আনোয়ার শাহাদাত
‘ধোফার বেডি কাফুর কাচে, দুই কুলে দুই বিলোই নাচে’, এই ছিল গানের কলি। ভাওয়াইয়ার সুরে উঁচু কণ্ঠে বদরু তালুকদারের ছেলে নাজিমুদ্দিন এ-গান গায় যখন সে তখন নেয়ামত হাটে যাওয়ার পথে। হাট সেদিন বসে মিলবার দিন ছিল না। দিনটি উ-হাটবার।
নেয়ামত হাটের উত্তর-পূর্ব কোণে হাটের ভেতর ঢুকতে বাড়িগুলোর উপর দিয়ে যে-পথ আছে তার পাশে ছোট পুকুর। রাস্তাটি পুকুরের পূব-পার ও উত্তর-পার হয়ে হাটের দিকে চলে গেছে। ছোট সে-পুকুরে ধোপা-বাড়ির মহিলাদের স্নান, হাঁড়ি-বাসন, কাপড়চোপড় যাবতীয় সব ধোয়ার কাজ চলে। এসব গ্রামে বাড়ি বা পরিবার ভিত্তিক নারী-দর্শন-বিষয়ক যে-পূর্বাপর রক্ষণশীলতার রেওয়াজ আছে ধোপা-বাড়ির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না। ব্যাটা-ছেলেরা চোখে কপাট খোলা লাট লাগিয়ে তাকিয়ে থাকবে। সে সব পথিকের চোখ ক্ষান্ত রাখার জন্য শুকনো কলাপাতা ও সুপারির ডগা দিয়ে পর্দা বানিয়ে আড়াল করা আছে। বর্ষা শেষে ফাল্গুনে কি চৈত্রে নতুন পর্দা জোড়া হয়। এ-বছর এখনও নতুন পর্দা লাগেনি। গেল বছরের বর্ষায় পচে যাওয়া ডগাগুলো শীতে শুকিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পর্দার অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। সেই বিপন্ন-অস্তিত্ব পর্দার সুপারির ডগা ও কলাপাতার ফাঁকা দিয়ে বদরু তালুকদারের বড় ব্যাটা নাজিমুদ্দিন পুকুরের পশ্চিম পারের ঘাট দেখতে পায়। আর ঘাটে তখন রমেশ ধোপার বউ শীলারানী করাতে কাটা রেইনট্রির গুঁড়ির উপর কাপর কাচে। শীলারানী গুঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে কখনো বাম হাতে কখনো ডান হাতে কাপড় উপরে আকাশের দিকে ছুড়ে মেরে আবার কোমর ভেঙ্গে নুয়ে পড়ে পায়ের কাছে কুঁচিয়ে পেটাচ্ছে। তখন বদরু তালুকদারের ছেলে নাজিমুদ্দিন ভাওয়াইয়া সুরে ওই গান গায়। তার গানের মাজেজা এমনকি অস্পষ্ট নয় বরং পাহাড়ি ঢলের পানির মতন পরিষ্কার, একদা-যৌবনবতী শীলারানী নুয়ে পড়ে কাপড় কাচে। কোমর ভেঙ্গে পুরো মানুষ যেখানে ওঠা-নামা করছে সেখানে তার রংচটা নীলাম্বরী কাপড়-আবৃত দেহের বুকের স্তনও বাকি থাকে না যা কিনা তার ক্ষেত্রে তখন যৌবন ও যৌনতার নিষ্ক্রিয় হয়ে সন্তানের খাদ্য পরিবেশনের জন্য অধিক গুরুত্ব বহন করে। শীলারানীর কাপড় কাচার সময় নাজিমুদ্দিনের গানের বিষয় শীলার বুক, গানে বেড়াল রূপী নর্তনের সঙ্গে তুল্য হয়।
নেয়ামতের হাটের দক্ষিণে লঞ্চঘাটের কাছে ছাড়া-কাছারিঘরের পাশে শীলারানীর স্বামী রমেশের লন্ড্রি-ঘর। পতিত টিনের উপর নিজ হাতে লেখা-
‘বিদাতা দোলাইগড়’
প্রোং-মিং রমেশ চন্দ্র।
সাং-নেয়ামত হাট।
প্রথম যখন রমেশ এ-সাইনবোর্ড লাগায় তখন উ-হাটবারে যেদিক থেকে লোক আসছে সকাল-বিকাল ভালো করে সেদিক মুখ করে দেয় সাইনবোর্ড। পরে অবশ্য সাইনবোর্ডের আগের লেখার উপর দিয়ে চকে লেখা আরও একটি ইংরেজি নাম স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা অক্ষরে সে ইংরেজি লেখা এরকম-
‘লোনডিঃ গড ডাই কির্ল্লাস’।
পূজা, বিয়ে, পার্বণ, ঈদ ও থানা সদরে মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় কাপড় ধোয়ানোর কিছু খদ্দের। নিয়মিত খদ্দের এত সামান্য যে এককভাবে এই ব্যবসা রমেশের পরিবারের খাই-খরচের জন্যে অপর্যাপ্ত। তবুও পরিচয় ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্নে রমেশ নিজের চেয়ে অবশ্যই তার ধোলাই-ঘরকে অনেক বড় মনে করে। রাতের মেইল লঞ্চ এম এল মাসুদের খালাসি গোলাম রসুলকে দু’টো টাকা দিয়ে সে বলবে- ‘ঝালকাডির মোবারকের আড়তে যাইয়া বিদাতা দোলাই গড়ের রমেশের বিলিচ পাউডার কইলেই হেরা বুইজজা লইবে, খবরদার বিদাতা লোনডির নাম না কইলে হেরা চেনবে না কইলাম।’
ধোয়ার জন্য রমেশের লন্ড্রিতে কাপড়চোপড় যা-ই আসুক শীলারানী ছাড়া তা ধোয়ার কে আছে!
শীলারানী বাড়ির ছোট পুকুরে কাপড় কাচবে, আর দু’চারজন এ ধরনের টিটকারি মেরে গান গাইবে এতে সে এতদিন ধাতস্থ। প্রথমদিকে এ ধরনের টিটকারি-মূলক গান বা কথা-বার্তায় ঘোমটার আড়ালে শীলারানী লজ্জায় অবনত হয়ে ঘোমটা আরও দীর্ঘ করে টেনে দিত। ভেজা দু’হাত কানে লাগিয়ে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করত। বোঝা যায় না শীলারানী কি জানে, কি জানে না এ ধরনের ঘটনার কোনো প্রতিবাদ করা যায় কি যায় না। কার্যত শীলারানীকে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ-হীন দেখা যায়। নাজিমুদ্দিনের ওদিনের গানের সময়ও শীলারানী প্রতিক্রিয়াহীন চড়াৎ চড়াৎ শব্দে রেইনট্রির গুঁড়ির উপর শক্তি দিয়ে কষে কাপর পিটিয়েছে। ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে যে!
কিন্তু সমস্যা একটি হয়ে গেছে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে আনসার তখন তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বসে আম খায়। চৈতের দুপুরে লবণ মরিচে কাঁচা আম কেটে খাওয়া আর গায়ে ঝিরঝিরে দক্ষিণা বাতাস লাগানো নৈমিত্তিক দৃশ্য। আনসার আলী পাতলা করে আম কাটে, খেজুরের রসের জন্য বানানো ধারালো লম্বা চাঁদ-বাঁকা ‘গাছ-কাটা দা’ দিয়ে। পুকুরের দক্ষিণ পাশে ‘জোয়ালে’ আম বলে খ্যাত বুড়ো গাছের বাড়া শক্ত হয়ে যাওয়া আম। শক্ত সেই কাঁচা আম-বাড়া লম্বালম্বি কেটে কচি পাতা ভরে বানানো হল বাড়া-বাঁশি পি-ই-প। ছয় শ্রেণীতে পড়া আনসার আলীর দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে পুষ্পরানী যখন পি-ই-প বাজাচ্ছে তখন ‘ক’ শ্রেণীতে পড়া ছোট ভাই মোহাম্মদ হানিফ সেই বাঁশি চেয়ে ভ্যা করে কাঁদে। বড় ভাই আব্দুর রব তখন ধমকায় পুষ্পকে বাঁশি হানিফের হাতে দেয়ার জন্য।
বদরু তালুকদারের ছেলেটি সে সময় শীলারানীকে উদ্দেশ্য করে তার বিশেষ ভাওয়াইয়া সুরে গান গেয়ে নেয়ামতের হাটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। নাজিমুদ্দিন সেভাবেই হেঁটে যেতে থাকে যেভাবে একজন মানুষ সাধারণ আর দশটা কাজের পরে হেটে যায়। তখন পেছন থেকে শীতল কণ্ঠে আনসার আলী ‘তালুকদারের পো’ বলে ডাকে। মাটিতে তার ‘গাছ-কাটা দা’ রেখে পরনের লুঙ্গি দোকোঁচা করে বেঁধে হাতে ঐ চাঁদ-বাঁকা দা নেয়। ‘আনসার ভাই’ বুঝি বলে নাজিম পেছনে ফিরে যাকে দেখে সে তার অতিশয় শান্ত আনসারের মূর্তিও নয়।
- ‘তোমার বউ যহন ঢেঁকিতে পাড় পাড়ে তহন কী নাচে, বিলাই না হিয়াল?’
আনসার নুয়ে পড়ে হাতের দা ঘুরিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দেয়ার মতো ভঙ্গি করে।
- ‘তোমার বুইনে যহন ছি-বুড়ি আর এক্কা-দোক্কা খেলে তহন কী নাচে, কুত্তা?’
এক পায়ে লাফিয়ে আনসার এক্কা-দোক্কা অভিনয় করে।
- ‘তোমার মায় যেকালে ধুলাই ক্ষেতে মুগড় দিয়া কোঁতানী মাইররা আস্তা মাটির চাহা ভাঙ্গে হেকালে কী লড়ে, খাডাশ?’
‘মাউগের ফো’ বলে আনসার নাজিমুদ্দিনের দিকে এগুবার জন্য পা বাড়াবার আগেই বদরু তালুকদারের ছেলে নুয়ে পড়ে লেজ-গোটানো কুকুরের মতো দৌড়ে হাটের দিকে চলে যায়। ‘ও কিছু নয়’ ভাবে আনসার আলীও আবার পুকুরের সেই দক্ষিণ পাড়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আম খাওয়ার আসরে ফিরে আসে।
হতভম্ব ছেলেমেয়েরা বাবার এই চেহারা এর আগে কোনোদিন দেখেনি। তবে ‘বাবাদের’ তো অনেককিছু করতে হয় সেরকম ধারণায় এক্ষুনি বাবার কাজটিকে ’বাবা হওয়ার’ প্রয়োজনীয় একটি কাজ বলে ছেলেমেয়েরা মেনে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু চৈত্রমাসের এই দুপুরে শীলারানী চোখের সামনে পূজামণ্ডপের পেছনে বরই-গাছ ঘিরে থাকা রাতের জোনাকির মতো দেখে। অনেকক্ষণ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থেকে হাতের কাপড় ছেড়ে অনেকটা লাফিয়ে পড়ে গাছের মুড়া থেকে পুকুরের কিনারায়। দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে শীলারানী অধিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কী ভেবেচিন্তে, কেন সে দৌড়ে অস্থির হয়ে বাড়ির ভেতরে আসে তা সে বুঝতে পারে না।
আনসার আলী কম-কথা-বলা স্বভাবের মানুষ। পেছনে কেউ বোবা আনসারও বলে। মোদ্দা-কথা দুচার-দশ গ্রামে আনসারের মতো শান্ত মানুষ পাওয়া ভার। দেশ স্বাধীনের আগে আনসার মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেও অন্যান্যদের মতো শহরমুখী সে হয়নি। পারিবারিক ধারাবাহিকতায় কৃষিকাজে থেকে যায়। গ্রামীণ প্রথায় চিন-পরিচয় প্রসঙ্গে আনসার নিজেকে ‘মৌসুমি বেকার’ বলে থাকে।
‘শিক্ষিত’ মানুষ, ‘আল-আলুডি’ করা মানুষের মতো তো আর তার কথা বলা সাজে না! অতএব আনসারের ‘শিক্ষিত’ মানুষের মতো জবাব ‘মৌসুমি বেকার’ অনেকের কাছে অর্থহীন মনে হলে আনসারকেই আবার ‘মৌসুমি বেকার’ অর্থ বুঝিয়েও দিতে হয়। ‘ম্যাট্রিক পাশ’ আনসার আলী শিক্ষিত বলে বিশেষ কিছু কাজও তার পড়ে গ্রামের মধ্যে। এর-ওর চিঠি পড়ে দেয়া, প্রতিবছর ফাল্গুনে ভুঁইয়ের নতুন আল ঠিক করার সময় ‘কালি করে দেয়া, দুচার ঘর মিলে ভাগে ইলিশ-মাছ কিনলে কার ভাগে ক'টুকরা আর ক’ পয়সা পড়লো তার হিসেব মেলানো, হারইন দিনের পূর্ব অনুসন্ধান, পঞ্জিকা দেখে বিয়ের দিনক্ষণ ও জোয়ারভাটার সময় বের করা, এইসব, আর ছেলেমেয়ে নিয়ে হাটবাজার, জালবোনা, মাছধরা, বৈশাখের জোয়ারে নতুন হাল জুড়ে ভাটিয়ালি, ফাল্গুন-চৈত্রে সম্ভব হলে যাত্রাপালা দেখা, এমন যাবতীয় সব বার্ষিক নিয়মিত চক্রে তার জীবন অতিবাহিত।
ক্ষোভ, রাগ, জিদ, ক্রোধ-বহির্ভূত আনসার আলী, প্রতিবেশীদের এ-ধারণার কখনো ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। সে-খবর কারও জানার কথা নয়, আনসারের জীবনের নিয়মিত চক্রের ছন্দপতন হলে তারও ভেতরে বহু বিশেষণের প্রতিক্রিয়া পুঞ্জীভূত হয়। তা নাহলে চৈত্রের রোদে প্রতিবাদে আনসার বাঙ্গি-ফুটি ফাটা দেবে কেনো। কতকিছু মিলে সব ক্ষোভ ভেতরে দানা বেঁধে বেরিয়ে আসতে চায়।
শৈশব থেকে বসন্তের যে-আনন্দ বেড়ে ওঠে আনসারের ভেতরে নেয়ামতের হাটের দক্ষিণের বিস্তীর্ণ মাঠের যাত্রাকে ঘিরে তা ভেসে যেতে দেখে সে। এখন আর হাটে টিন পিটিয়ে ঢোল নামে কেউ প্রচার করে না ‘আইতাছে, আইতাছে, যাত্রাপালা ‘ভেদ্দের মেইয়ে জোছনা’ কিংবা গাংগে এক মালাই নায়ে চোঙ্গা, যা পরে মাইক দিয়ে ঘোষণা করে না- ‘ভাই সাহেবগণ, হৈহৈ কাণ্ড রৈরৈ ব্যাপার, দেখপেন এক ঝাঁক ডানাকাটা পরীর নাচ’। এখন সেসব বন্ধ। ডানাকাটা পরীর নাচ দেখে বদরু তালুকদার নিজে ’মেরি ছক্কা’ বলে টাকা ছুড়ে আলো নামের তরুণীকে জাপটে ধরে যে কেলেঙ্কারি করেছিল তা এখন কারও বিশ্বাস হবে না। বদরু তালুকদার নিজেই তো যাত্রা দল আনা বন্ধ করে দিল। ‘ইসলাম ধর্মের মোসলেম রাষ্ট্রে এইসব চলবে না’ বলে বাধ সেধেছে গত বছর দুয়েক আগ থেকে। হাট কমিটির অনেক চেষ্টা তদবিরের পরেও তালুকদারের ঠেলায় যাত্রা আনা সম্ভব হয়নি। তার নাকি জেলায় বড় বড় নেতাদের সঙ্গে ভাব আছে, তারাই রাষ্ট্র চালায় বলে নেয়ামতের হাটের আশপাশের লোকজন জানে।
তা হলে যা হলো- আনসারের আর কোনো ফাগুনে কি চৈত্রের বিকেলে ছোট পুকুরে নেয়ে উঠে প্লেকার্ড লুঙ্গি আর চাদর জড়িয়ে পান মুখে দিয়ে যাত্রা দেখতে যেতে হয় না। হঠাৎ করে এক অন্যরকম মোসলমান হতে হলো। বাপ-দাদা পূর্বপুরুষের যেটা ছেলো এটা তার ওপর দিয়ে এলো। এলো তো এলো যাত্রাখানা ভাসিয়ে দিয়ে এলো। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে আনসার জরুরি ভঙ্গিতে বউকে একটি তথ্য জানিয়ে চমকে দেয়- মিতভাষী স্বামী এমন ভাষায় কিছু বলতে পারে ভাবনায় না থাকায় বউ আবার আনসারকে জিজ্ঞেস করে- ‘কী কইলেন?’
‘বদরু তালুকদারের দোসরা খৎনা হইছে, হের নেতারা হেরে পুরাডা খৎনা দিয়া দেছে, নাইলে যে-মানষে আলোরে জাপটাইয়া ধরে হে কেমনে কয় যাত্রা অইবে না!’ বউ অবিরাম হাসে- ‘কতা না কওইন্না মানু এমন কতা কয় যেন্ হাসতে-হাসতে পেডে খিল লাগে।’
চারদিকের কাণ্ডকারখানায় আনসার বিক্ষিপ্ত। দলিল পর্চার কাজে ঝালকাঠি যেতে হয়। রোজার মাস। থানার এম.বি.বি.এস. ডাক্তার বলেছে- ’আনসার মিয়া, আপনার আলসার হয়েছে, মনে হয় অম্বলের ফাইনাল খেলা, পেট খালি রাখবেন না, সেটাই সোয়াবের কাম।’
ঝালকাঠির লঞ্চে নেয়ামত হাটের দিকে কাজ শেষে যাত্রা, লঞ্চের পেছনের নিচু হাতলে বসে সে বাদাম খায়, অপরদিকের হাতলে বসে একজন একটি সুলতানী বিড়িতে আগুন ধরায়।
সহসা তিন-চারটি তরুণ এগিয়ে আসে মহিলা কেবিনের সামনে থেকে। তারা সেখানেই ব্যস্ত ছিল এতক্ষণ দেখেছে আনসার আলী। ছুটে এসে বিড়ি-ধরানো লোকটাকে ঘিরে ধরেছে মুহূর্তে। খুবই দায়িত্বপূর্ণ কাজ যেনো তাদের। সুলতানী বিড়ির পশ্চাৎ বা অগ্র-দেশে আগুন লাগায় তাদের বিবেক-ধর্মে ছ্যাৎ লেগেছে। পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো বোধহয়। অতএব দড়াম দড়াম শব্দে বিড়ি-বাহক লোকটির গালে পিঠে থাপ্পড় ঘুসি ও যৎবিক্ষিপ্ত লাথি পড়ছে। এ হয় না, রোজা-রমজানের দিন, ধুতি-ওয়ালা বিড়ি ধরিয়েছে। বিড়ি ছিটকে বিষখালীর গাঙ্গে পড়ে গেলো। বাতাসে বিড়ি জল-পানিতে পড়তে পড়তে চারটি পাক খেলো। অদূরে একটি কলাগাছ ও কচুরির ঝাঁকে বসে থাকা হট-টি-টি পাখি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তক্ষুনি লঞ্চের ঢেউ-এ ভেসে যাওয়া কলাগাছ ও কচুরির ঝাঁক দুলে উঠলো। হট-টি-টি উড়ে গেলো কী জানি কোন ভয়ে বিড়ি বিষখালির দরিয়ায় পড়ে নিভে গেলো।
নিভে গেলো কতকিছু! ভেসে থাকা কচুরির ঝাঁকের সেই হট-টি-টি আবার কোথায় বসবে কে জানে!
তখন বিড়ি নেই, কিন্তু দায়িত্ব চলছে।
’মালাউনের বাচ্চা, হালার পো পাইছোডা কী? রোজা-রমজানের দিন, শলায় আগুন ধরাইছ, জান্ডা খাইয়া হালামু।’
তখন কোনোকিছু ব্যাপার নয়, এই তার বিড়ি ছিটকে গাঙে পড়া, এই যে তার নাক দিয়ে রক্তের নহর বইছে, তার পরনের ধুতি একজন টেনে খুলে ফেলছে-এর কোনো কিছুই তখন কোনো ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, সেই লোক তখন বাম হাতে ধুতির এক মাথা দিয়ে নাকের রক্ত মুছতে চেষ্টা করে, নিজ উদ্যোগে দুকান ধরে এক ফাঁকে, যথা সম্ভব জিহ্বা কামড়ে দেয়, হাতজোড় করে বিনীত হাসির চেষ্টা করে বলতে থাকে- ‘মোর শাস্তি দাদু আরও বড়, গাংগে ফেলাইয়া দেওন দরকার, আরও পেরহার করণ দরকার, দ্যান, দ্যান দাদুরা, আরও কয়ডা দ্যান, মোরই অন্যায়, এই অন্যায়ের ক্ষ্যামা নাই।’ সে তার বাঁধ ভেঙে ভেসে যাওয়ার মতো অবশিষ্টাংশ দোমড়ানো গাল এগিয়ে দিয়ে আরও বলতে থাকে- ‘মোনের অজান্তে দাদু এই বুল না অইলে মানুষ্যসন্তান এই বুল করে না।’ ধুতি-বিড়ি খুবই আন্তরিক, আরও প্রহার প্রত্যাশা করে।
রক্তের কোনো জাত ও ধর্ম নেই, হয়তো তাই, রক্ত দেখে অথবা ছেলেগুলো হয়তো খুবই নতুন বলের বা নতুন দলের ছাত্র যুবা তাই খুবই দয়ালু হয়তো। দয়াপরবশত তারা আর মারে না তবে হুমকি দেয়, ‘ভবিষ্যতে আর যদি কোনোদিন দেহি রোজা-রমজানের দিন তয় এক্কেবারে ........ ’ এইটুকু বলে সে-যুবা তার ডানহাতে এক কোপের মতো বায়ুতে সঞ্চালন করে ঐ লোকটির গলা বরাবর। এর অর্থ হতে পারে, এইরকম ঘটনা পরে দেখলে শিরশ্ছেদ!
এ পরিস্থিতিতে লঞ্চের যাত্রীদের মধ্যে থেকে কারও এগিয়ে আসার প্রশ্ন আসে না। আনসার এ সময় নিজ দেহের শক্তির পরিমাণ উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে-শক্তি ও সাহস সমন্বিত হয় না তার মধ্যে। তবে বাদাম ছুলে খাওয়ার যে সাধারণ রীতি, একটির পর একটি, সেভাবে আনসার আর এখন বাদাম খায় না। সে ছোলাসহ খাবলা ভরে বাদাম মুখে পুরছে। মহিলা কেবিনের সামনে আরও একটু আগে ঐ ‘ধর্মপ্রাণ’ ছেলেগুলোই-না কী এলাহি টান সিগারেটে দিল! তখন তা আনসারের মাথায় ঢোকে নাই, এখন টের পাচ্ছে। কী কুদরতি কারবার মাথার!
ভাবুক আনসার ম্যাট্রিক পাশ। লেখাপড়া ও পড়াশোনা করা লোক সে। ’৬৫ সালের যুদ্ধের সময় কেরোসিনের দাম বেড়ে উধাও হয়ে গেলে আনসার উত্তরের কাছারিঘরে ‘বাতন’ ফল জ্বেলে এক প্রহর রাত পড়েছে। বি.এস.সি. স্যার পড়াতেন সিভিক্স্- ‘রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়’। বি.এস.সি. স্যারের মতো পৌর-নীতিকে ইংরেজিতে সিভিক্স্ বলার আনন্দে রাস্তা ছেড়ে কিছুটা আল ধরে হাঁটাহাঁটি করেছিল।
আনসার খাবলা করে বাদাম মুখে ভরলে পৌর-নীতি ভীষণ তৎপর থাকে। অথবা লঞ্চের মহিলা কেবিনের সামনে সিগারেটে সুখটান দিলে। নীতি-কথাগুলো আনসারের তখন সবই মনে পড়ে। ‘বাউল’ স্যার ডাক্তার লুৎফর রহমান পড়াতেন আর খেজুরের কাঁটার ছুঁচাল মাথা ভেঙে দাঁত খোঁচাতেন, মনে হতো অমাবস্যার রাতে ছাড়া-বাড়ির ভূতুম, দাঁত খোঁচতে খোঁচতে খিঁচি দিয়ে বলতেন,- ‘ফেল-করা কোনো ছাত্তর ছাড়া নীতিকথা কাউরে মনে রাখতে দেখি নাই।’
আনসার বারবার ফেল-করা ম্যাট্রিক পাশ। সারারাত জেগে জোরে জোরে পড়ে সকালে ভুলে যেত সব। তার মনে থাকে না, মনে নেই- বি.এস.সি. স্যারের সিভিক্স্, রাষ্ট্র, নাগরিক এইসব।
মোতাহার ফকির আধা পীর দাবিদার, মাইজভাণ্ডারী মুরিদ। প্রায় সবকিছুই ‘আইধ্যাত্মিক’ বলে চালান করে। আনসার তার কাছে গিয়ে বলে, কও দেখি ফকির উদ্ভ্রান্ত, বিক্ষিপ্ত মাইনি কী? মোতাহার মাথা দুলিয়ে ‘জানি ধরনের’ উত্তর দিলে আনসার নিজেকে সেই উদ্ভ্রান্ত ও বিক্ষিপ্ত দাবি করে। মোতাহার ফকির নতুন সাগরেদ পেয়ে আধ্যাত্মিক উত্তর করে- ‘এই দুনিয়া তাইনের খেলা, দুইদিনের এই খেলাঘরত পুতুল যেমনি নাচায় তেমনি নাচে’, অনেকদিন পর মোতাহারের জটা বাবরি ঝাঁকানোর মোক্ষম সুযোগ যেনো। এরই মধ্যে আরও গভীর প্রশ্ন করে বসে আনসার- ‘ভাণ্ডার কও দেহি তাইলে তোমার নাগরিক কি তাইনে বানায়?’ মোতাহার আধ্যাত্মিক প্রশ্ন পেয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে উলটা শ্বাসে এক চিৎকার মারে, ইয়াহ্! গলায় মিহি সুরে বলে, ‘খালি নাগরিক না, গুড়ি পিঁপড়া, ওলা ডাইয়া, কচু-পাতা, রাজা-উজির সবই তাইনে নিজ হাতে বানায়।’ শান্ত আনসার মনেমনে ফকিরকে গালি দেয়- ‘হারামজাদায় নাগরিক কী তাই জানে না।’
তখন সময় ছিল ওইরকম যখন কিনা আনসার পুকুরপাড়ে ওই ঘটনা ঘটায়। কথা রাষ্ট্র হয় এইভাবে-তালুকদারের ফো নাজিমুদ্দিন ভালো দৌড়াইতে না পারলে মার্ডার হইয়া যাইত। আনসারের হাতে ছিল খেজুরের রসের জন্য গাছ-কাটা দাও। সদ্য সুপারির বাইল্লা কোঁচায় গাঙের রাঙা বালিতে ধার-ওঠানো চাঁদ-বাঁকা দা। এখন এর একটা বিহিত হবে। শিগগির হাটে এর বিচার সালিশ বসবে। সেরকম ব্যবস্থাই হচ্ছে। আনসারকেও দু-একজন এ খবর জানিয়েছে, আনসার তার কোনো জবাব করেনি যথারীতি। কিন্তু এরই মধ্যে একদিন সে যখন নৌকায় বার্ষিক আলকাতরা দেয়ার আগে তক্তার ফাঁকে গাব-কষ মাখানো ত্যানা কাপড় ঢুকিয়ে নাও ‘গায়’ তখন বদরু তালুকদার নিজে ওই পথে হাটের দিকে যায়। তালুকদার মুরুব্বির মতোই বলে- ‘আনসার, এলাকাবাসী তো তোমার বিচার চায়, এতে আমার কিছু করার নাই।’ আনসার বাঁটলের উপর হালকা হাতুড়ি পেটানো ‘নাও গাওয়া’ বন্ধ করে, ‘তালুকদার, এলাকাবাসীর সঙ্গে তো আমার কোনো কারবার নাই, আমার লগে কারবার নাইলে আপনের লগেই হইবে। আর এই আউশের গাছ-কাটা দা-ডা।’
এই বলে সে পাশের সুপারি গাছের বালি কোঁচায়, কিছু রাঙা বালি ঢেলে গাছ-কাটা দায়ে খিঁজ-খিঁজ শব্দে ধার ওঠানো শুরু করে। বালুর ঘষায় এই ধরনের খিঁজ-খিঁজ শব্দে বদরু তালুকদার কেনো, অনেকের গায়ের ভেতর গিজগিজ করে উঠে গা কাঁটা দিয়ে ঝাড়া মারে।
হাট পলিটিক্স দুই ভাগ হয়ে যায়। হতো না, রাঙা বালিতে গাছ-কাটা দায়ে আনসারের শান তোলা গপ্প ছড়িয়ে পরে, ফলে শত্রুপক্ষ স্লোগান দেয়- ‘আনসার ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন নেয়ামত-হাটে, আনসার ভাই এগিয়ে চলো...’। বিচার সালিশ আর বসে না। তবে এক রাতে তার ঘরের চালে দ্রিম দ্রিম শব্দে আধলা ইট পড়তে থাকে। আনসার হাতে পাঁচ-ব্যাটারির টর্চ-লাইট নিয়ে ‘মাউগের ফোয়রা খাড়া’ বলে ডান হাতে দা ঘোরায়। নতুন ব্যাটারির টর্চলাইটের আলো শান-তোলা দায়ে পড়ে কিছু প্রতিফলিত আলো বিচ্ছুরিত হয় নিঃসন্দেহে আধলা-ছোড়াদের চোখের উপর।
তালুকদারের শত্রুপক্ষের সমর্থন ও বিশ্বস্ত ভরসা চাঁদ-বাঁকা দা সাহস যোগায়। ছাত্র হিসেবে আনসার যত খারাপই হোক না কেনো তার পৌর-নীতি পাঠ কাজে আসে। রাষ্ট্রের নাগরিক, নাগরিকের অধিকার, তার নিরাপত্তা ও তার অবস্থান এসব সে ভালোভাবেই পড়ছে বলে ধারণা। সম্ভবত সে-কারণে আনসার সাহসী হতে পারে এক্ষেত্রে। কিন্তু রমেশ ধোপার স্ত্রী শীলারানী কাপড় কাচা বন্ধ করে মুড়া থেকে হাঁটু-পানির কিনারায় সেই যে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ানো শুরু করেছে সে-দৌড় থামানোর নিয়ন্ত্রণ আর তার কাছে থাকে না। শীলারানীর সে দৌড়ানোয় সহসাই যোগ হয় রমেশচন্দ্র। তাদের দৌড় থেমেছে কি না বা থামবে কি না তা কেউ বলতে পারছে না আপাতত। কেনোনা ক’দিন পরে রমেশ-শীলারানীদের বসতবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। কোথায় তারা চলে যায় বা গেছে সে-সম্পর্কে কেউ যে উচ্চারণ করে না তা নয়। তাদের সে-দৌড় আজও থেমেছে কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তারা যেখানেই থাক আনসারের পৌর-নীতির জ্ঞান অনুযায়ী নাগরিক হিসেবে সেখানেই-বা তার মর্যাদা ও স্বীকৃতি কে দেয়!
এরও কিছুদিন পর আর একটি ঘটনা ঘটে যায়। নেয়ামত-হাটে বিদাতা দোলাইগড়ের ‘প্রোঃ’ এর নাম হিসেবে দেখা যায় আনসার আলীর নাম। তাতে অনেক নাগরিক আনসারের ‘জাত’ বিষয়ক প্রশ্ন তুলে অভিমান করে, ক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু আনসারকে এই বাণিজ্য-বৃত্তি থেকে নির্বৃত্ত করা সম্ভব হয় না। সেই পুকুরের সেই গুঁড়ির উপর এখন আনসারের স্ত্রী কাপড় কাচে। এখন বিড়াল নাচুক আর যা-ই নাচুক বদরু তালুকদারের ছেলে সে-কথার সুরে কোন গান গাইতে পারে না। তা হলে সমঅধিকারের নাগরিক আনসারের গাছ-কাটা দাও প্রবলভাবে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নিউইয়র্ক, জুলই ১৯৯৫ ।
‘ধোফার বেডি কাফুর কাচে, দুই কুলে দুই বিলোই নাচে’, এই ছিল গানের কলি। ভাওয়াইয়ার সুরে উঁচু কণ্ঠে বদরু তালুকদারের ছেলে নাজিমুদ্দিন এ-গান গায় যখন সে তখন নেয়ামত হাটে যাওয়ার পথে। হাট সেদিন বসে মিলবার দিন ছিল না। দিনটি উ-হাটবার।
নেয়ামত হাটের উত্তর-পূর্ব কোণে হাটের ভেতর ঢুকতে বাড়িগুলোর উপর দিয়ে যে-পথ আছে তার পাশে ছোট পুকুর। রাস্তাটি পুকুরের পূব-পার ও উত্তর-পার হয়ে হাটের দিকে চলে গেছে। ছোট সে-পুকুরে ধোপা-বাড়ির মহিলাদের স্নান, হাঁড়ি-বাসন, কাপড়চোপড় যাবতীয় সব ধোয়ার কাজ চলে। এসব গ্রামে বাড়ি বা পরিবার ভিত্তিক নারী-দর্শন-বিষয়ক যে-পূর্বাপর রক্ষণশীলতার রেওয়াজ আছে ধোপা-বাড়ির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না। ব্যাটা-ছেলেরা চোখে কপাট খোলা লাট লাগিয়ে তাকিয়ে থাকবে। সে সব পথিকের চোখ ক্ষান্ত রাখার জন্য শুকনো কলাপাতা ও সুপারির ডগা দিয়ে পর্দা বানিয়ে আড়াল করা আছে। বর্ষা শেষে ফাল্গুনে কি চৈত্রে নতুন পর্দা জোড়া হয়। এ-বছর এখনও নতুন পর্দা লাগেনি। গেল বছরের বর্ষায় পচে যাওয়া ডগাগুলো শীতে শুকিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পর্দার অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। সেই বিপন্ন-অস্তিত্ব পর্দার সুপারির ডগা ও কলাপাতার ফাঁকা দিয়ে বদরু তালুকদারের বড় ব্যাটা নাজিমুদ্দিন পুকুরের পশ্চিম পারের ঘাট দেখতে পায়। আর ঘাটে তখন রমেশ ধোপার বউ শীলারানী করাতে কাটা রেইনট্রির গুঁড়ির উপর কাপর কাচে। শীলারানী গুঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে কখনো বাম হাতে কখনো ডান হাতে কাপড় উপরে আকাশের দিকে ছুড়ে মেরে আবার কোমর ভেঙ্গে নুয়ে পড়ে পায়ের কাছে কুঁচিয়ে পেটাচ্ছে। তখন বদরু তালুকদারের ছেলে নাজিমুদ্দিন ভাওয়াইয়া সুরে ওই গান গায়। তার গানের মাজেজা এমনকি অস্পষ্ট নয় বরং পাহাড়ি ঢলের পানির মতন পরিষ্কার, একদা-যৌবনবতী শীলারানী নুয়ে পড়ে কাপড় কাচে। কোমর ভেঙ্গে পুরো মানুষ যেখানে ওঠা-নামা করছে সেখানে তার রংচটা নীলাম্বরী কাপড়-আবৃত দেহের বুকের স্তনও বাকি থাকে না যা কিনা তার ক্ষেত্রে তখন যৌবন ও যৌনতার নিষ্ক্রিয় হয়ে সন্তানের খাদ্য পরিবেশনের জন্য অধিক গুরুত্ব বহন করে। শীলারানীর কাপড় কাচার সময় নাজিমুদ্দিনের গানের বিষয় শীলার বুক, গানে বেড়াল রূপী নর্তনের সঙ্গে তুল্য হয়।
নেয়ামতের হাটের দক্ষিণে লঞ্চঘাটের কাছে ছাড়া-কাছারিঘরের পাশে শীলারানীর স্বামী রমেশের লন্ড্রি-ঘর। পতিত টিনের উপর নিজ হাতে লেখা-
‘বিদাতা দোলাইগড়’
প্রোং-মিং রমেশ চন্দ্র।
সাং-নেয়ামত হাট।
প্রথম যখন রমেশ এ-সাইনবোর্ড লাগায় তখন উ-হাটবারে যেদিক থেকে লোক আসছে সকাল-বিকাল ভালো করে সেদিক মুখ করে দেয় সাইনবোর্ড। পরে অবশ্য সাইনবোর্ডের আগের লেখার উপর দিয়ে চকে লেখা আরও একটি ইংরেজি নাম স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা অক্ষরে সে ইংরেজি লেখা এরকম-
‘লোনডিঃ গড ডাই কির্ল্লাস’।
পূজা, বিয়ে, পার্বণ, ঈদ ও থানা সদরে মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় কাপড় ধোয়ানোর কিছু খদ্দের। নিয়মিত খদ্দের এত সামান্য যে এককভাবে এই ব্যবসা রমেশের পরিবারের খাই-খরচের জন্যে অপর্যাপ্ত। তবুও পরিচয় ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্নে রমেশ নিজের চেয়ে অবশ্যই তার ধোলাই-ঘরকে অনেক বড় মনে করে। রাতের মেইল লঞ্চ এম এল মাসুদের খালাসি গোলাম রসুলকে দু’টো টাকা দিয়ে সে বলবে- ‘ঝালকাডির মোবারকের আড়তে যাইয়া বিদাতা দোলাই গড়ের রমেশের বিলিচ পাউডার কইলেই হেরা বুইজজা লইবে, খবরদার বিদাতা লোনডির নাম না কইলে হেরা চেনবে না কইলাম।’
ধোয়ার জন্য রমেশের লন্ড্রিতে কাপড়চোপড় যা-ই আসুক শীলারানী ছাড়া তা ধোয়ার কে আছে!
শীলারানী বাড়ির ছোট পুকুরে কাপড় কাচবে, আর দু’চারজন এ ধরনের টিটকারি মেরে গান গাইবে এতে সে এতদিন ধাতস্থ। প্রথমদিকে এ ধরনের টিটকারি-মূলক গান বা কথা-বার্তায় ঘোমটার আড়ালে শীলারানী লজ্জায় অবনত হয়ে ঘোমটা আরও দীর্ঘ করে টেনে দিত। ভেজা দু’হাত কানে লাগিয়ে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করত। বোঝা যায় না শীলারানী কি জানে, কি জানে না এ ধরনের ঘটনার কোনো প্রতিবাদ করা যায় কি যায় না। কার্যত শীলারানীকে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ-হীন দেখা যায়। নাজিমুদ্দিনের ওদিনের গানের সময়ও শীলারানী প্রতিক্রিয়াহীন চড়াৎ চড়াৎ শব্দে রেইনট্রির গুঁড়ির উপর শক্তি দিয়ে কষে কাপর পিটিয়েছে। ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে যে!
কিন্তু সমস্যা একটি হয়ে গেছে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে আনসার তখন তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বসে আম খায়। চৈতের দুপুরে লবণ মরিচে কাঁচা আম কেটে খাওয়া আর গায়ে ঝিরঝিরে দক্ষিণা বাতাস লাগানো নৈমিত্তিক দৃশ্য। আনসার আলী পাতলা করে আম কাটে, খেজুরের রসের জন্য বানানো ধারালো লম্বা চাঁদ-বাঁকা ‘গাছ-কাটা দা’ দিয়ে। পুকুরের দক্ষিণ পাশে ‘জোয়ালে’ আম বলে খ্যাত বুড়ো গাছের বাড়া শক্ত হয়ে যাওয়া আম। শক্ত সেই কাঁচা আম-বাড়া লম্বালম্বি কেটে কচি পাতা ভরে বানানো হল বাড়া-বাঁশি পি-ই-প। ছয় শ্রেণীতে পড়া আনসার আলীর দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে পুষ্পরানী যখন পি-ই-প বাজাচ্ছে তখন ‘ক’ শ্রেণীতে পড়া ছোট ভাই মোহাম্মদ হানিফ সেই বাঁশি চেয়ে ভ্যা করে কাঁদে। বড় ভাই আব্দুর রব তখন ধমকায় পুষ্পকে বাঁশি হানিফের হাতে দেয়ার জন্য।
বদরু তালুকদারের ছেলেটি সে সময় শীলারানীকে উদ্দেশ্য করে তার বিশেষ ভাওয়াইয়া সুরে গান গেয়ে নেয়ামতের হাটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। নাজিমুদ্দিন সেভাবেই হেঁটে যেতে থাকে যেভাবে একজন মানুষ সাধারণ আর দশটা কাজের পরে হেটে যায়। তখন পেছন থেকে শীতল কণ্ঠে আনসার আলী ‘তালুকদারের পো’ বলে ডাকে। মাটিতে তার ‘গাছ-কাটা দা’ রেখে পরনের লুঙ্গি দোকোঁচা করে বেঁধে হাতে ঐ চাঁদ-বাঁকা দা নেয়। ‘আনসার ভাই’ বুঝি বলে নাজিম পেছনে ফিরে যাকে দেখে সে তার অতিশয় শান্ত আনসারের মূর্তিও নয়।
- ‘তোমার বউ যহন ঢেঁকিতে পাড় পাড়ে তহন কী নাচে, বিলাই না হিয়াল?’
আনসার নুয়ে পড়ে হাতের দা ঘুরিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দেয়ার মতো ভঙ্গি করে।
- ‘তোমার বুইনে যহন ছি-বুড়ি আর এক্কা-দোক্কা খেলে তহন কী নাচে, কুত্তা?’
এক পায়ে লাফিয়ে আনসার এক্কা-দোক্কা অভিনয় করে।
- ‘তোমার মায় যেকালে ধুলাই ক্ষেতে মুগড় দিয়া কোঁতানী মাইররা আস্তা মাটির চাহা ভাঙ্গে হেকালে কী লড়ে, খাডাশ?’
‘মাউগের ফো’ বলে আনসার নাজিমুদ্দিনের দিকে এগুবার জন্য পা বাড়াবার আগেই বদরু তালুকদারের ছেলে নুয়ে পড়ে লেজ-গোটানো কুকুরের মতো দৌড়ে হাটের দিকে চলে যায়। ‘ও কিছু নয়’ ভাবে আনসার আলীও আবার পুকুরের সেই দক্ষিণ পাড়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আম খাওয়ার আসরে ফিরে আসে।
হতভম্ব ছেলেমেয়েরা বাবার এই চেহারা এর আগে কোনোদিন দেখেনি। তবে ‘বাবাদের’ তো অনেককিছু করতে হয় সেরকম ধারণায় এক্ষুনি বাবার কাজটিকে ’বাবা হওয়ার’ প্রয়োজনীয় একটি কাজ বলে ছেলেমেয়েরা মেনে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু চৈত্রমাসের এই দুপুরে শীলারানী চোখের সামনে পূজামণ্ডপের পেছনে বরই-গাছ ঘিরে থাকা রাতের জোনাকির মতো দেখে। অনেকক্ষণ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থেকে হাতের কাপড় ছেড়ে অনেকটা লাফিয়ে পড়ে গাছের মুড়া থেকে পুকুরের কিনারায়। দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে শীলারানী অধিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কী ভেবেচিন্তে, কেন সে দৌড়ে অস্থির হয়ে বাড়ির ভেতরে আসে তা সে বুঝতে পারে না।
আনসার আলী কম-কথা-বলা স্বভাবের মানুষ। পেছনে কেউ বোবা আনসারও বলে। মোদ্দা-কথা দুচার-দশ গ্রামে আনসারের মতো শান্ত মানুষ পাওয়া ভার। দেশ স্বাধীনের আগে আনসার মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেও অন্যান্যদের মতো শহরমুখী সে হয়নি। পারিবারিক ধারাবাহিকতায় কৃষিকাজে থেকে যায়। গ্রামীণ প্রথায় চিন-পরিচয় প্রসঙ্গে আনসার নিজেকে ‘মৌসুমি বেকার’ বলে থাকে।
‘শিক্ষিত’ মানুষ, ‘আল-আলুডি’ করা মানুষের মতো তো আর তার কথা বলা সাজে না! অতএব আনসারের ‘শিক্ষিত’ মানুষের মতো জবাব ‘মৌসুমি বেকার’ অনেকের কাছে অর্থহীন মনে হলে আনসারকেই আবার ‘মৌসুমি বেকার’ অর্থ বুঝিয়েও দিতে হয়। ‘ম্যাট্রিক পাশ’ আনসার আলী শিক্ষিত বলে বিশেষ কিছু কাজও তার পড়ে গ্রামের মধ্যে। এর-ওর চিঠি পড়ে দেয়া, প্রতিবছর ফাল্গুনে ভুঁইয়ের নতুন আল ঠিক করার সময় ‘কালি করে দেয়া, দুচার ঘর মিলে ভাগে ইলিশ-মাছ কিনলে কার ভাগে ক'টুকরা আর ক’ পয়সা পড়লো তার হিসেব মেলানো, হারইন দিনের পূর্ব অনুসন্ধান, পঞ্জিকা দেখে বিয়ের দিনক্ষণ ও জোয়ারভাটার সময় বের করা, এইসব, আর ছেলেমেয়ে নিয়ে হাটবাজার, জালবোনা, মাছধরা, বৈশাখের জোয়ারে নতুন হাল জুড়ে ভাটিয়ালি, ফাল্গুন-চৈত্রে সম্ভব হলে যাত্রাপালা দেখা, এমন যাবতীয় সব বার্ষিক নিয়মিত চক্রে তার জীবন অতিবাহিত।
ক্ষোভ, রাগ, জিদ, ক্রোধ-বহির্ভূত আনসার আলী, প্রতিবেশীদের এ-ধারণার কখনো ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। সে-খবর কারও জানার কথা নয়, আনসারের জীবনের নিয়মিত চক্রের ছন্দপতন হলে তারও ভেতরে বহু বিশেষণের প্রতিক্রিয়া পুঞ্জীভূত হয়। তা নাহলে চৈত্রের রোদে প্রতিবাদে আনসার বাঙ্গি-ফুটি ফাটা দেবে কেনো। কতকিছু মিলে সব ক্ষোভ ভেতরে দানা বেঁধে বেরিয়ে আসতে চায়।
শৈশব থেকে বসন্তের যে-আনন্দ বেড়ে ওঠে আনসারের ভেতরে নেয়ামতের হাটের দক্ষিণের বিস্তীর্ণ মাঠের যাত্রাকে ঘিরে তা ভেসে যেতে দেখে সে। এখন আর হাটে টিন পিটিয়ে ঢোল নামে কেউ প্রচার করে না ‘আইতাছে, আইতাছে, যাত্রাপালা ‘ভেদ্দের মেইয়ে জোছনা’ কিংবা গাংগে এক মালাই নায়ে চোঙ্গা, যা পরে মাইক দিয়ে ঘোষণা করে না- ‘ভাই সাহেবগণ, হৈহৈ কাণ্ড রৈরৈ ব্যাপার, দেখপেন এক ঝাঁক ডানাকাটা পরীর নাচ’। এখন সেসব বন্ধ। ডানাকাটা পরীর নাচ দেখে বদরু তালুকদার নিজে ’মেরি ছক্কা’ বলে টাকা ছুড়ে আলো নামের তরুণীকে জাপটে ধরে যে কেলেঙ্কারি করেছিল তা এখন কারও বিশ্বাস হবে না। বদরু তালুকদার নিজেই তো যাত্রা দল আনা বন্ধ করে দিল। ‘ইসলাম ধর্মের মোসলেম রাষ্ট্রে এইসব চলবে না’ বলে বাধ সেধেছে গত বছর দুয়েক আগ থেকে। হাট কমিটির অনেক চেষ্টা তদবিরের পরেও তালুকদারের ঠেলায় যাত্রা আনা সম্ভব হয়নি। তার নাকি জেলায় বড় বড় নেতাদের সঙ্গে ভাব আছে, তারাই রাষ্ট্র চালায় বলে নেয়ামতের হাটের আশপাশের লোকজন জানে।
তা হলে যা হলো- আনসারের আর কোনো ফাগুনে কি চৈত্রের বিকেলে ছোট পুকুরে নেয়ে উঠে প্লেকার্ড লুঙ্গি আর চাদর জড়িয়ে পান মুখে দিয়ে যাত্রা দেখতে যেতে হয় না। হঠাৎ করে এক অন্যরকম মোসলমান হতে হলো। বাপ-দাদা পূর্বপুরুষের যেটা ছেলো এটা তার ওপর দিয়ে এলো। এলো তো এলো যাত্রাখানা ভাসিয়ে দিয়ে এলো। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে আনসার জরুরি ভঙ্গিতে বউকে একটি তথ্য জানিয়ে চমকে দেয়- মিতভাষী স্বামী এমন ভাষায় কিছু বলতে পারে ভাবনায় না থাকায় বউ আবার আনসারকে জিজ্ঞেস করে- ‘কী কইলেন?’
‘বদরু তালুকদারের দোসরা খৎনা হইছে, হের নেতারা হেরে পুরাডা খৎনা দিয়া দেছে, নাইলে যে-মানষে আলোরে জাপটাইয়া ধরে হে কেমনে কয় যাত্রা অইবে না!’ বউ অবিরাম হাসে- ‘কতা না কওইন্না মানু এমন কতা কয় যেন্ হাসতে-হাসতে পেডে খিল লাগে।’
চারদিকের কাণ্ডকারখানায় আনসার বিক্ষিপ্ত। দলিল পর্চার কাজে ঝালকাঠি যেতে হয়। রোজার মাস। থানার এম.বি.বি.এস. ডাক্তার বলেছে- ’আনসার মিয়া, আপনার আলসার হয়েছে, মনে হয় অম্বলের ফাইনাল খেলা, পেট খালি রাখবেন না, সেটাই সোয়াবের কাম।’
ঝালকাঠির লঞ্চে নেয়ামত হাটের দিকে কাজ শেষে যাত্রা, লঞ্চের পেছনের নিচু হাতলে বসে সে বাদাম খায়, অপরদিকের হাতলে বসে একজন একটি সুলতানী বিড়িতে আগুন ধরায়।
সহসা তিন-চারটি তরুণ এগিয়ে আসে মহিলা কেবিনের সামনে থেকে। তারা সেখানেই ব্যস্ত ছিল এতক্ষণ দেখেছে আনসার আলী। ছুটে এসে বিড়ি-ধরানো লোকটাকে ঘিরে ধরেছে মুহূর্তে। খুবই দায়িত্বপূর্ণ কাজ যেনো তাদের। সুলতানী বিড়ির পশ্চাৎ বা অগ্র-দেশে আগুন লাগায় তাদের বিবেক-ধর্মে ছ্যাৎ লেগেছে। পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো বোধহয়। অতএব দড়াম দড়াম শব্দে বিড়ি-বাহক লোকটির গালে পিঠে থাপ্পড় ঘুসি ও যৎবিক্ষিপ্ত লাথি পড়ছে। এ হয় না, রোজা-রমজানের দিন, ধুতি-ওয়ালা বিড়ি ধরিয়েছে। বিড়ি ছিটকে বিষখালীর গাঙ্গে পড়ে গেলো। বাতাসে বিড়ি জল-পানিতে পড়তে পড়তে চারটি পাক খেলো। অদূরে একটি কলাগাছ ও কচুরির ঝাঁকে বসে থাকা হট-টি-টি পাখি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তক্ষুনি লঞ্চের ঢেউ-এ ভেসে যাওয়া কলাগাছ ও কচুরির ঝাঁক দুলে উঠলো। হট-টি-টি উড়ে গেলো কী জানি কোন ভয়ে বিড়ি বিষখালির দরিয়ায় পড়ে নিভে গেলো।
নিভে গেলো কতকিছু! ভেসে থাকা কচুরির ঝাঁকের সেই হট-টি-টি আবার কোথায় বসবে কে জানে!
তখন বিড়ি নেই, কিন্তু দায়িত্ব চলছে।
’মালাউনের বাচ্চা, হালার পো পাইছোডা কী? রোজা-রমজানের দিন, শলায় আগুন ধরাইছ, জান্ডা খাইয়া হালামু।’
তখন কোনোকিছু ব্যাপার নয়, এই তার বিড়ি ছিটকে গাঙে পড়া, এই যে তার নাক দিয়ে রক্তের নহর বইছে, তার পরনের ধুতি একজন টেনে খুলে ফেলছে-এর কোনো কিছুই তখন কোনো ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, সেই লোক তখন বাম হাতে ধুতির এক মাথা দিয়ে নাকের রক্ত মুছতে চেষ্টা করে, নিজ উদ্যোগে দুকান ধরে এক ফাঁকে, যথা সম্ভব জিহ্বা কামড়ে দেয়, হাতজোড় করে বিনীত হাসির চেষ্টা করে বলতে থাকে- ‘মোর শাস্তি দাদু আরও বড়, গাংগে ফেলাইয়া দেওন দরকার, আরও পেরহার করণ দরকার, দ্যান, দ্যান দাদুরা, আরও কয়ডা দ্যান, মোরই অন্যায়, এই অন্যায়ের ক্ষ্যামা নাই।’ সে তার বাঁধ ভেঙে ভেসে যাওয়ার মতো অবশিষ্টাংশ দোমড়ানো গাল এগিয়ে দিয়ে আরও বলতে থাকে- ‘মোনের অজান্তে দাদু এই বুল না অইলে মানুষ্যসন্তান এই বুল করে না।’ ধুতি-বিড়ি খুবই আন্তরিক, আরও প্রহার প্রত্যাশা করে।
রক্তের কোনো জাত ও ধর্ম নেই, হয়তো তাই, রক্ত দেখে অথবা ছেলেগুলো হয়তো খুবই নতুন বলের বা নতুন দলের ছাত্র যুবা তাই খুবই দয়ালু হয়তো। দয়াপরবশত তারা আর মারে না তবে হুমকি দেয়, ‘ভবিষ্যতে আর যদি কোনোদিন দেহি রোজা-রমজানের দিন তয় এক্কেবারে ........ ’ এইটুকু বলে সে-যুবা তার ডানহাতে এক কোপের মতো বায়ুতে সঞ্চালন করে ঐ লোকটির গলা বরাবর। এর অর্থ হতে পারে, এইরকম ঘটনা পরে দেখলে শিরশ্ছেদ!
এ পরিস্থিতিতে লঞ্চের যাত্রীদের মধ্যে থেকে কারও এগিয়ে আসার প্রশ্ন আসে না। আনসার এ সময় নিজ দেহের শক্তির পরিমাণ উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে-শক্তি ও সাহস সমন্বিত হয় না তার মধ্যে। তবে বাদাম ছুলে খাওয়ার যে সাধারণ রীতি, একটির পর একটি, সেভাবে আনসার আর এখন বাদাম খায় না। সে ছোলাসহ খাবলা ভরে বাদাম মুখে পুরছে। মহিলা কেবিনের সামনে আরও একটু আগে ঐ ‘ধর্মপ্রাণ’ ছেলেগুলোই-না কী এলাহি টান সিগারেটে দিল! তখন তা আনসারের মাথায় ঢোকে নাই, এখন টের পাচ্ছে। কী কুদরতি কারবার মাথার!
ভাবুক আনসার ম্যাট্রিক পাশ। লেখাপড়া ও পড়াশোনা করা লোক সে। ’৬৫ সালের যুদ্ধের সময় কেরোসিনের দাম বেড়ে উধাও হয়ে গেলে আনসার উত্তরের কাছারিঘরে ‘বাতন’ ফল জ্বেলে এক প্রহর রাত পড়েছে। বি.এস.সি. স্যার পড়াতেন সিভিক্স্- ‘রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়’। বি.এস.সি. স্যারের মতো পৌর-নীতিকে ইংরেজিতে সিভিক্স্ বলার আনন্দে রাস্তা ছেড়ে কিছুটা আল ধরে হাঁটাহাঁটি করেছিল।
আনসার খাবলা করে বাদাম মুখে ভরলে পৌর-নীতি ভীষণ তৎপর থাকে। অথবা লঞ্চের মহিলা কেবিনের সামনে সিগারেটে সুখটান দিলে। নীতি-কথাগুলো আনসারের তখন সবই মনে পড়ে। ‘বাউল’ স্যার ডাক্তার লুৎফর রহমান পড়াতেন আর খেজুরের কাঁটার ছুঁচাল মাথা ভেঙে দাঁত খোঁচাতেন, মনে হতো অমাবস্যার রাতে ছাড়া-বাড়ির ভূতুম, দাঁত খোঁচতে খোঁচতে খিঁচি দিয়ে বলতেন,- ‘ফেল-করা কোনো ছাত্তর ছাড়া নীতিকথা কাউরে মনে রাখতে দেখি নাই।’
আনসার বারবার ফেল-করা ম্যাট্রিক পাশ। সারারাত জেগে জোরে জোরে পড়ে সকালে ভুলে যেত সব। তার মনে থাকে না, মনে নেই- বি.এস.সি. স্যারের সিভিক্স্, রাষ্ট্র, নাগরিক এইসব।
মোতাহার ফকির আধা পীর দাবিদার, মাইজভাণ্ডারী মুরিদ। প্রায় সবকিছুই ‘আইধ্যাত্মিক’ বলে চালান করে। আনসার তার কাছে গিয়ে বলে, কও দেখি ফকির উদ্ভ্রান্ত, বিক্ষিপ্ত মাইনি কী? মোতাহার মাথা দুলিয়ে ‘জানি ধরনের’ উত্তর দিলে আনসার নিজেকে সেই উদ্ভ্রান্ত ও বিক্ষিপ্ত দাবি করে। মোতাহার ফকির নতুন সাগরেদ পেয়ে আধ্যাত্মিক উত্তর করে- ‘এই দুনিয়া তাইনের খেলা, দুইদিনের এই খেলাঘরত পুতুল যেমনি নাচায় তেমনি নাচে’, অনেকদিন পর মোতাহারের জটা বাবরি ঝাঁকানোর মোক্ষম সুযোগ যেনো। এরই মধ্যে আরও গভীর প্রশ্ন করে বসে আনসার- ‘ভাণ্ডার কও দেহি তাইলে তোমার নাগরিক কি তাইনে বানায়?’ মোতাহার আধ্যাত্মিক প্রশ্ন পেয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে উলটা শ্বাসে এক চিৎকার মারে, ইয়াহ্! গলায় মিহি সুরে বলে, ‘খালি নাগরিক না, গুড়ি পিঁপড়া, ওলা ডাইয়া, কচু-পাতা, রাজা-উজির সবই তাইনে নিজ হাতে বানায়।’ শান্ত আনসার মনেমনে ফকিরকে গালি দেয়- ‘হারামজাদায় নাগরিক কী তাই জানে না।’
তখন সময় ছিল ওইরকম যখন কিনা আনসার পুকুরপাড়ে ওই ঘটনা ঘটায়। কথা রাষ্ট্র হয় এইভাবে-তালুকদারের ফো নাজিমুদ্দিন ভালো দৌড়াইতে না পারলে মার্ডার হইয়া যাইত। আনসারের হাতে ছিল খেজুরের রসের জন্য গাছ-কাটা দাও। সদ্য সুপারির বাইল্লা কোঁচায় গাঙের রাঙা বালিতে ধার-ওঠানো চাঁদ-বাঁকা দা। এখন এর একটা বিহিত হবে। শিগগির হাটে এর বিচার সালিশ বসবে। সেরকম ব্যবস্থাই হচ্ছে। আনসারকেও দু-একজন এ খবর জানিয়েছে, আনসার তার কোনো জবাব করেনি যথারীতি। কিন্তু এরই মধ্যে একদিন সে যখন নৌকায় বার্ষিক আলকাতরা দেয়ার আগে তক্তার ফাঁকে গাব-কষ মাখানো ত্যানা কাপড় ঢুকিয়ে নাও ‘গায়’ তখন বদরু তালুকদার নিজে ওই পথে হাটের দিকে যায়। তালুকদার মুরুব্বির মতোই বলে- ‘আনসার, এলাকাবাসী তো তোমার বিচার চায়, এতে আমার কিছু করার নাই।’ আনসার বাঁটলের উপর হালকা হাতুড়ি পেটানো ‘নাও গাওয়া’ বন্ধ করে, ‘তালুকদার, এলাকাবাসীর সঙ্গে তো আমার কোনো কারবার নাই, আমার লগে কারবার নাইলে আপনের লগেই হইবে। আর এই আউশের গাছ-কাটা দা-ডা।’
এই বলে সে পাশের সুপারি গাছের বালি কোঁচায়, কিছু রাঙা বালি ঢেলে গাছ-কাটা দায়ে খিঁজ-খিঁজ শব্দে ধার ওঠানো শুরু করে। বালুর ঘষায় এই ধরনের খিঁজ-খিঁজ শব্দে বদরু তালুকদার কেনো, অনেকের গায়ের ভেতর গিজগিজ করে উঠে গা কাঁটা দিয়ে ঝাড়া মারে।
হাট পলিটিক্স দুই ভাগ হয়ে যায়। হতো না, রাঙা বালিতে গাছ-কাটা দায়ে আনসারের শান তোলা গপ্প ছড়িয়ে পরে, ফলে শত্রুপক্ষ স্লোগান দেয়- ‘আনসার ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন নেয়ামত-হাটে, আনসার ভাই এগিয়ে চলো...’। বিচার সালিশ আর বসে না। তবে এক রাতে তার ঘরের চালে দ্রিম দ্রিম শব্দে আধলা ইট পড়তে থাকে। আনসার হাতে পাঁচ-ব্যাটারির টর্চ-লাইট নিয়ে ‘মাউগের ফোয়রা খাড়া’ বলে ডান হাতে দা ঘোরায়। নতুন ব্যাটারির টর্চলাইটের আলো শান-তোলা দায়ে পড়ে কিছু প্রতিফলিত আলো বিচ্ছুরিত হয় নিঃসন্দেহে আধলা-ছোড়াদের চোখের উপর।
তালুকদারের শত্রুপক্ষের সমর্থন ও বিশ্বস্ত ভরসা চাঁদ-বাঁকা দা সাহস যোগায়। ছাত্র হিসেবে আনসার যত খারাপই হোক না কেনো তার পৌর-নীতি পাঠ কাজে আসে। রাষ্ট্রের নাগরিক, নাগরিকের অধিকার, তার নিরাপত্তা ও তার অবস্থান এসব সে ভালোভাবেই পড়ছে বলে ধারণা। সম্ভবত সে-কারণে আনসার সাহসী হতে পারে এক্ষেত্রে। কিন্তু রমেশ ধোপার স্ত্রী শীলারানী কাপড় কাচা বন্ধ করে মুড়া থেকে হাঁটু-পানির কিনারায় সেই যে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ানো শুরু করেছে সে-দৌড় থামানোর নিয়ন্ত্রণ আর তার কাছে থাকে না। শীলারানীর সে দৌড়ানোয় সহসাই যোগ হয় রমেশচন্দ্র। তাদের দৌড় থেমেছে কি না বা থামবে কি না তা কেউ বলতে পারছে না আপাতত। কেনোনা ক’দিন পরে রমেশ-শীলারানীদের বসতবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। কোথায় তারা চলে যায় বা গেছে সে-সম্পর্কে কেউ যে উচ্চারণ করে না তা নয়। তাদের সে-দৌড় আজও থেমেছে কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তারা যেখানেই থাক আনসারের পৌর-নীতির জ্ঞান অনুযায়ী নাগরিক হিসেবে সেখানেই-বা তার মর্যাদা ও স্বীকৃতি কে দেয়!
এরও কিছুদিন পর আর একটি ঘটনা ঘটে যায়। নেয়ামত-হাটে বিদাতা দোলাইগড়ের ‘প্রোঃ’ এর নাম হিসেবে দেখা যায় আনসার আলীর নাম। তাতে অনেক নাগরিক আনসারের ‘জাত’ বিষয়ক প্রশ্ন তুলে অভিমান করে, ক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু আনসারকে এই বাণিজ্য-বৃত্তি থেকে নির্বৃত্ত করা সম্ভব হয় না। সেই পুকুরের সেই গুঁড়ির উপর এখন আনসারের স্ত্রী কাপড় কাচে। এখন বিড়াল নাচুক আর যা-ই নাচুক বদরু তালুকদারের ছেলে সে-কথার সুরে কোন গান গাইতে পারে না। তা হলে সমঅধিকারের নাগরিক আনসারের গাছ-কাটা দাও প্রবলভাবে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নিউইয়র্ক, জুলই ১৯৯৫ ।
0 মন্তব্যসমূহ