আনোয়ার শাহাদাত
করম আলি ফকিরের পেট ভেতরে ঢুকে যে-পরিমাণ ভাঁজ পড়েছে তাতে ঠিক আড়াই সের ধান গোঁজা যাবে। ঘুণে-কাটা ভঙ্গুর খাঁচার মতন বুকখানা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। ডিঙি-নৌকার ভাঁজ-সাদৃশ্য লাভ করেছে তার ছয়-ছোট্ট দেহ।
কুঁজো দেয়া সেই ডোঙ্গা-করম-আলি নুয়ে পড়ে হাঁটু মাটিতে গেড়ে মন্ত্র পড়ে। দ্রুত পাঠরত মন্ত্র সপ্তস্বরে পৌঁছার অংশে হালকা ভেজা মাটিতে থাপ্পড় মারে। ঘরের চাল-বাঁধুনি বাঁশনী খোলার মতো মাটিতে থাপ্পড়ের চড়াৎ-চড়াৎ শব্দে চমকে ওঠে ক্যাথলিন। অভ্যাসবশত এক ফাঁকে মাথা থেকে হাতে তেল মেখে নেয় করম আলি ফকির। মন্ত্র পড়ার মধ্যে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা ও সুরে তার মাথার সয়াবিন তেল মাখানোর ইতিহাস বর্ণিত থাকে।
গড়গড় করে লাটাইর সুতা ছাড়ার সময় ঘুড়ি খুব ঢিলেঢালা কাত হয়ে যায় যেমন, করম আলি তেমনি কাত হয়, বাম হাত আসমানের দিকে ওঠে, ডান হাত জমিনে থাপ্পড় কেটে সেই আর্জি, পীর-দরবেশের নামে নির্দেশের হুংকার ছাড়ে- ‘যা হারামজাদি তিনমাথার পেতনি, গিরিজা গরের উফর দিয়া দক্ষিণ কোলায় পইররা হুগনা ক্ষেতের শামুক খা।’ হুংকারের স্বর ছেড়ে নরম স্বরে ফেরে ফকির ডোঙ্গা ‘কও বাছা, কও তওবা।’
এ-পর্যায়ে ক্যাথলিনের চোখের ও দেহের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় তিন-মাথার পেতনি করম আলির নির্দেশে দক্ষিণের মাঠে শামুক খেতে যাচ্ছে না। বরং ক্যাথলিনের চোখকে মৃত মাছের চোখে পরিণত করে নিশ্চল হয়েছে তার মধ্যে।
করম আলি ফকিরকে খবর দেয়া হয় দুপুরে। যখন শ্যাম বারৈ এপারে পান বিক্রি করে খালের ওপারে গিয়ে গামছা পালটিয়ে লুঙ্গি পরে তখন এপার থেকে মার্টিনা শ্যামকে ডাকে। তার আগে শ্যাম ঝাঁকি-জাল ফিকতে থাকা মোল্লার প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে- ‘না দাদু, ধুতি খালি গুন পোহে কাডে, আর সাদ্যের দাম, লঙ্গির দামও কোম আর জাত-ফাতও বোঝন যায় না।’ মার্টিনা তখন এপারে খেজুর-গাছের ঘাটের উপর বসে ছাই আর কুটার লসমা দিয়ে বাটি মাজা বন্ধ করে শ্যাম বারৈ-কে ডাকে- ‘ও শ্যাম যাদু, তুমি যদি উত্তর কান্দা যাও ডোঙ্গা করম আলি ফহিরেরে কইও মোগোর মায়র টান ওটছে, হে য্যান আইয়া এটটু তোবা পড়াইয়া যায়।’
শ্যাম বারৈ তখন উপলব্ধি করতে পারে দীর্ঘদিন পর আজ সে ক্যাথলিনের ঘরের পাশ দিয়ে আসার সময় তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়নি,- ‘ও শ্যাম নাগর, কুশলে আচোনি, বও, এক খিল্লি পান খাইয়া যাও’ -হ্যাঁ, একথাটি তো শ্যাম শোনেনি কতকাল হয়ে গেছে। শ্যামকান্তি বারৈ'র বুকের কোথাও খবর হয়ে যায় যেন কালবোশেখি ঝড়ে গাছগুলো উলটে রেখে গেছে মুড়ো-সুদ্ধ, যোগী-নাথের ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে বিলের মাঝে। শ্যাম আবার গামছা পরে। এক-গণ্ডা পান হাতে খালের এপারে এসে মার্টিনার কাছে দিয়ে উত্তর কান্দার দিকে চলে যায়। কালবোশেখি ঝড়ের পর ফ্যাকাসে প্রকৃতি তার মনে ভর করেছে।
নির্ধারণ অসম্ভব এবং অ-নিরীক্ষিত বিধায় ‘ক্ষয়রোগ’ নাম নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আর একটি মৃত্যুর ঘটনা এলো মাত্র। করম আলি ফকির সেখানে সামান্য মৃত্যু-অনুষ্ঠানের রীতি-কর্মটুকুর সহযোগিতার জন্য। সে তার সাধ্যমতো মৃত্যুত্তর ক্যাথলিনের আত্মার মঙ্গলের স্বার্থে ইহ-জাগতিক প্রচেষ্টার যাবতীয় অনুষঙ্গগুলো সম্পাদন করেছে। মৃত্যু-জগতে প্রস্থানের আগে ‘তওবা’ই সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর মন্ত্র, মৃত্যুপর-জগতের জন্য এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি-নির্ভর তওবা-প্রক্রিয়া চলছে ক্যাথলিনের। ক্যাথলিন এই নিঃশেষ অবস্থায় যেমন এর আগেও তেমনি তওবা কেন প্রায় কিছুই ইহ-জাগতিক কি পর-জাগতিক সম্পর্কে অজ্ঞ।
ক্যাথলিনের জীবন গেছে শুধু বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে। কে বড়, কেমন করে যিশু না ঈশ্বর সে তার জানা নেই। প্রত্যাশিত জিনিস কে দিতে পারে, চাইলে যিশু না গড, নাকি সব ভাঁওতাবাজি কিছুই জানে না, বোঝেও-নি, তার দরকারও পড়েনি কখনো। এসবের প্রতি অপ্রাসঙ্গিক আগ্রহ কি বিদ্বেষ এর কোনোটাই হয়নি। যতটুকু সে শুনেছে লোকমুখে এখানে-সেখানে। ক্যাথলিন একা কেন, ফিরিঙ্গি-পাড়ার সবারই ওই হাল। আর শুধু ফিরিঙ্গি-পাড়াই-বা হবে কেন, লজ্জাবতী গ্রামের হিন্দুরা কি শেখেরা সবারই এই অবস্থা। ভাঙাচোরা হলেও উপাসনালয় আছে সবার, অথচ ধার্মিকদের পদচারণাহীন সে বড় অবহেলিত। কোনো এক বছর পাদ্রি-শিবপুর থেকে ফাদার ড্যানিয়েল এসে বলেছিলেন- ‘টোমরা সম্ভব অলে রবিবারে অন্টট প্রার্টনায় আসপে, গির্জাকে ক্লিন রাখপে’।
ফলে তওবা সম্পর্কে করম আলি ফকিরের নিজেরই তেমন কিছু জানা নেই। আর খেরেস্তান ধর্মমতে করম আলিদের ধর্মের তওবা কীভাবে কতটুকু ক্যাথলিনের মৃত্যুত্তর জীবনে কার্যকর হবে তাই-বা কে জানে! না করম আলি, না ক্যাথলিনের মেয়ে মার্টিনা, না শ্যামকান্তি বারৈ। ক্যাথলিন তো তওবার নামই শোনেনি বাক ও হুঁশ হারাবার আগে। তওবার কথা শুনেছে মার্টিনা। গির্জা-ঘরে নয় অন্য কোথায়, মৃত্যুত্তর আত্মার শান্তিও মন্ত্র উচ্চারণ, শেষ নিঃশেষের আগে। তার মায়ের জন্যও নিশ্চয়ই প্রযোজ্য হবে ভেবে শ্যামকান্তি বারৈ-কে দিয়ে করম আলি ফকিরকে খবর দেয়া হয়।
অক্ষরজ্ঞানহীন করম আলি ফকিরের কাছে ধর্ম এক অলৌকিক জারিগানের অসমাপ্ত কিসসা। বহুজন বহু বয়ানে বর্ণনা করে, কোনো এক জোছনা-রাতে চৈত্রের শুকনো ধানক্ষেতে হোগলা পাটিতে মোড়ানো প্যান্ডেলে শোনা ভিনদেশি বয়াতির ভৌতিক গল্প। পুরো এলাকার মানুষের কাছেই ধর্মের বিষয়টি এমন করে আসে। তারই মধ্যে কিনা করম আলি ফকির অজ্ঞাত ‘তরিকা’র কথা দু-চারজনকে শোনায় খাল-পারের দোকান-ঘাটে। কোনো একজন ‘তুমি দর্মের জানো-ডা কী’ প্রশ্নের উত্তরে করম আলি পাশের কিশোরকে টেনে তার কানটা বুকের বাম দিকে চেপে ধরে।
কী, কী হোলো?
হুনি তোমার বুহের মধ্যে পাড় পারণের দরফর শব্দ।
শব্দে কী কয়?
কইবে আবার কী, ভর-ভর ভর-ভর শব্দ খালি!
না, কয় এল, এল, এল, মাইনে দিলের মইদ্যে আল্লার নাম।
দিলের মইদ্যে মাবুদের আপনি নাম চলছে বলে করম আলি ব্যক্তিগত অজ্ঞতা ঢেকে রাখে, আর এক ‘তরিকার’ কথা বলে-
হোনো মেয়ারা, মুই অইলাম যাইয়া আজমির শরিফের পীর-ছায়েবের তরিকানা বান্দা, দুইন্নার-কারবার অইলে সব ‘দিলে-দিলে’।
করম আলি মাটিতে থাপ্পড় করে আসমান-কাঁপানো, অতঃপর শূন্যে লাফায়-
মওলা রে, তুই হের দুইন্নের পাপ ভুইলে যা।
মার্টিনা এ-ফাঁকে ফকিরের সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। করম আলি মার্টিনার কথা বলার ইঙ্গিতকে তওবা পড়ানোর খেমটা নৃত্যের মধ্যে হারিয়ে দেয়। মার্টিনা তার পরও বলে-
‘মায় কইতো হে কোনোদিন কোনো পাপ করে নাই, খালি ছোড-কালে একদিন বড় পাপার হোয়া চুরি হইররা খাইচে, আর কোনো পাপ নাই।’
চাচার ঝাঁকের শসা চুরি করে বালিকার খাওয়ার পাপ ‘মওলা’র ভুলে যাওয়া দরকার আছে কি না মার্টিনার সে-প্রসঙ্গের উত্তর করার দরকার মনে করে না করম আলি। সে তার তওবা লম্ফ-নৃত্য এবং সুরেলা বিলাপ অজ্ঞাত শক্তিধরের কাছে যথারীতি জানাতে থাকে-
তুমি তাহের বুঝবা কী ছেড়ী, এই দুইন্নাইতে জরমানোই অইল যাইয়া পাপ, হেই পাপই তারে মুই ভুইল্লা যাওনের আব্দার হরতাছি।
ক্যাথলিনের কী পাপ সারাজীবনের রয়েছে। শৈশবে পাশের বাড়ির ম্যাগডোনের সঙ্গে ‘কোল’ বিয়ে। কৈশোরে ম্যাগডোনের সঙ্গে সাংসারিক জীবনের শুরু। তিনমাসের মাথায় ম্যাগডোন চট্টগ্রামে সাহেবের বাড়ির দারোয়ানের কাজে যায়। যাওয়ার সময় আরও তিনমাসের খোরাকি দেড় কাঠি চাল, পাতাবাহার ছাপার একজোড়া শাড়ি-কাপড় রেখে যায়। পূর্বদিকের বাড়ির ডোমেনিক সে-বছর কার্তিকে দেশে আসে চট্টগ্রাম থেকে। দুটো-একটা স্নো-পাউডারসহ ক্যাথলিনকে খবর দেয়- ম্যাকডোন পত্তর লেখে না, লেখানোর লোক নাই, সামনের পৌষে আসবে, থাকবে ফাল্গুন তক বলেছে। কত দীর্ঘ সে-কাল পৌষ আসার তা ক্যাথলিন ছাড়া আর কারও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু পৌষ এলে ফাল্গুনও চলে যায় চোখের পলকে। আসে না কেউ। একদিন আষাঢ়ের বর্ষায় চট্টগ্রাম থেকে ফেরে ডোমেনিক। কী সুন্দর এক ‘ফটোক’ ছবি ধরিয়ে দেয় ক্যাথলিনকে, সাদা-কালো রঙের কাশবনের মধ্যে সিমেন্ট-করা এক অসাধারণ ক্রোস লাগানো কবর। লজ্জাবতী গ্রামের ফিরিঙ্গি-পাড়ার কার-না স্বপ্ন অমন একটি সিমেন্ট ক্রোস লাগানো কবর হোক! কিন্তু ম্যাগডোন ছাড়া আর কার ভাগ্যে এমন সুলেখন! পুরো এলাকার বুক ফুলে গেছে যেন গর্বে।
আশ্চর্য ‘ফটোক’ দেড় বছরের মার্টিনা কী আনন্দে শিশুর লালায় ভিজিয়ে ভগ্নাংশ খেয়ে ফেলে। ক্যাথলিন দৌড়ে এসে মার্টিনাকে কোলে নেয়- ‘খাইয়া হালাইলিরে মা!’
তখন কথা একটি ওঠে- মার্টিনা কি ম্যাগডোনের মেয়ে? এত দারিদ্র্যের মধ্যেও এ ধরনের কুৎসা থামে না। যারা করার তার ক্ষুধা-পেটে আদলা মাটির চাকা পেটে চেপে ধরে চালিয়ে যায়। ক্যাথলিন তার বুকে চেপে ধরে মেয়ে মার্টিনাকে- ‘তুই ম্যাকডোনের মাইয়া না অও যাইয়া কাইল্লা কুত্তাডার মাইয়া, হেতে কার লাবই-বা কী, লোকসানই-বা কী!’
এরপর এতকাল বছরগুলো ঘুরে এসেছে কালবোশেখি নিয়ে। শিলাবৃষ্টি পড়েছে কখনো মাঠ ডুবিয়ে, মা-মেয়ে কুড়িয়েছে কাঁচা আম ও ভাঙ্গা ডাল। ঝড়-আক্রান্ত পাখির জন্য মন কেঁদেছে ক্যাথলিনের ও মার্টিনার। নিশুতি সেসব রাত কখনো বর্ষার কখনো মাঘের, এসে চলে গেছে বসন্ত-রাতও কারও ফিরে আসার সম্ভাবনাহীন। ক্যাথলিনের একটিও রাত অর্থপূর্ণ করেনি যিশু। নিজের ব্যর্থতা আখ্যায়নের জ্ঞান তো গডই বোধ করি ক্যাথলিনের কাছ থেকে কেড়েছে।
শ্যামকান্তি বারৈ অলস দুপুরে মাথার সাজি নামিয়ে একমুঠো চাল মুখে পুরে জল চেয়েছে ক্যাথলিনের কাছে। ফিটকিরি-দেয়া দিঘির জল জামবাটিতে ভাগাভাগি করে খেয়েছে কখনো ক্যাথলিন শ্যামকান্তির আর এক মুঠো চাল দিয়ে। ডালা খুলে শালপাতার বিড়ি বৌল-গন্ধের আগুনে জ্বালিয়েছে শ্যাম। সে-বিড়িতে ক্যাথলিন দম দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে তাকিয়ে থেকেছে দক্ষিণের পথে বাবুইপাখির বাসায় ভরপুর তালগাছের নিচে, যে-পথে কোনো একদিন ফেরার কথা ছিল ম্যাগডোনের।
করম আলি পানের পিক তুষের আগুনের পাত্র আউত্তায় ফেলে একতারা-ডুমবরা ও আঙুলের টাক্কায় চোখ বন্ধ করে গান গেয়েছে কখনো- ‘নিরিখ বন্দরে দুই নয়নে, নিরিখ বন্দরে ভুইল না মন তাহারে- -’।
ক্যাথলিনও তখন বারান্দায় মুগ্ধ হয়ে মুক্তার খোঁজে ডুব দিতে চেয়েছে, সম্ভবত মন তারও হয়তো ডোবোনি। সেই করম আলি ফকিরই তখন খেজুরের মিঠায় গোলানো জল নারিকেলের আইচার মালাই দিয়ে ক্যাথলিনের মুখে দিচ্ছে। এই সন্ধ্যায়ই বাবুইপাখির বাসায় ভরা তালগাছের নিচ দিয়ে শ্যামকান্তি বারৈ আসে। বিকেলে সে-পথেই আসতে হয়েছে করম আলি ফকিরকে।
‘করম আলি তোমারে যেন কইচে, “মৌয়তের কালে ক্যাথলিনরে দেখফার কেউ নাই পারলে যাইও” বাড়তে যাইয়া মোরও মনে অইচে ক্যাথলিন একদিন কইচে “ও শ্যাম তোমার ভগবানরে কইতে পার এটুটু সুখ-শান্তি যেন হের ভাণ্ড দিয়া মোর ভাগে দেয়”।’
ভেবে নেয়া যেতে পারে ক্যাথলিনের চোখ দেখছে, ম্যাকডোনের আসার পথে বাবুই-পাখির বাসা ভরা তালগাছ তলার ‘ছিললা’ পথে আসে করম আলি, শ্যামকান্তি ও মার্টিনা।
‘মেয়েছেলের নাড়ির শেষটুকু সজীব থাকে বাম হাতে’ এ বিশ্বাসে করম আলি ক্যাথলিনের ডান হাত বদলিয়ে বাম হাত ধরে। বাম হাতও ছেড়ে দিয়ে আর এক-দফা শূন্যে লাফায়- ‘অই যে বাইর অইয়া গেল লগের পেতনি-ডা’- শ্যাম বারৈ আঙ্গুল দিয়ে দেখায় গির্জা-ঘরের পাশের কবরস্থানের উপর বড় একটি ক্রোসের দিকে।
‘দ্যাক শ্যাম দ্যাক, ঐ যায় তক্তার ক্রুসটারে একটা ধাক্কা মাইররা, তয় হারামজাদি ক্যাথলিনের ধর-ডারে-ই খালি থুইয়া গেলে।’
করম আলি ফকিরের কথায় স্পষ্ট হয়, সে কিছু দেখতে পাচ্ছে, ক্রোসটাকে ধাক্কা মেরে দক্ষিণের ক্ষেতের দিকে যেতে। শ্যামকান্তিও চোখ কুঁচকিয়ে চোখে জোর এনে দেখার চেষ্টা করে।
-কীরে শ্যাম, দেহনিরে কিচু?
-দেহি ঝাপসা করম।
ওই ঝাপসা-ইরে শ্যাম, ঝাপসা, দুন্নইডাই ঝাপসা!
মাছ নয় বলে মার্টিনা ক্যাথলিনের ঝাপসা জগৎ দেখার চোখ বুজিয়ে অন্ধকার জগতে যেতে সহযোগিতা করে। না চাইলেও তার ভারী দীর্ঘশ্বাস মরার বাড়িতে লুটোপুটি করে, যে-দীর্ঘশ্বাসের ভার যে-কোনো মানুষের কাঁধে চাপ দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে।
নিউইয়র্ক, এপ্রিল ’৯৬
করম আলি ফকিরের পেট ভেতরে ঢুকে যে-পরিমাণ ভাঁজ পড়েছে তাতে ঠিক আড়াই সের ধান গোঁজা যাবে। ঘুণে-কাটা ভঙ্গুর খাঁচার মতন বুকখানা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। ডিঙি-নৌকার ভাঁজ-সাদৃশ্য লাভ করেছে তার ছয়-ছোট্ট দেহ।
কুঁজো দেয়া সেই ডোঙ্গা-করম-আলি নুয়ে পড়ে হাঁটু মাটিতে গেড়ে মন্ত্র পড়ে। দ্রুত পাঠরত মন্ত্র সপ্তস্বরে পৌঁছার অংশে হালকা ভেজা মাটিতে থাপ্পড় মারে। ঘরের চাল-বাঁধুনি বাঁশনী খোলার মতো মাটিতে থাপ্পড়ের চড়াৎ-চড়াৎ শব্দে চমকে ওঠে ক্যাথলিন। অভ্যাসবশত এক ফাঁকে মাথা থেকে হাতে তেল মেখে নেয় করম আলি ফকির। মন্ত্র পড়ার মধ্যে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা ও সুরে তার মাথার সয়াবিন তেল মাখানোর ইতিহাস বর্ণিত থাকে।
গড়গড় করে লাটাইর সুতা ছাড়ার সময় ঘুড়ি খুব ঢিলেঢালা কাত হয়ে যায় যেমন, করম আলি তেমনি কাত হয়, বাম হাত আসমানের দিকে ওঠে, ডান হাত জমিনে থাপ্পড় কেটে সেই আর্জি, পীর-দরবেশের নামে নির্দেশের হুংকার ছাড়ে- ‘যা হারামজাদি তিনমাথার পেতনি, গিরিজা গরের উফর দিয়া দক্ষিণ কোলায় পইররা হুগনা ক্ষেতের শামুক খা।’ হুংকারের স্বর ছেড়ে নরম স্বরে ফেরে ফকির ডোঙ্গা ‘কও বাছা, কও তওবা।’
এ-পর্যায়ে ক্যাথলিনের চোখের ও দেহের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় তিন-মাথার পেতনি করম আলির নির্দেশে দক্ষিণের মাঠে শামুক খেতে যাচ্ছে না। বরং ক্যাথলিনের চোখকে মৃত মাছের চোখে পরিণত করে নিশ্চল হয়েছে তার মধ্যে।
করম আলি ফকিরকে খবর দেয়া হয় দুপুরে। যখন শ্যাম বারৈ এপারে পান বিক্রি করে খালের ওপারে গিয়ে গামছা পালটিয়ে লুঙ্গি পরে তখন এপার থেকে মার্টিনা শ্যামকে ডাকে। তার আগে শ্যাম ঝাঁকি-জাল ফিকতে থাকা মোল্লার প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে- ‘না দাদু, ধুতি খালি গুন পোহে কাডে, আর সাদ্যের দাম, লঙ্গির দামও কোম আর জাত-ফাতও বোঝন যায় না।’ মার্টিনা তখন এপারে খেজুর-গাছের ঘাটের উপর বসে ছাই আর কুটার লসমা দিয়ে বাটি মাজা বন্ধ করে শ্যাম বারৈ-কে ডাকে- ‘ও শ্যাম যাদু, তুমি যদি উত্তর কান্দা যাও ডোঙ্গা করম আলি ফহিরেরে কইও মোগোর মায়র টান ওটছে, হে য্যান আইয়া এটটু তোবা পড়াইয়া যায়।’
শ্যাম বারৈ তখন উপলব্ধি করতে পারে দীর্ঘদিন পর আজ সে ক্যাথলিনের ঘরের পাশ দিয়ে আসার সময় তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়নি,- ‘ও শ্যাম নাগর, কুশলে আচোনি, বও, এক খিল্লি পান খাইয়া যাও’ -হ্যাঁ, একথাটি তো শ্যাম শোনেনি কতকাল হয়ে গেছে। শ্যামকান্তি বারৈ'র বুকের কোথাও খবর হয়ে যায় যেন কালবোশেখি ঝড়ে গাছগুলো উলটে রেখে গেছে মুড়ো-সুদ্ধ, যোগী-নাথের ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে বিলের মাঝে। শ্যাম আবার গামছা পরে। এক-গণ্ডা পান হাতে খালের এপারে এসে মার্টিনার কাছে দিয়ে উত্তর কান্দার দিকে চলে যায়। কালবোশেখি ঝড়ের পর ফ্যাকাসে প্রকৃতি তার মনে ভর করেছে।
নির্ধারণ অসম্ভব এবং অ-নিরীক্ষিত বিধায় ‘ক্ষয়রোগ’ নাম নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আর একটি মৃত্যুর ঘটনা এলো মাত্র। করম আলি ফকির সেখানে সামান্য মৃত্যু-অনুষ্ঠানের রীতি-কর্মটুকুর সহযোগিতার জন্য। সে তার সাধ্যমতো মৃত্যুত্তর ক্যাথলিনের আত্মার মঙ্গলের স্বার্থে ইহ-জাগতিক প্রচেষ্টার যাবতীয় অনুষঙ্গগুলো সম্পাদন করেছে। মৃত্যু-জগতে প্রস্থানের আগে ‘তওবা’ই সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর মন্ত্র, মৃত্যুপর-জগতের জন্য এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি-নির্ভর তওবা-প্রক্রিয়া চলছে ক্যাথলিনের। ক্যাথলিন এই নিঃশেষ অবস্থায় যেমন এর আগেও তেমনি তওবা কেন প্রায় কিছুই ইহ-জাগতিক কি পর-জাগতিক সম্পর্কে অজ্ঞ।
ক্যাথলিনের জীবন গেছে শুধু বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে। কে বড়, কেমন করে যিশু না ঈশ্বর সে তার জানা নেই। প্রত্যাশিত জিনিস কে দিতে পারে, চাইলে যিশু না গড, নাকি সব ভাঁওতাবাজি কিছুই জানে না, বোঝেও-নি, তার দরকারও পড়েনি কখনো। এসবের প্রতি অপ্রাসঙ্গিক আগ্রহ কি বিদ্বেষ এর কোনোটাই হয়নি। যতটুকু সে শুনেছে লোকমুখে এখানে-সেখানে। ক্যাথলিন একা কেন, ফিরিঙ্গি-পাড়ার সবারই ওই হাল। আর শুধু ফিরিঙ্গি-পাড়াই-বা হবে কেন, লজ্জাবতী গ্রামের হিন্দুরা কি শেখেরা সবারই এই অবস্থা। ভাঙাচোরা হলেও উপাসনালয় আছে সবার, অথচ ধার্মিকদের পদচারণাহীন সে বড় অবহেলিত। কোনো এক বছর পাদ্রি-শিবপুর থেকে ফাদার ড্যানিয়েল এসে বলেছিলেন- ‘টোমরা সম্ভব অলে রবিবারে অন্টট প্রার্টনায় আসপে, গির্জাকে ক্লিন রাখপে’।
ফলে তওবা সম্পর্কে করম আলি ফকিরের নিজেরই তেমন কিছু জানা নেই। আর খেরেস্তান ধর্মমতে করম আলিদের ধর্মের তওবা কীভাবে কতটুকু ক্যাথলিনের মৃত্যুত্তর জীবনে কার্যকর হবে তাই-বা কে জানে! না করম আলি, না ক্যাথলিনের মেয়ে মার্টিনা, না শ্যামকান্তি বারৈ। ক্যাথলিন তো তওবার নামই শোনেনি বাক ও হুঁশ হারাবার আগে। তওবার কথা শুনেছে মার্টিনা। গির্জা-ঘরে নয় অন্য কোথায়, মৃত্যুত্তর আত্মার শান্তিও মন্ত্র উচ্চারণ, শেষ নিঃশেষের আগে। তার মায়ের জন্যও নিশ্চয়ই প্রযোজ্য হবে ভেবে শ্যামকান্তি বারৈ-কে দিয়ে করম আলি ফকিরকে খবর দেয়া হয়।
অক্ষরজ্ঞানহীন করম আলি ফকিরের কাছে ধর্ম এক অলৌকিক জারিগানের অসমাপ্ত কিসসা। বহুজন বহু বয়ানে বর্ণনা করে, কোনো এক জোছনা-রাতে চৈত্রের শুকনো ধানক্ষেতে হোগলা পাটিতে মোড়ানো প্যান্ডেলে শোনা ভিনদেশি বয়াতির ভৌতিক গল্প। পুরো এলাকার মানুষের কাছেই ধর্মের বিষয়টি এমন করে আসে। তারই মধ্যে কিনা করম আলি ফকির অজ্ঞাত ‘তরিকা’র কথা দু-চারজনকে শোনায় খাল-পারের দোকান-ঘাটে। কোনো একজন ‘তুমি দর্মের জানো-ডা কী’ প্রশ্নের উত্তরে করম আলি পাশের কিশোরকে টেনে তার কানটা বুকের বাম দিকে চেপে ধরে।
কী, কী হোলো?
হুনি তোমার বুহের মধ্যে পাড় পারণের দরফর শব্দ।
শব্দে কী কয়?
কইবে আবার কী, ভর-ভর ভর-ভর শব্দ খালি!
না, কয় এল, এল, এল, মাইনে দিলের মইদ্যে আল্লার নাম।
দিলের মইদ্যে মাবুদের আপনি নাম চলছে বলে করম আলি ব্যক্তিগত অজ্ঞতা ঢেকে রাখে, আর এক ‘তরিকার’ কথা বলে-
হোনো মেয়ারা, মুই অইলাম যাইয়া আজমির শরিফের পীর-ছায়েবের তরিকানা বান্দা, দুইন্নার-কারবার অইলে সব ‘দিলে-দিলে’।
করম আলি মাটিতে থাপ্পড় করে আসমান-কাঁপানো, অতঃপর শূন্যে লাফায়-
মওলা রে, তুই হের দুইন্নের পাপ ভুইলে যা।
মার্টিনা এ-ফাঁকে ফকিরের সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। করম আলি মার্টিনার কথা বলার ইঙ্গিতকে তওবা পড়ানোর খেমটা নৃত্যের মধ্যে হারিয়ে দেয়। মার্টিনা তার পরও বলে-
‘মায় কইতো হে কোনোদিন কোনো পাপ করে নাই, খালি ছোড-কালে একদিন বড় পাপার হোয়া চুরি হইররা খাইচে, আর কোনো পাপ নাই।’
চাচার ঝাঁকের শসা চুরি করে বালিকার খাওয়ার পাপ ‘মওলা’র ভুলে যাওয়া দরকার আছে কি না মার্টিনার সে-প্রসঙ্গের উত্তর করার দরকার মনে করে না করম আলি। সে তার তওবা লম্ফ-নৃত্য এবং সুরেলা বিলাপ অজ্ঞাত শক্তিধরের কাছে যথারীতি জানাতে থাকে-
তুমি তাহের বুঝবা কী ছেড়ী, এই দুইন্নাইতে জরমানোই অইল যাইয়া পাপ, হেই পাপই তারে মুই ভুইল্লা যাওনের আব্দার হরতাছি।
ক্যাথলিনের কী পাপ সারাজীবনের রয়েছে। শৈশবে পাশের বাড়ির ম্যাগডোনের সঙ্গে ‘কোল’ বিয়ে। কৈশোরে ম্যাগডোনের সঙ্গে সাংসারিক জীবনের শুরু। তিনমাসের মাথায় ম্যাগডোন চট্টগ্রামে সাহেবের বাড়ির দারোয়ানের কাজে যায়। যাওয়ার সময় আরও তিনমাসের খোরাকি দেড় কাঠি চাল, পাতাবাহার ছাপার একজোড়া শাড়ি-কাপড় রেখে যায়। পূর্বদিকের বাড়ির ডোমেনিক সে-বছর কার্তিকে দেশে আসে চট্টগ্রাম থেকে। দুটো-একটা স্নো-পাউডারসহ ক্যাথলিনকে খবর দেয়- ম্যাকডোন পত্তর লেখে না, লেখানোর লোক নাই, সামনের পৌষে আসবে, থাকবে ফাল্গুন তক বলেছে। কত দীর্ঘ সে-কাল পৌষ আসার তা ক্যাথলিন ছাড়া আর কারও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু পৌষ এলে ফাল্গুনও চলে যায় চোখের পলকে। আসে না কেউ। একদিন আষাঢ়ের বর্ষায় চট্টগ্রাম থেকে ফেরে ডোমেনিক। কী সুন্দর এক ‘ফটোক’ ছবি ধরিয়ে দেয় ক্যাথলিনকে, সাদা-কালো রঙের কাশবনের মধ্যে সিমেন্ট-করা এক অসাধারণ ক্রোস লাগানো কবর। লজ্জাবতী গ্রামের ফিরিঙ্গি-পাড়ার কার-না স্বপ্ন অমন একটি সিমেন্ট ক্রোস লাগানো কবর হোক! কিন্তু ম্যাগডোন ছাড়া আর কার ভাগ্যে এমন সুলেখন! পুরো এলাকার বুক ফুলে গেছে যেন গর্বে।
আশ্চর্য ‘ফটোক’ দেড় বছরের মার্টিনা কী আনন্দে শিশুর লালায় ভিজিয়ে ভগ্নাংশ খেয়ে ফেলে। ক্যাথলিন দৌড়ে এসে মার্টিনাকে কোলে নেয়- ‘খাইয়া হালাইলিরে মা!’
তখন কথা একটি ওঠে- মার্টিনা কি ম্যাগডোনের মেয়ে? এত দারিদ্র্যের মধ্যেও এ ধরনের কুৎসা থামে না। যারা করার তার ক্ষুধা-পেটে আদলা মাটির চাকা পেটে চেপে ধরে চালিয়ে যায়। ক্যাথলিন তার বুকে চেপে ধরে মেয়ে মার্টিনাকে- ‘তুই ম্যাকডোনের মাইয়া না অও যাইয়া কাইল্লা কুত্তাডার মাইয়া, হেতে কার লাবই-বা কী, লোকসানই-বা কী!’
এরপর এতকাল বছরগুলো ঘুরে এসেছে কালবোশেখি নিয়ে। শিলাবৃষ্টি পড়েছে কখনো মাঠ ডুবিয়ে, মা-মেয়ে কুড়িয়েছে কাঁচা আম ও ভাঙ্গা ডাল। ঝড়-আক্রান্ত পাখির জন্য মন কেঁদেছে ক্যাথলিনের ও মার্টিনার। নিশুতি সেসব রাত কখনো বর্ষার কখনো মাঘের, এসে চলে গেছে বসন্ত-রাতও কারও ফিরে আসার সম্ভাবনাহীন। ক্যাথলিনের একটিও রাত অর্থপূর্ণ করেনি যিশু। নিজের ব্যর্থতা আখ্যায়নের জ্ঞান তো গডই বোধ করি ক্যাথলিনের কাছ থেকে কেড়েছে।
শ্যামকান্তি বারৈ অলস দুপুরে মাথার সাজি নামিয়ে একমুঠো চাল মুখে পুরে জল চেয়েছে ক্যাথলিনের কাছে। ফিটকিরি-দেয়া দিঘির জল জামবাটিতে ভাগাভাগি করে খেয়েছে কখনো ক্যাথলিন শ্যামকান্তির আর এক মুঠো চাল দিয়ে। ডালা খুলে শালপাতার বিড়ি বৌল-গন্ধের আগুনে জ্বালিয়েছে শ্যাম। সে-বিড়িতে ক্যাথলিন দম দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে তাকিয়ে থেকেছে দক্ষিণের পথে বাবুইপাখির বাসায় ভরপুর তালগাছের নিচে, যে-পথে কোনো একদিন ফেরার কথা ছিল ম্যাগডোনের।
করম আলি পানের পিক তুষের আগুনের পাত্র আউত্তায় ফেলে একতারা-ডুমবরা ও আঙুলের টাক্কায় চোখ বন্ধ করে গান গেয়েছে কখনো- ‘নিরিখ বন্দরে দুই নয়নে, নিরিখ বন্দরে ভুইল না মন তাহারে- -’।
ক্যাথলিনও তখন বারান্দায় মুগ্ধ হয়ে মুক্তার খোঁজে ডুব দিতে চেয়েছে, সম্ভবত মন তারও হয়তো ডোবোনি। সেই করম আলি ফকিরই তখন খেজুরের মিঠায় গোলানো জল নারিকেলের আইচার মালাই দিয়ে ক্যাথলিনের মুখে দিচ্ছে। এই সন্ধ্যায়ই বাবুইপাখির বাসায় ভরা তালগাছের নিচ দিয়ে শ্যামকান্তি বারৈ আসে। বিকেলে সে-পথেই আসতে হয়েছে করম আলি ফকিরকে।
‘করম আলি তোমারে যেন কইচে, “মৌয়তের কালে ক্যাথলিনরে দেখফার কেউ নাই পারলে যাইও” বাড়তে যাইয়া মোরও মনে অইচে ক্যাথলিন একদিন কইচে “ও শ্যাম তোমার ভগবানরে কইতে পার এটুটু সুখ-শান্তি যেন হের ভাণ্ড দিয়া মোর ভাগে দেয়”।’
ভেবে নেয়া যেতে পারে ক্যাথলিনের চোখ দেখছে, ম্যাকডোনের আসার পথে বাবুই-পাখির বাসা ভরা তালগাছ তলার ‘ছিললা’ পথে আসে করম আলি, শ্যামকান্তি ও মার্টিনা।
‘মেয়েছেলের নাড়ির শেষটুকু সজীব থাকে বাম হাতে’ এ বিশ্বাসে করম আলি ক্যাথলিনের ডান হাত বদলিয়ে বাম হাত ধরে। বাম হাতও ছেড়ে দিয়ে আর এক-দফা শূন্যে লাফায়- ‘অই যে বাইর অইয়া গেল লগের পেতনি-ডা’- শ্যাম বারৈ আঙ্গুল দিয়ে দেখায় গির্জা-ঘরের পাশের কবরস্থানের উপর বড় একটি ক্রোসের দিকে।
‘দ্যাক শ্যাম দ্যাক, ঐ যায় তক্তার ক্রুসটারে একটা ধাক্কা মাইররা, তয় হারামজাদি ক্যাথলিনের ধর-ডারে-ই খালি থুইয়া গেলে।’
করম আলি ফকিরের কথায় স্পষ্ট হয়, সে কিছু দেখতে পাচ্ছে, ক্রোসটাকে ধাক্কা মেরে দক্ষিণের ক্ষেতের দিকে যেতে। শ্যামকান্তিও চোখ কুঁচকিয়ে চোখে জোর এনে দেখার চেষ্টা করে।
-কীরে শ্যাম, দেহনিরে কিচু?
-দেহি ঝাপসা করম।
ওই ঝাপসা-ইরে শ্যাম, ঝাপসা, দুন্নইডাই ঝাপসা!
মাছ নয় বলে মার্টিনা ক্যাথলিনের ঝাপসা জগৎ দেখার চোখ বুজিয়ে অন্ধকার জগতে যেতে সহযোগিতা করে। না চাইলেও তার ভারী দীর্ঘশ্বাস মরার বাড়িতে লুটোপুটি করে, যে-দীর্ঘশ্বাসের ভার যে-কোনো মানুষের কাঁধে চাপ দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে।
নিউইয়র্ক, এপ্রিল ’৯৬
0 মন্তব্যসমূহ