ব্রাত্য
রাইসু
লিপির
সঙ্গে দেখা হওয়ার ১০/১২ বছর পরে উনি মারা গেছিলেন। অন্য কারণে। মানে দেখা হওয়ার
কারণে না। গলায় ক্যান্সার হইছিল। তার চিকিৎসা করাইতে উনি ভারত গেছিলেন। কয়েকবার
আসা যাওয়া করছেন। কেমো নিছেন। তারপর মারা গেছেন।
একবার
রনির (গল্পকার ও আর্টিস্ট) আম্মারে ধানমণ্ডির কোন একটা হাসপাতালে দেখতে গেছিলাম।
ফিরা আসনের সময় নিচ তলায় লিফটের জন্যে যারা খাড়াইয়া ছিলেন তার মধ্যে দেখি
লিপি। চুল ছোট কইরা ছাটা। হাতে খাবারের সসপ্যান। আমি জিগ্যেশ করলাম এইখানে কী মনে
কইরা। লিপি হাসলেন, আপনে বাসায় আসেন না কেন? টিটুর বউয়ের ডেঙ্গু হইছে। আমি বললাম যামু নে। জিগ্যেশ করলাম আপনের
অবস্থা কী? বললেন আবার মাদ্রাজ যাইতে হইব। তারপরে লিফটে
উঠতে উঠতে বললেন, আপনে আইসেন কিন্তু। আমি বললাম, যামু নে। তো লিপিরে আর দেখতে যাইতে হয় নাই।
আজকে
ভোরবেলা লিপিরে দেখলাম স্বপ্নে। স্বপ্ন থিকা উইঠা লেখাটা লিখতে বসছি। লিপি সুন্দর
শাড়ি পরতেন, সুতি শাড়ি। সেই রকম শাড়ি পরা দেখলাম একটা
পুকুর পাড়ে। একটা শহরের মাঝখানের পুকুর। বা মফস্বল রাজধানীর পুকুর। শহরতলীর ধরনে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া মতো। তো আমি দেইখা তার দিকে আগাইয়া গেলাম। গিয়া দেখলাম
ওইখানেই তার বাড়ি। মানে আগে যে জানতাম না তা না। স্বপ্ন তো, মারা যে গেছেন স্বপ্নে(ও) ভাবি নাই। দেখলাম স্বপ্নে না ভাবাই
স্বাভাবিক। তবু মানুষ কেমন ‘স্বপ্নে’র লগে একটা অহেতুক ‘ও’ লাগায়।
আগাইয়া
যাইয়া ওনার সঙ্গে ওনার ভাই দুয়েকজনরে দেখলাম। বা ভাই না। যেমন ওনার বাসায়
প্রতিবেশী কমবয়সী ছেলেরা যাইত, লিপি আপা লিপি আপা করতো, সেই রকম কিছু ছেলে দেখলাম। স্বপ্নে ভাই না প্রতিবেশী এইটা অপ্রকট থাকল।
মানে বাস্তবে যেমন মানুষ দেখলেই কার লগে কী সম্পর্ক পট পট মিলা যায় আর আমরা ঠিক
করি, এ হইল এর এই…স্বপ্নে তা তো সব সময় হয় না।
সেই
ছেলেদের একজন বললো, আপনে একটু কৃপণ, না?
আমি বুঝলাম না ব্যাপারটা। পরে আরেক ভাই কিংবা প্রতিবেশী বললো,
আপনে স্কলারশিপ পাইছেন, খাওয়ান নাই!
পরে দেখি লিপি। আমি ওনাদের বাসায় ঢোকার চেষ্টা করলাম। উনি বললেন, আম্মা আপনেরে বাসায় নিতে মানা করছে। আপনে স্কলারশিপ পাইয়া খাওয়ান
নাই। আর একটা ব্যাপার আছে। সেইটা এখন কমু না। পরে একটু গলা নামাইয়া বললেন,
পরে আপনেরে কমু। অথবা এমন হইতে পারে স্বপ্নে আমি ভাবছিলাম
(এইখানে ‘স্বপ্নেও ভাবি
নাই’ সম্ভব দেখা যাইতেছে) বা উনি কী ভাবছিলেন আমি স্বপ্নে সেইটা বুঝতে পারতে
ছিলাম। স্বপ্নে তো এ-ই নিয়ম। পরে কেমন মনে হইল পিছন দিক থিকা ওরা আমারে ঠেলতেছে।
আমি আমার বাসার কাছে আইসা পড়লাম।
আমাদের
বাসা স্বপ্নে অনেক বড় হইছিল। রাস্তার পাশে অনেকগুলা ঘর। তখন আর ঘরও মনে হইতেছিল
না,
হাটের মধ্যে যেমন থাকে খোলা রেস্টুরেন্ট, সেই রেস্টুরেন্টের ভিতর দিয়াই বাইর হওয়া যায় বাঁশের আড়তে বা চাউলের
দোকানে সেই রকম খোলা বাসা আমাদের। আমি দেখলাম লিপি রাস্তার পাশের একটা ছোট চা
দোকানে আমার অপেক্ষায় বইসা আছে। আমি তারে একটু পরে দেখা করমু ভাব দেখাইয়া সামনে
দিয়া কে একজন সিগনেচার নিতে আসছেন তার লগে দেখা করতে আগাইলাম। আমি ভদ্রলোকরে
বললাম, মেয়েদের কারো, মানে আমার
বোনদের সিগনেচার নেন তাইলেই তো হয়। বললেন, মেয়েদের
সিগনেচারে হবে না। আমি সিগনেচার দিলাম। পরে আরেকটু আগাইতেই কেমনে কেমনে অন্য
ঘটনায় একজন রিকশাঅলা দেখলাম একটা ভাওয়াইয়া গাইতেছেন। আবার আমিও একই গান
গাইতেছি। আমি যে ঘটনাক্রমে একই গান একই স্পটে আলাদাভাবে গুনগুনাইলাম তাতে
রিকশাঅলার দিকে তাকাইয়া (সঙ্গে আরেক রিকশাঅলা) তার রুচির একটু তারিফ প্রকাশ
করলাম। দেখলাম সেইটা বাউন্স হইল। আমার পিঠ চাপড়ানি ধরতে পাইরা একজন গাইতে গাইতে
অন্যজন নিঃশব্দে যাইতে লাগলেন। আমি আগের জায়গায় আইসা দেখলাম লিপি নাই, চইলা গেছেন।
বাসায়
আইসা দেখি আব্বা আমার ছোট বোনরে বলতেছেন তার বাচ্চা নিয়া অন্য কোথাও গিয়া থাকতে।
এখন সে কেমনে থাকবে একলা একটা বাচ্চা নিয়া অন্যত্র, আমি আব্বার
সঙ্গে কথাটা তুলতে চাইলাম। আব্বা উত্তর দিলেন না কোনো। আরেক বোনের সঙ্গে দেখা হইল।
সে কী জানি বললো মনে নাই।
আমি
বাইরে আসতে লিপি মোবাইলে ফোন করলেন। বললেন, ‘আপনে
ফোন বন্ধ কইরা রাখছিলেন? আমি অনেকক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করতেছিলাম।’ আমার যে একটা মোবাইল ফোন আছে,
তা দিয়া যে লিপির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় এইটা এতক্ষণ মাথায়
আসে নাই।
লিপি
বললেন,
রাইসু ভাই, আমি যেইখানে কাজ করি ওইখানে
একটা সমস্যা হইছে। উনি যখন এইসব বলতেছেন আমি তখন হাঁটতে হাঁটতে ওনার ক্যান্সার
হাসপাতালের কাছাকাছি আসছি। কিন্তু এই হাঁটা অনেকটা বাতাসে ভাসার মতোই। নিচু নিচু
গভীর খাদ। এর মাঝখান দিয়াই কাঁচা মাটির লাল রাস্তা। সরু। ভিজা। আমি হসপিটালের
দিকে আগায় আসলাম। লিপি বললেন, হাসপাতালের যিনি ডাক্তার
তার ওইখানে কোনো এক বিদেশী রোগিণী আসছিল। ডাক্তার মহিলা বলছেন যে তার রোগ নাই। পরে
নাকি দেখা গেছে আছে। তা নিয়া নাকি অনেক সমস্যা হইতেছে। আমি লিপিরে বললাম আমি এখন
আপনের হাসপাতালের কম্পাউন্ডে। এইখানে অদ্ভুত দেখতে চাইরটা কী জানি কাদা পানির
মইধ্যে ঘুরতেছে। লিপি আরও কী কী জানি বলতেছিলেন। আমারে যে ওনার বাসায় নিষেধ করা
হইছে এইটা নিয়া কিছু বলতেছিলেন না। ওনার স্বামী কেনাডায় আছেন, দুইটা বাচ্চা আছে ওনার… সেই সবও দেখলাম স্বপ্নে মনে আসে নাই।
প্রাণী
চাইরটা অদ্ভুত। স্বপ্নেও অদ্ভুত মনে হইল। পাতলা চ্যাপটা খয়েরি বড় পোকার মতো।
অনেকটা ঘুড্ডির মত দেখতে। বাদামী রঙের। দুই জোড়া কাছাকাছি ছিল। এক জোড়া ভিন্ন
লিঙ্গের বোঝা গেল। ওরা দুইটা করতেছিল। পাশেই আরেক সেট। বাপ আর ছেলে। একবার পানির—ঘোলা পানির—নিচে ডোবে আবার ভাইসা ওঠে। একবার যেইটা
ডোবে পরেরবার আরেকটা ডোবে। আমি হাসপাতাল থিকা আরেক রাস্তায় বাইর হইয়া আসলাম।
কিছুক্ষণ হাঁটতেই উত্তর-পশ্চিম কোনায় দেখলাম ফরহাদ দাঁড়াইয়া আছে। ফরহাদ আমার ১৫
বছর আগের বন্ধু। আমরা এক সঙ্গে এক লোকের বাড়ি ভাঙতে গেছিলাম একবার। আমার হাতে রাম
দা ধরায় দিছিল তখন কে জানি। আমি দেয়ালের উপরে দাঁড়ায় ছিলাম। ওরা ওই বাড়ির
দরজা জানালায় কোপাকুপি করতে ছিল। ফরহাদ একটা লাল, বাদামি চৌকোনা
ডিজাইন অলা টিশার্ট পরা। আমি তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম। তারপরে কোলাকুলি করতে চাইলাম।
সে বললো, যাও গা, ঝড় আসতেছে।
দেখলাম
আকাশে একটা গোলাপি-লালে মিশানো মেঘ। মোটা গরাদের মতো ফাঁক ফাঁক। কিন্তু আবার চারজন
মানুষ যেন হাত ধরাধরি কইরা কোথাও যাইতেছে। অনেকটা মার্ক শাগালের ছবির নাচের
ভঙ্গিতে বা কার জানি একটা সিনেমাতে যেইভাবে শয়তানরা যাইতেছিল ওইরকম। ওইখানে
কামরুজ ভাইয়ের ভাই টুটুল মেবি, তার সঙ্গে দেখা হইল। সে দেখলাম
ঝড়ের হাত থিকা বাঁচনের জন্য দৌড় দিছে। আমিও দৌড় দিলাম। বাসায় পৌঁছতে পারব কিনা
চিন্তা। বৃষ্টির ভারি ফোঁটা পড়া শুরু হইল।
এর
মধ্যে আবার ফোন আসলো লিপির। লিপি যে ফোনে কথা কইতেছিল, তা কীভাবে জানি অফ হইছিল, বা অফ হওয়া ছাড়াই
লিপি ফোন না রাখলেও আর ছিল না এতক্ষণ। স্বপ্নে এগুলি হয়। লিপি বলল আপনেরে একটা
কথা বলি। আপনে তো জানেন আমার আগে একটা বিয়া হইছিল। ওই সময়ের আমার একটা ছবি আছে।
আপনে এইটা একটু দেইখেন। কাকরাইলের ন্যাশনাল না কী যেন একটা হোটেলের নাম বইলা বলল
ওইখানে ঢুকলে দেখবেন কাঠের তিনটা তাক আছে, ছবি সাজাইয়া
রাখছে। আপনে মাঝখানেরটায় দেখবেন আমার ছবি আছে। ছবিতে এসি, তারপরে কার্পেটের ছবি আছে—আপনেগো
কার্পেটটাও কিন্তু সুন্দর—আমি মাঝখানে
বইসা আছি।
আমি
দেখলাম একটা ছবির ঠিক মাথার উপরে এসি আর হোটেল ঘরের বেগুনি কার্পেটের মধ্যে লিপি
বইসা আছেন। আমি ভাবছিলাম ছবিতে তার আগের স্বামীরে দেখতে পাবো, কিন্তু সেইটা নাই। লিপি বইসা যারা যারা ছবি দেখতেছে তাগো দিকে তাকাইয়া
আছেন।
কিন্তু
এইটা আমি ছবি নিয়া ভাবতেছিলাম। আসল ছবিটা দেখার জন্য আমি দেশে ফিরা কাকরাইলে
হোটেলগুলাতে খোঁজ করমু। আসলে লিপি যে হোটেলের নামটা কী কইছিল ঠিক কইরা আমার মনে
নাই। সবগুলা হোটেলেই খোঁজ করতে হইব।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পটি আমার কাছে কিন্তু দারুণ লেগেছে।
উত্তরমুছুন