পূর্বজন্ম
কেরোসিন চুলার লাল-কালো শীষের ওপর ভাতের হাড়িটা মা-ই বসিয়ে দিত। হাড়ি ভর্তি ঘোলাজল। ওতে কী চাল আছে, না ডাল আছে, নাকি মাথামুণ্ডু আছে বোঝা যেত না। আমরা তবুও বারংবার উঁকিঝুঁকি মারতাম। কখন জল ফুটে উঠবে? চাল- ফুটবে, ভাত হবে।
মাকে দেখতাম চুলার আগুন বাড়ানো-কমানো যন্ত্রটা এক্কেবারে ওপরে তুলে দিয়েছে। তবুও জল ফুটছে না! তাহলে চাল ফুটবে কখন? চাল না ফুটলে ভাত হবে কখন? আমাদের এই ব্যাকুল অপেক্ষা আগুন কেন বোঝে না? আর চুলা তো চুলাই। নিষ্প্রাণ বস্তু। তেল ভরলে আগুন জ্বলে। চুলার কি মন আছে? প্রাণ আছে? দেহ যদিও তার আছে, দেহটা তার নিজের কিনা সে বোধ তো চুলার নাই।
জল ফুটে না ওঠা পর্যন্ত আমাদের স্বস্তি হতো না। জলের সঙ্গে দুই-চারটা চাল হাড়ির গলায় উঁকি দিয়েই নিচে তলিয়ে যেত। কেবল জল আর চালের খেলা! চাল ফুটতে শুরু করলে বাড়িময় সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো। কালিজিরা চাল। এই চালের ভাত রাঁধলে দশ বাড়ির পরের মানুষের নাকেও সে ঘ্রাণ পৌঁছাতো। কিন্তু ওই জল আর চালের খেলা অথবা চাল আর জলের নৃত্য আমাদের মোটেই সহ্য হতো না। এই সহ্য না হওয়ার যুক্তি ছিল।
আমাদের পাকস্থলিতে তখন দীর্ঘদিন ভাত পড়ে নাই। আমরা ভুগেছি সান্নিপাতিক জ্বরে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া অথবা কালাজ্বরে। আর খেয়েছি বার্লি। সাগু। দুধ-পাউরুটি। হরলিকস।
বার্লি ভর্তি জামবাটিটা দেখলেই ভেতর থেকে ওয়াক ওয়াক শব্দ উঠতো। ওয়াক বন্ধ করার জন্য বাবা কাগজি লেবুর রস চিপে দিত। কখনো এক চামচ মধু অথবা দুই চামচ চিনি। কিন্তু আমাদের বমির ভাব কমতো না।
বাবাও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। হরলিকস নিয়ে পড়তো। জল বেশি দিয়ে এক চামচ গুললে আমাদের মন উঠতো না। আমরা চাইতাম হাতের চেটোতে শুকনো হরলিকস নিয়ে চেটেপুটে খেতে। বাবা ভয়ে দিত না। শুকনো হরলিকসে জ্বরের সঙ্গে দাস্ত শুরু হয়ে যেত। কিন্তু ওই প্রায় একগ্লাস না-হরিলিকস-জল খেলেই আমাদের পেটের ব্যামো শুরু হতো।
এদিকে সান্নিপাতিক, ম্যালেরিয়া অথবা কালাজ্বর। অন্যদিকে পাতলা ডালের মতো হলুদ পায়খানা।
এতকিছুর ধাক্কায় আমরা শুকিয়ে আমচুর হয়ে যেতাম। আমাদের ধুমধুমা জ্বর, বার্লি, সাগু, কাগজিলেবু, হরলিকস, পাতলা পায়খানা। এইসবের মাঝে বাবাকে খুব হতাশ দেখাতো। বাবা একেবারে বেদিশা বনে যেতো। কলাপাতা কেটে এনে বালিশের ওপর বিছিয়ে বদনার নাল দিয়ে জল ঢালতো। সরু ধারায় জল ঢেলে ঢেলে আমাদের জ্বরের গুষ্টি নিপাত করতে চাইতো। কিন্তু জ্বর ভাগতো না। বাবা একদিন প্রচণ্ড অসহ্য হয়ে রাবার ক্লথ কিনে আনলো। রাত দুপুরে কলাপাতা কাটাকাটি কি চাট্টিখানি কথা! ফলে তখন থেকে আমাদের জ্বর মাথার তলায় কলাপাতার বদলে রাবার ক্লথ! আমরা দিন গুনতাম ৫-১০, ১৫-২০, ২১ – সান্নিপাতিক হলে ২১ দিনের মাথায় জ্বর আমাদের ছেড়ে যেতো। ততদিনে আমরা কঙ্কাল হয়ে উঠেছি। কিন্তু ভাত খাওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে বেঁচে থাকছি।
ডাক্তারের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত বাবা ভাতের কথা মুখে আনতো না। বাবা না বলা পর্যন্ত কেউ-ই আমাদের ভাত খেতে দেবার সাহস করতো না!
জ্বর যেদিন ছাড়তো ওইদিনই যে আমরা ভাত পেতাম তেমনও নয়। জ্বরের-ভাত মহা-আয়োজনে আমাদের খেতে দেওয়া হতো। সরু-সুগদ্ধি-কালোজিরা-চালের জাউভাত। সঙ্গে কাঁচা পেঁপে সিদ্ধ। পাতলা পায়খানা না থাকলে আদার ঝালে শিং বা মাগুরের ঝোল।
ফলে ওই ভাত আমাদের জন্য ছিল অমৃত। জ্বরে ধুকতে ধুকতে আমরা অমৃতের আশায় প্রহর গুণতাম। যদিও ভাতটা মা-ই রাঁধতো। কিন্তু আমরা জানতাম বাবার ভাত। বাবা নির্দেশ না দিলে এই ভাত রাঁধা হতো না। বাবা চাল কিনে না আনলে মায়ের পক্ষে এই ভাত রাঁধা অসম্ভব ছিল। বাবা আমাদের পাশে বসে ভাত খাওয়াতেন। চামচ দিয়ে পাতে ভাত তুলে দিতেন। লবণ-ডলা সেদ্ধ পেঁপে। একেবারে লঙ্কা-তেল-পিঁয়াজ ছাড়া।
সান্নিপাতিক, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরের পর কালিজিরা চালের ভাত দেখে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। আমাদের চোখের পাতা-পাপড়ি-ভেজা দেখে বাবার মন আর্দ্র হয়ে উঠতো। আমরা দেখতাম, বাবা দুই হাতের উল্টা-পিঠে চোখ মুছছেন। বাবা কেন কাঁদছেন? আমাদের রোগ সেরে যাওয়াতে না আমাদের কান্না দেখে, না ওই ভাত খাওয়ার জন্য, ধরতে পারতাম না।
তবে বাবার ভাত খেতে খেতে আমরা আমাদের অসুখে ভোগার দীর্ঘ স্মৃতি বিস্মৃত হতাম!
পরজন্ম
আমাদের কলিজা কাঁপিয়ে দিয়ে এখনো জ্বর আসে। পৃথিবীতে এখনো রয়েছে সান্নিপাতিক। রয়েছে কালাজ্বর। ভাইরাল ফিভার আর ডেংগুজ্বরের নতুন আমদানী হয়েছে। ডেংগু মারাত্মক জ্বর! সময় মতো ধরা না পড়লে আমরা মারাও যাই। স্বচ্ছ-জমা জলে এডিস মশার থেকে এই জ্বরের জীবাণু ছড়ায়।
ছাদের কোনায়, টিনের চালে কোথাও জল জমা রাখা যাবে না। টবেও না। পুরানা কোনো পাত্রও জল জমা রাখা যাবে না। সব জল ঢেলে ফেল। এত এত জল আমরা ঢেলে ফেলি তবুও জ্বর আমাদের ছেড়ে যায় না। হাজার হাজার ধানের জালার মতো জ্বর মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। অথবা আসমানের মেঘ থেকে অবিশ্রাম বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। আমরা জ্বরকে তাড়াতে পারি না। লিটার কে লিটার জল পান করি। জল খরচা করে ওয়াসাকে জল সঙ্কটে ফেলে দেই। কিন্তু আমাদের জ্বরের উপশম হয় না। তীব্র জ্বরে আমাদের দেহ জলন্ত উনুনের মতো হয়ে থাকে। উত্তাপের তীব্রতায় আমরা পাগল পাগল হয়ে উঠি। আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে না। আমাদের পাশে আমাদের স্বামীরা থাকে। স্ত্রীরা থাকে। সন্তানেরা থাকে। তারা সবসময় নানান কাজ-বাজে বিজি থাকে। টিভি সিরিয়াল, ইন্টারনেট, শপিং, এরোবিকস কত কি যে কাজ তাদের!
তারা ভুল করেও একটা কলাপাতা কেটে আনে না। রাবার ক্লথ দূরে থাক। আমাদের মাথায় কেউ বদনার নাল দিয়ে জল ঢালে না। আমরা বেহুশির মধ্যেই বাথরুমে গিয়ে নিজের মাথা নিজেই কলের তলায় পেতে রাখি। বালি বা সাগুদানা, কাগজিলেবু, হরিলিকস- এইসব তো বহুদূর।
আমাদের বিছানায় শোয়া দেখে কেউ কেউ দুই একবার ঘুরে যায়। বলে-
‘সিটামল খাও।’
‘নাপা খাও।’
‘প্যারাসিটামল খাও।’
‘ফাস্ট খাও।’
আমরা সব-ই খাই। আমাদের সন্তানেরা কখনো হয়তো ভুল করে কপালে হাত রাখে। পরক্ষণেই গেমস খেলতে চলে যায়। আমাদের স্বামীরা বা স্ত্রীরা টিভি সিরিয়াল, ইন্টারনেট, ব্লুফিল্ম, ব্যায়ামাগার, পরকীয়া প্রেম, রূপচর্চা ইত্যাদি নিয়ে বিজি থাকে। এদিকে প্রচণ্ড জ্বর আমাদের হাড়-মজ্জার ভেতরে ঢুকে পড়ে!
জ্বরের ঘোরে আমরা রাতভর হাঁটাহাঁটি করি। ডাইনিংয়ে যাই। ফ্রিজ খুলি আর এক গ্লাস করে পানি খাই। তেষ্টা পেলে ফের যাই। ফের ফ্রিজ খুলি। ফের পানি খাই। জ্বরে বেহুশ অবস্থায় বিছানা আর ফ্রিজ করি। ফ্রিজ আর বিছানা করি। জ্বরগ্রস্ত বলে আমাদের স্মরণ হয় না- এক বোতল পানি শোবার ঘরে এনে রাখলেই হয়। তাহলে তো এই ফ্রিজ-বিছানা করতে হয় না। জ্বরাক্রান্ত বলে আমরা এমন পাগলামি করি। কিন্তু আমাদের পরিবারের কেউই একবোতল পানিও হাতের কাছে এনে রাখে না!
সন্তানেরা, স্বামীরা, স্ত্রীরা ঘুরে যায় আর বলে-
‘কি খাইবা?’
‘ভাত খাও?’
‘রুটি খাও?’
‘বার্গার খাও?’
‘পরোটা কাবাব খাও।’
‘চা খাও।’
‘বেশি বেশি পানি খাও।’
আমরা সব খাই। তবুও জ্বর আমাদের নিস্তার দেয় না। আমরা জ্বর-জীবনের ভেতর দিয়েই হেঁটে যাই। হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের ক্লান্ত, শ্রান্ত, অসুস্থ করে ফেলি! যানজট, টিভি, ইন্টারনেট, থ্রি-এক্স, খাদ্যদ্রবের মূল্যবৃদ্ধি, রাজনীতি, সাহিত্য, লোডশেডিং, পানির ক্রাইসিস, পরকীয়া, অবক্ষয়, খুন, জখম, মিথ্যাচার, দলাদলি, ঈর্ষা, হিংসা এসবের ভেতর আমাদের জ্বর বেশ পাকাপোক্ত ভাবে গেড়ে বসে! আমরা কোনো প্রতিকারই করতে পারি না!
আমরা অথবা আমি এখনো একটা সবুজ কলাপাতার আশা করি! বাবা আমার জ্বরাক্রান্ত মাথাটা সেই পাতার ওপর বিছিয়ে দেবে। বদনার নাল দিয়ে ঠাণ্ডা জল ঢালবে। অবিশ্রাম জল পতনে সমস্ত জ্বর জমা হবে বালতিতে।
জ্বরগ্রস্ত কোনো দিন বা রাতে আমি হাওয়ায় ভেসে আসা সুগন্ধে চমকে উঠি! কালিজিরা চালের ভাত রাঁধার গন্ধ। এই কট্টর নগর জীবনে এখনো কে রাঁধে অমন ভাত! আমার বাবার ভাত!
ওই ভাতের গন্ধ ভেসে আসা মাত্রই আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। যানবাহন ঠেসে থাকা ভয়ানক বিজি রাস্তা ধরে দৌড়াতে ইচ্ছা করে। মানুষের ভিড়-ভাট্টায় মিশে যেতে যেতে গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছা করে-
‘সান্নিপাতির জ্বরটা আজই সারলো বাবা। বাবা তুমি কোথায়? মাটির নিচে কী ঘুমেই তুমি মগ্ন! একবারও কি আসতে পারো না? একবার আসো তো বাবা। মাত্র একবার। একটা সবুজ-রঙা-কচি-কলাপাতা কেটে নিয়ে আসো। আর এক থালা ভাত। কালিজিরা চালের জাউ-জাউ ভাত। বাবা আমি তোমার হাতের ভাত খেতে চাই!’
1 মন্তব্যসমূহ
চোখ ভিজে গেল
উত্তরমুছুন