কার্তিক

আনোয়ার শাহাদাত


জন্মদান-প্রক্রিয়া-শেষে সন্তানের মা যথারীতি গর্বিত। অন্তত যদি সে মা সংস্কারমুক্ত ‘সমাজের’ একজন হয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে গর্বটুকু স্বাভাবিক। তার পরও যদি ‘দোষের-বাটি’তে ফেলে গর্বটুকুকে তাল-কচলানো হয় তবে তা তৃপ্তির চেয়ে তিক্ত কষ-ক্ষরণের ঘা করে দেয়। কেননা প্রকৃতি-প্রদত্ত প্রক্রিয়ায় মা হওয়ার গর্ব করার অধিকারের বিষয় কোনোভাবেই কেউ সংশ্লিষ্ট নন।

নবজাতকের মায়ের গর্ব আর একটু স্পষ্ট হয়- হাঁটতে গিয়ে তার পা ফেলার ভঙ্গি, সন্তানকে সময়-অসময় আগলে ধরা, অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে ছোঁয়া দূরে থাক, ছুঁতে এলে তেড়ে আসা এসবের ভেতর দিয়ে। 

পোয়াতি মা এখন ছোট উঠোনে নেমেছে। কার্তিকের উঠোন, বর্ষার কাঁচা ভাব এখনও কাটেনি। উঠোনের কোণায় শেকড়ের পাশে তার অবস্থান এখন। পা ফেলছে সেই গর্বিত ভঙ্গিতে। ধীরে, মাটি থেকে এক পা তুলে অপর পা চাপ দিয়ে আবার মাটিতে। কিছুক্ষণ পরপর গা-ঝাড়া। মাথা ডান বাম কাত করে আকাশের দিকে চোখ রাখা, কাক বা আজন্ম শত্রু দুর্ধর্ষ চিল নামছে কি না আবার! জামগাছের শেকড় থেকে অনেক দূরে বিমর্ষ কুকুর গন্তব্য-হীন হেঁটে যেতে থাকলে দু’ডানা তুলে তেড়ে যায় মা কোৎ-কোৎ শব্দ করে। তখন পাঁচদিন বয়সের নবজাতকরা কী সমঝোতায় জড়ো হয়। মা ফিরে এসে কোনো একটি খাবার ঠোঁটে নিয়ে ছেড়ে দেয়। সবগুলো বাচ্চা তখন চিকন স্বরে ডাকে মায়ের ঠোঁটের কাছে ভিড় করে। 

মা আবার গা-ঝাড়া দেয়। আড়াই মাসের দীর্ঘ ডিম দেয়া ও তা দেয়া চক্রে মায়ের গায়ে গুঁড়া পোকা জন্মে যায়। মুরগি দেহ পশমের নিচে সে-পোকার কিলবিলুনিতে যন্ত্রণায় ডানা ঝাপটে ঘনঘন গা-ঝাড়া। চিল নয়, কাঠ-ঠোকরা পাখি উড়ে যেতে দেখেও ভুলে নবজাতকের মা সতর্কতাসূচক ধ্বনির উচ্চারণ করে। চারপাশের বাচ্চাদের দিকে চোখ বুলিয়ে পাখা ফুলিয়ে ধরে। সন্তানরা সহসা ডানার নিচে মাতৃ-আশ্রয়ে লুকায়। 

তখন ঘর থেকে মানবসন্তানের মা রাহেলা আবারও প্রিয় মুরগির উদ্দেশ্যে দু’চার কথা শোনায়।

- কই ওলে বুদ্দি-সুদ্দি কি গিলা খাইচ? কুড়াইল্লা পক্ষী দেইখ্যা যে ছাওডিরে কোলের মধ্যে লইচ!

রাহেলা যখন থেকে আটটি বাচ্চাসহ উঠানে ছাড়ে তখন থেকেই কারণে-অকারণে কথা বলে চলছে মুরগির সঙ্গে।

- আহরে, মাগির ঢং দেখলে অয়, আডে কেমনে, য্যান আর কোনো মুরগির ছাও অয় না! জোরে জোরে গা ঝাড়া দে, হালাইয়া দে পোকাটিরে, নাইলে তোরে খাইবে পোহে- 

- অত ছ্যানাৎ ছ্যানাৎ হর ক্যা? খাইচ কী? পেডে দেহি কিচু পড়ে নায়।

-এ কই বোলে পিছের বাগে যাইয়া পাও দুইডা-ইদ্দা ছালাইয়া পোকা-ছোকা কিছু খা।

এভাবে যত কথা মনে আসে রাহেলার সবই বলে যায় সদ্য ওম থেকে উঠে আসা নবজাতকের মা-মুরগির সঙ্গে। 

মুরগির ডিম দেয়া শুরু হলে দু’সপ্তার মাথায় দেড় হালি হাটে বেচে দিয়ে তিলের তেল কিনতে হয়। এ-মুরগির মাস ধরে একদিন পর একদিন ডিম দেয়ার কথা। তাতে কখনো চোদ্দটা থেকে ষোলোটা ডিম হয়। সে থেকে দেড় হালি বিক্রি। ছেলে ‘আস্তা আন্ডা খামু’ বলে জিদ ধরলে আরও একটি ডিম চলে যায়। শামছু প্রস্তাব করেছিল রাহেলাকে- থাক দরকার নাই, এবারেও বিরত থাক মুরগি ডিমে ওম দেয়া থেকে। রাহেলা এতে শামছুর উপর রাগ করে না, অভাবী সংসারে রাগ ঢিলেঢালা হয়ে পরে ‘ভাগ্যের’ উপর ভর করে। বিবিধ অক্ষমতা উপলব্ধি করতে পেরে কেউ কারও উপর তেমন রাগ করে না। তবে শামছুর ডিমে ওম দেয়া থেকে বিরত থাকার প্রস্তাবে রাহেলা অভিমান করে। সবসময় একই কথা শামছুর। মুরগিরও আর বাচ্চা ফোটানো হয় না ডিম থাকে না বলে। কিন্তু ডিম-দেয়া পর্ব শেষ হলে মুরগির ‘ওম-জ্বর’ আসে। ওম-জ্বর এলেই তো মুরগি বসে পড়ে ডিমের উপর। ডিম ছাড়া মুরগি ওম-জ্বর নিয়ে উত্তরাধিকার-বিহীন অপ্রয়োজনীয় লাশে পরিণত হয়। গায়ের পশম খাড়া করে ডানা বাড়িয়ে তখন এ কোণায় সে কোণায় ঝিম মেরে থাকে। শামছু মুরগির ওম-জ্বর ছাড়ানোর জন্য ধরে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয় আর ওম-জ্বর যত তাড়াতাড়ি কাটে ডিম দেয়ার পরবর্তী পালা ঘনিয়ে আসে। 

অনেক দিন পর এবার প্রকৃতই মুরগিকে ডিম দিতে হয়। ওমের স্বাভাবিক উত্তাপে প্রথম ছয়টি ছা’ ডিম ফুটে উৎসুক চোখ খুলে চারদিক দেখে। হাতকাটা পঙ্গুর মতো আবির্ভূত পশম-পালকহীন ডানা ঝাপটিয়ে ঠোঁট নেড়ে যেসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাতে মনে হয় মুরগির ছা’গুলো জন্মে বেশ সন্তুষ্টই হয়েছে। মুরগিও বেহিসাবি আনন্দিত হয়। ডিমের ওম সাজি ‘আইওল’ ছেড়ে নেমে যায় মুরগি দু’টো ডিম ফোটা বাকি থাকতে। সম্ভাব্য দু’টো সন্তানের প্রতি মুরগির এ-অ-বিবেচিত দায়িত্ব-হীনতায় রাহেলা কষ্ট পায়। মুরগিকে অনুরোধ করে- ‘আর একদিন বইয়া থাক, বাহি আন্ডা দুইডা ফুডুক, তোর মাথা-ডার কিরা।’ অনেক কিছুর মতোই মুরগি রাহেলার অনুরোধ শোনার মতো বাধ্যগত থাকে না। বেরিয়ে পড়ে। শেষ-মেষ রাহেলা প্রায় ফুটে যাওয়া ডিম দু’টো তুষের পাত্রে ডুবিয়ে রাখে। ঠিকই একদিনের মাথায় ডিম দু’টো ফুটে অধিক সন্তুষ্ট আরও দু’টো বাচ্চা যোগ হয়। নতুন ছা দু’টো মুরগির কাছে এনে ছেড়ে দিতে সেকী মাতব্বরি তার! রাহেলাও তখন ছেড়ে কথা বলে না- ‘চুপ থাক বদ্‌জাত, যত নসল্লা, জানা হইচে মোর, কত দরদ নিজের আন্ডা ছাওর লইগ্যা, অই দুইডা রাইখ্যাই তো উইঠ্যা গেলি, এহন অত পোদ্দারি কীয়ের? হোন কতা, এই ছাও দুইডার মা কোইলাম তুই না, অগোর মা অইলাম মুই আর কোলার তুষ।’

অবশ্য রাহেলা নিজেই বলে তার কথা সব ‘গাং’এ গেছে কেননা মুরগি তার ওসব কথা একদম কানে তোলে না। কুক্ করে আশেপাশে একটি চক্কর কেটে খাবার খোঁজে বাচ্চাদের জন্য। হঠাৎ করে দু’পায়ের নখরে মাটির মেঝেতে ছালায় যেন এর নিচে কত খাবার পড়ে আছে ওর এবং বাচ্চাদের জন্য! রাহেলা রেগে গিয়ে ধমকায়- ‘খবরদার, মোর লেপা খাডালে আঁচড় দিবি না, চুলা-খোচানি লাডি ফিহা মাইররা ঠ্যাং ভাংমু কইলাম!’ মুরগির নখের আঁচড়ে মাটি চিরে গুঁড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই গুঁড়ায়ই বিভ্রান্ত বাচ্চারা ঠোকর দিয়ে অস্বাদে ঠোঁটে ঝাঁটা মারে। খাবার কোথায়, এ তো কেবল মাটি!

রাহেলার সকল দুঃখকষ্টের ভাব প্রকাশ মুরগিকে ঘিরে। আট-আটটি বাচ্চার পোয়াতি মা, অথচ তাদের সামনে কোনো খাবার দিতে পারছে না রাহেলা। দায়িত্বের অপারগতায় চৈত্রের অনাবাদী মাঠের মতো ফাঁকা হয়ে যায় রাহেলার বুক। সবশেষ খুদ-গুলো ক’দিন আগে জাউ করে খেতে হয়েছে। শামছুর কাছে সে প্রসঙ্গ তুলতে রাহেলা ভুলে গিয়েছে এমন নয়। বাচ্চাগুলো ফুটে বেরুবার পর, বাইরে নিজের মতো খাবার খুঁজতে যাওয়ার উপযোগী বড় হওয়ার আগে যে খুদ-গুলো খাওয়াতে হবে সেকথা রাহেলা স্মরণ করায়। শামছুও অনান্তরিক ছিল না। গামছাটা কাঁধে ফেলে কোথাও কিছু মেলে কি না এমনটি বলে বেরিয়ে পড়ে। ফিরে আসে প্রহরাধিক পর। নাড়ায় ছাওয়া বারান্দার মাটিতে গামছা বিছিয়ে শুধু শুয়ে থাকে সে নির্বাক। সংজ্ঞাহীন এই নীরবতাও একবার ভাঙ্গে শামছু নিজে ছেলেকে ডেকে। ঘরের মাচায় সঞ্চিত খুদের হাঁড়ি রাহেলা পর্যায়ক্রমে কাত ও উপুড় করে ঢালে গুঁড়া খুদ তার ঝাড়ুনি কুলায়। জাউ রেঁধে রাহেলা শামছুর সংজ্ঞাহীন সেই নীরবতায় আদরের হাত বোলায়- ‘মোনে অয় বাইরে গেলে দুন্নইডা পিডে লইয়া আইয়া হুইয়া রইচে, ওডো নাইয়া আও।’ শামছু তখন পেটে শূন্য বাসন খোরা চেপে ধরে দু’হাতের আঙুলগুলো দিয়ে এক অজ্ঞাত তালের বাদ্য বাজায়। মিহি কণ্ঠে সর্বাধিক দুঃখ-মিশ্রিত সুরে গান গায়, ‘এই জরমের মাইনি জানা নাই-রে পাগল, এই জরমের মাইনই জানা নাই।’

চৈতের অনাবাদী ফাঁকা ক্ষেত-মতন রাহেলার বুকে আর এক-দফা বজ্রপাত হয় যখন তার চোখে পড়ে শামছুর পেটে উপুড় করা শূন্য বাসনের উপর। শূন্য খোরা পেটে লাগিয়ে বাদ্য করার সময় পেট টেনে ভেতরে নিতে হয়। তা হলেই পেট ও বাসনের দুই শূন্যতায় আঙুলের পেটান পড়লে টুং-টাং শব্দ মধুর তাল তোলে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শামছুর পেটে সাধারণত নিচে টেনে বাসন বসালেও পেট অত গভীরে না যাওয়ায় বাদ্য তার ভাল হয় না। কিন্তু জাউ খেতে ডাকতে এসে রাহেলার চোখ এখন সেখানে, যেখানে শামছুর শূন্য পেটে বেশ খাপ খেয়েছে শূন্য বাসন। 

মুরগি উঠোনের কোণায় জামগাছের শেকড়ের গোঁড়া ছাড়ে না। রাহেলা অনেক যেতে বলেছে, দূরে একটু কোথাও।

- ‘যারে পাগলি এটটু লইড়া চইড়া খা, ছাওডিরে কষ্ট দিস না। লাগলে যাইয়া গুয়া বাগ-এ ছালা, পোক-ছোক কিছু তো পাবি। নাকি সাইবের-জি হইচ, মুহের দারে খাওন-ডা, আহ্ হা রে মোর সাইবের-জি সাইব, বাহার কী, ঢোঙ্গের মড়াগাছ, কই বোলে নিজের খাওন নিজে যোগার হরতে পার না।’

এ-পর্যন্ত বলে রাহেলা একটু হেসে আবারও শুরু করে

- ‘আরে, বোহা মুরগী, তোর যদি এহন জবান খোলতে, হেলে তুই দেহি মোরে এহন বন্দি জালে আটকাইয়া হালাইতে পারতি। ক, ফিরাইয়া ক,- “ও রাহেলা, রাহুরে, মোর রাহু-বিবি, তোর খাওন তুই যোগার হরতে পার না। অই যেন তোর কালা-চান পুত হের খাওন”। 

হাঁসের ছা’কে খাওয়াবার শামুক কাটার ক্ষয়ে-যাওয়া কাঁচিখানা রাহেলা ঘরের বেড়ার বাওতা থেকে টেনে হাতে নেয়। জাম গাছের নিচে পুরোনো কাঁকরোল ঝাড়ের গোঁড়ায় বসে। কাঁচি কাঁকরোল ঝাড়ের মাটির চাড়ার গুঁড়া ও গোবর মেখে উর্বরতার জন্য সার হিসেবে দেয়া হয়। তার মধ্যে কখনো বিভিন্ন পোকা জন্মায়। খুঁচিয়ে সেইসব পোকা বের করে নবজাতক ও তাদের মায়ের নবান্ন আপ্যায়ন করাই হচ্ছে রাহেলার উদ্দেশ্য এখন। এ-পর্যায়ে রাহেলার কানে ঝুন-ঝুনির শব্দ পৌঁছে। 

অনেক আগে প্রায় ভোর-বিহানে, ছেলে ‘কী খামু কী খামু’ করে ব্যর্থ হয়ে ত্যানা দিয়ে বানানো খুচইন কাঁধে ঝুলিয়ে চলে যায়। সাড়ে ছয় বছরের ছেলে খাবার না পেলে অনেক পাগলামিই করার কথা। এ-ছেলে তা করে না। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বাস্তবতাকে জগতের যে-কোনো প্রাণীই যে মেনে নেয় তা এ-ছেলেকে দেখে আবারও উপলব্ধি করা যায় একবার।

- ‘মাগো দেহি কিচু ধুরি-চিঙ্গইর ধরতে পারি নাহি।’

মোটা কঞ্চি-টুনি দিয়ে বানানো তিন কোণার গুঁড়া-চিংড়ি ধরার ত্যানা জাল ‘খুচইন’ ছেলে বড় মানুষের মতো কাঁধে বয়ে নিয়ে হেঁটে গেছে সেই সকালে। রাহেলা তখন পেছন থেকে অবাক হয়ে দ্যাখে, ছেলে ক্ষুধা নিবারণের জন্য নিজেই যাচ্ছে খাবার অন্বেষণে। পাশের দল ঘাস-ক্ষেতের শুকনো-প্রায় ডোবার দিকে ছেলের কোমরে ঝোলানো ঝুন-ঝুনির শব্দ মিলিয়ে যেতে শুনেছে। 

ছেলের বাবা বেরিয়েছে আরও আগে, যখন ভোরের পাখি পালক খসিয়ে ডেকে উঠছে। অভিন্ন উদ্দেশ্যে ছেলে ও বাবার গমন- ‘অন্বেষণে’। ছেলে যখন মাকে গুঁড়া-চিংড়ি ধরতে যাওয়ার কথা বলে মা তখন আগ্রহ নিয়ে কাতর স্নেহের কণ্ঠে বলেছে- ‘লইয়া আয় বাজান, মাডির খোলায় ভালোমতো টাইল্লা দিমুআনে।’

ছেলে বলে যায় মাকে, সে কোথায় কেন, ব্যর্থ হতে পারে পশ্চাতে এই ভাবনায় বাবা আর রাহেলাকে বলে যায় না। যদিও শামছুর কোনো ব্যর্থতা রাহেলার কাছে বিশাল ‘কপালের ফ্যার’ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।

সাড়ে ছয় বছরের ছেলের কোমরে ঝুন-ঝুনি থাকার কথা নয়। দেড় বছর বয়সে বাবা কালো সুতলির আগায় ঝুন-ঝুনি বেঁধে দেয়। নেয়ামত-হাটে শামছু চার কুড়ির সোয়া ঘা সুপারি ও এক কোঁচা চিচিঙ্গা বেচে। বীজ-বিচির চিচিঙ্গাটা ছেঁড়ার সময় রাহেলা যথারীতি আহ্ করে ওঠে

- ‘আহারে বীজফল রাকচি ওডা’- শামছু এর মধ্যে ছিড়ে কোঁচায় রাখে।

- আরও কত অইবে, আইজ পুতের লইগ্যা ঝুন-ঝুনি কিনমু।’

ছেলের কোমরে ঝুনঝুন শব্দ হবে সেকথা ভেবে নিয়ে চিচিঙ্গা হারানোর কষ্ট রাহেলার লেপটে যায়। 

সে-সময় থেকে ছেলের হামাগুড়ি, কি কখনো দৌড়ানোর সময় ঝুনঝুন শব্দে বাবা-মা অজ্ঞাত গর্বে আনন্দিত হয়। পুকুরের পারের দিকে সে-শব্দ হলে শামছু উঁচু-গলায় ছেলেকে ডাকে, অথবা রাহেলা হাতের কাজ ফেলে দু’পা এগিয়ে পুকুরপাড় থেকে ছেলেকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু ঝুনঝুনের মাধুর্যের বয়স ছেলের পেরিয়েছে যেমন, বছর-খানেক আগে সাঁতার শেখার ফলে তার প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শামছুর শখ- থাক না ছেলের কোমরে, খুলে ফেললেই তো শেষ হয়ে গেল। খাওনার দিনই ওস্তার হাতে ঝুন-ঝুনি খোলা হবে বলে শামছু সিদ্ধান্ত নেয়।

এসব গ্রামে দশ বছরের আগে ব্যাটাছেলের জন্য লুঙ্গি পরা সভ্যতা প্রযোজ্য নয়, কিন্তু দাদা সম্পর্কের মানুষেরা ভয় দেখায় ‘নুনু লিঙ্গ’ কেটে দেয়ার। সেই ভয়-মোচনের ব্যবস্থা হিসেবে শামছু ছেলের জন্য রাহেলার ছেঁড়া শাড়ি যা কাঁথা বানানোর জন্য রাখা হয়েছে তার ত্যানা দিয়ে কাপড় বানিয়েছে। ছেলের কোমরের তাগার সঙ্গে সেই ত্যানা-কাপড় মুড়ির সামনে পেছনে ঢেকে দেয়া হয় ভয় দেখানোর উৎস। 

সারা গায়ে কাদামাটি মাখা ‘কাদা-মূর্তি’ ছেলে ধুরি-চিংড়ি ধরার খুচইনহীন, চিংড়ি রাখার ঠোলা, জরুরি ঝুন-ঝুনিয়ে মায়ের সমনে এসে দাড়ায়- 

- ‘মাগো, কচু গাচ পামু কই, পুহুরের পারের কচুডি তো নাই মা, দুইডা কুত্তায় গিট পরছে, আজিজ কাকু কইচে কচু গাচে গিট লাগাইতে।’

কোথায় কচু-গাছ পাবে রাহেলার কাছে সে-প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে কোনো একদিক দৌড়ে চলে যায় আবার। ছেলে খুব ব্যস্ত, কাকু বলেছে কচু গাছ খুঁজতে, গিট লাগাতে হবে।

রাহেলার হাতের কাঁচি কাঁকরোল গাছের গোঁড়ায় ঝুরামাটির ভেতর, ঝুনঝুন শব্দ করে দৌড়ে চলে-যাওয়া ছেলের দিকে স্থির চেয়ে থাকে। কোথায় ছেলের ধুরি-চিংড়ি, খুচইন, কোথায়-বা তার ক্ষুধা! পুকুরপাড়ের পতিত কচু-গাছগুলো না পেয়ে মায়ের কাছে জানতে এসেছে। তার বয়স তাকে আজ যদি সবকিছু উপলব্ধি করার ক্ষমতা দিত তা হলে নিশ্চয়ই মার কাছে জানতে চাইত না পুকুর-ধারের কচু-গাছগুলো কোথায় গেল। এতদিন তারা কী খেয়ে বেঁচে থাকল। 

পাশের বাড়ির অজিজের গলা রাহেলা শুনতে পায়- 

- ‘আয়রে মরার কুত্তা-কেডি, কার্তিক মাইস্যা অভাবের মইদ্যে কী কামডা হয়, পেডে দেহি কিছু নাই, কইলাম অই কান্দা গরুর মড়ক আচে খাইয়া আয়, হ্যাঁ না যত্তা আকাম, আবার কতুডি কুত্তার ছায়ের যোগাড়। নিজেরা খাইতে পারে না আবার ছাও! কী রে ছ্যামরা শামছুর পো, কচুগাচে গিট লাগাইচ?’

- ‘কচু-গাছ পাইলাম না যে কাকু।’ 

যে আজিজ কুকুরকে কার্তিক মাস দেখাল সেই আজিজেরও কার্তিক মাস। সেও পেট-খালি করে বেড়াচ্ছে, একাধিক ‘ছাও’ আছে তারও ঘরে, কার্তিকের কুকুরের মতো সেও থামেনি। কী-ই-বা থেমে থাকে! একটি কার্তিকও কি থেমেছ এদের জীবনে?

রাহেলা কাঁচি ঘুঁটায় ঝুরামাটিতে। সামনে মুরগিও দু'পা দিয়ে ছালানো অব্যাহত রাখে। বিভিন্ন পোকা উঠে আসছে। বাচ্চাগুলো খাবার পেয়ে আনন্দে চিঁচিঁ করে মাথায় তুলছে। রাহেলার কাঁচিতে একটি বড় কেঁচো উঠে আসে। মুরগি তড়িঘড়ি কেঁচোটাকে ঠোঁটে নিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় যেন বাচ্চাগুলোও তার এই মোক্ষম সুস্বাদু খাবারে ভাগ বসাতে না পারে। খুব দ্রুত আস্ত কেঁচো মুরগি গিলে ফেলে। মুরগির এই ত্বরিত কেঁচো গেলা রাহেলার চোখের সামনে হলে পরে সে ক্ষুধার্ত মুরগির অবস্থা আঁচ করতে পারে। 

কিন্তু তারও মুখ ভরে যায় লোভ-লালায়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে সে একটি ঢোক গিলে ফেলে। আরও দ্রুত তার হাতের কাঁচি সচল হয়। মনে হতে থাকে আরও কেঁচো উঠুক। রাশি রাশি কেঁচো। মুরগির মতো অনেকেই তো ক্ষুধার্ত। সে, ছেলে, ছেলের বাবা, সবাই খালিপেট নিয়ে ঘুরছে। অথচ কাঁচির ঘোঁটায় মাটি ফুড়ে আর কোনো কেঁচো উঠছে না। রাহেলা আগের মতো অজান্তে আরও একটি ঢোক গিলে ফেলে। ক্ষুধায় জিহ্বা লোভ-লালায় সে ডুবে আছে। 



----------------------
নিউইয়র্ক, মার্চ ’৯৬

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ