শাহনাজ মুন্নী
শেষ বিকেলে সাত তলা অফিসের ঝাপসা
কাঁচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হলো কেরানী মারা বৃষ্টি বোধহয় একেই বলে।
ঠিক যখন ফাইল টাইল গুছিয়ে বাড়ি যাবার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেছে তখনই এমন ঝুঁপ করে
সদল বলে নেমে আসার কোন মানে হয়? শেষ শরতের
খেয়ালি বৃষ্টির বুঝি একটুও কান্ডজ্ঞান থাকতে নেই? বৃষ্টি কি বোঝে না, তার কল্যাণে বা
শত্রুতায় এখনই পথে জমবে এক হাঁটু পানি, বাসগুলো থাকবে লোকে ঠাসা, সিএনজিগুলো
সুযোগ বুঝে বিশাল ভাড়া হাঁকাবে, অফিস ফেরতা
মানুষগুলোকে কাক-ভেজা হয়ে নাজেহাল হতে হবে কাদা-পানি-অন্ধকারে, অথচ বৃষ্টি এমনিতে তার খুব প্রিয়, বহুদিন শুকনো আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির শব্দের জন্য
অপেক্ষাও করেছে সে, আরো অনেক
বাঙালীর মতো বৃষ্টি নিয়ে তার মধুর কিছু স্মৃতিও রয়েছে, অথচ সময় ভেদে কত কিছুই না পল্টে যায়, সেই দারুণ প্রতিক্ষীত রোমান্টিক বৃষ্টি এখন তার কাছে
সময়ে-অসময়ে গৃহবধূদের ঘ্যানঘ্যানে কান্নার মতো আকাশ থেকে ঝরে পড়া এক প্রকাল তরল
মাত্র,
যা তার মতো খেটে খাওয়া ছা-পোষা শহুরে মানুষকে কেবলই
বিড়ম্বনা আর ভোগান্তিতে ফেলে।
জানালার অস্বচ্ছ কাঁচের মধ্য দিয়ে
ঝাপসা রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে একটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘ঘটনা কি? বাড়ি যাবেন না ? সন্ধ্যা হয়ে গেল তো!’
বস অফিস থেকে বের হবার মুখে বোধ
হয় হঠাৎই ( নইলে তার মতো এত নগণ্য কর্মচারীকে তো চোখে পড়ারই কথা না) তাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলে সে একটু
অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে খানিকটা বোকার মতো হাসে।
‘স্যার দেখেন না, কি বৃষ্টি, প্রতিদিন অফিস
থেকে যাওয়ার সময় নাইলে আসার সময় বৃষ্টি নামে.. ’
অবশ্য বৃষ্টি হলেও বসদের বাড়ি
যাওয়ায় অসুবিধা নেই, তাদের জন্য গাড়ি
অপেক্ষা করে আছে, কিন্তু
কর্মচারিদের তো সে সুবিধা নেই। তার কথা শুনে বস ভ্রু কুঁচকে জানালার দিকে তাকান, সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করেন বৃষ্টির জোর কতটুকু। বস কি
বৃষ্টির মারমুখী হাবভাব দেখে এখন তাকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করবে,
‘আপনার বাসা কোথায়?’
সেও অতি নিম্নও নম্র কন্ঠে বলবে, ‘মোহাম্মদপুর, স্যার।’
‘ও, তাই নাকি?’ বস বলবে ‘চলেন তাহলে আমার সঙ্গে, আমি ওদিকেই যাব, বৃষ্টিতে ভেজার দরকার নেই, চলেন, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাই।’
সে তখন খানিকটা কুন্ঠা, লজ্জা ও সংকোচের সাথে বসের সঙ্গে লিফটে চড়ে নীচে নামবে।
বসের চমৎকার গাড়ির নরম সিটে বসে মায়ময় কোমলতায় ডুবে যাওয়ার অনুভব হবে তার। নাকে
এয়ার ফ্রেশনারের জেসমিন সুগন্ধী এসে ঝাপটা খাবে।
বস কয়েকটা সিডি হাতে নিয়ে বলবেন, ‘ কি গান আপনার পছন্দ? গজল চলবে? মেহেদি হাসান না জগজিৎ সিং? কোনটা দেবো?’
বাস্তবে অবশ্য এধরনের কোন কথোপকথন
হয় না। বস কাঁচের জানালা থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে বলেন,
‘তাহলে আপনি বৃষ্টি থামার অপেক্ষা
করেন,
আমি যাই।’
বস লোকটা এত অভদ্র কেন? সৌজন্য কিংবা ভদ্রতা দেখিয়ে একবার তো অন্তত বলতে পারতো, চলেন আপনাকে পৌছে দেই। যদি হতো সে একটি সুন্দরী ও স্মার্ট
নারী,
তাহলে কি বস পারতো এভাবে তাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে? নিশ্চয়ই তার সঙ্গ পাওয়ার লোভে বা সুন্দর মুখের প্রতি
স্বাভাবিক সহমর্মিতায় কাতর হয়ে ... ধেৎ কি
সব ভাবছি! নিজের হ্যাংলাপনায় বিরক্ত হয়ে নিজেক্ইে ধমকায় সে। বস বললেই তার গাড়িতে
চড়বো নাকি আমি? নিজের আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দেবো
এতো সহজে?
তারচে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরবো, সেও ভালো। সে হাতের ব্যাগটা গুছিয়ে বের হওয়ার জন্য পা
বাড়ায়।
বৃষ্টি তখনো থামেনি। ঝিরঝির, ঝরঝর, টুপটাপ, টিপটিপ, ঝুপঝাপ, ফিসফিস। বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। সঙ্গে বাতাসও হচ্ছে।
ঠান্ডা,
হিম হিম একটা ভাব।
লিফটের সামনে দাঁড়ানো সিকিউরিটি
গার্ড বললো, ‘বাইরে তো বৃষ্টি
হচ্ছে ম্যাডাম, ছাতা আছে সাথে?’
সে একটু হেসে মাথা নাড়ে। ছাতা
নেই। বৃষ্টি সামলানোর ঢাল তলোয়ার কিছুই সাথে নেই তার।
‘ম্যাডাম কিছু মনে না করলে, আমার ছাতাটা নিয়া যান। আমার নাইট ডিউটি। ছাতা লাগবে না।
কালকে সকালে ফেরৎ দিলেই হবে।’
গার্ডকে ধন্যবাদ দিয়ে নড়বড়ে
ছাতাটা হাতে নিয়েই বের হয় সে।
লিফটে উঠে হঠাৎ তার মনে হয় এটা
যেন কোন জীর্ণ শীর্ণ ছাতা নয়, এটা ভাঁজ করা এক রঙীন প্যারাসুট। ছাতাটা মেলে ধরে
সাত তালা থেকে লাফ দিলেই হতো, বৃষ্টি আর
বাতাসের সাথে মিলে এই সিক্ত মুক্ত ছাতা তাকে নিয়ে হেলে দুলে উড়াল মেরে পৌছে যেত
মোহাম্মদপুরে, ঠিক তাদের ভাড়া বাসাটার সামনে
নামিয়ে দিতো যত্ন করে। কী দারুণ-ই না হতো ব্যাপারটা। মাথার উপর ছাতার ছাউনি, চোখে-মুখে ভেজা বাতাসের আদুরে ঝাপটা। আর মেঘলা সন্ধ্যায় সে
উড়ে উড়ে যাচ্ছে মতিঝিলের সিমেন্টের শাপলা, দোয়েল চত্বর, সার্ক ফোয়ারা, সংসদ ভবন, মানুষের হৈ চৈ
সব পেরিয়ে ছাতার হাতল দুই হাতে ধরে উড়তে উড়তে একদিন বৃষ্টিতে সন্ধ্যায়
মোহাম্মদপুরে।
লিফটের দরজা খুলে গেলে তার আর উড়া
হয় না,
শিকভাঙা রঙচটা ছাতাটা মেলে বৃষ্টির ধাক্কা সামলে সে রাস্তার
অন্যপারে বাস-ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। গাদাগাদি করা ভীড়, ছাউনির নিচে। এর মধ্যে এক কোণায় একটুখানি জায়গা করে দাঁড়াতে
পারলেও বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচতে পারলো না সে। সালওয়ারের নিচের দিকটা কাদা-পানিতে
ল্যাটাপ্যাটা, ওড়নাটাও ভিজে জবজবে হয়ে গেছে.
এরকম ভিজতে ভিজতেই সে খেয়াল করলো রাস্তায় পাবলিক বাসের তেমন একটা দেখা নেই, মোহাম্মদপুর রুটের বাস তো আরো কম। একটা দুটো বাস এসে থামতেই
মানুষজন পড়িমরি ছুটছে সেদিকে, কেউ উঠতে পারছে, কেউ না।
রাস্তা দিয়ে হেডলাইটের তীব্র আলো
জ্বেলে হুশহাশ ছুটে যাচ্ছে প্রাইভেট কারগুলো। এদের মধ্যে একটা গাড়ি কি হঠাৎ এসে
ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে থামতে পারে না তার সামনে। আর সে তখন ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে
যেতে পারে। ভাবতে পারে, ‘একি!’
তখন সিনেমা নাটকে যেমন হয় তেমন
ভাবে গাড়ির জানালার কালো কাঁচ নামতে থাকে আর আরোহীর অবয়ব পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু
গাড়িতে বসে থাকা সুদর্শন যুবকটিকে কিছুতেই চিনতে পারে না সে। সন্ধ্যায় রাস্তায়
জ্বলে ওঠা লাইটপোষ্টের মলিন আলোতে সে দেখে যুবকটির মুখে অমলিন আন্তরিক হাসি, ‘চিনতে পারছো না?’
সে বিস্মিত, বিমূঢ়।
‘অবশ্য অনেকদিন দেখা নেই, না চেনারই কথা, এসো এসো, গাড়িতে উঠে এসো। তোমাকে পৌছে দিতে
দিতে কথা বলি।’
যুবকটি নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে
দেয়। ইশারা করে গাড়িতে ওঠার জন্য। নিজের ভেজা জামা-কাপড়ের দিকে তাকিয়ে একটু
ইতস্ততঃ করে সে। গাড়ির শুকনো সিটটা ভিজে যাবে যে ! তাছাড়া এত পরিচিত ভঙ্গীতে কথা
বলার পরও এই যুবককে তো ঠিক মতো চিনতেই পারছে না সে। অপরিচিত একজনের আহ্বানে তার
গাড়িতে ওঠা কি ঠিক হবে?
এমন সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই একটা
খালি বাসের গা চাপড়ে মোহাম্মদপুর-আসাদগেট-কলেজগেট বলে চেঁচাতে শুরু করে এক ছোকড়া
কন্ডাকটর। হবে কোন অফিসের ষ্টাফ বাস, যাত্রী নামানো শেষে খেপ্্ মারছে।
প্রায় দৌড়ে গিয়ে বাসটাতে উঠে সে।
আর কী ভাগ্য ! বাসের পেছনের দিকে জানালার পাশে একটা সিটও পেয়ে যায় সে। একটু পরেই
একজন বয়স্ক মহিলা এসে তার পাশে বসে। আচ্ছা, উনি না হয়ে অল্পবয়সী, লম্বা চুলের, উদাসী প্রকৃতির একটা ছেলেও তো পাশের সিট-টাতে বসতে পারতো।
তখন সে হয়তো জানালার দিকে একটু চেপে আসতো আর নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিতো বাসের জানালা
দিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার জন্য। বাসটা ছেড়ে দিতো আর তার হাতটা ভিজতে থাকতো। পাশে বসা
ছেলেটা তখন এক পলক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতো তার দিকে, তারপর উদাস ভঙ্গীতে ডুবে যেতো নিজের ভেতর। আর তার নিজের ভেতর বরফ গলতে থাকতো, মনে হতো, কেন সে কিছু কয়
না?
জলের মতো ঘুরে ঘুরে, বর্ষার মতো নরম কোমল সুরে, কিছু কথা কইতে
তার বাধা কোথায়? তবে কি আমাকে তার ভাল লাগেনি? আমার জন্য তার মনটা টলেনি? উদাসী যুবক, তাকাও, তাকাও একবার, কিছু ভাল লাগার মতো কথা তো অন্তত বলো !
কিন্তু উদাস যুবক কোন কথা বলার
আগেই ঝাঁকুনী দিয়ে বাসটা থেমে গেলে আর লোকজন হুড়মুড় করে নামতে শুরু করলে তাকেও অন্যদের সাথে
কলেজগেটে নেমে যেতে হয়। বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে। কলেজগেট থেকে নেমে আরো পনেরো
বিশ মিনিট হাঁটলে পরে ওদের আজিজ মহল্লা, জয়েন্ট কোয়ার্টার রোড। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে রিকশা খোঁজে, নেই। ফলে তাকে হাঁটতে হয়। বৃষ্টি চলে গেলেও রেখে যায় তার
ঠান্ডা পরশ, ভেজা হাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়
তার,
সেই উদাস যুবক বুঝি হাঁটছে তার পাশে পাশে, শুধু হাঁটছেই না সে একটি বাঁশিও বাজাচ্ছে, সেই বাঁশির সুর শুনতে শুনতে, ফুটপাথে জমে থাকা পানি আর পিচ্ছিল কাদায় আরেকটু হলেই আছাড় খেয়ে পড়তে পড়তে
কোনরকমে নিজেকে সামলে নেয় সে।
‘আচ্ছা, সঙ্গে যখন আসতে চাইছো আসো, কিন্তু বাঁশি বাজানোর দরকারটা কি? আমি আরেকটু হলেই .. উফ্্ ..’
‘বারে, আমি ছিলাম না! আমি বুঝি তোমাকে পড়তে দিতাম? খপ্্ করে ধরে ফেলতাম না!’
বাঁশি বাজানো বন্ধ করে এবার যুবক
তার হাত ধরে। সামান্য এই স্পর্শেই যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় তার শরীরে।
‘এই না থাক্্, হাতটা ছাড়ো, আশেপাশের লোকজন ভালো না, কে- কি বলে
ফেলে..’
যুবক তার হাত ছেড়ে দেয়, তারপর আবার বাঁশি বাজানো শুরু করে। কি যে করুণ মধুর সেই
বাঁশির সম্মোহনী সুর।
সেই সুরের ভেতরেই যেন উড়ে উড়ে সে
এসে দাঁড়ায় ৪৭৮/৯ আজিজ মহল্লা, জয়েন্ট
কোয়ার্টার রোডের বাড়িটার সামনে। বেল টেপার অনেকক্ষণ পর ভাবি এসে হাড়িমুখে নিঃশব্দে
দরজা খুলে দিয়ে সরে যায়। ভাবির মুখ সবসময় এমন ভারী হয়েই থাকে, বোধহয় আইবুড়ো ননদিনীর মুখ দেখতে দেখতে উনি বিরক্ত।
সে দরজা লাগিয়ে ঘরে ঢোকে। দুই
রুমের ঘর। একটাতে ভাই-ভাবি তাদের ছয় বছর বয়সী ছোট ছেলেটাকে নিয়ে থাকেন, অন্য ঘরে এক বিছানায় থাকেসে, তার কলেজ পড়–য়া ছোটবোন আর
কিশোরী ভাতিজি। অন্য বিছানায় থাকেন অসুস্থ মা।
ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে, হাত-মুখে পানি দিয়ে সে বিছানায় হাত-পা টান টান করে চিৎ হয়ে
শোয়। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আহ্্ আরাম। এখন এক কাপ গরম চা যদি পাওয়া যেতো। চোখ
বন্ধ করে ভাবে সে। ভাবিকে বলতে গেলে মুখ ঝামটা খেতে হবে নির্ঘাৎ। হয়তো শুনতে হবে
ঘরে চা-পাতি-ই নেই, নয়তো থাকবে
চিনির সংকট। থাক্্ বাবা দরকার নেই। অবশ্য খানিক পরেই চোখ বন্ধ অবস্থাতে পুরুষ
কন্ঠের ডাকাডাকি শুনতে পায় সে।
‘ওঠো তো, আদা তেজপাতা দিয়ে গরম চা বানাইছি, একটু খাও। আরাম পাইবা। এমনিতেই বৃষ্টিতে ভিজ্যা আসছো, সর্দি লাগবো..’
সে বুঝতে পারে লোকটা তার স্বামী।
বড্ড ভাল মানুষ, সাদাসিধে বউ ন্যাওটা টাইপের লোক।
একটু বেশি বেশি আদর যত্নকরে বলেই হয়তো স্বামীকে খুব একটা পাত্তা দেয় না সে।
স্বামীটি পোষা কুকুরের মতো পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে আর লেজ নাড়ে। ভালই লাগে তার।
‘একটু শুইছি আরাম কইরা, আর উনি ডাকাডাকি শুরু করছেন, যাও তো এখন আমি চা খামু না, যাও সরো। ’
স্বামীকে ধমক দিয়ে পাশ ফিরে শোয়
সে। কিন্তু স্বামী বেচারা নাছোড়বান্দা। সে এবার হাত বাড়িয়ে তাকে ঝাঁকুনি দিতে শুরু
করে। উফ্্ আর পারা গেল না, স্বামীকে জোরে
আরেকটা ধমক দেয়ার জন্য চোখ খুলে সে। দেখে ছোট বোন মুখের উপর ঝুঁকে আছে। এতক্ষণ সেই
ঝাঁকাচ্ছিল তাকে।
‘আপু, ঘুমায়া গেলা নাকি? চলো,
ভাত খাওয়ার জন্য ভাবি ডাকতাছে।’
এবার চোখ কচলে এক লাফে উঠে বসে
সে। যাহ্্, এতক্ষণ সে তাহলে ঘুমাচ্ছিলো !
অসময়ের ঘুম! মানে ক্লান্তি আর অবসন্নতার ঘুম।
ছোটবোনের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত
ভঙ্গীতে হাসে সে। তারপর দুই হাতে মাথার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোপা বেঁধে
নেয়। গল্প করার ভঙ্গীতে বলে,
‘আজকে অফিস থেকে ফেরার সময় কি হল
জানিস্্,
আমার বস তার গাড়িতে লিফট অফার করলো .. বৃষ্টিতে আমি কিভাবে
ফিরবো,
তা নিয়ে উনার দুশ্চিন্তার শেষ নাই ..’
‘ওমা তাই নাকি ! তারপর তুই কি বললি?’
ছোট বোনের কৌতুহলী প্রশ্নে মুচকি
হাসে সে।
‘আমি খুব কায়দা করে রিফিউজ করলাম।
বিনয়ে গলে গিয়ে বললাম, থ্যাঙ্কিউ স্যার, আমি একটা সিএনজি নিয়ে চলে যেতে পারবো, একটুও অসুবিধা হবে না। আপনি একদম চিন্তা করবেন না স্যার।’
রাতে খেতে বসে ভাতিজা জিজ্ঞেস করে,
‘ফুপু বিষ্টির মধ্যে বাসায় আসতে
তোমার অনেক কষ্ট হইছে, না?’
‘নারে বুবুন, খুব অদ্ভুত একটা কান্ড হইছে, বললে বিশ্বাস করবি না, কিন্তু সত্যি’ ভাতিজার নিস্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে সে।
‘হইছে কি আমাদের অফিসের যে গার্ড
আছে না,
সে আমাকে বলে কি, আপা,
আমার এই প্যারাসুটটা নিয়া যান, এইটা দিয়া উড়তে উড়তে বাসায় চলে যাবেন।’
‘ধেৎ ফুপু ! তুমি এত্তো বানায়া
বানায়া কথা বলতে পারো!’
বুবুন কপট রাগ দেখায়।
‘নারে সত্যি, জিনিসটা দেখতে ছাতার মতোই, কিন্তু যেই তুই খুলবি, অমনি সেটা তোকে
নিয়ে উড়তে শুরু করবে। শুধু হাতলটা শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। হাত ফসকালে রক্ষা নাই।’
‘ইহ্্, বানায়া বলতাছো।’
বুবুন অবিশ্বাসে ঠোঁট উল্টায়।
ততক্ষণে ভাত খাওয়া শেষ। সে তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বলে, ‘বিশ্বাস না করলে আর কি? আমি তো প্যারাসুট দিয়াই আসলাম। যা দারুণ লাগলো না!’
বুবুনের চোখে একসাথে
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল দেখতে দেখতে মুখ টিপে হাসে সে।
ভাবি এসে ডাক দেয় তখন, একটু আড়ালে নিয়ে, যেন গোপন কোন ষঢ়যন্ত্র করছে এমন ভঙ্গীতে ফিসফিস করে বলে, ‘পাশের বাসার খালাম্মা তোমার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব
আনছিলো। ছেলে তাদের আত্মীয়, ঢাকায় বাড়ি আছে।
সব-ই ভাল। শুধু .. এটা না ধরলেও চলে .. তবু জানা ভাল ..’
ভাবি কয়েকবার ঢোক্্ গেলে- ‘মানে ছেলের আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। বউটার আরেক জায়গায় এফেয়ার
ছিল তাই কয়েক মাসের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে গেছে, এখন তুমি রাজি থাকলে ওরা দেখতে আসবে।’
‘দেখতে আসায় তো দোষ নাই ভাবি। আসুক
না।’ সে ক্যাজুয়েল
ভাবেই বলে। এত সহজ সম্মতি পেয়েই হয়তো ভাবির শক্ত চোখ-মুখ আস্তে আস্তে নরম হয়ে আসে।
আর খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই সে হাল্কা কন্ঠে, যেন বলার জন্যই বলা এমন ভাবে বলে ,
‘আজকে অফিস থেকে ফেরার সময়, জানো ভাবি, হঠাৎ ঘ্যাচ করে
একটা গাড়ি পাশে এসে থামলো, দেখি আমাদের এক
ক্লাসমেট,
বিরাট ব্যবসায়ি, আমাকে প্রায় অনুনয়-বিনুনয় করে ওর গাড়িতে তুললো..’
ভাবির চোখ গোল গোল হয়ে যায়।
‘বলো কি? সত্যি?’
‘হ্যাঁ, ভাবি, আমাকে একদম
বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো ! কলেজে পড়ার সময় তো ছিল মহা ভ্যান্দা টাইপের একটা
ছেলে ... এখন তো চেনাই যায় না, বিরাট স্মার্ট
..’
ভাবির চেহারা দেখে বোঝা যায়, বিবরণ শুনে উনি মোটামুটি কাৎ , সম্ভাব্য ননদ জামাইয়ের আসনে গাড়িওয়ালাকে প্রায় প্রায় বসিয়ে
দিতে দিতে তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করেন,
‘এই, ওই ছেলে আবার বিবাহিত নয় তো?’
‘কি জানি ওই কথা তো জিজ্ঞেস করতেই ভুলে
গেছি ..’
ঠোঁট উল্টে বলে সে।
লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী
লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী
শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়। জবরদস্তি নয়, সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্ন, কাব্যসংলগ্ন ও স্বতস্ফূর্ত। মুন্নীর কবিতাও তার ব্যক্তি স্বভাবের মতোই অউচ্চকিত। মৃদুভঙ্গীতে তিনি মোক্ষম বোধটি ব্যক্ত করে ফেলেন। যার অনুরণন থেকে যায় ঢেউ মিলিয়ে যাবার পরও।
(লিখেছেন: সরকার আমিন)
0 মন্তব্যসমূহ