের প্রলেপ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে শুরু করে, স্বপ্ন থেকে তন্দ্রায় নেমে সে শোনে পরিচিত কণ্ঠের আর্তনাদ। পাশের ঘরে খচমচ করে শব্দ হয়, তার ছেলে ইকবাল জেগে উঠে বলছে, হ্যানায় চিল্লাইতেছে না? অ মা, হ্যানায় চিল্লাইতেছে তো? হ্যানায় কই?
এরপর আরো কয়েক মিনিট লাগে তাদের লাঠি হাতে বের হতে। ওদিকে মাহবুব তার শিশ্নের যাবতীয় রক্ত হারিয়ে ন্যুব্জ, সে দ্রুত উঠে লুঙ্গি ঠিক করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কিন্তু মাহবুবের খরভাষ স্ত্রী শিল্পীও ঘুম থেকে উঠে গেছে, সে উঠানে বেরিয়ে এসেছে একটা দা হাতে।
মাহবুবের কলেজপড়ুয়া ছোটো ভাই নিপু বুঝতে পারে ঘটনা কী হয়েছে, সে ঘরে ঢুকে আলুথালু হেনার গালে প্রকাণ্ড এক চড় কষায়। হেনা তখন ছেঁড়া সালোয়ার কোমরে জড়ো করে বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করছে, তার ঊরুমূলে ছোপ ছোপ রক্ত, নিপুর চড় খেয়ে সে পড়ে যায়। তার কণ্ঠ ছিঁড়ে আরেকটা চিৎকার বেরিয়ে আসে, "আব্বা! আব্বা গো!"
এরপর কী হয়? দরবেশ আর ইকবাল কি লাঠি আর দা হাতে ঢুকে পড়ে মাহবুবদের ভিটায়? তারা কি দেখতে পায়, তাদের কন্যা ও বোন কীভাবে একটি কাপড়ের স্তুপের মতো পড়ে আছে ঐ অন্ধকার ঘরের মেঝেতে, তাকে লাথি মারছে শিল্পী, হিসহিস করে বলছে, হ্যাটামারানি খানকি, এই আছেলে তোর মনে? বাজারে গিয়া ঘর নিতে পারিস না?
রমণ সুমহান প্রবল উত্থান টের পান নিজের অন্দরে। গল্প লেখা যায় হেনাকে নিয়ে। শক্ত একটা গল্প। ৎসিগমুন্ট বোমানের তরল ভয়ের তত্ত্বটা ওখানে ফিট করে দেয়া যাবে অনায়াসে। এটা শুধু এক ধর্ষণের গল্পই নয়, বরং ধর্ষণ পরবর্তী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের গল্পও বটে। ধর্ষণ মানেই সালিশ, পাংশু মুখে বসে আছে হেনা, তার সামনে প্রবল সব সমাজপতি, মাহবুব নিখোঁজ। ঐ সালিশের অংশটুকু তিনি পুরো মুনশিয়ানায় ফুটিয়ে তুলবেন। দেখাবেন ধর্ষণ কী করে একটি ব্যক্তিক অপরাধের পাশাপাশি একটি সামাজিক সমাভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি মানুষের ভূমিকা আছে মাহবুব আর হেনার মধ্যে ঘটে যাওয়া যৌন সংস্পর্শের সাথে। এই ভূমিকাগুলো আসে না গল্পে। শুধু ধর্ষক আর ধর্ষিতার চোখ দিয়ে ধর্ষণকে দেখার সময় পার করে এসেছে পৃথিবী। একটা গল্প হতেই পারে হেনাকে নিয়ে।
দোররার ঘায়ে হেনার অসুস্থ হয়ে পড়া, তারপর তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে গিয়েও সমাজপতিদের চাপে আবার ফিরিয়ে আনা, তারপর অবস্থার অবনতি হলে আবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, এবং সেখানে হেনার মৃত্যু নিয়ে তিনি আপাতত কিছু লিখবেন না। টু মাচ মেলোড্রামা রুইনস আ গুড প্লট। মেলোড্রামা ছেঁটে বাকিটুকুকে তিনি কয়েকমাস সময় নিয়ে সাজাবেন। ধর্ষণ পরবর্তী মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড এই গল্পে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া ওটা ৎসিগমুন্ট বোমানের তত্ত্বের সাথে যায়ও না। ভালো একটা থিওরি শুধু শুধু ফ্যাক্টের মুখে ফেলে পচিয়ে কী লাভ?
ইদ্রিস ফকির হাঁক দেয়, "ইকবাল, আছোনি ঘরে?"
দরজা খোলার পর ভেতরে একটা মলিন কুপির আলো উঠানে এসে পড়ে কাঁপা পায়ে, লম্বাচওড়া এক যুবকের দেহরেখা সে আলোর পথ আটকে দাঁড়ায়। "ইদ্রিস কাকা?"
ইদ্রিস ফকির সোৎসাহে বলেন, "এনারা সাম্বাদিক। ঢাকা থিকা আয়েছেন। তগো লগে কথা বলবেন।"
ইকবাল সতর্কভাবে বলে, "আব্বারে ডাকমু?"
ইদ্রিস ফকির সস্নেহে হাসে টেনে টেনে। "আবার দরবেশ ভাইরে এর মইধ্যে টানবি ক্যান? তুই ত বাড়ির বড় পোলা,
তোর লগে কথা বললেই কাম হইবে।"
ইকবাল মলিন গলায় বলে, "সালামালিকুম।"
ফাকমিদুল এগিয়ে এসে কাশে। "ওয়ালাইকুম সালাম। আমি ফাকমিদুল হক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তুমি নিশ্চয়ই হেনার ভাই? ... নাইস টু মিট ইউ। কীসে পড় তুমি?"
ইকবাল সন্দিগ্ধ গলায় বলে, "আমি পড়ি না।"
ফাকমিদুল বলে, "দ্যাটস ব্যাড। আচ্ছা, তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই আমরা। তুমি নিশ্চয়ই জানো, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন দোহে তৃণসম দহে? এখন দ্যাখো, আমরা এই ঘৃণার রাজনীতি আর কতদিন করে যাবো?"
ইকবাল বলে, "আমি তো ইদ্রিস কাকারে বইলা দিছি, আমরা বিচার চাই। টাকাপয়সা দিয়া আমাগোরে চুপ করাইবা ক্যান কাকা? আমার বইনের জানডার একডা দাম আছেলে না?"
ফাকমিদুল একটা হাত উঁচিয়ে ধরেন, "এগজ্যাক্টলি! কিন্তু দাম দিয়ে কি আর জান পাওয়া যায়? দ্যাখো, যা হয়ে গেছে, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক, কিন্তু তোমাকে সামনে আগাতে হবে।"
ওমর ফারুক বলে, "দ্যাখো ইকবাল, আমরা এই খবরটা শুনে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি। আমি জানি, তোমার বোন আর মাহবুবের মধ্যে ভালোবাসাটা অপরাধী ...।"
ইকবাল গর্জে ওঠে, "কীয়ের ভালোবাসা? হ্যায় জোর কইরা আমার বইনের ইজ্জত কাড়ছে, তার শ্লেলতাহানি করছে, তারপর ব্যাকটিতে মিল্লা তারে মাইরা খুন করছে। হাসপাতালে নিয়া গেছিলাম, হ্যারা কইছে খবরদার নিবি না, ফিরাইয়া আন!" তার গলা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে।
রমণ সুমহান খুব সতর্ক চোখে দেখেন, ইকবালের হাতের নাগালে কোনো লাঠি কিংবা দা আছে কি না। ছোটো দা ছুঁড়ে মারলে খুব বিপজ্জনক অস্ত্র হয়।
ওমর ফারুক বলে, "না ইকবাল, তুমি ভুল বুঝছো। মাহবুব আর হেনার মধ্যে ভালোবাসা হতেই পারে। এখন তুমি শোকাতপ্ত, তাই বুঝতে পারচো না, ধর্ষক আর ধর্ষিতা, নিহত ও হত্যাকারী কীভাবে পরস্পরকে ভালবাসতে পারে? এর উত্তর আছে আমার কাছে। প্রথমত, উভয়ের মন থেকে ঘটনাটির স্মৃতি মুছে ফেলে যুদ্ধ ও সংঘাতের বাইরের জমিনে তাদের নিয়ে যেতে হবে। হেনা তো মারাই গেল, এখন তার অভিজ্ঞতাটা এবং ইতিহাসটাকেও যদি নাই করে দিতো পারো, তাহলে সেই শূন্য সময়, সেই ফাঁকা স্পেসে তাদের মিলবার একটা সুযোগ থাকলেও থাকতে পারে।"
ইকবাল বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলে, "আমনে কী কন বোজতেসি না? কীয়ের ভালোবাসা ...?"
ওমর ফারুক থামে না, সে হাত তোলে ট্রাফিকের পুলিশের মতো। তার কপালে জ্বলে ওঠা ট্রাফিকের লালবাতি দেখে ইকবাল থেমে যায়। ওমর ফারুক বলে চলে, "এই ভালবাসার সাক্ষী হতে হলে দর্শকদেরও সব ভুলে যেতে হয়, চলে যেতে হয় ইতিহাস, ভূমি, মানুষ আর স্মৃতির বাইরের সেই শূন্যস্থানে। কিন্তু স্মৃতি, যন্ত্রণা, ভয় ও ঘৃণা দ্বারা ভারাক্রান্ত একটি গ্রামে কীভাবে তা সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই ভালবাসাটা হয় অপরাধী এবং পাত্রপাত্রীদের হতে হয় অভিযুক্ত। তারা হারিয়ে যায় এবং প্রত্যাখ্যাত হয়। যেমন হয়েছে মাহবুব আর হেনা। তাদের নিষিদ্ধ প্রেম হওয়ার আরেকটি পথ হলো, সময়কে উল্টোদিকে প্রবাহিত করে খোদ নির্যাতনের ঘটনাটিকে অতীতেই রদ করা, ঘটতে না দেওয়া। কিন্তু এ দুটোর কোনোটাই সম্ভব নয়। সম্ভব একমাত্র ভবিষ্যতে, যখন উভয় পক্ষ একটা রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে নতুনভাবে মানবিক বন্ধন নির্মাণ করবে, সৃষ্টি করবে নতুন ইতিহাস এবং নতুন বাস্তবতা। তাই ইকবাল, তোমাকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে রিকনসিলিয়েশনের জন্য। ঘৃণা নয়, পরস্পর সমঝোতার ভিত্তিতে হাঁটতে হবে নতুন পথে।"
ইকবাল চিৎকার করে ওঠে, "আমনে এইগুলি কী কইতে আছেন?"
ফাকমিদুল এগিয়ে আসে। "থামেন ফারুক, আপনি বেশি প্যাচান সব সময়। ... ইকবাল, শোনো। তুমি দুনিয়ার অনেক কিছুই বোঝো না। আমরা ঢাকায় থাকি, গবেষণা করি, অনেক কিছু জানি। যা বলি মন দিয়ে শুনে যাও শুধু। তোমার প্রতিক্রিয়ার যে গড় বৈশিষ্ট্য, তাতে মূলত আত্মীয়তার চেতনার বিপরীতে উল্লম্ব অবস্থানে রেখে ঘটনাটি বিচার করা হয়েছে। আমি হেনার মৃত্যুর ঘটনাটি বিচার করতে চাই বাংলাদেশের অন্যান্য সামাজিক সঙ্কটেরসঙ্গে আনুভূমিকভাবে। তার সঙ্গে মেলাতে চাই জাতি-রাষ্ট্র ধারণার। জাতি-রাষ্ট্র যদি বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায় একটি ইমাজিনড কমিউনিটি অথবা গায়ত্রী স্পিভাকের ভাষায় আর্টিফিশিয়াল কনস্ট্রাক্ট হয়ে থাকে, তবে তার কল্পিত ঐক্য ও সংহতির জন্য লাগাতারভাবে একটি আদর্শ জাতীয়তার অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে হয় এবং স্টুয়ার্ট হলের মতে কিছু রেপ্রিজেন্টেশন-পদ্ধতির মাধ্যমে এই নির্মাণের কাজটি করতে হয়, সেই অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্যও ...।"
এইবার দরবেশ খাঁ বেরিয়ে আসে ঘরের স্বল্পালোকিত আয়তন ছেড়ে। ছেলের মতো সেও দীর্ঘাঙ্গ, কিন্তু কৃশ। ফাকমিদুল দুই পা পিছিয়ে যায়।
ভাঙা গলায় দরবেশ খাঁ বলে, "আমরা কিছু চাই না। আমার মাইয়াডারে মাইরা ফালাইছে। বিচার চাইছি শুধু। একটা কচি মাইয়া, পয়সা ছেল না তারে ভাল খাওয়াইতে পরাইতে পারলাম না, ইস্কুলে দেছেলাম কুলাইতে পারলাম না। কিন্তু সে তো কোনো অপরাধ করে নাই। তারে এইভাবে বেইজ্জত কইরা, সবার সামনে বিচার কইরা আবার মাটিতে ফালাইয়া দোররা মারল। আমনেরা বড় শহরের লোক, বিচার করেন।"
রমণ সুমহান এবার একটা সিগারেট ধরান। ইকবাল নিরুপায় মথের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সেই সিগারেটের আগুনের দিকে।
রমণ সুমহান বলেন, "আপনার আরেকটা মাইয়া আছে না? তার তো একটা গতি করা লাগবে, নাকি?"
দরবেশ খাঁ কাঁপা গলায় বলেন, "হ্যাঁ, আমার ছোডো মাইয়াটা ... সারাদিন কিসু খায় নাই, তার বুবুর লাইগ্যা কানতে কানতে মাইয়াডা শ্যাষ ...!"
রমণ সুমহান কথা বাড়ান না। তিনি কড়াইল বস্তিতে গবেষণার সময় প্রচুর ঝগড়া কাছ থেকে দেখেছেন, মিটমাটের ব্যাপারে তিনি ভালো বোঝেন, বিশেষ করে কিছু ঝগড়া যেখানে তিনি নিজেই লাগিয়ে দিয়েছিলেন গবেষণার অংশ হিসেবে। তিনি সংক্ষেপে বলেন, "আপনার কপাল খারাপ দরবেশ ভাই। আপনার মেয়ের নামে অনেক কথা চইলা গেছে বিভিন্ন পেপারে। তারা পয়সা খাইয়া কী না কী লেখে কোনো ঠিক নাই। আমরা আপনার দুঃখ বুঝি। আমরা আপনারে অনুরোধ করতেছি, মামলা মকদ্দমায় যাইয়েন না। মাহবুব তো আর দোররা মারে নাই হেনারে। মারছে? সে একটা বলদ, ভুল কইরা জ্বিনের আছরে একটা কাম কইরা ফালাইছে। সে তো আপনার আত্মীয়ই হয় একরকম। তো ঘরে ঘরে এইসব মকদ্দমা কইরা কি টিকতে পারবেন? করেন তো খ্যাতের বদলির কাম। এদের সাথে বিবাদ কইরা পারবেন না। তারচেয়ে মাহবুব গ্রামে ফিরলে জুতা মাইরেন। যা-ই করেন, মাইয়া ফিরত পাইবেন না। ছোটো মাইয়ার পড়াশোনা বিয়াশাদির কিছু খরচাপাতি দিবে তারা, ভালমতো ব্যবস্থা দেখেন। ফারুক, ফাকমিদুল, চলেন আমরা যাই। আসি, স্লামালিকুম।"
ফাকমিদুল বলে, "এই প্রতিশোধ অথবা প্রতিরোধের ডাইকোটমি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে, ধূসর জায়গাগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে ...।"
রমণ সুমহান হ্যাঁচকা টান দেন তার হাত ধরে, "চলেন তো!"
ইদ্রিস ফকির মিহি গলায় আরো কয়েকটা বাক্য বিনিময় করে দরবেশের সাথে। রমণ সুমহান জোরে পা চালান।
ওমর ফারুক চুপ করে থাকে, ফাকমিদুল বক বক করে যায়, "এই ব্যাপারটা বুঝতে হবে, এই ডিসকার্সিভ আলোচনাটা হওয়া জরুরি। ধর্ষণ হলেই লোকজন একেবারে পাগল হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদী জঙ্গি দিয়ে দেশটা ছেয়ে গেছে, কেউ একটু ডিকনস্ট্রাক্ট করতে চায় না ধর্ষণের টেক্সটটাকে ...।"
ওমর ফারুক বলে, "ফাকমিদুল ভাই, কালকে ডিসির অফিসের সামনে বক্তৃতা দিতে হবে কিন্তু। দেইখেন, গলায় কাশি যেন বসে না যায়!"
ফাকমিদুল চুপ করে যায়।
ইদ্রিস ফকির কিছুক্ষণ পর জোর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে ধরে ফেলে তাদের । উৎফুল্ল গলায় বলে, "স্যার আপনেরা বড় কামেল আদমি। কদমবুছিটা কইরা ফালামু স্যার?"
রমণ সুমহান তরল গলায় বলেন, "সালামি দিমু না কিন্তু! দেড় লাখ পুরাটাই দিতে হইব।"
ইদ্রিস ফকির খুশির হাসি হাসে।
মাইক্রোবাস নাক ঘুরিয়ে চামটা গ্রাম ছেড়ে চলে যায় অন্য পৃথিবীর দিকে। সেই পৃথিবীতে একটা পাঁচশো সিসি নরটন মোটরসাইকেলের একমাত্র সিলিণ্ডারে কাঁপন তুলে আর্জেন্টিনার আকাশের নিচে ছুটে বেড়ায় হবুডাক্তার এরনেস্তো। আর দৈনিক কচুবনের মাইক্রোবাসে চড়ে প্রাক্তন বাম ওমর ফারুক হিসাব কষে, পরশুদিন তাকে যেতে হবে খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙা উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামে এক ধর্ষিতা আদিবাসীর ধর্ষকের সাথে রিকনসিলিয়েশনের কাজে।
0 মন্তব্যসমূহ