শাহনাজ মুন্নী
হারকিউলিস ছিলেন গ্রীস দেশের
সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। যেমন সাহসী তেমনি শক্তিশালী কিন্তু মোটেও নিষ্ঠুর নন বরং ভীষণ
দয়ালু। দেবতার ঔরসে আর মানুষের গর্ভে তার জন্ম। হারকিউলিসের বাবা আবার যে সে দেবতা
নন,
তিনি দেবতাদের রাজা প্রবল পরাক্রমশালী জিউস, আর হারকিউলিসের মা মানুষের মেয়ে আক্লামিনা।
সেই হারকিউলিসের সঙ্গে আমাদের
একদিন দেখা হলো, তবে বাস্তবে নয়, টেলিভিশনের পর্দায়।
১৯৯৮, ৯৯ সালের দিকে বাংলাদেশ
টেলিভিশনের পর্দায় এই হারকিউলিসকে আপনারাও কেউ কেউ দেখেছেন হয়তো। একজন দীর্ঘদেহী সুঠাম, পেশীবহুল, গৌরবর্ণ
আমেরিকান অভিনেতা হারকিউলিসের ভ’মিকায়
চমৎকার অভিনয় করতেন। তিনি দুষ্ট লোকদের শাস্তি দিতেন, শিষ্ট লোকদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন। তার
ব্যাপক-বিপুল-বিশাল শৌর্য-বীর্য দর্শকদের চোখ এবং মনের আনন্দ যোগাত। ঢাকার
মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির পাঁচতলার একটি বাসায় ২০ ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশনেও
সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে হারকিউলিস তার নতুন নতুন অভিযানের
অবিশ্বাস্য গল্প কাহিনী নিয়ে উপস্থিত হতেন। কখনো হিংস্র সিংহের সাথে লড়াই, কখনো আবার সাত মাথাঅলা ভয়ংকর দৈত্যকে পরাজিত করার রোমাঞ্চকর
যুদ্ধ। ওই বাসার ড্রইংরুমে আরো আট নয় জন দর্শকের সঙ্গে বসে মাহফুজাও প্রচন্ড
উত্তেজনা নিয়ে হারকিউলিস সিরিজের প্রতিটি পর্ব অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে দেখতো। সিরিজের
ইংরেজি সংলাপ অবশ্য মাহফুজা বুঝতো না। বোঝার প্রয়োজনও ছিল না তার। কারণ ভাষা না বুঝলেও গল্পটা ধরতে তার কোন অসুবিধাই হতো
না। সব কিছুই বুঝতো সে, মানে আন্দাজ করে
বুঝে যেতো, হারকিউলিসের হাত-পা নাড়ানো দেখে, তার চোখ-মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে, ধারাবাহিক ক্রিয়াকর্ম দেখে মাহফুজা ঠিকই বুঝে নিতো কি ঘটছে, এমনকি হারকিউলিস কি
বলছে তা ধরতেও বিন্দু মাত্র অসুবিধা হতো না মাহফুজার। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী ঘরে অনুপস্থিত থাকলে
ড্রইংরুমে তার সহ-দর্শকদেরও বিজ্ঞাপন বিরতির সময় সিরিজের কাহিনী নিজের ভাষায়
প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিতো মাহফুজা। মাহফুজা আসলে এই বাড়ির গৃহকর্ম-সহকারী।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম লতাডুঙ্গি গ্রাম থেকে এই বাড়িতে কাজ করতে এসেছে
সে। এই বাসায় প্রায় তিন বছর হয়ে গেল তার, চৌদ্দ বছর বয়সে এসেছিল এখন বয়স তার সতেরো। এই বয়সের মেয়েদের চেহারায় লাবণ্যে
ঢলো ঢলো সজীব সতেজ একটা ভাব ফুটে উঠে। চোখে, মনে নানারকম রঙের উদয় হয় .. মাহফুজারও হয়েছে, হচ্ছে, তা হোক না তার গায়ের রঙ খানিকটা
শ্যামলা,
হোক না নাকটা একটু বোঁচা, তবু তার দিকে তাকিয়ে আশে-পাশের ছেলে ছোকড়াদের চোখের দৃষ্টি যে এখন বেশ পাল্টে
যাচ্ছে তা বুঝতে খুব বেশি রূপসী হতে হয়নি মাহফুজাকে। কিন্তু কেন যেন কাউকেই চোখে
লাগে না তার, মনে ধরে না। মনে হয় সবাই যেন কেমন
হ্যাংলা,
পাতলা, হিলহিলে, হাড়গিলে, চ্যাংড়া, পেংড়া, লিকলিকে, ফ্যাকফ্যাকে। তার স্বপ্নের পুরুষের মতো নয়। নিজের মনের গোপন কথাটা আর গোপন রাখতে না পেরে
একদিন মাহফুজা মনের কথাটা বলেই ফেলে, ও যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়ির সবচে প্রবীণ সদস্যাটির কাছে। প্রবীণ সদস্যা যাকে
মাহফুজা খালাম্মা বলে ডাকে, সেই খালাম্মার
মাথায় তেল ঘষে দিতে দিতে মাহফুজা বলে,
‘আর কয়দিন আফনের মাথাত তেল দিতে
পারুম,
জানি না গো খালাম্মা।’
খালাম্মার চোখ আরামে প্রায় বুজে
এসেছিল,
তিনি কথাটার গূঢ় অর্থ বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘কেনরে, কই যাবি?’
‘ওম্মা .. খালাম্মা ...আমার বিয়া-শাদি
হইতো না?
সারা জীবন বান্দিগিরি করুম নি ? কত্তো বিয়ার ঘর আইতাছে ...’
‘ও, হুম,
ঠিকই বলছিস, বিয়া হইলে তো স্বামীর ঘরেই থাকবি’
খালাম্মা সায় দেন। মাহফুজা
খানিকক্ষণ চুপচাপ চুলে বিলি কাটে। তারপর নিজের মনেই বলে, ‘বিয়ার ঘর আইলে কি হইবো, আমার যে খালাম্মা একটা জামাইও পছন্দ হয় না।’
খালাম্মা এখন চোখ বন্ধ করে আরামটা
রীতিমতো উপভোগ করছেন। মাহফুজা অপর পক্ষের কোন সাড়া না পেয়ে নিজেই আবার বলে,
‘ও খালাম্মা, আমার কি হইবো?’
‘উ.. কেন? কি আবার হবে?’
‘এই যে জামাই পছন্দ হয় না..’
‘হয় না, হবে, আল্লাহপাক যার
সাথে জোড়া লিখছে, তার সাথেই বিয়া
হবে।’
‘আমার পছন্দ যে অন্য রকম খালাম্মা
..’
খালাম্মা এইবার চোখ খুলে সোজা হয়ে
বসেন।
‘কি রকম পছন্দ আবার তোর?’
‘আমার না খালাম্মা ..’
মাহফুজা থেমে যায়।
‘কি?’
‘আমার পছন্দ হারকিউলিস’রে ..’
খালাম্মা প্রথমে বুঝতে পারেন না।
তিনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
‘কারে? হারকিরি ? কি কছ?’
‘হারকিরি না, হারকিউলিসের কথা
কইছি গো খালাম্মা..’
মাহফুজা লাজুক কন্ঠে বলে। এবার
বুঝতে পেরে হাসিতে ভেঙে পড়েন খালাম্মা।
‘হারকিউলিসের কাছে বিয়া বসবি? .. হি হি হি ... তোর বাপরে ক’ আমেরিকায় প্রস্তাব পাঠাইতে.. হা হা হা ’
‘হাসেন কেরে খালাম্মা? গরীব দেইখ্যা আমরার পছন্দ নাই ..’
খালাম্মা হাসি থামিয়ে মাথা নাড়েন।
‘না, না,
পছন্দ তো হইতেই পারে .. বেডার মতো বেডা পছন্দ করছোছ .. এখন
হেরে খবর দেই কেমনে, যে আমরার কইন্যা
রেডি ..’
‘খালাম্মা ঠাট্টা কইরেন না.. আমার
শরম লাগতাছে ..’
খালাম্মা অতঃপর নিজেকে সম্বরণ
করেন,
কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ির ছোট থেকে বড় সকলেই মাহফুজাকে ‘হারকিউলিসের বউ’ বলে ডাকতে শুরু করে। মাহফুজাও এতে খুব একটা প্রতিবাদ করে না, বরং উপাধিটা যেন সে
লাজুক ভঙ্গীতে মাথা পেতে মেনেই নেয়।
ব্যাপারটা এক কান দু কান করে যখন
বাড়ির চাকুরীজীবী গৃহকর্ত্রীর কানে পৌছায় তখন তিনি কৌতুক বোধ করার পাশাপাশি
খানিকটা বেদনা বোধেও আক্রান্ত হলেন, এই ভেবে যে কল্পনার রঙীন জগতে বস-বাস করা এই মেয়েটার জন্য কঠোর বাস্তবতা না
জানি কতখানি নির্মম পরিহাস নিয়ে অপেক্ষা করে আছে, তিনি নিজ দায়িত্বে মাহফুজাকে কাউন্সিলিং করার চেষ্টা করলেন। এরই অংশ হিসেবে
একদিন ওকে ডেকে হাল্কা গলায় বললেন,
‘টেলিভিশনে যা দেখা যায় সব কিন্তু
সত্যি না রে মাহফুজা ..’
‘জি আপা’
মাহফুজা বলে। গৃহকর্ত্রী আবার
বলেন,
‘এই যে হারকিউলিস দেখিস, এটারও সব কিছু সত্যি না, অনেক কিছুই ক্যামেরার কারসাজি। তাই টিভিতে যা দেখায় তার সব কিছু বিশ্বাস করার
দরকার নাই।’
‘জি আপা।’
‘শোন হারকিউলিসের মতো ছেলেকেই বিয়ে
করতে হবে,
এমন গোঁ ধরে বসে থাকলে চলবে? বাংলাদেশে এমন ছেলে পাবি তুই?’
‘আপা যে কি কন, আমি তো ফাইজলামি করছি .. খালাম্মাই এমনে এমনে এইডারে লইয়া
রং তামাশা করতাছে ..’
‘তাই যদি হয়, তাহলে তো ভালই’
গৃহকর্ত্রী মহান দায়িত্ব পালন
করেছেন,
এমন স্বস্তি নিয়ে ঘুমাতে যান।
মাহফুজার বিয়ে ঠিক হয় এই ঘটনার
প্রায় মাস ছয়েক পর। বিয়ে উপলক্ষে মাহফুজার
বাবা তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে এলে গৃহকর্ত্রী মাহফুজার বাবার হাতে বাড়তি
কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
‘দেখতে -শুনতে ভাল, শক্তি সামর্থ্য আছে এমন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েন। আর
ছেলের স্বভাব চরিত্র ভাল কি-না, ঠান্ডা মেজাজ
কিনা এই্সবও খোঁজ নিয়েন।’
মাহফুজার স্বল্পভাষী বাবা মাথা
নেড়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যান।
মাহফুজার স্বামী শাহাজালালের বাড়ি
লতাডুঙ্গির পাশের গ্রাম হিজলতলী। হিজলতলীকে বলা হয় ডাকাতের গ্রাম। কথিত আছে, এই অঞ্চলের পুরুষরা বহুকাল আগে ডাকাতি করে জীবন ধারণ করতো।
শাহাজালাল অবশ্য ডাকাতি করে না, সে উপজেলা সদরে
রিকশা চালায়। আরো আট/দশজন রিকশাচালকের মতই তার দেহের গড়ন। মাঝারী উচ্চতা, রুগ্ন শীর্ণ স্বাস্থ্য, ভাঙা গাল, কোটরাগত চোখ, গায়ের রং কালো। প্রথম দেখাতেই স্বামীকে অপছন্দ করলো মাহফুজা, কিন্তু কি আর করা? ঢাকার আপা তো বলেই দিয়েছিলেন, টেলিভিশন আর
জীবন আলাদা। মাহফুজা প্রচুর কান্নাকাটি করে, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে, হতাশার
দীর্ঘশ্বাস মনের গভীরে চেপে রেখে হিজলতলী যায় সংসার করতে। বিয়ের অল্প দিনের মধ্যেই
মাহফুজা বুঝতে পারে শাহাজালাল বড়ই রগচটা আর বদরাগি মানুষ। তবে তার যত বীরত্ব সবই
বউয়ের সঙ্গে। পান থেকে চুনটি খসার উপায় নেই, বাবুর মাথায় রাগ উঠে যাবে, যাকে বলে
একেবারে চন্ডাল রাগ। তখন হাতের কাছে যাই পাবে, হোক সেটা লাকড়ি কিংবা লোহার রড, কাঠের খড়ম বা চিকন বাঁশ, হুশ থাকবে না
তার,
বেধড়ক বউ পিটাবে। তিন বেলা ঠিকমতো ভাত দেওয়ার মুরাদ নাই, কিল মারার গোঁসাই, বোধহয় এমন পুরুষদেরই বলে। এরকম মার কিল খেতে খেতেই পর পর তিনটা মেয়ের জন্ম
দিয়ে ফেলে মাহফুজা। বছর বছর মেয়ের মুখ দেখে শাহাজালাল আরো ক্ষিপ্ত। অভাবের সংসারে
মেয়েরা তার কাছে বোঝা ছাড়া কিছুই না। আর এই মেয়েদের জন্ম দিয়েছে তো মাহফুজাই .. ।
শাহাজালাল কথায় কথায় খোটা দেয়। অন্য মাইয়া বিয়া করলে তার ঘরে নিশ্চয়ই পোলা
জন্মাতো। ইচ্ছা করলে সে এখনো আরেকটা বিয়ে করতে পারে। মাহফুজার পেটে যদি ছেলে না জন্মায়, তাহলে সে আবার বিয়ে করবে, এমন কথাও বলে। তবে মাহফুজারও এখন মুখ ফুটেছে। স্বামীর গায়ে সে হাত তুলতে পারে
না বটে তবে মুখ আর জিহ্বা ব্যবহার করে নিজের মনের ঝাল পুরোটাই মিটিয়ে নেয় সে।
শাহাজালাল কার ঘরের জন্ম সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তার মা-বাবা চৌদ্দ গুষ্টিকে কুৎসিত
ভাবে গালাগালি করে, যতক্ষণ না গায়ে
ব্যাথার দাগ দূর না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত অবিরাম তার মুখ চলতেই থাকে .. শাহাজালালের
হাত ব্যাথা হয়ে যায়, কিন্তু মাহফুজার
মুখের গালাগাল বন্ধ হয় না।
এভাবেই তো মার খেয়ে, গালি দিয়ে আর বাচ্চা জন্ম দিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের কত মাহফুজার
সারা জীবন কেটে যায়, কিন্তু আমাদের
মাহফুজার জীবনে যে হারকিউলিসের প্রভাব রয়ে গেছে। সেই জন্যই বোধহয় একদিন তার
স্বামীর চাচাতো ভাই সেলিম ছয় বছর পর একটা কম্বল, একটা টেলিভিশন আর দুই ভরি সোনার গয়না নিয়ে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসে।
সেলিমের বয়স আটাশ। অবিবাহিত। লম্বা, শ্যামলা, একহারা গড়ন। সেলিম ফূর্তিবাজ, ষ্টাইলিশ এবং কৌতুক পরায়ণ। মাহফুজার সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার আগে
তার দেখা হয়নি। এবার যখন হলো তখন অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন ভাবির সঙ্গে তার কথা
বার্তা খুব জমে গেলো। ফলে একদিকে সেলিমের মা-বোনেরা যখন সেলিমকে বিয়ে করানোর জন্য
হন্যে হয়ে পাত্রী খুঁজছে, তখন সেলিমের
দেখা পাওয়া যায় শাহাজালালের ভাঙা ঘরের মাটির দাওয়ায়। মাহফুজার সাথে তার ব্যাপক
আড্ডা। মাহফুজা ঢাকা শহরে পাঁচ বছর থেকেছে, শহুরে মানুষের কায়দা-কানুন আর
রস-রহস্য সে ভালই জানে, তার সেই
কায়দা-কানুন বা রঙ্গ রস বোঝার ক্ষমতা শাহাজালালের নেই কিন্তু সেলিম এসবের কদর বোঝে, নতুন ভাবির পাশ ঘেষে বসে এটা সেটা গল্প করতে করতে ঘন্টার পর
ঘন্টা কিভাবে কেটে যায় টের পায় না সে। আর মাহফুজার কেন যেন মনে হতে থাকে ঢাকার
টেলিভিশনে দেখা হারকিউলিসের চেহারার সঙ্গে সেলিমের কোথায় যেন মিল আছে। হাসিটা? নাকি চোখের দিকটা? নাকি সবই তার মনের ভুল? কুহক? মায়া? মাহফুজা ঠিক
বুঝতে পারে না। সেলিমের সাথে হাসি ঠাট্টা করতে গিয়ে তার মাঝে মাঝে মনে হয়, শাহাজালালের হাতে এত মার খাওয়ার পরও যে সে বেঁচে আছে, তা বোধহয় একদিন সেলিমের সঙ্গে দেখা হবে বলেই।
অবশ্য গ্রাম দেশে সেলিম-মাহফুজার সম্পর্কের বিষয়টা
নিয়ে গুঞ্জন উঠতে বেশি দিন লাগে না। আবিয়াতো সেলিমের সাথে তিন বাচ্চার মা
শাজালালের বৌ-এর এত খাতির কিসের? দুইজনের মধ্যে
এত কিসের গুজুরগুজুর, ফুসুরফাসুর ? এত কিসের হাসাহাসি? এত ঢলাঢলি, এত মাখামাখিই বা কিসের? দেওর ভাবির সম্পর্কের আড়ালে ফষ্টি-নষ্টি? ইটিশ পিটিশ?
শাহাজালালের কানে কথাটা গেলে সেও
গ্রামের লোকদের সাথে একমত হয় যে তার বৌ মাহফুজার চরিত্র অত্যন্ত খারাপ। এতদিন ধরে
এই দুশ্চরিত্রা নারীর সাথে সংসার করছে সে, সংসার নাতো হাবিয়া দোজখ। মাহফুজার পেটে জন্ম নেয়া তিনটা মেয়েও হয়তো অন্য কারো, এমন সন্দেহের কথাও গ্রামবাসীকে জানায় শাহ্ জালাল। তা
স্বামীই যদি স্ত্রী সম্পর্কে এইসব বলে বেড়ায় তখন আর গ্রামবাসীদের বলার বাকি থাকে
কি?
সর্বশেষ আগুনে ঘি পড়ে তখন, যখন গ্রামের লোকেরা রাতের আঁধারে সেলিম আর মাহফুজাকে একসাথে
হাতে-নাতে ধরে ফেলে।
মাহফুজা অবশ্য বলে, সে রাতের বেলা বদনা নিয়ে ঘরের পেছনে পেশাব করতে বেরিয়েছিল।
ফেরার সময় হঠাৎ দেখে সেলিম উঠানের কোণায় দাঁড়ানো। সেলিম তখন গলা খাকারি দিয়ে বলে, ভাবি নাকি? মাহফুজা বলে যে, হ্যাঁ। তারপর মাহফুজা তাকে জিজ্ঞেস করে, রাত বিরাতে বাইরে কেন?
আর সেলিমের বক্তব্য, ওই রাতে ঘরের ভেতর খুব গরম লাগায় সে বাইরে বেরিয়েছিল
একটুখানি হাওয়া খেতে। তখন দেখে যে ভাবি বদনা হাতে বাড়ির পিছন দিক থেকে আসতেছে, তখন সে একটু গলাখাকারি দেয় আর ভাবির কুশল জিজ্ঞেস করে, তারপরে দুইজনে কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টা করে।
সেলিম বলে, খালি ঘরে তার ঘুম আসছিলো না। গরম লাগছিলো। তাই রাতবিরাতে বাইরে আসছে। মাহফুজা বলে, বিয়া করেন, ঘর খালি রাখছেন কেন? খালি ঘরে মন তো উথাল-পাথাল করবেই .. সেলিম উত্তরে হয়তো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো আর এই সময় মাহফুজার পায়ের উপর দিয়ে আচমকা একটা মেঠো ইঁদুর দৌড় দিলে মাহফুজা খুব ভয় পায় আর সেলিম তাঁকে আশ্বস্ত করে এই বলে, যে ভয়ের কিছু নেই ওটা সামান্য একটা ইঁদুর বৈ তো কিছু নয় ..
সেলিম বলে, খালি ঘরে তার ঘুম আসছিলো না। গরম লাগছিলো। তাই রাতবিরাতে বাইরে আসছে। মাহফুজা বলে, বিয়া করেন, ঘর খালি রাখছেন কেন? খালি ঘরে মন তো উথাল-পাথাল করবেই .. সেলিম উত্তরে হয়তো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো আর এই সময় মাহফুজার পায়ের উপর দিয়ে আচমকা একটা মেঠো ইঁদুর দৌড় দিলে মাহফুজা খুব ভয় পায় আর সেলিম তাঁকে আশ্বস্ত করে এই বলে, যে ভয়ের কিছু নেই ওটা সামান্য একটা ইঁদুর বৈ তো কিছু নয় ..
শাহজালাল গাঁ গাঁ করে ভয়াবহ
চিৎকার দিয়ে গ্রামবাসীকে জানায়, এমন অসতী বউ সে
আর কিছুতেই ঘরে রাখবে না। মাহফুজাকে সে এই মুহুর্তে তালাক দিবে।
এরকম অরাজক অবস্থায় যা হয়, গ্রামের মুরুব্বীরা তো আর বসে থাকতে পারেন না। সমাজের
শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য তারা নিজ দায়িত্বে সালিশ বসান।
মাহফুজা আর সেলিম নিজেদের বক্তব্য
দেয়। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে, অন্ধকারে তারা
দুইজনকে খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখেছে, তবে চুম্বনরত ছিল কি-না তা অন্ধকারে দেখা যায় নাই, নাউজুবিল্লাহ, এমন দৃশ্য মুখে বর্ণনা করাও পাপ।
মাহফুজা মুখে কাপড় গুজে গুণগুণ
করে কাঁদে। সেলিম ফুঁসতে থাকে, রাগে বা দুঃখে।
শাহাজালাল একেকবার হাতে কিল বা চড়ের মুদ্রা তুলে হিংস্র ভঙ্গীতে ছুটে যেতে চায় মাহফুজার দিকে। গ্রামের তরুণরা
তাকে জাপটে ধরে থামায়। সমাজপতিরা রায় ঘোষণা করার আগে জিজ্ঞেস করেন, ‘সেলিম তুমি অসামাজিক কার্যকলাপ করছো, এখন শাহজালাল যদি মাহফুজারে তালাক দেয় তুমি কি মাহফুজারে
বিয়া করতে রাজি আছো?’
সালিশে উপস্থিত সেলিমের মা-বোনেরা
চিল-কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে,
‘এইডা কিতা কইলাইন ? ওই রাক্ষুসি ডাইনির সাথে আমরার মাসুম পোলার বিয়া? এইটা হইতোই পারে না .. আমরার পোলার কুনু দোষ নাই, যত নষ্টের গোড়া ওই মাগি ..ওই যাদুটোনা কইরা আমরার সেলিমের
মাথা খাইছে ’
সমাজপতিরা আবার সেলিমের মতামত
চাইলে সে নিশ্চুপ থাকে। সালিশের রায় কি হওয়া উচিত তা নিয়ে মজলিশ থেকে বিভিন্ন রকম
মতামত আসতে থাকে। মাহফুজাকে কোমর পর্যন্ত
মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মারার প্রস্তাব করে কেউ, মাথা ন্যাড়া করে, মুখে চুনকালি
মেখে তাকে গ্রামছাড়া করার প্রস্তাবও আসে। না, শরীয়ত মতে তাকে একশ র্দোরা মারা হোক, এমন কথাও বলেন অনেকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য থানা-পুলিশের ভয়ে এসব প্রস্তাবের
কোনটাই আর কার্যকর করা হয় না। তবে, সর্বসম্মতিক্রমে শাহাজালাল ভরা মজলিশে
বুক ফুলিয়ে মাহফুজাকে উচ্চ কন্ঠে তালাক দেয়। মৌলভি সাহেব সেলিম আর মাহফুজাকে
সর্বসমক্ষে তওবা পড়িয়ে সালিশ শেষ করেন।
মাহফুজার বাবা এসেছিল তার
কলঙ্কিনী মেয়েকে লতাডুঙ্গি গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবার সঙ্গে গিয়ে যে
লাভ নেই,
তা বুঝতে অবশ্য মাহফুজার দেরী হয়নি। বাবা তো নিজের পেটের
ভাত যোগাড় করতেই হিমশিম খান। মাহফুজা আর তার তিন মেয়ের দায়িত্ব তিনি নেবেন কিভাবে?
‘পারুম, পারুম, আল্লায়ঐ দেখবো।
আমি খাইলে তরাও খাইবি।’
বাপ ভাঙা কন্ঠে বলে। তার নিস্পাপ
মেয়েটাকে যারা ষঢ়যন্ত্র করে কলঙ্কিনী অপবাদ দিলো তাদের মাথায় যেন ঠাডা পড়ে, যেন আল্লার গজব নামে, ভাঙা গলায় সেই অভিশাপও দেন তিনি।
মাহফুজার ঠোটের কোণায় মৃদু হাসি
ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। সে ছোট মেয়েটাকে কোলে আর সঙ্গে বাকি দুই মেয়ে নিয়ে স্বামীর
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
মাহফুজার বৃদ্ধ বাপ মেয়ের সাথে
হেঁটে পারেন না। তিনি হাঁপাতে থাকেন,
‘ও মা, কই যাছ? .. লতাডুঙ্গির পথ তো এইটা না .. ও মা, একটু খাড়া..’
‘আব্বা, কইছি না, আপনে যান গা, আমার পথ আমি দেখমু, আপনে যান।’
বৃদ্ধ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে তার মেয়ের
সাথে হাঁটার পাল্লায় হেরে যান। মাহফুজা পিতাকে পেছনে ফেলে তার তিন সন্তানকে নিয়ে
গট্্ গট্্ করে সামনের দিকে হেঁটে যায়। কই যায় মাহফুজা? ওই দিকে তো ইস্টিশনের পথ। মাহফুজা ইষ্টিশনে কেনো যায়? কি উদ্দেশ্য তার? সে কি হতাশাগ্রস্থ, অপমানিত
গৃহবধুদের মতো তিন সন্তান নিয়ে ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দেবে? সন্তানসহ
আত্মাহুতি দিয়ে মনের জ্বালা মিটাবে? নাকি সে তিন বাচ্চাসহ ঢাকা যাওয়ার লোকাল ট্রেনে উঠে বসবে? মহা-বীর হারকিউলিসের কাছ থেকে সে কি জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে
পড়ার কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি ? *
লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী
লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী
শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়। জবরদস্তি নয়, সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্ন, কাব্যসংলগ্ন ও স্বতস্ফূর্ত। মুন্নীর কবিতাও তার ব্যক্তি স্বভাবের মতোই অউচ্চকিত। মৃদুভঙ্গীতে তিনি মোক্ষম বোধটি ব্যক্ত করে ফেলেন। যার অনুরণন থেকে যায় ঢেউ মিলিয়ে যাবার পরও।
(লিখেছেন: সরকার আমিন)
0 মন্তব্যসমূহ